অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৬, ২০২৪
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৬, ২০২৪
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাসান মাহমুদ হক -
উন্নয়ন

      এত উঁচু বিল্ডিঙে জাহিদ আগে কখনো আসেনি। সে সমাজের নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাদের এসব আকাশচুম্বী অট্টালিকায় আসবার প্রয়োজন বা যোগ্যতা কোনোটাই সাধারণত থাকে না বা হয় না। মেঘের দিকে মাথা তোলা প্রাসাদের মতো দালানটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র লাগছে জাহিদের। চোখ তুলে ভবনটার উচ্চতা আন্দাজ করার চেষ্টা করল সে। সূর্যের প্রখর উজ্জ্বলতায় অথবা প্রাচুর্যের তীব্র ঝলকানিতে দৃষ্টি অবনত করতে বাধ্য হলো প্রায় সাথে সাথেই। মাটির দিকে তাকিয়ে মাটি দেখতে পেলো না, পেলো শুধু বাস্তবতার মতো রুক্ষ আর কঠিন কনক্রিট।

      বাস থেকে নেমে কয়েক মিনিট হেঁটে এই পর্যন্ত আসতে হয়েছে তাকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো এনজিও ‘উন্নয়ন’-এর কম্পাউন্ডের ভেতরে ঢুকে কাঁচের প্রধান দরজা থেকে বেশ খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে জাহিদ আরেকবার চিন্তা করলো ভেতরে যাবে কিনা। যেতে তার ইচ্ছে একেবারেই করছে না। সংকোচ তো হচ্ছেই, কিছুমাত্রায় ভয়ও হচ্ছে। যদিও একজন সাতাশ বছর বয়সী শক্ত-সমর্থ যুবাপুরুষের ভীত হবার মতো কী কারণ এই দুপুরবেলায় এখানে থাকতে পারে সে ব্যাপারে সে নিজেও নিশ্চিত নয়।

      এর আগে একদিন কম্পাউন্ডের গেট থেকে ফিরে গিয়েছিল সে। তারও আগে একদিন তার আসার কথা ছিল, সেদিন এই এলাকাতেই আসেনি সে। আজ তৃতীয়বারের মতো আসবে বলে কথা দিয়েছে পুষ্পিতাকে। এবারও কথা না রাখলে তার ওপর থেকে পুষ্পিতার বিশ্বাস পুরোপুরি উঠে যেতে পারে। সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক হবে। আর বিশ্বাস একবার উঠে গেলে তা আর ফিরিয়ে আনা যায় না, বিশেষত, নারীর মনে।

      সুতরাং, জাহিদ লম্বা একটা দম নিয়ে এগিয়ে গিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। তাকে পার হতে হলো আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর। তারপর একজন নিরাপত্তাকর্মী এমনভাবে তার দেহতল্লাশি করল যেন তারা কোনো সন্ত্রাসী হামলার হুমকি পেয়েছে। তল্লাশি শেষে কাউন্টারের সামনে গিয়ে জাহিদ সুন্দরী রিসেপশনিস্টকে পুষ্পিতার সাথে দেখা করার ইচ্ছের কথা বললে সে অবিশ্বাসের চোখে তাকাল জাহিদের দিকে। বললো,

-কোন পুষ্পিতা ম্যামের সাথে দেখা করতে চান? ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যাম?

      মামাতো বোন পুষ্পিতা এই প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট কি না তা জাহিদ জানে না। শুধু জানে সে এর স্বত্বাধিকারীর একমাত্র মেয়ে এবং এখানেই কাজ করে। সুতরাং এরকম উঁচু পদেই থাকার কথা তার। কিন্তু সেটা তো জাহিদ নিশ্চিত জানে না, নাও তো হতে পারে। নিজের ভেতরের দ্বিধা লুকিয়ে কণ্ঠকে যথাসম্ভব বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করল সে। বলল,

-জি, উনার সাথেই। উনি আমার কাজিন।

-আচ্ছা। আপনি ওখানটায় বসুন। আমি ম্যামের সাথে কথা বলে দেখছি উনি এখন গেস্ট অ্যাটেন্ড করবেন কিনা।

      ওয়েটিং কর্নারের দামি সোফায় গিয়ে বসল জাহিদ। এত নরম সোফা, যেন ডুবে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশ দেখতে লাগলো সে। খুবই সুন্দর করে সাজানো অফিস, যেরকম বিদেশি সিনেমায় দেখা যায়। দেয়ালে দেয়ালে পেইন্টিং ঝোলানো। সবকিছু এত পরিষ্কার আর ঝকঝকে-চকচকে উঁচু শ্রেণির যে, নিজের মলিন পোশাকের দিকে তাকিয়ে বিব্রত বোধ করলো জাহিদ। তার আত্মবিশ্বাসের এই অভাবটা কেউ যেন বুঝতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যে সে টেবিল থেকে একটা ইংরেজি ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে মুখের সামনে মেলে ধরে পড়ার ভান করতে থাকলো। কারণ আসলে ইংরেজিতে বেশ দুর্বল সে এতদূর পড়ালেখা করার পরেও।

      কয়েক মিনিট পরেই মিষ্টি কণ্ঠের ‘এক্সকিউজ মি’ শুনে জাহিদ তাকিয়ে দেখলো রিসেপশনিস্ট সুন্দরীটি উঠে এসেছে, দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। সে বলল, সরি, স্যার। আপনাকে বসিয়ে রাখলাম। আমি স্মৃতি। চলুন, আপনাকে ম্যামের চেম্বার পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছি।

      জাহিদ অপ্রস্তুত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো, না, না। পৌঁছে দিতে হবে না। ধন্যবাদ। আমি একাই যেতে পারব।

     -পৌঁছে দিতেই হবে। কারণ ম্যাম সেরকমই অর্ডার দিয়েছেন।

      -পুষ্পিতা আপনাকে এই অর্ডার করেছে?

      -না। ম্যাম বলেছেন উনার পার্সোনাল সেক্রেটারিকে। তিনি বলেছেন আমাকে।

      -চেইন অব কমান্ড? বাহ! আচ্ছা, চলুন।

      স্মৃতির পিছে পিছে বাধ্য ছেলের মতো হাঁটল জাহিদ। কিছুদূর হেঁটে লিফট। আঠারো তলায় ওঠা। তারপর আরেকবার আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর পার হওয়া। এবার অবশ্য জাহিদের দেহতল্লাশি হলো না স্মৃতির ইশারায়। আরো কিছুদূর হেঁটে একটা রুমের সামনে পৌঁছে স্মৃতি জাহিদকে দাঁড়াতে বলে ভেতরে চলে গেলো। এক মিনিট পর বের হয়ে ভেতরে যেতে বললো। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ভেতরে ঢুকলো জাহিদ।

      রুমে ঢুকে জাহিদ দেখলো পুষ্পিতা নয়, সেখানে বসে আছে হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মতো সুন্দরী একজন তরুণী। সে জাহিদকে বললো, বসুন, মিস্টার জাহিদ।

      জাহিদ বুঝতে পারল না। বলল, জি, আমি তো পুষ্পিতার কাছে এসেছিলাম।

     – হ্যাঁ, জানি। আমি এমিলি, পুষ্পিতা ম্যামের পার্সোনাল সেক্রেটারি। বসুন, প্লিজ।

      জাহিদ দ্বিধান্বিত অবস্থায় বসলো। এমিলি ফোনে কথা বললো পুষ্পিতার সাথে। ফোন রেখেই জাহিদকে সাথে নিয়ে পৌঁছে দিলো পুষ্পিতার চেম্বারে। তাকে দেখে জাহিদের মুখে হাসি ফুটলো। প্রিয় মানুষকে দেখলেই মানুষের মন খুশি হয়ে ওঠে। ফুলের মতো সুন্দর তরুণী পুষ্পিতা জাহিদের দিকে তাকিয়ে ফুলের মতো নিষ্পাপ হাসি দিয়ে বললো, এত দেরি করেছো কেন? যাক, তাও তো এসেছো এবার।

      জাহিদ বললো, আর আসছি না! বাপরে বাপ! এ তো মিলিটারির মতো অফিস! এত কড়াকড়ি কেন?

      -যেকোনো প্রতিষ্ঠান মিলিটারির মতো চালানোই সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে করে বাবা। এজন্য একটু কড়া নিয়ম-কানুন।

      -এনজিও কেন মিলিটারির মতো চলবে? কী আজব!

      -হাহাহা! বাবার সামনে কিন্তু ভুলেও এই কথা বোলো না।

      -আরে না, তা বলব না। মামা মনে কষ্ট পাবেন। উনি নরম মানুষ।

      আর তেমন কথা হলো না জাহিদ আর পুষ্পিতার। কী একটা মিটিং নাকি আছে আধঘণ্টা পরে, তাই সময় নষ্ট না করে পুষ্পিতা জাহিদকে নিয়ে গেলো তার বাবার চেম্বারে। মাঝখানে উনার সেক্রেটারির বিশাল ঘরটা পার হতে হলো তাদেরকে।

      পুষ্পিতার বাবা সরদার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম তালুকদার আকবর এই বিশাল প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এবং জাহিদের দূরসম্পর্কের মামা। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি। তার পূর্বপুরুষ ছিল জমিদার। যুদ্ধের পরে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিশাল সম্পত্তি বিক্রি করে তিনি শুরু করেন এই এনজিও ‘উন্নয়ন’। একে নিজের সন্তানের মতো করে বড়ো করে তুলেছেন আস্তে আস্তে। তিনি বলেন তার দুই সন্তান, বড়ো সন্তান উন্নয়ন আর ছোটো সন্তান পুষ্পিতা। পুষ্পিতার জন্মের আগে জন্ম উন্নয়নের।

      আকবরের ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক আর তার মেজাজ দরবেশের মতো ঠাণ্ডা। তিনি কথা বলেন খুব কম, একদম মেপে মেপে। তিনি চশমার ফাঁক দিয়ে জাহিদ আর পুষ্পিতার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর বোনের শরীর কেমন আছে জানতে চাইলেন জাহিদের কাছে। তারপর তাদেরকে বললেন জহির সাহেবের কাছে যেতে।

      জহির সাহেব উন্নয়নের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজার। তিনি জাহিদের ইন্টারভিউ নিলেন অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে, যেহেতু সরাসরি চেয়ারম্যান স্যারের রুম থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যামের সাথে এসেছে সে। সাক্ষাৎকার শেষে জাহিদ পুষ্পিতার চেম্বারে গেল। পুষ্পিতা দরজাটা লক করে আচমকা চুমু খেলো জাহিদের ঠোঁটে। জাহিদ প্রথমে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও সামলে নিয়ে সাড়া দিলো। তাদের চুমু এবং পরস্পরের শরীর নিয়ে সামান্য খেলা পর্ব শেষ হলে দরজা আনলক করে বসলো তারা। মানুষ যে শ্রেণিরই হোক, শরীরের ঊর্ধে কেউ না। তারা চা খেতে খেতেই সুদিনের সংবাদের মতো জাহিদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার চলে এলো। জাহিদ বললো, পুষ্প, তোমাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেবো!

      পুষ্পিতা বললো, তোমার সাথে কি আমার ধন্যবাদের সম্পর্ক?

      -না, তা নয়।

      -তাহলে এসব বলবে না কখনো। জয়েনিং কবে লিখেছে?

      -পরশু।

      -তাহলে তো কালই যেতে হবে তোমাকে।

      -হ্যাঁ, কালই যাবো।

      -ঠিক আছে, তা যেয়ো। এখন তুমি আমার রুমেই বোসো। আমার সাথে লাঞ্চ করে যাবে। আমি মিটিংটা সেরেই আসছি।

     – নাহ, আজ আর বসবো না। চলে যাই। গিয়ে গোছগাছ করি।

      -খেয়ে যাও। তুমি তো খিচুড়ি পছন্দ করো। আমাদের অফিসের ক্যাফের খিচুড়িটা রেস্টুরেন্টের চেয়ে ভালো কোয়ালিটির।

     – লোভ দেখাচ্ছো! আরেকদিন এসে খেয়ে যাবো। আজ যাই।

     – ঠিক আছে, যাও। মিটিঙে আসলে দেরিও হতে পারে। বসে থেকে বোর হবে তুমি।

      জাহিদ বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো অফিস থেকে। বাকি দিনটা বেশ ব্যস্ততায় কাটলো তার। সাধ্যের ভেতর সামান্য কিছু কেনাকাটা করা, বাসের টিকেট কাটা আর গোছগাছ শেষ করতে করতে রাতে ঘুমাবার সময় হয়ে গেলো। বিছানায় শুয়ে সে নিজের বর্তমান অবস্থার পর্যালোচনা করলো মনে মনে।

      সারা জীবনই মাঝের সারির ছাত্র ছিল জাহিদ। সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করেছে এক বছর আগে। চাকরির চেষ্টা কম করেনি। চলছিল টিউশনি করে। ভাগ্যাহতের মতো যখন চাকরির আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল তখন পুষ্পিতার অনুরোধে আকবর মামার সাহায্য নিতে রাজি হয়েছে। অবশ্য তার মা অনেকদিন থেকেই বলছিলেন মামার সাথে দেখা করার জন্যে। দেখা করতেই মামার সুবিশাল এনজিও উন্নয়নের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের একটিতে ম্যানেজার পদে জীবনের প্রথম চাকরি পেয়ে গেল জাহিদ। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প এটা। কাজ কঠিন হবে না, সে তুলনায় বেতনও অনেক ভালো। সমস্যা একটাই, চাকরির শুরুতে পোস্টিং একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামে। এতে অবশ্য তার তেমন কোনো ক্ষতি নেই। শুধু পুষ্পিতার সাথে দেখা হবে মাসে-দুমাসে একবার, এটাই কষ্ট।

      বছর দুয়েক আগে জাহিদের চার বছরের পুরোনো প্রেমিকা সোমা যখন স্বার্থপরের মতো তাকে ছেড়ে একজন সদ্য বিসিএস পাস করা ক্যাডার ডাক্তারকে বিয়ে করলো, তখন সে হয়তো টিকতেই পারতো না পুষ্পিতার সাপোর্ট না পেলে। হয়তো আত্মহত্যাই করতো সে পুষ্পিতা না থাকলে। পুষ্পিতা অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে জাহিদকে। সোমা চলে যাবার পর সেটা প্রকাশ করলে জাহিদ তাকে আঁকড়ে ধরেছে। আসলে জাহিদও পুষ্পিতাকে পছন্দ করত ছোটোবেলা থেকে, কিন্তু সে জাহিদের চেয়ে দুবছরের বড়ো বলে কিছু বলতে পারেনি। তবে ভালো বন্ধুত্ব ছিল তাদের মধ্যে। এখন বন্ধুত্ব রূপান্তরিত হয়েছে প্রেমে। পুষ্পিতা শিগগিরই বিয়ে করতে চায়। জাহিদও চায়, সে তো পুষ্পিতার ওপর একেবারে ডিপেন্ডেন্ট হয়ে পড়েছে এখন। আসলে নিজের জীবনের সবকিছু নিয়ে চোখ বন্ধ করে নির্ভর করার মতো একটা মানুষ সবারই দরকার।

      পরদিন কর্মস্থল রূপনাইয়া গ্রামে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেলো জাহিদের। এলাকা চেনে না সে, তার বাড়ি কাছাকাছি কোথাও না, অনেক দূরে। বেশ বড়ো একটা নদী রূপনহর-এর পাড়ে গ্রাম, সীমান্তের কাছাকাছি, দুই গ্রাম পরেই বাংলাদেশ-ভারতের বর্ডার। লোকজনের কাছে শুনে শুনে ছোটোখাটো দুর্গের মতো এনজিওর অফিসটা খুঁজে বের করলো জাহিদ।

      অফিসের দপ্তরি কাম দারোয়ান কাম নাইট গার্ড রহমত জানালো আর মাত্র আধঘণ্টা আগে এলেই বিদায়ী ম্যানেজার করিম সাহেবকে পাওয়া যেতো, যার আন্ডারে জাহিদকে কয়েকদিন ট্রেনিং নিতে হবে। করিম সাহেব অফিস শেষে চলে গেছেন তার উপজেলা শহরের বাসায়। জাহিদ এলে তার দেখাশোনা-খেদমত করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন রহমতকে।

      -জাহিদ বলল, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তো এখানেই?

      রহমত বলল, হ, স্যার। ওই পিসনের ঘরডায় থাকতে পারবেন, যদি শহরে না যান। আর খানার ব্যবস্থা আমিই করবো।

      ঘরটা চলনসই। মাঝারি মানের একটা বিছানা, একটা ছোটো টেবিল আর দুটো চেয়ার ঘরে। কম পাওয়ারের একটা বৈদ্যুতিক বাতি আছে। জাহিদের আবার প্রচুর বই পড়ার অভ্যেস রাতে। তাই বাতিটা বদলে ভালো বাতি লাগানোর জন্যে টাকা দিলো সে রহমতকে। রহমত নির্দেশ পালন করলো চমৎকৃত হবার মতো দ্রুততায়।

      জাহিদ টিউবওয়েলের পানিতে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতেই রাতের খাবার চলে এলো। খাবার দিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিতে রহমত জিজ্ঞেস করলো কিছু লাগবে কি না। নেশা বা নারী কোনোটারই অভ্যেস নেই জাহিদের, থাকলে হয়তো সেই ব্যবস্থা করে দিতো রহমত। অভ্যেস না থাকলেও এখন নিতে পারতো, কিন্তু জাহিদ নিরেট ভালো ছেলে। কিছুই নিলো না সে, চুপচাপ খাওয়া শেষ করে একটা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লো।

      পরদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙলো তার। গ্রামে কী কারণে যেন সন্ধ্যেবেলাই ঘুম চলে আসে আর ভোরবেলাতেই ঘুম ভেঙে যায়। জাহিদ নাশতা করে রেডি হয়ে অফিসে বসল। করিম সাহেব চলে এলেন সাড়ে নয়টার দিকে। তিনি যতটা বয়স্ক হবেন বলে ভেবেছিল জাহিদ, তিনি মোটেই তা নন। জাহিদের চেয়ে বড়োজোর পাঁচ-সাত বছরের বড়ো হবেন, তাকে দেখে সেরকমই মনে হলো জাহিদের। তিনি বড়ো ভাইয়ের মতো ব্যবহার করলেন জাহিদের সাথে।

      করিম সাহেবের থেকে জানা গেলো তিনি এই প্রতিষ্ঠানের এই পদে চাকরিতে আছেন চার বছর হলো। রূপনাইয়ায় পোস্টিং দুবছর হয়েছে। আগে ছিলেন পাশের জেলার একটা গ্রামে। পদোন্নতি পেয়ে গ্রাম থেকে উপজেলা শহরে যাচ্ছেন এখন। জাহিদকে কয়েক দিনের মধ্যে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েই গিয়ে জয়েন করবেন। ভাগ্য এবং পারফরম্যান্স ভালো হলে উপজেলা থেকে জেলায় পদোন্নতি পাবেন কয়েক বছর পর। একইভাবে জেলা থেকে বিভাগে যেতে পারবেন আরও কয়েক বছর পর। তারপর হয়তো কেন্দ্রীয় অফিসেও যেতে পারেন। কেন্দ্রীয় অফিস পর্যন্ত ওঠার সৌভাগ্য সবার হয় না। তবে জাহিদের হবে বলে আশা করা যায়, সে ভাবলো, কারণ তার চাকরি একরকম কেন্দ্রীয় অফিস থেকেই শুরু হয়েছে বলা যায়। কেউ কেউ অনেককে ছাড়িয়ে যাবে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

      করিম সাহেব জাহিদকে অভিজ্ঞ সিনিয়র অফিসারের মতো পরামর্শ দিলেন যেন সে উপজেলা শহরে অবস্থিত উন্নয়নের কোয়ার্টারে বা গ্রামে অবস্থিত বাংলোতে না ওঠে। থাকার ব্যবস্থা সেখানে খুবই ভালো, কিন্তু বেতন কেটে নেবে অর্ধেক। জাহিদ যেহেতু একা মানুষ, তাই অফিসের সাথে লাগোয়া কেবিনে থাকলেই তার জন্য ভালো হবে। এতে কাজেরও অনেক সুবিধা হবে। করিম সাহেবের বউ-বাচ্চা আছে বলে তিনি বাসা নিয়েছেন উপজেলা শহরে।

      দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে তাদের মাঠকর্মীরা এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে জাহিদের সাথে পরিচিত হয়ে গেলো। তাদের কাজ মূলত গ্রামে ঘুরে ঘুরে ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি পরিশোধের টাকা সংগ্রহ করা। আরও কিছু কাজ আছে, করিম সাহেব পরে বুঝিয়ে দেবেন বললেন। মোট পনেরো জন মাঠকর্মীর চাকরি-ছুটি-বেতন সব ম্যানেজারের হাতে, অর্থাৎ এখন থেকে জাহিদের হাতে। বেশ ক্ষমতাবান হয়ে গেল সে হঠাৎ করে।

      করিম সাহেব মন লাগিয়ে কাজ করার পরামর্শ দিলেন তাকে। বললেন, খুব ভালো চাকরি পেয়েছেন। পরিশ্রম বেশি না। একটু কঠোর হতে হবে শুধু, কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। ব্যস, এটুকুই।

      জাহিদ বুঝতে না পারলে ছাড় না দেয়ার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলেন করিম সাহেব। ঋণগ্রহীতারা মাঝেমাঝেই কিস্তি শোধ করতে চায় না। তাদের সাথে ম্যানেজারের সরাসরি দেখা বা কথা হয় না সাধারণত। মাঠকর্মীদের মাধ্যমে জানা যায় খবর। তাদেরকেই চাপ দিতে হয়। সে চাপ তাদের মনের মতো বাড়িয়ে তারা ঋণের কিস্তি শোধ করতে ব্যর্থ হওয়া মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। চাপে কাজ না হলে পরে তাদের বেতন থেকে টাকা কেটে নিয়ে কিস্তি শোধ করতে হয়। তা না করলে ম্যানেজারের বেতনই কাটা যাবে। এভাবেই প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ভারসাম্য রক্ষা করা হয় অর্থের।

      করিম সাহেবের থেকে আরও কিছু খুঁটিনাটি শুনতে শুনতে জানতে জানতে লাঞ্চের সময় হয়ে গেলো। লাঞ্চের পর থেকেই মাঠকর্মীরা একে একে ফিরে আসতে শুরু করলো। কিস্তি সংগ্রহের দিনের টার্গেট পূরণ হয়ে গেলে আগেভাগেই ছুটি পেয়ে যায় তারা সেই দিনের মতো। না হলে বিকেল চারটা পর্যন্ত চেষ্টা করে যেতে হয় তাদেরকে। তারপর অফিসে এসে ম্যানেজারের কাছে রিপোর্ট দিয়ে ছুটি পায়।

      রিপোর্ট করতে এসে মাঠকর্মী নজরুল বলল, স্যার, পুবপাড়ার শেফালি কিস্তি দিতেসে না এক মাস হয়া গেল প্রায়। অরে টাইট দ্যাওন লাগবো।

      করিম সাহেব বললেন, ঠিক আছে। কালকে যাওয়া যাবে। বাকি সবাই ঠিকঠাক দিতেসে তো টাকা?

      -জি, স্যার। দিতেসে। শেফালি ছাড়া আর কেউ ঝামেলা করতেসে না।

     – ওরে কি তিন দিনের আল্টিমেটাম দিসিলা?

      -জি, স্যার। সেইটা আজকেই শেষ হইলো।

      -ভয় দেখাও নাই?

      -জি, স্যার। দেখাইসি।

     – ঠিক আসে। কালকে যায়া মজা বুঝাইতেসি।

      নজরুল চলে গেলে করিম সাহেব জাহিদকে বললেন, আপনাকে হাতে-কলমে একটা টাইট দেয়ার প্রসেস দেখানো যাবে। ভালোই হলো, কী বলেন?

      -জাহিদ বললো, হ্যাঁ, তাই তো মনে হয়। কীভাবে টাইট দেয়া হবে?

     – সেটা না হয় কালই দেখবেন।

      অতি নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে শেফালির বিয়ে হয়েছে ষোলো বছর বয়সে। তার স্বামী জব্বার ইউনিয়ন মেম্বার মালেক মিয়ার বছরবান্ধা কামলা ছিল। সে মদখোর হলেও সংসার ভালোই চালাতো। বিয়ের তিন বছর পর সে অ্যাকসিডেন্ট করে অচল হবার পর এ বাড়ি-ও বাড়ি কাজ করে সংসার চালাত শেফালি। তবুও জব্বার গালাগাল করতো। হাতের কাছে পেলে অমানুষের মতো কিল-চড়ও মারতো। চলেও যেতে বলতো মাঝে মাঝে।

      দেখতে বিশেষ ভালো না এবং দুই বাচ্চার মা হলেও শেফালির বাইশ বছরের দেহের বুনট বেশ আঁটোসাটো। ফলে গ্রামেও পুরুষদের চোখের এবং মাঝেমঝেই হাতেরও স্বীকার হতে হতো তাকে। এমনকি উন্নয়নের মাঠকর্মীরাও সুযোগ পেলেই বিরক্ত করতো তাকে। আধুনিক নারী হয়তো শেফালির অবস্থায় পড়লে আত্মহত্যার কথা ভাবতো। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়া গ্রামের মেয়ে শেফালির মাথায় এসব আসেনি। তার মতো মেয়েদের কাছে বেঁচে থাকাটাই অনেক বড়ো। সুন্দরভাবে বাঁচার ধারণাটাই তাদের কাছে বিলাসিতা।

      শেফালিকে একটু ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল উন্নয়ন। দিয়েছে ঋণ। সে টাকায় নিজের মতো করে দিন ফেরানোর আশায় সে বাজারে ছোটো একটা দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। সদাইপাতি আর চা-নাশতার দোকান। মেয়েমানুষ ব্যবসা করছে দেখে গ্রামের লোকজন প্রথমে আপত্তি তুললেও এখন সবাই মোটামুটি মেনে নিয়েছে। দেশ বদলে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে। প্রগতির দিকে এগোনোর গতিই স্বাভাবিক গতি।একটা ছাগলও কিনেছিল শেফালি। বড়ো করে কুরবানির ইদে বিক্রি করতে চেয়েছিল। তাতে বাড়তি কিছু আয় হতো। জীবনযাত্রার মানের কিছুটা উন্নতি হতো। কিন্তু সেটা আর হলো না। ব্যবসা সবসময় সমান তালে চলে না। আয় ওঠানামা করে। কদিন ধরে ব্যবসার অবস্থা ভালো যাচ্ছে না বলে কোনোরকমে দিন চলছে শেফালির। তাই সে কিস্তি শোধ করতে পারছে না। কিন্তু উন্নয়ন এসব শুনতে বা মানতে নারাজ।

      পরদিন করিম সাহেব জাহিদকে নিয়ে গেলেন শেফালির বাড়িতে। তাদের সাথে গেলো তাদের মাঠকর্মীরা এবং মেম্বারের পালা কয়েকজন মাস্তান। মেম্বারকে এবং তার মাস্তানদেরকে খুশি রাখে উন্নয়ন, নাহলে এই গ্রামে কাজ করতে পারতো না। প্রথমে অযথাই কিছু কথাবার্তা বললো তারা আর সবাই মিলে চোখ দিয়ে শেফালির শরীর চাটলো পশুর মতো। তারপর করিম সাহেবের প্রচণ্ড ধমক খেয়ে আর দলবল দেখে ভয় পেয়ে শেফালি তার ছাগল বেঁচে দেবার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো। তার এই বিপদের সু্যোগ নিয়ে প্রতিবেশি আবদুল উপযুক্ত দামের চেয়ে বেশ অনেকটা কম দামে কিনে নিলো ছাগলটা। সে টাকায় শোধ হয়ে গেল শেফালির বকেয়া কিস্তি। তাকে খুব বেশি টাইট দেবার প্রয়োজন পড়লো না করিম সাহেবের কিংবা উন্নয়নের। শোধ হয়েও কিছু টাকা হাতে থাকল শেফালির। বোকা মহিলা এই টাকা হাতে পেয়ে খুশি হলো অনেক।

      সে রাতে জাহিদের কেবিনে বড়ো একটা বাটি ভরে ছাগলের মাংসের ভুনা আর চালের আটার রুটি দিয়ে গেল আবদুল। জাহিদরা তথা তাদের এনজিওর ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প না থাকলে এই ছাগল শেফালির কেনাও হতো না আর পানির মতো এত সস্তা দামে বিক্রি করারও প্রয়োজন হতো না। তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ জাহিদের জন্যে এই সামান্য উপহার। ব্যাপারটায় জাহিদ বিব্রত বোধ করলেও খেতেই হলো তাকে। কারণ সে রাতে রহমত খাবারের ব্যবস্থা করেনি। আবদুল আগেই বলে রেখেছিল রহমতকে যে রাতে সে খাবার দেবে।

      করিম সাহেব জাহিদকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। জাহিদ মন দিয়ে কাজ করতে থাকলো। ঋণ শোধ নিলো, ঋণ দিলো। কিছুদিন পরেই শেফালি আবার এলো ঋণ নিতে, তার এবারের ইচ্ছে মুরগি পালা। তার ঋণের ব্যবস্থা করলো জাহিদ। দুমাস পরে আরেকজন ঋণগ্রহীতা হালিম কিস্তি শোধ করতে ব্যর্থ হলে জাহিদ তার দলবল নিয়ে গিয়ে তার গরুর বাছুরটা বিক্রি করিয়ে কিস্তি শোধ নিলো। বোকা শেফালির মতোই খুশি হলো বোকা হালিম, বকেয়া শোধ করেও কিছু টাকা হাতে থেকে যাওয়ায়। একইভাবে পালা হাঁসের পাল বেঁচে কিস্তি শোধ করলো মায়মুনা। এরকম আরও অনেকেই।

      জাহিদ টাইট দেয়াটা রপ্ত করে ফেললো বেশ ভালোভাবে। মাঠকর্মীদের সাথে ধমক ছাড়া সে কথাই বলে না এখন। খুব ভালো চালাচ্ছে সে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প তার এলাকায়। কয়েক মাস পরে বন্যা হলো। বন্যার পরে প্রচুর মানুষ নতুন ঋণ নিলো। ফলে জাহিদের ব্যস্ততা বাড়লো। চাকরিতে থিতু হয়ে গেলো সে। মোটা বেতনের টাকায় তার জীবনযাত্রার স্টাইলের পরিবর্তন হলো। নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে লাফিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণি পেরিয়ে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উঠে এলো সে। বিসিএস দেয়ার যে ইচ্ছেটা তার মনে ছিল, তা আর থাকলো না। কারণ এই চাকরি সরকারি ক্যাডারের চাকরির চেয়েও ভালো, শুধু সামাজিক সম্মানের দিকটা ছাড়া আর সব দিক দিয়েই। সত্যায়িত করার ক্ষমতার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে জীবনে।

      রূপনাইয়ার অফিসে কাজের পাশাপাশি সপ্তাহে একদিন জাহিদকে রিপোর্ট নিয়ে যেতে হয় উপজেলা অফিসে। দুসপ্তাহে একদিন উপজেলার ম্যানেজারদেরকে যেতে হয় জেলা অফিসে। আর মাসে একদিন জেলার ম্যানেজারদেরকে যেতে হয় বিভাগীয় অফিসে। কেন্দ্রীয় অফিসে বিভাগীয় ম্যানেজারদেরকে যেতে হয় তিন মাসে একদিন। ছয় মাসে একটা জাতীয় সম্মেলনে যায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারী। সবাইকে সবসময় কঠোরভাবে মানতে হয় চেইন অব কমান্ড সামরিক বাহিনীর মতো। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবার কোনো সুযোগ নেই। সুযোগ পেলে ঘোড়াকে ডিঙিয়েই ঘাস খেতে চায় যে কেউ। তাই সুযোগই দেয় না উন্নয়ন।

      ওপরের অফিসারদের সাথে কাজ করতে করতে আস্তে আস্তে জাহিদ বুঝতে পারলো তাদের এনজিও আসলে কতটা বিশাল! কী বিরাট তাদের কাজের পরিধি! কী ব্যাপক তাদের প্রকল্পগুলোর প্রভাব! কী বিপুল তাদের সম্পদের পরিমাণ! জানতে পারলো তাদের ভেতরেও আছে আমলাতন্ত্র। আছে কূটনীতি, আছে রাজনীতি। যেন রাষ্ট্রের ভেতর আরেকটা রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের মতোই সমস্ত কিছুর উৎস ও মালিক জনগণ হলেও কেন্দ্রে আছে গুটিকয়েক মানুষ। এই গুটিকয়েকের মাথার ওপর আছে মাত্র একজন মানুষ কিংবা একটি পরিবার, রাজা আর রাজপরিবারের মতো, যাদের রাজত্ব প্রতিদিনই আর‌ও বড়ো আর আরও বিস্তৃত হচ্ছে।

      প্রকাণ্ড একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ সিস্টেমের অতি সামান্য একটা অংশ জাহিদ, দৈত্যাকার একটা টাওয়ারের অসংখ্য সিঁড়ির একটামাত্র ধাপের মতো। তাই সে এতো কিছু নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করলো। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে মগজ খরচ করলো না। চিন্তা করে দেখলো, সিস্টেমটা আছে বলেই আর ভালোভাবে চলছে বলেই সারাদেশে সুবৃহৎ সংখ্যক প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ খেয়ে-পরে বাঁচতে পারছে। পথে বা স্টেশনে বা খোলা আকাশের নিচে না থেকে ঘরে থাকতে পারছে। প্রয়োজনে নিতে পারছে চিকিৎসা। স্কুলে পাঠাতে পারছে ছেলেমেয়েদেরকে। ঋণ না পেলে এদের সিংহভাগকেই দারিদ্রসীমার নিচে বাঁচতে হতো। পূর্ণ হতো না মৌলিক অধিকারগুলোও। মৌলিক অধিকার পূরণ না হলে মানুষ আসলে ঠিক মানুষ হিসেবে বাঁচতে পারে না। কোনো দয়া বা সাহায্য না পেলে মরতেও হতো অনেককেই।

      এসব ছাড়াও উন্নয়ন থেকে লোকজন প্রয়োজনে সহজ শর্তে ঋণ পাবার কারণে এলাকায় সুদখোরদের ব্যবসা প্রায় শেষ। বেকার কমে গেছে অনেক। কমে কমে প্রায় শূন্যে চলে এসেছে বখাটে, নেশাখোর আর জুয়ারির সংখ্যা। উন্নয়ন হচ্ছে স্পষ্টতই। ভাগ্যবান ও কঠোর পরিশ্রমীদের জীবনযাত্রার মানও পালটাচ্ছে। এটা শুধু ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের ভূমিকা বা প্রভাব। এর পাশাপাশি উন্নয়নের আছে ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। আরও কী কী আছে জাহিদ এতদিনেও সব জানতে পারেনি। তার ধারণা এবং লোকেরও ধারণা উন্নয়ন এবং আকবর সাহেব নোবেল পুরস্কার পাবে একদিন। অন্যান্য বেশকিছু পুরস্কার পেয়েছে তারা দেশে ও বিদেশে।

      গ্রামের লোকেদের ঋণ নিতে উদ্বুদ্ধ করার কাজটা মাঠকর্মীদের, ম্যানেজারের নয়। তবু জাহিদ তা করতে চাইলো। এতে জনগণের সেবাও হবে, আর তার পদোন্নতির জন্য যে প্রোগ্রেস দরকার সেটাও ত্বরান্বিত হবে। কিন্তু এনজিওর নিয়ম ভঙ্গের দায়ে যদি পড়ে যায় তাহলে তো বিপদ। তাই সে ওপরের মহলের কাছে অনুমতি চাইলো মাঠে কাজ করার। রুটিন কাজের ক্ষতি না করার শর্তে ঐচ্ছিক অতিরিক্ত কাজের অনুমতি মিললো।

      জাহিদ গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নানা অঙ্কের নানা মেয়াদের নানা প্যাকেজের ক্ষুদ্রঋণের মার্কেটিং করতে শুরু করে দিলো। ঋণ নিয়ে কী কী করা যায় তা বললো। সেসব করে কী কী লাভ হবে তা বোঝালো। এমনভাবে এটা সে করলো যেন সে গ্রামবাসীর পরম বন্ধু। তাদেরকে সুদিনের সোনালি স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করলো সে। এতে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ঋণগ্রহীতার সংখ্যা বাড়তে শুরু করলো আর প্রমোশনের দৌড়ে এগিয়ে যেতে থাকলোও সে।

      এক বছর পরে উন্নয়নের জাতীয় সম্মেলনে সেরা গ্রাম ম্যানেজারের পুরস্কার পেলো জাহিদ। তার সুনাম ছড়িয়ে পড়লো আশেপাশের গ্রামগুলোতে। অন্যান্য গ্রামের ম্যানেজারেরা ফোনে এবং সরাসরি তার বুদ্ধি-পরামর্শ নিতে শুরু করলো। কেউ একজন কোনোকিছুতে ভালো করলেই তাকে অন্ধ অনুকরণ করার বাতিক আছে আমাদের দেশের মানুষের, যেন সাফল্যের রাস্তা কেবলমাত্র ওই একটিই যে পথে সেই একজন হেঁটে সফল হয়েছে।

      সহকর্মী অফিসারদের এই উপদ্রবটা একরকম উপভোগই করতে থাকলো জাহিদ মধুর যন্ত্রণার মতো। নিজের কাজের উদ্যম বাড়লো তার এর প্রভাবে। একদিন সে প্রান্তিক কৃষক হেলালের বাড়িতে গিয়ে উঠানে বসে ভালো ভালো কথা বলে উৎসাহ দিয়ে তাকে ঋণ নিতে প্রায় রাজি করিয়ে ফেলেছে। তখন একজন সদ্য কৈশোর পেরোনো যুবক পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দিল জাহিদকে। সে সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো যুবকের দিকে।

      হেলাল পরিচয় করিয়ে দিলো যুবককে। বললো, স্যার, এইটা আমার পোলা। শফিকুল।

      জাহিদ বলল, আচ্ছা, শফিকুল। কেমন আছো, শফিকুল?

      শফিকুল বলল, আছি, স্যার। আমাদের মতো গরিবদের যেমন থাকার কথা তেমনই আছি। আপনি কেমন আছেন, স্যার?

      শফিকুলের শুদ্ধ বাংলা শুনে জাহিদ বুঝলো সে পড়াশোনা করা ছেলে, এসএসসি পাশ করেছে বলে মনে করলো। বললো, আমি ভালো আছি, শফিকুল।

      জাহিদ হেলালের সাথে কথায় ফিরতে চাইলো। কিন্তু খেয়াল করলো শফিকুল তার পাশে দাঁড়িয়েই আছে, যেন কিছু বলতে চায়। জাহিদ বললো, কিছু বলবে, শফিকুল?

      শফিকুল বলল, জি, স্যার। আমার একটা জিনিস জানার ছিল।

      -হ্যাঁ, বলো কী জানতে চাও।

      -আপনার এই চাকরিতে প্রমোশন হয় না, স্যার?

      -নিশ্চয়ই হয়। হবে না কেন?

      -প্রমোশন হলে আপনি কোথায় যাবেন?

      -কোথায় যাবো তা তো জানি না। কোনো একটা উপজেলা অফিসে যাবো।

      -সেখানে প্রমোশন হবে না?

     – হবার কথা।

     – সেখান থেকে কোথায় যাবেন?

      -জানি না। উপজেলার পর জেলা অফিস। যেকোনো জেলায়। জেলার পর বিভাগীয় অফিস। যেকোনো বিভাগে। কিন্তু তুমি এসব জানতে চাচ্ছো কেন? জেরা করছো কেনো পুলিশের মতো?

      -কারণ আছে, স্যার। বলছি সেটা। আগে বলুন, বিভাগীয় অফিস থেকেই কি অবসরে যাবেন?

      -না। আশা করা যায় ঢাকায় সেন্ট্রাল অফিস পর্যন্ত যেতে পারব। তারপর অবসর।

      -অর্থাৎ, স্যার, আপনি এই রূপনাইয়া গ্রাম থেকে চাকরি শুরু করে রাজধানী ঢাকা শহরে পৌঁছে তারপর অবসর নেবেন। কিন্তু, স্যার, আমরা কোথায় যাবো বলতে পারেন?

      কী মারাত্মক একটা প্রশ্ন করে ফেলেছে সেটা শফিকুল সম্ভবত জানে না। এর উত্তরের অন্ধ কূপের মতো গভীরতা সম্পর্কেও হয়তো তার ধারণা নেই। জাহিদ শফিকুলের এই প্রশ্নের জবাব দিলো না কিংবা জবাব দিতে পারলো না। কারণ সে জানে, এদের কোথাও যাওয়া হবে না। শফিকুল, হেলাল, মায়মুনা, হালিম, আবদুল, শেফালি, রহমত। এদের কেউই কোথাও যেতে পারবে না। এদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। এরা ঋণ নেবে। ঋণের টাকায় কোনোরকমে কাজ করে খেয়ে-পরে টিকে থাকবে। এদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শুরু করবে, কিন্তু বেশিদূর না যেতেই পোকায় খাওয়া পাতার মতো ঝরে পড়বে। ঋণ শোধ করে এরা আবার ঋণ নেবে। বাবার পরে ছেলে নেবে। তারপর নেবে তার ছেলে। তারপর তার ছেলে। তারপর… এরা এই গ্রামের মাটির কাছেই থেকে যাবে ধুলোবালির মতো। এই মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষগুলোর জীবন কখনও বদলাবে না। কিন্তু এদের জীবনের নির্যাস দিয়ে সমাজের উঁচুতলার মানুষের বানানো সুউচ্চ বিল্ডিংগুলোর উচ্চতা আরও বাড়বে, ক্রমাগত কেবল বাড়বেই।

হাসান মাহমুদ হক
সরিষাবাড়ী, জামালপুর
hasanmahmudhaq@yahoo.com

Read Previous

একটি অমীমাংসিত গল্প

Read Next

অগ্নিবলয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *