অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আলী ইব্রাহিম -
ব্রহ্মপুত্রের গল্প

শহর থেকে বেদনা কুড়িয়ে ফিরেছি গ্রামে। মাতৃক পরশ নিতে।

বাপের কাস্তে, কোদালের দিন উঠে দাঁড়ায় উত্থিত এই দুহাতে।

বাঁধের সাথে বাঁধা দাদার বয়স্ক সেই নৌকা এখনো কী সপ্রতিভ!

এই ব্রহ্মপুত্র যাওয়ার পথে একটা ভূতের বাড়ি ছিল।

আব্বা বলেছিল, সাঘাটা বাজারে পাকুরগাছে মাথা রেখে

আর বিলবস্তার বটগাছে পা রেখে ঘুমিয়ে থাকত ভূতটা।

ছোটবেলায় আব্বার কাছে ভূতের গল্প শুনতে শুনতে

আমরা ছোট তিন ভাই বোন ঘুমিয়ে পড়তাম।

সেই বট ও পাকুর গাছ এখন আর নেই।

সেই ভূতের বাড়িটা এখন হয়েছে ডাকবাংলো।

ব্রহ্মপুত্র সরু হতে হতে সরে গেছে পূর্বদিকে।

তার সাথে ভূতটাও নাকি চলে গেছে।

আব্বা বলত, সেই ভূতটা ব্রহ্মপুত্রের মাছ খেয়ে বেঁচে থাকত।

তার চলাফেরায় বাধা পেলে সে নাকি মানুষের পথ আটকাত।

একবার বাঁশঝাড়ের মাঝরাস্তায় বাঁশ সরিয়ে বাড়ি ফিরে

ভূতের ভয়ে পরাণ মাঝির ছেলেটা মারাই গেল।

সেই গল্প শুনে আমরা ভয়ে আব্বার বুকে লুকিয়ে থাকতাম।

এরপর থেকে বাজার করে আর খেলা শেষে

সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরেছি আমরা। ভয়ে ভয়ে।

আব্বা বলেছিল, গণ্ডগোলের সময় আমার মা, বড় ভাই ও

চাচা-চাচিরা বাগবাড়ী চরে আশ্রয় নিয়েছিল।

কিন্তু আব্বা তার বাপের ভিটায় থেকে খাবার রান্না করে

মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিত।

একদিন এক মিলেটারি আব্বার খোঁজে বাড়িতে এসেছিল।

আব্বাও কৌশলে ওই পাকসেনাকে আমাদের পুকুরে

ডুবিয়ে চুবিয়ে মেরে ফেলেছে!

পরদিন শতাধিক মিলিটারি বেয়নেট হাতে দাঁড়িয়ে থেকে

সেই বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

আব্বা তার আগেই পূর্বপুরুষের ভিটা বাগবাড়ীতে চলে যায়।

আব্বা বলত, এই যে আলগা বেপারী, মোনাক মণ্ডল, নরেশ পাল;

গণ্ডগোলের সময় ভূতের ভয়ে একদিনও ঘর থেকে বাইরে বের হয়নি,

এই যে মালেক বাহার রাজাকার ছিল। রাজাকার!

অথচ আজ সেই লোকগুলো মুক্তিযোদ্ধা হয় কীভাবে? কী করে?

৮৮’র বন্যায় সব ফসল নষ্ট হওয়ার পর থেকে আমাদের ঘরে ভাতের অভাব।

এরপর থেকেই আমরা চার ভাই, দুই বোন পেটের ক্ষুধা বুঝেছি। আহা ক্ষুধা!

আমরা তখন অনেক ছোট। ব্রহ্মপুত্রে মাছ ধরে ধরে খুঁজেছি জীবন।

সেই থেকে আমাদের আর তিনবেলা ঠিকমতো খাওয়াই হয়নি।

লঙ্গরখানার বদৌলতে তবু কিছু পুষ্টি সঞ্চয় করতে পেরেছিলাম।

সেই থেকে আব্বার চোখে অন্ধকার; আর তার সঙ্গী ওই ব্রহ্মপুত্র।

আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো ক্রমেই নিষ্প্রভ হতে থাকে। আব্বা তখন একা।

সেই ইতিহাস আমরা ভুলিনি।

সেই থেকে আমরা মাটির অন্তরে আলো জ্বেলেছি।

আর আব্বা আমাদের প্রাণে ঐকিক হয়ে বাজতে থাকে।

তাই শহর থেকে বাড়িতে গেলেই আব্বার কাছ ঘেঁষে বসতাম।

গল্প শুনতাম। আব্বা আমাকে বীজের গল্প বলত।

বৈত উৎসবে বোয়াল, চিতল আর মাঠে মাঠে মহিষের গল্প।

কব্জি ডোবা দুধের গল্প। মেঘের গর্জন ও নৌকার গল্প।

মুক্তিযুদ্ধের গল্প। ভূত ও ব্রহ্মপুত্রের গল্প।

আব্বা এখন ঘাসফুল হয়েছে।

দাদার ভিটায় মায়াবী অতীত।

আর আমি আব্বার সরলতায় বিস্মিত।

আর শহরের বিভীষিকা ভুলে আমিও এখন চাষা।

সেই ব্রহ্মপুত্র আবার ফিরে এসেছে বুকের ভেতর।

সেই বাপের ভিটা এখন আর নেই।

আর আব্বার সাড়ে তিন হাত মাটি এখন শুধুই বিস্মৃতি।

আমি কি তবে এই ব্রহ্মপুত্রের কেউ নই!

ব্রহ্মপুত্র একা হয়ে যায়। আর এই আমি একা। একা।

 

+ posts

Read Previous

মুদ্রিত দুঃখের ধারাপাতে

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৫ম সংখ্যা (অক্টোবর-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *