অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাবিবুল্লাহ রাসেল -
মোহনার মায়াজলে

মোহনার মায়াজলে

হাবিবুল্লাহ রাসেল

সন্তোষ কুমার শীল ছোটগল্পকার হিসেবে অধিক পরিচিত হলেও উপন্যাস লিখছেন সমানতালে। ‘দুঃখ জয়ের গান’, ‘একাত্তরের কথকতা’র পর সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার তৃতীয় উপন্যাস ‘মোহনায় যেতে যেতে’। কী গল্প কী উপন্যাস— সন্তোষ কুমার শীলের লেখার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মিথ্যের মেঘ ঠেলে সত্য উন্মোচন।

‘একাত্তরের কথকতা’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিমাদ্রী’র জীবনবোধ, কণ্ঠস্বর, নৈতিকতা, সমাজ ভাবনা, ধর্ম-দর্শন যেন হুবহু ভর করেছে ‘মোহনায় যেতে যেতে’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র স্বপ্নময়ের উপর। বলা যায়, হিমাদ্রীর সম্প্রসারিত রূপ স্বপ্নময়। স্বপ্নময় একজন চিত্রশিল্পী। সে মনে করে, কেবল শিল্পের প্রতি নয়, সমাজের প্রতিও রয়েছে তার দায়বদ্ধতা। স্বপ্নময় ভাবে, ‘মানুষের উপলব্ধিবোধ জন্মানোর পর তার সারা জীবনের সাধনাই হচ্ছে মনুষ্যত্ব অর্জন করা। সে ঈশ্বরের মতো সৃজনশীল হবে। তার অন্তরে থাকবে মহান মঙ্গল ও কল্যাণবোধ।’ (পৃষ্ঠা : ৫২)। স্বপ্নময় যে নান্দনিক স্বপ্ন লালন করে, তার চারপাশের মানুষ, এমনকি তার আপনজনও সেই স্বপ্নের উল্টো পিঠে বিরাজ করে। স্বপ্নময় পরিবারে, পেশায়, সমাজে, প্রতিটি পথে পদে পদে হোঁচট খায়। স্বপ্নময়ের স্ত্রী কবিতা সংসার ছেড়ে চলে যায়, সত্যপথে চলতে গিয়ে তাকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে হয়।

মোহনায় যেতে যেতে                    সন্তোষ কুমার শীল                     প্রকাশক : অনুপ্রাণন প্রকাশন          প্রচ্ছদ : আইয়ুব আল আমিন  প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০২২               মূল্য : ৩৬০ টাকা

স্বপ্নময় যে দিকেই তাকায় দেখে, কত সহজেই মানুষ লোভ-লালসা-স্বার্থ-বিদ্বেষ নিয়ে জৈবিক জীবন যাপন করে। কিন্তু স্বপ্নময় এসবের হাওয়ায় পাল লাগায়নি। সে সংগ্রাম করছে স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কেটে। সে ক্ষেত্রে স্বপ্নময় নিজেকে ভাবতেই পারে সে ঈশ্বরের মতো সৃজনশীল। কিংবা উপন্যাসের পরতে পরতে পাঠকও উপলব্ধি করতে পারে, স্বপ্নময় যেন স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিনিধি। নিষ্পাপ, নিঃস্বার্থ, নিরপরাধ, কল্যাণকামী, সাহসী, সততার মূর্ত প্রতীক স্বপ্নময়। যার কোনো ত্রুটি নেই। কিন্তু সমাজ-সংসারে এমন ত্রুটিহীন মানুষ সত্যিই বিরল। একজন মানুষকে মূল্যায়ন করতে হলে কেবল সেই মানুষটির দিকে তাকালেই হয় না, তাকে নিয়ে তার চারপাশের মানুষগুলোর ভাবনার দিকেও তাকাতে হয়। নিজের কাছে প্রত্যেক মানুষই সৎ, কিন্তু তার চারপাশের মানুষ তাকে কোনো নিক্তিতে মাপে তাও জানা জরুরি। আমরা কেবল স্বপ্নময় চরিত্রটিকে দেখতে পাই স্বপ্নময়ের ভাবনার আলোকে। কিন্তু তার স্ত্রী কবিতাকে দেখতে পাই না— দেখতে পাই কবিতার ছায়া। কবিতার যে ছায়াটুকু দেখতে পাই, তাও কেবল স্বপ্নময়ের অভিযোগের ভেতর দিয়ে। যেখানে কবিতাই কেবল দোষী, আর স্বপ্নময় সম্পূর্ণ নির্দোষ।

যার প্রতি একসময় স্বপ্নময়ের আকর্ষণ ছিল, যে এখনো স্বপ্নময়কে কামনা করে, সেই রিয়া নামের রমণী কবিতার প্রসঙ্গ তুলে প্রশ্ন করে, ‘তুই তাকে আসতে বলতে পারিস না?… এমনও তো হতে পারে, সে অধীর হয়ে তোর আমন্ত্রণের অপেক্ষায় আছে!’ উত্তরে স্বপ্নময় বলে, ‘যদি সে আমন্ত্রণের অপেক্ষায় থাকে তবে সে ভুল করছে। কারণ, আমন্ত্রণ পায় বাইরের কেউ। যার ঘর-গৃহস্থালি তাকে আমন্ত্রণ করে আনাটা হাস্যকর। তাহলে বুঝতে হবে সে আমন্ত্রণ পাওয়ার মতো দূরত্বে অবস্থান করছে। সে দূরত্ব ঘুচাতে আমি কেন যাব?’

এখানে স্বপ্নময়কে কী বলা যায়— একরোখা নাকি অভিমানী? জেদি নাকি আপসবিমুখ? স্বপ্নময় তার গভীর ভালোবাসা, অসীম ধৈর্য, প্রখর বুদ্ধিমত্তা, নিখাদ শিল্পসত্তা দ্বারা কবিতাকে জয় করতে কি পারত না? হয়তো সে প্রচেষ্টা স্বপ্নময়ের ছিল কিন্তু উপন্যাসে আমরা তা দেখতে পাই না। স্বপ্নময়ের ধ্যান-জ্ঞান শিল্প; হয়তো শিল্প-যাপনের জন্য তিনি সংসার-যাপনকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি।

উপন্যাসে যদি কবিতা চরিত্রটিকেও বিশ্লেষণ করা হতো, কবিতাকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হতো তবে হয়তো বলা যেত— দোষে-গুণে মিলেই মানুষ।

উপন্যাসে ফুটে উঠেছে সমাজতন্ত্রের স্বপ্নগুলো কীভাবে পুঁজির দাস হয়ে যায়; কীভাবে সাম্রাজ্যবাদ গিলে খায় লাল ঝাণ্ডা। ৭৬ পৃষ্ঠায় ঔপন্যাসিক লিখেছেন, ‘হঠাৎ একটা মিছিল আসে। তাদের বসার ঘরের সামনে দিয়ে যেতে যেতে ঝাঁঝালো শ্লোগান ওঠে— ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। এই শ্লোগানে মেতে জীবনের কতগুলো দিন যে স্বপ্নের ঘোরে কাটিয়েছে তার হিসেব নেই। আজ মনে হয় এই শ্লোগান মজদুরদের এক হওয়ার আহ্বান নয়। এটা মালিক শ্রেণির এক হওয়ার আহ্বান।’

হরিনাথ ও সাধু চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে ঔপন্যাসিক যেমন ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন তেমনি পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় সমাজের ক্ষতগুলো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন—

‘দেখলাম, ধর্মাচরণের মধ্যে যত ফাঁকি আছে পৃথিবীর আর কোনো কিছুতে তেমন নাই। ধর্মের নামে সব চলে। তারপরও লোকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করে মাথায় তুলে রাখে।’ (পৃষ্ঠা : ৫১)।

‘সে সাধু হতে চায়, দশজনের মধ্যে একজন হতে চায়। এই হতে চাওয়া লোকগুলোকেই সমাজ বুদ্ধিমান বলে, সমাজসেবক বলে, আরও কত কী!’ (পৃষ্ঠা : ৫২)।

উপন্যাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ফুটে উঠেছে ব্যক্তি, ব্যক্তির মূল্যবোধ, সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রকাঠামো নিয়ে গভীর দর্শন। কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা যাক—

‘যে কোনো মানুষ নিজের ব্যাপারে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই বন্ধু বা কাছের মানুষের কাছে আসে যাচাই করে নিতে।’ (পৃষ্ঠা : ১১৮)।

‘মানুষ যত দৈন্যের মাঝে বাস করুক না কেন বাইরে সে নিজেকে সুখী, পরিপূর্ণ জীবন যাপনের ছবি দেখাতে ভালোবাসে।’ (পৃষ্ঠা : ৪০)।

‘সমাজ বা রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা তো আর বিবেক দ্বারা পরিচালিত হওয়ার সুযোগ নেই! সেটা হয় যুক্তিতর্ক আর অন্ধ ক্ষমতা দ্বারা।’ (পৃষ্ঠা : ১১১)।

‘পাপের তো একটা সর্বগ্রাসী মোহ আছে, প্রলুব্ধ করার অদ্ভুত শক্তি আছে।’ (পৃষ্ঠা : ২৭)।

‘তোকে (কাউকে) অভিযুক্ত করতে পারলে আমার ঈর্ষাবোধ তুষ্ট হয়। অপরের অবমূল্যায়ন করার মধ্যে একটা জৈবিক তৃপ্তি আছে বোধহয়।’ (পৃষ্ঠা : ৭৩)।

‘এদেশে অপরাধ করতে, প্রকাশ্যে গালাগালি করতে কোনো লজ্জা নেই। সঙ্কোচ হয় শারীরিক সমস্যার কথা বলতে, ভালোবাসার কথা বলতে!’ (পৃষ্ঠা : ৯১)।

‘বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে যে সুখ তা প্রকৃত সুখ নয়। প্রকৃত সুখ আছে সত্য উপলব্ধির মধ্যে।’ (পৃষ্ঠা : ৭৪)

একটা সত্য ততদিন স্থির হয় যতদিন না নতুন সত্য এসে উপস্থিত হয়! তারপর পুরানো বিশ্বাসের স্তরে নেমে আসে। (পৃষ্ঠা : ৭৫)।

উপন্যাসে ফুটে উঠেছে মানুষের জয়গান। চণ্ডিদাসের মতো ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই বাণী ধারণ করে শিল্প সৃজন করে বেঁচে আছে স্বপ্নময়। তাই তো তার কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই, ‘বাঁশির সুরটাকে ধর মানুষের ঈশ্বরবোধ যা অন্তরে প্রশান্তি ছড়ায়, ভালোলাগায় ভরিয়ে তোলে। কিন্তু এই সুর তোলে মানুষ। সুর অধরা। আমরা তা দেখি না, ধরতে পারি না। শুধু শ্রবণযন্ত্রে অনুরণন তোলে। কিন্তু মানুষটিকে আমরা হাতের নাগালে পাই, যার ওই মোহনীয় সুর সৃষ্টির অদ্ভুত যাদুকরী শক্তি আছে। তাকে বিদ্বেষ করে, অবহেলায় দূরে সরিয়ে কোনোদিন সুরের নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়।’ (পৃষ্ঠা : ৭৬)

স্বপ্নময়ের বন্ধু বিপ্লব আহমদের কণ্ঠে শুনি— ‘এখন থেকে মানুষ নিয়েই পড়ে থাকব। স্রষ্টাকে তো আমি হাতের নাগালে পাই না! পাই তার সৃষ্টি মানুষকে। তাদের দিকে পিছন ফিরিয়ে স্রষ্টাকে লাভ করার চিন্তা বৃথা। আর আমার বাড়িতে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে ডাকব। তাদের এক জায়গায় এনে যার যার ধর্মীয় মতো অনুযায়ী ঈশ্বর ভাবনার কথা শুনব।’ (পৃষ্ঠা : ৭৭)। এমন অসাম্প্রদায়িক চেতনা যদি দেশের অর্ধেক তরুণের অন্তরেও বাসা বাঁধত, তবে কতই না সুন্দর হতো দেশ!

উপন্যাসে উঠে এসেছে উপকূলীয় অঞ্চলের ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা। চিরচেনা লোকালয় কীভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় তা কেবল উপকূলবাসীই জীবন দিয়ে, স্বজন হারিয়ে, সম্পদ হারিয়ে উপলব্ধি করতে পারে। হঠাৎ এক ঝড়ের রাতে চৈতালী আশ্রয় নেয় স্বপ্নময়ের অফিসে। অপরিচিত নারীটি সব চেয়ে আপনজন হয়ে ওঠে। স্বপ্নময়ের শিল্পযাপনের সাথে কবিতা নিজেকে মেলাতে পারেনি, সে স্বপ্নময়ের সংসার ত্যাগ করেছে। কিন্তু চৈতালী স্বপ্নময়ের শূন্যতা পূরণ করে। তা হতে পারে ব্যক্তি স্বপ্নময়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা অথবা স্বপ্নময়ের শিল্পসত্তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অথবা উভয়ই।

স্বপ্নময় সবকিছু ছেড়ে একদম গ্রামে গিয়ে ‘চাষির স্বর্গ’ করে। সেখানে নানা জাতের ফুল-ফল-শাক-সব্জি-মাছ চাষ করে। স্থাপন করে বৃদ্ধাশ্রম। আশ্রয় নেওয়া সবাইকে নিয়ে স্বপ্নময় মাটি চাষ করে আর অবসরে করে শিল্পচাষ; তুলির টানে টানে ক্যানভাসে ফুটে ওঠে রঙের খেলা। চৈতালী একদিন খুঁজে খুঁজে আসে স্বপ্নময়ের খামারে। সবকিছু দেখে মুগ্ধ হয়। স্বপ্নময়ের মতো চৈতালীর অন্তরজুড়েও বয়ে যায় ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো দাও প্রাণ।’ চৈতালী স্বপ্নময়কে সম্মোহিত কণ্ঠে বলে, ‘আমাকে নেবেন আপনার চাষের কাজে?’

স্বপ্নময় চরিত্রটি যেভাবে উপন্যাসজুড়ে বিস্তার লাভ করেছে, চৈতালী চরিত্রটি সেভাবে প্রস্ফুটিত হয়নি। জীবননদীর নানা বাঁক পেরিয়ে চৈতালী স্বপ্নময়ের সাথে একই মোহনায় মিলেছে, স্বপ্নময়ের জীবনের বাঁকগুলো পাঠক দেখতে পায়, সেখানে চৈতালীর জীবনের বাঁকগুলো মোহনার উত্তাল স্রোতে চাপা পড়ে যায়। সাংবাদিকতা ছাড়া উপন্যাসে চৈতালীর আর কোনো পরিচয় নেই। তবে কি চৈতালীর জীবন বাঁকের রহস্যটুকু লুকিয়ে আছে মোহনার মায়া জলস্রোতে? হাফিজুর রহমান হিরু ও ইসমত আরা কলি চরিত্র দুটিও পাঠককে গভীরভাবে ভাবাবে। মোহনায় যেতে যেতে পাঠক মোহিত হবে নিঃসন্দেহে।

 

+ posts

Read Previous

প্রখ্যাত তাজিক কবি লায়েক শের আলির কবিতা

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৪র্থ সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *