অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাজ্জাদ সাঈফ-এর গুচ্ছকবিতা

দ্রাঘিমালণ্ঠন 

১.

এইভাবে কোনো কোনো রাতে

দ্রাঘিমালণ্ঠনে আলোকিত হয় সম্পর্কের ঝাড়!

সুদূর বনানী জ্বেলে এক পরাহত জোছনার মুখ

উজ্জ্বলতর, এইভাবে গোপন দরোজা খুলে বেড়িয়ে পড়ছে রাত কোনো সান্ত্বনামুখের খোঁজে, ক্ষীণ স্বরে গায় অন্তিম ব্যঞ্জনা!

এদিকে স্মৃতির বাগান পেয়ে পালকঝরা পাখির ফোঁপানো মুখ অবিকল রক্তবর্ণ লাগে-

যেন তুমি অপাপবিদ্ধ কেউ, অচেনা সবুজবীথি কুড়াতে এসেছো গাঁয়ে! অথচ সমাজের কটুক্তিকে অধ্যাদেশ ভ্রম হয়। কেউ কেউ আরতিভ্রষ্ট করে; যেন-বা খল মেঘে ছেয়ে আছে ঘর, চেনা অক্ষর!

২.

কিছুদূর গিয়ে ফিরে আসছে যে রোদ, সামনে সড়ক, মেঘের বাজনা বুকে নিয়ে মানুষের ফলনমৌসুম জুড়ে সেই রোদ বন্ধুত্বের মত মোলায়েম। গানে ভর করে অতীত অনন্তের। আমরা যে যার মতো সুপার শপ, মডেল মসজিদ, ঢাকের আওয়াজ রপ্ত করেছি এক জন্মে। কিছুদূর গিয়ে ফিরে আসা যায়। একটা সমাজ অজস্র স্বপ্নের নাম। সেই নলখাগড়া স্বপ্নের কাছে বারবার ফিরে আসে কেউ। সামনে সড়ক। বহুদূর ফ্রন্টফুটে এসে ট্রাভেলিং ব্যাগ নিয়ে যে কোনো বাসে আজ উঠে যেতে পারি। স্বপ্নকে সন্তানসম দীর্ঘ চুমুর পর যেকোনো আঘাত আজ ফিরিয়ে দিচ্ছি আমি খল-সমাজের!

৩.

হাঁটতে হাঁটতে যেদিন মানুষের সভ্যতার কাছে চলে আসি, সমাজের অনেক বারণ চলে আসে আমার সামনে!

আজকাল একটি রক্তক্ষয়ী দৃশ্যের ভিতর

নিজেকে খুঁজে পাই এমন দুঃস্বপ্ন আমাকে অস্থির করে।

আর গোলাপ নিজেই এখন সুকৌশল, একটা ফাঁদের মতন; এলিটদের বাগানের মতন!

এখন আর টানে না ছক কষা দীপ্তির নির্মাণ!

অসমতল হতে কতো চৌচির চিৎকার এসে সমস্ত দীপ্যমান চোখকে কাঁদায়, রাষ্ট্র নির্বিকার!

যেন এখনো গারোদের চাষাবাদে নাক সিটকায় সভ্যতার প্রথম দিনটি, কেতাদুরস্ত!

৪.

যেভাবে অসুখ লুকিয়ে রাখে চরাচর, কুয়াশা পেটে করে নিয়ে যায় চাঁদভাব; আরতিধ্বনির দিকে মুখ করে দিগন্তে একটা গাছ সে-রকমই আত্মদানে মুখর, আর সব দিকে আঁধার জড়িয়ে একাকিত্বে উজ্জ্বল, মাথা উঁচু করে মেঘেদের আড়কথা শোনে, তুমি সেই ঘন ইথারের কেউ?

অথচ সমুদ্রকে গিলে হাই তুলছে স্বপ্নের বোয়া সাপ

সামনে রাস্তাঘাট সুস্থির, তিথিনির্জন ধুলিতে ভারি-

এতসব ফাঁপর লাগা অন্ধকারে, সর্বাঙ্গ ডুবিয়ে ঘাসে

যামিনীতুলিতে কে সে তুলে নেয় অস্তিত্বের জলরং?

এই দেখো এতকিছু ভাবতে গিয়ে নির্জনতর হৃদয় লক্ষ্য করে ধীর পায়ে পাহাড়ের শিরায় নামছে গান, অলস চিতার লোমে ডুবছে শিশিরঝরা!

৫.

আমি কি এক স্টেশনে এসে অক্ষর খসে যাওয়া

মাইলফলকের পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, একাই দীর্ঘকাল;

মুখের ওপর রোদ পড়ছে টেরে!

ঘাম ঝরছে পাখিদের ডানা বেয়ে

জামগাছের ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্মৃতি!

মাঝে মাঝে এইদিকে আসে অস্তিত্বসংকট

হর্ন বাজিয়ে আসে ট্রেন, আসে ধান ভানা স্বর

যেন এক দুর্দশা থেকে ছুটি পেয়ে হৃদয় নিয়েছে কোনো

সাগর-ভ্রমণ-টিকিট!

আর লোকের অগোচরে আমি একা পাথর থেকে গেছি এক জন্ম!

৬.

তোমার জীবন তুমি দুহাতে ছিঁড়েছো হেসে

চারদিকে মানবন্ধন, মানুষের মনুমেন্ট;

জীবন নিয়ে গভীর কুয়ার নিচে হাবুডুবু তুমি আর

সামাজিক মস এসে পেচিয়ে ফেলছে ধীরে

কলিজা তোমার; চারদিকে হুল্লোড়, পিতার ভৎর্সনা।

অথচ তোমার কবিতা হতে উঁকি দেয় মেহেদি বাগান;

সরু চোখে চায় ডোরাকাটা সাপ; আকাশের বুক চিরে গহনার মতো চাঁদ, ভাসছে ও হাসছে আম্মার চেনা হাসি!

অথচ নরকবাস্তবতা সারা দুনিয়ায় তার হাত-পা ছড়িয়ে থির; বলিকাঠে গর্দান রেখেই বেঁচে থাকা চর্চা করছে সজ্ঞান মানুষেরা!

তোমার কবিতারা কি বাংলাদেশ? গাঙ্গেয় অববাহিকা?

মিছিল এসে দরোজায় অপেক্ষমান, ফিরবে নাকি তুমি বিস্ময়-বিপ্লবে?

৭.

মুভির ভূতের মতো আওয়াজ করে চলে গেল অতিদূর ট্রেনের বগি, পাবে সেইখানে যেতে মেঘজর্জর আকাশের দেখা, কত নির্জন বুকে চলে কাঠচেরাইয়ের কল, কত বুক মহাশূন্য!

আর নিজ বিষয় আশয় ফেলে এসে দূর মফঃস্বলে ঘর যে বেঁধেছে হাওয়ায়, তাঁকে পাবে নিঃসম্বল বার্ধক্যে, অথচ তাঁহার শব্দ জমানো ঝোঁক আর বইপত্রে ঠাসা মস্তিষ্কে ছিল শনে বাঁধা গেরস্থালি, সামান্য আলোয় ফোটা এক ফুল দুই পত্রের প্রেম, একদিন, কোনো একদিন প্রেমে!

মুভির ভূতেরা কারো খামচে ধরেছে গলা। আমাদের শোক নাই প্রতিরোধ নাই শুধু কবিতার ছলেবুনে রাখা আছে জীবনাবৃত্তি!

প্রেম এক সুজলা প্রার্থনা, কখনো সে পাপ।

এতে রক্তও ছাড়ে না রক্তরে পণ গুনে, প্রেমের মাশুলে!

৮.

এতসব ভাবনাবৃত্তে এসে নিস্তরঙ্গ লাগে, উলবোনা মেঘ নিয়ে হাবুডুবু মস্তিষ্ক-

থামছেই না এ-রকম রেডিয়োর গান মনে করি আজ, মনে করি সাতানব্বই সাল, মেঘের ফাটলে ঝুঁকে আছে মালতীমদিরা চাঁদ!

এতো যে নীরবতা নিয়ে চেয়ে আছে বাজারের ব্যাগ, গলা উঁচু করে আছে চিচিঙ্গা, ভারাক্রান্ত লাগে নাকি তোর, ধীরে ওড়া ঘুড়ির মতন সরু কণ্ঠে ডাকে নাকি নক্ষত্রপুঞ্জ নাকি সুপ্ত কোনো গ্রহের আলেয়া?

যে আজো নিজেকে দেখে রাখতে জানে না তার ঘর আলো করে আছে মুঘলবর্ণ ঝার; সেইদিকে চেয়ে থেকে গাঙে যে ঢেউ ওঠে তার বুকে এসে মিয়া তানসেন জপ করছেন নাকি কালরাত্রি?

মনের বাগিচায় ঘুড়ি ওড়াচ্ছে কেউ, আর কারো

মুখস্থ জ্ঞান হতে সানাই বাজায় আহসান মঞ্জিল!

৯.

আমাকে দিয়েছো বুকে জ্বরের সত্যতা, সারাটি রাত বধির শিশিরঝরা;

হে বিষাদবাহু, আগুনপত্রালি, যা কিছু জীবনে নিবিড় লাগে, অস্তকে আপন ভেবে লঘু হয় সূর্য নিজে, নিজেরই ছায়ার কাছে হাত পেতে দাঁড়ায় আকাশ, সব গান অধিবাস্তব!

অযুত কবর ডাকে নাম ধরে আমাকে শুনি, স্বপ্নকে স্বাধীন ভেবে গোধূলিতে বেঁচে থাকা যায়, যে-রকম ইতিহাস বেয়ে মহীরুহ মধু দত্ত; ডানা ঝাপটানো বর্ণমালায় অপঘাত কোনো সাধনার ফল?

আমাকে নিয়েছো তুলে দলছুট একাকিত্বে, একঘেয়ে নির্জনতায়; ঘিরে থাকে বজ্রধ্বনি, ঘিরে থাকে ঝড়ের আভাস, এই পথে ঘনিষ্ঠ যে তার নাম দুঃস্বপ্ন!

১০.

চেয়েছিলাম ছায়ার পত্রালি আর কিছু অভিমান-পিছুটান; চেয়েছিলাম কলোনির ছাল ওঠা ছাদ, হাঁসেদের সাঁতার কাটা সুর। ততোধিক চাইনি কিছুই আমি, আর এত সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার ধারে তোমাকে অগ্নিগর্ভ লাগে, সুরমাটানা চোখ, কবিতায় কতটা জেগেছো রাত?

হাত ফেলে ছুটে যাচ্ছে ছোঁয়া, কিছুদিন শিরিষের ডালে মেঘ। গান থেকে আলগা হচ্ছে কথা, কিছুদিন একাকিত্বের ভীতি।

দেশ থেকে ছিটকে পড়েছে প্রেম, চিরদিন বিরহ বাস্তবতায় ঘুরপথে তার দিকে ছুটে আসে একঘেয়েমি! কোথা থেকে কান্না শিখেছো তুমি? কতটা দূর রিলকে ফোটায় গোলাপ?

আমার মতন ধৈর্য হারানো নাবিক, তোমার বুকে সমুদ্র পাড়ি দেবে! হৃদয়ে কাঠের সাঁকো নড়ে আর সন্ধ্যায় চাষের জমিতে হাঁটে শূকর সম্প্রদায়!

এই গ্রহ শৃঙ্খলিত কোনো পোপের তর্জনীতে।

সারারাত রাজ করে মগজবাগানে সাপ, বিষধর সাপ।

১১.

লিখি অনিশ্চয়ের ভাষা, গাছের শেকড়ে লিখে রাখি নদীস্পর্শ, লিখে রাখি নীড়ের ভিতর হতে পাখা আর হেমন্ত পরিচিতি- আজ দ্বিধা এসে ফুল। শতমুখী ফুল, অযুত ভঙ্গিতে ফোটে!

তিরবিদ্ধ বুক মেলে কাছে ডাকছে সমুদ্র

আর ক্ষতস্থানে নেমে রক্তকে ঢাকছে মেঘ

চারদিকে ঘনবসতি পেয়ে সেই দু-নলা মেঘ

খোশগল্প করে, যেন রূপকথা, মাটির নিকটে নেমে এসে পেয়ে গেছে নিজের দেখা;

সেইদিকে পানের বরজ এসে ঘোড়াশাল পেয়ে জাগে;

যেন পয়সার পিঠে ঝনঝন করে স্বপ্ন, মুদ্রায় আঁকানো রাজা-উজির হাঁটে অন্তহীন ঘাসের ওপর। কথারা পোশাক ছেড়ে বেরিয়ে এসে, নিজ মনে ভাঙে মানুষের খোয়াবের মানে!

১২.

সমাজের ছলনামালা গলায় জড়িয়ে ফিরে আসি ঘরে।

দেয়ালে আছড়ে পড়ে ছায়া, বেঁচে থাকার একটা ঘ্রাণ আছে শুধুমাত্র মৃতরাই টের পায় তা।

একদিন খুব ঝড় ঘরে এসে ঢোকে, করমর্দন করে, চারিদিকে অস্তপ্রমাদ হাওয়া, অনেক উঁচু হতে দীর্ঘশ্বাস প্রেরণ করে মেঘ, ব্রিজের কিনারে নেমে আসে বিজলিজ্বলা আলো!

একদিন নিজের‌ই ছায়ার দিকে তেড়ে যাবে শতখণ্ড হৃদয়ের ফণা, এইভাবে, যেন সাপ ও প্রফুল্ল ময়ুর এসে মুখোমুখি হবে সূর্যাস্তে, আর দংশন তার সমস্ত শক্তিতে নীল; মানুষ একে অন্যের দিকে চেয়ে কথা বলবে আপন মনে, সফলতা এক ছলনার ওপর আরেক ছলনার জয়োৎসব; এইদিকে স্বপ্নও পোশাকে ঢুকেছে আজ, চুল আচঁড়াচ্ছে আয়নায়;

সমস্ত দৃশ্যকে ঘিরে থাকে হাঁটার ভঙ্গিমা, যেন নিখোঁজ মানুষ ফিরে এসে হাই তোলে নিজের ভিতর, এভাবেই ফিরে আসা যায়; আজানের ধ্বনি কান ঘেঁষে যায় তারপর, শনের খড়ি পুড়ছে চায়ের জ্বালে, হাত নেড়ে কাছে ডাকে বরই-সিজন।

Read Previous

রীতা ইসলামের যুগল কবিতা

Read Next

শিকড়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *