অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মানস চৌধুরী -
মাসুদ রানা জনপ্রিয় যে কারণে
মাসুদ রানা’র জনপ্রিয়তার কারণ: কতিপয় চিন্তাসূত্র

মাসুদ রানার কি গোঁফ ছিল? মাসুদ রানার পাঠক হিসেবে আমার যোগ্যতা এতো কম যে মনে করে বলতে পারবো না যে তাঁর গোঁফ কখনও আনোয়ার সাহেব (বা তাঁর ভূতলেখকবৃন্দ) বানিয়েছিলেন কিনা। তবে এসবে সোহেল রানার সামান্যই ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে। তিনি যখন প্রযোজক মাসুদ পারভেজ হিসেবে নিজেকে ‘মাসুদ রানা’ ছায়াছবির নায়ক নিয়োজিত করলেন, তখন নিজের প্রাকৃতিক গোঁফ হঠানোর কোনো কারণ খুঁজে পাননি। এটা ঠিকই, তাঁর চুল হঠানোর তুলনায় গোঁফ হঠানো অধিক কসরৎ ও মনোবেদনার কারণ হতে পারতো।

বাস্তবে তিনি পর্দা-উপস্থিতিতে কখনোই দুটোর কোনোটাকেই অনুপস্থিত করেননি। পর্দায় একমাত্র ‘মাসুদ রানা’ সোহেল রানার গোঁফের উপর ভর করেই হাজির হলেন। তখনও বাংলাদেশের আম-মানুষজন গোঁফওয়ালা জাতীয় নেতা হিসেবে কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই চেনেন; জিয়াউর রহমানকে চিনে সারেননি। তবে কেবল গোঁফের কারণে মাসুদ রানার কোনোভাবে নিন্দিত হতে হয়েছে বলে শোনা যায়নি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের যতটুকু দর্শকতৃপ্তির ইতিহাস জানা যায় তাতে নিজের গোঁফ ও নাইলনের চুলসমেত সোহেল রানাই মাসুদ রানার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পর্দা দাবিদার বলে বিবেচিত হয়েছেন।

মাসুদ রানাকে নিয়ে কিছু বলতে শুরু করার পর লোকে যদি জিজ্ঞাসা করে বসেন যে ‘কয়টা পড়ছো বই’, তাহলে খুবই বিপদে পড়ে যাবো। জানামতে, মাসুদ রানার খণ্ড শ’ চারেকের কাছে। আর স্মৃতিমতে, আমার আস্ত পড়া কেবল ‘পিশাচ দ্বীপ’। সেটা কেনো ও কীভাবে বাসাতে পেয়েছিলাম তা ধারণা নাই। তবে আমার মামাদের দুজনের একজন সংগ্রাহক হতে পারেন। এর বাইরে আমি নিজে নিয়মিত লাইব্রেরিতে যাতায়াত শুরু করলে মাসুদ রানার বিপুল সম্ভার আমাকে কখনও টানে নাই। কুয়াশা বা দস্যু বনহুর-ও দু-চারটা খণ্ড পড়েছি, মাসুদ রানা একেবারেই নয়। সামনে পড়ে আছে, খুলে দুপাতা পড়লাম- এরকম কিছু পরিস্থিতি বাদে। একেকবার মনে হয়, আমার শুচিতাবাদী মনের কারণে। কিন্তু ভেবেচিন্তে সেই অনুসিদ্ধান্ত বাদ দিতেই হয়। কারণ অশুচিতাবাদী যৌনতার অনেক সাহিত্যই আমি পড়েছি। চূড়ান্ত বিচারে হয়তো চুপচাপ তীক্ষ্ণ শার্লক হোমসের প্রতি আমার অনুরাগ,সাঁই সাঁই ধরনের মাসুদ রানার প্রতি বিরাগের কারণ হয়ে থাকবে।

গোয়েন্দা বনাম স্পাই
বাংলা সাহিত্যের (আধুনিক) ইতিহাসে গোয়েন্দা অনেক। অপেক্ষাকৃত পরিচিতরা হলেন কিরীটী রায়, ব্যোমকেশ বকশী, ফেলুদা। ঘনাদা বা স্বপন কুমার সম্ভবত ঠিক একই বর্গে পড়বেন না। কিন্তু গোয়েন্দারা গুপ্তচর নন। বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দারা কমবেশি শার্লক হোমসের বিদ্যাবুদ্ধির প্রচ্ছায়াতে গড়ে উঠেছেন। তাতে কেউ ধুতি পরতে পারেন, কেউ চুরুট খেতে পারেন, কেউ শাল গায়ে চড়াতে পারেন, কেউ সনাতনি বাংলায় দীর্ঘ কেইস-বিবরণী সবাইকে গোল করে বসিয়ে দিতে পারেন, আরেকজন ইংরাজি সঙ্গীতমুগ্ধ থাকতে পারেন। এরকম নানান ভিন্নতা সত্ত্বেও এঁরা সকলেই গোয়েন্দা, কিংবা ব্যোমকেশের ভাষায় সত্যান্বেষী। এসব ভিন্নতা সত্ত্বেও এঁরা শার্লকের উত্তরসূরী। ওদিকে গোয়েন্দা আর গুপ্তচরেই কেবল মামলা ফিনিশ হয়ে যাচ্ছে না। আরও আছে এডভাঞ্চারাস কম্যুনিস্টসম ঝোড়ো চরিত্র। যেমন কিনা দস্যু বনহুর। দস্যু বনহুরকে মেলাতে হলে মেলাতে হবে রবিনহুডের সাথে। তুলনায় কুয়াশা বরাবরই কুয়াশাচ্ছন্ন। তবে যদি বলতেই হয়, মাসুদ রানার থেকে কুয়াশা অনেক বেশি গোয়েন্দা। মাসুদ রানা বরাবরই স্পাই, শুরু থেকেই। কুয়াশা খানিকটা আলাদীনের দৈত্যের মতো ভোজভাজি করে ফেলতে পারেন।

তাহলে দুই বাংলার মেলা মেলা গোয়েন্দা থাকলেও গুপ্তচর বা স্পাই আসলে ভালোমতো কেবল মাসুদ রানাই। যদি গোয়েন্দাদের দল বিকশিত হয়ে থাকেন শার্লকের বুদ্ধিরূপের উপর দাঁড়িয়ে, তাহলে আমাদের স্পাই মাসুদ রানা দাঁড়িয়েছেন আরেক জগদ্বিখ্যাত স্পাই জেমস বন্ডের উপর দাঁড়িয়ে। এগুলো সাধারণ জানাশোনাই সকলের। তবে অতি সম্প্রতি জানতে পারলাম, পশ্চিম বাংলায় মাসুদ রানা ততটা তেমন জনপ্রিয় হন নাই কখনও। জানতাম আসলে। তবে তথ্যটাতে অত গুরুত্ব দিই নাই কখনও। কিন্তু এ দফা জানার পর দুইটা বিষয় মনে হলো। একটা চিরপরিচিত। বাংলাদেশের কোনো পুস্তকই বা ইন্ডিয়ার বাংলাভাষিরা যত্ন করে গ্রহণ করেছেন। আর দ্বিতীয়টা নীতিসঙ্গত (বা রাজনীতিসঙ্গত) বিষয়। কেনো বা কীভাবে ভারতের নাগরিকেরা, হোন বাঙালি, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একজন কুঁদে-বেড়ানো সামরিক কর্মকর্তার জৌলুস গ্রহণ করবেন।

পর্দায় ধাঁই-ধাঁই স্পাই
যার মনে যাই থাকুক, সোজা-সরল সত্য হলো বাংলাদেশে জেমস বন্ডের মুখ্য কনজাম্পশন হয়েছে পর্দায়, বইতে নয়। যে সময়ের কথা হচ্ছে তখন বাংলাদেশে হাজারের উপরে প্রেক্ষাগৃহ ছিল। সঠিক হিসাব দেবার জন্য বাংলাদেশে মহাফেজখানার হাল আরও ভালো হতে হতো। তবে সেইসব হাজার প্রেক্ষাগৃহের অনেকগুলোতেই ইংরেজি ছবি প্রদর্শিত হতো। কোনো হলই কেবল ইংরেজির জন্য তালিকাভুক্ত ছিল না। কিন্তু কিছু প্রেক্ষাগৃহে ইংরাজি অপেক্ষাকৃত বেশি হারে দেখানো হতো। এছাড়া মফস্বলের হলগুলোতে প্রায়শই ছুটির দিনের আগের দিন, প্রথমে শনিবার, পরে বৃহস্পতিবার, এক টিকেটে দুই ছবির এক ধরনের চর্চা ছিল। ছুটির আগের দিনে মুক্তি পাক আর না পাক, ছুটির দিনটাতে তা চলতোই। হংকং কিংবা হলিউডের নরম-পর্নোগ্রাফিগুলো এই কাতারে থাকতো। এসব ছবির দর্শকেরা ‘যেন বা লুকিয়ে’ দেখে আসতেন।

কিন্তু, জেমস বন্ড এই লুকোছাপা চরিত্রের ছিলেন না। তা তিনি যতই প্রেমঘন দৃশ্যে হাজির হোন না কেনো। কথিত আছে যে, জেমস বন্ড বা অন্যান্য ইংরেজি ছবির প্রণয়দৃশ্যগুলো সেন্সর বোর্ড ঠিকঠাক মতো কেটে দিতেন। তবে ‘এক টিকেটে দুই ছবি’র ওই নরম-পর্নোগুলোর বেলায় সেন্সর বোর্ডের কর্তারা কী করতেন তা জানা যায় না। জেমস বন্ড বলতে বাংলাদেশে, যদি ঠিক মনে পড়ে, শ্যেন কনোরি আর রজার ম্যুর বিরাজ করতে পেরেছিলেন। মানে সেলুলয়েড জমানার কথা হচ্ছে, সাম্প্রতিক ডিজিটাল ড্যানিয়েল ক্রেইগ নয়।

জেমস বন্ড চিরকালই পিটাপিটি করেন। করতেই হয়। মাসুদ রানাও অনেক পিটাই করে থাকেন। তবে শেষের দিকের বন্ড, প্রযুক্তির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বহু হাইটেক পিটাই করে থাকেন। শেষেরটাতে তো দেখলাম বন্ড প্রায় সংসারই পেতে বসেছেন। ‘নো টাইম টু ডাই’ দেখার পর সহদর্শকদের বললাম যে ‘অপুর সংসার’-এর আদলে ছায়াছবিটার নাম ‘জেমসের সংসার’ বা ‘বন্ডের বন্ধন’ হতে পারতো। এদিক থেকে মাসুদ রানা গুরুতরভাবে অগ্রসর বিবাহ নিরপেক্ষ মানুষ। ৪০০ খণ্ডেও তিনি খণ্ডীকৃত হয়ে বিবাহ এবং বান্ধাপ্রণয়ে বান্ধা পড়েননি। বাস্তবে সিনেমার পর্দায় যে স্পাইকে ধাঁই-ধাঁই বহু লোকে দেখে উঠে সারেননি, তাঁরাই পাতায় পাতায় শব্দে-শব্দে মনশ্চক্ষে দেখেছেন সেই স্পাইকেই, মাসুদ রানার মাধ্যমে। ‘দেশে’র জন্য নিবেদিত প্রাণ এক উর্দিহীন মিলিটারি!

নেতাদের প্রতিকৃতি বা আইকন
জাতীয় নেতা বলতে যদি রাজনীতি-জাতীয় নেতা বোঝাই তাহলে নিশ্চয়ই কোনো অন্যায্য কাজ হয় না। এখন শেরে বাংলা বা ভাসানীর যেসব ছবি প্রতিকৃতি সম্প্রচার করা হয়, কিংবা তাঁদের বিষয়ে যেসব বাণীমালা ভেসে বেড়ায় পাঠ্যপুস্তকে বা রাজনীতি-আলাপে, তাতে তাঁদেরকে ‘সিনেমাটিক হিরো’ হিসাবে গ্রহণ করা খুবই কঠিন। সিরাজ শিকদার হয়তো হতে পারতেন। তাঁকে নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্প্রচার নাই বললেই চলে। চললেও তিনি অধিকতর দস্যু বনহুর ধাঁচের হতেন, অবশ্যই কম মাসুদ রানা ধাঁচের। রইলেন বাকি তিনজন।

কিন্তু মাসুদ রানার জব ডেস্ক্রিপশনের দুইটা অন্তত আমাদের বিবেচনায় রাখা দরকার। তার মধ্যে মিলিটারিত্বই খোদ যথেষ্ট কারণ বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রশাসকের সাথে মাসুদ রানার কিছুমাত্র বনিবনা না হবার। আর থাকে (হেটারোসেক্সুয়াল) প্রণয়োদ্ভাস। দিকে দিকে, ক্ষণে ক্ষণে, এমনকি জনে জনে। মাসুদ রানার ব্যক্তিত্বের সব থেকে আকর্ষণীয় অংশই এটা, আমার জন্য বলছি। এটাকে হিসাব মানলে স্বাধীন বাংলাদেশে নেতাদের মধ্যে এরশাদের থেকে বড়ো দাবিদার কেউই থাকেন না। কিন্তু এরশাদ দুর্ভাগাও বটে। তিনি মানসপটে এসে হাজির হবার বহু আগেই মাসুদ রানা প্রতিষ্ঠিত এমনকি বিদারিত (স্যাটুরেইটেড)। তাছাড়া, কোনো এক রহস্যজনক কারণে এরশাদ একজন ড্যাশিং হিরো হিসাবে আবির্ভূত হতেই পারেন নাই- স্ট্যাটিসটিকস, এইসথেটিক্স এবং পোয়েটিক্স যতোই তাঁর পক্ষে থাকুক না কেনো।

তাহলে জিয়াই ছিলেন মাসুদ রানার সব চেয়ে নিকটজন। মিলিটারি হিসেবে তো বটেই, তুখোড় বুদ্ধিমান হিসেবে; সর্বোপরি ‘হিরো’র প্রতিকৃতি বা আইকন হিসেবে। মাসুদ রানা ছেঁড়া গেঞ্জি না পরতে পারেন, খালও না কাটতে পারেন, কিন্তু মনশ্চক্ষে যদি কোনো রাষ্ট্রনায়ককে ‘যেনো বা মাসুদ রানা’ ভাবতে চান, তাহলে অনায়াসে জিয়াকেই ভাবতে পারা ঠিক হবে। এতে জিয়ার নিজস্ব গোঁফ যদি মনশ্চক্ষে অশান্তি উৎপাদন করে, কাজী আনোয়ার হোসেনকে গোঁফওলা মাসুদ রানা পয়দা করতে বলা যেতে পারতো। তাছাড়া, জিয়া ময়দানে আসার আগেই, যেমনটা বললাম, সোহেল রানা নিজের গোঁফ মাসুদ রানাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। ছবিটাকে ঠিক ফ্লপও বলা যাবে না, রীতিমতো হিটই ছিল জানা যায়। যদিও এই ছবির দর্শকসংখ্যা আর মাসুদ রানার পাঠকসংখ্যার মধ্যে কোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন তুলনা সম্ভব নয়।

রুচিবান-শুচিবান যাঁরা
বাংলার সাহিত্য-গোয়েন্দাগণ সকলেই অতিশয় রুচিবান। এমনকি শুচিবান; অতিশয় শুচিবান। তাঁদের শুচির মাত্রা এতোটাই যে পাঠকদের পক্ষে তাঁদের অযৌন কল্পনা করা অত্যন্ত বিবেচনাপ্রসূত হবে। এঁদের মধ্যে কার থেকে কার রুচি বেশি,বা কার শুচি শক্ত তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ এঁদের কস্ট্যুম,কাল,সঙ্গীতরুচি বেশ স্বতন্ত্র পরস্পরের থেকে। তবে ফেলুদা অপেক্ষাকৃত নবীন ও পাশ্চাত্যনিষ্ঠ হবার কারণে তিনি অধিক সম্ভাবনাময় ছিলেন শুচিগিরি ছাড়তে। এর মানে এই নয় যে, আমি পাশ্চাত্যিয় রুচিকে অশুচি বলছি। তা তো বলছিই না, উপরন্তু যৌনতাকে শুচি বা অশুচিতা দিয়ে আমি নিজে বোঝারও আগ্রহ বোধ করি না।

আমার বক্তব্য এই যে, গড়ে পাশ্চাত্যের যে ইমেজ পাঠক-মনোজগতে বিরাজ করতে থাকে আর যৌনতা যেরকম অশুচিময় কাঠামোতে বন্দি, তাতে ফেলুদা অপেক্ষাকৃত যৌনমনস্ক থাকতে পারতেন; ও সেই সুবাদে ‘অশুচি’। কিন্তু তিনি এমনকি তাঁর স্রষ্টা সত্যজিতের থেকেও কঠোর ব্রহ্মচর্য অনুশীলন করে গেছেন। ‘সচ্চরিত্র’ চরিত্র সৃষ্টিতে বাংলা অঞ্চলের লেখকেরা দুর্দান্ত অবদান রেখে গেছেন। সমরেশ বসুর জন্ম না হলে উত্তরকালের নায়ক-নায়িকাদের হয়তো চৈতন্যদেবের মতো গলায় উত্তরীয় দিয়ে নদীয়া অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে হতো।

যাহোক, মাসুদ রানাকে নিয়ে বলতে গিয়ে এতো লোকের কথা চলে এসেছে। মাসুদ রানা এই নিখিল বঙ্গীয় অযৌন পুরুষ এডভাঞ্চারাস ‘হিরো’দের ব্রহ্মচর্য থেকে ঐতিহাসিক মুক্তি এনে দিয়েছেন। তাতে পূর্বসূরী গোয়েন্দাদের মন ভালো হয়েছে কিনা জানার কোনো সুযোগ নাই। তবে ওটিটি একটা ছায়াছবিতে কিরীটী রায়কে একজন বান্ধবী সহযোগে সম্প্রতি দেখা গেলো। মোবাইল ফোন আর বান্ধবী এই দুইটা সংযোজন ঘটেছে।

অভিনয় ও চিত্রনির্মাণ নিয়ে আজকে আলাপ না করাই উত্তম, আসলে কখনোই আলোচনা না করা ভালো। মাসুদ রানা যে তাঁর পূর্বতন ভার্চুয়াস/সচ্চরিত্র নায়কদের থেকে সরতে পারলেন এই যোগ্যতার কারণে তিনি পাঠকদের, বিশেষত পুরুষ পাঠকদের, কাছে অনেক গ্রহণযোগ্য হতে পেরেছিলেন। আর প্রণয়কালে তাঁকে ঠিক মিলিটারির সামাজিক ইমেজসুলভ লাগেও না। চলতি ভাষায় যাকে রোমান্টিক বলা হয়ে থাকে, সেই যোগ্যতাই বরং তিনি বহন করে চলেছিলেন।

তদুপরি আমেরিকানিজম ও ইয়্যুথ
উর্দিহীন হলেও মাসুদ রানা মিলিটারি। তিনি কখনোই মিলিটারিগিরির বাইরে থাকতেন না। সোহানা প্রমুখের সাথে একটু আরাম-আয়েশ করার সময়েও তাঁর মাথা থাকত কিলবিল ইন্টেলিজেন্সের মাথা। অবশ্যই মাসুদ রানার জাতীয়তা বদলাতে হয়েছে। তিনি পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্সের কর্মকর্তা ছিলেন, পরে বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগের চর হলেন। এই জাতীয়তা বদলের বিষয়ে তাঁর নিজের কিছুই করার ছিল না। কারণ, তিনি রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর চাকুরিজীবী ছিলেন। এখন রাষ্ট্র বদলে গেলে তিনি কী করতে পারেন! কিন্তু ভাবুন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর যতো বুদ্ধিমান কর্মকর্তাই হোন না কেন, যিনি ধরাধামে আবির্ভূত হন ১৯৬৬ সালে, তখন কি তাঁর জন্য ঢাকা খুব আরামদায়ক জায়গা? নিখিল বাংলাদেশ কোনো আরামদায়ক জায়গা?

আবার কাজী আনোয়ার হোসেন যতোই দেশপ্রেমিক হোন না কেনো, মাসুদ রানার কারিগর হিসেবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এক কর্মচারীকে তিনি তো আর ছয় দফা আন্দোলনের সৈনিক বানাতে পারেন না। সেটা বানাতে হলে তাঁর দস্যু বনহুর কিসিমের কিছু লিখতে হতো। ফলে দুর্দান্ত ক্ষিপ্র সেমিবন্ড দেশিবন্ড জন্মাবধি বাংলা পাঠকের ‘জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন’তে (বা মতান্তরে জাতীয়তাবাদী স্বপ্নতে) এক বেখাপ্পা ‘হিরো’ হিসেবে থাকার কথা। বিচিত্র নয় যে, তিনি আরও আরও জনপ্রিয় হলেন ১৯৭৫-এর পরবর্তী বাংলাদেশে।

এখন কেউ যদি আমাকে প্রমাণ করতে বলেন, আমি হাত-পা ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করব। কোনো জনপ্রিয়তার মাপনযন্ত্র আমার কাছে নাই; বাংলাদেশে নাই মহাফেজখানার কোনো চর্চা। কিন্তু এটা অনুভব করার জন্য এমনকি আমার ১৯৭৫ সালে গুরুতর বয়স্ক লোকও হতে হয় নাই। বস্তুত এটা আমার ১৯৭৫ সালের আবিষ্কার নয়। পরেরই। পঁচাত্তর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের নাগরিকমনস্কতার (সামরিকমনস্কতার) গুরুতর সব বদল ঘটতে থাকে। এটা ভোজভাজির মতো এক রাত্রিতেই হয়নি তা সত্য। কিন্তু মার্কিনীবাদ বা আমেরিকানিজমের পদ্ধতিগতভাবে বাংলাদেশে বিকশিত হয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে, সর্বমোট ৬ বছরও ক্ষমতায় ছিলেন না। বস্তুত তিনি চার বছরই ছিলেন। কিন্তু সেই সময়টাতে মার্কিনবাদিতা একটা স্বপ্নবলয়ের মতো রচিত হতে থাকে, বিকশিত হতে থাকে।

সর্বোপরি, জনমানসে প্রোথিত হতে থাকে। এর অবধারিত অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে নতুন কল্পিত এক যৌবন/ইয়্যুথ, যার অবধারিত অনুষঙ্গ পৌরুষ। তাহলে পৌরুষদীপ্ত এক তারুণ্যময়তা দিয়ে মার্কিনী জীবনযাপনের অধিকল্পনা (ফ্যান্টাসি) এই সময়কালের মনোজগত বুঝতে খুবই জরুরি। অন্তত আমার প্রস্তাব সেটাই। মাসুদ রানা সেখানে অধিকল্পনার মূর্ত অধীশ্বর হিসেবে পুনর্জাগরিত হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের কোনো গোয়েন্দাই ‘দেশমাতা’র সেবক হিসেবে বিকশিত নন। তাঁরা মাইক্রো-ইভেন্টের ‘হিরো’; মাসুদ রানা ম্যাক্রো ইভেন্টের। ঠিক এই সময়কালটাতেই যে সারা বাংলাদেশের চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত তাঁদের (পুরুষ) বাচ্চাদের সেনা অফিসার বানানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন সেই বাস্তবতাটাকে এর সাথে মিলিয়ে পাঠ করা যায়। যায় তো বটেই! কিন্তু আজকেই তা করে ফেলতে হবে তা তো নয়। আজকে উর্দিহীন মাসুদ রানাতেই শেষ করি আমরা! উর্দিহীন, তথাপি মিলিটারি, তথাপি রাষ্ট্রের পতাকাবাহী, কাঁধে করে নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। মাসুদ রানার দেশাত্মবোধ তাই সামরিক-সীলমোহরসম্পন্ন রাষ্ট্রচৈতন্য।

(০২,০২.২০২২।। আদাবর, ঢাকা। ১২:৩৩ এএম)
(নিউজ বাংলা ২৪। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ প্রকাশিত [বিভাগীয় সম্পাদক: শিবব্রত বর্মণ])
https://www.newsbangla24.com/column/179227/That-is-why-Masood-Rana-is-popular

+ posts

Read Previous

তৃতীয় প্রণয়

Read Next

Melt Down – Three Mile Island

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *