
মার্বেল ও এক কিশোরীর গল্প
একই পাড়ায় ছোটোবেলা থেকে একই সাথে খেলাধুলা করে বড়ো হয়েছে একদল কিশোর কিশোরী। মার্বেল, সাতচারা, লাট্টু, ডাংগুলি এমনকি ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেয়া একই সাথে । পাড়ায় এলো নতুন এক পরিবার। সেই পরিবারের এক কিশোর এসে ওদের সাথে খেলাধুলায় যোগ দিলো।
একদিন বিকেল।
ছেলেরা মার্বেল খেলছে ।এক কিশোরী এসে- ‘’আমিও তোদের সাথে খেলবো’’। “যা, ভাগ ! মেয়েরা আবার মার্বেল খেলে নাকি” বলে উঠলো নতুন আসা কিশোর। হতভম্ব কিশোরীটি। এটা কী বলছে নতুন আসা কিশোরটি! এতোদিন তো কেউ বলেনি, “এটা ছেলেদের খেলা, ওটা মেয়েদের খেলা”! জিদ চেপে গেলো মেয়েটির। কতো তাড়াহুড়ো করে স্কুলের পড়া, বাড়ির কাজ শেষ করে সে খেলতে এসেছে। প্রথমে তো প্রায় কান্নাই চলে আসলো।
তারপর। খেলা চলছে। হঠাৎ করে কিশোরদের খেলার মাঝখানে কিশোরীটি কয়েকটা মার্বেল নিয়ে দৌড়। যেতে যেতে বলছে, “দেখি, কেমন করে খেলিস তোরা! আমাকে খেলায় না নিলে আর কোনোদিন তোরা মার্বেল খেলতে পারবি না এই বলে দিলাম”! নতুন আসা কিশোরটি অবাক। বুঝতে পারেনি মেয়েদের খেলা বললে মেয়েটি এতো ক্ষেপে যাবে। বাসায় তো সারাক্ষণ শুনে আসছে বোনকে মা বলছেন, “তুই মেয়ে। ছেলেদের সাথে মিশবি না। যেসব খেলা ছেলেরা খেলে ওগুলো খেলবি না। ফুটবল, ক্রিকেট, মার্বেল, ঘুড়ি ওড়ানো ওগুলো ছেলেরা খেলে’’। মেয়েটার কথা শুনে নিজের বোনের জন্য বড্ড মায়া হলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো, সে মাঠে খেলতে আসার সময় ছোটো বোনটা কিভাবে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে।
পরদিন। নতুন আসা কিশোর, তার বোন, মার্বেল নিয়ে পালিয়ে যাওয়া মেয়েটি, পাড়ার কিশোররা সবাই একসাথে মার্বেল খেলছে।
এটা ষাটের দশকের এক কিশোরীর আত্মসম্মানবোধ আর প্রতিবাদের গল্প।
নিঃসঙ্গতা আর কয়েকটা চড়ুই পাখির গল্প
মফঃস্বল শহর। একতলা বাড়িতে অনেক লোকের বসবাস। আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা। সারাদিন হৈচৈ চলছে। বড়োদের কথাবার্তা, কাজকর্ম, ছোটদের খেলাধুলা। গমগম করছে বাড়িটা। সাথে আছে ঘুলঘুলিতে বসবাসরত কয়েকটা চড়ুই পাখির কিচিরমিচির। ওরাও যেনো এ বাড়ির সদস্য।
আস্তে আস্তে বাড়িটা খালি হতে শুরু হলো। বড়ো, ছোটো অনেকেই পরপারে চলে গেলেন । ছোটোরা বড়ো হলো। পড়াশুনার জন্য ছেলেরা শহরে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলো। ছেলেরা পড়াশুনা শেষ করে কেউ শহরে চাকরি নিয়ে থেকে গেলো। কেউ ফিরে আসলো। বিয়ে করলো। সবার আলাদা আলাদা সংসার। সেই বাড়িতে এখন একা থাকেন বাড়ির মেজো বউ বিধবা রাহেলা বেগম। স্বামী গত হয়েছেন পাঁচ বছর হয়। সকালবেলাটা এটা ওটা কাজ করে পার হয়ে যায়। দুপুরে যখন ভাত খেয়ে ঘুমাতে আসেন তখন নিঃসঙ্গতা এসে ভর করে। কেমন যেনো শূন্য লাগে বুকের ভিতরটা। ঠিক তখনই ঘুলঘুলির চড়ুই পাখিগুলো ফিরে আসে। কিচিরমিচির করতে থাকে। এই চড়ুইগুলোর অপেক্ষায় থাকেন আজকাল দুপুরে।
তারপর! যে চড়ুইগুলোর কিচিরমিচির শুনলে তিনি একসময় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতো বলে বিরক্ত হতেন, সেই কিচিরমিচির শুনতে শুনতে তিনি গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যান ।