অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রিচার্ড ইমদাদুল হক তানজিম – গুচ্ছকবিতা

দাঁড়কাক কবে সভ‍্য হবে 

ঘর থেকে বের হলে ডাস্টবিনে চোখ পড়ে অজস্র দাঁড়কাক

পরিত্যক্ত উচ্ছিষ্ট ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে

আমি নাকে হাত দিয়ে দৌড়াতে চেষ্টা করি

অথচ একটি অদৃশ্য শেকল আমার পায়ে বেড়ি পরিয়ে

টেনে নিয়ে যাচ্ছে আবর্জনার নর্দমায়।

নগর-বন্দরে, অলি-গলিতে, গ্রামের কাদামাখা পথে

নানান পোশাকে হেঁটে যাচ্ছে যত্রতত্র

সবাই মুখরিত, চাপা হাসির বন‍্যা বয়ে যায়।

আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করছি

অথচ কারো কানে পৌঁছায় না আমার ডাক,

আমার আত্মচিৎকার, হাহাকার।

কুৎসিত দাঁড় কাক প্রিয়তমার শাড়ি নোংরা উল্লাসে করছে উলঙ্গ

নদীর ঢেউয়ের মতো দেহ, পর্বত ন‍্যায় নিতম্ব, স্তন

ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়

নর্দমার ফেনা লেপে দিচ্ছে প্রিয়তমার শরীরে

যৌনদ্বার করছে ক্ষতবিক্ষত।

আহ! বিবেক আহ!

প্রতিবাদের প্লাকার্ড নিয়ে বন্দিত্ব ভেঙে ফেলি

নারীত্বের অধিকার পেতে বিক্ষোভে মিশে যাই

আর চুপিচুপি গোধূলির রক্তিম আভা বলে যায়

দাঁড়কাক কবে সভ‍্য হবে।

আদি থেকে আজ

এই মাটিতে হেঁটে হেঁটে আমি সোনালি স্বপ্নের বীজ বুনেছি

দুরন্ত ছেলে বেলার কল্পকাহিনী জবা ফুলের তরুণ

ডালে গেঁথে দিয়েছি নববধূর কানের দুলের মতো।

ভেজা মাটির গন্ধ সানকি ভরে রেখেছি ভবিষ্যতের জন্যে

আমার ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে, আমার নবাগত সন্তানের জন্যে।

আজও আমি সেই গন্ধ টের পাই।

আমি লালন করেছি আমার দেশের প্রত‍্যেক বালুকণার

প্রতি ভালোবাসা, হিমেল হাওয়ার প্রতি ভালোবাসা।

বিশ্বাসঘাতকতার রেণু আমার চোখে আসেনি কস্মিনকালে।

বাংলার জল, ধুলো, কাদা, হাসনাহেনা, গোলাপ

প্রতিমা বানিয়ে হৃদয়ের অন্দরে রেখেছি যতনে।

পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে যে ভালোবাসা বাংলার বুকে ছড়াচ্ছে সুবাস

তা আমার হাজার বছরের চেনা।

কৃষকের ঝরানো ঘাম মুক্তোর নির্যাস ভেবে মেখেছি শরীরে

মায়ার শেকল বেঁধে রেখেছি প্রজাপ্রতির পাখায়

পূর্বপুরুষের রক্ত, মাংস, হাড় মিশে হয়েছে উর্বর

রেখে গেছে বাসযোগ‍্য গ্রাম ও নগর।

সন্ধ‍্যানদীর স‍্রোত টেনে রাখে পাঁজর শতাব্দী কাল

রুপালি জল, কর্ষিত মৃত্তিকায় জন্ম নেয় পুষ্পল বসুধা।

শিরোনাম জানি না 

কবিতার লাইনেই মুখ তুলে ঘুমিয়ে পড়ি। প্রতিটি শব্দ

শুকে মনে হয় এক গেলাস শরবত ঢেলে দিয়েছে  নাকের ভেতর।

ইট পাথরের টুংটাং সংগীত

রুগ্‌ণ কুকুরের ঘড়ঘড় ডাক

মগজের নদীতে ভাসিয়ে দেয় মাঝিহীন নৌকো,

কল্পনার পাতা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায় পুরোনো স্মৃতি।

সারা শরীর ঘিরে রেখেছে অজস্র দানব, চোখের কালো

মণি ঠোকরাতে চায় তীক্ষ্ম চঞ্চু। একটা পেরেক

হাতে আটকাতে চাই কালো থাবা

শহরের অলি-গলিতে ঢুকে পড়েছে ঘন বিষ

নাকে হাত দিয়ে অনবরত হাঁটছে নর্তকী

জিহ্বা বের করে ঝুলছে একটি কুকুর।

তাতেই গড়ে উঠছে দোকানপাট, হোটেল, থিয়েটার

নিঃশব্দে ঢুকে পড়ছি অনবরত, ধূসর

ওরা হাসি মুখে টেনে নিচ্ছে বিষের গেলাস। আর

বলছে ‘এমন সুধা খাইনি কোনোদিন।’

হাঁটছি ফুটপাতে, খেতের আলে

দুই পা পেছনে টানছে সাপের লেজ, দ্রুত টেনে

নিয়ে যাচ্ছে পরিত্যক্ত নর্দমায়।

বিষণ্ন অবসর

এখন আর আগের মতো ব‍্যস্ততা নেই। বলতে পারো পুরোটা সময়

অলসেই কেটে যাচ্ছে। সরষে খেতের রঙিন প্রজাপ্রতি গল্প

করতে আসে না। জানি না কী অপরাধ।

কথার ফাঁকে কোনো ত্রুটি হয়েছে কিনা মনে পড়ে না

নাকি আর্ম ফোর্সের তরফ থেকে জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা

যদি পা বাড়াও বসে যাবে চকচকে বুকে।

তাহলে আমাকে রূপকথার গল্প শোনাবে কে?

সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ পড়ে রবীন্দ্রনাথের শান্ত স্নিগ্ধ

চিত্রপটের উপর, মৃদু হেসে বলে, ‘হে নির্জনতম মানব

তুমি সিপ্রা নদীর তীরে বানাও কুটির।’ সেখানে ঘাসের

মতো স্নিগ্ধ তরুণী খুলে রেখেছে বসন্তের দুয়ার।

তারপর চোখ পড়ে চঞ্চল কিশোর নজরুলের প্রতি। আমার ঝাপসা

চোখের দিকে বাড়িয়ে দেয় একটা রাইফেল। আমাকে বলে

হুলিয়া ভেঙে তৈরি করো স্বাধীন স্বদেশ।

ধুলোয় ধূসরিত বইগুলো আমার দিকে ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়ে থাকে

কাকে তুলে নেব চলছে তুমুল বিরোধিতা।

কিছু দিন যাবত হকার আসাও বন্ধ করে দিয়েছে, দরজার নিচ থেকে

অভ‍্যন্তরীণ কিংবা আন্তর্জাতিক বার্তা কেউ ঠেলে দেয় না

যা দেখে আনন্দে আপ্লুত বা ব‍্যথায় ব‍্যথিত হতাম।

প্রগতিশীল লেখকেরা তাদের তীক্ষ্ন কলম চালিয়ে যাচ্ছে উদ‍্যম বেগে

তা অনেক দিন দেখতে পাই না।

ব্যালকনির কারাগারে পায়চারি করি সারাক্ষণ।

কখনো কখনো ভাবি আমার আত্মা আমার সঙ্গে করছে বিশ্বাসঘাতকতা,

বাতাসের রেণু খিলখিল করে হাসে আর বলে নিজের আত্মা কীভাবে হয় বিশ্বাসঘাতকতা?

উত্তরে বললাম, তাহলে আমি কেন বিষণ্ন?

বিচিত্রা

ঘুম থেকে উঠলে চোখে পড়ে পড়ার টেবিল

কত মনীষীর সৃষ্টি রাশি রাশি স্তূপাকৃত হয়ে আছে

ধূলি পড়ে হয় মলিন, আমি পরম যতনে

সোনার স্পর্শে করি সাফ।

কিছুক্ষণ অধীর হয়ে তাকিয়ে থাকি

বঙ্কিম রচনাবলি, জীবনানন্দ রচনাবলি, শামসুর রাহমান কবিতাসমগ্র

জ্বলজ্বল করে আমার সামনে, কানের প্রাচীরে

তাদের অমৃত শীতল সুরধারা ঢেলে দেয়।

টিভি সেটে ভেসে আসে ‘সুপ্রভাত বাংলাদেশ’।

কিছুক্ষণ পায়চারি করি উঠোনে অথবা মেঠোপথে

তারপর ডাক আসে সকালের নাস্তার, নাকে মুখে কিছু

গুঁজে বেরিয়ে পড়ি কর্মযজ্ঞে, পায়ে বেড়ি পরিয়ে

টেনে নিয়ে যায় নিরস কর্মস্থল।

চোখে পড়ে শুষ্ক পৃথিবীর বক্ষস্থলে নর্তকীর নৃত্য

উৎসুক জনতা ম‍্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে নিরীক্ষণ করছে

নর্তকীর সুঢৌল নিতম্ব আর অর্ধনগ্ন স্তন।

আর আমি দিনের শেষে ক্লান্ত পায়ে ধরি বাড়ির পথ।

রিচার্ড ইমদাদুল হক তানজিম : জন্ম ৭ জানুয়ারি, ১৯৯৭ বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলায়; সন্ধ্যানদী বিধৌত জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নে। দক্ষিণ চর হোগলপাতিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে এসএসসি, বীরশ্রেষ্ঠ ক‍্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজ থেকে এইচএসসি, সরকারি ব্রজমোহন কলেজ থেকে বাংলা বিভাগ অনার্স কোর্সে উত্তীর্ণ হন। বর্তমানে ব্রজমোহন কলেজে বাংলা বিভাগে মাস্টার্স কোর্সে অধ‍্যয়নরত। অনুপ্রাণনসহ বেশ কিছু সাহিত্যপত্রিকায় তিনি কবিতা লেখেন।

 

Read Previous

রূপান্তরের গল্পগাথায় কঠিন বাস্তবের আবরণে অতলান্ত বিষাদ

Read Next

রুদ্র সুশান্ত – যুগল কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *