অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪
১৩ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪
১৩ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মারুফা আফরিন -
সিকস্তি আর পয়োস্তির গল্প- পাথুরে মাটির কিষাণ

বই পর্যালোচনা
বইয়ের নাম: “পাথুরে মাটির কিষাণ”
ধরন :উপন্যাস
প্রকাশনী : অনুপ্রাণন
প্রচ্ছদ : Ayub Al Amin
______________________
প্রমত্তা পায়রার ভাঙন কবলিত নদীজনদের মাঝে বেড়ে ওঠা কবি ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ার হোসেন বাদলের লেখায় বরাবরই উঠে এসেছে অবহেলিত প্রান্তিক মানুষের জীবনগাথাঁ। দুঃখী ও শ্রমজীবী মানুষের বন্দনায় সরব থেকেছেন আজীবন। নির্মোহ যাপনের মধ্য দিয়ে লেখক হয়ে উঠেছেন পৃথিবীর সকল প্রলেতারিয়াত মানুষের প্রতিনিধি। বরাবরের মতো এবারের উপন্যাসেও তিনি সর্বহারাদেরই আখ্যান তুলে ধরেছেন। কৃষক, শ্রমিক , জেলে, ভিক্ষুক ,তাঁতী এমনকি হাটুরে ক্যানভাসারের জীবনাচার অতি সূক্ষ্মভাবে আশ্চর্য মুন্সিয়ানায় উঠিয়ে এনেছেন আলোচ্য উপন্যাসে।
‘জমিরুদ্দিন বলতো নদীর গল্প, নদী ভাঙনের গল্প। সিকস্তি আর পয়োস্তির গল্প। জেলে এবং কৃষকের গল্প। তার গল্পের পাত্র-পাত্রীরা হচ্ছেন আযাহার চৌকিদার, ছাহের গাজী আর বানেছা বুড়ি।’
এক দুঃসহ অর্থনৈতিক টানাপোড়েন নিয়ে বেড়ে ওঠা জমিরুদ্দীনের যাপিত জীবন নিয়েই রচিত সামাজিক উপন্যাস “পাথুরে মাটির কৃষাণ”। নদী ভাঙনে সর্বশান্ত এক কিশোর যার বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও একজন আদর্শ স্কুল মাষ্টার। অকালে বাবা ,বোন ও ভিটেমাটি হারিয়ে নানান চড়াইউৎরাই এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় জমিরুদ্দিনের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। কিশোর বয়সে মনের মধ্যে প্রেম উঁকি দিলেও ভাতের লড়াইয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে চলে যেতে হয় সবকিছু পেছনে ফেলে। ওলটপালট জীবনের ধাঁধায় শূন্যতা পূর্ণতায় বিয়ে, সংসার সবই হয় জমিরুদ্দিনের। স্বাধীনতা পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে মানুষের দুর্বিষহ জীবনের স্বাক্ষী যেমন জমিরুদ্দিন তেমনি মানুষ যে উত্তরআধুনিক যুগের সর্বোচ্চ জায়গায় পৌছে গেছে তার প্রতক্ষ্যদর্শীও তিনি। জীবনের পরতে পরতে যে শিক্ষা গ্রহন তিনি করেছেন তা সঞ্চয় করে জমিরুদ্দিন হয়ে উঠেছেন এক নির্ভেজাল মানুষ। এই উপন্যাসে ভাঙন কবলিত জনপদের সর্বহারা মানুষদের জীবনাচারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। সুবিধাবাদী সমাজব্যবস্থার কড়ালগ্রাসে নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের পাশে দাড়িয়ে তাদেরকে নিজের পায়ে দাড়াতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র জমিরুদ্দিন।
স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি একাত্তরের যুদ্ধের পরে ঘাপটি মেরে থেকে আবার সরব হয়ে ওঠে। নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতাসীনরা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য যাচ্ছে তাই করে যায়। বাম ডানের খেলায় বিত্তবান আর বিত্তহীনের বিপরীতমুখী অবস্থান জমিরউদ্দীনের মনে অস্বস্তির কারন হয়। ওদিকে প্রেম বিরহের দোলাচালে স্থবির হয় যৌবনের উচ্ছ্বলতা। নানান পেশায় যুক্ত হন জমিরউদ্দিন তবে কোনোদিন কোনো অন্যায় তাকে স্পর্শ করেনা।
কথাসাহিত্যিক আনোয়ার হোসেন বাদলের ‘পাথুরে মাটির কিষাণ’ তার অন্যান্য উপন্যাসের একটু ব্যতিক্রমধর্মী বলে মনে হয়। ব্যতিক্রম এ জন্যে যে, উপন্যাসটিতে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, শুধু নারী নয় কখনও কখনও পুরুষকেও বিকৃত যৌনতার শিকার হতে হয়।
লেখকের অন্যান্য উপন্যাসে আপোষহীন সংগ্রামী নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে শাহিনুর, সালেহা, বর্ণা, তানজিলা প্রমূখ। পাথুরে মাটির কিষাণে সংগ্রামী পুরুষের মূর্ত প্রতীক জমিরুদ্দিন নিজে।
সমগ্র জীবন উল্টোপথে সাঁতার কেটে জমিরুদ্দিন দেখেছেন জীবনের নানান রং। বহু কন্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে একজন জমিরুদ্দিন এ সমাজ ব্যবস্থায় নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন তা উপন্যাস পাঠে উপলব্ধি করা যায়।
উপন্যাসের পাত্র পাত্রী অসম্ভব রোমান্টিকতায় ভরপুর এক প্রেম যুগল। তা উপন্যাস পাঠে বিভিন্ন সংলাপে দেখতে পাই।
“জমিরুদ্দিন ভাই, হাতর দিয়া নদীডা পাড়ি দিতে পারেন?
-সোনাইরে, তুই কইলে আগুন নদীও সাঁতারাইয়া যাইতে পারি।”
উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চঞ্চলা, চপলা, রোমান্টিক নারী চরিত্র জামিলা। অর্থ বিত্তের মাঝে বেড়ে ওঠা জামিলার সাহস এবং সংযম পাশাপাশি রাখা তার ব্যক্তিত্বের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র জমিরুদ্দিন হলেও দৃশ্যত বৈদগ্ধ চরিত্র মনেহয় জামিলাকে। জামিলা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় একজন নির্ভীক প্রেমিকা। তার প্রেম স্বভাবসুলভ অথচ তিনি নিভৃতচারীও। পক্ষান্তরে জমিরুদ্দিন একজন শক্তিশালী,আদর্শ ব্যক্তিত্বের প্রেমিক। হয়তো সে কারনেই ঢাকায় যেতে যেতে লঞ্চের কেবিনে জামিলাকে নীরবে কাঁদতে হয়েছে।
উপন্যাসের দু’জন শক্তিমান কৌশলী ও বিচক্ষণ চরিত্র সাতক্ষীরার হেকিম আবদুল হাই ও ভারতের বসিরহাটের হরিপ্রসাদ রায় বাবু । অরেছ শিকদার ,চাঁন গাজী, লালু শরীফ, আলমগীর, কেরামত সর্দার , মালা মুখার্জি , জাকির ভূইয়া ,রুস্তম চেয়ারম্যানসহ আরো অন্যান্য চরিত্র রয়েছে।ঔপন্যাসিক তাদের নিজনিজ অবস্থানে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে যুক্ত করলেও সমগ্র উপন্যাসে হোসেন শরীফ চরিত্রটি আমার কাছে কিঞ্চিৎ দুর্বল মনে হয়েছে।
ভিক্ষুক ফরমান ও তার স্ত্রীদের কাহিনী পাঠককে হাস্যরসে স্পর্শ করবে। রায় বাবুর স্ত্রীর মাতৃত্ববোধে পাঠকের চোখ নিজের অজান্তেই ভিজে যাবে।
উপন্যাসের চমৎকার এক চরিত্র ভিক্ষুক বানেছা বুড়ি,শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গয়জুদ্দিন কারিগরের মা।শতবর্ষ পেরোনো এই বৃদ্ধা ইতিহাসের অনেক কিছুর স্বাক্ষী। অনেক ঘটনা ঘটে গেছে তার চোখের সামনে। রাজগঞ্জ ,বিনয়কাঠি গ্রাম নদীতে বিলীন হওয়ার মত বুড়িও একদিন বিলীন হয় পাথুরে মাটি ভেদ করে পলিমাটিতে। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটে।
সাহিত্যের ইতিহাসে এরকম মাটি মানুষের উপন্যাসই বাংলা সাহিত্যকে সতত সমৃদ্ধ করেছে। উপন্যাসটি অজস্র কাহিনির দোলাচালে ,পাওয়া না পাওয়ার হাসি কান্নার সংমিশ্রণে এক অন্যরকম অনুভূতিতে পাঠককে টেনে নিয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত। সত্তুর দশকের যোগাযোগ ব্যবস্থা ,শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদি একবিংশ শতাব্দীতে এসে সেগুলোর বিস্ময়কর পরিবর্তন লেখক সুক্ষ্মভাবে বর্ণনায় উঠে এসেছে। নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন ঘুণেপোঁকা বংশবৃদ্ধি করে কিভাবে খেয়ে যাচ্ছে সমাজের মগজ। এতোটাই বাস্তবধর্মী লেখা যে পাঠককে কখনো ভারাক্রান্ত করবে আবার পাঠক উজ্জীবিত হবে, উদ্বেলিত হবে , যে কোনো পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার প্রয়াস পাবে, উত্তোরণের পথ পাবে অন্ধকার থেকে।
উপন্যাসটি পড়তে পড়তে পাঠক চরিত্রগুলোর সাথে এমনই পরিচিত হয়ে যাবে যে মনে হবে প্রত্যেকটা চরিত্র আমাদের অতি পরিচিত। একটি ঘোরময় রচনাশৈলী “পাথুরে মাটির কিষান”। স্বাধীনতা পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে মানুষের জীবনযাত্রা,সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়েই আবর্তিত উপন্যাস “পাথুরে মাটির কিষান”।
উর্বর পলিমাটিতে জন্ম নিয়ে বিরুদ্ধ পথ অতিক্রম করে পাথরে ফুল ফোটানোর মতো মানুষের হাসি কান্না, দুঃখ বেদনাগাঁথা অক্ষরের বন্ধনীতে চাষ করে চলেছেন একজন আনোয়ার হোসেন বাদল।সময় ও পাথর হয়ে যায় , দুঃসময় আর শেষ হয়না। আনোয়ার হোসেন বাদল স্বপ্ন দেখেন সুখী সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলা। তাবৎ বাংলা ভাষাভাষীকে তিনি একই সুতোয় গাঁথা দেখতে চান।তার দৃষ্টিতে এপার ওপারের মাঝখানে কোনো কাঁটাতার নেই। পৃথিবীর তাবৎ মানুষ একই শ্রেণিভুক্ত।
“সাহিত্য সমাজের দর্পণ স্বরূপ।” সুস্থ সমাজ গড়তে সমৃদ্ধ সাহিত্যের বিকল্প নেই।” পাথুরে মাটির কিষান” একটি সুস্থ ধারার সমৃদ্ধ সামাজিক উপন্যাস। উপন্যাসটি পড়লে আনোয়ার হোসেন বাদলের অন্যান্য বইও পাঠকের পড়তে ইচ্ছে করবে। মনে হবে তার সৃষ্টি মানেই শেকড়ের টান।
বাংলা সাহিত্যে পাথুরে মাটির কিষাণ কালোত্তীর্ন একটি সৃষ্টি হিসেবে টিকে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
মারুফা আফরিন
০৫/১২/২০২২
——————————————————————————————————————————————————————————————-
আনোয়ার হোসেন বাদল, কবি ও কথাসাহিত্যিক। ১৯৬৫ সালের ০১ মে পটুয়াখালী জেলার পায়রা তীরবর্তী রাজগঞ্জ গ্রামে তার জন্ম। পৈত্রিক জমিজমাসহ গ্রামটি নদীতে বিলীন হয়ে গেলে শৈশবেই কাঁধে তুলে নেন বাবার সংসার।
জীবনযুদ্ধে সামরিক বেসামরিক নানাবিধ পেশায় কাজ করেন তিনি। পেটের তাগিদেই ঘুরে বেড়ান জনপদ থেকে জনপদে। সঙ্গত কারণেই নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে মিশে সংগ্রহ করেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে জড়িয়ে যান শৈশবেই।
মাত্র বাইশ বছর বয়সেই বিয়ে। একটি ভবঘুরে যাপনের পরও স্ত্রী সুলতানার গভীর ভালোবাসায় গড়ে ওঠে সুন্দর এক পারিবারিক জীবন। প্রগতিশীল ও মেধাবী দুই কন্যা উচ্চশিক্ষা নিয়ে কর্মজীবী। স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রী এবং একমাত্র কনিষ্ঠ ছেলেকে নিয়ে বর্তমানে নিজ জেলায় বসবাস করছেন। লিখে চলেছেন দু’হাতে, কাজ করছেন একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে।
এক জীবনের অনিয়মিত লেখালেখিতে তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা মোট বারো-
১. নির্বাসিত বিপ্লবী (কাব্যগ্রন্থ), ২. অপেক্ষার প্রহর (কাব্যগ্রন্থ), ৩. একান্তে কবি ও কবিতা (কাব্যগ্রন্থ), ৪. কফিনবন্দী কবিতা (কাব্যগ্রন্থ),
৫. কাকেদের উৎসবে গণতান্ত্রিক হট্টগোল (কাব্যগ্রন্থ), ৬. শত মঞ্জরী (যৌথ কাব্য), ৭. বিবর স্বপ্ন (গল্পগ্রন্থ), ৮. বাপজানের গল্প (উপন্যাস),
৯. নাটুয়া প্রণয় (উপন্যাস), ১০. অনার্য জীবন (উপন্যাস), ১১. কৃষ্ণপক্ষের আলো (উপন্যাস), ১২. দৃষ্টিপাত দ্বিতীয় গোলক (উপন্যাস)
Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

খাতুনে জান্নাত : বস্ত্তনিষ্ঠ ও মুক্ত মানসিকতায় সত্যান্ধ কবি(সূত্র : তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘নিসর্গে নিমগ্ন নামতা’)

Read Next

অনুপ্রাণন মোড়ক উন্মোচন, বই আলোচনা ও লেখক সম্মাননা অনুষ্ঠিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *