অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অনন্য কামরুলের একগুচ্ছ অণুগল্প

ঢোল

ঢোলটি একাই সমতালে বেজে চলেছে। লোকজন ভাবছে, শেষমেশ ফেটে যায় কিনা!

যে-ই দেখছে, হাসছে। বলছে, ‘খাসা ঢোল তো!’ মাঝেমধ্যে কিছু আনকোরা দর্শকের সহজ হাততালি পেলেই ঢোলটির বাজনা আরও গাঢ় হচ্ছে। কানফাটা স্বরের সঙ্গে প্রাণফাটা মধু ঝরছে! আহা! এমন অমিয়ের উৎসধারা কোথায়?

কিছু আলাভোলা দর্শক পেয়ে ঢোলটির সে কী উল্লম্ফন! উপস্থিত লোকজনের অভিজ্ঞরা ঢোলের চারিত্র্য জেনে নীরব থাকলেও খুদে দর্শকরা তার কারিশমায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়। কেউবা আবার বাংলা স্যারের পড়ানো ‘কর্ম-কর্তৃ বাচ্যের কর্তা’র উদাহরণের কথা মনে করে পুলকিত হয়। দু-চোখ ছানাবড়া করে ভাবে, ওমা, এমন ঢোল তাহলে আছে দুনিয়ায়!

ইতোমধ্যে ঢোলের একটানা লাগামছেঁড়া শব্দে বাতাসে ফাটল ধরে। রাত ভারী হতে হতে বেতসলতার মতো নুইয়ে পড়ে। তবু তার দৌরাত্ম্য থামে না। ন¤্র দর্শকরা ঘামে সাঁতরে সাঁতরে ঢোলের খেমটা নাচ দেখে। বল্গাহারা ঢোলের সঙ্গে তাল মিলাতে মিলাতে সময়ও একসময় হিমশিম খায়। সহসা দূর থেকে ছুটে আসা শব্দবহুল নৈঃশব্দ্য ঢোলের সপ্তসুরে একদলা থুথু লেপ্টে বড় করে লিখে দেয়, ‘ধিক’।

 

কুম্ভীরাশ্রু

কুমিরটি হঠাৎ মানবীয় হয়ে ওঠে। একগাদা মানবসন্তানকে নিজের বলে দাবি করে। সবাইকে তানপুরা বানিয়ে ইচ্ছেমতো আঙুল দিয়ে বাজায়।

জলে নামার আগের দিন কুমিরটি বাচ্চাদের নিয়ে উৎসব করে। অনুষ্ঠান সমাপনান্তে অতল আবেগী হয়ে ওঠে। দু-চোখ অশ্রুতে সয়লাব হয়। মাথায় হাত বোলাতেই বাচ্চাগুলো ভেউ ভেউ করে কাঁদে। কুমিরের মনে নিদারুণ জোশ জাগে! বাচ্চাদের কাদামাটির মন কুমিরের ফোঁটা ফোঁটা চোখের জলে আরও কাদা কাদা হয়ে ওঠে। তারা তখন ঘোরে মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে কুমিরটিকেই আসল মা ভেবে দইয়ের মতো নীরবে গলতে থাকে।

অকস্মাৎ ইথারে টান লাগে। বাতাসেরা হাঁপানি রোগীর মতো হাপিত্যেশ করতে থাকে। কুমিরের চোখ অশ্রু টলমল হলেও মন ঠিকই খলের মতো খলবল করে ওঠে। সেই দৃশ্য মুভি হয়ে শূন্যে মাতম তোলে। আর তার প্রতি রিলে অ্যাসিড পোড়া ঘায়ের মতো ভেসে থাকে একগুচ্ছ মুখোশের ছবি।

কঞ্চি

কঞ্চি নিজেকেই স্বয়ম্ভূ দাবি করে বাঁশবাগানে সুদীর্ঘ বক্তৃতা করে। উটকো বাতাসে বাঁশবাগান নড়ে উঠলে কঞ্চি তাকে ‘বাহবা’ ভেবে ভয়ানক তেলতেলে হয়ে ওঠে।

একদিন বাগানের মালিক ভুলবশত কঞ্চিকে বাঁশ ভেবে বাজারে তুললে কী ভয়ানক হুলুস্থূল পড়ে যায়! কেউ বলে, ‘মশাই চুল সব পেকে গেল, তাও বাঁশ-কঞ্চির তফাত বোঝেন না?’ কেউ বলে, ‘আপনি সাংঘাতিক ধূর্ত তো মিঞা, কঞ্চিকে বাঁশ হিসেবে চালিয়ে দিতে চান?’

মুহূর্তেই বাজারসুদ্ধ খবরটা সংক্রমিত হয়। লোকটিকে ঘিরে ভারি জটলা বাঁধে। নানাজনের নানা কটূ কথায় তার কান ও মুখ যেন বাসচাপা জন্তুর মতো থেঁতলে যায়! কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দাগি আসামির মতো নত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে সে। হঠাৎ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে এক অদ্ভুত ধরনের লোক উচ্চস্বরে বারবার ছড়া আওড়াতে থাকে: বাঁশ হলো ঘাস/কঞ্চি তারই দাস।

উপস্থিত জনতার সকলেই জাদুগ্রস্তের মতো লোকটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আর সেই সুযোগে কঞ্চি ক্রমশ কুঞ্চিত হতে হতে ঝরাপাতায় মুখ লুকিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে।

নির্লজ্জ

লজ্জা কাকে বলে জানে না সে। নাকি লজ্জাই তাকে লজ্জা পেয়ে পরবাসে! এসব নিয়ে কানাঘুষা করে কেউ কেউ।

প্রতিষ্ঠানের ধূলিকণা থেকে শুরু করে সবকিছু যেন ভালোভাবে চিনে গেছে তাকে। যেমন ধরুন, সেদিন যখন সে নিজেকে জাহির করে একটি উন্নয়নচিত্র তুলে ধরল, সারাটি দুপুর লাগামছাড়া বৃষ্টি হলো। টানা বর্ষণে রাস্তাঘাট সব ডুবে গেল। এমনকি অফিসের চারদিকে নদী জেগে মাছেরা লাফাল।

নিজেকে মুকুটবিহীন সম্রাট দাবি করে আত্মশংসা লেখে সে। তার কর্মকাণ্ডে ছুঁচোরও ভেদবমি হলো।

মাস দুয়েক পর। বিদায়ের ঘণ্টা বাজলে মাছিও ঘেঁষে না তার কাছে। সে ভাবে, স্বীকৃতি আবশ্যক। হোক সেটা কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো। বক্তাদের কিছুটা জোরপূর্বক শিখিয়ে দেওয়া হলো। বিদায়-অনুষ্ঠান স্তুতিবন্যায় ভেসে গেল। তার আনন্দ আর ধরে না!

বাসায় গিয়ে বিজয়ীর হাসি নিয়ে আয়না দেখে সে। আয়নার ভেতর থেকে শিংঅলা শয়তান তাকে দেখে লজ্জায় জিভ কাটে। খটখটে গলায় চোখ ছানাবড়া করে বলে, ‘তুই তো দেখি আমাকেও হারিয়ে দিলি রে!’

ফেসবুক

দু’জনের দুই জোড়া চোখ আটকে আছে স্ক্রিনে। পাশাপাশি বসেও তারা পারস্পরিক আলাপ সেরে নিচ্ছে ম্যাসেঞ্জারে। একমাত্র মেয়েটি কথাতৃষ্ণা নিয়ে বাবা-মা’র কাছে গিয়ে হাত ধরে টানতেই দুই গালে লেপ্টে থাকছে আঙুলের সিলমোহর। তাই আত্মরক্ষায় কার্টুনের নদীতে সাঁতরে বেড়ানোকেই সে এখন ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছে।

স্মার্ট ফোন দুটি যেন ইদানীং তাদের অক্সিজেন। চকিতে চোখে না পড়লেই শ্বাসকষ্টে ভোগে তারা। বিয়ের প্রথম কয়েক বছর দু’জনের সামান্যতে মিঠে খুনসুঁটি থাকলেও এখন তারা ভোল পাল্টিয়েছে। যেমন- ‘তুমি আমার ছবিতে লাইক দাও না কেন?’ লাইক দিলে বলে, ‘ভালো কমেন্ট দিতে এত কার্পণ্য কেন? তোমার চেয়ে আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডরাই জোশ। সবাই আমাকে আদ্যোপান্ত চেনে…’

স্ত্রী এখন আর গভীর রাতে অকারণে সাজুগুজু করে না। স্বামীরই বা ফুরসত কই? মুখের বদলে দুটি পিঠই পারস্পরিক স্পর্শ-প্রেমে ধন্য হচ্ছে যেন! দু’জনেই জলভরা ঘড়ার মতো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে নিজস্ব খোঁয়াড়ে।

মেয়েটির এখন আর রূপকথার গল্প শুনে ঘুমানো হয় না। রূপকথা সে তো রূপ নিয়ে চলে গেছে দূরে! প্রতিদিন ঘুম ভেঙে দেখে, সে বালিশ চেপে শুয়ে আছে। খেতে গেলে বুয়ার মার তো তার নিত্যসঙ্গী! তাই এখন আর কাঁদতেও অরুচি।

হঠাৎ একদিন মেয়েটির শরীরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। ডাক্তার বাবা-মাকে নানা পরামর্শ দিলেও তারা শুধু ইমানশূন্য মুসলমানের মতো নিঃশব্দে মাথা নাড়ায়। এরপর আবার ফিরে যায় স্বরূপের সরাইখানায়। অসুস্থ মেয়ের ছবি পোস্ট করে দু’জনেই দোয়া চায়। টাকি মাছের পোনার মতো দোয়া খচিত কমেন্ট ঝাঁকে ঝাঁকে জমা হয় পোস্টে। এদিকে সময়মতো ওষুধ না সেবনে মেয়েকে কুমিরের মতো কামড়ে ধরে অসুখ। বাবা-মা’র তাও ভাবান্তর হয় না! তবুও কমেন্টের উত্তর দিতে উদাসীন হয় না কেউ।

একদিন দুপুরে বুয়ার কল পেয়ে দু’জনেই ঝাউবনের ঝড়ের মতো আন্দোলিত হয়। অফিসের কাজ চাপা দিয়ে ছুটে আসে বাসায়। দেখে, মেয়েটি ভীষণ কাতরাচ্ছে। ‘মাগো, বাবা গো’ বলে প্রলাপ বকছে। এ কথা জানাতেও কেউ ভুল করে না ভার্চুয়াল জগৎবাসীকে। হু হু করে আসতে থাকে দুঃখচিহ্নিত স্টিকার।

সন্ধ্যায় বাবা-মা আবারও বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে স্বরচিত জগতে। আপডেট কিছু আপলোডে তারা কিবোর্ডে মাতম তোলে। বুয়া চাঁদে পাওয়া রোগীর মতো ছুটে এসে বলে, ‘খুকি আর নেই!’ তড়িতাহতের মতো দু’জনেই দৌড়ে যায় বেডরুমে। শাশুড়ি সেই যুগের মেয়ে হলেও প্রযুক্তিজ্ঞান তাঁর বেশ টনটনে। বাবা-মা হাউমাউ করে কেঁদে ‘মা, মা’ বলে মেয়েকে ধরতে গেলে এক ঝটকায় থামান তিনি। বলেন, ‘তোরা এখন ইচ্ছেমতো ছবি তুলে আপলোড দে। অনেক অনেক কমেন্ট পাবি।’ ছেলে জলভরা চোখে কিছু বলতে চাইলে মা শুধু হাতের ইশারায় যা জানায় তা অনুবাদ করার ভাষা তাদের অভিধানে নেই!

Website | + posts

Read Previous

সালভিনের প্রেমের কবিতা

Read Next

হাসিন আরার দুটি অণুগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *