অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অহনা নাসরিন -
আতঙ্ক

অঞ্জন, অর্জুন, অর্ণব আর আমি অদিতি। আমরা চার বন্ধু। আমাদের নামের আদ্যক্ষর অ বর্ণ দিয়ে শুরু। সৃষ্টিকর্তা, আমাদের সৃষ্টির পেছনে কোনো একটা রহস্য লুকিয়ে রেখে

ছিলেন, না হয় আমাদেরকে একই জায়গার মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন। আমাদের চিন্তা-চেতনা ও আবেগের এত মিল থাকবে কেন! আমরা একে অপরকে ভালো বুঝি, বুঝবার চেষ্টা করি। একজনের মন খারাপ হলে অন্য সবার ভেতরেও আলোড়ন হয়। ঝড় ওঠে। তোলপার হয় আবার একই সময়ে শান্তও হয়। তবে কখনো কখনো ভুল বোঝাবুঝিও হয়। মানুষ ভুলের ।ঊর্ধ্বে নয়। আর একটি চিরন্তন সত্য কথা, বয়সের সাথে সাথে মানুষের মনের ও পরিবর্তন আসে। অর্থাৎ সময় মানুষকে বদলে দেয়। বদলে যাচ্ছি আমরা। আগের ছেলেমানুষি আর নেই। বুঝতে শিখেছি-‘জীবনটা যার যার তার তার’।

আশ্রয়’নামের একটি অনাথ আশ্রমে আমরা চার বন্ধু একসাথে বড় হয়েছি। আমাদেরকে কত বছর বয়সে আশ্রমে দিয়ে গেছে মনে নেই, জানা নেই আমাদের বাবা-মা কি বেঁচে আছে নাহ পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। কোথায় আমাদের বাড়ি সেসবের কিছুই আমাদের মনে নেই। যতোটুকু মনে পড়ে আমরা এক সাথে থেকেছি, খেয়েছি, পড়াশুনা করেছি, একে অপরের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়ে হেসেছি। কেউ কষ্ট পেলে একসাথে দুঃখ ভাগ করে নিয়ে কেঁদেছি। আমরা চার বন্ধুর মধ্যে আমি একা নারী। যতোদিন আশ্রমে ছিলাম কখনো ছেলে-মেয়ের প্রভেদ খুঁজিনি। ভেবেছি আমরা সবাই মানুষ। ওখানকার দিনগুলি বেশ সুখেরই ছিল। যখন আশ্রম ছেড়ে আসতে হলো বাইরে, কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হলো তখন আমি অনুধাবন করতে পারলাম আমি মানুষ হতে পারিনি। সকলের কাছে রক্তেমাংসে একজন নারী হয়ে ওঠেছি। ওরা তিন বন্ধু প্রতিদিন আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় আমি নারী।

অর্নিবাণ আমার ভালোবাসা। আমি তাকে পছন্দ করি, ভালোবাসি। অনির্বাণের সাথে দেখা নেই বেশ কদিন। আজ দেখা করার কথা ছিল। যাব কি যাব না এ নিয়ে দোটানায় আছি। অর্নিবাণ বড় অভিমানি ছেলে। আজ না গেলে অভিমানে আরও তিনদিন কথা বলবে না। তাতে আমার কি! আমি তো আমার মনের উপর জোর কাটাতে পারবো না। মনকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন কাজ, যা আমি কখনো পারি না। কিংবা চাই চাই ও না। মনকে পুরোপুরি স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। আজ যাইনি বলে আমার কোন আক্ষেপ নেই, অভিমান করবে বলে কোনো ভয়ও নেই। না দেখতে পাওয়ার জন্য কোন কষ্টও নেই।

অনেকবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি-‘আমি কেন অর্নিবাণকে ভালোবাসি?’ উত্তর একটাই মন চায় বলে। দীর্ঘ ষোলটি বছর আমরা চার বন্ধু পাশাপাশি ছিলাম কারো প্রতি তো আমার কোন আকর্ষণ তৈরি হয়নি। মন বলেনি ভালোবাসতে । এই কারণে মানুষ বলে- ‘প্রেমিক আর বন্ধু কখনো এক হয় না’। প্রেমিকের চেয়ে বন্ধুর স্থান অনেক ঊর্ধ্বে। আমার তিন বন্ধু দেখতে শুনতে মন্দ নই। অনির্বানের চেয়ে মন্দ নয় তাহলে ওদের কেন ভালোবাসতে পারিনি, তারা অনাথ বলে? আমিও তো অনাথ। ওদের সম্পত্তি নেই বলে, আমিও তো গরীব। আমারও তো কিছু নেই। অর্নিবাণকে আমি অনি বলে ডাকি। অনির প্রতি আমার কোনো মোহ জন্মায়নি, মনে প্রেম জেগে ওঠেছে। যা ওদের প্রতি জাগেনি। অনিকে আমি বিশ্বাস করি, ভালোবাসি। সেও আমাকে ভালেবাসে এই কথাটাও বিশ্বাস করি কিন্তু ভালোবাসায় যখন শর্ত চলে আসে তখন বিশ্বাসে ফাটল ধরে। প্রেমে চিড় ধরে। ফলে সম্পর্ক তিতু হয়ে ওঠে। অনি সেদিন আমাকে বললো-‘তুমি যদি আমাকে ভালোবাস আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাও তাহলে বন্ধুদের ছেড়ে আলাদা ফ্ল্যাটে উঠতে হবে’। কিন্তু ওদের ছেড়ে আমি এক মুহূর্তও থাকার কথা ভাবতে পারি না। বন্ধুত্বের সম্পর্ক রক্তের চেয়েও গাঢ়। ওরা আমার আত্মার আত্মীয়। ওদের বাদ দেওয়া মানে আত্মাকে বাদ দেওয়া আর আত্মা ছাড়া দেহ মূল্যহীন।

আজ অনির সাথে দেখা করার মুড না থাকায় অদিতি বাসায় শুয়ে শুয়ে ডায়েরি লিখছিল। এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে অর্ণব দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে-কিরে আজ তোর না কোথায় যাওয়ার কথা, শুয়ে আছিস যে, শরীর খারাপ? অর্ণব অন্য দুজন থেকে একটু আলাদা। কম কথা বলে। চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করে। কি ভাবে? কার কথা ভাবে? সে কিছুই বলে না। অর্ণবের গায়ের রং একটু চাপা। তবে চেহারায় মাধূর্য আছে। যেকোনো মেয়ে অনায়াসে তার প্রেমে পড়ে যাবে যদি একবার তার চোখের দিকে তাকায়। ওর চোখ দুটি বেশ সুন্দর । মায়া আছে। নম্র-ভদ্র গোছের সহজ-সরল টাইপের ছেলে স্বামী হিসেবে সুপুরুষ তবে প্রেমিক হিসেবে অচল। প্রেমিকদের একটু-আধটু পাগলামি জানতে হয়। তবে সব পাগলই প্রেমিক হয় না।

-নারে অর্ণব,কখন এলি? অদিতি শুয়ে ডায়রি লিখছিল। ডায়রিটা গুছিয়ে রেখে উঠে বসে প্রশ্নটা করে।

-এই তো এলাম

-তুই কি করছিস? শুয়ে আছিস যে!

-এমনিতেই

অর্ণব, অদিতির পাশে এসে বসলো। একটু দূরত্ব রেখেই বসছে। অর্ণব জানে আগুন আর মোম পাশাপাশি থাকতে নেই। এই মুহূর্তে অদিতি আগুন আর অর্ণব মোম। আগুনের সংস্পর্শে এলে মোম গলবেই। এতদিন অদিতি ছিল রং করা পুতুল এখন সে রক্তে-মাংসে নারী।

-আমার প্রশ্নের উত্তরটা এড়িয়ে গেলে যে?

অর্ণবের কথাটি এড়িয়ে গিয়ে আবার নিজেই পাল্টা প্রশ্ন করে- তুই কি কফি খাবি?

অদিতির হাবভাব দেখে মনে হলো, মনের আকাশে মেঘ করেছে। আরেকটু ভারী হলে বৃষ্টি হয়ে চোখের কোণ বেয়ে ঝরে পড়বে। তার মনটা হালকা করা দরকার। ফু দিয়ে মেঘ উড়িয়ে দিতে হবে। আবারও প্রশ্ন করে অদিতিকে-‘কি হয়েছে তোর? অর্নিবাণ কিছু বলেছে? তোকে আজ ডিপ্রেসড মনে হচ্ছে। অদিতি নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই উত্তর দেয়- ‘নাহ কিছু না; এমনি ভালো লাগছে না। ভাবছি চাকরিটা ছেড়ে দিব। অন্য কোথাও চেষ্টা করবো’। অদিতির কথা শুনে অর্ণবের ভেতরে একটা আশঙ্কা তৈরি হলো, তবে কি তার বস! বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়েই অর্ণব জানতে চাইলো,

-চাকুরি ছেড়ে দিলে কিভাবে চলবি? ফ্ল্যাটভাড়া, খাওয়া-খরচ, হাত-খরচ ওসব কে যুগাবে?

অর্ণবের কথা শুনে অদিতি একটু হাসি মুখে উত্তর দিলো,

-বাদ দে তোরা আছিস না, একটা মাস কোনোরকম চালাতে পারলে পরের মাসে ম্যানেজ করে নিব। আমার তিনটা প্রাণের বন্ধু থাকতে এত ভাবনা কিসের?

অর্ণব বিষয়টাকে সিরিয়াসলি নিয়ে কনর্ফাম হওয়ার জন্য আবার প্রশ্ন করলো,

-তাহলে তুই কি ফাইনালি সিদ্ধান্ত নিলি চাকুরি ছেড়ে দিবি?

অদিতি একটু কঠিন স্বরে জানাল,

– হুম ছেড়ে দিব। এছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। বলতে পারিস বাধ্য হয়েছি এ সিদ্ধান্ত নিতে, আপাতত এর বাইরে কিছু বলতে পারব না। এ বিষয়ে আজ অন্যদের সাথে কথা বলব, তুই ও থাকিস।

অর্ণব স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলো,

-আচ্ছা, শোন আমি একটু বেরুব। তুই থাক। আর আজ রাতে নাও ফিরতে পারি তুই অপেক্ষা করিস না। কাল ফিরে তোর সাথে কথা বলব।

অর্ণব কথাটা শেষ করেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অদিতির উত্তর শুনার প্রয়োজন বোধ করলো না। তার কিসের এত তাড়া এ বিষয়টা অদিতির অজানাই রয়ে গেল।

অর্জুন আর অঞ্জন রাতের ডিনার শেষে এক সাথে তাদের রুমে বসে আছে। অর্ণব ফিরেনি; হয়তো ফিরবে না। এমন সময় অদিতি রুমে ঢুকে অঞ্জনের পাশে গিয়ে বসলো। তিনজনই চুপচাপ কোনো কথা নেই। অদিতি একটু ইতস্তত করেই কথাটা তুললো, সে আর চাকুরি করবে না। কথাটা শুনেই অর্জুন রেগে উঠলো এবং অদিতির দিকে তাকিয়ে রাগতস্বরে বলতে লাগলো,

-তুই চাকরি করবি কি করবি না সেটা তোর ব্যাপার। তোর যা মন চায় তুই তা কর। এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। জীবন তোর সিদ্ধান্তও তোর, তবে একটা কথা বলে রাখি তোকে আমরা খাওয়াতে পারব না। বিষয়টি মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিস।

অদিতি বুঝতে পারে অর্জুনের ক্ষোভের কারণ। সে স্বাভাবিক থেকেই বলে,

-এভাবে বলছিস কেন? তোরা আমার বন্ধু বল পরিবার বল সবই তো তোরা। তোদের ছাড়া কাকে বলব? আর আমার দুঃসময়ে তোরা ছাড়া কে আমার পাশে দাঁড়াবে? জানিস তো কখনো কখনো মানবিক সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়ে বড় হয়। অদিতির কথা শুনে অর্জুন আর ও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে সে অদিতিকে বলে বসে,

-ন্যাকামো আমার পছন্দ নয়। তোকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম তার উত্তর পেলাম না। আজ এসেছিস বন্ধুত্ব ফলাতে।

অর্জুনের কথা গুলো অদিতিকে আহত করলেও নিজেকে সামলে নিয়ে সে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

-ঠিক আছে কাল তোর কথার উত্তর দিব।

এবার অঞ্জনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-কাল তোর প্রশ্নের ও উত্তর দিব। অঞ্জন মাথা নিচু করে বসে ছিল। এতক্ষণ কোনো কথা বলে নাই। অদিতির কথা শুনে মুখ তুলে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অঞ্জন বেরিয়ে যাওয়ার পর অদিতিও তার রুমে ফিরে আসে আর দরজা লক করে দেয়।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে অদিতি আকাশ-পাতাল ভাবছে। তার মাথায় নানা রকম ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই সাথে তার মায়ের কথা মনে পড়ছে। মায়ের মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে আজ মা পাশে থাকলে হয়তো তার এতটা কষ্ট পেতে হতো না। বাবা বেঁচে আছে, কোথায় আছে অদিতি জানে না। এই ষোল বছরে তার বাবা কোনোদিন খোঁজ নেয়নি। বাবার মমতা কেমন হয়; তা তার জানা নেই। জন্মের পর থেকেই শুনছে বাবা কাজে আছে। আজও কি বাবার কাজ শেষ হয়নি! একবারও ইচ্ছে করেনি তার মেয়ের খোঁজ নিতে! তবে সব পুরুষই কি স্বার্থপর! ঠিক আমার বন্ধুদের মতো? নাকি প্রেমিকের মতো? নাকি বসের মতো? অদিতি আর ভাবতে চায় না। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। নাহ সে আর কাঁদবে না। কাল সকল স্বার্থপরতার জাল ভেদ করে মুক্ত একটা পৃথিবী খুঁজবে। যে পৃথিবীতে বলাকার মতো একা সে ডানা মেলে উড়বে। এই বন্দিশালায় বন্দি থেকে পাখা জাপটে মরতে ইচ্ছে করছে না। দুঃখকে সে দেখছে নদীর মতো বয়ে যেতে; সুখকে সে দেখেছে মরীচিকার মতো। আজ আর সে কিছুই চায় না।

অর্জুন ভালো ভালো জামা কাপড় পরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তার মনে বেশ আনন্দ; ঠিক ১১টায় আশ্রমে যেতে বলেছে অদিতি। অদিতি তার জন্য সেখানেই অপেক্ষা করছে। আজ তার কথার উত্তর দিবে। ফুরফুরে মেজাজ আর মনের ভেতর তোলপাড় করা ঢেউ এ ঢেউ যেন আনন্দের। অনেকদিন পর তার মনের মানুষ তার ডাকে সাড়া দিয়েছে, এর চেয়ে আনন্দের এর চেয়ে সুখের আর কি হতে পারে! সময় মতো পৌঁছতে বলেছে তাই দেরি করা যাবে না। ঠিক এগারোটায় আশ্রমের সেই ঘরটিতে গেল, যে ঘরটিতে একদিন অদিতি থাকতো। ঘরের দরজায় ভেতর থেকে সিটকিনি দেয়া না থাকায় একটু ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ভেতরে প্রবেশ করতেই অর্জুনের চোখে পড়লো, ‘আমার মৃত্যুর জন্য অর্জুন দায়ী’ কথাগুলো লিপস্টিক দিয়ে বড় বড় অক্ষরে ড্রেসিং টেবিলের গ্লাসে লিখা। এইটুকু পড়েই অর্জুন ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসলো। ডানে-বায়ে না তাকিয়ে অর্জুন সোজা বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে একটা বাসে উঠে পড়লো এবং অজানা গন্তব্যে পা রাখলো। অর্জুনের হাত-পা টকটক করে কাপছে। কেন অদিতি এমন করলো। সে ভালোবাসে না এটা বললেই পারতো। এর জন্য সুইসাইড করে নোট লিখে যেতে হবে! এতদিনের বন্ধুত্বের এই বুঝি প্রতিদান! পুলিশের ভয়ে সে পালিয়ে যাচ্ছে, কোথার যাবে সে ঠিক জানে না।

অদিতির বস সৌমিত্র আজ অফিস যায়নি, দামি একটা স্যুট পড়েছে, বিদেশি পারফিউম লাগিয়েছে। নিজে ড্রাইভ করে চলে আসে আশ্রমে। অদিতি এতদিন পর তার কথায় সায় দিয়েছে।

আসতে আসতে সে সিদ্ধান্ত নিল আজই অদিতিকে নিয়ে তার নতুন ফ্ল্যাটে তুলবে। সে ফ্ল্যাটে অদিতি থাকবে, আর সৌমিত্র মাঝে মাঝে সেখানে যাবে। জীবনটা আর কয়দিন। আশ্রমে এসে পৌঁছতে পৌঁছতে তখন ঘড়িতে পৌনে বারোটা। এখানে এসে অদিতিকে খোঁজ করলে একজন অদিতির রুম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে চলে যায়। সৌমিত্র ঘরের দরজায় নক করতেই দরজাটা খুলে যায়। সে হাসতে হাসতে রুমে ঢুকে দেখে অদিতি শুয়ে আছে। গলা পর্যন্ত সাদা চাঁদরে ঢাকা। অদিতির পাশে যাওয়ার আগে চোখে পড়লো, ড্রেসিং টেবিলের গ্লাসে লিখা- “আমার মৃত্যুর জন্য বস দায়ী”। একথাগুলোও লিপস্টিক দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা। লেখাটা পড়েই সৌমিত্র সেখানে না দাঁড়িয়ে সোজা গাড়ির কাছে চলে গেল। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গাড়ি স্টার্ট দিলো অজানার উদ্দেশ্যে। কোথায় যাবে সে জানে না। পুলিশের ভয়ে সে পালাচ্ছে ।

অনিবার্ণ, অঞ্জন আর অর্ণবকেও অদিতি আসতে বললো এবং তারাও আলাদা আলাদা সময়ে আসলো এবং ড্রেসিং টেবিলের গ্লাসে লেখাটা পড়ে সবাই পালালেও অর্ণব পালায়নি। সে অদিতির পাশে গিয়ে বসলো। তার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলতে লাগলো, ‘আমি কেন তোর মৃত্যুর কারণ হলাম, আর কিভাবে হলাম সেটা তো বলে গেলি না। আমি তো কোনদিন তোকে বিব্রত করিনি। তুর খুশিই আমার খুশি ছিল। তুই অনির্বাণকে ভালোবাসতি আমার ভেতরে ভেতর কষ্ট হতো কিন্তু কখনো খারাপ লাগেনি। আমি শুধু চাইতাম তুই সুখি হ।

সেই ছোট্টবেলা থেকে আমরা মা বাবাকে ছেড়ে থেকেছি। কষ্ট কি? আমি বুঝি। প্রিয়জন হারানোর বেদনা কি? জীবন চলার পথে তা উপলব্ধি করেছি।। তুই-ই ছিল আমার একমাত্র প্রিয় মানুষ। ভেবেছিলাম তোর জন্য বেঁচে থাকবো। আমার অস্তিত্ব জুড়ে তুই থাকবি, আমার ভালোবাসা শুধু তোর জন্য ছিল। তাই ঠিক করেছি আমি কোনদিন বিয়ে করবো না। কাল যখন বললি তুই চাকুরি ছেড়ে দিবি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম তোর বসের কারণে তোর খুব কষ্ট হচ্ছে। কাল রাতে আমি বেরিয়ে যাই আমার এক বন্ধুর কাছে তোর জন্য একটা চাকুরির কথা বলতে। সে বলেছে আগামি মাসে জয়েন করতে পারবি।

অদিতি তুই কেন এমন করলি? আমি না হয় বলতে পারিনি আমার ভালোবাসার কথা, কিন্তু তুই তো বন্ধু ছিলি একবার বলতে পারতি, আমি তোর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি। আমি চলে যেতাম কেউ জানতো না। অনেক দূরে… । আজ অপরাধী হয়ে বাঁচা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি ও চলে যাবো। তুই যেখানে গেছিস আমিও সেখানে চলে আসবো।

অদিতির হাতটা ছেড়ে অর্ণব উঠে দাঁড়ালো ঘর থেকে চলে যাবার জন্য। এমন সময় অদিতি অর্ণবের হাতটা টেনে ধরলো। অর্ণব ভয় পেয়ে আঁতকে উঠলো। একি! মৃত মানুষ জীবিত হয়ে উঠলো! অর্ণব আবার অদিতির পাশে বসতেই অদিতি শোয়া থেকে উঠে বসলো। অদিতি, অর্ণবের বুকে মাথা রেখে বললো, ‘এই কথাটা আগে বললি না কেন, তুই যে আমার নির্ভরতার হাত। আমি যে এতদিন ভুল মানুষকে ভালোবাসতাম’।

অর্ণব অদিতির পাশে বসে পড়লো, ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। চোখের জল মুছে বলতে লাগলো- ‘অদিতি ভালোবাসা বলার বিষয় নয়, উপলব্ধির। তুই বুঝতে পারিসনি সেটা তোর ব্যর্থতা।’

অদিতি তার কথার উত্তরে বললো- ‘তুই সবসময় নিরব থাকতি, কখনো কিছু বোঝার সুযোগ তৈরি করে দিসনি কি করে বুঝবো, কচ্ছপেরও হৃদয় থাকে!’ অর্ণব একটু রাগ করে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললো- ‘ তুই আমাকে কচ্ছপ বললি? পৃথিবীর আর কোনো প্রাণি ছিল না’? অদিতি হাসতে হাসতে অর্ণবের বুকে মাথা রেখে বললো-‘ কি করে বলি এর চেয়ে ভালো উপমা যে খুঁজে পাইনি’। অর্ণব আর আমি ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। অর্ণব অনেকবার জানতে চেয়েছে কেন এই নাটকটি করলাম। কোনো প্রশ্ন কারো মনে উদ্রেক হলে তার স্বপক্ষে উত্তর দাঁড় করাতে হয়; না হলে প্রশ্নের শাখা- প্রশাখা বাড়তে বাড়তে একসময় মহীরূহে পরিণত হয়। তার সুযোগ দেওয়া উচিত না। রাতে দুজনে একসাথে ডিনার শেষ করে ব্যালকনিতে বসলাম।

পূর্ণিমার চাঁদ না থাকায় আকাশে চাঁদের আলো নেই। রাস্তার সোডিয়াম লাইটের আলোতে অর্ণবের ঝাপসা চোখগুলি দেখা যাচ্ছে। হাজারো প্রশ্ন তার চোখে মুখে। আমি প্রথমে আর্জুনের প্রসঙ্গ টানলাম। অর্জুন বেশ হ্যান্ডসাম যুবক। তাকে দেখলেই যে কোন মেয়ে প্রেমে পড়বে। কিন্তু অর্জুনের সৌন্দর্য আমাকে আকৃষ্ট করেনি। এই ফ্ল্যাটে উঠার পর অর্জুন নানা ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছে সে আমাকে চায়। পছন্দ করে, ভালোবাসে। সারাজীবন পাশে থাকতে চায়। অর্জুন যতবারই এই প্রসঙ্গ তুলেছে ততবারই বলেছি- ‘আমি তোকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবিনি’। এ কথা শুনে সে রেগে যেতো। এদিকে অঞ্জন চায় তাকে বিয়ে করতে; না হলে সে আত্মহত্যা করবে। কারণ সে নাকি ভালোবাসে।

আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি আমরা বন্ধু, এর বাইরে কিছু ভাবিনি। ভাববার সুযোগ নেই। সেও আমাকে হুমকি দিতে থাকে। এদিকে বস হুমকি দিতে থাকে বন্ধুদের ছেড়ে তার দেওয়া ফ্ল্যাটে উঠতে। সেখানে গিয়ে থাকতে; কারণ সে চায় না আমি তিনজন ছেলে বন্ধুদের সাথে থাকি। সে আমাকে পছন্দ করে এবং বিয়েও করবে। যদিও তার স্ত্রী সন্তান আছে। এই ধরো রক্ষিতার মতো। তার এই প্রস্তাবে রাজি না হলে চাকুরি চলে যাবে। এদিকে অনির শর্ত এই ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্য কোথাও উঠতে হবে। এখানে থাকা তার পছন্দ নয়। কিন্তু আমি সবাইকে ছেড়ে যেতে পারছিলাম না। এত চাপ নিতে না পেরে এই আইডিয়াটা এপ্লাই করি এবং সফলও হই। কারণ কেউ আমাকে ভালোবসেনি। তারা নানাভাবে উত্যক্ত করার কারণে তাদের ভেতরে ভয় কাজ করছিল। আর আমি মরে গেছি আর মৃত্যুর জন্য ওরা দায়ী এই ভেবে পালিয়ে যায়। ওদের প্রেম আমার জীবনটাকে বিষিয়ে তুলেছিল। আর সেই বিষে আমি কাতর ছিলাম। আজ থেকে আমি মুক্ত, ওদের শুরু। আতঙ্কে দিন কাটানো কতটা যন্ত্রণার এবার হাড়ে মাংসে টের পাবে।

অদিতির কথা শুনে অর্ণব চুপ হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে জীবন এক জটিল অংক।

 

+ posts

Read Previous

হাফিজ রহমান-এর গুচ্ছকবিতা

Read Next

কলঙ্কিনী রাধা – দ্বিতীয় পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *