অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৬, ২০২৪
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৬, ২০২৪
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শাপলা সাদী -
দ্যা স্কেচ আর্টিস্ট

পর্ব-১
রুয়ে লা চ্যাম্পস এলিসিস, প্যারিস, ফ্রান্স। পিছনে আর্ক দে ট্রিয়ম্ফে রেখে, আমার সামনেই বসা রয়েছে একজোড়া কাপল। ছবি আঁকছি তাদের। কাপলদ্বয়ের মধ্যে লোকটি ইন্ডিয়ান এবং মেয়েটি সম্ভবত ফ্রেঞ্চ।

তাদের একে অপরের প্রতি আন্তরিকতা দেখে বুঝাই যাচ্ছে নতুন প্রেমে মজেছে আমি একজন স্কেচ আর্টিস্ট, রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় বসে সৌখিন পর্যটকদের ছবি আঁকি, বিনিময়ে কিছু ফ্রাঙ্ক পেয়ে থাকি। বর্তমানে এটাই হচ্ছে আমার পেশা।

আমি বর্ষা, প্যারিসে এসেছি স্কেচ আর্ট নিয়ে পড়ালেখা করতে। ছোটো থেকেই আমার সখ ছিল প্যারিসে গিয়ে আমি আর্ট নিয়ে পড়ালেখা করবো। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর বাবা মারা গেলেন। বাবা মারা যাবার পর আমরা ভাইবোনেরা মিলে বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে, যে যার জীবনের টার্গেট অনুযায়ী জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েছি। আমার বাবা ছিলেন সমাজের প্রতিষ্ঠিত ধনী ব্যবসায়ী। তাই উত্তরাধিকারী সূত্রে আমরা ভাইবোনেরা সকলেই মোটা অঙ্কের অর্থ এবং সম্পত্তি অংশ হিসেবে পেয়েছি। একে তো কম বয়স আমার, তার উপরে হাতে চলে এসেছে অগণিত নগদ অর্থ, হাতে টাকা আসতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম প্যারিস পাড়ি জমানোর জন্য। মা তো মারা গেছেন আরও দুই বছর আগে। ভাই এবং বোনেরা নিজের নিজের সংসার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আমাকে নিয়ে তেমন কারও কোনো মাথা ব্যাথা নেই। স্বাধীন জীবন আমার তাই সিদ্ধান্ত নেয়া মাত্রই দেশ ছেড়ে চলে এলাম প্যারিসে। প্যারিসে এসেই একটা আর্ট স্কুলে ভর্তি হলাম, কিছুদিন থাকলাম একটা হোস্টেলে, কিছুদিন থাকার পর হোস্টেল ছেড়ে এভিনিউ ভিক্টর হুগো লেনে মিনি একটা ফ্ল্যাট নিয়ে একাই বসবাস করছিলাম। প্যারিস কে বলা হয়ে থাকে সিটি অব এক্সট্রাভেগেঞ্জা। প্রচুর খরচ পড়ে এইখানে জীবন অতিবাহিত করতে গেলে।

ইদানিং আমার খরচের পরিমাণটাও বেড়ে গেছে, দেশ থেকে টাকা আসার পরেও আমি কুলাতে পারছি না। আর এর কারণ হলো আমার নেয়া মিনি সাইজের লাক্সারিয়াস ফ্ল্যাটটি। সারা জীবন লাক্সারি লাইফ লিড করে বড়ো হয়েছি। তাই তো, এখানে এসে হোস্টেলে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারায় আমার এই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছি। এবং এই হাই ক্যাটাগরির লাইফ লিড করতে গিয়েই অর্থ সংকটে পড়েছি, এক্সট্রা মানি অর্জনের জন্য নেমে পড়েছি স্কেচ আর্টিস্ট হিসেবে।

কাপলদ্বয়ের ছবি আঁকানো শেষ করে ছেলেটির তাদের নাম জিজ্ঞাসা করলাম আমার আঁকা স্কেচ এর নিচে সিগনেচার হিসেবে দেয়ার জন্য, ফ্রেঞ্চ মেয়েটি তার নিজের নাম জানালো মেনোরা কিন্তু ইন্ডিয়ান ছেলেটি তার নাম বলতে ইচ্ছুক নয়। বুঝলাম কোনো ঘাপলা আছে নিশ্চয়। শুধু মেনোরার সিগনেচার দিয়ে ছবিটি বাঁধিয়ে দিলাম। মেনোরা আমার আঁকা স্কেচ দেখে খুশি হয়ে গোটা একটা দশ ইউরোর নোট বের করে দিলো। আমি সেই দশ ইউরো নিই কিভাবে? আমি মেনোরার দেয়া দশ ইউরো নিলাম না দেখে ইন্ডিয়ান ছেলেটি খুশি হলো তবে, মেনোরা একটু মন খারাপ করলো।

কাপলদ্বয় চলে যেতেই, প্রায় ৭০ বছরের একজন বৃদ্ধা মহিলা এসে আমাকে ভাড়া করতে চাইলো, আমাকে যেতে হবে সীন নদীর ধারে, সেখানে গিয়ে সীন নদীর দৃশ্যসহ বৃদ্ধার স্কেচ আঁকতে হবে। এই জন্য বৃদ্ধা মহিলাটি আমাকে ২০ ইউরো দিতে চাইলেন, আমি রাজি হয়ে গেলাম। তবে বৃদ্ধা মহিলাটির স্কেচ আজকে না, আগামীকাল সকালে সীন নদীর পাড়ে গিয়ে আঁকতে হবে, বৃদ্ধা মহিলাটির ১০ ইউরো দিয়ে অ্যাডভান্স করে চলে গেলেন।

আমার দেখাদেখি ইদানীং এই এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো স্কেচ আটিস্ট গজিয়েছে। আগে এই এলাকায় আমি একাই স্কেচ আটিস্ট ছিলাম কিন্তু এখন প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন রয়েছে স্কেচ আটিস্ট। যখন একা একা স্কেচ আট করতাম তখন বেশ ভালোই আয় হয়েছে, কিন্তু এখন আর তেমন আয় হয় না। ভাবছি ভালো একটা কাজ পেলে পেশাটা চেঞ্জ করবো।

সীন নদীর পাড়ে এসে অপেক্ষা করছি বৃদ্ধা মহিলাটির জন্য। নদীর ধারে এই পার থেকে ওই পারে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো মিউজিয়াম ‘দ্যা ল্যুভর’ এর অংশ বিশেষ। এই ল্যুভরেই রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক, আটিস্ট এবং বিজ্ঞানী লিও নার্দো দ্যা ভিঞ্চির আঁকা বিশ্ববিখ্যাত মোনালিসা এবং দ্যা লাস্ট সাপার-এর মূল কপি।

আমি একটি ফার গাছের তলে পাতানো মার্বেলের সাদা বেঞ্চে বসে রয়েছি, এইখানেই বৃদ্ধার আসার কথা। এখন বাজে সকাল সাড়ে সাতটা, জুন মাসের হালকা গরম পড়েছে এখন, সীন নদীর ধারে বসে সে নদী থেকে বয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাস খেতে বেশ ভালোই লাগছে। বসে থেকে সীন নদীর অববাহিকায় গড়েও ওঠা জাঁকজমক পূর্ণ প্যারিস সিটির সৌন্দর্য উপভোগ করছি।

হঠাৎ করে পিছনে কিছু একটার শব্দ পেতেই ফিরে তাকালাম, দেখলাম বৃদ্ধা মহিলাটি আসছেন, তার গায়ে জড়ানো রয়েছে একটা চাদর, তবে বৃদ্ধা মহিলাটি প্রচুর সেজেছে। মুখে ভারী মেকআপ এবং গায়ে জড়ানো রয়েছে একটা চাদর। মুখে ভারী মেকআপ এবং ঠোঁটে দিয়েছে ডার্ক লিপিস্টিক। বুঝাই যাচ্ছে যুবা বয়সকালে বৃদ্ধা অনেক সুন্দরী এবং বহুত স্টাইলিস ছিলেন। নদীর এই পাড়টা অনেক নিরিবিলি, লোকজন নেই বললেই চলে। বৃদ্ধা আমাকে বললেন, তিনি নদীর পার ঘেষে বেঞ্চে শুয়ে থাকবেন আর তার পিছনে লাইলাক ফুল এবং নদীর জলধারাসহ যেনো তার পুরো শরীরের স্কেচটি যেনো ফুটিয়ে তুলি। বৃদ্ধার কথা মতোই তার স্কেচ আঁকতে বসলাম।

বৃদ্ধা তার শরীরে জড়ানো চাদরটা খুলে ফেলতেই দেখলাম তিনি একটা স্বচ্ছ গাউন পরে রয়েছেন, সেই স্বচ্ছ গাউনের মধ্য দিয়ে তার শরীরের সব ধরনের ভাঁজ দেখা যাচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম, ভাগ্যিস এইটা প্যারিস, আমাদের দেশ হলে তো বৃদ্ধাকে দেখে মানুষ বলতো, বয়স কালের ভীমরতি ধরেছে তার। বৃদ্ধা মহিলাটি নদীর ধারের বেঞ্চে গিয়ে আধা শোয়া এবং আধা বসা অবস্থায় মডেল গার্লদের মতো পোজ নিয়ে বসলেন। বেঞ্চের পিছনে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রঙের লাইলাক ফুল এবং সীন নদীর প্রবাহিত জলধারা।

আমি বৃদ্ধার নির্দেশ অনুযায়ীই তার স্কেচ করা শুরু করলাম। স্কেচ করার মধ্যই বৃদ্ধা আমাকে আমার উচ্চতা কতো সেইটা জানতে চাইলেন। অনেকেই আমাকে ঐ প্রশ্নটা করে থাকে, তোমার উচ্চতা কতো? এর কারণ হলো, আমি বেশ লম্বা, আমার উচ্চতা ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি। মেয়েরা সাধারণত এতো লম্বা হয় না। কিন্তু আমি অনেক লম্বা। অনেক সময় ছেলেরাও বিব্রত বোধ করে আমার পাশে দাঁড়াতে। যাই হোক, বৃদ্ধা আমার উচ্চতা শুনে বললেন,

-তুমি এই কাজ করছ কেনো? মডেলিং করলেই তো পারো, অনেক টাকা রোজগার করতে পারবে। আমি বললাম,
-প্যারিসে আমি তেমন কাউকে চিনি না এবং কিভাবে মডেলিং এ ঢুকতে হয় তাও আমি জানি না। বৃদ্ধা বললেন,
-তুমি আগামীকাল রু দে লা পেক্স-এ চার্লস দে গল’স অ্যাপার্টমেন্টে এসে আমার সাথে দেখা করো। আমার অ্যাপাটমেন্ট এর গ্রাউন্ড প্লেসেই লাপ্যাশন স্টেজ রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ব্রান্ডের মেকআপ এবং ড্রেস ম্যাটেরিয়ালস এর ফ্যাশন শো অনুষ্ঠিত হয় আমার অ্যাপাটমেন্টের গ্রাউন্ড প্লেসে। আমি তোমাকে সেইখানে ঢুকিয়ে দিবো। মডেল হলে তুমি খুব নাম করতে পারবে, কারণ শুধু তোমার উচ্চতায় না বরং তোমার চেহারাটাও বেশ আকষণীয়। বৃদ্ধা বললেন,
-ইয়াং কালে আমিও একজন নামিদামি মডেল ছিলাম, এখন আমি বিভিন্ন ফ্যাশন শো অগানাইজ করে থাকি।
বৃদ্ধা কথা তে খুব আন্তরিকতার ছোঁয়া রয়েছে। আমার খুব ভালো লাগছে তার সাথে কথা বলতে। মনে মনে তুলনা করছি আমাদের দেশের বৃদ্ধা নারীদের সাথে ফ্রান্স এর এই বৃদ্ধা নারীটির কতো তফাৎ। এই বয়সেও সে এখনও ফ্যাশন শো পরিচালনা করে। বৃদ্ধা মহিলাটি শুধু সৌখিন নয় বরং খুব অ্যাক্টিভও।

পর্ব-২
বৃদ্ধার নাম শেভিনা দিমিত্রি মেদভেদেভ। প্যারিস এসে আমি ফ্রেঞ্চ বলা শিখেছি তবে এখনো ভালো করে রপ্ত করতে পারিনি ভাষাটা।

আমার বিকৃত ফ্রেঞ্চ ভাষা শুনে সেভিনা আমাকে ইংলিশেই কথা বলতে বললো এবং এও উপদেশ দিলো, ফ্রেঞ্চ ভাষাটা তাড়াতাড়ি ভালো করে রপ্ত করে নিতে।

স্কেচ আঁকা হয়ে গেলে সেভিনা স্কেচ টি নিয়ে আমার হাতে আরও ১০ ইউরো এবং একটা ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললো,

-পারলে আজকে সন্ধ্যার দিকে আমার অ্যাপার্টমেন্ট এ এসো। তাহলে আজকের মিড শো এর Dior- এর ফ্যাশন শো তে ঢুকিয়ে দিতে পারবো তোমাকে। Dior এর নাম শুনে, আমার বুকের রক্ত যেনো ছলকে উঠলো। Dior হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দামি দামি ব্রান্ড। Dior -এর মডেল হওয়া চারটি খানি কথা না। এতো সহজে Dior আমাকে তাদের শো তে নিবে বলে মনে হয় না। তবে সেভিনার কথায় ভরসা পাওয়া যায়। কারণ তার ব্যক্তিত্বই বলে দিচ্ছে ইনি একজন ঘাঘু মহিলা।

সেভিনার কাছ থেকে আরও দশ ইউরো নিয়ে, আমার ফ্ল্যাটে চলে এলাম। আজকে আর স্কেচ করতে নামছি না। ভাবছি ফ্ল্যাটেই থাকবো সারাদিন এবং সন্ধ্যায় রওনা দিবো সেভিনার অ্যাপার্টমেন্ট-এ। প্রত্যকটা মেয়েই স্বপ্ন দেখে গ্ল্যামারাস লাইফের। আমিও তাদের থেকে ব্যতিক্রম নই। তাই বলে Dior -এর মডেল? সত্যিই অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

আমার মিনি ফ্ল্যাটটিতে রয়েছে, একটি লিভিং রুম, একটা বেডরুম, একটা বেলকানি, একটা বাথরুম উইথ বাথ টাব অ্যান্ড ওয়াশ স্ট্যান্ড এবং একটা কিচেন। ওয়েল ডেকোরেটেড করা আমার ফ্ল্যাটটির ওয়াল এবং ফ্লোর গ্লাস টাইলস দিয়ে ডেকোরেশন করা। গ্লাস টাইলসগুলো সমুদ্রের পানির মতো স্বচ্ছ নীল। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে যে, আমার ফ্ল্যাটটি কোনো সুইমিং পুলের মধ্যে অবস্থিত ।

প্রায় আট মাস হতে চললো ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছি, প্রত্যেক মাসের ভাড়া বাংলাদেশি টাকায় প্রায় দুই লক্ষ টাকা পড়ে।

এই আট মাসে একদিনও আমি আমার কিচেনটা ব্যবহার করিনি কুকিং করার কাজে। প্রত্যক দিন বাইরে থেকে খেয়ে আসি। ভাবলাম আজ কিছু একটা কুকিং করি। নিজেকে হ্যাপি ট্রিট দেবার জন্য কিছু স্পেশাল কুকিং করতে চাইলাম। কিন্তু সমস্যা হলো আমি কোনো রান্না জানি না। তাই রেসিপি বই বের করে খুঁজতে লাগলাম খুব সহজ পদ্ধতিতে কি রান্না করা যায় সেই সব রেসিপি। আমি ইউরোপিয়ান খাদ্যে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কারণ এইখানে দেশি খাবার রেঁধে খাওয়ানোর জন্য কেউ নেই। রেসিপি বই থেকে দুটি পদ বেছে নিলাম- একটি হচ্ছে ম্যাক এন্ড চিজ পাস্তা এবং টমেটো স্যুপ। আর ডেজার্ট এর জন্য বেছে নিলাম থ্রি লেয়ার্ড চকোলেট ব্রাউনি।

পদগুলো বেছে নেবার আরও একটা কারণ হলো, আমার ফ্রিজে স্টক করাই আছে চিজ, পাস্তা, টম্যাটো স্যুপ প্যাক এবং দুই কার্টন ভর্তি করা বিভিন্ন ধরনের বেলজিয়াম চকোলেট। বেলজিয়াম চকোলেটের স্বাদ আমার খুব ভালো লাগে। গভীর রাতে ক্ষুধা পেলে ঘুম থেকে উঠে আমি চকোলেট খেয়ে থাকি। রান্না করতে গিয়ে একটা সমস্যায় পড়লাম, ব্রাউনি বানানোর জন্যে ময়দার প্রযোজন, কিন্তু আমার ঘরে কোনো ধরনের ময়দা বা কর্ন ফ্লাওয়ার নেই। পরে বুদ্ধি করে কুকিজ গুঁড়ো করে ব্রাউনির বেস তৈরি করে তার মধ্যে গলানো মিল্ক চকোলেট ঢেলে দিলাম। তারপর প্রি হিটেড ওভেনে দিয়ে ১৫ মিনিট বেক করতেই, তৈরি হয়ে গেল আমার নিজের হাতের তৈরি করা থ্রি লেয়ার্ড চকোলেট ব্রাউনি। ১১ টায় রান্না করতে ঢুকে প্রায় দুপুর দুইটা বাজলো রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে আসতে।

নিজের হাতের রান্না এই প্রথম খাচ্ছি। মনে হচ্ছে স্বর্গীয় স্বাদ। প্রতি বাইটেই পাচ্ছি স্বাদের পরিপূর্ণতা। রেসিপি বইয়ে যেভাবে এবং যে পরিমাণে রান্না করার কথা লেখা রয়েছে। ঠিক সেইভাবেই রান্না করেছি মেপে মেপে। তাইতো রান্নাটাও হয়েছে সেই রকম চমৎকার। পাস্তা আর স্যুপ খেয়েই পেট ভরে গেছে। ব্রাউনি পরে খাবার জন্য রেখে দিয়ে কিচেন পরিস্কার করতে ঢুকলাম।

কিচেনের সবকিছু চকচকে এবং ঝকঝকে করে বিকাল পাঁচটায় রেডি হয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হলাম সেভিনার অ্যাপার্টমেন্ট-এর উদ্দেশ্য । হিসাব করে দেখেছি আমার ফ্ল্যাট থেকে সেভীনার অ্যাপার্টমেন্ট-এ পৌঁছাতে প্রায় চল্লিশ মিনিটের মতো সময় লাগবে। একটু আগেই বের হলাম কারণ রাস্তার পাশের কফি শপগুলোর একটায় ঢুকে কফি খেয়ে রওনা দেবার জন্য।

কফি এবং কিছু স্ন্যাক্স খেয়ে প্রায় ছয়টার দিকে কফি শপ থেকে রওনা দিলাম শেভিনার অ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে। মেট্রো রেলের স্টেশন এ দাঁড়িয়ে রয়েছি। ছয়টা পনেরোয় ছেড়ে যাওয়া মেট্রোরেল ধরার জন্য। আমার পাশেই স্টেশনের কম্পাউল্ড এ দাঁড়িয়ে একজন মেয়ে এবং একজন ছেলে খুব ঝগড়া করছে। তাদের কথা শুনে বুঝতে পারছি, মেয়েটি প্রেগন্যান্ট এবং মেয়েটি তার বাচ্চাটিকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে চাইছে কিন্তু ছেলেটি আপত্তি করছে বাচ্চাটিকে পৃথিবীতে আনতে। কৌতূহলবশত তাদের দিকে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলাম দুইটি পরিচিত মুখ।

লোকটির সব কথা শুনতে পেয়েছি আমি, লোকটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যক্তি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লোকটিকে প্রথম যখন দেখেছি তখনও পছন্দ হয়নি। এখন তো মনে হচ্ছে লোকটিকে শায়েস্তা করতে পারলে শান্তি পেতাম।

পর্ব-৩
পরিচিত মুখ দুইটা কিছুক্ষণ পরেই উধাও হয়ে গেলো। আরও কিছুক্ষণ পরে মেট্রোরেল-এ চড়ে পারি জমালাম শেভিনার অ্যাপার্টমেন্টর উদ্দেশ্য।

রু দ্যা লা পেক্স, আধুনিক প্যারিস এর নতুন সংস্করণ। প্যারিসের এই এরিয়ায় রয়েছে আধুনিক মানের যতসব মালটিষ্টরোয়েড অভিজাত স্কাইসক্রাপার বিল্ডিং, অ্যাপার্টমেন্ট এবং মার্কেট প্লেস। Dior -এর ফ্যাশন হাউস শেভিনার অ্যাপার্টমেন্টটি খুঁজে পেতে খুব কষ্ট পেতে হয়নি আমাকে। অ্যাপার্টমেন্ট এ প্রবেশ করতেই রিসেপশনে শেভিনার দেয়া ভিজিটিং কার্ডটি দেখাতেই, আমাকে আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে পাঠিয়ে দিলো তাপরা। আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে দেখলাম বিশাল আয়োজন চলছে Dior -এর নিউ মেকআপ কিট লঞ্চ হবার জন্য। ফ্যাশন শো-এ ক্যাট ওয়াক এর জন্য শত শত মাটির তলার ফ্লোরে এতো বিশাল আয়োজনের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। এতো মানুষের মধ্য শেভিনা কে কোথায় খুঁজে পাবো এবং কাকেই বা জিজ্ঞাসা করবো বুঝতে পারছি না।

একজন মেকআপ আর্টিস্টকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-শেভিনা মাদামকে কোথায় পাওয়া যাবে? মেকআপ আর্টিস্ট লোকটি আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,
-তুমি কি ইভানিং শো-এ হাঁটছো ?
-আমি বললাম আমি জানি না, আমি নতুন এইখানে। শেভিনা মাদাম বলতে পারবেন ভালো, আমি ইভনিং শো-এ হাঁটছি না মিড নাইট শো-তে হাঁটছি।
মেকআপ আর্টিস্ট লোকটি মুখ বাঁকা করে বললো,
-তাহলে আমার সময় নষ্ট করছ কেন যাও শেভিনা মাদামকে খোঁজো। তার কথা শুনে বোকা হয়ে গেলাম। আমি নাকি তার সময় নষ্ট করছি?
একজন মাথা কামানো টাকলি মডেল গার্ল মেকআপ নিতে নিতে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
-তুমি কি ইন্ডিয়ান। আমি বললাম,
-আমি বাংলাদেশি। মেয়েটি বললো,
-এইটা আবার কোথায় অবস্থিত? মেয়েটির কথা শুনে রাগে গা জ্বলে উঠলো। বললাম,

-ম্যাপ দেখে বের করে নাও গে কোথায় অবস্থিত। খেয়াল করে দেখছি মডেল গার্ল থেকে শুরু করে মেকআপ আর্টিস্ট এরা সবাই আমাকে দেখছে আর নিজেদের মধ্য আমার অতিমাত্রার উচ্চতা নিয়ে আলোচনা করছে। আরও খেয়াল করে দেখলাম এইখানে আমার চেয়ে লম্বা কেউ নেই। আমার অতিমাত্রার উচ্চতা নিয়ে আমি যেন ওদের সবার মধ্যে মনি হয়ে গেছি। আরও কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করে যখন শেভিনা ম্যাডাম এর দেখা পেলাম না তখন ভাবছি ফিরে যাবো, সেই মুহুর্তেই একজন লোক যে মেয়েদের মতো সাজ নিয়েছে, সে যেন কোথায় থেকে এসে আমাকে বললো,

-তুমি এখনও মেক আপ নাওনি কেন আর এক ঘন্টার মধ্যই শো শুরু হয়ে যাবে। আমি কিছু না ভেবেই বললাম, যে আমাকে মেকআপ করাবে তাকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না।
মেয়েদের মতো সেজে থাকা লোকটি বললো,
-আমিই তোমার মেক আপ করছি। তুমি শুধু চেঞ্জ করে এসো।
লোকটিকে বললাম,
-আমি তো কোনো ড্রেস নিয়ে আসেনি যে চেঞ্জ করবো। লোকটি একটি মিচকি হাসি দিয়ে বললো,
-Dior- এর ফ্যাশন এ Dior এরই ড্রেস ম্যাটেরিয়ালস পড়তে হয়। এসো আমার সাথে এই বলে লোকটি আমাকে একটা বিশাল হল রুমে নিয়ে এলো এইখানে, Dior এর হাজার হাজার পোশাক হাঙ্গার করে রাখা রয়েছে। মেক আপ আর্টিস্ট লোকটি লোকটি আমাকে বললো,
-তুমি তোমার পছন্দ অনুযায়ী ড্রেস পরে নাও, শো শেষে যাবার সময় ড্রেসটা খুলে রেখে নিজের ড্রেস পরে চলে যাবে। আমি হাই কর্লাড অফ হোয়াইট বাস্কি গাউন এবং অ্যাস কালারের লেগিংস পছন্দ করে পড়লাম। লোকটি আমার মেকআপ করিয়ে দিতেই আমার চেহারা একদম চেঞ্জ হয়ে গেলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে এইটা আমি। লুকিং গ্লাসে নিজের বদলানো রূপ দেখে মনে হাই লেভেলের কনফিডেন্স চলে আসলো।

যে আমার মেক আপ করলো তার নাম ভাচ্চিও। মেক আপ করানোর সময় ভাচ্চিও আমাকে বললো, জানো তোমার স্কিন কালার টা খুব প্রিসিয়াস, মডেল গার্লরা স্কিনের এই রংটা পাওয়ার জন্য, রোদে পুড়ে স্কিন ট্যান করে। ভাচ্চিওর কথা শুনে আমার তো চোখে পানি চলে এসেছিল। আমার গায়ের রং লাইট ব্রাউন মানে উজ্জল শ্যামলা। আমার ভাইবোনদের মধ্যে আমার গায়ের রংটা ছিল সবার চেয়ে চাপা। এই জন্য আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে কম কথা শুনতে হয়নি আমাকে। ভাচ্চিওর কথা শুনে মনে হচ্ছে, ওর কথাগুলো রেকর্ড করে বাংলাদেশের বিটিভিতে প্রচার করে দিই। যেনো বাংলাদেশের মানুষ জেনে রাখে যাদের গায়ের রং শ্যামলা বা উজ্জল শ্যামলা তারা একেকজন প্যারিসের প্রিসিআস মডেল গার্ল হবার যোগ্যতা রাখে।

প্রথমে ভেবেছিলাম মডেলিং ব্যাপারটা বিশাল এবং জটিল কিছু ব্যাপার। কিন্তু প্যারিসে এসে দেখলাম আসলে মডেলিং ব্যাপারটা একদম পানির মতো সহজ। এইখানে মডেল হবার জন্য ছুঁচালো নাক কিংবা নিখুঁত চেহারার কোনো প্রয়োজন নেই। মনে সাহস এবং জোর থাকলেই হলো। স্টেজে ক্যাট ওয়াক করা তো আরও সহজ।

সাজপোশাক পড়ে স্টেজ বরাবর হেঁটে যাও এবং ফিরে আসো পূর্বের স্থানে। স্টেজে একবার হেঁটেই বুঝে গেলাম এটাই হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে সহজ পথ অর্থ এবং নাম কামানোর জন্য। আগে থেকেই আমি একজন রাফ এন্ড টাফ ধরনের মেয়ে তাই, স্টেজে প্রথম ক্যাট ওয়াক করলেও কোনো ধরনের সংকোচ হলো না আমার। মডেলিং-এ অনেক ধরনের মেয়ে রয়েছে, ফর্সা, কালো, শ্যামলা, লম্বা, মাঝারি গড়ন, হাড় জিরজিরে পাতলা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যবান মেয়েরাও।

কে কখন টপে উঠে এইটা বলা মুশকিল। তাই নামি দামি ব্রান্ডগুলো সব ধরনের মেয়েদেরকে দিয়ে তাদের প্রোডাক্টের ফ্যাশন শো-এর মাধ্যমে তাদের পণ্যের মার্কেটিং করে থাকে। প্রথম দিনেই পরপর তিনটা শো করলাম। প্রথম শো করার পর শেভিনা নিজেই আসলো আমার খোঁজে। আমাকে সে বললো,

-তোমার প্রথম শো টা সফল হয়েছে। Dior -এর উপস্থিত সব এজেন্ট তোমার খুব প্রশংসা করছিল। তুমি খুব সুন্দরভাবে নিজেকে এবং Dior -এর প্রোডাক্টগুলোকে তুলে ধরতে পেরেছ। তারা তোমাকে আরও দুইটা শো করার জন্য অনুরোধ করছে। তুমি কি রাজি? আমি সেভিনা কে জড়িয়ে ধরে বললাম,
-তোমাকে অনেক ধন্যবাদ শেভিনা। তুমি না থাকলে এত বড়ো স্টেজে আসার কোনো সুযোগই পেতাম না। শেভিনা বললো,
-শুধু ধন্যবাদ দিয়ে হবে না। আমাকে চকোলেট গিফট্ দিতে হবে। আমি হাসতে হাসতে বললাম -শুধু চকোলেট? শেভিনা বললো,
-চাইলে চকোলেট এর সাথে কেক ও দিতে পারো। ইভনি,নাইট এবং মিড নাইটের তিনটা শো করে একসাথে একশো আশি ইউরো পেয়েছি।

একসাথে এতো ইউরো এই প্রথম আয় করলাম। মনের মধ্যে অনেক আনন্দ এবং খুশি নিয়ে রাত আড়াইটায় আমার ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। আাসার সময় Dior -এর সুপারভাইজার আমাকে বললেন, খুব শীঘ্রই Dior -এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর তোমার সাথে কন্ট্যাক্ট করবেন। তোমাকে Dior -এর ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর বানানোর জন্য।

বুঝতেই পারছি সামনেই রয়েছে আমার সোনালি দিন… তারপরেও কেনো জানি না কি একটা ব্যাপার নিয়ে মনে মধ্যে খচখচ করেই যাচ্ছে। বারে বারে মন যেন কু গেয়ে উঠছে। বলছে সব কিছু এতো সহজ হবার ব্যাপারে কোনো ষড়যন্ত্র নেই তো?

পর্ব-৪
ফ্ল্যাট এসে ফ্রেশ হয়ে, আমার তৈরি করা চকোলেট ব্রাউনিটা খেতে বসলাম। ইভনিং শো-এর পর থেকে পেটে কিছু পরেনি। সেইখানে শত শত মডেল গার্লদের জন্য খাবারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। নিজের তৈরি করা ব্রাউনি খেতে খেতে শেভিনা কে কি গিফট দেয়া যায় সেইটা ভাবতে লাগলাম। চিন্তা করলাম শেভিনা যখন মুখ ফুটে চকোলেট এবং কেক চেয়েছে তখন তাকে সেগুলোয় গিফট করা উচিত। ঘড়ি দেখলাম এখন বাজে রাত চারটা। আজকে সন্ধ্যায় আবার আমাকে শো-এ অংশ গ্রহণ করতে হবে। সারাদিন ঘুমাবো, হাতে রয়েছে প্রচুর টাকা তাই সিদ্ধান্ত নিলাম স্কেচ করতে আর বের হবো না। ঘুম থেকে উঠে বিকালেই বের হয়ে যাবো শো-এর উদ্দেশ্যে।

মেট্রো রেল থেকে নেমে বিকাল সাড়ে ছয়টায় প্যারিসের বিখ্যাত কেক শপ লা বলেঙ্গেরি থেকে ১২ পিসের এক সেট বিভিন্ন ডিজাইন এবং স্বাদ বিশিষ্ট অপেরা কেক এবং এক কার্টন বেলজিয়াম চকোলেট নিলাম সেভিয়ার অ্যাপার্টমেন্ট এর উদ্দেশ্যে চকোলেট নিলাম সেভিনার জন্য। এবার ট্রামে চড়ে রওনা দিলাম সেভিনার অ্যাপার্টমেন্ট এর উদ্দেশ্যে।

ট্রামে বেশি লোকজন নেই। আমার পাশের সিটেই বসে রয়েছে, গতকালের সেই পরিচিত মুখ যে তার আগত সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে চাইছে বলে তার বয়ফ্রেন্ড এর সাথে মেট্রোরেল-এর কম্পাউন্ড এ দাড়িয়ে ঝগড়া করছিল। এইটুকু জানি মেয়েটির নাম মেনোরা, যে আমার স্কেচের বিনিময়ে এক্সট্রা ১০ ইউরো দিতে চেয়েছিল। দেখলাম উদাসী মুখে বসে রয়েছে। মেরোনা বলে ডাক দিতেই সে আমার দিকে তাকালো, প্রথমে সে আমার চেহারা দেখে মনে করার চেষ্টা করলো আমার মুখটা পরিচিত কিনা।

চিনতে পেরে বললো, Salute, enchant de vous recontrer, comment vas tu?

ফ্রেঞ্চ মানুষদের এই জিনিসটা আমার খুব ভালো লাগে, তারা খুব সহজেই মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে। অল্প পরিচিত মানুষের সাথেও তারা এমন ব্যবহার করে দেখে মনে হয়, যেনো কতকালের পরিচিত। আমিও তার সাথে কুশল বিনিময় করে মিশে গেলাম। তাকে বললাম

-গতকাল তোমাকে আর তোমার বয়ফ্রেন্ডকে দেখলাম মেট্রোরেলের কম্পাউন্ড এ ঝগড়া করছিলে, কোনো সমস্যা হয়েছি কি তোমার সাথে তোমার বয়ফ্রেন্ডের? তার প্রাইভেসি নিয়ে কথা বলছি দেখে সে এতটুকুও রাগ করলো না বরং সে এক ধরনের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জানালো। গতকালই তার বয়ফ্রেন্ড তাকে ছেড়ে চলে গেছে । কোথায় চলে গেছে মেরোনা জানে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
-কেনো সে তোমাকে ছেড়ে চলে গেলো?
মেরোনা বললো,
-আমি ওর দ্বারা প্রেগনেন্ট হয়েছি অথচ সে তার বাচ্চাটিকে স্বীকার করছে না। বলছে এইটা নাকি তার বাচ্চা না, আমি নাকি অন্য কারও দ্বারা প্রেগনেন্ট হয়ে ওর বাচ্চা বলে দাবি করছি। এই বলে মেরোনা দুঃখে কেঁদে ফেললো। জিজ্ঞাসা করলাম ,
-কয় দিনের সম্পর্ক তোমাদের? মেরোনা জানালো,
-৯ মাসের সম্পর্ক আর প্রেগন্যান্ট হওয়া হলো দুই মাস। আরও জিজ্ঞাসা করলাম,
-তোমার প্রফেশন কি? মেরোনা বললো,
-আমি একজন লাইব্রেরিয়ান। আমার লাইব্রেরিতেই আমার বয়ফ্রেন্ড-এর সাথে পরিচয় হয়েছিলো তারপর আস্তে আস্তে বন্ধুত্বে এবং পরে আমরা ঘনিষ্ট সম্পর্কে জড়িয়ে যাই। মেরোনা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
-তুমি কি ইন্ডিয়ান? আমি বললাম,
-না, আমি বাংলাদেশি, ইন্ডিয়া আমাদের প্রতিবেশি দেশ। মেরোনা জানালো সে বাংলাদেশ এর ইতিহাস সম্পর্কে জানে। আমাকে বললো,
-তোমরা তো অনেক সাহসী মানুষ। সত্যিই তোমাদের ইতিহাস গর্ব করার মতো। মেরোনার কাছ থেকে আমার দেশের প্রশংসা শুনে আমার মন বিগলিত হয়ে গেলো। মেরোনা আমার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললাম,
-আমার সাথে যোগাযোগ রেখো। যদি কখনো তোমার কোনো উপকারে আসতে পারি তাহলে আমার খুব ভালো লাগবে। মেরোনাও তার লাইব্রেরির নাম্বার দিয়ে বললো,
-তোমারও যদি কখনো আমার প্রয়োজন পরে তবে লাইব্রেরিতে কল দিলেই আমার ঠিকানা পেয়ে যাবে। আমি মেরোনাকে বললাম,
-তুমি কি প্যারিস এ একাই থাকো। সে বললো,
-হ্যাঁ এবং জানালো সে একটা এতিমখানায় মানুষ হয়েছে।
ও একজন এতিম এই কথাটা শুনে আমার বুক কেমন যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। জিজ্ঞেস করলাম,
– তুমি যে তোমার বাচ্চাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসছো তুমি কি তাকে একাই মানুষ করতে পারবে?
মেরোনা হাসি মুখে বললো,
-কেনো পারবো না, আমি যদি বাবা-মা ছাড়া ভালো মানুষ হতে পারি, সেই হিসেবে আমার সন্তান শুধু মায়ের ভালবাসা নিয়ে আরো ভালমত মানুষ হতে পারবে।
আমি বললাম,
-কিন্তু তোমার একা একা সন্তান মানুষ করতে কষ্ট হবে অনেক। মেরোনা বললো,
-আমি আমার সন্তান এর মুখ দেখে সব কষ্ট সহ্য করে নিতে পারবো।
ট্রাম থেকে নামার সময় মেরোনার হাতটি ধরে বললাম,
-তুমি অবশ্যই আমার সাথে যোগাযোগ দেখো এবং যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে অবশ্যয় কল দিয়ে আমার সাহায্য নিতে পারো।

প্রায় তিন মাস অতিবাহিত হয়ে গেলো, ফ্যাশন জগতে আমার পা দেয়া। এই তিন মাসে আমার জীবন কোথায় থেকে কোথায় চলে এসেছে হিসাব করে দেখলে অলৌকিক বলে মনে হয়। । আমিই এখন Dior -এর প্রধান ফ্যাশন হোস্ট। গত সপ্তাহেই Vogue Paris Magazine -এর কভার পেজে আমার ছবি বের হয়েছে এবং Vogue Paris হচ্ছে  প্যারিসের বিখ্যাত ফ্যাশন ম্যাগাজিন। এই ম্যাগাজিনে একমাত্র বিখ্যাত মডেলদেরই ছবি বের হয়ে থাকে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে আমি এখন প্যারিসের সবচেয়ে বিখ্যাত ফ্যাশন আইকন। আমার রোজগারও অনেক বেড়ে গেছে। আমার আয় থেকে দেশে প্রচুর টাকা পাঠাচ্ছি, আমার সব গরীব আত্মীয় স্বজনদের জন্য এবং নিজের ভবিষ্যতের জন্যও জমা করছি প্রচুর অর্থ। ভেবে রেখেছি ভবিষ্যতে দেশে গিয়ে একটা স্কেচ স্কুল খুলবো, যেখানে পথ শিশুদেরকে বিনামূল্য স্কেচ শেখাবো, আর তারা স্কেচ শিখে নিজেদের পায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অনেক টাকা রোজগার করবে।

আমার পুরোনো ফ্ল্যাট চেঞ্জ করে ডাবল বেডের ফ্লাটে উঠেছি। মেরোনা এখন আমার সাথে থাকছে। কারণ ওর সেবা শুশ্রুষা করার কেউ নেই, তাই আমিই ওকে নিয়ে এসেছি আমার ফ্ল্যাটে। মানবিকতার খাতিরে যতটুকু পারি আমি ওর যত্ন নেয়ার চেষ্টা করি। মেরোনা কোনোমতেই আমার ফ্ল্যাটে আসবে না। আমি ওর বাচ্চার দোহাই দিয়ে ওকে নিয়ে এসেছি। সেই থেকেই সে আমার এইখানে থাকছে।

ফ্যাশন জগতটা বাইরে থেকে দেখে যতটা জাকজমকপূর্ণ বলে মনে হয় ভিতর থেকে ততটাই অন্ধকার। আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছি, এই জগতে আসা যতোটা সহজ, বের হওয়া ততটাই কঠিন। এই তিন মাসে অনেক কিছুই চেঞ্জ হয়ে গেছে শুধু একটা জিনিসই চেঞ্জ হয়নি আর সেটা হলো, আমার মেকআপ আর্টিস্ট। ভাচ্চিও এখনও আমার মেকআপ আর্টিস্ট হয়ে রয়ে গেছে। আমারও যেমন কদর বেড়েছে ফ্যাশন জগতে, ভাচ্চিও-রও কদর বেড়েছে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে। আজকে launch হতে যাচ্ছে Dior-এর নতুন ডিজাইন এর আসন্ন শীতের পোশাক। ভাচ্চিও আমার মেকআপ করছে আর আমাকে সাবধান বাণী শুনাচ্ছে। বলছে,

-তুমি এখন বিখ্যাত মডেলে পরিণত হয়েছ। তোমার আশেপাশে এখন বিভিন্ন কোম্পানির দালালই ঘুরাঘুরি করবে। সাবধানে থেকো যেন এইসব দালালদের খপ্পড়ে না পরো। বেশির ভাগ দালালই কিন্তু ফ্রড এবং ব্লাকমেইলার। জিজ্ঞাসা করলাম,
-কি নিয়ে তারা ব্ল্যাকমেইল করে। ভাচ্চিও কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
-ড্রাগস্ নিয়ে। আমি বললাম,
-কিন্তু আমি তো কোনো ড্রাগস্ নিই না। ভাচ্চিও বললো,
-এখন তুমি নাম করে গেছো বিভিন্ন ধরনের ড্রাগস্ ডিলার রা তোমাকে টার্গেট করবে করবে তাদের ড্রাগস্ সেবন করার জন্য। বলবে তাদের পিওর ড্রাগস্ সেবন করলে তুমি কোনদিন মোটা হবে না, তোমার স্কিন কোনোদিন ঝুলে যাবে না, শরীরে কোনো দাগ থাকবে না, বয়স বাড়লেও তোমার চেহারা সবসময় ইয়াং থাকবে। এইসব কথা বলে তোমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করবে। আমি বললাম,
-আমি যদি তাদের প্রলোভনে না পা দেই তাহলে? ভাচ্চিও বললো,
-না পা দিলে তারা তোমাকে অন্যভাবে রাজি করার চেষ্টা করবে। জিজ্ঞাসা করলাম,
-অন্যভাবে রাজি করা বলতে কি বুঝাচ্ছ? ভাচ্চিও বললো,
-তাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের কৌশল থাকে তারা সেই কৌশল ব্যবহার করবে। তোমাকে শুধু সাবধান থাকতে হবে তাদের কে এড়িয়ে যাবার। ভাচ্চিও আরও বললো,
-দেখো না, নামকরা বড়ো বড়ো মডেলগুলো আত্মহত্যা করে। কেন জানো, তারা আত্মহত্যা করে ড্রাগস্ সেবন করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে যখন তারা সেই ড্রাগস্ আর না পায় তখন তারা আত্মহত্যা করে। অনেকে আবার ব্ল্যাকমেইল এর ফাঁদে পড়ে আত্মহত্যা করে। ভাচ্চিও কে বললাম,
-তুমি এত কথা আমাকে বলছো কেন? তোমার কি মনে হয় আমি ভবিষ্যতে ড্রাগস্ নিবো? ভাচ্চিও বললো,
-তুমি তো নিতে চাইবে না কিন্তু তোমাকে জোর করে নিতে বাধ্য করবে? আমি বললাম,
– কে আমাকে নিতে বাধ্য করবে? ভাচ্চিও আবার কানে ফিসফিস করে বললো,
– Dior -এর এজেন্টরাই তোমাকে ড্রাগস্ নিতে বাধ্য করবে। পিছনে ওরাই হচ্ছে ড্রাগস্-এর মাফিয়া। তোমাকে যেমন তারা বেশি পরিমাণের অর্থ নিচ্ছে শো করার জন্য, আমার ওরাই তোমাকে ড্রাগ অ্যাডিক্ট করানোর মাধ্যমে তোমার যাবতীয় কিছু হাতিয়ে নিবে। এইটাই হচ্ছে ফ্যাশন জগতের রাজনীতি। আজ ওদের নিয়ে তুমি নাম করছো, কাল ওরাই তোমার কাছ থেকে সব কিছু নিংড়ে নিয়ে তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবে। আজ তুমি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছো কাল থেকে অন্য আর একজন কে দাঁড় করাবে। ভাচ্চিওর কথা শুনে বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। ভাচ্চিও কে বললাম,
-ওদের হাত থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই? ভাচ্চিও বললো,
-আছে, কিন্তু উপায়গুলো আমি তোমাকে পরে বলবো। কারণ এখন তোমার স্টেজে উঠার সময় হয়ে গেছে।

ভাচ্চিওর কথা শুনে মনে মনে ভাবছি, আমি আসলে কিছুই না, ওদের হাতের পুতুলমাত্র। ওরা আমার সাথে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আমার কোনো ক্ষমতা নেই ওদের বিরুদ্ধে যাবার, কারণ এই প্যারিস সিটিতে আমি একজন অসহায় নারী ছাড়া আর কিছুই না। অসহায় নারীদেরকে যে কেউ ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে অনায়াসে। কারণ অসহায় নারীদের হয়ে পদক্ষেপ নেবার কেউ থাকে না। এই জন্যই কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সন্তানেরা মডেল হতে পারে না। কারণ ক্ষমতাধর ব্যাক্তিদের সন্তানদের জন্য পদক্ষেপ নেয়ার কেউ থাকে বলে।

আজকের রাত দশটায় শো শেষ করেই আমার ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এখন আমার নিজের গাড়ি রয়েছে। জার্মান ফোর্ড কিনেছি। গাড়ি কাছে আসতেই দেখি কেউ একজন আমার গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটির কাছে আসতেই বললো,
-আমি  পি আর গুরুঠাকুর। দেখেই বুঝেছি ইন্ডিয়ান।
শুনেছি পি আর গুরুঠাকুর ভারতের সবচেয়ে নামিদামি জুয়েলারি ব্রান্ড।
মনে প্রশ্ন জাগলো, সেই ব্রান্ডের মালিক কি ইনি? আমি বললাম,
-আমি বর্ষা হোসেন। লোকটি বললো ,
-আমি জানি তোমার নাম আর তুমি ইন্ডিয়ান এও জানি। আমি বললাম,
-আপনি ভুল জানেন, আমি বাংলাদেশি।
লোকটি তর দুই হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে নিয়ে বললো,
-বাংলাদেশকে আমরা আমাদের একটা স্টেট হিসেবেই গণ্য করি। লোকটির কথা শুনে রাগে গা আমার জ্বলে গেলো, বললাম,
-আমাদের দেশের রয়েছে নিজের একটা পতাকা, আমাদের রয়েছে আলাদা আইন ও সংস্কৃতি এবং রয়েছে সমৃদ্ধশালি একটা ইতিহাস। আপনি কোন দাবিতে বলতে বলতে পারেন যে বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার একটা স্টেট? লোকটি ওভার স্মার্ট সাজার জন্য বললো, আমি আসলে পরীক্ষা করে দেখছিলাম, আপনি কতোটা আপনার দেশকে ভালোবাসেন। আমি বললাম,
-নিজের চরকায় তেল দেন। আর অযথা আজেবাজে কথা বলে মানুষের সময় নষ্ট করবেন না। লোকটি বললো,
-আপনি বোধহয় আমার সম্পর্কে জানেন না। তাই আপনি আমার সাথে এইভাবে কথা বলছেন।
লোকটিকে ভালো করে দেখলাম, স্বীকার করি একটা পুরুষ মানুষের মেয়েদেরকে আকর্ষণ করার মতো রকম গুণ থাকা প্রয়োজন লোকটির সেই সকল সব গুণই রয়েছে। পি আর গুরু ঠাকুরের বয়স খুব জোর হলে ৩৫ থেকে ৩৬ বছর হবে। লম্বা, চওড়া, চার্মিং এবং স্মার্ট। বললাম ,
-আপনাকে চিনলেই বা আমার কি আসে যায়। গুরু ঠাকুর বললেন,
-আমিও একজন ভারতের প্রতিষ্ঠিত জুয়েলারি ব্রান্ড-এর কর্ণধার। আমি প্যারিসে এসেছি শুধু আপনার টানে। আমি বললাম,
-আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। কালকে লা প্যাটেসেরী কফি শপে চলে আসবেন বিকাল চারটায়। সেইখানে আপনার সব কথা শুনবো। আজ আসি এই বলে গাড়িতে চড়ে, গাড়ি স্টার্ট দিলাম।

পর্ব-৫
বিকাল চারটায় আইফেল টাওয়ার এর মাথায় অবস্থিত লা প্যাটেসেরি কপি শপে বসে অপেক্ষা করছি পিআর গুরু ঠাকুরের জন্য। অপেক্ষা করার কথা তার, অথচ অপেক্ষা করছি আমি। ব্যাপারটা সত্যিই আজব দেখাচ্ছে। তার জন্যে অপেক্ষা করার কারণ রয়েছে আমার। আমি জানতে চাই, গুরু ঠাকুর কি উদ্দেশ্যে আমার পিছনে লেগেছে? আইফেল টাওয়ারের চূড়োয় বসে নিচের প্যারিস সিটি এবং আঁকাবাঁকা সীন নদী দেখতে যতটা না ভালো লাগছে, তার চেয়ে বেশি ভালো লাগছে শরতের ঘন নীল আকাশে ঘনীভূত তুলোর মতো শ্বেত রঙের ভেসে বেড়ানো মেঘ দেখতে। এইখান থেকে মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই সাদা মেঘগুলোকে ছুঁতে পারবো।
চারটা দশে দেখা দিলেন গুরু ঠাকুর। আমার টেবিলের সামনের চেয়ার বসলেন তিনি। লোকটি খুব কড়া ধরনের পারফিউম স্প্রে করে এসেছে। পারফিউমের গন্ধ টা নাকে এসে লাগছে। লম্বা, চওড়া, সুদর্শন এবং খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা গুরু ঠাকুর এসেই দুই কাপ কফির অর্ডার দিলেন। ক্ষমা চেয়ে বললেন,

– দেরি হয়ে গেল ম্যাম আসতে। আমি সরাসরি বললাম,
-বলুন আপনার কি বলার আছে আমাকে। প্রথমেই তিনি শুরু করলেন, আমার প্রশংসা করা। বিরক্ত হয়ে বললাম,
– আমি এগুলো শুনতে আসিনি, আমি শুনতে এসেছি আপনার উদ্দেশ্য টা কি? লোকটি একটু কাচুমাচু হয়ে বললো,
-আমার উদ্দেশ্য আপনার সাথে বন্ধুত্বের সর্ম্পক গড়ে তোলা, ব্যাস এইটুকু আর কিছু না। আমি বললাম,
-আমার সাথে বন্ধুত্ব করে আপনার লাভ কি এবং একই সাথে আমার কি লাভ হতে পারে? গুরু ঠাকুর বললেন,
-আমাদের দুজনেরই অনেক লাভ হতে পারে ম্যাডাম। আপনি একজন মডেল এবং আমি একজন ভারতের নামকরা জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের মালিক। আমার জানা মতে আপনি আর মাত্র চারমাস আছেন Dior’এর অ্যাম্বাসেডর হয়ে। এর পড়ে আপনাকে তারা চেঞ্জ করে অন্য একজন কে তাদের ফ্যাশন এর প্রধান হোস্ট বানাবে। সেক্ষেত্রে দেখা যাবে আপনার কাজের সংকট, তখন আপনি আমার জুয়েলারি ব্রান্ড-এর আ্যাম্বাসেডর হতে পারেন। এইখানে Dior আপনাকে যে পরিমাণ অর্থ দিয়েছে, আমি তাদের চেয়ে ডাবল দিবো। ভেবে দেখুন একবার, আমরা দুজনেই কিন্তু লাভবান হচ্ছি। আপনার জনপ্রিয়তা এবং খ্যাতি দিয়ে দিয়ে আমি যেমন আমার কোম্পানি কে পৃথিবীর বড়ো বড়ো সিটি তে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো। ঠিক তেমনিভাবে আপনিও প্রচুর অর্থের মালিক হয়ে যেতে পারবেন।

গুরুঠাকুরের কথা শুনে ভাচ্চিওর কথা মনে পড়ে গেলো। ভাচ্চিও গতকালই আমাকে সাবধান করেছে- ‘‘দালালরা চেষ্টা করবে তোমাকে লোভ দেখিয়ে ট্রাপে ফেলার জন্য”। আমি লোকটিকে বললাম,

-আপনি কিভাবে শিওর হচ্ছেন যে Dior-এর সাথে আমার কনট্র্যাক্ট এর মেয়াদ আর বাড়বে না? লোকটি বললো,
– ম্যাডাম আমিও কিন্তু Dior-এর মতোই মডেল নিয়ে ব্যবসা করি। আমার কানে এসেছে তারা আপনার জায়গায় মেলিন্ডাকে কনট্র্যাক্ট দিবে। উফফ, মেলিন্ডা। আবারও মেলিন্ডার নাম শুনতে হচ্ছে আমাকে। মেলিন্ডা আমার অপনেন্ট। শুনেছি সে নাকি খুব চেষ্টা করছে, আমাকে Dior থেকে সরিয়ে দেয়ার। এও শুনেছি, সে কিছুদিন আগেই Dior-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর এর সাথে, কিছুদিনের জন্য সমুদ্রের বুকে ইয়টে ভেসে প্রাইভেট ভ্যাকেশন এ প্রাইভেট সময় কাটিয়ে এসেছে। আমি গুরু ঠাকুরের কথা মেনে নিয়ে বললাম,
-চান্স আছে মেলিন্ডার বলতেই হয়। কারণ ও খুব পরিশ্রমী মেয়ে। যেহেতু ও খুব পরিশ্রম করছে, সেহেতু Dior ওকে কাস্ট করতেই পারে।
মনে মনে ঠিক করে নিলাম, গুরু ঠাকুরের সাথে আমার কন্ট্যাক্ট থাকা প্রয়োজন। লোকটির বন্ধুত্ব আমারও খুব প্রয়োজন। দেখাই যাক না আমাদের বন্ধুত্ব কতদূর এগোয়। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে গুরু ঠাকুর কে বললাম,
– আপনার কথা মনে থাকবে আমার। ভেবে দেখবো আপনার কথাগুলো। গুরু ঠাকুর তার একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললেন। আপনার যখন খুশি আপনি আমার এই নাম্বার এ আমার সাথে কন্ট্যাক্ট করতে পারবেন ম্যাম। আমি আপনার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম। গুরু ঠাকুরের কার্ডটি নিয়ে, চোখে ইয়া বড়ো একটা সানগ্লাস পড়ে রওনা দিলাম। লিফট এ প্রবেশ করতেই লিফটের মধ্যে থাকা একজন ব্যক্তি আমাকে চিনে ফেললো। বললো,
-আপনি Dior-এর মডেল বর্ষা হোসেন না? লোকটির কথায় আমি যদি হ্যাঁ বলি, তাহলে আমি জানি আমি কি মহাবিপদে পড়ে যাবো। আমার ফ্যানগুলো আমাকে ছেঁকে ধরে চিরে চ্যাপ্টা করে দিবে। আমি বললাম,
– না, আমি বর্ষা হোসেন না। তবে তার মতো হতে পারলে লাইফটাকে অনেক ধন্য মনে করতাম, লোকটি আমার কথা বিশ্বাস করলো কিনা জানি না, তবে এইটুকু বুঝলাম তিনি দোটানায় পড়ে গেছেন। ছয় মিনিট পর লিফট থেকে বেরিয়ে, মুখটাকে নিচু করে তাড়াতাড়ি গাড়িতে চলে বসলাম, যাত্রা শুরু করলাম শেভিনার অ্যাপার্টমেন্ট এর উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণ আগেই শেভিনা টেক্সট করেছে, আমার সাথে তার নাকি একটা জরুরি প্রাইভেট কথা আছে। একটু নাম কামিয়েছি কিনা, ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করে দিয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা। সব দেশেই রয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা। শেভিনার ফ্ল্যাটের বারে বসে রয়েছি। আমি মদ খাই না, কিন্তু শেভিনা খায়। ও বারে বসে আছে তাই আমাকেও ওর সাথে বসে থাকতে হচ্ছে। শেভিনার কথা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। বললাম,
– আমি রিজাইন করবো। শেভিনা বললো, কনট্র্যাক্ট এর মেয়াদ এক্সপায়ার না হওয়া অব্দি কেউ রিজাইন করতে পারে না। শেভিনা বললো,
-এতো বিচলিত হচ্ছো কেনো? বিখ্যাত হবার আনন্দ আছে যেমন, কষ্টেরও কিন্তু কমতি নেই। কষ্টকে ভয় পেলে হবে? কষ্টকে জয় করতে হবে। তবেই না টিকে থাকতে পারবে এই জগতে। বললাম,
– দেখছো না কিভাবে পিছনে লেগেছে সবাই। একমাত্র তুমি ছাড়া আর তো কেউ নেই আমার ভরসা করার মতো। শেভিনা বললো,
-যে ইনফরমেশনগুলো দিলাম তোমায়, সেগুলো, মাথায় রেখে সাবধানে থেকো। চিন্তুা করো না আমি তোমার ব্যাকে আছি। তোমাকে গার্ড করার জন্য। নিচে এসে ভাচ্চিওর খোঁজ করা শুরু করলাম। ও আমার যেমন মেক আপ আর্টিস্ট, ঠিক তেমনি আমার উপদেষ্টাও। যেকোনো ধরনের সমস্যার সমাধান ওর কাছ থেকেই পেয়ে থাকি। আমার শুভাকাঙ্ক্ষীও।
ভাচ্চিও-কে না পেয়ে হলে চলে আসলাম। আজ একাই নিজের সাজ নিবো, লাগবে না আমার ভাচ্চিও-কে। ড্রেস চুজ করে মেক আপ নিলাম নিজে নিজেই। আজকে পড়লাম গাঢ় সবুজ রঙের প্রিন্টেড জ্যাকেট এবং টিয়া রঙের সিল্কের প্লাজো। রাগে গজগজ করতে করতে মেক আপ ও নিলাম খুব ভারী মাত্রায়। আমি খুব ভালো করেই জানি এই ড্রেসে এতো ভারী মেক আপ যায় না। তারপরেও নিলাম ড্রেসের সঙ্গে ম্যাচ করে না এমন ধরনের মেক আপ। কারণ আমি চাইছি নিজেকে এই জগৎ থেকে আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিতে।
তিন রাউন্ড ramp শেষ করে আবার বের হলাম ভাচ্চিওর খোঁজে। কোথাও খুঁজে পেলাম না ভাচ্চিও কে। অথচ শুনলাম কিছুক্ষণ আগেই নাকি ও মেক আপ রুমে ছিল। মেলিন্ডা আমাকে দেখে টিজ করে বললো,
-আজকাল আজব ধরনের প্রানি আমাদের ফ্যাশন শো-তে আশ্রয় নিয়ে ফ্যাশন-এর রুচিগুলোকেই নষ্ট করে দিয়েছে। এইসব আজব ধরনের প্রানিগুলোকে ধরে চিড়িয়াখানায় দিয়ে আসলেই তো পারে। মেলিন্ডা যেমন আমার অপনেন্ট, মেলিন্ডারও রয়েছে আর এক অপনেন্ট। ওর নাম সোফি। আমার হয়ে সোফিই মেলিন্ডাকে বললো,
-মানুষ মডেলদের কাছ থেকে সবসময় ইউনিক সাজ-পোশাক আশা করে। আর ইউনিক সাজ পোশাকই মডেলদেরকে বিখ্যাত করতে সহায়তা করে, আর সেই সাজ যদি বর্ষা হোসেনের মতো কোনো মডেল করে তবে সেইটা তো সোনায় সোহাগা। দেখলাম সোফির কথা শুনে মেলিন্ডার মুখটা এতোটুকু হয়ে গেল। সোফি মেলিন্ডাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো,
-দেখো বর্ষা আগামীকাল তুমি আরও হিট হয়ে যাবে। তোমার এই ইউনিক সাজ সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। সোফির কথা শুনে মনে মনে বললাম। কেউ যেনো গ্রহণ না করে সেই জন্যই তো আমি এই সাজ সেজেছি, আর তুমি চাইছো কিনা গ্রহণযোগ্যতা পাক।
পরের দিন খবরের কাগজগুলোর ঢালাও করে বের হলো আমার গতকালের সাজ পোশাকের সমালোচনামূলক খবর। একটা খবরের কাগজে বের হয়েছে। আমি নাকি অতিমাত্রায় ড্রাগস্ নেবার কারণে মাথা ঠিক না থাকায় এই ধরনের মেক আপ নিয়েছি। অনেক খররের কাগজে আবার আমার মেক আপ এবং গেট আপ-এর প্রশংসামূলক খবরও বের করেছে। বুঝতে পারছি, আমার এতো সমালোচনার সাজ একসময় আধুনিক ট্রেন্ডে পরিণত হবে। সোফিয়ার কথায় ঠিক বের হলো, মানুষ ইউনিক এবং নতুন ধারার নিয়মকে বেশি মাত্রায় এপ্রিশিয়েট করে থাকে।
মেনরার বাচ্চা হবার দিন ঘনিয়ে আসছে। আজকে তার আট মাস পার হলো। ওকে চেকআপে নিয়ে গিয়েছিলাম ডাক্তার বললেন,
-মা এবং বাচ্চা দুজনের স্বাস্থ্যই ভালো আছে। মেনরাকে ফ্ল্যাটে রেখে। আবার গুরু ঠাকুরের সাথে দেখা করতে আসলাম পার্কে। সাথে করে ভাচ্চিও কেও নিয়ে আসলাম আমার সাথে। কারণ ভাচ্চিও কে গুরু ঠাকুর সম্পর্কে বলেছিলাম। ভাচ্চিও গুরু ঠাকুরকে দেখতে চেয়েছিল। তাই তাকে সাথে করে নিয়ে আসা। নিয়ে এসে দেখলাম বেশ ভালোই হয়েছে। গুরু ঠাকুর এবং ভাচ্চিও আগে থেকেই একে অপরের সাথে পরিচিত। গুরু ঠাকুরের কাছে জানতে পারলাম ভাচ্চিও এবং গুরু ঠাকুর ফ্রান্স-এর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছে। ভাচ্চিও আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে আমাদের দুজনকে একা রেখে জরুরি কাজের ছুতোয় চলে গেলো। ভাচ্চিও চলে যেতেই গুরু ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন,
-এই হিজড়াটা কে কিভাবে জুটালেন? বললাম,
– ও আমার পার্সোনাল মেক আপ আর্টিস্ট এবং উপদেষ্টা। ওর ব্যাপারে আমার সামনে কিছু বলার আগে ওকে সম্মান দিয়ে কথা বলবেন প্লিজ। এইবার গুরু ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– কি কারণে আমাকে আপনি ডেকেছেন? গুরু ঠাকুর বললো,
-আমি জানি না আপনি আমার বন্ধুত্ব গ্রহণ করেছেন কিনা? তবে আমি মনে প্রাণেই আপনাকে বন্ধু হিসাবে মেনে নিয়েছি। আপনি যেহেতু আমার বন্ধু, তাই আমি চাই আপনার সবসময় ভালো হোক। মনে মনে বলছি, লোকটি খুব ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে পারে। কোনো সন্দেহ নেই ধড়িবাজ লোক, মেয়েদের মন জয় করার জন্য গুছিয়ে কতই না মিথ্যা কথা বলতে পারে। আমিও একটু অভিনয় করে বললাম। বন্ধু না ভাবলে কি এমনি এমনিই আপনার সাথে দেখা করতে চলে আসলাম। আসলে জানতে চাইছি ধড়িবাজ লোকটি কি বলতে চাইছে।
পি. আর গুরু ঠাকুর আমাকে কিছু ইনফরমেশন দিলো, যে ইনফরমেশনগুলো আমি সেভিনার কাছ থেকে আগেই পেয়েছি তবে, সেভিনার ইনফরমেশনগুলো ছিল অবিস্তারিত আর গুরু ঠাকুরের ইনফরমেশনগুলো বিস্তারিত এবং ভয়ানক। বুঝতে পারছি না, গুরু ঠাকুর লোকটি কি সত্যিই আমার বন্ধু না এরও আছে অন্য কোনো মতলব? গতবার গুরু ঠাকুর আমাকে কফি খাইয়েছিল, এইবার আমি তাকে কফি খাইয়ে ঋণ শোধ করে দিলাম। গুরু ঠাকুরের ইনফরমেশন পেয়ে একটা সিদ্ধান্ত, ফ্যাশন দুনিয়া তো আমি ছেড়ে যাবই, কিন্তু তার আগে অবশ্যই মেলিন্ডার একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে যাব।
সব খবরের কাগজ বের হয়েছে, Dior-এর একজন নামকরা মডেল নাম মেলিন্ডা, সে Dior-এর ফ্যাশন শো-এর মেকআপ রুমে খুন হয়েছে। খুনের আলামত দেখে, সন্দেহ করা হচ্ছে বর্ষা হোসেনকে।

পর্ব-৬
-বললাম তো আমি খুন করিনি, আমাকে ষড়যন্ত্রের জালে ফাঁসানো হচ্ছে। আপনি কি একটু চেষ্টা করতে পারেন না সত্যটাকে প্রমাণ করার জন্য?
ক্রিমিনাল লয়ার মোহাম্মদ আফজাল হোসেন এর চেম্বারে বসে আছি। ভয় পেয়ে ছুটে এসেছি একজন লয়ার হায়ার করতে। ভাচ্চিও আর আমি এসেছি বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত এই লয়ার-এর কাছে। শুনেছি বাংলাদেশের মানুষের কোনো বিপদ হলে তিনি নাকি সবার আগে তাকে সাহায্য করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন।
আফজাল হোসেন বললেন,
-কেন যে তোমরা গ্ল্যামার এর নেশায় এইসব অন্ধকার জগতে প্রবেশ করো বুঝে পাই না। এই জগৎ বাইরে থেকে দেখতে ভালো, কিন্তু ভিতরে এর সবই কালো।
তুমি আমার দেশের মেয়ে, ছোটো বোনের মতো। আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা করবো। তুমি যদি সত্যি খুন না করে থাকো, তবে তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। তুমি খুন না করে থাকলে, তোমার কোনো লয়ার এরও দরকার নেই। তুমি এই কেসে শুধু একজন সাসপেক্টেড এই যা। যে কেউ সাসপেক্ট হতে পারে। এতো ভয় পাবার কিছুই নেই।

ফ্রেঞ্চ আইনের উপরে ভরসা রাখতে পারো। এই দেশের আইন আমাদের দেশের মতো দুর্নীতিতে ভরা না একদম স্বচ্ছ আইন বলতে পারো। এই দেশের আইন সব সময় সত্যটাকেই খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। তোমার বেলাতেও তাই হবে বিনিময়ে তুমি শুধু সত্য ইনফরমেশন দিয়ে আইনের লোকদেরকে সাহায্য করবে এইটুকুই ব্যাস।

আফজাল হোসেন এবং আমি উভয়ে বাংলাদেশের হবার কারণে, দুজনেই একে অপরের সাথে মাতৃভাষা বাংলাতেই কথা বলছি। এতদিন পর প্রাণ খুলে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পেরে কি যে ভালো লাগছে, এই ভালো লাগার কথা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। বুঝতে পারছি ভাচ্চিও খুব বিরক্ত হচ্ছে কারণ ও আমাদের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না।

আফজাল হোসেন গোড়া থেকে সব কিছু শুনতে চাইলেন আমার কাছে। কিভাবে আমার ফ্যাশন জগতে প্রবেশ ঘটলো? কে কে আমার ঘনিষ্টজন? আমি কোথায় থাকি? কার সাথে থাকি? মেলিন্ডার সাথে আমার কবে থেকে বিরোধ? ভাচ্ছিওর সাথে আমার কবে থেকে পরিচয়? এই সব কিছু। সব কিছু জানানোর পর আফজাল হোসেনকে গুরু ঠাকুর সম্পর্কেও বললাম। গুরু ঠাকুর সম্পর্কে যতটুকু জানি সবটাই বললাম। আফজাল হোসেন মন্তব্য করলেন,

-গুরু ঠাকুর তোমার জীবনে বন্ধু হয়ে আসলো, আর তোমার জীবনে শুরু হয়ে গেলো তোলপাড়, আজব ব্যাপার তাই না? ভাচ্চিও আমাদের কথা না বুঝলেও, খুব
ধৈর্য্য সহকারে আমাদের কথা শুনে যাচ্ছিল। আফজাল হোসেন আরও খুঁটিনাটি সবকিছু শোনার পর বললেন,
– আমি তো দেখতে পাচ্ছি তুমি নির্দোষ। তোমাকে কেউ ফাঁসানোর জন্য তোমার ব্যক্তিগত ব্যবহার করা জিনিস ভিক্টিমের আশেপাশে রোপন করেছে যাতে করে পুলিশ যেন তোমাকেই সন্দেহ করে। চিন্তা করো না খুনির এইসব কার্যক্রম মোটেও ধোপে টিকবে না। আমি আবার বলছি তুমি যদি সত্যিই নির্দোষ হয়ে থাকো তবে তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো যে আইন তোমার পক্ষেই রয়েছে। এই দেশের আইন সর্বতোভাবে তোমাকে সাহায্য করবে তোমাকে নির্দোষ প্রমাণ এবং খুনি কে খুঁজে বের করতে। তারপরেও যদি তুমি কোনো সমস্যাই পরো, আমি তো রইলাম তোমাকে সাহায্য করার জন্য। নির্দ্বিধায় চলে আসবে আমার কাছে। আফজাল হোসেনের কথা শুনে মন থেকে কিছুটা ভয় দূর হলো। তাই সময় নষ্ট না করে, আফজাল হোসেন-এর চেম্বার থেকে বের হয়ে ভাচ্চিও আর আমি শেভিনার ফ্ল্যাটে চলে এলাম। শেভিনায় আমাকে ফোন করে তার ফ্ল্যাটে আসতে বলেছিল।

শেভিনার কাছে এসে জানতে পারলাম, মেলিন্ডার পোস্টমর্টেম রির্পোট বেরিয়ে গেছে। আমি রিপোর্ট সম্পর্কে জানতে চাওয়ার আগেই, শেভিনা বললো,
– রিপোর্ট অনুযায়ী মেলিন্ডা খুন হয়েছে রাত ১১ টা থেকে রাত সাড়ে ১১ টার মধ্যে। সেই সময় তুমি ramp-এ হাঁটছিলে। শেভিনা জিজ্ঞাসা করলো,
-মনে পড়ে তোমার শো কখন শুরু হয়েছিল? আমি বললাম,
-সাড়ে দশটায় শুরু হযে সাড়ে এগারোটায় শেষ হয়েছিল। যেহেতু এক ঘন্টার নো ব্রেক ramp ছিল, সেহেতু ramp ভেঙে মেকআপ রুমে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না আমার। ভাচ্চিও বললো,
– কিন্তু ইনভেস্টিগেশন এ যদি বর্ষা কে জিজ্ঞাসা করা হয় ওর ব্যক্তিগত ব্যবহার করা জিনিসগুলো, আলামত হিসেবে পাওয়া ওর ডায়মন্ডের হেয়ার ক্লিপ এবং সূক্ষ্ম সোনার সুতোর দিয়ে কাজ করা রুমালের ব্যাপারে তখন বর্ষার কি উত্তর হবে? শেভিনা বললেন,
-খুনি বর্ষার পার্স থেকে হেয়ার ক্লিপ আর রুমাল চুরি করে, ভিক্টিমের পাশে রোপন করেছে বর্ষা কে ফাঁসানেরা জন্য, এটাই তো ঘটেছে তাই না? শেভিনা আরও বললেন,
– COP (পুলিশ) এর সাথে আমার কথা হয়েছে। বর্ষা কোনোভাবেই সাসপেক্ট হচ্ছে না। ভাচ্চিও বললো,
-আপনি এত জোর দিয়ে কিভাবে বলছেন মাদাম যে, বর্ষার জিনিসপত্র আলামত হিসেবে পাওয়ার পরেও সে সাসপেক্টেড হচ্ছে না? শেভিনা বললেন,
-কারণ সি সি টিভি ক্যামেরা ফুটেজ ইনভেস্টিগেটরদের হাতে চলে গেছে তাই।
আমি বললাম,
– কিন্তু মডেলদের প্রাইভেসির জন্য মেক আপ রুমে কোনো সিসিটিভির ক্যামেরা লাগানো নেই আমার জানামতে। শেভিনা বললো,
-ভিতরে নেই কিন্তু মেক আপ রুমের করিডোরে তো লাগানো রয়েছে। মেক আপ রুমে কে কখন ঢুকছে আর কে কখন বের হচ্ছে এগুলোর ভিডিও তো রয়েছেই। শেভিনা বললো,
– একটা সারপ্রাইজ আছে তোমাদের জন্য। ভাচ্চিও জানতে চাইলো কি সারপ্রাইজ? সেভিনা জানালো,
– সিসিটিভির ক্যামেরা ফুটেজ আমার কাছেও রয়েছে এক কপি। দেখবে নাকি তোমরা গত পরশু মেলিন্ডাকে, কে খুন করে বেরিয়ে গেছে? ভাচ্চিও আর আমি একসাথেই বলে উঠলাম,
-অবশ্যই দেখবো। শেভিনা তার ৬০০ ইঞ্চির হোম থিয়েটারে সিসিটিভির ক্যামেরার ফুটেজ চালিয়ে দিলো। পুরো হোম থিয়েটারের স্ক্রিনে মোট বারোটা ছোটো ছোটো সিসিটিভির ক্যামেরার ফুটেজ তৈরি হয়েছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরের ১২টি শাখাকে কেন্দ্র করে। গত পশুর রাত সাড়ে দশটায় সময় অ্যাডসাস্ট করতেই দেখা যাচ্ছে মেক আপ রুমের করিডর দিয়ে আমরা সব মডেল এবং মেকআপ আর্টিস্টরা একসাথে স্টেজ রুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। আমি যেহেতু সবার চেয়ে লম্বা তাই আমাকে সবচেয়ে বেশি চেনা যাচ্ছে। স্টেজ রুমের করিডোরে আসতেই সব মেকআপ আর্টিস্টরা সেখানেই থেকে গেলো, আর আমরা মডেলরা সবাই সারি সারি হয়ে স্টেজে ramp walk এ অংশগ্রহণ করলাম।

দেখা যাচ্ছে ১১:১৫ টা এর দিকে আমি তিন রাউন্ড-এর ramp শেষ করে ফিরে আসছি, আর সেই সময় মেক আপ রুমে থেকে মেক আপ রুমের করিডোরে একজন কিন্তু কিম্ভূতকিমাকার দর্শনধারী মানুষ বের হয়ে এসে করিডোরের শেষ প্রান্তের এক্সিটার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এবং সে বাইরে যাবার সাথে সাথে নীল রঙের একটা মার্সিডিজ গাড়ি এসে কিম্ভূতকিমাকার মানুষটিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। গাড়িটি চোরাইভাবে সংগ্রহ করা তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ দেখা যাচ্ছে গাড়ির নম্বর প্লেটটি false । এইখানে দুইটা প্রশ্ন জেগে উঠছে আমার, এক আমরা সব বেরিয়ে আসলেও, মেলিন্ডা কেন বের হয়ে আসলো না? এবং দুই নম্বরটা হলো মানুষটি ছেলে না মেয়ে? কারণ সে মেয়েদের লম্বা গাউন পরে থাকলেও তার বুকে মেয়েদের মতো স্তনের কোনো ভাঁজ দেখা যায়নি।

প্রশ্নগুলো আমার মনের ভিতরেই রাখলাম। শেভিনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিম্ভূতকিমাকার মানুষটিকে কি চিনতে পেরেছে COP’রা? শেভিনা হাসতে হাসতে বললো,

– কীভাবে চিনবে, দেখছো না কি ধরনের গেটআপ নিয়েছে, বর্ণীল wig পড়েছে, হেবি মেটালিক মেকআপ নিয়েছে লং গাউন পড়েছে, এবং উচ্চতা বাড়ানোর জন্য পড়েছে ছয় ইঞ্চি হাই হীল। জিজ্ঞাসা করলাম,
– পুলিশ কি আইডেন্টিফিকেশন করতে পেরেছে খুনি কে? শেভিনা বললো,
– এই ধরনের গেটআপধারীদের আইডেন্টিফিকেশন করা খুব কঠিন।
মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, যাক আমি তো রেহাই পেয়েছি সাসপেক্ট হওয়া থেকে। শেভিনা আমাদের কে কেক আর কফি সার্ভ করলো। আমি মদ খাই না দেখে শেভিনা তার নিজের হাতে আমাদের জন্য কফি বানিয়েছে।
শেভিনা বললো,
-আমার বয়স ৭২ বছর চলছে এখন। একটা পুরো জীবনের এক্সপেরিয়েন্স রয়েছে আমার। সেই এক্সপেরিয়েন্স থেকেই বলছি, মানুষ দেখা মাত্রই চিনতে পারি আমি, মানুষটা ভালো না মন্দ। আমাকে ইঙ্গিত করে বললো,
-এই মেয়েটির মায়ামাখা মুখ দেখেই বুঝেছি, মেয়েটি খুব সরল এবং সৎ। তাইতো আমি সবসময় তোমার পাশে থাকার চেষ্টা করি বর্ষা। এবং চেষ্টা করি যতটুকু পারি তোমাকে সাহায্য করার। আমার বিশ্বাস বর্ষার মতো মেয়ে কখনো কোনো ধরনের ক্রাইম করতে পারে না। আমিই COP’দেরকে বলেছি, সব কিছু ইনভেস্টিগেট করার পরে, তবেই আপনারা বর্ষাকে আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডেকে পাঠাবেন। অযথা মেয়েটিকে হেনস্তা করবেন না। আমি উঠে গিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেভিনার হাতে চুমু খেলাম।
– সেই প্রথমদিন দেখার পর থেকে তুমি আমাকে অনেক সাহায্য করেছ শেভিনা। আমি চিরকাল তোমার কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে বাঁধা রইলাম। সেভিনা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-জানো কিছু কিছু সম্পর্ক না ডিভাইন থেকে হয়ে থাকে। সেই সম্পর্কগুলো রক্তেরও হয় না আবার স্বার্থের ও হয় না। সেগুলো হচ্ছে আত্মার সম্পর্ক। তোমার সাথে হয়তো আমার আত্মিক বন্ধন রয়েছে বলেই, হয়তো তুমি আমার কাছে এতো প্রিয় বলে মনে হয়।
আজ তিনদিন হলো মেরনার বাচ্চা হয়েছে। নার্সিং হোমে মা ও ছেলে দুজনেই ভালো আছে। এখন আমি যাচ্ছি পুলিশ স্টেশন-এ। কিছু তথ্য এবং প্রমাণ নিয়ে, সিসি ফুটেজ ক্যামেরা দেখে স্কেচ এঁকে খুনির চেহারা বের করার চেষ্টা করতেই খুনিকে পেয়ে গেছি। ভাচ্চিওই হচ্ছে সেই খুনি, যে মেলিন্ডাকে খুন করে মেয়েদের গাউন পরে, হেবি মেটালিক মেকআপ নিয়ে, বর্ণীল রঙের উইগ পড়ে এবং নিজের উচ্চতা গোপন করার জন্য ছয় ইঞ্চির হাইহিল পরে এক্সিটার দিয়ে বেরিয়ে যায়। মেলিন্ডা খুন হবার আগেই শেভিনা এবং গুরু ঠাকুর দুজনেই আমাকে ইনফর্ম করে জানিয়েছিল যে, ভাচ্চিও একজন সাইকোপ্যাথিক রোগী। ওর কাছ থেকে আমি যেনো সাবধানে থাকি। গুরু ঠাকুর আমাকে আরও জানিয়েছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইটা খুনের ঘটনা ঘটেছিল ভাচ্চিও ছিল খুনের ঘটনাগুলোর মেন সাসপেক্টেড আসামি। কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। এর পরে আরও unsolved খুনের ঘটনা ঘটেছে প্যারিসে ধারণা করা হয়ে থাকে সেগুলোতেও ভাচ্চিও জড়িত রয়েছে। ভাচ্চিও মেলিন্ডাকে খুন করেছে, কারণ মেলিন্ডা প্রায় ভাচ্চিওর মেকআপ করার ধরণ নিয়ে আজেবাজে কথা বলে বেড়াতো। এবং সে একবার ভাচ্চিও কে হুমকিও দিয়েছিল Dior-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে বলে Dior থেকে বের করে দেয়ার জন্য।

মেলিন্ডার খুনি হিসাবে প্রথমে আমাকে সাসপেক্ট করা হয়, তারপরে সোফিকে এবং শুনিছি Dior-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টরকেও নাকি মেলিন্ডার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা বাদ করা হয়েছে। ভাচ্চিওই আমার পার্স ব্যাগ থেকে ডায়মন্ডের হেয়ার ক্লিপ আর সোনার সুতোর কাজ করা রুমাল চুরি করে মেলিন্ডার মৃতদেহের পাশে রেখে এসেছিল আমাকে ফাঁসানোর জন্য।

ফুটেজ ক্যামেরা দেখে ভাচ্চিওকে ধরা সম্ভব ছিল না। কারণ সে যে ধরনের হেবি মেটালিক মেকআপ এবং হাইট চেঞ্জ করার জন্য ছয় ইঞ্চির হিল পড়েছিল এতে করে তার চেহেরা আইডেন্টিফিকেশন করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।

আজ মেলিন্ডা মারা যাওয়া একমাস হতে চললো, আমি স্টেজে শো-তে পারফরম্যান্স করার সাথে সাথে ভাচ্চিওর উপরেও নজর রেখে ছিলাম। সিসিটিভির ক্যামেরা ফুটেজ দেখে ভাচ্চিও-কে আমি ভয় পেতে শুরু করেছিলাম। কখনোই ওর সামনে মেলিন্ডার কথা উচ্চারণ করতাম না। যদিও বা কেউ ওর সামনে মেলিন্ডার কথা উচ্চারণ করতো, তবে ভাচ্চিও মেলিন্ডার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য না করে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতো। এতে করে আমার মনে আরও বেশি আত্মবিশ্বাস জেগে উঠে যে, ভাচ্চিওই হচ্ছে মেলিন্ডার খুনি। একদিন শেভিনার কাছ থেকে সিসি টিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে ফ্ল্যাটে এসে স্কেচ করতে বসলাম। হেবি মেটালিক মেকআপ সরিয়ে শুধু নাক, মুখ এবং চোখ স্কেচ করতে গিয়েই ফুটে উঠে ভাচ্চিওর আসল মুখ। সেই স্কেচই নিয়ে যাচ্ছি পুলিশ স্টেশন-এ।

পুলিশ স্টেশন-এ এসে, তদন্ত কর্মকর্তাকে ভাচ্চিওর স্কেচের ছবি দিলাম, কিন্তু তিনি বললেন, আপনি কীভাবে আপনার মনগড়া বানোয়াট ছবি খুনির স্কেচ বলে দিতে এসেছেন? তদন্ত অফিসারের সামনেই সিসিটিভির ফুটেজ দেখে আবার আর একটা ভাচ্চিওর স্কেচ আঁকলাম তখন তারা আমার আঁকা স্কেচ দেখে অবাক হয়ে বললেন,

-আগে আমাদের মাথায় এই আইডিয়াটা আসেনি তো। হেবি মেটালিক মেকআপ করা নকল চেহারার পিছনের আসল চেহারা একমাত্র স্কেচের মাধ্যমেই বের করা সম্ভব।
মাদাম আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ,
-আপনি আমাদের কাজ পানির মতো সহজ করে দিলেন।
তদন্ত অফিসারকে শেভিনা ও গুরুঠাকুরের দেয়া ইনফরমেশনগুলোও জানালাম যে ভাচ্চিও একজন সাইকোপ্যাথ।
পুলিশ স্টেশন থেকে বের হয়ে গুরু ঠাকুরকে কল দিলাম। নার্সিং হোমের ঠিকানাটা দিয়ে তাকে বললাম আমার সাথে নার্সিং হোমে দেখা করতে। একঘন্টা পর গুরু ঠাকুর আসলেন, আমি তখন নার্সিং হোমের করিডোরে তার অপেক্ষায় বসে রয়েছি। গুরু ঠাকুর বেশ হতবিহ্বল হয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন, তার ধারণা আমার কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে সেই কারণেই তিনি চিন্তিত হয়ে ছুটে এসেছেন। গুরুঠাকুর আমাকে সুস্থ সবল দেখে বললেন,
-যাক আপনি ভালো আছেন দেখে আমি চিন্তামুক্ত হলাম। বলেন আমাকে এখানে কেন ডেকেছেন। গুরু ঠাকুরকে চমকিয়ে দিয়ে বললাম,
-আপনি কি মেনোরা নামে কাওকে চিনেন?
গুরু ঠাকুর, আমাকেও চমকিয়ে দিয়ে বললো,
-চিনি না মানে, ওর খোঁজেই তো আমি হন্যে হয়ে আপনার পিছে পিছে ছুটে বেড়াচ্ছি।
আমি সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম গুরু ঠাকুরের কথায়, জিজ্ঞাসা করলাম,
– আমার পিছে পিছে কেনো ঘুরে বেড়াচ্ছেন?
গুরু ঠাকুর সব কথা খুলে বললেন আমাকে, বললেন
-মেনোরা যখন বললো, সে মা হতে যাচ্ছে তখন আমি ভয় পেয়ে যাই। ইন্ডিয়ায় আমার বউ বাচ্চা আছে, অপরিণত সম্পর্কের গণ্ডিতে একটা বাচ্চার বাবা হতে চাইনি আমি। ভয়ে আমি কাপুরুষের মতো মেরোনার গর্ভে আসা আমার সন্তানকে অস্বীকার করে মেরোনার কাছ থেকে পালিয়ে যাই। কিন্তু বিশ্বাস করেন আমি পালিয়ে গেলেও বিবেকের দহনে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যেতে লাগলাম। বারবার আমার বিবেক আমাকে তাড়া দিতে থাকলো একজন অসহায়, এতিম এবং অনাথ নারীর সাথে ধোঁকাবাজি করার জন্য। প্রত্যেকদিন স্বপ্নে দেখতে লাগলাম একটা শিশু গর্তে পড়ে যাচ্ছে আর আমি তাকে বাঁচাতে গিয়ে বাঁচাতে পারছি না। বিবেক জাগ্রত হলো আমার, আমি আমার আগত বাচ্চার জন্য আবার ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এলাম প্যারিসে। এসেই মেরোনার খোঁজে গেলাম প্রথমে মেরোনা যে বাসায় থাকতো সেইখানে। কিন্তু জানতে পারলাম মেরোনার আবাসস্থল চেঞ্জ করেছে। আবার গেলাম তার কর্মস্থল লাইব্রেরিতে কিন্তু সেখানেও গিয়ে মেরোনাকে পেলাম না কিন্তু জানতে পারলাম, মেরোনাকে বর্ষা নামে একজন ইন্ডিয়ান মডেল তার তত্ত্বাবধানে রেখেছে।
বর্ষা ম্যাডাম প্যারিসে আপনাকে কে না চেনে, আপনার খোঁজ করতেই খুব সহজেই আপনাকে পেয়ে গেলাম। আর মেরোনার খবর পাওয়ার জন্য আপনার সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম আপনার সামনে মেরোনার প্রসঙ্গ তুলতে। কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না, কোন মুখে আপনার কাছে মেরোনার খোঁজ করবো? এখন আপনি বলেন, আপনি কীভাবে জানলেন যে, আমিই মেরোনার সেই পলাতক আসামি? আমি বললাম,
-আপনি প্রথম যেদিন আমার গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন এবং বলছিলেন আপনি শুধু আমার জন্যেই ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন। সেদিনই আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি, আপনি সেই লোক, মেরোনার সাথে যে ব্যক্তিটির স্কেচ আমি আঁকিয়েছিলাম।
গুরুঠাকুর অবাক হয়ে বললেন,
-আপনিই আমাদের স্কেচ এঁকেছিলেন?
বললাম,
-হুঁ আমিই সেই স্কেচ আর্টিস্ট। আপনাদের স্কেচ আঁকার পর ভাগ্যক্রমে রাতারাতিই জনপ্রিয় মডেলে পরিণত হয়েছি। তারপর থেকে আর স্কেচ নিয়ে বসিনি। যাই হউক, আপনি যখন আপনার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, একদিন এই বন্ধুত্বের দোহাই দিয়েই মেরোনার সন্তানকে তার বাবার কাছে ফিরিয়ে দিবো। আর আজকেই সেই দিন। বললাম,
-গুরু ঠাকুর আপনি ফুটফুটে সুন্দর একটি ছেলের বাবা হয়েছেন। সে অবিকল দেখতে আপনার মত হয়েছে। গুরু ঠাকুর ভেজা চোখ নিয়ে বললেন,
– কোথায় আমার সন্তান? প্লিজ আমার সন্তানকে আমার বুকে এনে দিন। আমি আমার সোনামনিকে একটু আদর করি। আমি আমার পিছনের দরজা দেখিয়ে দিয়ে বললাম ভিতরে ঢুকে যান। ভিতরেই রয়েছে আপনার সন্তান আর আপনার সন্তানের মা। পি আর গুরু ঠাকুর আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ভিতরে প্রবেশ করলেন। আর আমিও নিশ্চিন্তে এসে আমার গাড়িতে চড়ে বসলাম শেভিনার ফ্ল্যাটে যাবার জন্য। কারণ আমি যে আজ থেকে ওখানেই থাকবো। কারণ এই শেষ বয়সে এসে শেভিনা আমাকে তার মেয়ে হিসেবে দত্তক নিয়েছে আর আমিও তাকে মা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি।
সমাপ্ত

+ posts

Read Previous

আকাশ রয়েছে চেয়ে

Read Next

পুনর্জন্ম

One Comment

  • দারুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *