অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কাজী লাবণ্য -
অজ্ঞাতবাস

নিচের কাকিমা বুঝি জিরে তেলে গাদাখানেক শুকনো লংকা দিয়ে কিছু একটা সম্বার দিলো। লহমায় ঝাঁঝটা এসে আমার নাকে ঢোকার আগেই সরতে চেয়েও পারলাম না। দু’হাতে পেট ধরে হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো করে সজোরে হাঁচি দিতে দিতেই বুঝতে পারলাম শুভ ফিরল, কাকির সাথে কি নিয়ে যেন কথা বলছে। ওঠানামার সময় উনার সাথে কথা না বললেই নয়। প্রথমদিকে ভীষণ বিরক্ত লাগত, কিন্তু পরে যখন আমি করপোরেটের চাকরিটা করতাম, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে বা রাত হয়ে যেত, তখন প্রিয়মকে এই কাকিমা-ই দেখতেন। লোহার দরজা ঠেলে শুভ দরোজার গোড়ায় আসতে আসতে আমি উঠে গিয়ে সিটকিনি খুলে দিলাম। আমার মুখের ‘পরে নজর বুলিয়ে ও ভেতরে চলে গেল। যাবার আগে হাতের ব্যাগগুলো বিছানায় নামিয়ে রাখল। ওঘরে প্রিয়ম উঁচু ভলিউমে বব দ্য বিল্ডার দেখছে, পুত্রকে ইংরেজি কার্টুনগুলো দেখতে দেই।

একমাত্র সন্তানকে ভালো ইংরেজি স্কুলে পড়াতে চাই, সেভাবেই ওর পথ তৈরি করছি আমরা দু’জনে। রাজধানীর সব ইংরেজি স্কুলে খোঁজখবর নিয়েছি, সরেজমিন তদন্ত করে দেখেছি বাবুকে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করাতে গেলে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। শুভ আর আমার চাকুরির টাকায় নিভু নিভু লিকলিকে মোমবাতির মতো কায়ক্লেশে জীবন টেনে নেয়া হয়তো যাবে, কিন্তু বাবুকে পড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু তাতো আর হতে পারে না!
বাবু ভালো স্কুলে পড়বে, বড় হবে, বিদেশ গিয়ে উচ্চ ডিগ্রি নেবে এটাই আমাদের স্বপ্ন।
পাস করার পর থেকেই দু’জনে চাকুরির জন্যে অসংখ্য আবেদন করেছিলাম, শেষে আমি একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে আর শুভ কাজ পায় একটি এনজিওতে, শোনা যাচ্ছে, সেটিও নাকি উঠে যাবে এ বছরেই। এরই মাঝে আমাদের প্রিয়মের জন্ম এবং এখন সে দুরন্ত এক শিশু।
লবঙ্গগন্ধি টুথপেস্টের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ ছড়িয়ে শুভ এসে আমার পাশে বসল–

-কি, শরীর ভালো আছে তো? ট্যাবলেট খেয়েছ? সব তো গুছানো কমপ্লিট, এই খাবারের প্যাকেটটা নিলেই শেষ। দেখি তোমার ফোনটা দাও সিম চেঞ্জ করে দেই- এই বলে সে আমাদের দু’জনের ফোনের সিমকার্ড চেঞ্জ করতে লাগল।

-যাও বাথরুম সেরে এসে শোবে চল, একটু ঘুমিয়ে নেয়া দরকার।

আমার কোনো সাড়া না পেয়ে সে আরো কাছে নিবিড় হয়ে আসে, মাথায় আলতো হাত দিয়ে বলে-

-এত কি চিন্তা করছ বলত? আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ব্যস। এটা ঠিক যে আমরা যা করছি, তা হয়তো ঠিক করছি না, কিন্তু এমন ইস্যুতে এ ছাড়া আমাদের আর কি-ইবা করার ছিল। তোমাকে তো আমি বলেছি- তুমি যা চাইবে, যেভাবে চাইবে তাই হবে। এখানে আর কোনো কথা নেই, থাকতে পারে না। আমার তো তোমাকে বাঁচাতে হবে…

