অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

লুনা রাহনুমা -
আনতারা

আনতারা নামটির অর্থ বীরাঙ্গনা।

বীরাঙ্গনা শব্দটি শুনলেই সুধাংশু বিশ্বাসের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে হয়। সেই সময় তিনি ছিলেন এক দুরন্ত কিশোর। সুধাংশুর বাবা সুবল বিশ্বাস ১৯৭১ সালে সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য। বাবার মুখে যুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছে সে। গোলাগুলি, রক্ত আর প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর সেই দিনগুলো এতো বছর পর এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে তার। চোখে ভাসে ভয়ানক দিনগুলোর ভুলে যেতে চাওয়া স্মৃতিগুলো। বাবাকে হারানোর স্মৃতি। যুদ্ধ মানেই তো হত্যা, নৃশংসতা, ক্ষত-বিক্ষত লাশের বহর। তবুও এসব না পেরোলে নিজের একটি স্বাধীন দেশ পাওয়া হতো না।

সুধাংশুর বড় মেয়েটি জন্মেছিল দেশ স্বাধীন হবার প্রায় বাইশ বছর পর। মেয়ের সাথে যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই, ছিল না। তবুও স্ত্রী মৃন্ময়ী দেবীর গর্ভের সন্তানটি যখন সময়ের আগেই পৃথিবীতে চলে আসলো, তখন বাড়ির দাইটি বলেছিলো,

‘তোর বেটি মস্ত বড় পালোয়ান বাহে। অই বাঁচি থাকপে। আগোত হইচে জন্যে মরণ উয়্যাক নিব্যার পাইরব্যান্নায়।’

দাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে সুধাংশুর আবারো মনে পড়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের কথা। যুদ্ধের সময়কার ভাগ্যহতা বীরাঙ্গনাদের কথা। তাই তিনি কন্যার নাম রাখলেন- আনতারা। স্বাধীনতার এতো বছর পরেও সুধাংশুর মনে হয় দেশ স্বাধীন হলেও দেশের জন্য যুদ্ধ করা শেষ হয়নি এখনো এই দেশের মানুষের। সেই অনেক বছর আগে যুদ্ধের মাঠে সহযোদ্ধার মৃতদেহ কাঁধে করে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া সুধাংশুর বাবা এখনো ঘুমে কিংবা জাগরণে এসে তাড়া দেয়া ছেলেকে। যুদ্ধের রক্তাক্ত গল্প শোনায় ক্ষুব্ধ কণ্ঠে। বাবা যেন এখনো হেঁটে চলেছেন এই দেশের মাটিতে, তাঁর কাঁধে সহযোদ্ধার লাশের ভার, এখনো তাঁর পেছনে হেঁটে চলেছে আব্দুল, জব্বার, অসিত, মনির, শ্যামল, আলেয়ার মা, সখিনা, শিশু রেহানা, পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়া পাগলপ্রায় অসংখ্য মেয়ে-মহিলা-নারী ও মায়ের দল।

দেশ স্বাধীন হবার পর স্বাধীন দেশের মাটিতে সুধাংশু বীরদর্পে খোলা তলোয়ারের মতো বাবার যুদ্ধের বন্দুকটিকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে কিছুদিন। তারপর বন্দুকটিকে জমা দিয়ে এসে ভেবেছিলেন, মারা যাবার আগে বাবা যেমন দেশ পাবার গল্প করে গিয়েছে, হয়তো ঠিক তেমনই একটা দেশ পাবে এবার তারা। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী বছরগুলোতে দেশের পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকলো। মৃত্যুর স্পর্শ ছুঁয়ে প্রথমবার সন্তান জন্ম দেয়া মায়ের মতন আর নিজ রক্তের উত্তরাধিকারের মুখ দর্শনে আপ্লুত পিতার মতন স্বাধীন দেশের মানুষগুলো চিন্তায় এবং পরিকল্পনায় দিশেহারা হয়ে গেল। ভীষণ বিশৃঙ্খলা আর অন্যায় ঘটতে থাকে সদ্য ভূমিষ্ঠ দেশটির ভেতর। রাজনীতির খেলায় ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রে বন্ধুর মতো প্রিয়জনের হাতেই প্রাণ হারাতে থাকে এই দেশের সেরা সন্তানেরা। নিজের বাড়িতেই সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কণ্ঠস্বর ও দিকনির্দেশক শেখ মুজিবুর রহমানকে। লঙ্গরখানায় অন্নের অভাব। বন্যায়, শীতে বস্ত্রের অভাব। হাহাকারের আর্তনাদ পুরো দেশটা জুড়ে। মানুষের এতো কষ্ট দেখে সুধাংশুর মতো অনেকের মনে হয়, যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। মৃত যোদ্ধাদের পরিবার এখানে সেখানে না খেয়ে দিনযাপন করছে। পাকিস্তানি মিলিটারিদের বর্বরতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ শরীরে নিয়ে বীরাঙ্গনারা পতিতালয়ে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছে। তবুও স্ত্রী-কন্যাকে প্রাণ দিয়ে আগলে রাখতে চেষ্টা করে সুধাংশু। বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছে, এই একটা পরম শান্তি তার কাছে।

জন্মের পর থেকেই আনতারা মেয়েটা লক্ষ্মীর প্রতিমা সুধাংশুর ঘরে। ভীষণ চঞ্চলা হলেও আদবে সুশীলা। বাবার আদর বেশি কাড়ে, নাকি মায়ের মমতায় বেশি আদৃত হয়, সঠিক করে মেপে বলা কঠিন। কিন্তু সে তার বাবা ও মায়ের দুই চোখে দুটি স্বপ্নের তারার মতন প্রিয়। আনতারার দুই বছরের ছোট ভাই প্রণব, সারাক্ষণ বোনের সাথে থাকে। আনন্দ, বেদনা, হাসি-কান্নায় মাতিয়ে রাখে এই দুটি তাদের সুখী গৃহকে। যুদ্ধের সময় একবার শখ করে পাকিস্তানিদের দেখতে গিয়ে সুধাংশুর ডান পায়ে একটা গুলি এসে লেগেছিলো। গুলিটি হাঁটুর উপর মাংসপেশির ভেতরে হাড়ের খুব কাছ কেটে বেরিয়ে গিয়েছিল বলে বাঁচা। পা কেটে ফেলতে হয়নি। কিন্তু সুধাংশু দুই পায়ে সমান জোর পান না এখন আর। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পা’টি আরো অকেজো হয়ে পড়েছে। সংসার চালানোর জন্য সে এখন নদীতে মাছধরার কাজ করে। নিজের নৌকা নেই, তাই ভোলানাথ, শিবু, হারাধনের বড় নৌকায় জোগালি দিয়ে মাছ ধরতে যায় নদীতে। রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর কসবা হিন্দু জেলেপল্লীতে বাস করেন এরা সবাই। অনেক বছর ধরে পাশাপাশি থাকায় পরিবারগুলো আত্মীয় না হয়েও পরমাত্মীয়ের মতো সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে নিজেদের ভেতর।

সময়ের পরিক্রমায় সুধাংশু বৃদ্ধ হয়েছে। শিশু আনতারা এখন যুবতী। পণের টাকা জোগাড় হয়নি বলে মেয়ের বয়স ত্রিশ পার হয়ে যাবার পরেও তাকে পাত্রস্থ করা যাচ্ছে না, এই নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে সুধাংশুর মনে। ছেলেটি তবু পীরগঞ্জ সদরে একটা মুদি দোকানে কাজ করে। সুধাংশু ভাবছেন ছেলেটিকে বিয়ে দিয়ে যদি কিছু টাকা-পয়সা পাওয়া যেত মেয়ের পরিবার থেকে, তাহলে তিনি আদরের মেয়ে আনতারার জন্য একটা বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারতেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে একটি সুপাত্রের সাথে দাবি করা পণের লম্বা লিস্ট।

চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষ, দুর্গা পূজা শুরু হয়েছে। সুধাংশুদের হিন্দুপল্লীতে ভীষণ খুশির আমেজ। সবার মন উৎফুল্ল। কিন্তু আনন্দ স্থায়ী হলো না। সপ্তমীর দিন জেলেপল্লীর সবার ভেতর খুব উৎকণ্ঠা দেখা গেলো। পাশের ঘরের শিবু এসে প্রথম সংবাদটি দিলো,

‘দাদা শোনচেন? ফির বিপদ আইলো হামার।’

সুধাংশু বলে,

‘হ। শোনচোঁ। হাটখোলাত দোকানোত টিপিত খবর দ্যাখছোঁ। কুমিল্ল্যাত বোলে মন্দিরোত কোরান শরীপ পাওয়া গেইছে। হামার ছিরি রামের সাঁতের হনুম্যানের পায়ের নেচোত কেবা মোসলমানের বইখ্যাঁন থুইচে।

মৃন্ময়ী ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। একটা পিঁড়ি টেনে নিয়ে বসলো পাশে। বললো,

“হায় রাম! মন্দিরোত কোরান ঢোকলে কী হয় বাহে? হুনম্যান ফির কোরান পড়ি দ্যাখফে নাকি? এইগল্যা কোন কথা হইলো বাহে?’

ঘরের ভেতর তিনটি বয়স্ক মানুষ ভয়ে মিইয়ে যেতে চায়। আতঙ্কে গুটিয়ে যায় বুকের ভেতর। প্রতিবাদে ফেটে পড়তে চায় কণ্ঠনালী। কিন্তু তারা যথাসম্ভব গলা নামিয়ে ফিসফিস করে কথা বলে। আলো জ্বলা চোখে সন্তর্পণে তাকায় একে অন্যের মুখের দিকে। ঠোঁটের কোণে কেমন একটা অভিমানের রেখা ফুটে ওঠে। সে অভিমান মিলিয়ে যায় না কিছুতেই। স্থায়ী হয়ে ফুটে ওঠে মুখের কোণায়, কথা বলার ভঙ্গিতে। চাপা কণ্ঠে শিবু উত্তেজিত হয়ে বলে,

‘বইন! এইগল্যা ইচ্চ্যা করি কচ্ছে কাঁইয়ো। এই দ্যাশোত হেন্দুর ঘরোক থাইকপ্যার দিব্যান্নায়। হামাক দ্যাশ থাকি ক্ষ্যাদে দিব্যার জন্যে ওরায় মন্দির, হেন্দু বেইচ্ছোইল, হেন্দুর ভূঁই সোগগুল্যাত অইত্যাচার কত্তুছে। দুইদিন পর পর নানান ভ্যাঁংতা ওমার।’

সুধাংশু শূন্য দৃষ্টিতে বসে থাকে অনেকক্ষণ ধরে। দুই হাঁটুর উপর দুই গালে হাত রেখে বলে,

‘হামার দ্যাশ ছাড়ি হামরা কোনঠে যাঁমো বাহে? দ্যাশ শাদিন কইরব্যার যায়া হামার বাপ মরি গেইছে। হামরা ইতিম হছি। যোদ্ধের সমায় মুইও সাহাজ্য কচ্ছোঁ মুক্তিবাহিনিক। হামার বাপ দাদা চোদ্দগুষ্টি এই ভিঁট্যাত হইচে। দ্যাশ ছাড়ি কোনঠে যামো হামরা?”

মৃন্ময়ী পরনের ত্যানা ত্যানা হয়ে যাওয়া বহু ব্যবহৃত শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে ঘরের ভেতরে গেলো। পাতলা স্টিলের দরজা ঠেলে আবার ফিরে এসে এদের পাশে বসলো। একটি বাটিতে কিছু মুড়ি আর কয়েকটি নারকেলের নাড়ু নিয়ে এসেছে শিবুর জন্য।

শুকনো মুড়ি চাবাতে চাবাতে শিবু বললো,

‘মুঁই শুননু কুমিল্ল্যাত, চাঁদপুরের গোড়োত বোলে ভাঙ্গাভাঙ্গি হইচে। হেন্দুর মন্দিরোত মোসলমানের বই ঢোকলে ধর্মের ক্ষতি না হইলেও মোসলমানের ঘরে সর্বনাশ হয়া গেইছে। মোসলমানের চায়া জাতপাত বোলে হেন্দুরে বেশি? অ্যালা দেখতুছোঁ সোগ উল্ট্যাপাল্টা।’

মৃন্ময়ী রাগে ফুঁসে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠতে ইচ্ছে করে তার। তবু গলার স্বর নিচু রেখেই বলে,

‘জাতপাত মারাইছে। এইগল্যা খালি হামার খ্যাদে দেওয়ার বুদ্দি। অ্যাখে মাটির মানুষ। ওমার অক্ত নাল? হামার অক্ত কি ধলা?’

বুক ভেঙে কান্না আসতে চায় ওদের তিনজনেরই। হাহাকারের মতো শোনায় কথাগুলো। ভয়ে চিমসে আছে তিন মানুষের চোখ-মুখ। শিবু ফিসফিস করে বলে,

‘অবস্তা ভালো নোয়ায় কিন্তু। মোসলমানেরা হেন্দুর বাড়িত ডাঙ্গাডাঙ্গি কত্তুছে। মানুষ মারি ফেলাইতুছে। সোগ জিনিস কাড়ি নিতুছে। সোগগুল্যা আক্ষইশ।’

পূজামণ্ডপে আগুন ধরানো নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে পুরো পল্লীর সবাই। রাগে ফুঁসছে। কিন্তু কেউ মুখে কিছু বলছে না। এই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। রাষ্ট্রধর্মও ইসলাম। এখানে অন্য ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে হিন্দুধর্মের মানুষদেরকে খুব সতর্ক হয়ে থাকতে হয়। কারণটা পরিষ্কার না হলেও হিন্দু আর মুসলমানদের পরস্পরের প্রতি এই বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব সেই ধর্ম চালু হবার সময় থেকেই হয়ে আসছে। হিন্দুর দেশে কোণঠাসা হয়ে থাকবে মুসলমানেরা। আর মুসলমানের দেশে কোণঠাসা হয়ে থাকবে হিন্দুরা। এটাই যেন এখন প্রচলিত সার সত্যি নিয়ম প্রতিবেশী দুটি দেশের ভেতর। যদিও দেশের কোনো নিজস্ব ধর্ম থাকার কথা নয়। সব ধর্মের মানুষই একটা দেশের নাগরিক। এসব পুঁথিগত কথা, এই হিন্দুপল্লীর কেউ বলে না। তারা কেবল ভয়ে আরো বেশি করে আধমরা হয়ে যেতে থাকে প্রতিদিন। সংখ্যালঘু হিসেবে বাংলাদেশে টিকে থাকতে হলে তাদেরকে অবশ্যই মুসলমানদেরকে ভয় পেয়ে দিন কাটাতে হবে। মনে ভয় না পেলেও আচরণে তা অবশ্যই প্রকাশ পেতে হবে। ওরা সবাই সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে। যদিও অল্প কিছুদিনের ভেতরেই শোনা গেলো ইকবাল হোসেন নামে মাথা খারাপ একটি ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছে মণ্ডপে হনুমানের কোলে কোরআন রাখার অপরাধে। সুধাংশুর মতো অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, যুক্তিতে বুঝে পায় না, ইকবালের যদি মাথা খারাপই হবে, তাহলে সে খারাপ মাথা খাটিয়ে এতগুলো মানুষের জীবন নিয়ে মজা করার বুদ্ধি পেলো কোথায়? কীভাবে?

কুমিল্লার ঘটনাটি অমীমাংসিত থাকতেই দেশে ঘটলো আরেকটি ভয়ানক ঘটনা। বিজয়ার দিন দশ বছরের একটি হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে মুসলমান ধর্মের কেউ। সিঁদুর খেলার আনন্দপূর্ণ বিজয়া পরিণত হলো রক্তাক্ত শারদে। অনলাইনে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানবতাবাদী মানুষেরা প্রতিবাদের ঝড় তুলে ফেললো। সারা দেশে চলছে বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের ঢেউ।

এইসব বিক্ষোভ গুঞ্জনের ভেতর কয়েকটি দিন কোনোরকমে পার করতেই আবার এলো আরেক ভয়ংকর অধ্যায়। জেলেপল্লীর অধিকাংশ বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে। বয়স্করা এখানে সেখানে জটলা পাকিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে। সুধাংশুদের জেলেপল্লীর বাসিন্দা প্রশান্ত কুমার। শোনা যাচ্ছে, প্রশান্তের ১৬ বছরের ছেলে পরিতোষ নাকি ফেসবুকে একজনের পোস্টের কমেন্টে মুসলমানদের পবিত্র ঘর কাবা শরিফের ব্যঙ্গ ছবি পোস্ট করেছে। এই নিয়ে পুরো ফেসবুক তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। সুধাংশুর মোবাইল ফোন নেই। সে ফেসবুক কিংবা আধুনিক এইসব যন্ত্রপাতির কাজকর্ম বুঝতে পারে না। তবে পরিতোষের জন্য তার দুশ্চিন্তা হতে লাগলো। ছোটবেলা থেকে চোখের সামনে বড় হতে দেখেছে ছেলেটিকে। রাত দশটার দিকে কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোক পল্লীতে এসেছে পরিতোষকে খুঁজতে। লোকগুলো সহসা জেলেপল্লীর চারপাশ ঘিরে ফেললো। ভয় পেয়ে পরিতোষ এবং তার পরিবারের সবাই পালিয়ে গেলো পল্লী থেকে। ক্ষিপ্ত লোকগুলো জেলেপল্লীর অর্ধশতাধিক বাড়িতে হামলা করে, আগুন লাগায় এবং লুটপাট করে। প্রাণ বাঁচাতে আর সবার মতো সুধাংশু নিজের স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়েকে নিয়ে পাশের ক্ষেতে গিয়ে লুকালো। রাতের অন্ধকারে তারা সবাই যথাসম্ভব পা টিপে টিপে হাঁটছে। কথা বলছে ফিসফিস করে। কানের কাছে মশা আর পোকার দল শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে, কামড়ে দিচ্ছে, কিন্তু কারো ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। একটু শব্দ করে মৃন্ময়ী বলে উঠলো,

‘আনাতারায় কি তোমার গোড়োত?’

মৃন্ময়ীকে চাপা ধমকে দিলো সুধাংশু,

‘চুপ করেক। কথা কইলে সবাখে মারি ফেলাইবে।’

মৃন্ময়ী অন্ধকারে স্বামীর হাত ধরে বললো,

‘আনু কোনঠে? আনুক দেখতুছোঁ না ক্যান?’

‘আনু ন্যা তোমার গোড়োত আছিল?’

‘আছিল তো। অ্যালা ক্যাম্বা দেখতুছোঁ না? হামার আনু কোনঠে হারে গেলো?’

সুধাংশু কেঁপে ওঠেন। ক্ষেত থেকে বেরিয়ে গিয়ে খুঁজতে চান মেয়েকে। কিন্তু মৃন্ময়ী স্বামীর হাত ছাড়ে না,

‘না। তোরা অ্যালায় যাবান্নান। আনু বোদায় নুকি আছে কোনোঠে। থাউক। বিয়ানবেলা পাওয়া যাইবে।’

সারারাত জেলেপল্লীর অধিকাংশ মানুষ ক্ষেতের ভেতর লুকিয়ে থাকলো মুসলমানের হাতে ধরা পড়ার ভয় আর সাপের কামড়ের ভয় নিয়ে। ক্ষেতের ভেতর প্রাণ ভয়ে লুকিয়ে থাকা মানুষগুলো তাদের শিশু সন্তানদের মুখ চেপে ধরে থাকে প্রাণপণে। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা জেলেপল্লীর আগুন নেভাতে আর লুটপাটের দাঙ্গা থামাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পৌঁছে গিয়েছে। পুলিশ অর্ধশতাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করে নিয়ে গেলো। ভোরের দিকে চারপাশ থেকে মাইকিং শোনা গেলো। সরকারি লোকজন তাদের সবাইকে ক্ষেত থেকে বেরিয়ে আসতে বলছে,

‘তোমাক ভয় নাই বাহে? বারে আইসো। তোমাক কেউ মাইরব্যান্নায়।’

ক্ষেতের ভেতর থেকে বেরিয়ে মানুষগুলো প্রথমেই ছুটে গেলো নিজের বাড়ির কাছে। বুকভাঙা ক্রন্দনে ফেটে পড়তে চাইলো জেলেপল্লীর পুরোটা আকাশ। আর্তনাদে আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস।

‘হায় ভগবান! হামার ঘর কোনঠে? হামরা অ্যালা থাকমো কোনঠে?’

ঘর বলতে এখন পল্লীতে পড়ে আছে শুধু পোড়া ছাইভস্ম। অনেকগুলো দরিদ্র পরিবারের মাথা গোঁজার সামান্য ঠাঁইটুকুও চলে গেল অল্প কিছু মানুষের ক্রোধের দাবানলে পুড়ে। সুধাংশু পোড়া ভিটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর আবার ক্ষেতের দিকে দৌড়ে গেল। যেতে যেতে মৃন্ময়ীকে উদ্দেশ্য করে গলা চড়িয়ে বলে,

‘আনাতারাক উকটি আইসোঁ। চেংড়িট্যা যে কোনঠে গেল?’

স্বামীর পেছন পেছন মৃন্ময়ীও দৌড়ে যান ক্ষেতের কাছে। অল্প খুঁজতেই ক্ষেতের একপাশে পেয়ে গেলেন আনতারার রক্তাক্ত, বিবস্ত্র, ক্ষত-বিক্ষত লাশটি। মাটির উপর বসে পড়েন মৃন্ময়ী। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছেন। সুধাংশু তার গলার গামছাটি দিয়ে ঢেকে দিতে চেষ্টা করে মেয়ের লজ্জা। রাতে পালানোর সময় দানবেরা তার মেয়েটিকে মুখ চেপে ধরেছিলো এইখানে। উপর্যুপরি ধর্ষণ করে যাবার সময় মেয়েটির মাথা ইটের আঘাতে থেঁতলে দিয়ে গেছে। ক্ষেতে সবুজ ঘাসের উপর জমে থাকা তরল রক্তের ছোট ডোবাগুলো এখনো জমে উঠতে পারেনি। মৃত মানুষের মুখেও এমন ভয়ার্ত ছায়া লেপ্টে থাকতে পারে আগে জানা ছিল না সুধাংশুর। শুধু ধর্ম বিশ্বাস আলাদা হবার কারণে এতো আক্রোশ হয় মানুষের উপর মানুষের!

মেয়ের পাশে সুধাংশু পাথর হয়ে বসে থাকে। মৃন্ময়ীর মতো তার চোখ থেকে জলের ধারা নেমে আসে না। তার চোখ দুটিও যেন পাথরে পরিণত হয়েছে। একজন বীরাঙ্গনার বাবা সে, তাকে তো ভেঙে পড়লে হবে না। মেয়ের সৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে যে তাকেই।

লুনা রাহনুমা

+ posts

লুনা রাহনুমা

দেশের জাতীয় দৈনিক, বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা, মুদ্রিত লিটল ম্যাগাজিন ও ওয়েবজিনে নিয়মিত লিখছেন।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ "ভালোবেসে এঁকে দিলাম অবহেলার মানচিত্র"(১৯৯৯) এবং "ফুঁ"(২০০০), বিশাকা প্রকাশনী।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ "নারীবৃক্ষ" (ডিসেম্বর, ২০২১), অনুজ প্রকাশনী।
প্রকাশিত অনুবাদ গল্পগ্রন্থ "দিগন্তের দিকে হেঁটে যাওয়া মেয়েটি," (একুশে বইমেলা, ২০২২), অনুপ্রাণন প্রকাশন।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের সুইন্ডনে বসবাস করছেন।

Read Previous

অজ্ঞাতবাস

Read Next

বিব্রতকর আলাপ-প্রলাপ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *