অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাসার তাসাউফ -
আকাশ রয়েছে চেয়ে

এক গ্রামে তিনজন লোক বাস করতো। অবশ্য শুধু তিনজন লোকই সেই গ্রামটাতে বাস করতো না। সংখ্যাটা তিনশো থেকে তিন হাজারও হতে পারে। তবে এখানে যে তিনজন লোকের কথা উল্লেখ করেছি- তাদের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল এবং সেগুলো দোষ নাকি গুণ তা বোঝা না গেলেও- তারা যে গাঁয়ের অন্য লোকজন থেকে একটু আলাদা সেটা সহজেই বোঝা গিয়েছিল।

        কাকতালীয়ভাবে তিনজনেরই নাম ছিল রাজা। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, তাদের চরিত্রে অদ্ভুত মিল ছিল। তিনজনের মাথায়ই ছিল কোঁকড়া কোঁকড়া বাবরি চুল। তিনজনেরই গোঁফ ছিল। কিন্তু দাড়ি ছিল না কারও মুখেই। তিনজনেই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতো। তিনজনই বিয়ে না করার পণ করেছিল। তিনজনই প্রাণেমনে বন্ধু ছিল। তিনজনই ভীষণ অলস ও অকর্মণ্য ছিল এবং তিনজনই কোনো গুপ্তধন কুড়িয়ে পেয়ে হঠাৎ বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দিনযাপন করেছিল। তিনজনই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে জ্ঞানার্জনের অদৃশ্য রথ নিয়ে গিয়েছিল কলেজ পর্যন্ত। কিন্তু সামনে আর এগুতে পারেনি, থেমেছিলও একসঙ্গে। হয়তো জ্ঞানার্জনের চেয়ে ধনার্জন বেশি লাভবান মনে হয়েছিল। তারা নাকি কবে, কার মুখে শুনেছিল, ঝিনুকের ভেতরে মুক্তো, সাপের মাথায় মণি এবং ব্যাঙের মুখে এক ধরনের দামি পাথর থাকে। সেগুলি খুঁজে পেলে বিক্রি করে সাত রাজার ধন-দৌলত পরিমাণ টাকা-পয়সা পাওয়া যায়। তারা এমন কথাও শুনেছিল, যে সাপের মাথায় ঐ মণিটা থাকে- সেটি মানুষের আড়ালে চলে যায়। বন-বাদাড়ে, মাটির গর্তে কিংবা গাছের খোড়লে লুকিয়ে থাকে। ব্যাঙের মুখে সেই দামি পাথরটা থাকলে ব্যাঙ সেটা মুখ থেকে বের করে মাটিতে রেখে রাতের আঁধারে এর আলোয় খাবার খুঁজে ফিরে। আর ঝিনুকের ভেতরের মুক্তো হলে সে মুখ বন্ধ করে চলে যায় জলের গভীরে।

        কোথায় পাওয়া যাবে সেই মুক্তো, মণি কিংবা দামি পাথর? এসব অমূল্যধন খুঁজে পেতে হলে অহর্নিশি জল-জঙ্গলে খুঁজতে হবে। তাই তারা তিনজন ঘর থেকে বেড়িয়েছিল। মনেপ্রাণে দৃঢ় পণ করেছিল, যতোদিন এই গুপ্তধন খুঁজে না পাবে ততোদিন তারা বাড়ি ফিরবে না।

        আমার গল্প এই তিন রাজাকে নিয়ে। তবে গল্পের প্রয়োজনে তিনজনকে তিনটি ভিন্ন নামে সম্বোধন করবো। রাজু, রাজিব ও রাজন।

        অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা জঙ্গলে বসে আছে তারা তিনজন। সারা জঙ্গলে শিয়াল আর ঝিঁঝিঁ পোকার হল্লা। তাদের মুখে কোনো কথা নেই। চুপচাপ বসে সিগারেট ফুঁকছে। জঙ্গলের ভেতরে নীরবতা ভেঙে একটা গাছের ডালে শব্দ ফুটে ওঠে- রাতজাগা কোনো পাখির ডানা ঝাঁপটানির শব্দ বোধহয়। জঙ্গলের গহীন থেকে একটা শিয়াল দৌড়ে এসে তাদের দেখে থমকে দাঁড়ায়। অন্ধকারে তিনজন মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়ে যেদিক থেকে এসেছিল পিঠটান দিয়ে সেদিকেই দৌড় দেয়। জঙ্গলের ভেতরে বসে কয়েকটা সিগারেট শেষ করে ফেলেছে তারা। অনেকাট সময় কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ একচিলতে আগুনের ফুলকির মতো কিছু একটা তাদের চোখে পড়ে। তিনজনই চমকে ওঠে দৌড়ে যায় সেখানে। কুড়াতে গিয়ে হাতে পায় একটা জোনাকি পোকা। এতে তারা হতাশ হয় এবং এই হতাশা তাদের ক্ষতবিক্ষত করে। কিন্তু তারা বাড়ি ফিরে আসে না। জঙ্গলের ভেতরেই বসে থাকে। একচিলতে আগুনের ফুলকির অস্পষ্ট ঝিলিক যেন তাদের আরও উস্কে দিয়েছে। জঙ্গলের ভেতরের অন্ধকার কিংবা শিয়ালের কোলাহল তাদের ছুঁতে পারে না।

     এ মুহূর্তে ঝোপের আড়ালে বসে নিজেদের মনে হচ্ছে পুরনো অশত্থ কিংবা প্রাচীন বটবৃক্ষ। সেই কবে থেকে আশার শিকড় মেলে, ডালপালা ছড়িয়ে বসে আছে তো, আছেই। যেখানে আগুনের ফুলকির মতো দেখেছিল সেখানে আবার তাকায় তারা। না, তাদের সেই আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটার দেখা পায় না- যার জন্য এতো অপেক্ষা, এতো আকাঙ্ক্ষা না জানি বস্তুটা দেখতে কী রকম?

     তিনজনই অবিচল বসে থাকে। তাদের স্থির চোখের দৃষ্টি দেখে বোঝা যায় না তারা জোনাকি না-কি জঙ্গলের অন্ধকার দেখে। গভীর অন্ধকারে তারা চুপচাপ বসেই থাকে, যেন বসে থাকা ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই। দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী তারা আশায় আশায় আঁধারে বসে থেকে একসময় আশাহত হয়ে পড়ে। তখন বিরক্ত হয়ে রাজন বলে ওঠে, ‘আর কতো দিন এভাবে জঙ্গলে বসে থাকলে গুপ্তধন খুঁজে পাব?’

     রাজু বলে, ‘ধৈর্য হারালে চলবে না।’

     রাজিব বলে, ‘ধৈর্য ধারণ করার ধৈর্যও তো হারিয়ে ফেলেছি, আর কতো দিন?’

     রাজন বলে, ‘এভাবে বসে থেকে কী হবে?’

     সত্যিই তো! এভাবে অন্ধকারে বসে থেকে কী হবে? এবার তাদের টনক নড়ে। তিনজন একসঙ্গে গা ঝাড়া দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। জঙ্গলের ভেতরটা আর তাদের কাছে ভালো লাগে না। তারা সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। তখনও সাপের মাথার মণি, ব্যাঙের মুখের দামি পাথর কিংবা ঝিনুকের ভেতরে অসংখ্য মুক্তো তাদের চোখের সামনে থেকে সরে যায়নি, বেলুনের মতো ভাসতে থাকে। আর সেটাই তাদের বুকের ভেতরে যন্ত্রণাকে দাহ করে; কিন্তু আশাহত করতে পারে না।

     তারা জঙ্গলের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে ক্রমশ আলোর মধ্যে আসতে থাকে। আশপাশে তখন কোনো জনমানবের কোলাহল চোখে পড়ে না। শুধু তারা তিনজন। তারা একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। হয়ে পড়ে বিষাদকাতর ও উদ্ভ্রান্ত। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে বলে তারা আরও বিষাদগ্রস্ত, আরও উভ্রান্তন্ত হয়ে পড়ে। গুপ্তধন পাওয়ার তাদের যে আশা তা যেন গুঁড়ো হয়ে, ধুলো হয়ে শূন্যে উড়ে যায়। তারা যেন অচঞ্চল, স্থির হয়ে পাতাশূন্য বৃক্ষের মতো ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে থাকে। সত্যিই তো, এভাবে আর কত দিন! তাদের গুপ্তধন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে সময় তো থেমে থাকে না। রাত বাড়তে থাকে। রাত বাড়তে থাকে বলেই বাড়ি ফেরার তাগদা দিয়ে রাজন আবার বলে, ‘চল, বাড়ি চলে যাই এভাবে আর কতো দিন?’

     রাজিব বলে, ‘আচ্ছা, আমরা যে জিনিসের আশায় রাতদিন এভাবে জল-জঙ্গলে ঘুরে মরছি, আসলে কি আদৌ তা আছে?’

     রাজিবের কথায় সায় দিয়ে রাজনও বলে, ‘আসলেই কি গুপ্তধন বলে কিছু আছে?’

     দুজনের জিজ্ঞাসাই রাজুর উদ্দেশ্যে।

     রাজু জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, আছে।’

     রাজনও রাজিব একসঙ্গে বলে, ‘কোথায় আছে?’

     রাজু বলে, ‘ভার্র্জিনিয়া পাহাড়ে।’

     রাজিব বলে ‘সেটা কোথায়?’

     রাজু বলে, ‘মন্টভেল শহরে। জিরাফের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এবরোথেবরো পাথুরে এক পাহাড়। সেই পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠে গেছে এঁকে বেঁকে চোরাগোপ্তা পথ আর এই পথে গেলেই সন্ধান মিলবে থোমাস জেফারসন বিলের গুপ্তধন।’

     রাজিব বলে, ‘থোমাস জেফারসনের বিলের গুপ্তধন মানে?’

     রাজু বলে, ‘থোমাস জেফারসন বিল নামে এক ব্যক্তি ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে সোনা-রূপা শিকারে এক দুঃসাহসিক অভিযানে রোয়ানোক ছেড়ে পশ্চিমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিল। কোলোরাডো নামক এক জায়গায় বিশাল সোনা আর রূপার গুপ্তধন পেয়ে সেগুলো নিয়ে ভার্জিনিয়ায় ফিরে আসে। বুফোর্ত নামক এক শহরের মাটির নিচে সব সোনা ও রূপা পুঁতে রাখে। কাকপক্ষীও জানতে পারে না।’

     রাজিব বলে, ‘তারপর কী হলো?’

     রাজু বলে, ‘তারপর আবার অভিযানে যায়। দুবছর পর আবার সোনা ও রূপা নিয়ে ফিরে এসে সেই শহরেই মাটির নিচে পুঁতে রাখে।’

     রাজন বলে, ‘এবারও কি কেউ জানতে পারেনি?’

     রাজু বলে, ‘না। তবে রবার্ট মরিস নামে বিলের একজন বন্ধু ছিল। থাকত লিঞ্চবার্গ নামক শহরে। বিল একটি লোহার ছোটো বাক্স সঙ্গে নিয়ে সেই বন্ধুর কাছে যায়। বাক্সটি রবার্ট মরিসের কাছে দশ বছরের জন্য আমানত রেখে ফিরে আসে। আসার আগে বন্ধুটিকে অনুরোধ করে আসে যেন বাক্সটি খোলা না হয়। বাক্সটি খুলতে নিষেধ করার কারণেই রবার্ট মরিসের মনে কৌতূহল তৈরি হয়। কী আছে বাক্সের ভেতরে? কেনো বাক্সটি খুলতে নিষেধ করে গেল বিল?’

     রাজিব বলে, ‘রবার্ট মরিস কি বাক্সটি খুলেছিল?’

     রাজু বলে, ‘না, খুলেনি। লুকিয়ে রেখেছিল বন্ধুর আমানত। কিন্তু এই বাক্সের ভেতরেই গুপ্তধনের সকল রহস্য লুকানো ছিল। এর পরের বছর বিল একটি চিঠি লিখে রবার্ট মরিসকে মনে করিয়ে দেয়, সে যেন বাক্সটি লুকিয়ে রাখে। কেউ যেন জানতে না পারে বাক্সটির কথা। তারপর দীর্ঘ তেইশ বছর কেটে যায়। বিলের কোনো খবর পায় না মরিস। তারপর বন্ধুটি আর বেঁচে নেই ভেবে বাক্সটি খুলে ফেলে।’

     রাজন বলে, ‘কী পেল বাক্সটি খুলে?’

     রাজু বলে, ‘বাক্সে তিনটি কাগজ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।’

     রাজিব বলে, ‘কাগজে কী লেখা ছিল?’

     রাজু বলে, ‘গাণিতিক সংকেতের মাধ্যমে গুপ্তধনের কথা লেখা ছিল। প্রথম পাতায় গাণিতিক সংকেতের মাধ্যমে নির্দেশ করা হয়েছে গুপ্তধনের সঠিক রহস্যের কথা। দ্বিতীয় পাতায় গুপ্তধনের বিভিন্ন জিনিসের নাম এবং পরিমাণ। তৃতীয় পাতায় লেখা ছিল বিলের সঙ্গী ও আত্মীয়-স্বজনের নাম ঠিকানা। বিল তাদের মধ্যে গুপ্তধন ভাগ করে দেওয়ার কথাও উল্লেখ করেছে।’

     রাজিব বলে, ‘রবার্ট মরিস কি সংকেতগুলোর মানে বুঝতে পেরেছিল?’

      রাজু বলে, ‘না। সংকেতগুলোর মানে বুঝতে ছুটে গিয়েছিল তার বন্ধু জেম্স ওয়ার্ডের কাছে। জেম্স ওয়ার্ড ছিল বিশিষ্ট গণিত বিশারদ। সে সমস্ত মেধা ব্যয় করে শুধু রহস্য কোডের অর্থ উদ্ধার করতে পেরেছিল, আর কিছু না।’

     রাজিব বলে ‘তারপর কী হয়েছিল?’

     রাজু বলে, ‘বিলের তিনটি কাগজের রহস্য উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে জেম্স ওয়ার্ড “দ্য বিল পেপারস” নামে একটি বই প্রকাশ করে। এই বই প্রকাশের পর বিশ্বেরজুড়ে গুপ্তধন শিকারিদের মধ্যে নেশার ঝড় ওঠে। চোরাগোপ্তা পথে একে অন্যের চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্রামাগত মাটি খুঁড়তে থাকে। একশ চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিকারিরা গুপ্তধনের আশায় পাহাড় খুঁড়েছে। কিন্তু বরাবরই সবাই হয়েছে ব্যর্থ। বিলের মিস্টেরি কোড বা গাণিতিক সংকেতের অর্থ উদ্ধার করতে পারেনি কেউই। সারা বিশ্বে এখনও গুপ্তধন শিকারীদের মাথার ঘাম ঝরছে এ তিন পাতা গাণিতিক সংকেতের অর্থ উদ্ধার করতে গিয়ে। কারণ এই তিন পাতার মধ্যেই রয়েছে বিলের গুপ্তধনের সঠিক অবস্থান আর এর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারলেই মিলে যাবে বিলের বিশ মিলিয়ন ডলারের গুপ্তধন।’

     রাজন বলে, ‘বিলের গুপ্তধনের মধ্যে কী কী আছে?’

     রাজু বলে, ‘দুই হাজার নয়শো একুশ পাউ- সোনা আর পাঁচ হাজার একশো পাউ- রূপা।’

     রাজিব বলে, ‘এগুলোর দাম বাংলাদেশি টাকায় কত হবে?’

     রাজু বলে, ‘একশো বিশকোটি টাকার মতো।’

     রাজন বলে, তুমি এসব কথা জানলে কী করে?’

     রাজু বলে, ‘আমার বাবার কাছ থেকে জেনেছি। বাবা জেনেছিল দাদুর কাছ থেকে, হয়তো দাদু জেনেছিল তার বাবার কাছ থেকে- এভাবে বংশ পরম্পরায় শুধু জেনেই আসা হচ্ছে। কিন্তু সন্ধানে কেউ বের হয় না। তাই তোমাদের নিয়ে আমার এ অভিযান।’

     রাজন বলে, ‘অভিযান না ছাই! গুপ্তধন তো থাকে মন্টভেল শহরে, এভাবে রাতদিন শুধু এখানে এ জল-জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে কি সেগুলোর সন্ধান মিলবে?’

     রাজু বলে, ‘সেই গুপ্তধনের কিছু অংশ বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। কিছু অংশ সাপের মাথায় মণি হয়ে, কিছু অংশ ব্যাঙের মুখে দামি পাথর রূপে আর কিছু অংশ ঝিনুকের ভেতরে মুক্তো হয়ে আছে। এখন আমাদের সেগুলি খুঁজে বের করতে হবে।’

     রাজিব বলে, ‘কিন্তু কোথায় খুঁজব?’

     রাজু বলে, ‘এক কাজ করি, তিনজন একই জায়গায় না থেকে আলাদা আলাদা জায়গায় খোঁজ করা যাক।’

     তার এই কথাটা রাজন ও রাজিবের মনে ধরে। একই জায়গায় তিনজন অযথা সময় নষ্ট করে কিছু হবে না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয়, রাজু জঙ্গলের ভেতরে সাপের মণি খুঁজবে, রাজন খুঁজবে ব্যাঙের মুখের সেই দামি পাথরটা আর রাজিব চলে যাবে নদীর ধারে- সেখানে যতো ঝিনুক আছে সব কটার খোলস খুলে খুলে মুক্তো খুঁজবে। বলা তো যায় না কোথায় কি আছে- হয়তো কেউ একজন পেয়েও যেতে পারে কাঙ্ক্ষিত গুপ্তধন।

     এরপর চোখের সামনে যতো বন-জঙ্গল, ঝোপ-ঝাড় পেয়েছে, পেয়েছে যতো সাগর-নদী, খাল-বিল, পুকুর-নালা, সরোবর কিংবা উপত্যকা সবখানে হন্যে হয়ে তন্নতন্ন করে গুপ্তধন খুঁজেছে। খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত-শ্রান্ত, ত্যাক্ত-বিরক্ত এবং হতাশ হয়ে যখন তারা বাড়ি ফিরে আসতে উদ্যত হয়, তখনই একটা বাজারের সামনের ছোটো জঙ্গলের ভেতরে দেখতে পায় একটা গোলাকার বস্তু- যা বরফখণ্ডের মতো সাদা। রোদে চকচক করে, অন্ধকারে দেয় আলোর ঝিলিক। তারা ধরে নেয় এটাই সেই গুপ্তধনের অংশ কিংবা ব্যাঙের মুখের সেই পাথরটা অথবা সাপের মাথার মণিটা। তাদের আনন্দের সীমা থাকে না। বস্তুটি হাতে নিয়ে তারা একেকজন একেকবার লোফালুফি করে। একজন শূন্যে ছুঁড়ে আরেকজন ক্রিকেট খেলায় ক্যাচ ধরার মতো সেটা ধরে উল্লাসে চিৎকার দেয়। লোকজন তাদের এই ক্ষুদ্র বস্তুটি নিয়ে এতটা আনন্দিত হবার মর্মার্থ বুঝতে পারে না। সবাই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি মেলে তাকায়। কেউ কেউ অনুচ্চ স্বরে বলেও ফেলে, ‘লোকগুলি কি পাগল!’

      তিনজনের মধ্যে কোনো হুশ নেই। কে কী বলে কিংবা কে কী ভাবে তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। তারা তো এখন আর গ্রামের অন্যদের মতো না। তাদের হাতের মুঠোয় আছে অমূল্যধন! যার জন্য কয়েক বছর ধরে জল-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছে। তারা আত্মভোলা হয়ে আনন্দে নাচতে থাকে। তাদের ঘিরে মানুষের ভিড় ও কোলাহল বেড়ে যায়। এই ভিড়ের মধ্য থেকে একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি তাদের সামনে এগিয়ে এসে ছোঁ মেরে বস্তুটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে কিছুক্ষণ। তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, ‘এ তো দেখছি একখণ্ড পাথর!’

     ‘এ্যাঁ!’ তিনজনেই হাহাকার করে ওঠে। তাদের চোখের সামনে কিছু নেই। পেছনেও সব শূন্য, পায়ের তলায় নেই মাটি। কেবল মাথার ওপরে আকাশ রয়েছে চেয়ে আর সবই ফাঁকি…!

বাসার তাসাউফ
কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক
জন্ম: ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি
জন্মস্থান: অনন্তপুর, হোমনা, কুমিল্লা
প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা- ৯টি।

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ: সব মেঘে বৃষ্টি হয় না, নাকাল, সূর্যঘড়ি, স্বর্গগ্রামের মানুষ, পিতৃশোক ও দীর্ঘশ্বাসের গল্প, স্বরচিত নির্বাসন, স্কুল থেকে পালিয়ে।

Read Previous

অগ্নিবলয়

Read Next

দ্যা স্কেচ আর্টিস্ট

One Comment

  • প্রত্যাশা আরও বেশী ছিল!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *