অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৬, ২০২৪
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৬, ২০২৪
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লীনা হাসিনা হক -
একটি ফনিক্স সাইকেল আর একজন পরিযায়ী ফ্লেমিংগোর উপাখ্যান

আমার কৈশোর কেটেছে আশির দশকের ময়মনসিংহ শহরে। আমার বালিকা বেলা আর তারুণ্যের প্রথম দিনগুলোও কেটেছে এই শহরে। জীবনের লম্বা একটা সময় ছোটাছুটি করে কোথাও থিতু হতে পারিনি, যাযাবরের মতন ঘুরে ফিরে পড়ন্ত বেলায় এসে কেবলি ছুটে যাই ব্রহ্মপুত্র তীরের এই নেহায়েত সাদামাটা চাকচিক্যহীন শহরে।

এমনকি চোখ বন্ধ করলেই কৈশোরে ফেরত যাওয়ার মতন এক ধরনের সেলফ হিপনোটাইজেশন হয় আমার। আমাদের ময়মনসিংহের বাড়িটার উল্টাদিকেই ‘বনফুল’ নামের পুরোনো বাড়ি। সামনে মাঠ (লনকে আমরা মাঠই বলতাম), কোনো বাউডারি দেয়াল নাই, তখনকার কোনো বাড়িতেই থাকত না, খুব বেশি হলে কাঁটা মেন্দির বেড়া থাকত। বাড়িটির রাস্তার ধার ঘেঁষে কয়কটি সুপারি-নারকেল গাছ। মেইন রোড থেকে সুরকি বিছানো পথ বারান্দার নিচে শেষ হয়েছে, দুটি সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠতে হয়। বাইরের বারান্দাটাতে টিনের ছাদ দেওয়া ছিল, জানালায় টিনের বৃষ্টি ছাউনি ছিল।

বর্তমান অবস্থায় ‘বনফুল’ নামের বাড়ীটির একাংশের ছবি।

দেশ বিভাগের সময় বাড়িটি কিনেছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা, পরবর্তীকালে এই নতুন মালিকেরা। পুরোনো দিনের ইট সুরকির গাঁথুনির বাড়িটা তেমন আহামরি কিছু নয়, যারা কিনলেন নুতন রঙ করে বাড়িটির সামনে ফলক ঝুলানো হল ‘বনফুল’। হালকা হলদে রঙের বাড়িটি বেশ ছিমছাম হয়ে উঠেছিল। বাড়ির ‘বনফুল’ নামটি ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। তখন আমাদের পাড়ার বেশির ভাগ বাড়ির কোনো নাম ছিল না, যেগুলো ছিল তা সবই ‘ভিলা’, ‘কুটির’, কুঠির’, ‘ধাম’, ‘নিবাস’ বা ‘ভবন’ এরকম ছিল। এই বাড়ির রেফারেন্স ছিল ‘বনফুল’ বাড়ি।

বনফুল বাড়ির মুখোমুখি আমাদের নামহীন বাড়ির বড় মাঠ সেখানে নানাবিধ সবজি আর ফুলের চাষের কিছু চেষ্টা হতো, ফুলে যদিও বা কিছু সফলতা ছিল, সবজিতে নৈব নৈব চ! বৃষ্টি তুমুল হয়ে নামলে সেই মাঠে জল জমত আর আমার ভাইয়েরা পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলত জল ছিটিয়ে। পাড়ার বালকেরা অবশ্য বনফুল বাড়ির মাঠেও ডাংগুলি আর ক্রিকেট খেলত।

নারকেল, সুপারি, আম, মেহগনি আর দুইটা ইউক্যালিপটাস গাছ ছিল আমাদের বাড়ির মাঠে। মেইন রোড থেকে বাড়ির মাঠের শুরুতেই ছিল শিউলী আর তেজপাতা গাছ। গেইটে বা বাউন্ডারি দেয়ালের কোনো বালাই ছিল না আমাদের বাড়িতেও।

কাহিনী অবশ্য আমাদের এল শেইপের লম্বা বারান্দাওয়ালা অতি সাধারন সাদা একতলা বা হলুদ রঙের বনফুল বাড়ির গঠনশৈলী বা বাগানের বাহারের নয়। ব্যাপার ছিল ওই বাড়ির সদ্য তরুণ কলেজপড়ুয়া ছেলেটি এবং তার একজন বন্ধুর। আসলে সেই ছেলে দুটির কাউকে নিয়েও ঘটনা নয়, কাহিনীর অন্যতম প্রোটাগনিস্ট ছিল সেই ছেলেটির ফনিক্স সাইকেল। লাল রঙের ফনিক্স সাইকেল।

এই গল্পের মূল চরিত্র এক কিশোরীর, পিতার অকাল মৃত্যুর পরে অর্থকষ্টসহ আরো নানবিধ কষ্টের সাথে ডানা ভেঙে থুবড়ে পরা টুকরো হওয়া স্বপ্নের বেদনা নিয়ে দিশাহীন এক কিশোরীর। নগণ্য কিশোরীর সেই স্বপ্ন ভাঙার বেদনার না ছিল কোনো অংশীদার, না ছিল কোনো উপশম।

নাহ ভুল বললাম, ওই যে বনফুল বাড়ির ছোট ছেলেটি তার বন্ধুসহ ফনিক্স সাইকেল চালিয়ে হাওয়ায় চুল উড়িয়ে লাল কালো সাদা চেইক শার্ট নৌকার পালের মতন ফুলিয়ে ক্রিংক্রিং বেইল বাজিয়ে আসা যাওয়া করত, লাল রঙের সেই সাইকেলটি প্রতিবার মেয়েটিকে অসম্ভব এক স্বপ্ন দেখাত আবার একই সাথে স্বপ্ন ভাঙার ব্যাপারটি ঘটত।

আমাদের বাড়ি দুটি ছিল পাড়ার এমন জায়গায় যে চরপাড়া, স্টেশন রোড বা ব্রাহ্মপল্লী যে দিক থেকেই আসা হোক না কেন সবদিকেই একটা মোড় পড়বে, আমরা মমিসিঙ্গা মানুষেরা বলি ‘মুড়’! তো মুড়ের মাথায় এসে রিকশা বা সাইকেলকে সঙ্গত কারণেই ঘণ্টি বাজাতে হতো। ফনিক্স সাইকেলের ঘণ্টি মেয়েটি চিনে গিয়েছিল।
জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে মেয়েটি উঁকি দিয়ে দেখত সাইকেল আরোহীর যাতায়াত। প্রায় নেশাগ্রস্তের মতন। এখন ধারণা করি, ছেলেটিও নিশ্চয়ই বুঝতে পারত পর্দার আড়ালের উপস্থিতির কথা। কে জানে কী ভাবত সে, কোনোদিন তো কোনো ভাব বিনিময় হয় নাই। পাগলাটেই ভাবত হয়তো, সারা জীবন কম বেশি তাই তো লোকে মনে করল। কিছু আসে যায় নাই মেয়েটির এতে।

এই পর্যন্ত পড়ার পরে মনে হতে পারে মফস্বল শহরের চিরায়ত ক্লিশে হয়ে আসা প্রেমের গল্প। পড়শী তরুণের জন্য পাশের বাড়ির কিশোরীর আকুলতা।

আকুলতা তো অবশ্যই তবে সেই তীব্র চাওয়া ছিল সাইকেলটির জন্য যা মেয়েটির কাছে ছিল স্বাধীনতার রূপক, নিজের ইচ্ছামতো যখন তখন বাইরে বেরোবার স্বাধীনতা, শেকল ছেঁড়ার স্বপ্ন দেখার নেশা।

স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও বের হওয়ার অনেক বাধা নিষেধ ছিল। মা চাচি ছাড়া কোথাও যাওয়ার অনুমতি ছিল না। কালেভদ্রে ভাইদের কাউকে সাথে নিয়ে বন্ধুর বাসায়। এই তো ছিল বাইরের জগত।

সাইকেলের মালিকের প্রতি ঈর্ষা হিংসায় লীন হয়ে যেত সেই মেয়েটি। রাগে ক্ষোভে জ্বলে যেত সে। প্রায় তারই সমান তো বয়সে, কেন ওদের কোনো বাধা নাই যখন তখন হাওয়ার বেগে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার? কেন ও মাগরিব পার হয়ে সন্ধ্যার আঁধারেও বাইরে থাকতে পারে? কেন তার নিজের সাইকেল হতে নাই?

স্কুলের মাঠে সে সাইকেল চালানো শিখেছিল, সাইকেল দৌড়ে দ্বিতীয় হয়েছিল ওই পর্যন্তই তার সাইকেল অভিযান।

শম্ভুগঞ্জ ব্রীজ

৪০ বছর আগের ওই ধরনের সামাজিক পারিবারিক আবহে পাড়ার রাস্তায় সাইকেল চালানোর কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবার নয় অথচ মেয়েটির তীব্র ইচ্ছা হতো সাইকেল চালিয়ে চুল উড়িয়ে সে ছুটে যায় পাড়ার গণ্ডি পেরিয়ে শহরের বড় রাস্তায় তারপরে শহর ছাড়িয়ে শম্ভুগঞ্জের ব্রীজ পেরিয়ে গারো পাহাড়ের কাছে!

মেয়েটির কাণ্ডজ্ঞানহীন সেই ইচ্ছা পূরণ হয় নাই।

জানালার ফাঁক দিয়ে সে কেবল দেখত আর ভাবত বেশ হয় যদি ওদের সাইকেল ড্রেনে পড়ে যায়। আরও ভালো হয় হাত পা ভাঙলে। ল্যাংড়া হয়ে আর সাঁ সাঁ সাইকেল চালানোর কেরদানি দেখাতে হবে না! ভাব দেখে মনে হয়
ইহ্ যেন ‘রাজ্জাক’!

মেয়েটি রীতিমতো অভিশাপ দিত— সব থেকে বেশি ভালো হয় সাইকেলটা ভেঙ্গে গেলে। ছেলেটি যেন পরীক্ষায় ফেল করে। মোটকথা মেয়েটি ছেলেটির দুর্দশা কামনা করত। উল্লেখ করা যায়, মেয়েটি এর মাঝে জীবনের আরেক কঠিন শেকলে আবদ্ধ হয়ে গেছে! বোঝা না বোঝার কুয়াশামাখা মন আর ইচ্ছা অনিচ্ছার ‘যা চাই তা ভুল করে চাই’-এর দোলাচল ঘিরে ছিল তারুণ্যের চৌকাঠে পা রাখতে যাওয়া মেয়েটির। সাইকেলের ঘণ্টি তাকে এক মুক্ত আকাশের হাতছানি দিত।

জীবনের নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে কিশোরী মেয়েটি এখন প্রৌঢ় বয়সী। কাজের সূত্রে দেশে বিদেশে ঘুরেছে, বসবাস করেছে। নিজের স্বাধীনতা নিজেই অর্জন করেছে। তাকে কেউ আর বাধা দিতে পারে না কোনো কিছুতে। তবু নিজের পাড়ায় নিজের শহরে সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সেই অবসেসিভ চাওয়াটা পূরণ হয় নাই। হবেও না আর।

ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক স্রোত বয়ে গেছে, মেয়েটি চুল না ওড়ালেও পনিটেইল দুলিয়ে শার্ট ফুলিয়ে সাইকেল চালিয়েছে আমস্টারডাম শহরের ক্যানালের ধার ঘেঁষে, অক্টোবরের হিমেল বৃষ্টি ভেজা দিনে কোপেনহেগেনের মূল শহরে সাইকেলের জন্য নির্ধারিত লেইনে সারি ধরে, কাঠমান্ডুর গড়ানো রাস্তায় বা দরবার স্কোয়ারের বিশাল এভিনিউতে, পোখরার বিখ্যাত লেকের ধারে, সুইডেনের লুন্ড শহরের নিরিবিলিতে, কিগালীর শহরতলীতে সবুজ চা বাগানের মাঝ দিয়ে, কাম্পালা শহরে ভিক্টোরিয়া লেকের কাছাকাছি লাল মাটির গ্রামীণ পথে, আরুশা আর নাইরোবির জ্যাকারান্ডা ফুলের পাপড়ি বিছানো পথে।

এতকিছুর পরও যখনি ময়মনসিংহ আসে সে, বনফুল বাড়ির দিকে তাকালেই কিশোরীবেলার সেই চেপে রাখা বাসনা মাথাচাড়া দেয়… এই শহরের রাস্তায় গিজগিজে রিকশার ভিড়ে লাল রঙের ফনিক্স সাইকেল চালিয়ে চুল উড়িয়ে সে যাচ্ছে… সাইকেলের ঘণ্টি বাজে ক্রিং ক্রিং…

সাইকেল এখন আর চালায় না সে, ব্যালান্স রাখতে পারে না। কেবল নিজের শহরে সাইকেল নিয়ে দাপিয়ে বেড়ানোর পাগলপারা ইচ্ছা এখনো তাকে তাড়ায়।

বনফুল বাড়িতে কেউ থাকে না আর। শুনেছে ওরা সবাই দেশের বাইরে। ছেলেটির সাথে কোনোদিন সামনাসামনি দেখা হয় নাই, কথা তো দূরের বিষয়। ভালো নামটাও জানা নাই। এবার বাড়ি গিয়ে জানা গেল, বনফুল বাড়ি নাকি বিক্রি করে দেওয়া হবে। বাড়িটার দশা খুবই করুণ, পুরো বাড়ির ছবি তোলা গেল না, কবে যে বড় দেয়াল তোলা হয়েছে সে খেয়ালও করে নাই। দেয়ালের বাইরে থেকেই দু একটা ছবি তুলেছে।

জীবনে যে কোনো ধরনের সীমার বাঁধনে অস্থির বোধ করা মেয়েটির অস্থিরতার মূল অনুঘটকগুলোর মধ্যে এই বাড়িটিও প্রকারান্তরে রয়েছে।

কোনোদিন সুযোগ হবে কিনা কে জানে। হলে সে বলত, শোন গো ছেলে, তুমি নও— তোমার সাইকেলটাই ছিল আমার হিরো। তোমার মতন যখন তখন যেখানে ইচ্ছা যেতে না পারার অবদমিত আকাঙ্ক্ষাই আমাকে যাযাবর করেছে, সাইকেলটা বাহন মাত্র।

পৃথিবীর পথে পথে ঘুরবার এই নেশা তৈরিতে টলস্টয় আর মুজতবা আলীর পাশেই তোমার লাল সাইকেলটাও ছিল। তোমাকে ধন্যবাদ। অবুঝ তাপিত হৃদয়ে তোমার জন্য সে সকল অপকামনা করেছি তার জন্য মনে কিছু নিও না গো ছেলেবেলার পড়শী।

 

লীনা হাসিনা হক : লেখক ও লীনা হাসিনা হক একজন আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা কর্মী। আফ্রিকা, দক্ষিন এশিয়া, দক্ষিন পূর্ব এশিয়া, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে মানুষের জীবন জীবিকার উন্নয়নে কাজ করেছেন এবং করছেন । নিজের চোখে দেখা মানুষের বিশেষত নারীর  যাপিত জীবনের কাহিনি বর্ণনা করতে ভালবাসেন।

leena.huq@gmail.com

Read Previous

রাহুল চন্দ্র দাস – যুগল কবিতা

Read Next

মোহনার মায়াজলে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *