অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৪, ২০২৪
১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৪, ২০২৪
১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তালুকদার লাভলী -
অগ্নিবাসর

তিলকা প্রতি মঙ্গলবার মন্দিরে গিয়ে শিবের মাথায় জল ঢালে, পুজো দেয় আর প্রার্থনা করে। কিন্তু তার মনে এ পর্যন্ত বিন্দুমাত্র ভক্তি জাগ্রত হয়নি কঠিন মৃত্তিকায় গড়া শিবঠাকুরের ওপর। প্রার্থনারত চোখে ভেসে ওঠে শুধু কলিযুগের শিব, মনের ভেতর যে বসে আছে একঠায়; যে শিব তার বুভুক্ষু শরীরে সেচ দিতে চায়, চাষ করতে চায় অনাবাদি ভূমি। মনের ভেতরে তার দোলাচল ভাবনার এক জগৎ ধারণ করে। পুজো সেরে প্রসাদ হাতে মন্দির থেকে বের হয়ে আসে তিলকা। উদ্ভ্রান্তের মতো তার চোখ দুটো খুঁজতে থাকে কলিযুগের শিবকে।

আচমকা বিষাক্ত মেঘ এসে আচ্ছন্ন করে দেয় তিলকার মনটাকে। জ্বলন্ত কাঠের আগুনে জল ঢালার পর যেমন দপ করে নিভে গিয়ে পড়ে থাকা কয়লা থেকে তীব্র উত্তাপ বেরোয়, তিলকার মনের অবস্থা ঠিক তেমন হয়ে যায় স্বামী নামক পুরুষটিকে দেখামাত্রই। ওর ইচ্ছে করছে প্রসাদের থালাটা স্বামীদেবতার মুখে ছুঁড়ে মারতে। কিন্তু উপায় যে নেই। শত হলেও তার স্বামী পূজনীয় ব্রাহ্মণ। তার পায়ে জল ঢেলে, তাকে তুষ্ট করে বর নিতে পারলেই স্বর্গ হাতের মুঠোয় চলে আসবে। সে কারণে মনের আগুন চাপা দিয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে চলে আসে সে।

ওর চলার পথে রাগী সূর্যের মতো কড়া চোখ তুলে চেয়ে থাকে স্বামীদেবতা। যদিও পেছন ফিরে তাকায়নি তিলকা, কিন্তু তার মনশ্চক্ষু তা ঠিক ঠিক বলে দিচ্ছে। যেখানে সবাই তার ব্রাহ্মণ স্বামীটিকে ভক্তির মাধ্যমে মনের বাসনা ব্যক্ত করে, ইহলৌকিক-পারলৌকিক মঙ্গল কামনা করে পায়ের ধুলো মাথায় নেয়, সেখানে তিলকা বরাবরই স্বামীদেবকে প্রত্যাখ্যান করে আসছে। একে তো স্বামী হচ্ছে ভগবান, তার ওপর ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ। তাকে প্রত্যাখ্যান করার ফলস্বরূপ তার ঝুলিতে জমা হচ্ছে নরক ভোগের অসংখ্য ফল।

বাড়িতে ঢোকামাত্র বিস্ফোরিত হয় তিলকার ভেতরের চাপা আগুন। উঠানের মাঝখানে ছুঁড়ে মারে প্রসাদের থালাটা। প্রচণ্ড শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ছুটে আসে উঠানে। এ যেন বড়ো কোনো দুর্যোগ। সবার চোখ কপালে ওঠে, মাথায় হাত। সর্বনাশ! সর্বনাশ হয়ে গেছে! পুজোর থালা বলে কথা! এ যে চৌদ্দগোষ্ঠীকে নরকে নেবার ব্যবস্থা করেছে তিলকা! পুরো বাড়িতে হইচই পড়ে যায়। মহিলারা ঠোঁটে ঠোঁটে শত শত ভর্ৎসনার চপেটাঘাত করতে থাকে তিলকাকে। কেউ কেউ তার দিকে তেড়ে আসে। বিনুমাসি সবাইকে থামিয়ে দেয়। বলে, ‘ক্ষিতীশ বাড়ি এসে ওর বিচার করবে, তোমরা যে যার ঘরে যাও।’

তিলকা চুপটি করে বসে আছে নিজ ঘরে। ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছে সবাই। সূর্যের তেজও ফুরিয়ে এসেছে। বিনুমাসি সন্ধ্যাপ্রদীপ আর ধূপকাঠি জ্বেলে দিয়েছে ঘরে ঘরে। ঘর বলতে থাকবার একটা ঘর আর রান্নাঘর, পুজোর ঘর ও গোয়ালঘর। সংসারে সদস্যসংখ্যা মোটে চারজন। সচ্ছল অবস্থা। ঘরগেরস্থালির মূল দায়িত্বে আছে বিনুমাসি। দশ বছর আগে স্বামী নিরুদ্দেশ হবার পর থেকেই মাসি এখানে। আর খেতখামার, চাষাবাদ ও দেখাশোনা করার জন্য রয়েছে রাখাল মদন। ব্রাহ্মণ ক্ষিতীশ এ গ্রামের মন্দিরের পুরোহিত। পুজো-আর্চার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় তার দিনগুলো।

বিনুমাসি সন্ধ্যাপুজো সেরে ঘরে ঢুকতেই চোখ কপালে তুলে চিৎকার করে, ‘ছ্যা ছ্যা! পুজোর ঘর থেকে বের হয়েই ছোটো জাতের মুখটা দেখেতে হইল রে।’

মদন গোয়ালের কাজ শেষ করে ঘরের বারান্দায় এসে বসেছিল সবে। কাপড়ের আঁচলটা ওপরের দিকে তুলে বিনুমাসি অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোরে না বোইলেচি, সকাল-সন্ধ্যায় আমার সামনে পড়বি নে।’

তিলকা ঘর হতে বের হয়ে ভয়ে ভয়ে বলে, ‘মদন জলখাবার খেতে অ্যাইসেচে গো, মাসি।’

‘সেটা তো জানি, অলক্ষুণে বউ, তুমি আর এই ছোটোজাতটার হইয়ে সাফাই গাইতে অ্যাইসো না। তুমি তো নিজেই নরক হাতে বইসে আছো। এই সোবে তোমার আর কী হইবে! আমার হইয়েচে যত জ্বালা গো, যত জ্বালা, দুর্গা দুর্গা! নরক থেইকে রোক্ষে কোরো ঠাকুর, রোক্ষে করো।’

তিলকা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ঘরে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। এমনিতেই সে অপরাধী, তার ওপর আবার মদনের পক্ষ নেওয়া, মহা অন্যায়। এতকিছুর পরও সে মদনের অপমান সহ্য করতে পারে না। ওর দিকে তাকালে মনটা আর্দ্র হয়ে ওঠে তিলকার, মনের কোথায় যেন নড়ে ওঠে। কেন এমন হয়- উত্তর জানা নেই তার। বিনুমাসি এখনো নিজের ঘরে বসে পানদানিতে পান ছেঁচছে আর বকবক করছে।

মদন সব সময় এই বুড়ির ভয়ে দূরে দূরে থাকে। কিন্তু আজ ভুলবশত একটু আগেই চলে এসেছিল, যার উপযুক্ত মাশুল পেয়েছে সে।

তিলকা প্রদীপ হাতে ঘরের বাইরে পা রাখে। মৃদু আলোয় চলার পথটুকু আবছা দেখা যায়। পা টিপে টিপে ঢুকে পড়ে মদনের ঘরে। ঘর বলতে বাঁশ-বেত দিয়ে তোলা এক চিলতে ছাউনি, চারপাশটা পাটশোলা দিয়ে ঘেরা। খেজুরপাতার পাটিটা সব সময় বিছানো থাকে। এর আগে শুধু খড়বিচালি বিছিয়ে ঘুমাত মদন। এই পাটিটা নিজহাতে তৈরি করে দিয়েছে তিলকাই। চিত হয়ে শুয়ে আছে মদন। মোটা পুরুষালি ঠোঁট, চওড়া কপাল, শক্ত দুটি বাহু, সুঠাম দেহ, স্ফীত বক্ষ। শিবমন্দিরে এই শিবকেই প্রার্থনা করেছে, আর জল ঢেলেছে তিলকা। কিন্তু প্রথার শেকল ছিঁড়তে পারেনি কিছুতেই। ভাঙতে পারেনি ধর্মের তালা। যদিও তার তৃষিত সত্তায় হাহাকার! ক্ষুধার্ত যন্ত্রণাগুলো বুকের ভেতর হাতুড়ির মতো আঘাত করে সর্বক্ষণ।

তিলকাকে ভেতরে ঢুকতে দেখেই ধড়মড় করে উঠে বসে মদন, ‘বউদি! তুমি?’

মদনের কথার উত্তর না দিয়ে পাশে বসে তিলকা। ওর মাথায় আলতোভাবে ডান হাতটা রেখে বলে, ‘মদন, তোর রাগ হইয়েচে জানি। বিনুমাসির এসব নিত্যদিনের ঘটনা। রাগ করিস না রে।’

‘আমার মোতন ছোটো জাতের জইন্যে এইডাই তো স্বাভাবিক, বউদি। আমার জন্যই তো অভিশাপ দিয়ে। যারে ভগবান বানাইছে অচ্ছুত কইরে, তার জইন্যে এইডা তেমন কিছু নয়। আমি কোনো কষ্ট পাই নাই, বউদি।’

মদন কী বলছে সেদিকে খেয়াল নেই তিলকার। ওর ভেতরে বেসামাল ঢেউ। পড়ে যাওয়ার ছল করে খুলে ফেলে মাথার ঘোমটা। বুকের বসন ইচ্ছাকৃত এলোমেলো করে দেয় অনেকটা। মিটিমিটি আলোয় স্পষ্ট হতে থাকে মদনের চোখ দুটো। আড়চোখে দেখে নেয় সে। ওর ভয়ার্ত চকচকে চোখ দুটো তিলকার বুকের দিকে। কিছুটা অংশ উদোম। যেহেতু গায়ে জামা নেই। এ সমাজে এখনো শাড়ির নিচে জামা পরার সভ্যতা চালু হয়নি। বর্তুলাকার নিতম্ব দুটি যেন কোনো শিল্পীর তানপুরা। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে আকর্ষণীয় ঢেউ উথাল-পাতাল করছে। ওর শরীরে চরম উত্তেজনা। মদনের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ হবার উদ্যোগ নিতেই সামাজিক প্রথার চাবুক তাকে আঘাত করলে মদনের ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে তিলকা।

পুরোহিত ক্ষিতীশ বাড়ি ফিরেছে কিছুক্ষণ হয়। খেতে বসেছে। বিনুমাসি অনেক যত্ন করে খাবার তুলে দিচ্ছে তার পাতে। অশান্ত মন, বিভ্রান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে তিলকা। ওর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না তুলেই খাওয়ার জন্য ডাকে বিনুমাসি। ওর পেটে এ মুহূর্তে ক্ষুধা নেই। ছল করে উপোসের কথা বলে বিনুমাসিকে।

ক্ষিতীশ বিড়ি ফুঁকে পান চিবুতে চিবুতে এসে শুয়ে পড়ে তিলকার পাশটায়। কুড়ি বছরের ভরাট যৌবনবতী তিলকার জীবন জলহীন মরুভূমির মতো এক ফোঁটা জল চেয়ে হাহাকার করছে। দীর্ঘদিন বৈশাখের আকাশে জমতে থাকা মেঘের মতো তার মনের আকাশে জমেছে গভীর আকুতি। ক্রমে ঘনীভূত হচ্ছে তৃষাতুর হাহাকার! মদনের লোমশ বুক, ভরাট কণ্ঠ, আবেগমাখা ধারালো চাহনি দিশেহারা করে দিয়েছে তিলকাকে। ঠিক তখন ষাটোর্ধ্ব লোকটির শীর্ণ কর্কশ হাতটা ওর বুকের ওপর পড়তেই ছ্যাঁত করে ওঠে তিলকা। ওর ইচ্ছে করছে ভগবানরূপী পতি নামক লোকটিকে খুন করতে। রুক্ষ যৌবনের বিষাক্ত জল ঢালবে মাঝপথে আর কর্দমাক্ত পিচ্ছিল জমিতে উত্তেজনায় বিচলিত হয়ে গুলি খাওয়া আহত পাখির মতো ছটফট করে রাত্রি পার করতে হবে তাকে।

বভুক্ষু হৃদয়ে হাহাকার! উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজে খুঁজে কলিকালের শিবদেবকে কাছে পেয়েও লাম্পট্য প্রথার কশাঘাতে থেমে যায় তিলকা। সমাজের কঠোর প্রথা জোর করে আঁকড়ে ধরেছে তাকে। সে পুরোহিত ব্রাহ্মণের সহর্ধমিণী বলে কথা। সে কারণে এ সমাজে তার নিরন্তর সংগ্রাম। এখানে অশিক্ষা আর কুসংস্কারকে কুলঙ্গীর সাঁঝের প্রদীপ করে জ্বালিয়ে রাখা হয়। কুলীন ব্রাহ্মণের কন্যা হওয়ার অপরাধে আজ তার এই শাস্তি। কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে পা দিয়েছিল সবে। পিতার কাঁধে বোঝার জঞ্জাল। কন্যাদায়ের সে জঞ্জাল সাফ করতেই সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে যায় পঞ্চাশোর্ধ্ব বিপত্নীক পুরোহিত ব্রাহ্মণ ক্ষিতীশকে। এ যেন সাপের পাঁচ পা দেখা। একদিকে পিতা কন্যাদান করে মুক্ত হন আইবুড়ো কন্যার অভিশপ্ত পিতৃত্ব থেকে। অন্যদিকে পাকাপোক্ত হয় তার চৌদ্দপুরুষের স্বর্গপ্রাপ্তি।

আর এ স্বর্গকে রক্ষা করবার জন্যই প্র্রতিনিয়ত লাম্পট্য প্রথার জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে তিলকা। একদিকে সমাজ-ধর্ম, অন্যদিকে শরীরের বেহিসাবি উন্মাদনায় কাতরাতে কাতরাতে পার করে আসছে পাঁচটি বছর। ক্লান্ত যৌবনবতী তিলকার বুভুক্ষু হৃদয়ে এখন শুধু করুণ রাগিণী। তার মনসেতারে বিষাদময় সুরের আবেগ।

কুড়িতম বসন্তের শিরশিরানি আজ মদনের চোখে। শরীরেও হালকা রঙের আভা। গতরাতের তিলকার ঈষৎ স্পর্শ এখনো লেগে আছে ওর গায়ে। প্রথম নারীর স্পর্শ বলে কথা। নতুন স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে ওর মনসাগরে, মৌমাছির আনাগোনা প্রকৃতির যৌবনে। তিলকার লাজনত মুখ এবং চোখের প্রশ্রয়ী চাহনি উসকে দেয় মদনের শরীর। রাঙিয়ে দেয় মন। যেন মুঠো মুঠো পুষ্প ছড়ানো আবিরের নেশা জাগানো মহুয়ার মদিরতা ভরা হোলি খেলা চলছে আকাশের যৌবন জুড়ে।

দিনরাত গড়িয়ে গড়িয়ে বেহিসাবি যৌবনের তাণ্ডবে তিলকার সতীত্বের বেড়ি ছিঁড়ে যায় প্রকৃতির কশাঘাতে। প্রথম প্রথম সতীত্বের অহংকারকে বুকে ধরে, সমাজের চোখে নিজেকে সম্মানিত স্ত্রী হিসেবে দিন যাপনের চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু দিন দিন তার যৌবনের তীব্র ঢেউয়ের কাছে বাঁধ মানে না ধর্মীয় প্রথা। আকাশ যখন ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন, চাঁদের চোখে ঝিমুনি আর পৃথিবী ডুবে আছে মরফিনের মাদকতায়, তখন তিলকার বুকে দাউদাউ আগুন। সে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় তিলকার সতীত্ব। একদিকে দ্বিধা, অন্যদিকে মুক্তি- এই আপাত অনুভূতির স্রোতে ভাসতে ভাসতে সে পা রাখে ঘরের বাইরে। চারদিকটা সুনসান। থেকে থেকে বাদুড়ের ডানা ঝাপটানি ঘোষণা দিচ্ছে রাতের প্রহরের। সমস্ত গ্রাম গভীর ঘুমে নিমগ্ন। শুধু তিলকা অপেক্ষায় ছিল এই মুহূর্তটির জন্য। পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় সে। মেটো জ্যোস্নায় পথ দেখতে খুব একটা অসুবিধা হয় না তার। আকাশটা যেন পাহারা দিয়ে নিয়ে এসে তিলকাকে দাঁড় করিয়ে দেয় মদনের ঘরের সামনে। যদিও সতীত্ব ভাঙবার দুঃসাহস নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে, তবুও সাবধানি চাবুকের চোখরাঙানিতে কাঁপন ধরেছে তার শরীরে। কপালে চিন্তার ভাঁজ। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে উঠছে। শুষ্ক ঠোঁটটাকে জিভের লালায় একটুখানি ভিজিয়ে নেয় সে। ঝাঁপের দরজায় কড়া নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায় দুয়ার। এ মুহূর্তটার জন্যই যেন অপেক্ষায় ছিল মদন।

আবেগ অনুরাগ আর পুরুষত্বে ভরা একুশ বছরের যুবাকে দেখামাত্রই তিলকার নারীত্ব ছলাৎ করে ওঠে, শাড়ির আঁচল পড়ে খসে। মেলে ধরে রুপোর কৌটায় ঢেকে রাখা কুসুমকলির মতো শ্বেতশুভ্র যৌবন। কুড়ি বছরের নারীর উদোম বক্ষের দিকে সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে আছে মদন। তিলকার নিলাজ ঠোঁটে প্রশ্রয়ী মৃদু হাসি দেখে কালক্ষেপণ করতে রাজি নয় সে। যৌবনবতী তিলকাকে জড়িয়ে ধরে সে। জাতকুলে সমাজে অস্পৃশ্য হলেও মদন গর্বিত পুরুষ হিসেবে মায়াবী উপত্যকায় এঁকে দেয় সোনালি দাগ। যেন হিরের নদীতে চলছে সোনার পানসি। সে পানসি বেয়ে চলছে রঙিন মাঝি। মাঝনদীতে ঝোড়ো ঝাপটায় ভেঙে যায় অভিশপ্ত সতীত্বের তালা। প্রকৃতির তাণ্ডবে সতীত্বের শেকল পড়ে থাকে আস্তাকুঁড়ে।

{আদিম আঘাতে তিলকার বুকে বিলাসী শান্তি! চির আকাঙ্ক্ষিত সুখ! অন্ধকার ফুরোবার আগেই ঘরে ফেরে আলুথালু বেশে। দেহের এখানে-ওখানে সোনালি আঁচড় আর রোমাঞ্চকর কামড়ের চিহ্নগুলোকে সযত্নে ঢেকে রাখে আঁচলে। ভালোলাগার উষ্ণ যন্ত্রণার বন্দি পায়রাগুলোকে উড়িয়ে দেয় মনের আকাশে।}

অনেকগুলো বছর পর তিলকা খুঁজে পেয়েছে কলিযুগের শিবঠাকুরকে। মরূদ্যানটা এখন জলে টইটম্বুর। যখন আকাশ ছড়িয়ে দেয় ভালোবাসার নীল আবির, গাছে গাছে ফুলের সমারোহ; দুটো মানবের ভালোবাসার উষ্ণতায় যখন রঙিন হয়ে ওঠে পৃথিবী, ঠিক তখনই প্রথার কালোচিল থাবা বসাল তিলকার জীবনে।

ভয়ে তিলকার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। ব্রাহ্মণের মৃত্যুতে নয়, লেলিহান চিতায় তিলকার মন-আবেগ-অনুরাগ-ভালোবাসার শরীর জ্যান্ত দগ্ধ হবে, সে ভয়ে।

জ্বলন্ত বাসরচিতা সাজাতে ব্যস্ত শবযাত্রীরা। চিতাখোলায় যেন উৎসব লেগে গেছে। শুকনো একটা ডোবার তলায় বেশ বড়ো গর্ত করে চিতা তৈরি করা হয়েছে। ন্যাড়া মাথায় টিকিওয়ালা পাঁচজন ব্রাহ্মণ। চিতার ওপর কাঠ সাজিয়ে তার ওপর মৃত পুরোহিত ব্রাহ্মণকে সটান শুইয়ে দেয়। পুরোহিতের কপালে চন্দনের ফোঁটা, গলায় তাজা ফুলের মালা দিয়ে বরের সাজে সাজিয়ে নিয়েছে। চিতায় প্রচুর তেল-ঘি ঢালছে পাঁচ ব্রাহ্মণ। ন্যাড়া মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে তোড়জোড় করে আগুন জ্বেলে দেবার আয়োজন করছে। পাঁচজন মহিলা পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে হাত-ধরাধরি-করে চিতার চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচছে। ভিড় থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে মদন। ভীত চোখ, শুষ্ক ঠোঁট, ফ্যাকাশে মুখ আর প্রচণ্ড ঝড়ের বেগে কাঁপছে ওর বুক। তবু সে নির্বাক!

যে গর্বিত পুরুষের বুকে তিলকা জাতকুল সঁপে দিয়েছে ভালোবাসার দাপটে, প্রকৃতির বেহিসাবি তা-বে ভেঙেছে সতীত্বের তালা, সে-ই কিনা আজ নির্লিপ্ত। তিলকার মনে প্রশ্ন জাগে, কেন নিষ্ঠুর ধর্মের শেকল ভাঙতে পারছে না মদন! কেন ঝড়ের মতো লন্ডভন্ড করছে না বর্বর এই প্রথার গিঁটগুলো! নির্বাক কেন কলিযুগের শিব!

এতক্ষণে তিলকার চোখে ছিল জলের ধারা। এবার আঁচল দিয়ে মুছে নেয় চোখ দুটো। এখন তার চোখে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে চিতার আগুন আর ভেতরে উদ্ধত হয় প্রথাভাঙার চাবুক। চারদিকটায় চোখ বুলিয়ে নেয় তিলকা। পাঁচজন মহিলা পরিপাটি হয়ে হাত-ধরাধরি-করে নাচছে আর গাইছে।

আর এখানে তিলকাকে সাজানো হচ্ছে বিয়ের সাজে। কপাল জুড়ে সিঁদুর। চুলগুলো খোলা। বিনুমাসি প্রাণপণ চিৎকার করে উঠছে একটা বীভৎস আর্তনাদের মতো এবং সজোরে বুক চাপড়াচ্ছে। লোকের ভিড়, হইচই। যেন মেলা বসেছে।

চিতায় প্রচুর তেল ঘি ঢালা হয়। তিলকা চিতার চারদিকটায় ঘুরে ঘুরে আত্মীয়স্বজনকে চুমো খেয়ে নেয়। আর চিৎকার দিয়ে সুর করে বলতে থাকে, ‘পাঁচ দুই, পাঁচ দুই।’ পাঁচ অর্থ পূর্বজন্মে সে পাঁচবার সহমরণে গেছে। আর দুবার যেতে পারলে সাতবার হবে, তখনই মানবজন্ম থেকে মুক্তি পেয়ে পাকাপাকি স্বর্গে যেতে পারবে। তিলকার হাতে কেউ পান দিচ্ছে। কেউ দিচ্ছে সুপারি। কারণ ওরা পান-সুপারি ওদের মৃত আত্মীয়স্বজনের কাছে স্বর্গে পাঠাচ্ছে তিলকার হাত দিয়ে।

তিলকা চোখ তুলে আরো একবার দেখে নেয় চারপাশটা। ওর চোখের আগুন যেন দগ্ধ করছে অভিশপ্ত সমাজটাকে। ধীরপায়ে মদনের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরনের রঙিন শাড়িটা একটানে খুলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলে, ‘দ্যাখ, এই শরীরে সোনালি বিষ ঢেইলেচি অভিশপ্ত সুখ থেকে মুক্তি পেতে।’ উপস্থিত সবযাত্রীরা বিস্ময়ে হতবাক। কেউ কেউ সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে থাকে ওর উদোম শরীরের দিকে। উত্তেজনায় তিলকার বক্ষ, নিতম্ব দুলছে ছলাৎ ছলাৎ করে।

মদনের দুহাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে তিলকা বলে, ‘মদন, তোর জইন্যে সব খুইলে দিলাম। দেখ! এসব তোর জইন্যে। ঐ বুড়োটা কষ্ট ছাড়া কিছু দিতি পারে নাই। ওর সঙ্গে আমি স্বর্গে যাব না নে। আমি ভালোবাইসেচি তোরে।’ মদন অসহায়ের মতো এদিক-ওদিক তাকায়। জোরে জোরে শ্বাস নেয়।

‘ভয় পাইলি মদন? তুই না কলিযুগের শিব? আমি প্রতিদিন তোর লিঙ্গে জল ঢাইলেচি। পূজা দিয়েচি। সেই শিবের শক্তি কই? মধ্যরাইতে যেই শিব প্রকৃতির যৌবনে বুনো তান্ডবে ঝড় তুলত। সবকিছু তছনছ কইরে ভাসিয়ে নিয়ে যেত গভীর সাগরে। সেই শিব কোথায়?’

মদনের গলা ধরে তাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে চিতার ধারে নিয়ে আসে তিলকা।

‘আজ এই চিতায় বুনো তাণ্ডব করব।’ হিহি করে হাসতে হাসতে এক হাতে মদনের কলার চেপে ধরে আর অন্য হাতের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, ‘ঐ দিকে তাকিয়ে দ্যাখ। সমাজের কীটগুলো দাঁড়িয়ে আমাদের বাসর সাজাইচ্ছে। ওরা চন্দন কাঠের বাসরশয্যায় আশীর্বাদের আগুন জ্বালিয়েচে। ঘি ঢাইলচে।’

মদনের কপালে চন্দনের তিলক পরিয়ে দেয় তিলকা। উপস্থিত সকলে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তিলকার দিকে।

তিলকা ঠিক কী করতে চাইছে! উদোম শরীরে মদনকে জড়িয়ে ধরে চিতার চারপাশে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করছে। মহিলারা লজ্জায় মাথা নিচু করে ছিছি করছে। মদনকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় জ¦লন্ত চিতায় ঝাঁপ দেয় তিলকা। তিলকার নগ্ন গায়ে ঘি আর চন্দন মেখে দিয়েছে আগেই। যার দরুন লকলক করে আগুনের লেলিহান শিখা সাপের জিহ্বার মতো জড়িয়ে ধরছে তাকে। মদন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তিলকা হিহি করে হাসছে আর মদনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘পাঁচ দুই, পাঁচ দুই।’ টিকি দুলিয়ে তিনজন পুরোহিত বাঁশের গোঁজা মেরে মেরে ওদেরকে চেপে ধরছে চিতার ভেতর। আর মন্ত্র পড়ে ঘি ঢালছে পুরোহিত। ঠাসঠাস করে হাত-পায়ের গিঁট ভাঙার শব্দ যেন প্রথাবাদীদের স্বর্গযাত্রার পথ সুগম করে দিচ্ছে।

যেন তিলকার পায়ের জুতোর বাড়ি পড়ল লাম্পট্য প্রথার গায়ে। অন্ধ ধর্মের গালে।

 

Read Previous

হাফিজ রহমান-এর গুচ্ছকবিতা

Read Next

কলঙ্কিনী রাধা – দ্বিতীয় পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *