নারী ও নদী এবং…
নদীর ঢেউ কালের স্রোত বেয়ে আসে যখন প্রস্তরের ঠিকানায়
তখন পাড়ের কার্নিশে দাঁড়িয়ে থাকা নারী কি বুঝতে পারে কত ঢেউয়ে কত দীর্ঘশ্বাস তোলা,
নারীর বুক ছিঁড়ে যেমন ভালোবাসার ঢেউ গলে পড়ে পুরুষের আলতো ছোঁয়ায়।
নদীর ঢেউয়ের কি সেই ঠিকানা জানা আছে প্রস্তরের শরীর বিনা
ভালোবাসাত ছুটে এসে ধেয়ে এসে ধারাজলে ভিজিয় দেয়া নয়;
ভালোবাসায় নারী সজলমুখী হয়, কিন্তু
নদীর ঢেউ সে তো সারা বেলা জলেই সিক্ত রয়,
উদ্ভবের ঠিকানা ছেড়ে গতিময় একগেয়ে চলায়
দলছুট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না এতটুকু, কিন্তু
নারীর তো রয়েছে ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার আকুল বাসনা, ঘর বাঁধার স্বপ্ন।
নতুন মুখের শব্দ শোনার সার্থক তৃষ্ণা,
রয়েছে পাওয়ার আনন্দ আর না পাওয়ার বিরহ ব্যথা।
নারী নদীর ঢেউ গুনে শিহরীত হয়, অথচ
সে তো জানে না নদীর ঢেউ তার অঙ্গের সজ্জিত রূপের
ঝলকানো তির্যক পুলকের চেয়ে বেশি কিছু নয়।
তবু….
নারী নদীর কাছেই ছুটে যায় কখনো প্রিয়র হাত ধরে আন্দোলিত হয়, আলোড়িত হয়;
নদীর ঢেউয়ের সাথে মিশে যেতে চায়, বয়ে যেতে চায়, আর
নদী তার ঢেউয়ের গৌরবে আরও উত্তাল হয়।
শব্দ
শব্দ, শব্দ, কতই যে শব্দ নিত্য
গুঞ্জরিত হয়ে চলেছে চারিপাশে
কিছু তার শ্রবণে ঢালে হলাহল,
কিছু তার মধু, অবিরল— উচ্ছল
তবুও যেন সব শুনশান নীরবতা—
রাজ্যপ্লাবী শ্রাবণধারার মতো,
নেমে আসে ছাপিয়ে যত মুখরতা!
হে দুঃখ আমার
তুমি কাছে এলে—
যেন দূরে সরে সরে যাই আমি,
তাই বলেই কি—
দুঃখ তুমি এখনও আমার পিছু ছাড়োনি?
উঁচুনিচু ওই পাহাড়-ঘেঁষা
সারি সারি কৃষ্ণচূড়া—
যেন জ্বলন্ত-লাভার স্রোতের মতো,—
বয়ে চলেছে ঋজু ভঙ্গিতে;
সে ভীরুতায় বসন্ত সঙ্গীতে
বসন্তবাহার নিয়েছে ঠাঁই—
আপন অলক্ষেতে।
তবুও…
তবুও ভালোবাসব
তবুও রাখব মনে,
দাও, যত পারো, নিঠুর ব্যথা!
গড়ো, যদি মন চায়, গগনচুম্বী
দূরত্বের ইস্পাত-প্রাকার,
হৃদয়বোধ্য করে নেব সকল, —ভাষায়;
যতো অস্ফুটস্বরে বলই না কথা—
দুর্বোধ্যঋদ্ধতায়!
অসম স্পর্শ
ভেবেছিলাম দেবে কঠোর বাধা
ছুঁতে গেলে তোমার ঐ হাত;
তাই বুঝি অধরোষ্ঠ দিয়ে স্পর্শের কথা
ভাবিনি একটুও;
পাছে অভিমানের প্রাকার গড়ো অকস্মাৎ।
অলীক ভাবনা আর আকাশকুসুম রচনা
যদিও অদ্যাবধি বিদ্যমান;
পদ্মপাতার মতো ভাসমান—
বিচিত্র এ মানসসরোবরে।
হঠাৎ দেখি—
আমার নগ্ন, দক্ষিণ-হাতটি মুহূর্তেই
তোমার পেলব পরশে হলো মথিত!
এক অভূতপূর্ব রোমাঞ্চ উঠল জেগে— দেহমনে
ছন্দের ঢেউ প্রোত্থিত হতে লাগল থরথর কম্পনে;
এ মন আমার,—
গলায় তোমার পরাতে উৎসুক হলো—
একটি গীতহার— ভালোবাসার উপহার।
সেই যে হলো শুরু….
আমার বিজন কাব্য ভবনে পড়ে গেল সাড়া
এ যেন সাড়ম্ভরতায় অনন্তকালের গহ্বর হতে—
অন্তঃপুরে প্রক্ষিপ্ত, হৃদয়াবেগে আহত
নিত্যকালের প্রহরভেদী
কবিতার মহোৎসব।
প্রিয়তমা আমার,
আজ আবারো সমস্ত দিগন্তপ্লাবী
মহাশূন্য বিদীর্ণ-করে
বলতে চাই—
‘তোমার ভালোবাসায় আমি ধন্য;
তোমার ভালোবাসায় এ জীবনে
জীয়নকাঠির মতো দিয়েছে অমৃতের স্বাদ
ছড়াল প্রাণোদ্দীপনী লাবণ্য’।
বিরাণভূমি
স্বপ্নে তোমার হাত ছুঁয়েছি
বাস্তবতায় আছি বহুদূরে;
এ কেমন হঠকারিতা আজ
উভয় দিকে সংকট— তোমাতে আমাতে?
একাকিত্বটাকে কেন রেখে গেলে
ছাপিয়ে, ক্ষণকালের পূর্ণতাকে?
যাবেই যদি কেন এসে মুখর করলে
হৃদয়ের মাঝে চরের মতো জেগে থাকা
আমার এ নির্জন বিরাণভূমি?
আড়াল
আড়ালে থাকি বলেই তো—
খোঁজো আমায়!
মৌনমত্ত থাকি বলে হও মুখর,
কষ্ট দিই বলে—
বাঁধো নিবিড় ভালোবাসায়!
যে বাঁধন অতি-অচ্যুত-নিগূঢ়
জাগাও এক দূরায়নী টানের উদ্ভব
বিমূর্ত কায়ায়— অশরীরী ছায়ায়!
জিজ্ঞাসা
নির্জন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে
আদিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির মাঠে
দেখছি কত আলুথালু ঢেউ
ধীরে ধীরে যেন প্রলীন হয়ে যাচ্ছে
মহাকালের সুশৃঙ্খল আবর্তনে;
হঠাৎ এ মৌনতার-মহোৎসবকে পণ্ড করে দিতে
বুকের গহন-দ্বারোন্মোচন করে ধেয়ে এল
চরাচর জীবনের অনাহুত কোলাহল!
একটি জীবনে কত আয়োজন
কত বিচিত্র-বাহারের আভরণ,
সময়ের প্রান্ত রেখায় পৌঁছুলে শেষে
সব কিছুই মনে হয় যেন
মায়া মরীচিকাময়!
এ নির্জনতাকে বুকে পুরে নিয়ে
হেঁটেছি অনেকটা পথ;
বর্তমানের কিনারা ঘেঁষে,
প্রতি পলে রচিত হয় স্মৃতিময় অতীত;
ভবিষ্যৎ এসে কড়া নাড়ে বর্তমানের ক্ষীণ দরজায়
না খুলে উপায় কোথায়?
আহ্বানে তার তবু দিতে হয় সাড়া—
ইচ্ছা অনিচ্ছার দোলায় চেপে।
ক্লান্ত পথিক পথকে কেবল মাড়াতে চায়
পর্যটক চায় স্মরণের তরীতে তুলে নিতে,
প্রব্রজ্যাধারী সন্ন্যাসী সে তো ভাবলেশহীন
—সন্মার্গ পথিক!
তার কী-ইবা প্রয়োজন এ আয়োজন সম্ভোগ?
ভবঘুরেরা কেবল কি তবে বারবার দলে যায়
একই পথের কোমল তৃণদল!
‘আমি’ তবে কে?
তোমার ও পথ
তোমার ও পথ কেন এত কণ্টকাকীর্ণ?
পা বাড়াতেই রক্তাক্ত হয় চরণতল!
যে রক্তের ছোপ লেগে রয় মাটির বুকে
জানি না মহাকাল প্রতিশোধ নেবে তা
—কীভাবে?
আজ ইচ্ছে করেই তাড়িয়ে দিয়েছি চাঁদটিকে
আমার আঙিনায় তার দেহ-লাবণ্য ছড়িয়ে
নরম আলো ঢালবে বলে এসেছিল—
রুপোলি চাদর জড়িয়ে।
তার অরূপ বদনখানি মলিন হলেই বুঝি বাঁচি
এই গহিন-স্মৃতির ভার আর যে বইতে না’রি;
ভেবেছি এবার খুব দূরে যাব, দূরে অনেক দূরে
খুঁজে পাবে না তুমি, পাবে না তোমার স্মৃতিকাপালি;
আড়ালে আড়ালে আড়াল হবো সময়ের আবডালে।
ক্ষুদ্র হৃদয়ের দৌর্বল্য স্বীকার করে হয়তোবা কোনোদিন
এসে সঁপে দেব তোমাতে আমার এ জীর্ণ-আমি’টিকে;
হৃদয়ের গোপন কন্দরে উঠবে জ্বলে হয়তো সেদিন
আমার নিভে যাওয়া ব্যর্থ প্রেমের-প্রদীপখানি।
প্রতীক্ষায় তাই আজও এই আমি,—
যাপিত গোপন কষ্টের এ দিঘল রজনী।
স্মরণাবর্তন
সকল কোলাহলকে ছাপিয়ে
নেমে আসে গহিন নীরবতা।
অনুভব করি অনুভূতির চরম পরিবর্তন
প্রতিটি শোণিত-নালিতে ওঠে প্রলয়ঙ্করী
রক্তোচ্ছ্বাস।
ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক কোষে,
প্রতিটি কোঠরে পড়ে নিবদ্ধতার কপাট।
ভেতর থেকে কে যেন এসে—
মুখের উপর বন্ধ করে দেয়
প্রাকার গলা দরজা;
ঝিঝি করা রাতে চন্দ্রাসক্ত বিনিদ্র রাত যাপন।
এ সবই পারম্পর্যহীন এক নিরবচ্ছিন্ন
ঘটনা বলে প্রতীয়মান হলেও—
সময়ের চক্রবাঁকে এক হৃদয়দীপ্ত চাউনির
পুণরাবর্তন বৈ যেন নিছক আর কিছু নয়।
কষ্টের শব্দ
বুঝি কষ্টেরও নিজস্ব এক শব্দ আছে;
শক্তি আছে ভীষণ-তেজী!
ছায়ামূর্তি আগুণ হয়ে স্মৃতির কায়ায়
তীব্র দহন যায় যে কেবল জ্বেলে—
আজ কি তবে বিবাগীর পথটুকুজুড়ে
শূন্যতার স্বরূপ শুধু উঠছে জেগে—
গোধূলির রঙ ছড়ানোর লগ্ন শেষে
নিকষ কালো আঁধার, গায়ে মেখে?
অনেক কথা ছিল…
অনেক কথা ছিল বলবার
যা এখন নিতান্তই নীরব বাণী,
অনেক ইচ্ছে ছিল একবার
হৃদয়ে তোমার হব বিবাগী।
অনেক কথার মরণ হলে
চোখে তখন অগ্নি ঝরে,
অনেক ইচ্ছে ভেস্তে গেলে
অভিমানের মেঘ উড়ে।
অনেক স্বপ্ন গাঁথতে গিয়ে
সয়েছি শত যুক্তি-যাতনা,
অভিসার তোমার রচিতে
গিয়ে, ভুলেছি স্বপ্নকামনা।
অনেক সন্ধ্যার ঝাপসা হাওয়া
নীরবেই করেছ মঞ্জুর সেদিন—
অবাধ্য মনের বোকাটে চাওয়া;
অনেকটাই ছিলে ভাবশেষহীন।
বুঝিনি সত্যিই, এ ছিল কতটা
তোমার দুরন্ত মনের অগোচরে
চলার গোপন অভিপ্রায় ঢাকা
সহজ সন্ধি— সুপ্ত-কঠিন হৃদয়ে।