সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে লবণাক্ত জলমাটিতে জন্মানো বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ নিয়ে সৃষ্ট বন ম্যানগ্রোভ। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ ভাষাচিত্র থেকে প্রকাশিত হলো সুন্দরবনের জলদস্যুদের নিয়ে চাণক্য বাড়ৈ’র উপন্যাস ‘জলমানুষ’। চাণক্য বাড়ৈ’র প্রথম পরিচয় তিনি কবি। ২০১৯-এ প্রকাশিত উপন্যাস ‘কাচের মেয়ে’র পর ‘জলমানুষ’ পড়লে তাকে আর কেবল কবি বিশেষণে আটকে রাখা যায় না। চাণক্য বাড়ৈ যখন উপন্যাস লিখেন কবিতার কোনো ছাপ থাকে না, তখন তিনি একজন সুদক্ষ ঔপন্যাসিক।
সুন্দরবনের জলদস্যুদের নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী যে আখ্যান লেখা হয় পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়, তার সবটুকু জুড়েই রয়েছে লেখকের কঠিন পরিশ্রম আর মেধার ছাপ। শুধু জলদস্যুদের জীবনই নয়, সাথে সাথে উঠে এসেছে গণিকা, কোস্টগার্ডের টহল, চোরাচালান, রাজনৈতিক গডফাদার, বনবিভাগের কর্মকর্তাদের কার্যকলাপ আর জেলে, সারেং, বাওয়ালী, করাতি, মৌয়াল, গুনিন বিচিত্র পেশাজীবী মানুষের জীবনযাপন।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রে কারা- রুস্তম-ফুলমতি? নাকি খালেদ-ফুলমতি? নাকি তাহের-আফছানা? নাকি তামজিদ-তন্দুরী? দারুণ দ্বন্দ্বে ফেলে দেয় পাঠককে।
সুন্দরবনের দস্যুসম্রাট রুস্তম। সুন্দরবনে তার উপর কথা বলার সাহস নেই কারো। কিন্তু রুস্তম চায় দস্যুজীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে। বানিয়াশান্তা গণিকাপল্লীর সুন্দরী ফুলমতিকে নিয়ে সে ঘরবাঁধার স্বপ্ন দেখে। রাজনৈতিক নেতা রশিদুদ্দীনের দেয়া তেইশ বিঘার বাগদা চাষের প্রোজেক্টসহ পাঁচ লক্ষ টাকার প্রোজেক্টের প্রলোভন বা ফুলমতির প্রেম বা নিজের সুবুদ্ধিতে সুস্থ জীবনের তাড়না, যে কারণেই হোক রুস্তম এই অসুস্থ জীবন থেকে ফিরতে চায়। রুস্তম ফুলমতির নিয়মিত গ্রাহক। ফুলমতির চেয়ে বেশি কিছু ভাবে না। সে বলে, ‘গতর যতদিন আছে, আমার কদরও ততদিন। এই কথা আমার চেয়ে আর কেউ ভালো জানে না।’
ফুলমতি যেমন ভাবে গণিকা-জীবন থেকে কখনো ফেরা যায় না, তেমনি রুস্তমের শিষ্য খালেদ ও তাহেরও ভাবে দস্যুজীবন থেকে ফেরা যায় না। খালেদ ও তাহের ওস্তাদের আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা আলাদা আলাদা দল গঠন করে। নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে নেয় আর একমত হয় কখনোই আত্মসমর্পণ নয়। কেননা তাদের আশঙ্কা, যদি আত্মসমর্পণ করে, তবে একদিন না একদিন তাদের জেলে যেতেই হবে। তাছাড়া মানুষ কখনোই তাদেরকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে না, কাজ দেবে না। সরকার যতই স্বাভাবিক জীবনের কথা বলুক তারা কখনোই স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না। তারা অপরাধে জড়িয়েছে সাধে নয়, জীবন বাঁচানোর তাগিদে। ফলে জোটবদ্ধ হয়ে দস্যুতা ছাড়া তাদের আর কোনো শক্তি বা উদ্ধারকর্তা নেই। তারা মনে করে, একটি রাজনৈতিক পক্ষ তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সরকারের নাম ভাঙিয়ে তাদের আত্মসমর্পণের জন্য চাপ দিচ্ছে।
বাগেরহাট পিসি কলেজ থেকে বিএসসি পাস করা তাহের বলে, ‘এখানে আমরা যারা উপস্থিত আছি, সকলের ক্ষেত্রেই দেখা যাবে এই পথে পা বাড়ানির জন্যি কোনো না কোনোভাবে এই সমাজ, এই রাষ্ট্র আর সিস্টেমের দায় আছে। যেমন ছেল আমার ক্ষেত্রে। এই রাষ্ট্র কোনোভাবেই এই দায় এড়াতে পারে না। কারণ, কেউই আমরা নিজেদের ইচ্ছায় এই জীবন বেছে নিইনি। আর তাই আরামের জীবন ছেড়ে আমরা সবাই এই জলে-জঙ্গলে বাঘ, কুমির, সাপ, দুর্যোগ, আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয় উপেক্ষা করে অনেকেই বৃদ্ধ আর অসুস্থ মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান, স্বজন, সুন্দরী প্রেমিকা ফেলে রাইখে এখানে আসছি। তাহলি ভাবুন, এই জীবনে এসে কত মূল্য দিতি হচ্ছে আমাদের আর বিনিময়ে কী পাচ্ছি আমরা? আর সরকার আমাদের এক বস্তা চাল দিলো, ক’হাজার টাকা দিলো, মাসিক কিস্তিতে একটা ইজিবাইক কিনে দিলো, তাতে কি আমাদের এত বড়ো ক্ষতি উসুল হয়ে যাবে? এতই সস্তা আমাদের জীবন? আর আদৌ এসব আমরা ঠিকঠাক হাতে পারব কি-না, সেটাও একটা প্রশ্ন। তাই আমরা ভুল করে সাপের গর্তে পা দিতি পারি, কিন্তু এই আত্মসমর্পণের ফাঁদে কোনোভাবেই পা দেব না।’ তারা ডাকাতি কার্য চালিয়ে যায়। প্রয়োজনে জোটবদ্ধ হয়ে অপারেশনে নামে।
রুস্তম কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারে না। সহযোগী হারুনকে বলে, ‘সব শালা বেইমান। এই ফকিন্নির পোলাগুলারে দুডো টাকার মুখ দেখাইছে এই রুস্তম। প্রশাসন সব হাতে আনিছি আমি। সবাইরে দামি অস্ত্র দিছি। ট্রেনিং করাইছি।… এখন আবার বলতিছি, ফিরে আয়। মামলা-মোকদ্দমা সব উঠায়ে নেবে সরকার। কাজের সুযোগ দেবে। আলোর জগতে আয়। এখন সব শালা বেঁকে বইছে। এই রুস্তমই তাদের অন্ধকার জগত থেকে আবার আলোর জগতে আনার চেষ্টা করতি যাইয়ে সবার শত্তুর হয়ে গেছে।’ ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতা রশিদুদ্দীন ও কামাল শিকদারকে রুস্তম কথা দিয়েছে, সে তার দল নিয়ে আত্মসমর্পণ করবে। রশিদুদ্দীন এ আসন থেকে নমিনেশন পাওয়ার মিশনে নেমেছে। বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে নানারকমের ব্যবসা তার। ক্ষমতা বা টাকার কোনোটিরই অভাব নেই। কিন্তু রশিদুদ্দীন জানেন, শুধু টাকার বিনিমিয়ে এবার নমিনেশন কেনা সম্ভব নয়। তাকে কিছু কাজ করে দেখাতে হবে। জলদস্যুদের যদি প্রলোভন দেখিয়ে আত্মসমর্পণে রাজি করানো যায়, তাহলে দলে তার সুনাম বাড়বে। এদিকে সরকারও চায় সুন্দরবনকে নিরাপদ করতে। এটাই নমিনেশনের ব্যাপারে কাজে লাগাতে চান রশিদুদ্দীন। কামাল শিকদারকে দিয়ে তাই রুস্তমকে চাপ দেয় বারবার। রুস্তমও সেটা চায়। হন্যে হয়ে ঘোরে বিদ্রোহী খালেদকে মারার জন্য। উল্টো খালেদের হাতেই বারবার নাকানি-চুবানি খায় রুস্তম।
তাহেরের অবুঝ ছেলে নাবিলের মৃত্যুতে বিষাদ নেমে আসে। তাহেরকে বশে আনার জন্য নাবিলকে তুলে আনতে সহযোগীদের পাঠায় রুস্তম। সহযোগীরা গিয়ে নাবিলের মৃত্যুসংবাদ পায়। তাহেরের স্ত্রী আফসানাকে একা পেয়ে ধর্ষণ করে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসে। পুত্রের মৃত্যুর পরে কত অঘটন ঘটে গেছে, কিছুই জানে না তাহের। রুস্তম একটার পর একটা খালেদের গোপন আস্তানা পুড়িয়ে দিলে অবশেষে তাহেরের সহযোগী তামজিদের গুলিতে প্রাণ হারায় রুস্তম। খালেদ ও তাহের বাহিনীতে আনন্দ নামে।
বানিয়াশান্তা গণিকাপাড়ায় আশ্রয় নেয় আলোমতি নামের সুন্দরী। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফুলমতি, নুসরাত, বেবি, পাপিয়া, দোলাদের সাথে গভীর বনে জলদস্যুদের উৎসবে যোগ দিয়ে রাতযাপন করে আলোমতি। সব আয়োজন করেও পুত্রশোকে কাতর তাহের যোগ দেয় না উৎসবে। হরিণের মাংস, মদ আর মেয়েদের নিয়ে ফূর্তিতে মেতে ওঠে অন্য সবাই। খালেদ মেতে ওঠে রুস্তমের ফুলমতিকে নিয়ে। ফুলমতি খালেদকে বলে, ‘এই বনের রাজা হলে তুমি। আজ থেকে আমার মনের রাজাও তুমি। এখন থেকে আমার ঘরের দরজা তোমার জন্যি সব সোমায় খোলা থাকবে।’ সকালে অর্থ নিয়ে খালেদের সাথে তাহেরের ভুল বোঝাবুঝি হলে তাহেরকে গুলি করে খালেদ। আলোমতি জানতে পেরে ছুটে আসে। তাহেরের নিস্পন্দ মুখের দিকে চেয়ে থমকে দাঁড়ায়। চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ে, ‘কথা কও, চোখ খোলো। কথা কও, নাবিলের বাপ।’ এ সংলাপ দারুণভাবে পাঠককে নাড়া দেয়। পাঠকের তখনোই জানা হয় আলোমতিই আফসানা। তামজিদ জানতেও পারে না যে নারীর সাথে রাতযাপন করেছে, সে তার সর্দারের প্রিয়তমা স্ত্রী। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া তাহেরও জানতে পারে না পরম মমতায় যে তার মুখে জল তুলে দিয়েছে, সে আফসানা। আস্তে আস্তে আফসানাও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, খাঁড়ির কিনার থেকে জল তোলার সময় একটা শঙ্খচূড় সাপ তাকে আঘাত করেছে। কাঁধের গামছা দিয়ে হাঁটুর নিচে বাঁধন দেয়া ছাড়া তামজিদের আর কিছুই করার থাকে না।
সর্দারের মৃত্যুর পর তামজিদ বড়ি ফিরে আসে। ততদিনে বিয়ে হয়ে গেছে ভালোবাসার মানুষ তন্দুরীর। যার জন্য স্বপ্ন দেখেছে, জীবন বাজি রেখে অর্থ সংগ্রহ করেছে, সেই তন্দুরী বলে, ‘যেদিন শুনলাম তুমি জলদস্যু হয়ে গেছ, সেইদিন ধরে নিছি তামজিদ ভাই আর নাই। তুমিও এহন ধরে নেও, তন্দুরী বলে তোমার কেউ ছেল না কোনোদিন।’ দারুণ আঘাত পেয়ে মৃত সর্দারের কথা ভাবে, ‘মায়া কাটাও তামজিদ। মায়া না কাটালে জলমানুষ হওয়া যায় না।’
আবার জঙ্গলে ফেরার আগে মায়ের মুখটা শেষবারের মতো দেখতে পা বাড়ায়, মা গুলবদন বিবির শ্বাস যেভাবে হাপরের মতো শব্দে ওঠানামা করে, তামজিদের মনে হয় একটি কামারশালার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যমজ ভাই সামজিদ জানায়, গত সন্ধ্যায়ও পুলিশ তামজিদকে খুঁজে গেছে, থানায় ওয়ারেন্ট হয়েছে। ঘুমন্ত মাকে জাগায় না তামজিদ। কুপিবাতিটা জ্বালিয়ে শেষবারের মতো গর্ভধারিণীর মুখ দেখে নেয়। জমানো সব টাকা ভাইয়ের কাছে দিয়ে বলে, ‘মারে তোরা দেখিস’।
অতঃপর, সর্দারের খুনের বদলা নিতে আর দুই দলেরই সর্দার হতে জঙ্গলের পথে ছোটে তামজিদ, ভাবে, ‘জীবনে কখনো কখনো এমন কিছু পরিস্থিতির সামনে এসে দাঁড়াতে হয়, যখন সিদ্ধান্ত যত বড়ো, সময় নিতে হয় তত কম।’
উপন্যাসের পরতে পরতে ফুটে উঠেছে সুন্দরবন ও বনসংলগ্ন ছোট-বড়ো অসংখ্য ¯্রােতক্ষুব্ধ নদী। যেমন- ভৈরব, বলেশ্বর, পশুর, শেলা, দড়াটানা, মালঞ্চ, আড় পাঙ্গাশিয়া, রাই, খড়মা, বেতমুড়ি, পানগুছি, সোনাখালি, শিবসা, ভোলা নদী, মোংলা নদী। পাঠক সহজেইে এ অঞ্চলের নদী-লোনাজল, নানা প্রজাতির বৃক্ষসহ সামগ্রিক জীববৈচিত্র্যের ধারণা পাবেন।
উপন্যাসে ফুটে উঠেছে গহীন জঙ্গলে দিনের পর দিন বাস করার নানান লোকপ্রযুক্তি, লোকজ্ঞান। মন্ত্রবলে গুনিনের বাঘবন্দি, অন্য অঞ্চলে বাঘ চালান করে দেয়া বা বাঘের দাঁতে খিলন দেয়া, যাতে মানুষ শিকার করতে গিয়ে বাঘ মুখ হা করতে না পারে এমন নানাবিধ লোকাচার তুলে ধরেছেন লেখক। তুলে ধরেছেন মুণ্ডা, পোদ, হিন্দু-মুসলিম ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বনবিবিকে পূজা করার লোকবিশ্বাস।
উপন্যাস জুড়ে রয়েছে লেখকের প্রমিত শব্দের সাথে আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহারের দারুণ দক্ষতা। কোনো কোনো উপন্যাস পড়তে গিয়ে বোদ্ধা পাঠকেরও আঞ্চলিক শব্দের পাঠ উদ্ধারে জটিলতায় পড়তে হয়। ‘জলমানুষ’-এ লেখক গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শব্দের পাশে বন্ধনীতে প্রমিত শব্দ বা টীকা তুলে ধরেছেন। ১৬৭ পৃষ্ঠার উপন্যাসে সামান্যই বানান-বিভ্রাট রয়েছে, যা চোখে পড়ার মতো নয়।
সুন্দরবনের প্রাকৃতিক রূপ, জলদস্যুদের জীবন ও পরিবার, সুখ-দুঃখ, প্রেম, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ে লেখা এ উপন্যাস পাঠে পাঠককে বারবার রুদ্ধশ্বাস ঘটনাবলির সাথে আবর্তিত হতে হয়।
চাণক্য বাড়ৈ’র জন্ম বাগেরহাট জেলায়। গভীরভাবে দেখেছেন ও অনুভব করেছেন সুন্দরবনকে। তারই স্বাক্ষর রেখেছেন ‘জলমানুষ’-এ। ‘জলমানুষ’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নিশ্চয়ই জায়গা করে নিবে। চাণক্য বাড়ৈ’র জন্য শুভ কামনা।
# জলমানুষ। চাণক্য বাড়ৈ। প্রচ্ছদ: পার্থপ্রতিম দাস। প্রকাশক: ভাষাচিত্র। মূল্য: ৩৩০ টাকা।
হাবিবুল্লাহ রাসেল
প্রভাষক, ফজিলা রহমান মহিলা কলেজ
কৌরিখাড়া, স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর-৮৫২২