আমি মাথা নিচু করে চুপচাপ শুনে যাই।
শুভ আবার বলে-

-তুমি নিরাপত্তার কথা ভাবছ? ভেবোনা আমার উপরে ছেড়ে দাও। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।

আমি এক অব্যক্ত দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকাই।

-লাবু, তুমি মন শক্ত কর, যার জন্য তুমি আমি আমরা এতকিছু করছি, তুমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে ওর ক্ষতি হবে, ‘প্লিজ বি স্ট্রং অ্যান্ড স্টাডি মাই ডিয়ার, ফর আওয়ার কামিং বেবি’।

এই একটি শব্দে আমার মন একদম ভালো হয়ে যায়।

-আওয়ার বেবি…

-যাও, তুমি শোও, আমি আসছি।

বলে আমি ওঠে গিয়ে প্রিয়মের গালে একটা আদর দিয়ে ওর মশারি গুঁজে দিয়ে বাথরুমে চলে যাই। সময় নিয়ে গোসল করি। শীতকাল চলে গিয়েছে, ধোঁয়া ওঠা বরফের তীব্রতায় চলে আসছে গরম, দিনে দুবার গোসল না করলে থাকতে পারি না। তাছাড়া আমাদের এই বাসাটা ছাদের উপর হওয়ায় তাপ অনেক বেশি।
টাকা বাঁচানোর তাগিদে আমরা মনসুরাবাদ এলাকায় গাবতলী বাসডিপোর কাছাকাছি ছাদের উপরে খুব স্বল্পভাড়ায় দেড়খানা ঘর ভাড়া নিয়েছি। নিচে দুই বুড়োবুড়ি থাকেন, আমরা আসাতে তারা বেশ খুশি হয়েছেন। অবশ্য এ বাড়ি থাকবে না, সবকিছু ঠিকঠাক, ডেভেলপাররা এটাকে ভেঙে হাইরাইজ বিল্ডিং বানাবে।
গোসল সেরে এসে দেখি শুভ ঘুমাচ্ছে, ওর গাঢ় শ্বাসের মৃদু শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, বাবুকে ওপাশে সরিয়ে নিজেও সরে আমার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমি ছাদে চলে এলাম, বাড়ির পেছনে কচুরিপানায় ভরা একটা খাল আছে, সেটাই ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠছে, খালের একেবারে কিনারে একটা ঝকঝকে মসজিদ উঠেছে, আর কত যে ঘরবাড়ি। মিরপুর রোড ধরে শাঁ শাঁ করে চলে যাচ্ছে ভারী যানবাহন কেঁপে উঠছে রাস্তা, কেঁপে উঠছে জমিন, কাঁপছি আমিও।
এ-বাড়ির সীমানায় কিছু গাছপালা আছে সেগুলোকে পেঁচিয়ে উঠে গেছে ধুন্দুল, তেলাকুচাসহ নানান জংলি লতা। সেগুলিকে ঘিরে কিছু জোনাক জ্বলছে, ঠিক ওই জায়গাটিতে সম্ভবত জলের পাইপ ফেটে গিয়ে চিকন, কিন্তু তীব্র ঊর্ধ্বমুখী কয়েকটি জলের ধারা একটা ফোয়ারা তৈরি করেছে। অন্যসময় এগুলো দেখতে আমার কি যে ভালো লাগে! এই ঢাকা শহরেই যে আজো তেলাকুচা গাছ আছে, কেউ কি জানে সে কথা! আমার মনে হয় কেউ জানেই না। একসময় বৃক্ষপ্রেমীদের, বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষ চেনার সংগঠন ‘তরুপল্লব’-এ আমরা দু’জন নিয়মিত যেতাম। সেখানে অধ্যাপক নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা, বিপ্রদাস বড়ুয়াসহ আরো বিজ্ঞজনদের উদ্ভিদ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞানের কথা শুনেছি আর চিনেছি বেশকিছু গাছ লতাপাতা।

এই স্যাঁতসেঁতে জংলি জায়গাটার উপর মায়া পড়ে গেছে, কতদিন থাকলাম এখানে? আজ এই শেষ মুহূর্তে আর হিসাব করতে ভালো লাগছে না। এই রাতের শেষে ভোর আসবে, সেই ভোরের আবডালে আমরা গাড়িতে উঠে চলে যাব অচেনা শহরের অজানা ঠিকানায়। অজ্ঞাতবাসে।

(২)
কেমিস্ট্রির একজন ছাত্র আর বোটানির এক ছাত্রী মিলে তৈরি হয় এক নতুন কেমিস্ট্রির পথচলা। তা চলতেই পারে, এ আর এমন নতুন কি! কিন্তু লাবিবা আহমেদ আর শুভময় চক্রবর্তীর কেমিস্ট্রি কি চাইলেই একত্রে পথ চলতে পারে! না পারে না। কাজেই, নিজেদের ডিপার্টমেন্ট পেরিয়ে, ঢাবির ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে এ কথা পৌঁছে যায় আমাদের অন্দরমহলে। ব্যস, একটা ঝড় এসে আমাদের মাঝে সুউচ্চ প্রাচীর তৈরি করে দেয়, আমি বন্দী হই অন্তরালে আর শুভ ছিটকে পরে কক্ষপথ থেকে দূরে। কিন্তু তাবলে কি সব থেমে যায়!
পাখি গান গায় না!
ফুল ফোটে না! চাঁদ ওঠে না! জ্যোৎস্না ছড়ায় না!
সময় একদিন আমাদের জানিয়ে দেয়, এভাবে সম্ভব নয়। আমরা এই জগতে এসেছি-ই পরস্পরের জন্য। গার্জিয়ানরা শুভাকাঙ্ক্ষী মানি, কিন্তু তাঁরা না বুঝলে আমরা নাচার।
ভালোবাসার শক্তি অদম্য।
যৌবনের অকুতোভয় তীব্রতাকে অস্বীকার করা এককথায় অসম্ভব।
নিজ গোত্র, আবাস, পরিবার, মতান্তর ছেড়ে আমরা ঘর বাঁধলাম।
আমি ও’লেভেল পর্যন্ত পড়েছিলাম ঢাকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। এজন্যই নামকরা ইংরেজি স্কুলে চাকরি পেতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু সন্তান জন্মের পর আমি স্কুলের কাজটা ছেড়ে দেই, সে একটু বড় হলেই আমি আবার একটি জব পাই একটি করপোরেট অফিসে। এখানেই আমি একজন কলিগের কাছে সারোগেট মাদারের বিষয়টা জানতে পারি।

আমাদের দেশেও নাকি আজকাল ভারত বা অন্য দেশের মতো উচ্চবিত্তরা সন্তান ধারণে অক্ষম বা শোবিজ জগতের মানুষেরা বিশাল অ্যামাউন্টের বিনিময়ে সারোগেট মাদার খোঁজেন এবং পুরো ব্যাপারটা হয় অসম্ভব গোপনীয়তার মধ্যে। কেউ ক্ষুণাক্ষরেও কিছু জানতে পারে না।
ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকে যায়, মাথায় হিসাব-নিকাশ চলতে থাকে, বাবুটা বড় হচ্ছে, ওকে স্কুলে দিতে হবে এবং জানি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের খরচ অসম্ভব বেশি।
মনস্থির করে আমি শুভকে সব খুলে বলি, শুভ এককথায় উড়িয়ে দেয় ব্যাপারটা। কিন্তু উড়ে গেলে তো আর জীবন চলবে না। আমি ধীরে ধীরে ওকে সব বুঝিয়ে বলি।

-দেখ, তোমার একটা সুস্থ মস্তিষ্ক আছে বলেই না তুমি কাজ করছ এবং মাস গেলে পারিশ্রমিক পাচ্ছ, ঠিক তো? আমার একটি সুস্থ সবল জরায়ু আছে, মাত্র ৮-৯ মাসের জন্য আমি কেন সেটি ইউজ করতে পারব না, বল! এখানে সমস্যা কোথায়! ওদের দরকার জরায়ু আমার দরকার টাকা। এই তো, প্লিজ তুমি আর না করো না। বাবুকে স্কুলে ভর্তির সময় আসন্ন, আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি, কাজেই শুভ’র আর না করার সুযোগ থাকে না।

ভারতে এ কাজের জন্য আলাদা আইভিএফ সেন্টার থাকলেও আমাদের পুরো ব্যাপারটা সেটলড হয় গাইনি বিশেষজ্ঞের ক্লিনিক এবং চেম্বারে, ভীষণ গোপনীয়তায়। তবে দফায় দফায় বহুবার সেখানে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে আমার মাথা ঘুরে যায়, সারোগেসি নিয়ে রীতিমতো রমরমা ব্যবসা চলে। টেস্টটিউব বেবি বিধিসম্মত হলেও সারোগেসি এদেশে এখনও আইনসম্মত নয়, তাতে কি! আগ্রহী মানুষজন কি আর আইনের তোয়াক্কা করে! এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকগণ ইচ্ছুক দম্পতিদের সহায়তা দিয়ে থাকেন।

সেখানে আমার নানারকম ইনভেস্টিগেশন চলে, শেষে একটি চূড়ান্ত চুক্তিপত্রে আমি স্বাক্ষর করি যে,

‘সন্তান জন্মানোর পরপরই আমি তাদেরকে দিয়ে দিতে বাধ্য থাকব’।

এ নিয়ে আমাকে তারা নানাভাবে কাউন্সেলিং করে, গর্ভে ধারণ করলেও আমি সেই অনাগত শিশুর মা নই, কেবল একজন বায়োলজিক্যাল মা ছাড়া। আমি তো জানি কেবল টাকার বিনিময়ে অন্য নারীর মাতৃত্বের জন্য গর্ভধারণ করছি। যদিও আমি সেই দম্পতিকে কোনোদিন চোখে দেখিনি। আমার খাদ্য, ঘুম, বিশ্রাম, ওষুধ দিনরাতের একটা রুটিন তারা আমাকে দিয়ে দেয়।

চুক্তি অনুযায়ী, অর্ধেক পেমেন্ট হয় শুরুতেই বাকিটা ডেলিভারির পরে। শব্দটি ডেলিভারিই, তবু কেন যেন আমার কানে খট করে বাজে। কেউ কোনো কারণে ডিম্বানুও দিতে অপারগ হলে কেবল ইচ্ছুক বাবার শুক্রাণু বিশেষ পদ্ধতিতে কোনো নারীর গর্ভে রেখে সন্তান বড় করার নাম আইইউআই সারোগেসি। এখন আমি একজন সারোগেট মাদার, আমি আইইউআই পদ্ধতিতে গর্ভ ভাড়া দিলাম বিপুল অংকের অর্থের বিনিময়ে। তবে আমি আনন্দিত, কারণ আমাদের সন্তানের অ্যাডমিশনের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু বিপত্তি বাঁধে মাস ৪/৫ যাওয়ার পর থেকেই।
আমি ঘুমুতে পারি না, খেতে পারি না,অস্থির লাগে, নানান স্বপ্ন দেখি, দেখি এক নাইটিংগেল শিশু দুলতে দুলতে আমাকে মা মা বলে ডাকছে, গর্ভস্থ শিশুর পদচারণা আমার ভেতরে মাতৃত্বের অনাবিল অনুভূতি তৈরি করে! দিন দিন চোখমুখ শুকিয়ে আসে… নিজেকে পাগল পাগল লাগে! মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে- এ আমি কি করেছি!
শুভ সারাদিন পরে ফিরে এসে প্রায়শই জিজ্ঞেস করে কি তোমার কি শরীর খারাপ? আমি মাথা নেড়ে না জানাই।
কিন্তু আমিও তো আর পারছি না। ওকে তো জানাতেই হবে।
একরাতের কথা, দিনে কাবু করা গরম থাকলেও এখনও রাতের বেলা হালকা কুয়াশা পরে, কিছুটা ঠান্ডা অনুভূত হয়, কিন্তু আমার হয় না, অন্যান্য রাতের মতো সাবধানে মশারির বাইরে এসে আমি চেয়ারে বসে থাকি বা ছাদের খোলা অংশে বসে থাকি। মাথার উপর আকাশভরা চন্দ্র-তারা ঝিকমিক করে। তাদেরকে দুশ্চিন্তায় ভুগতে হয় না, তাদের পাগল হওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে নির্ঘুম বসে থাকতে হয় না।
অন্ধকারে শুভ এসে আমার পাশে বসে, আমি চমকে উঠলে সে আস্তে করে বেষ্টন করে আমাকে জড়িয়ে বসে থাকে, একটা প্রলম্বিত নীরবতা একসময় ভেঙে যায়-

-তোমার কি হয়েছে? কি নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করছ? এমন কি বিষয় যা আমাকে বলতে…

ওর কথা শেষ হবার আগেই আমি ভেঙে পড়ি। এতদিনের দুর্ভাবনার তীব্রতা নিয়ে যে মানসিক উদ্বেগ, টানাপড়েনে আমি নিজের মধ্যে ক্রমশ উন্মাদ হয়ে যাচ্ছিলাম, তা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে উদার এক বালুকাবেলায়। শুভ’র কোল আমার সেই উদার জমিন। আমি পাগলের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠি, শুভ হতভম্ভ হয়ে যায়, কান্নাকাটি করার মেয়ে আমি নই সেটা ও ভালো করে জানে।

আমি ওকে জানিয়ে দেই গর্ভের সন্তান আমি কিছুতেই কাউকে দিতে পারব না। এবারে সে একেবারে বাকরুদ্ধ, স্তব্ধ হয়ে যায়! কিন্তু আমি নিরুপায়।
দীর্ঘদিন দীর্ঘরাত আমাদের মাঝে চলে তর্ক, ন্যায়-অন্যায় আলোচনা, বোঝাপড়া, তবে বেশিরভাগ সময় এসব ভেসে যায় আমার ভেতর থেকে ছিটকে আসা হাহাকার আর আর্তনাদে। শুভ এক একদিন রাগে ফেটে পড়ে, আমাকে নানাভাবে বোঝায়, শেষে এটি সম্ভব নয় বলে ও ওর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়।
দিন যায়, রাত যায়, কোনো সমাধান আসে না। আমি আরো ভেঙে পড়ি। অসুস্থ হয়ে যাই। আমি যে প্রকৃতপক্ষেই সেটা পারব না, একটা সময় গেলে সে উপলব্ধি করতে পারে, তারপর থম ধরে থাকে একটা লম্বা সময়। অতঃপর একসময় ঝড় থেমে যায়, পৃথিবী শান্ত হয়ে আসে।
শুভ, আমার প্রিয় শুভ, আমার সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটায়।

(৩)
ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত এক দুপুরে মিরপুর রোডের অদূরে বাতিল ঘোষিত বাড়িটির কলিংবেল উচ্চকিতভাবে বেজে ওঠে, ভাতঘুমে ঝিমানো মানুষটি পাশের জনকে খুনখুনে কণ্ঠে বলে-

-এ্যাই দেখ তো এই ভরদুপুরে কে এলো?

বুড়ো মানুষটি হেলেদুলে দরজা খুলতে চলে যায়, অপরজন কান খাঁড়া করলে, ভেসে আসে শব্দেরা…

-হ্যাঁ, হ্যাঁ ছাদে ভাড়া থাকত। না না আমাদের আত্মীয় নয়… কি জানি, কোথায় যেন চলে গেছে, না, না, আমরা জানি না, কিচ্ছু জানি না। আমরাও এখান থেকে চলে যাচ্ছি হ্যাঁ হ্যাঁ… এ বাড়ি… ভাঙা হচ্ছে…

+ posts

Read Previous

আংটি

Read Next

আনতারা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *