আন্তন চেখভের ছোটগল্প পর্যালোচনায় প্রথমেই যে-বিষয়টি বিবেচ্য তা হচ্ছে গল্পের প্লট। চেখভের সেরা গল্পগুলো পড়লে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিনি খুব সাধারণ বিষয়কে উপজীব্য করে গল্পের প্লট নির্মাণ করেছেন। কিন্তু তাঁর অসাধারণ বয়ান-কৌশলের কারণে সাধারণ প্লটের গল্পও অসাধারণ হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক পরিসরে খ্যাতনামা অনেক গল্পকারই সমাজের উপরিকাঠামোর অন্তরালে বিরাজমান অন্যায়, বৈষম্য কিংবা ক্লেদকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ করে সরাসরি অথবা রূপকের আশ্রয় নিয়ে গল্পের প্লট সাজিয়েছেন। চেখভ তা করেননি। তাঁর গল্পের প্লট সাদামাটা, অনেকটাই ক্লাইমেক্সবিহীন; তেমন কোনো টুইস্টও পরিদৃষ্ট হয় না। তবে বয়ান-কৌশলের মুনশিয়ানায় তাঁর গল্পের প্রতিটি চরিত্র এতটাই জীবন্ত হয়ে ওঠে যে পাঠক নিজের অজ্ঞাতে চলে যান এমন এক রাজ্যে, যেখানে তাঁর মনে হবে পুরো আখ্যানই বাস্তবতার অনন্য এক বয়ান।
প্রসঙ্গক্রমে ব্যাপক আলোচিত ছোটগল্পকার ‘মপসাঁ’ গল্পের মডেলটি স্মর্তব্য। এ-কথা উল্লেখ করতে অত্যুক্তি নেই যে, বাংলা ভাষায় ছোটগল্পকে সর্বাধিক জনপ্রিয় করে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের অনেক ছোটগল্পও শেষ হয়েছে ক্লাইমেক্স দিয়ে। কিন্তু চেখভের গল্পশেষে তেমন কোনো ক্লাইমেক্সের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তবে তাঁর কিছু গল্পের সমাপ্তি ঘটেছে অন্যতম চরিত্রের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, যা পাঠক ততক্ষণ অনুধাবণ করতে পারেননি, যতক্ষণ না গল্প শেষ হয়েছে। এটিও চেখভের গল্পের স্বতন্ত্র এক রীতি। তাঁর গল্পের বয়ানকৌশল এমনই যে, সাধারণ ঘটনা হয়ে ওঠে অসাধারণ, সাধারণ চরিত্র হয়ে ওঠে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, চরিত্রগুলো যেন জীবন্ত, সেখানে লেখকের কল্পনাশক্তির কোনো ছাপ নেই; বরং এ-যেন বাস্তব ঘটনার শৈল্পিক বিবরণ বরং এমনটাই ঘটে থাকে। লেখক ব্যক্তির চরিত্র চিত্রায়ণে কল্পনাকে বাস্তবতার রঙে রাঙিয়ে অনন্য-সাধারণভাবে পাঠকের নিকটে উপস্থাপন করেছেন।
চেখভের গল্পে অনন্য এক বৈশিষ্ট্য ‘বয়ান’। তাঁর প্রতিটি গল্পে কখনও মানুষের অবয়ব, কখনও-বা পরিবেশ-প্রকৃতি এমনভাবে বিবৃত হয়েছে, যা তাঁর গল্পগুলোকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছে। তাঁর বিখ্যাত ‘আরিয়াদনে’ গল্পে অন্যতম মুখ্য নারী-চরিত্র আরিয়াদনে সম্পর্কে তাঁর বয়ান যে-কোনো পাঠকের মানসপটে ভেসে উঠবে কোনো রুশ সুন্দরীর কাল্পনিক অবয়ব। আরিয়াদনে সম্পর্কে চেখভের বয়ান পাঠককে কল্পনা থেকে যেন বাস্তবের কাছেই নিয়ে যায়— ‘প্রথম আলাপ হওয়ার পর যা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করল, তা হল ওর অদ্ভুত নামটা— আরিয়াদনে। নামটা অবশ্য ওর চরিত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। একরাশ ঘন কালো চুল, ছিপছিপে তন্বী দেহ, তারুণ্যে ভরা টলমলে মুখ, স্বচ্ছ উদ্ভাসিত টানা টানা দীঘল দুটো চোখ। সব মিলিয়ে এক কথায় বলা যায়— পাগল-করা এমন মোহিনী রূপ যে প্রথম দিনেই আমি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম, না পড়ে কোনো উপায়ও ছিল না। আজও স্পষ্ট মনে আছে— চোখে চোখ পড়তেই আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল, সমস্ত সত্তা উজাড় করে স্রষ্টা ওকে নিপুণ ভাস্কর্যে গড়ে তুলেছেন। ওর কণ্ঠস্বর, ওর হাসি, ওর কথাবলার প্রতিটি ভঙ্গি, এমনকি নদীর বালুতটে ওর পায়ের চিহ্নও আমাকে বিপুল আনন্দে ভরিয়ে তুলত। আর আমি ওর দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে জীবন-তৃষ্ণার কানায় কানায় ভরে উঠতাম। ওর সবকিছুই ছিল এমন উচ্ছল আর কাব্যিক যে ওর ত্রুটির মধ্যেও সবাই খুঁজে পেত এক দুর্লভ ছন্দের আভাস। ফলে সবার কাছেই ও ছিল দেবী কিংবা রোমান কোনো সম্রাজ্ঞীর মতো অপ্সরীতুল্য নারী।” কিংবা রিয়াভস্কি সম্পর্কে স্বল্প কথায় যে বয়ান করেছেন তা যেন পাঠকের মানসচক্ষে ভেসে ওঠে কোনও রুশ তন্বী-তরুণী। শিল্পী রিয়াবভস্কি বললেন, ‘রেশমের মতো সোনালি চুল আর বিয়ের পোশাকে ওলগা ইভানভ্নাকে দেখাচ্ছে বসন্তের সাদা ফুলে ফুলে ছাওয়া একটা তন্বী চেরিগাছের মতো।’
একই গল্পে পরিবেশ-প্রকৃতি বয়ান করেছেন অপূর্ব ভঙ্গিতে যা এমনই শৈল্পিক যেন পাঠক কল্পনায় চলে যাবে বর্ণিত স্থানে। তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘প্রজাপতি’ গল্পে ইভানভ্না তার বন্ধু রিয়াবভস্কির সাথে স্টিমারে করে বিখ্যাত রুশ নদী ভলগা হয়ে মস্কোতে যাচ্ছে। চেখভ সেই ভ্রমণের সামাজিক, মনোস্তাত্ত্বিক ও দেহজ প্রেমের আখ্যান বয়ান করেছেন তা অনতিক্রম্য। তিনি লিখেছেন, জুলাই-এর এক নিথর চাঁদনি রাত। ভলগার বুকে স্টিমারের পাটাতনে দাঁড়িয়ে ওলগা ইভানভ্না কখনও জল কখনও অপূর্ব তটরেখার দিকে তাকিয়ে আছে। পাশে রিয়াবভস্কি দাঁড়িয়ে বলে চলেছে, ‘ওই- যে জলের উপর কালো ছায়া, ছায়া নয় যেন স্বপ্ন… এই-যে ঝকঝকে রহস্যময় নদীর জলধারা, সীমাহীন আকাশ আর বিষণ্ন তটরেখা, এরা যেন আমাদের জীবনের তুচ্ছতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়, মনে করিয়ে দেয় এসবেরও ঊর্ধ্বে এমন কিছু আছে যা শ্বাশত, আনন্দময়। এমন একটা মুহূর্তে ইচ্ছে করে সব কিছু ভুলে যাই, মনে হয়, আসুক মৃত্যু, তবুও তলিয়ে যাই বিস্মৃতির অতলে। মনে হয় অতীতটা কী তুচ্ছ, কী নিরস, আর কী নিরুদ্দিষ্ট অনাগত ভবিষ্যৎ! এমনকি আজকের এই রাতটি, যা আর কোনও দিন ফিরে আসবে না, এ-ও শেষ হবে, মিশে যাবে অনন্ত কালসমুদ্রে— তাহলে কেন এই মিছে বেঁচে থাকা?’
আন্তন চেখভের গল্পে নারী চরিত্র মহিমান্বিত হিসেবে প্রস্ফুটিত না বলেই প্রতীয়মান হয়। তাঁর বিখাত ‘দ্য ডার্লিঙ’ গল্পে ওলেনকা উদ্দেশ্যহীনভাবে পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ে শোচনীয় পরিণতি বরণ করে নেয়। স্বীয় অস্তিত্ব ধরে রাখতে অন্তরে লালিত বিশ্বাস দ্বারা তাড়িত হয়ে সে নিয়তির দুমোর্চ্য গোলকধাঁধায় উদভ্রান্ত হয়, সঠিক দিশা খুঁজে পায় না, অথচ সে সকলেরই প্রিয় ডার্লিং। ওলেনকা চরিত্রের মধ্য দিয়ে চেখভ হয়ত নারীর অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। অথচ অন্যান্য অনেক গল্পে তিনি নারী চরিত্রকে ভ্রষ্টা হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। ‘প্রজাপতি’ গল্পে ওলেনকা যেন ভিন্ন এক নারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ‘প্রজাপতি’ গল্পের ওলগা ইভানভ্না রঙিন প্রজাপতির মতো বর্ণবৈভবা, চঞ্চল ও সুন্দরী। কিন্তু ব্যক্তিত্বে অস্থিরমতি। কেন অতৃপ্ত, তা সে নিজেও জানে না। শিল্পমনা ওলেনকা স্বেচ্ছায় বিয়ে করে চিকিৎসক দিমভকেকে। বিদ্বান, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও সুপুরূষ স্বামী দিমভ-এর সাথে সে অতৃপ্ত। তার শিল্পীসত্তা যেন খুঁজে ফেরে শিল্প-সাহিত্যনুরাগী কোনো পুরুষকে। শিল্পী রিয়ারিয়াবভস্কির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে সে। নিজ স্ত্রী ভ্রষ্টা জেনেও স্বামী দিমভ তাকে ক্ষমা করে দেয়; ওলগা ইভানভ্না যখন স্বামীর কাছে প্রত্যাবর্তন করতে চায়, চিকিৎসক দিমভ মারাত্মক ডিপথেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে চলে যায়।
‘আরিয়াদনে’ গল্পে ওলগা ইভানভনার মতোই এক লাস্যময়ী তরুণী আরিয়াদনে। তারুণ্যে ঝলমলে দিনগুলোতে অস্থিরমতি আরিয়াদনেকে দেখা যায় জমিদার নন্দন তরুণ সামোকিনের প্রতি অনুরক্ত। আরিয়াদনে যখন উদ্ভিন্ন-যৌবনা তরুণী, তখন তাদের দু’জনের মাঝে উপস্থিত হয় বিচিত্র চরিত্রের বিবাহিত পুরুষ ইভানভিচ লুবকভ। স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে লুকিয়ে আকণ্ঠ ঋণে জর্জরিত আরিয়াদনে সামোকিনের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। লাস্যময়ী তরুণী আরিয়াদনে কেন টগবগে তরুণ সামোকিনের পরিবর্তে মাঝবয়সী লুবকভের প্রতি প্র্রেমাসক্ত হয়ে পড়ে তা সত্যিকারার্থে অনুধাবন করতে হলে মনোবিজ্ঞানীর মতামত প্রয়োজন। লুবকভের কাছ থেকে ধার করা টাকাতেই সে আরিয়াদনে-কে নিয়ে ইতালিতে বেড়াতে যায়। চেখভ এই গল্পে আরিয়াদনে ও সামোকিনের প্রেমের শেষ পরিণতি পাঠককে জানার সুযোগ দেননি।
এক্ষেত্রে চেখভের কৃতিত্ব কী? ক্লাইম্যাক্সবিহীন গল্প? হাঁ, ঠিক তাই। নিস্তরঙ্গ মানবজনমে চটুল নেশার রঙিন স্বপ্নে যারা মোহগ্রস্ত কিংবা উচ্ছ্বসিত, চেখভের গল্প তাদেরকে কম-বেশি আশাহত ও পরাভূত করবে। জীবনের রুঢ় বাস্তবতা ক্লাইমেক্সবিহীন গল্পে সরল বর্ণনায় তা-ই উপস্থাপন করেছেন চেখভ।
‘কনে’ গল্পে নাদিয়া বিয়ের পূর্বক্ষণে রোমাঞ্চকর জীবনের রঙিন নেশায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে; তেমনটিই করেছিল ‘একটি বিরস গল্প’র কাতিয়া। নাদিয়া, কাতিয়া দু’জনেই ঘর ছেড়ে ঘুরে বেড়ায় কী এক অজানা স্বপ্নের ডানায় ভর করে, কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরে আসে। ঝলমলে জীবনের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে তারা ছুটে চলে নিরন্তর কিন্তু অতৃপ্তি তাদেরকে হতাশ করে পুনর্বার ঠেলে দেয় পূর্বস্থানে।
চেখভের গল্পে আর এক অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য চিন্তাশীল পাঠককে আকৃষ্ট করবে, চেখভের চরিত্রগুলো নিজেই গল্প বলে। লেখকের উপস্থিতি সেখানে ঢাকা পড়ে যায় চরিত্রগুলোর নিখুঁত ও সাবলীল আচরণে। চেখভের গল্পের এই বৈশিষ্ট্যে তলস্তয়ও বিমোহিত হয়েছেন।
মো. রেজাউল করিম
মো. রেজাউল করিম ১৯৬৪ সালে কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান-এ প্রথম শ্রেণি নিয়ে স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করেন। ২০১৩ সালের শেষার্ধে নিয়মিত চাকরি থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন।
২০১৩ থেকে ’২৪-এ সময়ে তাঁর ১৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখালেখির ক্ষেত্র বহুমাত্রিক।

One Comment
আন্তন চেখভ এর লেখার সাথে পরিচয় হয়, বিটিভির নাটকের মাধ্যমে। সেসময় অনুবাদ নাটকগুলো একটা নির্দিষ্ট দিনক্ষণে প্রচার হতো। এভাবেই দস্তয়ভস্কি, সমারসেট মম, চেখভ সহ আরো অনেক বিদেশী লেখকের নাম জানা এবং পরবর্তীতে চেনা। তার ছোট গল্পগুলোকে আমার বাস্তব জীবনের মতো মনে হতো;যেখানে চমকের চেয়ে বাস্তবতাই মুখ্য।
লেখক আপনার লেখায়ও সেই ধরনটা আছে। আপনার বাস্তবধর্মী গল্পগুলো গল্প থাকে না আশেপাশের চেনা জানা পরিবেশের কেউ হয়ে যায়, যাকে অনুভব করতে পারি নিমিষেই।
ধন্যবাদ।