প্রকাশিত হলো শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল অনুপ্রাণন ৬ষ্ঠ সংখ্যা। এর পূর্বের সংখ্যা অর্থাৎ ৫ম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল গত অক্টোবর ২০২৩-এ। ৫ম সংখ্যা প্রকাশের সময় থেকে ৬ষ্ঠ সংখ্যাটি প্রকাশে এতটা দেরি হওয়ার জন্য আমরা দুঃখিত। অপ্রত্যাশিত দেরির একটা কারণ হতে পারে— এবারের ৬ষ্ঠ সংখ্যায় লেখার সংখ্যা ৫ম সংখ্যার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এতগুলো লেখা
২০১২ সালে মা মারা যায়। মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার পর আমি আমেরিকা ফিরে আসি। ফেরার সময় ছোটো একটা স্যুটকেসে মায়ের কিছু শাড়ি, শেষ বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ার, হাসপাতালে ওটিতে নেয়ার আগে মায়ের হাত থেকে খুলে রাখা শাঁখা পলা চুড়ি, মায়ের কপালের টিপ, হাসপাতালের বেডে মায়ের মাথা আঁচড়ে দেয়ার সময় ঝরে পড়া তিন চারটি সোনালি চুল, মায়ের ব্যবহার করা ওয়ারিদের ফোনটা,
মায়ের দেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার আগে কাগজে নেয়া মায়ের পায়ের আলতা মাখা ছাপ এবং আরও কিছু মেমেন্টোর সাথে মায়ের নিজস্ব একটা ট্রেজার বক্স এনেছিলাম।
সুটকেসটা এনে রেখে দিয়েছিলাম আমার বিছানার পাশের টেবিলের নীচে, আর খুলিনি।
বাবা মারা গেলো ২০২০ সালে। এই বছর দেশে গেলাম, আমেরিকা ফেরার সময় বাবার বহু ব্যবহৃত একটা শার্ট, একটা লুংগি আর একটা মাফলার হাত ব্যাগে ভরে এনেছি।
বাবার শার্ট লুংগি মাফলার মায়ের জিনিস ভর্তি সুটকেসে ভরে রাখবো ভেবে ১১ বছর পর আজ সুটকেসটা খুলেছি।
সেখানে পেলাম মায়ের দুটো শাড়ি পাকিস্তান আমলের, এখনও ঝকঝকে। একটা কালো নক্সি পাড়ের, অন্যটা লাল আর রূপালি জরির নক্সি পাড়ের।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, এই শাড়িগুলো পরে মা স্কুলে যেতো। শাড়ির পাড়ের সাথে রঙ মিলিয়ে ব্লাউজ পরতো।
আরেকটা শাড়ি মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা থাকতে মা রঙ তুলি দিয়ে ডিজাইন করেছিল, বলতো ফেব্রিকের শাড়ি।
সেসময় তিনটা ভয়েলের থানে মা রঙ তুলি দিয়ে এঁকেছিলো। একটা ছিলো সাদা থানের উপর, একটা হাল্কা কমলা, আরেকটা হালকা বেগুনি থানের উপর করা।
সাদা আর কমলা শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে, হাল্কা বেগুনি শাড়িটা আমার খুব পছন্দের ছিলো বলেই হয়তো মা এই শাড়িটা তুলে রেখেছিলো।
একটা শাড়ি পেয়েছি, আমাদের বিয়ের পর আমার উত্তম বেলী রোড থেকে শাড়িটা কিনে মা’কে দিয়েছিলো। জামাইয়ের দেয়া প্রথম শাড়ি, মা রেখে দিয়েছিলো।
আড়ং থেকে কেনা কাপড়ের তৈরি একটা পেন এন্ড পেপার হোল্ডার খুঁজে পেলাম। এটিও মা’কে দিয়েছিলো আমার উত্তম, মা তুলে রেখেছিলো।
সুটকেসে কয়েকটা ছোটো রঙিন টাওয়েল পেলাম। আমিই হয়তো আমেরিকা থেকে নিয়ে গেছিলাম। মা কত যত্ন করে রেখেছে।
আমার বাবা মা’কে ভালোবেসে যখন যা দিয়েছি, মা ভালোবাসার জিনিস ভালোবেসে গ্রহণ করেছেন, ভালোবেসে আগলে রেখেছেন।
কখনো বলেননি, সস্তার জিনিস দিয়েছি, কখনো বলেননি সেইলে কেনা জিনিস দিয়েছি, কখনো বলেননি ডেট এক্সপায়ার্ড জিনিস দিয়েছি।
মা জিনিস হাতে নিয়ে সেখানে মেয়ে, জামাই আর নাতনিদের ভালোবাসা অনুভব করতেন, জিনিসের গায়ে দামের ট্যাগ খুঁজতেন না, এক্সপিরেশন ডেট খুঁজতেন না।
এইজন্যই মায়ের ট্রেজার বক্সে থাকা শত বছরের পুরানো জিনিস আজও জ্বল জ্বল করছে।
একটা কৌটোর মুখ খুলতেই বের হলো লুডুর গুটি আর ছক্কা পাঞ্জা। এই গুটি আর ছক্কা পাঞ্জাটা মায়ের তরুণী বয়সের, যখন মা অবসরে তার ননদ জায়েদের সাথে অবসরে লুডু খেলতো।
একটা কৌটো খুলে পাওয়া গেলো বেশ কিছু ঝকঝকে সেফটি পিন, পঁচিশ বছর আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে এনে দিয়েছিলাম। আরেক পাউচে পাওয়া গেলো অন্য সাইজের আরও কিছু সেফটি পিন, কখনো আমিই হয়তো আমেরিকা থেকে নিয়ে গেছিলাম।
একটি ছোটো কৌটো ভর্তি চকচকে এক টাকার কয়েন। তিনটি ছোটো ছোটো পাউচ আমার মেজো কন্যা মিশা দিয়েছিলো দিদাকে। প্রতিটি পাউচে আছে নতুন একশো টাকার নোট।
পেলাম একটা সানগ্লাস, এটাও মিশা দিয়েছিলো দিদাকে। আমেরিকা থেকে দেশে যাওয়ার সময় মিশা সবসময় ওর দিদার জন্য টুকিটাকি হাবিজাবি অনেক কিছু নিতো। আমাদের কারোরই ধারণা ছিলো না, মা প্রতিটি জিনিস এতো যত্ন করে ট্রেজার বক্সে রেখে দিতো।
বক্সের ভেতর এবার পেলাম একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট। প্যাকেট খুলে একটা একটা জিনিস বের করি আর থমকে যাই!
প্যাকেটের ভেতর সব কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা, খুব সম্ভব আমার জন্যই মা এই প্যাকেটটা রেখেছিলো।
কারণ মা জানতো একমাত্র আমিই স্মৃতিচারণ করতে ভালোবাসি, হাতড়ে হাতড়ে স্মৃতি খুঁজি, স্মৃতি কুড়াতে ভালোবাসি।
প্লাস্টিকের প্যাকেটের ভেতর থেকে বের করলাম ছোটো একটা পকেট এলবাম। এলবামে আমাদের আনন্দময় বিভিন্ন সময়ের ছবি যেখানে মা আছে, আমার মেয়েরা আছে, মাসি পিসী ঠাকুমা আছে।
ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আমার জীবন থেকে আনন্দময় সবই হারিয়ে যাবে মা জানতো, তাই ছবিগুলো যত্ন করে তুলে রেখেছে আমার জন্য।
পেলাম প্রফেশনাল জ্যোতিষী দিয়ে তৈরি করা আমার দুই মেয়ে মৌটুসি আর মিশার কোষ্ঠি, খুব যত্ন করে রাখা।
মা কেনো নাতনিদের কোষ্ঠি করিয়েছিলো কে জানে! মা তো জানতেও পারেনি, মায়ের আদরের নাতনিদের কোষ্ঠিতে কি লেখা ছিলো!
দুটো এনভেলাপ পেলাম, একটিতে আমার টিচার্স ট্রেনিং কলেজের রেজিস্ট্রেশন কার্ড, আরেকটিতে বিএড পরীক্ষার প্রবেশ পত্র। দেখে আমার দুই চোখ ফেটে জল এলো। মায়ের ট্রেজার বক্সে আমার বিএডের রেজাল্টের কপি নেই, তাই প্রমাণ নেই তিন কন্যা জন্মের পর বিএড করেছি, বিএড পরীক্ষায় ৭৯৩ পেয়েছি।
আরও অনেক কাগজপত্রের মাঝে তিনটা আলাদা ছোটো প্যাকেট পেলাম, পত্রিকার কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে লাল সূতো দিয়ে বাঁধা।
এক প্যাকেটের গায়ে মায়ের নাম লেখা, আরেক প্যাকেটের গায়ে আমার নাম লেখা, তৃতীয় প্যাকেটের গায়ে দাদু দিদিমার নাম লেখা।
মায়ের নামের প্যাকেট খুললাম আগে, বেরিয়ে এলো মায়ের বিভিন্ন বয়সের পাসপোর্ট সাইজের ছবি। তেতাল্লিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে বিভিন্ন সময় পাসপোর্ট সাইজের ছবি তুলতে হয়েছে।
একটা ছবি মায়ের প্রথম বয়সের, পরের গুলো আরও পরের। প্রথম বয়সের ছবিটায় মা’কে দেখে মনেই হয় না, এটা আমার সুন্দরী মা।
আমার মায়ের উপরের পাটির সামনের দুটো দাঁত একটু উঁচু ছিলো, আর ঠোঁট দুটো পাতলা ছিলো বলে দাঁত দুটো দেখা যেতো। ছবি তোলার সময় ঠোঁট চেপে দাঁত ঢাকতে গেলে আমার সুন্দরী মায়ের চেহারা বদলে অসুন্দরী হয়ে যেতো।
সেই ছবির চেহারা মায়েরও পছন্দ হতো না, আমারও না। এইজন্য মা প্রয়োজন ছাড়া কক্ষনো ছবি তুলতো না।
আজ আমার মায়ের সব বয়সের ছবিগুলোই খুব সুন্দর লাগলো। মা’কে কত বলেছি, মা দাঁত দেখা যাক। তোমার সামনের দাঁতদুটো দেখেই তোমাকে চিনি, ঠোঁট চেপে দাঁত ঢাকতে হবে কেনো! তবুও মা ছবি তোলার সময় সিরিয়াস হয়ে যেতো।
একটা ছবি দেখে আমি আজ ফিদা হয়ে গেলাম। পাকিস্তান আমলে তোলা ছবি। মায়ের পরনে সেই শাড়ি, গলায় সেই ঝিনুক লকেটের হার। এই শাড়িটা ছিলো আমার খুব পছন্দের, নাম দিয়েছিলাম ইস্পাহানি শাড়ি। কারণ পাকিস্তান আমলে আমাদের বাসায় যে ইস্পাহানি চায়ের সাদা সবুজ বাক্স আসতো, এই শাড়ির প্রিন্টটা দেখতে ইস্পাহানি চায়ের প্যাকেটের মতো লাগতো।
মুক্তিযুদ্ধের পরে এই শাড়িটা আমি আর দেখিনি। মা’কে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম, ইস্পাহানি শাড়িটার কথা। মা বুঝতেও পারতো না, ইসপাহানি শাড়ি কোনটা। আমি মনে করিয়ে দিতাম, অই যে ‘৭০ সালে আমরা প্লেনে চড়ে কলিকাতা গেলাম, তুমি ইস্পাহানি শাড়িটা পরেছিলা। অইটাই ইস্পাহানি শাড়ি।
মা বলতো, কি জানি কি কস, ইসপাহানি শাড়ি, বাপের জন্মেও এমন নাম শুনি নাই। নিশ্চয়ই ছিঁড়ে গেছে।
আর মায়ের গলার এই হারটার কথা অনেক মনে পড়ে। ঝিনুকের উপর জোড়া ময়ুর ডিজাইনের লকেট। আমার বিয়ের সময় মায়ের যত গয়না ছিলো, সব ভেঙে আমার বিয়ের গয়না গড়িয়ে দিয়েছে। ঝিনুক লকেটওয়ালা এই হারটাও ভাঙতে হয়েছিলো।
এই একটা ছবি আমাকে আজ এতো কাঁদালো!
এরপর খুললাম আমার নামের প্যাকেট। এখানেও পাসপোর্ট সাইজের ছবি, ক্লাস এইটে যখন পড়ি, আমার পাসপোর্ট করানোর জন্য এই ছবি তোলা হয়েছিলো।
তখন কী বেকুব ছিলাম আমি, বারো- তেরো বছরের এক কিশোরীকে তার মা বললো, শাড়ি পরে ছবি তোল। অমনি কিশোরী মায়ের শাড়ি পরে, মাথার চুল টেনে ঝুঁটি বেঁধে, চোখে কাজল, কপালে কাজলের বড় টিকা, গলায় পুঁতির মালা পরে ছবি উঠালো!
কী বোকা দেখাচ্ছিলো ছবিতে, ভাগ্যিস দালাল বলেছিলো, এই ছবি দিয়ে পাসপোর্ট হবে না।
আমি বললেই আমার মেয়েরা পাসপোর্টের জন্য তুলতো এভাবে ছবি? অথচ মায়ের কথায় আমি শাড়ি পরে স্টুডিয়োতে গিয়ে ছবি তুলেছি। এত বছর পর নিজের ছবি দেখে নিজেই খিলখিল করে হেসে ফেলেছি।
এরপর দাদু দিদিমার প্যাকেট খুললাম। সেখানে দাদুর একটা ছবি, দিদিমার তিন বয়সের তিনটা ছবি। একটা ছবিতে দিদিমার স্বাক্ষর আছে, শ্রী চারুলতা রায়।
স্বাক্ষর পড়ে খুশীও হলাম, হেসেও দিলাম।
আমার দিদিমা ঠাকুমা দুজনেই প্রাইমারি স্কুল পাশ। এটা আমার কাছে অত্যন্ত গর্বের, কোন্ আমলের নারী উনারা, বেঁচে থাকলে দিদিমার বয়স আজ একশ তিন হতো, ঠাকুমার হতো একশ বিশ।
দিদিমার স্বাক্ষরে নিজের নামের আগে শ্রীমতি না লিখে শ্রী লিখেছে দেখে হাসি পেয়েছে। ঠিকই আছে, শ্রীমতি হলেও আমার দিদিমা শ্রীমতিদের মতো মিনমিনে ছিলেন না, চলনে বলনে ঠাটে বাটে শ্রী মহাশয়দের মতোই তেজস্বী ছিলেন।
মনে পড়ে গেলো, দিদিমা আর মা পাকিস্তান আমলে কত যে বেড়াতো, প্রায় দিন মা মেয়ে রিকসায় চড়ে চলে যেতো সিনেমা দেখতে, আমার সব মনে আছে কারণ দিদিমা আর মা যেখানেই যেতো আমাকে সাথে নিতো।
দেশ স্বাধীনের পর আমাদের হাল দেখে কে বলবে, আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষগুলো চলনে বলনে শিক্ষায় সম্পদে কতখানি পরিপূর্ণ ছিলো!
পেলাম আমার মিশা কন্যার হাতে লেখা চিঠি। অস্ট্রেলিয়া থাকতে মিশা ওর দিদা দাদুকে খুব মিস করতো, তাই চিঠি লিখতো।
পাঁচ বছরের মিশা বাংলা বর্ণ পরিচয় ছাড়াই বাংলায় চিঠি লিখতো, এটা দিদার কাছে হয়তো অষ্টমাশ্চর্য বিষয় ছিলো তাই ট্রেজার বক্সে চিঠিগুলো রেখে দিয়েছে।
মিশা চিঠির শেষে ‘ইতি মিশা’ না লিখে লিখতো, ‘ইতিহাস মিশা’! সেই থেকে মিশার নাম হয়ে গেছিলো, ইতিহাস মিশা।
চিঠি দুটো দেখে আবার ঝাঁপিয়ে কান্না এলো। আমাদের সে-ই প্রাণোচ্ছল পাগলি আহ্লাদী মিশা আজ সত্যিই ইতিহাস মিশা হয়ে গেছে!
জীবনের বাস্তবতা ইতিহাস মিশাকে পুরো বদলে দিয়েছে।
আমার পাসপোর্ট সাইজের কিশোরী বয়সের ছবিগুলো পত্রিকার যে কাগজ দিয়ে মোড়ানো ছিলো, সেই কাগজে বড় হরফে লেখা,” গ্রন্থমেলা অনন্য সুন্দর, বিশ্বে নন্দিত”!
এটা পড়ে আমার অদ্ভুত এক ভাবের উদয় হলো।
মা একই সময়ে বিভিন্ন জনের ছবি কাগজে মুড়িয়ে তিন সেট প্যাকেট বানিয়েছে, আমার ছবির প্যাকেটটা কিভাবে গ্রন্থমেলার মোড়কে ঢুকে গেলো!
তবে কি সেদিনই নির্ধারিত হয়ে গেছিলো, আমার লেখা বই একদিন এই অনন্য গ্রন্থমেলায় ঠাঁই পাবে!
মায়ের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই!
আরও কত স্মৃতি মায়ের ট্রেজার বক্সে। আমাদের অস্ট্রেলিয়ার ছবি, মৌটুসির নাচের ছবি, হারমোনিয়াম বাজিয়ে মৌটুসী ফাংশানে গান গাইছে, ছোট্টো মিশা আমি আজ কানাই মাস্টার আবৃত্তি করছে, পুতুলের মতো দেখতে মিশা—-
মিথীলার ছবি, ছোট্টো মিথীলার কত ছবি—-
ছবিগুলো দেখে মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেলো।
ট্রেজার বক্সটা সযতনে আবার সুটকেসে রেখে সুটকেসের ডালা বন্ধ করে দিলাম।