অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বপন বিশ্বাস -
গোরকুই

গোরকুই নামটা দেখার পর থেকেই কেমন যেন উতলা হয়ে ওঠে রমেশের মনটা। এই নাম সে আগেও কোথায় যেনো শুনেছে বলে মনে হয়। ঠিক মনে করতে পারে না। বয়স বাড়ছে। এখন অনেক কিছুই মনে করতে পারে না। গল্প করতে গিয়ে মানুষের নাম ভুলে যাওয়া তো সাধারণ সমস্যা। তাছাড়া, ওই অঞ্চলে সে এর আগে কখনও যায়নি। ওদিকের কোনো আত্মীয়-বন্ধুর কথাও মনে পড়ছে না। এক সময় খুব বই পড়ার সখ ছিল। সেখানেও এমন কোনো জায়গার নাম পড়েছে বলে মনে পড়ে না। ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলার’ সেই স্বর্গছেঁড়া চা বাগানের কথা মনে পড়ে। ‘পথের পাঁচালী’র নিশ্চিন্তপুরের কথা মনে পড়ে। গোরকুই নামে কোনো গ্রামের কথা কোনো বইয়ে পড়েছে বলেও মনে পড়ে না। তবে কি খবরের কাগজে কোনো খবর হয়েছিল?

পাশের টেবিলে কাজ করে বসির সাহেব ও হারুন সাহেব। কথাটা পাড়তে বসির সাহেব বললেন, আরে দাদা, এমন নাম তো কতই আছে। ওই গ্রামে হয়তো বড়ো কোনো গোরস্থান আছে। তাই নাম দিয়েছে গোরকুই। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এক বান্ধবী ছিল, তার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করলে বলতো ঠাকুরগাঁ আর পঞ্চগড়ের মাঝখানে। কিন্তু উপজেলার নাম বলতো না।

-কী ছিল জায়গাটার নাম? হারুন সাহেব প্রশ্ন করে বসল।

বসির সাহেব মুখ নিচু করে উত্তরটা দিতে যাচ্ছিল। সামনের টেবিলের আনিসা ম্যাডামের চোখে চোখ পড়তেই থেমে গেল। রমেশ বলল,

-আমি ঠিক ওরকম কিছু বলছি না। তবে আমি এই নামটা কোথায় যেন শুনেছি। মনে করতে পারছি না। খুব অস্বস্থি হচ্ছে।

-আপনি খামাখা চিন্তা করছেন। বাসে সরাসরি ঠাকুরগাঁ যাবেন। অফিসের গেস্ট হাউসে থাকবেন। তদন্ত কাজে লোকাল প্রশাসন সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করবে। অনেকদিন পরে একটা ট্যুর পেয়েছেন। কিছু টাকা ধরে নিয়ে আসেন।

কথাগুলো কে বলল, কী বলল, কিছুই রমেশের কানে গেল না। ফাইলের কাগজটাই আবার একবার চোখ বুলালো। ঠাকুরগাঁ জেলার রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ। সেখান থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমের একটি গ্রাম। নাম গোরকুই। রমেশ প্রেসারের রোগী। নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। অস্বস্থি বাড়লে প্রেসার বাড়ে। তখন রাতে ঘুম আসে না । তার জন্য হালকা মাত্রার ঘুমের ওষুধ খেতে হয়। আজ শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে বলে অফিস থেকে আগাম ছুটি নিয়ে নিল। পায়ে হাঁটা দূরত্বে বাসা। তবু মাঝ রাস্তায় বটতলার মোড়ে একটু দম নেয়। চায়ের সাথে একটা সিগারেটে টান দেয়। ডাক্তারের বারণ। বাড়ি ফেরার পর গন্ধ পেয়ে বউয়ের ঘ্যানঘ্যান। তবু অভ্যাসটা ছাড়তে পারে না।

টেনশন বাড়লে টানের আগ্রহটা বাড়ে। চায়ের সাথে সিগারেটে টান দিলে যে টেনশন কমে, তাও ঠিক না। আজ যেমন সিগারেটে টান দিতেই গোরকুইয়ের কথা আবার মনে পড়লো। একটা ফালতু চিন্তা তাকে মাথার ভেতরে মশার মতো পুঁ পুঁ শব্দ করে অস্থির করে তুলছে। যেন মারতে গেলেই হারিয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার কানের পাশ দিয়ে পুঁ করে চক্কর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। এমন বিরক্তি নিয়ে বাসায় ফিরতেই বউ বললো, কি গো, আজ এতো তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলে? অসুখ টসুখ করেনি তো। রমেশের কোনো উত্তর না পেয়ে দুবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো। কি বুঝল কে জানে। বলল,

-যাই হোক বাপু, তোমার ট্যুরে যাওয়ার আগে বাজারটা করে দিয়ে যেও। রমেশ কথাটা কানে তুলল না।  রাতে তার দুটো রুটি বরাদ্দ। আজ একটা রুটি খেয়েই শুয়ে পড়লো। বউ বলল,

-কি গো শরীর খারাপ কিনা জিজ্ঞেস করলাম তাও কোন উত্তর দিলে না। এখন এক রুটি খেয়ে উঠে পড়লে। বাইরে থেকে কিছু খেয়ে এসেছো নাকি? রমেশের কোনো উত্তর দিতে ইচ্ছা করলো না।

মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই আবার সেই মশাটা কানের পাশ দিয়ে পুঁ করে চলে গেল। অমনি মনে পড়ল ভাদুর মা’র ধলা গরুটার কথা। মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া গরুটা সেবার বিয়াল। একটা এঁড়ে বাছুর। সাদাকালো বাদামি মিলিয়ে আর্মিদের পোষাকের মতো অদ্ভুত রং। ভাদুর মা আর্মি বলতে পারে না। সে বলে, ভরাপরাদের মুখে ছাই দিয়ে আমার আমরি বেঁচে থাকুক। ওকে হালের বলদ বানাবো। ভাদুর মায়ের হালের বলদ দুটো মরেছে বছর দুয়েক আগে। ইলেকশনের পরে পাড়ায় আগুন দিলো। রাতের বেলা। যে যার মতো পালিয়ে বাঁচলো।

ঘরবাড়ি পুড়ে সব ছাই হয়ে গেল। ভাদুর মা’র গোয়ালঘর থেকে ধলা গরুটাও পালিয়ে বেঁচেছে। হালের বলদ দুটো শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। পুড়ে মরেছে। কিছুদিন পরে সরকারি সাহায্য এলো। ঘর বানানোর জন্য টিন দেয়া হলো। মন্দির মেরামতের জন্য টাকা দেয়া হলো। ভাদুর মা গরু দুটোর জন্য কান্নাকাটি করলো। কিন্তু কোনো ফল হলো না। যারা সাহায্য দিতে এসেছিল তারা বললো, গরুর জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। মানুষ মরলে জন প্রতি দশ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। ভাদুর মা কেঁদে কেঁদে বললো, হালের বলদ দুটো না মরে আমি কেনো মরলাম না। কে যেনো একজন মন্তব্য করলো, দশ হাজার টাকার জন্য আপনি কেনো মরবেন। ভাদুর মা মুখ ঝামটি দিয়ে বললো, তোদের সাহায্যের নিকুচি করেচি। টাকার জন্যি কেন মরতি যাবো। হালের বলদ দুটো বেঁচি থাকলি তো ভাদুর চাষবাসের কাজে আসতো। আমি বেঁচি থেকি লাভটা কী?

ধলা গাই বিয়ানোর পর ভাদুর মা নতুন গোয়াল ঘরে গোরক্ষনাথের পূজো দিলো। যদিও গোরক্ষনাথ কেউ বলে না। সবাই বলে গোক্ষনাথ। গোয়ালের দরজায় সিঁদুরের দাগ কাটা হলো। গোক্ষনাথের কাঠের মূর্তিতে তেল-সিঁদুর ঢাললো। সুর করে পাঁচালি পড়া হলো। পাড়ার রাখালরা সব হেচ্চ হেচ্চ করে তার সাথে দোহার দিলো। ধলা গাইয়ের দুধ জ্বাল দিয়ে পায়েসের শিরনি রান্না হলো। পাড়ার ছেলেরা কলাপাতায় সে শিরনি খেয়ে এঁটো হাতে ধলা গাইয়ের পিঠে চাপড় দিলো। ভাদুর মা বললো, দেখিস কাল থেকে ধলি আমার ক’সের করে দুধ দেয়।

পরদিন দুধের খবর নিতে গিয়ে দেখা গেলো একজন গোয়ালের দরজায় বসে গান গাচ্ছে। রমেশ এই গান এর আগেও শুনেছে। গোক্ষনাথের গান। যে গান গায় তাকেও সবাই গোক্ষনাথ বলে ডাকে। ওদের আসল নাম কেউ জানার প্রয়োজন মনে করে না। ওরা প্রতি বছরই আসে। ধানের বতরের সময়। ওদের গানের সুরটা খুব মজার। গোয়াল ঘরের নানা নিয়ম-কানুনের কথা বলে আর এক হাতে ছোট্ট একজোড়া করতালে তাল দেয়। এতোদিন পরেও রমেশ সেই গানের কথাগুলো বেশ মনে করতে পারে-

সকাল উঠিয়া যেবা গোবর ফেলায়

গোক্ষনাথ ওই গোয়ালে বার মাস রয়।

গোবর ফেলিয়া যেবা বেড়ায় মোছে হাত

ছয় মাসের গর্ভ গাভীর হয়ে যায় পাত।

বৃহস্পতিবারে যেবা হলুদ বিলায়

তার ঘরের লক্ষ্মী ছেড়ে অন্য বাড়ি যায়।

গোয়াল ঘরে গিয়া যেবা ঝেড়ে বান্দে চুল,

তার ঘরের গরু-বাছুর করে ঢুলা ঢুল।

গোবর কাঁড়িতে যেবা করে ঘিনা ঘিন

তার গোয়ালের গরু বাছুর বাঁচে অল্পদিন।

সেদিন পাড়ার ছেলেরা সবাই গোল হয়ে গান শুনছিল। গান শেষ হলে ভাদুর মা গোক্ষনাথের মূর্তিতে সিঁদুর আর তেল ঢালছিল। সবাই হুমড়ি খেয়ে দেখছে সেই তেল ঢালা। এমন সময় কে যেনো পেছন থেকে ধাক্কা দিলো। রমেশ হুমড়ি খেয়ে পড়ল গোক্ষনাথের কৌটার ওপর। কৌট উলটে গোক্ষনাথের মূর্তি ছিটকে পড়লো দূরে। তেল-সিঁদুর মাটিতে পড়লো গড়িয়ে। তার ওপরে রমেশের মুখ। রমেশের মা কোথায় যেন আড়ালে দাঁড়িয়ে গান শুনছিল। ছুটে এসে ছেলেকে তুলতেই দেখে মুখে তেল-সিঁদুর লেগে রমেশকে আর চেনা যাচ্ছে না। ভাদুর মায়ের গলা পাওয়া গেল, কী দস্যি ছেলে রে বাবা! ঠাকুর-দেবতা কিছু মানে না। দিলিতো ঠাকুরের ঘটি উলটে।

একদিকে অমঙ্গলের আশংকা অন্যদিকে ভাদুর মা’র মুখ ঝামটি। সব মিলে মায়ের রাগ এসে পড়ল রমেশের পিঠে। গোক্ষনাথ লোকটা ছিটকে পড়া জিনিসগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে বললো, ছোটোদের ওভাবে মারতে নেই দিদি। ছোটোরা হলো দেবতার মতো। ওদের কষ্টে দেবতা রুষ্ট হন। ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু হলো না। গামাল শেষ করে সন্ধ্যায় সেই গোক্ষনাথ লোকটা ফিরে এলো রমেশকে দেখতে। তখন রমেশ বিছানায় শুয়ে। গায়ে কিছুটা জ্বর।

 গোক্ষনাথের মনের গহীনে কোথায় যেন একটা বেদনা অনুভব হলো। বললো, আমারই ভুল। বড়োদের একটু অসতর্কতার জন্য ছোটোদের কষ্ট পেতে হয়। লোকটা রমেশের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, আমারও একটা মেয়ে আছে ওর কাছাকাছি বয়স হবে। যখন গামালে বের হই তখন মেয়েকে মন্দিরের সেবায়েতের কাছে রেখে আসি। দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই। সারাদিন হাঁটতে হয়। ওইটুকু মেয়ে নিয়ে তো আর চলা যায় না। কোথায় খাওয়া, কোথায় থাকা, তার তো কোনো ঠিক নেই। রমেশের মা বলল,

-এই এলাকায় আসলে আমাদের বাড়িতে উঠতে পারেন। শাকান্ন, নুন, ভাত যা জোটে তা-ই চাট্টি মুখে দেবেন। এই এলাকায় নাথ বলতে তো আমরাই কয়েক ঘর আছি। আর সবাই তো ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। গোক্ষনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

-সে সব কথা কি আর বলার রে দিদি। যার যেমন ভবিতব্য। কালে কালে আরও কতো কিছুই যে দেখতে হবে।

তার পরের বছরও গোক্ষনাথের দেখা পাওয়া গেলো। রমেশ দুদিন তার সাথে সাথে এপাড়া ওপাড়া ঘুরলো। রাতে বসে অনেক রকম গল্প হলো। একটা গল্প তাকে অনেকদিন ধরে ভাবিয়েছে। পুরাতন ইতিহাসের গল্পগুলো কেমন যেন রূপকথার গল্প বলে মনে হয়। তখন রমেশের বয়সটাও তো রূপকথা শোনার বয়স। রমেশের মা গোক্ষনাথকে জিজ্ঞেস করেছিল, দাদার দেশের বাড়ি যেনো কোথায়?

উত্তর অঞ্চলে। আমাদের বাড়ি থেকে হিমালয় পর্বত দেখা যায়। রমেশের মা হিমালয়ের নাম শুনে জোড় হাতে উপরের দিকে মুখ করে একটা প্রণাম করলো। বললো, সেখানে কতো মুনি-ঋষিরা গুহায় বসবাস করে। তপস্যা করে সিদ্ধি লাভ করে। ওখানকার ওই কৈলাশ পর্বতেই তো মহাদেবের বাস। তার জটা থেকে জলের ধারা নেমে আসছে। তার থেকেই তো গঙ্গা। আপনি দাদা পুন্যবান মানুষ। রমেশের মা এবার গড় হয়ে গোক্ষনাথকে প্রণাম করলো। প্রণাম পেয়ে বেচারা বেশ গদগদ হয়ে উঠলো। বললো, বসেন দিদি আপনার সাথে দুটো কথা কই। সবাই তো এসব জিনিস বোঝেও না, মান্যিও করে না। আমাদের নাথ সম্প্রদায়ের গুরু গোরক্ষনাথ। তিনি একবার পাঞ্জাব-বিহার পার হয়ে হিমালয়ের দিকে রওনা দিলেন। তখনকার দিনে সৈন্যাসীরাতো পায়ে হেঁটেই দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতেন। মঠ-মন্দির তৈরি করতেন। সেখানে বসে সাধনা করতেন। সেবার তার চলার পথে নোনা নদী বাধা হয়ে দাঁড়ালো। তখন সে নদীতে প্রবল স্রোত। তবে সে স্রোত তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। তিনি খড়ম পায়ে নদীর ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। অন্যদিকে কাইচা নদীর তীরে আস্তানা করেছেন পীর শাহ নেকমরদ। অলৌকিক ক্ষমতা বলে তিনি দেখতে পেলেন গোরক্ষনাথের কেরামতি। তিনি মনে মনে হাসলেন।

গোরক্ষনাথকে একটু পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন। যেই কথা সেই কাজ। নেকমরদ আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা ইশারা দিতেই গোরক্ষনাথ নদীতে তলিয়ে যেতে থাকলেন। তাঁর পরনের কাপড় ভিজে গেলো। তিনি ধ্যানযোগে জানতে পারলেন, এসব নেকমরদের কেরামতি। তিনি আর সামনে এগোলেন না। নদীর বুকে একটা বালুচর সৃষ্টি করে ফেললেন। সেই চরের বুকে তিনি তপস্যায় মগ্ন হলেন। সেই পুন্যভূমিকে কেন্দ্র করে বালুচরে গড়ে উঠলো এক নাথ আশ্রম। নোনা নদীর চরে খনন করা হয় সুমিষ্ট পানীয় জলের কূপ। সেই গোরক্ষনাথের কূপ থেকেই আমাদের গ্রামের নাম গোরকুই।

-ভারি সুন্দর নামতো! এখনও আছে সেসব মঠ, মন্দির, কূপ? রমেশের মা উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করলো।

-আছে বৈকি! অবশ্যই আছে। অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। তবু মন্দিরটা টিকে আছে। বছরান্তে মেলা বসে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে। ওই কূপের জলে স্নান করে পাপমুক্ত হয়। যদিও কূপে এখন আর পাপ ধোয়ার মতো জল পাওয়া যায় না। মন্দিরে একজন সেবায়েত আছে। তার কাছেই আমার মেয়েকে রেখে আসি। একবার মা লক্ষীকে সাথে করে নিয়ে আসবেন। আমার কাছে কয়েকদিন থেকে যাবে।

রমেশের মা’র কথা শুনে গোক্ষনাথ কিছু সময় মাথা নিচু করে বসে রইলো। কী যেন ভাবলো। তারপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো,

-আমি তো আমার লক্ষ্মিকে একেবারেই আপনার হাতে তুলে দিতে চাই। আমার মা-মরা মেয়েটা যদি আপনার মতো একজন মা পায় তবে আমি মরেও শান্তি পাব।

রমেশের মা কোনো কিছু না ভেবেই বলে দিলো,

-সে তো হতেই পারে। স্বজাতির ভেতরে আত্মীয়তা। তা নিয়ে আর এত ভাবা ভাবির কী আছে। আপনারা পুন্যবান মানুষ। আপনার ঘরের মা লক্ষ্মি আমার ঘর আলো করবে সেতো আমার সৌভাগ্য। তবে কী, রমুতো আমার এখনও অনেক ছোটো। দুয়েকটা পাশ দিক। তারপরে দেখা যাবে। আপনি ওকে আশির্বাদ করেন।

রমেশ কে ইঙ্গিত করলো গোক্ষনাথকে প্রণাম করার জন্য। বললো,

-উনি তোমার গুরুজন। প্রণাম করে আশির্বাদ নাও।

রমেশের কানে ঢুকলো না মায়ের কথা। তার মাথায় তখন নদীর স্রোতের মতো অনেকগুলো উদ্ভট প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিভাবে নদীর ওপর দিয়ে খরম পায়ে দিয়ে পার হয়? কীভাবেই বা সে জানতে পারে দূরে বসে করা নেকমরদের কেরামতি? কীভাবেই-বা মুহুর্তের ভেতরে একজন নদীর মাঝে চর তৈরি করতে পারে? একজন দূরে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো আর অমনি সেই সাধুবাবা ডুবে যেতে থাকলো। ভাবতে ভাবতে রমেশ নিজেই একটা খরম পায় নদীর ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু করলো। প্রবল স্রোত। রমেশ পরম নির্ভরতায় হেঁটে চলেছে নদীর ওপর দিয়ে। তার পরনে একটা গামছা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। এক হাতে কুমন্ডল আর অন্য হাতে একটা ত্রিশুল। হঠাৎ একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো তার গায়ের ওপর। পরনের গামছাটা ভিজে গেলো। সে জলের ভেতর তলিয়ে যাচ্ছে। ত্রিশুলটা জলের ভেতরে শক্ত করে ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু নদীর তল খুঁজে পাচ্ছে না। ঢেউয়ের তোড়ে হাত থেকে কুমন্ডল ভেসে চলে যাচ্ছে। এমন সময় আবার একটা ধাক্কা। ঢেউ না। মা ডাকছে। বলছে প্রণাম কর। উনি তোর গুরুজন।

রমেশের ঘুম ভেঙে গেলো। মা নেই। কেউ নেই। সে সব কতোকাল আগের কথা। এখন কে কার খবর রাখে।

দুই.

সকাল থেকেই ঘন কুয়াশা। তার সাথে উত্তরাঞ্চলের হাড় কাঁপানো শীত। সকালে যখন গোরকুইয়ের দিকে রওনা হলো তখন গাড়ি থেকে দূরে কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশার চাদরে মোড়া রাস্তার পাশের ছোটো ছোটো বাড়িগুলো দেখে মনে হয় এ এক অন্য বাংলাদেশ। এখনও উন্নয়নের তেমন কোনো ছোঁয়া লাগেনি। রমেশ জেলা অফিসের তদন্ত কর্মকর্তা সালাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো,

-এখান থেকে কি সত্যি হিমালয় পর্বত দেখা যায়? সালাম সাহেব বলল,

-আকাশ পরিষ্কার থাকলে আবছায়া দেখা যায়। তবে পরিষ্কারভাবে দেখতে হলে বাঙলাবান্ধা যেতে হবে। আমাদের ওদিক থেকে তো খুব কাছে।

-আপনার বাড়ি বুঝি বাঙলাবান্ধা সীমান্তের কাছে?

-কাছে মানে খুব কাছে। আমার বাড়ি পাগলাডাঙ্গী। তারপরেই বাঙলাবান্ধা সীমান্ত। আপনি ওখান থেকে শিলিগুড়ি শহরের আলো। রাস্তায় বাস চলছে। সব দেখতে পাবেন। শিলিগুড়ি থেকে বাগডোগরা হয়ে বাস চলে যাচ্ছে সেই বিখ্যাত নকশাল বাড়ি। দুটো দিন সময় দিলে আমি আপনাকে সব জায়গা ঘুরিয়ে আনতে পারবো। বর্ডারে আমার জানাশোনা লোক আছে। কোনো অসুবিধা হবে না।

সালাম সাহেবের কথা শুনতে শুনতে রমেশদের গাড়ি নেকমরদ পার হয়ে গেল। ইউনিয়ন পর্যায়ের ছোটো একটি বাজার। নেকমরদ ছাড়িয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি পৌঁছে গেলো গোরকুই। অশ্বিনী মাস্টারের বাড়িটা বড়ো রাস্তা থেকে কিছুটা ভেতরে যেতে হবে। পায়ে হাঁটা রাস্তা। সালাম সাহেব গাড়ি থেকে নেমে গেলো অশ্বিনী মাস্টারকে ডাকতে। তিনিই মূল অভিযোগকারী। রমেশ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দেখলো তাদের গাড়ি থেমেছে একটা পুরাতন মন্দিরের আঙিনায়। ড্রাইভার বললো,

-এটাই স্যার গোরক্ষনাথের মন্দির। কুয়াশার ভেতর দিয়ে গোটা পাঁচেক মন্দিরের কাঠামো বোঝা গেলো। আরও দুয়েকটা ছোটো কাঠামো দেখা গেলো কিন্তু ঠিক ঠাওর করা গেল না সেগুলো কী।

ড্রাইভার লোকটার বেশ নাদুস-নদুস চেহারা। নাম শাহজাহান। দেখলেই বোঝা যায় সরকারি অফিসের ড্রাইভার। বেশ তেলে ঝোলে আছে। মাথায় চুলের একটু ঘাটতি । যে কারণে সবসময় টুপি পরে থাকে। তাতে শীত থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। আবার মাথাও ঢাকা থাকে। গরমকালে কী করে কে জানে? রমেশ ভাবলো, গাড়িতে থাকলে জিজ্ঞেস করা যেতো। কিন্তু সালাম সাহেব নামার পরপরই সে “আমি একটু আসি স্যার” বলে কুয়াশার ভেতরে হারিয়ে গেলো। না থেকে হয়তো ভালোই হয়েছে। এমন ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা না বলাই ভালো। এই সব ভাবতে ভাবতে রমেশের চোখ গেলো বড়ো মন্দিরটির দিকে।

ঘন কুয়াশার ভেতর থেকে একটা কিশোরী মেয়ে বেরিয়ে এলো। বেশ আনন্দে নাচতে নাচতে গাড়ির দিকে এগিয়ে এলো। কাছে আসতে বোঝা গেলো চৌদ্দ-পনের বছরের একটা মেয়ে। পায়ে আলতা, প্যাঁচ দিয়ে একটা লাল শাড়ি পড়া। মাথার দুপাশে দুটো বিনুনি, লাল ফিতে দিয়ে ফুল করে বাঁধা। তার একহাতে টক জাতীয় কোনো ফল। আরেক হাতের তালুতে লবণ। সেই ফল লবণে ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে খাচ্ছে। আর সেই টক খাওয়ার আনন্দ যেনো তার চোখ-মুখ থেকে শুরু করে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আনন্দে নাচতে নাচতে মেয়েটা গাড়ির জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। রমেশ গাড়ির গ্লাসটা নামিয়ে দেখলো কালোর ওপর খুব মিষ্টি চেহারা। হাসলে চোখ দুটো আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। জানালার কাছে মুখ এনে হাসতে হাসতে বললো,

-তুমরা কি বরই খাবেন? খু-উ-ব মিষ্টি।” কথাটা বলেই সে চোখে মুখে এমন একটা চমক ফুটিয়ে তুলল যে, টক খাওয়ার জন্য রমেশের মুখে জল চলে এলো। তবু হাসি মুখে বললো,

-তুমি খাও। আমি খাবো না। মেয়েটা খুশি হলো নাকি দুঃখ পেলো কিছুই বোঝা গেলো না। কাছেই একটা গাছের গোড়া বাঁধানো উঁচু জায়গায় বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে আনমনে বরই খেতে থাকলো। এমন একটা দূরত্বে বসেছে যেখানে কথা বলে ঠিক ভাব জমানো যায় না। বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করার পর চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটা রমেশকে একটা মুখ ভেঙচি দিলো। ভাবটা এমন যে, তুমি বরই না খাওয়াতে আমার বয়েই গেলো। রমেশ হেসে জিজ্ঞাসা করলো, তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়? মেয়েটা এমন অবাক চোখে রমেশের দিকে তাকালো যেন তাকে না চেনাটা খুবই অন্যায়। তারপর একটা মুখ ভেঙচি দিয়ে বললো,

-তুমরা কি মোর নাম জানেন না। মোর নাম লক্ষ্মি। মুই এইঠে থাকোঁ। কথাটা বলেই সে দৌড়ে বড়ো মন্দিরটির ভেতরে চলে গেল।

এতক্ষণে কুয়াশা কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে। ড্রাইভার এসে দরজা খুলে গাড়িতে বসলো। সিগারেটের গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা লাগলো। বউয়ের মুখটা ভেসে উঠলো রমেশের মনে। অফিস থেকে ফেরার পর রমেশের গা থেকেও কি এমন উৎকট গন্ধ বের হয়! হয়তো বিরক্ত হয়। তবে সে বকাঝকা করে সিগারেট খাওয়ার অমঙ্গল চিন্তা করেই। দূরে বসে বউয়ের জন্য কেমন যেনো একটা মায়া হলো। রমেশ ভাবে একেই কি বিরহ বলে! এমন সময় সালাম সাহেব কয়েক জনকে সাথে নিয়ে ফিরে এলো। তাদের মধ্যমনিটি যে অশ্বিনী মাস্টার তা বুঝতে রমেশের অসুবিধা হলো না। পোশাকে চেহারায় উচ্চতায় সবদিক থেকেই সে অন্যদের থেকে আলাদা।

সালাম সাহেব সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দেয়ালঘেরা মন্দিরের ভেতরের দিকে একটি বসার ব্যবস্থা করা হলো। অশ্বিনী মাস্টারের সাথে আর যারা এসেছে তারা গ্রামের অতি সাধারণ মানুষ। যে ভূমিদস্যু মহলটির বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ তারা অনেক বেশি প্রভাবশালি। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সবাই তাদের হাতের মুঠোয়। যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে সাহস পায় না। তাছাড়া আজ যারা এসেছে তারা ঠিক গুছিয়ে কথা বলার মতো মানুষও না। সবাই অশ্বিনী মাস্টারকে দেখিয়ে দেয়। যদিও সমস্যাটি তাদের। সেখানে অশ্বিনী মাস্টারের নিজের কোন স্বার্থ নেই।

কথা বলে জানা গেলো তিনি পাবনা অঞ্চলের মানুষ। শিক্ষকতা করতে এই অঞ্চলে এসেছিলেন। জমি কিনে ছোটো একটা বাড়ি করেছেন। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর আর পাবনা ফিরে যাওয়া হয়নি। বাবা-মা মারা গেছে। ভাইবোনেরাও সব দেশান্তরি। এখন পরিবার নিয়ে এখানেই থাকেন। গ্রামের ছাত্র পড়িয়ে যা পায় তা দিয়ে সংসার চলে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো তাকে খুব শ্রদ্ধা-ভক্তি করে। মানুষের বিপদে আপদে তিনিও সবার পাশে দাঁড়ান। শহরে একটা ডাক্তার দেখাতে হলেও গ্রামের মানুষগুলো অশ্বিনী মাস্টারকে সাথে নেয়।

সালাম সাহেব বিবাদি পক্ষের কয়েকজনকেও এখানে উপস্থিত থাকার জন্য খবর পাঠিয়েছিলেন। তারা কেউ উপস্থিত হয়নি তবে জানা গেলো তারা সদর অফিসে রমেশের সাথে দেখা করবে। আলোচনা শুরু হতে মন্দির চত্বরে কিছু লোকজনের আনাগোনা শুরু হলো। কেউ দূরে মোটরসাইকেল থামিয়ে সিগারেট টানছে। কেউ মন্দিরের সেবায়েতের খোঁজ করতে আসছে। গ্রামের যে মানুষগুলো অশ্বিনী মাস্টারের সাথে এসেছিল তারা তাদের নানা রকম জরুরি কাজের উসিলায় কেটে পড়লো।

অশ্বিনী মাস্টার কথা বলতে বলতে রমেশকে মন্দির চত্বরটা একবার ঘুরে দেখার অনুরোধ জনালো। বললো,

-এতো দূর থেকে এসেছেন। এই মন্দির এলাকাটা একবার দেখে যান। এটাই বাংলাদেশে সব থেকে প্রাচীন নাথ আশ্রম। ধারণা করা হয়, গোরক্ষনাথ বিহার থেকে হিমালয়ের দিকে যাওয়ার পথে এখানে আস্তানা করেছিলেন। রমেশ বললো,

-শুনেছি তিনি যখন নদীর ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে পার হচ্ছিলেন তখন একজন ফকির বাবা তার আসমানী ক্ষমতাবলে গোরক্ষনাথকে ডুবিয়ে দিচ্ছিলো। অশ্বিনী মাস্টার বললো,

-এমন একটা গল্প বেশ প্রচলিত আছে।

পীর শাহ নেকমরদ এসেছিলেন ধর্ম প্রচার করতে। আর গোরক্ষনাথ তার অলৌকিক ক্ষমতাবলে বিহারে বসে তা জানতে পারে। সেখান থেকে তিনি ছুটে আসছিলেন নেকমরদের ধর্ম প্রচারে বাধা দিতে। তবে আমি বেশ কিছু বইপত্র ঘেঁটে দেখেছি তারা দুজন দুই সময়ের মানুষ। তাদের দুজনের সময়কালের পার্থক্য প্রায় কয়েকশ’ বছর। তাছাড়া সে সময় যে সব সুফি দরবেশরা ধর্ম প্রচার করতে এসেছিল তারা এতোটা হিংসা পরায়ন ছিল না। তাদের মহত্ব, মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়েই তো মানুষ নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছিল।

এইসব আলী-কালীর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে তারও অনেক পরে। আর এই দ্বন্দ্ব থেকেই নতুন নতুন গল্পের জন্ম হয়েছে। আলী-কালীর দ্বন্দ্ব কথাটা রমেশের বেশ পছন্দ হলো। গ্রামের সহজ-সরল মানুষেরা ভাষাতেও কতো সহজ। রমেশের ছোটোবেলায় স্কুলের বন্ধুদের কথা মনে পড়লো। ওরা প্রায়ই রমেশকে ক্ষেপাতো। বলতো, তোদের কালীর জিভ বেরানো কেন জানিস? আমাদের আলী তোদের কালীকে তাড়া করেছিল তাই দৌড়াতে দৌড়াতে জিভ বেরিয়ে গেছে। এই কথা শুনে সবাই হেসে উঠতো। রমেশও হাসতো। বলতো,

-আলী ছিল আরবে আর কালী ছিল স্বর্গে। কীভাবে তাড়া করবে? অন্য একজন হয়তো উত্তর দিতো, মনে হয় আলী মারা যাওয়ার পর বেহেস্তে গিয়ে কালীকে তাড়া করেছিল। রমেশ বলতো, আলী মারা গেলে যাবে বেহেস্তে। কালীতো থাকে স্বর্গে। যুক্তিতে না পেরে রমেশের গায়ে জল ছিটিয়ে দিতো। রমেশ বলতো, গায়ে জল ছিটাবি না বলছি। ভালো হবে না কিন্তু! ওরা বলতো, জল কোথায়, আমরা তো পানি ছিটাচ্ছি। তখন টিফিন শেষের ঘন্টা পড়তো। সবাই ছুটে ক্লাসে ঢুকতো।

অশ্বিনী মাস্টার রমেশের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-স্যার কি কিছু চিন্তা করছেন? রমেশ বললো,

-না। আমি ঠিক আছি। বলছিলাম, এখন আপনাদের এলাকায় আলী-কালীর দ্বন্দ্বটা কেমন?

-ভেদ থাকলে দ্বন্দ্ব তো থাকবেই। তবে মিলেমিশে থাকাটা একটা অভ্যাস। সেই অভ্যাসটা এখনও আছে। ফাল্গুন মাসে এখানে মেলা বসে। সবাই সেখানে আসে। আনন্দ করে। তখন কোনো ভেদাভেদ করতে পারবেন না।

বড়ো মন্দিরটির ভেতরে ঢুকে অশ্বিনী মাস্টার বললেন,

-এই যে দেখুন, আমি এখানে চাকরি নিয়ে আসার পরেও দেখেছি। এখানে একটা ছোট্ট কালী মূর্তি ছিল। সেটা একদিন চুরি হয়ে গেলো। উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু পাওয়া যায়নি।

কালী মন্দিরটির পাশে আরও দুটো ছোটো মন্দির। সেদুটো শিব মন্দির। অন্য দুদিকে আরও দুটো মন্দির আছে। তার একটি শিব মন্দির। অন্যটি নাথ মন্দির। এলাকার মূল আকর্ষণ নাথ মন্দিরের পাশে পাথর দিয়ে বাঁধানো একটা ইন্দারা। গোরক্ষকুপ। অশ্বিনী মাস্টার বললেন,

-এই গোরক্ষকুপ থেকেই এলাকার নাম হয়েছে গোরকুই। কুপটির তলা পর্যন্ত পাথর দিয়ে বাঁধানো। কুপে নামার জন্য পাথর কেটে সিঁড়ি করা আছে।

ছোটোবেলায় রমেশদের বাড়িতেও সান বাঁধানো ইন্দারা ছিল। তখন আশেপাশের এলাকায় কোনো টিউবওয়েল ছিল না। রমেশের এক কাকা অল্প বয়সে টিটেনাস হয়ে মারা যাওয়ার সময় টিউবওয়েলের জল খেতে চেয়েছিল। তবে তা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে রমেশের ঠাকুরমা কখনও টিউবওয়েলের জল খেতো না।

যুদ্ধের পরে দেশে ফিরে ইন্দারাটা ব্যবহার করা গেলো না। রাজাকাররা মানুষ মেরে ইন্দারায় ফেলে দিতো। ইন্দারা পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখা গেলো শুধু হাড়গোড়ের স্তুপ। তখন টানাটানির সংসার। নতুন ইন্দারা বানানোর সামর্থ নেই। পালবাড়ি থেকে কুয়োর পাট কেনা হলো। ইন্দারা বাদ দিয়ে কম খরচে কুয়ো কাটা হলো। তারও বেশ পরে বাড়িতে টিউবওয়েল বসলো। তবে ঠাকুরমা যতদিন জীবিত ছিল কুয়োটিও চালু রাখতে হয়েছিল তার জন্য।

মন্দির থেকে বেরনোর সময় রমেশের ছোটোবেলায় দেখা সেই গোক্ষনাথের কথাটা অশ্বিনী মাস্টারকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল। হয়তো এই মন্দিরের আশেপাশেই কোথাও বাড়ি ছিল। এতোদিন আগের ঘটনা যে, তার বেঁচে থাকার কথা না। কিন্তু তার সেই মেয়েটি! সে এখন কোথায়? হয়তো দূরগাঁয়ে কোথাও বিয়ে হয়েছিল। নাতি-নাতনি নিয়ে ঘর-সংসার করছে। অথবা বিধবা হয়ে ফিরে এসে এ গাঁয়েই কোথাও বাস করে। নাম জানলে জিজ্ঞেস করা যেতো। বাবা-মেয়ে কারো নাম জানা নেই। কিছু জিনিস হয়তো না জানাও ভালো। তবু গাড়িতে ওঠার সময় ঘুরে দাঁড়িয়ে অশ্বিনী মাস্টারকে সকালে দেখা সেই মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করলো। বললো, সালাম সাহেব যখন আপনাদের ডাকতে যায় তখন গাড়িতে আমি একা বসা ছিলাম। তখন এখানে লাল শাড়ি পরা একটা মেয়েকে দেখেছিলাম। চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়স হবে। এখানে বসে বসে বরই খাচ্ছিল। আমাকেও বরই খাওয়ার জন্য সেধেছিল। নাম কি, বাড়ি কোথায়? জিজ্ঞেস করতেই দৌড়ে মন্দিরের ভেতরে চলে গেল। অশ্বিনী মাস্টার বললো,

-হবে হয়তো এলাকার কোনো চেংরি-পেংরি। মন্দিরের গাছের ফল-ফলাদি তো সব গাঁয়ের চেংরা-পেংরারাই খায়।

না, তার কথা শুনে মনে হলো সে এই মন্দিরেই থাকে। আর তাকে সবাই চেনে। খুব চঞ্চল। নাম লক্ষ্মি। মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কাছাকাছি থাকলে একবারটি ডেকে দিন। কথা বলে যাই। তখন আমি বরই না খাওয়াতে হয়তো খুব মন খারাপ করেছে।

অশ্বিনী মাস্টার অবাক হয়ে তার পাশে দাঁড়ানো সেবায়েতের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর মাথা নিচু করে কি যেন ভাবলেন। রমেশ বলল,

-কী কোনো সমস্যা! তারপর সেবায়েতের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

-ঠিক আছে ডাকা লাগবে না। তবে ওর সাথে দেখা হলে বলবেন, আমার জন্য যেন বরই রেখে দেয়। পরের বার আসলে অবশ্যই খাবো আর নিয়েও যাবো।

সেবেয়েত কোনো উত্তর দিলো না। তবে অশ্বিনী মাস্টার উত্তর দিলো। বললো,

-কথাটা আমি বিশ্বাস করি না। তবু গল্পটা আমি আপনাকে বলি। মন্দিরের ওই পাশে যে উঁচু ভিটাটা দেখছেন। ওটা অনাদি নাথের ভিটা। সে অনেকদিন আগের কথা। অনাদি দেশে দেশে গান করে বেড়াতো। গোরক্ষনাথের গান। আমাদের ওদিকে বলে গোক্ষনাথের গান। তার মা-মরা মেয়েটাকে রেখে যেতো এই মন্দিরের সেবায়ের কাছে। মেয়েটা একবার মন্দিরের ভেতরে গাছের সাথে গলায় দড়ি নিয়ে মারা যায়। তারপর থেকে সেই সেবায়েতও উধাও। অনাদি নাথ বাড়ি ফিরে মেয়ের আত্মহত্যার খবর শুনে সেই যে গেলো আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। মেয়েটার নাম ছিল লক্ষ্মি। অনেকে নাকি এখনও মন্দিরের আশেপাশে লক্ষ্মিকে ঘোরাফেরা করতে দেখে। সেই থেকে এ গাঁয়ে আর কেউ মেয়ের নাম লক্ষ্মি রাখে না। তবে হতে পারে কোনো দুষ্টু চেংরি হয়তো আপনাকে ভয় দেখিয়েছে।

রমেশ গাড়ীতে উঠে বসলো। বললো,

-সবাই ভালো থাকবেন আর সাবধানে থাকবেন। দরকার হলে আমরা আবার যোগাযোগ করবো।

গাড়ি ছুটে চলেছে ঠাকুরগাঁ ছাড়িয়ে পঞ্চগড়ের দিকে। সূর্য মাথার ওপর থেকে হেলে পড়েছে। আকাশ পরিষ্কার। বেশ ঝলমলে রোদ। সালাম সাহেব বললেন,

-ওই যে দেখেন স্যার, হিমালয় দেখা যাচ্ছে। রমেশ ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলো। মেঘ নাকি সত্যি হিমালয় পর্বত। আকাশের অনেকটা জুড়ে দিগন্ত বিস্তৃত মেঘের ছায়া। তার ওপরে ভাদুর মা ধলা গাইয়ের দুধ দোয়াচ্ছে। পাশেই যেন সেই আর্মি পোশাক পরা বাছুরটি বাঁধা। গোক্ষনাথের গানের সুরটি দূর থেকে ভেসে আসছে। সেই মেঘ রঙের পাহাড়ের চূড়ায় মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো। রমেশের আজ মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।

 

Swapan Biswas
153-30 89th Ave. Apt. 509
Jamaica, New York.
NY 11432.
Swapan64@gmail.com

+ posts

Read Previous

আফরোজা বেগমের দুটি অণুগল্প

Read Next

কামরাঙা ফুল ভোর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *