
আবর্তন
আমি আর তাকিয়ে থাকতে পারি না তোমার দিকে যেভাবে তাকায় প্রেমিক প্রেমিকার চোখে, ছোট বেলায় খালে বিলে দেখেছি রৌদ্র তাপে ভেসে থাকা মৃত মাছের সেঁতসেঁতে চোখ, সে চোখের দিকে তাকালেই কেমন যেন শরীরের লোমগুলো শিরশিরিয়ে উঠত, আজকাল অনেকেই অনেক বড়সড় হয়ে গেছে
ঠিক যেন উঁচু ভবনের মতো, উপরের সে আভিজাত্য দেখতে চাইলে নিজের ঘাড়টিও পিছনদিকে একটু বাঁকা করতেই হয়, তাই ওদিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারি না,
তোমার দিকে তাকালেই চোখ দুটো আমার ক্রমশই
অবশ হয়ে যায়, যেমন অবশ হয়ে আছে এখনো স্টিফেন হকিংয়ের হুইল চেয়ার, ব্ল্যাকহোলের সূত্রের মতো তোমায় ঘিরে অন্ধকারময় যে আবর্তন সে অন্ধকারে কেন জানি আর তাকিয়ে থাকতে পারি না, অবশেষে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম দেখি পাহাড়ও কাঁদছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম কী করে সপ্তম আসমান পাড়ি দেওয়া যায়, সূর্য গ্রহ নক্ষত্র যেন বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে,
নিরুপায় হয়ে পৃথিবীর দিকে তাকাতেই দেখি সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদ দুর্ভিক্ষ ক্ষুধা এবং একটি আসন্ন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘিরে রেখেছে আমায়, আমি তখন কোনো দিকেই আর তাকাতে পারছি না, চোখ দুটো ঘষতে ঘষতে ঘরে ফিরে স্ত্রী সন্তানদের দিকে তাকিয়ে রইলাম তাঁরা আমার চোখে চোখ না রেখে আমার দুটো হাতের দিকে তাকিয়ে রইল, এবার আমি
মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম দেখলাম মা আমার মমতার আঁচল বিছিয়ে অপেক্ষা করছে মহাকাল ধরে আর বিড়বিড় করে বলছেন বাবারে
মানুষের চোখ এখন
হাশরের ময়দানের চেয়েও অনেক ভয়াবহ।
দুর্ভিক্ষ
তাহলে এখনই প্রস্তুত থাকুক হাঁড়ি যেহেতু ঘোষণাপত্র এসেই গেছে দুর্ভিক্ষের
পাহাড়ের কাছে ধরনা দিয়ে কিছু নুড়িপাথর লুকিয়ে রাখব ঘরের এক কোণে, সন্তানদের মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে কোনো একসময় হাড়ির গর্ভে ফুটতে থাকবে ক্ষুধাকাতর সান্ত্বনা
তাহলে এখনই প্রস্তুত থাকুক ভূমিহীনরা তাদের কবরের চাষাবাদ হবে হয়তোবা গোরস্তানের উর্বর জমিনেই, পৈত্রিক কবরেও হানা দিতে পারে পুঁজিবাদী লাশের মিছিল, কোথাও আমার এক টুকরো জমিন নেই চাষাবাদের, দুর্ভিক্ষ বুঝি এসেই গেল যেহেতু ঘোষণাপত্র পৌঁছে গেছে মানুষের কানে কানে।
আমার ঘর যখন আমার একটি রাষ্ট্র
রাষ্ট্র তখন আমার একটি ঘর
দুর্ভিক্ষ যদি এসেই যায়
ভুমিহীন সে ঘরের হাড়িতে একদিন হাসতে হাসতে ফুঁটাতে থাকবো ইউসুফের মতো সুষম বণ্টনের শস্যদানা
দুর্ভিক্ষ যদি এসেই যায়
রাতের আঁধারে চুপি চুপি পিঠে করে বহন করতে থাকবো ওমরের মতো রাষ্ট্রের ক্ষুধা
দুর্ভিক্ষ যদি এসেই যায়, যদি ভেঙে যায় মানবিক সংসদ
তাহলে এখনই প্রস্তুত থাকুক রঙ তুলির স্কেচ
জয়নুল আবেদীনের মতো জলরঙের স্পর্শে এঁকে যাব পুঁজিবাদী লাশের বীভৎস কঙ্কাল।
বৈশ্বিক মন্দা
মায়ের আঁচলে বেঁধে রেখেছি বৈশ্বিক মন্দা
নিংড়ানো ভাতের মাড়ে লবণ ছিটিয়ে স্বাদ বাড়ানোর কৌশল তিনিই শিখিয়েছিলেন…
বাড়ির আনাচে একটু ঘুরে এসেই পুষ্টির সহজলভ্যতা যেন তাঁর কাছে যাদুর চেয়ে অধিক আশ্চর্যময়
ইদানীং সন্তানদের পুষ্টির ব্যাকরণ খুঁজতে থাকে স্ত্রী, আর আমি খুঁজতে থাকি মায়ের আঁচল, কেননা বৈশ্বিক মন্দার চেয়ে মায়ের ভালোবাসার পুষ্টি খুব বেশি শক্তিশালী।
অবগাহন
আমি যখন বেরিয়ে পড়ি বাড়ির আঙিনা থেকে মা তাঁর সন্তানকে দ্যাখে, স্ত্রী দ্যাখে সাজানো সংসারের হেঁটে যাওয়া দৃশ্য, এইসব রূপান্তরিত দৃশ্য নিয়ে মানুষের মাঝে নিজেকে মিলিয়ে ফেলি,
সারাদিন ঘুরে ঘুরে মানুষের বিস্মিত সম্পর্কের বৈষম্যের ক্ষুধা কাঁধে নিয়ে কখনও বা রাষ্ট্র হয়ে উঠি, কখনওবা বিপ্লবের বারুদে নিজেকে ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো করে ফেলি, ভাঙাচোরা হৃদয় নিয়ে ঘরে ফিরে আবারও পারদের মতো সামাজিক হয়ে যাই,
মায়ের দিকে তাকালেই ভুলে যাই কবরের কথা, স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে প্রেমিক হতে হতে দুজনার চোখেই ভেসে ওঠে হেঁটে যাওয়া সংসারের রুগ্ণ শরীর, আমি তখন আর মানুষ থাকতে পারি না কবি হয়ে যাই, কবি হতে হতে পৃথিবীর গোরস্তানে দাফন করতে থাকি সমাজ ও রাষ্ট্রের যত অনিয়ম,
যখনই আমি মায়ের দিকে তাকাই কবরের কথা ভুলে যাই, কবরের কথা ভুলে যেতে যেতে আবারও জীবিত হয়ে উঠি, স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে প্রেমিক হতে হতে হয়ে যাই বৃক্ষ, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র, এভাবেই মানুষের মাঝে নিজেকে মিলিয়ে ফেলি, অবগাহন করি পৃথিবীর অন্ধকারে।
One Comment
মুগ্ধতা, কবিতা পড়ে ভালো লাগলো