বই: স্বপ্ন জলে জ্যোৎস্না
লেখক: আনোয়ার রশিদ সাগর
প্রকাশনা: অনুপ্রাণন প্রকাশন
প্রচ্ছদ: আইয়ুব আল-আমিন
মুদ্রিত মূল্য: ১৬০ টাকা
দারিদ্র্যের কোষানলে বেড়ে ওঠা এক সংগ্রামী কিশোরের গল্প নিয়েই মূলত লেখক আনোয়ার রশিদ সাগর স্যার রচনা করেছেন ‘স্বপ্ন জলে জ্যোৎস্না’ উপন্যাসটি। গ্রামীণ জীবনে বেড়ে ওঠা এক দুর্বল ছাত্র মফিজের মাধ্যমিক স্কুলজীবনের গল্প দিয়েই উপন্যাসের শুরু। যেখানে লেখক মফিজ নামক একটি ছেলের খুব কম বয়সে বাবাকে হারিয়ে ফেলার পর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সংগ্রামের গল্প বলেছেন। এই সংগ্রামে মফিজের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন তারই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমাদের সমাজে এরকম শিক্ষকদের শত শত অবদান চাপা পড়ে যায়, সেই জায়গা থেকে সমাজে শিক্ষকদের ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন লেখক।
উপন্যাসের ভেতর লক্ষ করি আঞ্চলিক ভাষার প্রচুর ব্যবহার। বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার আঞ্চলিক ভাষাগুলো লেখায় অন্যরকম মাত্রা এনেছিল। অবশ্য এই ভাষা আমার অতি চেনা ভাষা, মায়ের ভাষা বলেই এরকম মনে হয়েছে হয়তো! লেখক নিজেও এই অঞ্চলেরই; চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা শহরে বেড়ে ওঠা মানুষ!
গল্পের শুরুতেই মফিজের কর্মকাণ্ড আমাকে বারবার সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এই মফিজ যেন ঠিক কাকতাড়ুয়া উপন্যাসের বুধার মতোই সহজ-সরল, অথচ কী ভীষণ সক্রিয় এবং কর্মঠ! স্কুলজীবন শেষ করতে না করতেই মফিজের জীবনে নেমে আসে দুঃখ-দুর্দশা ও সংগ্রাম। টিউশনি করে নিজে টাকা রোজগার করে মায়ের সাথে বেশ সুখের সময়টা কাটানোর মুহূর্তেই মাকেও হারিয়ে ফেলে! এরপর মনে হতে থাকে এই মফিজ যেন কাকতাড়ুয়ার বাপ-মা হারা সেই বুধা-ই!
তবে মফিজের একমাত্র বড় ভাবী ছিল, যে কিনা একদম মায়ের মতো মফিজের যত্ন নিয়ে গেছে। মফিজের একমাত্র বড় ভাই ছিল অবসাদগ্রস্ত রোগী।
একসময় গল্প এগোতে এগোতে কাকতাড়ুয়ার চিন্তা মাথা থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং গল্পের ভেতরের জীবনের গল্পের আবেগ এই গল্পের ভেতর ডুবে যেতে বাধ্য করে। মফিজ দুর্বল ছাত্র হওয়ায় তার কাছে দুর্বল এবং দারিদ্র্যপীড়িত ছাত্ররাই বেশি পড়তে আসত। কিন্তু মফিজের কঠিন পরিশ্রমে ছাত্ররা ভালো রেজাল্ট করতে শুরু করলেই এলাকার শিক্ষকদের চোখের শূল হয় মফিজ। অভিভাবকদের কানে মফিজের নামে বিষমন্ত্র ফুঁকতে থাকে কতিপয় অসাধু শিক্ষক। যাতে করে মফিজের জীবনে যেন আরও ধস নামতে শুরু করে। এখানে লেখক খুব সুন্দর করে সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। ঠিক এভাবেই প্রাইভেট বাণিজ্যের প্রভাবে সুস্থ সমাজ বিকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
হেডস্যারের বাড়িতে যাওয়া-আসা এবং হেডস্যারের সমস্ত কাজের বিশ্বস্ত সঙ্গী হওয়ায় হেডস্যারের বাড়িতে বেশ যাওয়া-আসা ছিল মফিজের। এখান থেকে হেডস্যারের ছোট মেয়ে লীনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মফিজ! অথচ নিজের দরিদ্রতাকে মুখ্য করে দেখে কখনও নিজের আত্মসম্মান নষ্ট হতে দেয়নি।
এরপর আস্তে আস্তে নিজেকে যোগ্য করে তোলার চেষ্টায় পরিশ্রম করে মফিজ। ইন্টার পাস করে এলাকার ইউপি মেম্বারের মেয়ের সাথে বিয়ের সুযোগকেও হাতছাড়া করে দিয়ে হেডস্যারের কল্যাণে গ্রাম ছেড়ে খুলনা শহরে এসে হেডস্যারের মেয়ের শ্বশুরের সহযোগী হিসেবে থাকতে থাকতে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এখানে এসে তার পছন্দের মানুষ লীনার সাথে একই বাড়িতে থেকেও মফিজ কখনও আত্মমর্যাদা নষ্ট হতে দেয়নি।
এরপর লেখক তার কলমের নৈপুণ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজের অবহেলা, দরিদ্রতার ভয়াবহ অভিশাপের নির্মম চিত্র! মানুষ তার ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কত কিছু করতে পারে, তা বোঝাতে সুন্দর একটি উক্তি তুলে ধরেছেন— ‘পৃথিবীতে মানুষই বড় অভিনেতা। নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এত নিখুঁত অভিনয় আর অন্য কোনো প্রাণি করতে পারে না ‘
সমাজে এরকম শত শত মফিজরা কীভাবে দরিদ্রতার অবসান ঘটানোর দৃঢ় চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে তার পথ দেখাতে চেয়েছেন লেখক।
এ ছাড়াও জীবনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ জীবনমুখী গল্পের সমাপ্তি টেনেছেন এক লোমহর্ষক কাহিনি দিয়ে।
গল্পের মতো জীবন হয় নাকি, জীবন থেকে সৃষ্টি হয় গল্পের? এই প্রশ্নের উত্তর যেটাই হোক না কেন মানুষ তো গল্পের মতোই জীবন সাজাতে চায়। অথচ দেখা যায় গল্পের মতো জীবন সাজাতে যেয়ে সৃষ্টি হয় আরও একটি গল্পের। লেখক ঠিক যেন তেমনই এক চিরচেনা জীবনের গল্প নিয়ে সাজিয়েছেন তার উপন্যাস ‘স্বপ্ন জলে জ্যোৎস্না।’
২ Comments
মুগ্ধ করার মত আয়োজন। ধন্যবাদ প্রকাশক ও সম্পাদক মহোদয়কে।
নামের বানানটা ভুল হয়েছে। রফিকুর রশীদ ভাই প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেন,তোমার নামের বানানের (ী) কি (ি) হয়ে যায়?
এখন তাঁর উত্তরে বলতে হচ্ছে যায়।
তবু আলোচককে ধন্যবাদ।ধন্যবাদ অনুপ্রাণন প্রকশনের প্রকাশক ও সম্পাদক মহোদয়কে।