অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৬, ২০২৪
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৬, ২০২৪
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হামিদা বানু মৌসুমী -
একটি অমীমাংসিত গল্প

মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে চলেছে। সাড়ে সাতটা  বেজে গেছে। অনিক হাত বাড়িয়ে এলার্ম বন্ধ করে উঠে পড়ে। এতো সকালে উঠতে ওর ভীষণ কষ্ট হয়। এতদিনের দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস এতো সহজে কি বদলানো যায়? কিন্তু কি আর করা, চাকরি বলে কথা! সাড়ে আটটার মধ্যেই ওকে অফিসে পৌঁছাতে হবে। পাঁচ মিনিট দেরি হলেও জবাবদিহি করতে হয় বসের কাছে। অনিক খুব দ্রুত ফ্রেশ হয়ে কোনোরকমে নাস্তা সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। গাইবান্ধা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে তারকেশ্বর গ্রামে গ্রামীণ মানবকল্যাণ সংস্থার কার্যালয়৷ মোটরসাইকেলে যেতে ১৫ মিনিটের বেশি সময় লাগে না। ও যখন অফিসে পৌঁছলো তখন  ৯:০০ বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। হাতে সময় থাকায় আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে ও সারাদিনের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে নেয়। আগামীকাল ধুপির চরে সার্ভের সব প্রস্তুতি আজকেই নিয়ে রাখতে হবে। অফিসের কাজে যতই মগ্ন হয়ে উঠুক না কেনো অনিকের গায়ে এখনো লেগে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ধ। সেখানকার ছায়াঘেরা সবুজ চত্বরের প্রতিটি ধুলিকণা, অবারিত জীবনের কোলাহল, বেহিসেবী আড্ডাবাজি প্রতি মুহূর্তে ওকে  হাতছানি দিয়ে ডাকে। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে বাড়ি এসেছে পাঁচ মাস। এখনও রেজাল্টও হয়নি তবে কপালগুণে এর মধ্যেই চাকরি জুটে গেছে।

চায়ের কাপ নামিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই অনিক খেয়াল করে কতগুলো চড়ুই জটলা করছে। মুহূর্তেই ও আনমনা হয়ে ওঠে। নিজের অজান্তেই চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করতে থাকে ঝুমঝুমি, ঝুমঝুমি, ঝুমঝুমি! ওর চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, অফিসের চেয়ার টেবিল বিলীন হয়ে ভেসে ওঠে এক আনিন্দ্য সুন্দর মুখ।

ঝুমঝুমি ছিল অনিকের বন্ধু দিপুর ছোটোবোন। দিপুর বাড়ি রাজশাহী। ওর বড়ো মামা ঢাকায় থাকে। একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ঝুমঝুমি এসএসসি পরীক্ষা শেষে ঢাকায় মামার বাড়ি বেড়াতে আসলে দিপু ওকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসে। প্রথম যেদিন ঝুমঝুমির সাথে দেখা, সে দিনের কথা ও কখনোই ভুলবে না। স্মৃতির ক্যানভাসে দিনটি যেন আজও অম্লান হয়ে আছে। তখন ছিল বর্ষাকাল। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল, অসংখ্য চড়ুই পাখির কিচিরমিচিরে মুখরিত চারপাশ। ভেজা জারুল আর কাঠগোলাপের গন্ধমাখা বাতাসে দিপু ঝুমঝুমির সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দেয়। কি যে মিষ্টি লাগছিলো ঝুমঝুমিকে! এরপর ঝুমঝুমি ঢাকায় তিন মাস ছিল।

অনিকের সঙ্গে আরও কয়েকবার দেখা হয়েছে। ওদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্বও হয়েছে। তবে যতবারই ওদের দেখা হয়েছে অনিক অবাক হয়ে দেখেছে ঝুমঝুমির আশপাশে অসংখ্য চড়ুই। খুবই অদ্ভুত লেগেছে অনিকের। অনিক মনে মনে ঝুমঝুমিকে ভালোবেসে ফেললেও বলার আগেই ঝুমঝুমি রাজশাহী চলে যায়। এর কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন খবর আসে ঝুমঝুমি মারা গেছে একদিনের জ্বরে। ও দিপুর সঙ্গে গিয়েছিল রাজশাহীতে। দুইদিন পর ঢাকায় ফেরার সময় খেয়াল করে ঝুমঝুমির কবরের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই পাখি বসে আছে। মনে হয়েছে যেন পাখিগুলো কবর পাহারা দিচ্ছে। ঝুমঝুমির অকস্মাৎ মৃত্যু অনিককে তীব্র কষ্টে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ঢাকায় ফিরে ও হঠাৎ করেই কবিতা লিখতে শুরু করে। ওর সব কবিতা জুড়ে থাকে না পাওয়া এক নারীর জন্য বিষণ্ন হাহাকার। তবে একসময় বুকের মধ্যে গুমড়ে কাঁদা কষ্টও সময়ের স্রোতে কিছুটা ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু মনের মধ্যে ও ঠিকই পুষে রেখেছে একটা ঝুমঝুমি পাখি।

অনিক চর উন্নয়ন প্রজেক্টের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে জয়েন করেছে দুই মাস। এটা একেবারেই নতুন প্রজেক্ট সংস্থার। প্রত্যন্ত চর এলাকায় গিয়ে তাদের সার্ভে করতে হচ্ছে। সার্ভে শেষ হলে বাছাইকৃত কিছু এলাকায় কাজ শুরু হবে। প্রত্যন্ত চর অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে সার্ভে করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। সপ্তাহে দুই দিন করে চলছে সার্ভে। অনিক খুব উৎসাহ নিয়ে কাজ করছে। তার ইচ্ছে চর এলাকার লোকজনের জীবনযাত্রা এবং প্রাকৃতিক দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা করে একটা গবেষণা পত্র তৈরি করবে। চাকরিটা মূলত, এ কারণেই নেয়া যেন রথ দেখার সাথে কলাবেচাও হয়।

পরদিন খুব ভোরে অনিক বাড়ি থেকে বের হয়। উদ্দেশ্য কামারজানি ঘাট, ওখান থেকেই চরে যাওয়ার নৌকা ছাড়ে। ও পৌঁছে দেখে রাকিবুল, নিলু, মিঠু, শিহাব আগেই এসে হাজির। ওরা সবাই এই প্রজেক্টে কাজ করে। অফিসের সিনিয়র কর্মী রুকু ভাইও ওদের সঙ্গে উপস্থিত। ওরা আটটা নাগাদ রওনা দেয় অফিসের শ্যালো নৌকায়। এখন নভেম্বর মাস নদীতে পানি কম তাই সময় লাগবে যেতে। বর্ষার সময় হলে অনেক দ্রুত পৌঁছানো যেতো। হেমন্তের মিষ্টি রোদ আর সকালের ঝিরিঝিরি বাতাস। নদীতে পানকৌড়ি, পাতিহাঁসের ওড়াউড়ি, দুপাশে সবুজ ক্ষেত, কাশবন ছুঁয়ে ওরা এগিয়ে চলে গন্তব্যে। দারুণ সুন্দর প্রকৃতির সুধা অনিক প্রাণভরে উপভোগ করে। রুকু ভাইয়ের বাড়ি এই এলাকায়।  কামারজানি ঘাটের পাশেই। মূলত রুকু ভাই ওদের গাইডের মতোই। বয়সে ওদের থেকে বড়ো হলেও সবার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। খুবই সহজ সরল আর সাধাসিধে মানুষ। এলাকার পথঘাট সবই তার খুব চেনা। ঘন্টাখানেক যাওয়ার পর নৌকা বডড়ো নদীতে গিয়ে পড়লো। এখানে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র আর যমুনা এক সঙ্গে মিলিত হয়েছে। জায়গাটা বেশ নির্জন, কিরকম একটা গা ছমছমে ভাব আছে। এই নদী তার খামখেয়ালিপনায় কতো ইতিহাস কতো সভ্যতা যে বুকের ভিতর লুকিয়ে রেখেছে নদীপাড়ের মানুষই শুধু তা জানে।

ওরা যখন ধুপিরচরে পৌঁছলো তখন দুপুর ১২ টা। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। চারদিকে শুধু ধু ধু বালুচর আর কাশবন। লোকালয়ে পৌঁছাতে ওদের বেশ কিছুটা হাঁটতে হবে। বাদাম, মটরশুটি আর কালাই ক্ষেতের ভেতর দিয়ে হেঁটে চললো ওরা। তপ্ত বালি আর খানাখন্দ সবকিছু মাড়িয়ে ওরা যখন লোকালয়ে পৌঁছলো মুহূর্তেই ২০/৩০ জন নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর ওদের চারপাশ থেকে এমনভাবে ঘিরে ধরে যেন  ভিনগ্রহের প্রাণি ওরা। বেশিরভাগ বাচ্চার গায়ে কোনো কাপড়-চোপড় নেই, ছোটো-বড়ো কারো পায়েই স্যান্ডেল নেই। এই লোকগুলোকে দেখেই বোঝা যায় সভ্যতার আলো এখনও এখানে খুব একটা পৌঁছেনি। প্রথমেই এলাকার কৃষক হযরত আলীর বাড়িতে স্থানীয় লোকদের সঙ্গে  কথা বলে ওরা প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর এলাকাটা খুব ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখে। স্থানীয় মেম্বার আনসার আলীর বাড়িতে ওদের দুপুরে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘুরতে ঘুরতে সবাই খুব ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত। কাঁচা বাদাম সিদ্ধ আর সবরি কলার সাধারণ আহারই ওদের কাছে অমৃতের মতো লাগে।

ইতিমধ্যেই দুপুর গড়িয়ে গেছে।  রুকু ভাই ওদের নৌকায় ফিরে যাবার তাগাদা দিতে লাগলো। সূর্য বেশ খানিকটা পশ্চিমে ঝুকে পড়তে শুরু করেছে। ওরা যখন নৌকায় এসে বসলো সবাই বেশ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। বড়ো নদীতে নৌকা ছুটে চলছে। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। অনেক দূরে আবছা কিছু গ্রাম আর পাহাড় দেখা যাচ্ছে। ওরা নৌকার উপর বসে অপেক্ষা করছে নদীতে সূর্যাস্ত দেখবে। নদীতে কতো রকম নাম না-জানা পাখি আর পাতিহাঁসের কলরবে মুখরিত চারপাশ। সবারই ঘরে ফেরার তাগিদ। পড়ন্ত বিকেলের এলোমেলো বাতাস মুহূর্তেই ওদের সব ক্লান্তি যেন দূর করে দিলো। এই সুন্দর প্রকৃতি আর পরিবেশেও রুকু ভাইকে কিছুটা অস্থির দেখায়। সে বারবার মাঝিকে দ্রুত যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতে লাগলো।

এরমধ্যে নৌকা বড়ো নদী পার হয়ে ছোটো নদীতে এসে পৌঁছেছে আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ওরা কামারজানি ঘাটে পৌঁছাবে। লাল টকটকে থালার মতো সূর্য পশ্চিম দিকে আস্তে আস্তে হেলে পড়ছে, দেখে মনে হচ্ছে যেনো নদীতে ডুব দিচ্ছে। সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছে সেই দৃশ্য। শুধু রুকু ভাইকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। রুকু ভাই যতোই তাগাদা দিচ্ছেন নৌকার গতি যেন আরও কমে আসছে। ছোটো নদীতে পানি কম তাই ধীরে ধীরে নৌকা চলছে। এমন সময় হঠাৎ একটা ঝাঁকি দিয়ে নৌকা থেমে যায়। মাঝির সহকারি কিশোর বয়সী আনিস দৌড়ে ইঞ্জিন-এর কাছে যায় তারপর নদীতে নেমে পড়ে। আনিস পানি থেকে নৌকায় উঠে বলে, “ওস্তাদ ফ্যান ভাঙ্গি গেছে বদলান লাগবে।”

নৌকাটা যেখানে থেমে গেছে তার পূর্ব পাশ্বে ধু ধু বালুচর দূরে কিছু কাশবন দেখা যাচ্ছে আর পশ্চিম পাশে একটু দূরে একটা জঙ্গল মতো জায়গা। বড়ো বড়ো রেইন্ট্রি গাছ দেখে মনে হচ্ছে  অনেক পুরনো। অনিক অবাক হয়ে খেয়াল করলো একটা মাঝারি ধরনের রেইনট্রি গাছে অজস্র চুড়ুই পাখি বসে আছে। এতো পাখি বসে আছে গাছে দেখে মনে হচ্ছে যেন পাখির গাছ!

রুকু ভাই বিরক্তির সুরে বলে উঠে, এতোক্ষণ এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম।

তার এই কথায় অনিক জিজ্ঞেস করে, কিসের ভয়? অন্যরাও এগিয়ে এসে অনিকের সাথে যোগ দেয়।

প্রথমে বলতে না চাইলেও সবার জোরাজুরিতে রুকু ভাই বলা শুরু করে, এই জায়গাটার নাম বাটকামারীর চর। একসময় এখানে জনবসতি ছিল। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে এখানে অনেক লোকের বাস ছিল। সেই সময় এই এলাকার  চেয়ারম্যান ছিলেন ইদ্রিস সাহেব। তার একমাত্র মেয়ে  ঝুমঝুমি, অপরূপ সুন্দরী। ঝুমঝুমি বাড়ির চাকর আলীকে ভালোবেসে ফেললো। দুজনের বয়সই খুব কম ১৭/১৮ হবে। অল্প বয়সের প্রেম। বিষয়টি জানাজানি হতে সময় লাগলো না। একসময় চেয়ারম্যান সাহেবের কানেও তা পৌঁছল। তিনি একথা শুনে খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। একদিন সকালে রেইনট্রি গাছের ডালে আলীর ঝুলন্ত মৃতদেহ পাওয়া গেলো। আপাতদৃষ্টিতে আত্মহত্যা বলে মনে হলেও গ্রামের লোক কানাঘুষা করতে থাকে এটা আসলে খুন। আলীর মৃত্যুতে ঝুমঝুমি নির্বাক হয়ে যায়। পরেরদিন রেইনট্রি গাছের ডালে আরও একটা লাশ দেখে এলাকাবাসী স্তব্ধ হয়ে যায়। গলায় ওড়না পেচানো ঝুমঝুমির মৃতদেহ মৃদুমন্দ বাতাসে যেন দুলে দুলে বিলাপ করতে থাকে। ঐ গাছের নিচেই দুজনকে কবর দেয়া হয়। এরপরই ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই এবং  নানা ধরনের পাখি এসে বাসা বাঁধে ওই রেইনট্রি গাছে। সেই থেকে এই গাছগুলো পাখিদের দখলে। ঝুমঝুমি পাখিদের খুব ভালোবাসতো তাই মৃত্যুর পরেও পাখিরা যেন ওর মোহে আটকা পড়ে আছে ।

এই ঘটনার বছর খানেক পরেই ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় প্রবল স্রোত আর তীব্র নদী ভাঙনে পুরো গ্রামটি বহ্মপুত্রের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। শুধু এই কবরস্থানের অংশবিশেষ আর রেইনট্রি গাছগুলো যেনো কালের সাক্ষ্য বহন করে চলছে আজও। সেই থেকে সন্ধ্যার পর এই পথ দিয়ে কেউ যাতায়াত করে না। কোন নৌকাও সাধারণত যায় না ঘটনাক্রমে কোন নৌকা সন্ধ্যার পরে এ পথে গেলেই কোনো না কোনো বিপদ বা ঝামেলায় পড়েছে। আর এখন যা হলো তা তো তোরা দেখতেই পাচ্ছিস। নৌকা ঠিক হতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে? হয়তো সারারাত এখানেই কাটাতে হবে। কিভাবে রাত কাটবে, কে জানে?

মাঝি এবং আনিস নৌকার ফ্যান বদলানোর কাজে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা পেরিয়ে চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। ওদের চমকে দিয়ে হঠাৎ করেই আকাশে ঘন মেঘ করে বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হয়ে গেলো। বাতাসের লক্ষ্মণ দেখে মনে হচ্ছে ঝড়, বৃষ্টি আরম্ভ হবে যেকোনো মুহূর্তে। ধীরে ধীরে বাতাসের গতি বাড়ছে, টিপটিপ বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে। সবাই নৌকার ছাউনির ভিতরে গিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ে। মাঝি এবং আনিসও ছাউনির ভিতরে চলে এসেছে, অন্ধকার আর ঝড়ো বাতাসে কোনোভাবেই ফ্যান বদলানো সম্ভব না। কাজেই তাদের ভোর পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করতে হবে।

বাতাসের গতি ধীরে ধীরে দমকা হাওয়ায় রূপ নিচ্ছে। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকানো আর বজ্রপাতের শব্দে মনে হচ্ছে যেন কেয়ামত নেমে আসছে। সবাই আল্লাহর নাম নেওয়া শুরু করেছে মনে হচ্ছে আজ রাতই যেনো তাদের জীবনের শেষ রাত। ঢেউয়ের দোলায় নৌকা এতো উথাল-পাতাল করছে যে কোন মুহুর্তেই উলটে যেতে পারে। সবাই হাতের নাগালে যা আছে তাই ধরে আতঙ্কে শক্ত হয়ে বসে আছে। ক্রমেই বেড়ে চলেছে দমকা বাতাস আর ঝড়ের তাণ্ডব। এতো ঝড়ের মধ্যেও অনিকের কানে হঠাৎ ভেসে আসলো যেন চড়ুই পাখির হুটোপুটির শব্দ। ও ছাউনির একেবারে কোনায় বসে আছে। ছাউনির বাইরে গলা বাড়িয়ে অন্ধকারের মধ্যেই ও দেখার চেষ্টা করে পাখিদের। মুখ বাইরে বের করতেই ও মূহুর্তে একেবারে ভিজে যায়।

পাখিদের হুটোপুটির মধ্যে কেমন যেন একটা বিপন্ন আর্তরব। হঠাৎ ওর কোলের উপর কিছু একটা আছড়ে পড়ে। ও হাত বাড়িয়ে ধরতেই অন্ধকারেও বুঝতে পারে ওটা একটা চড়ুই পাখি। মনে হয় আহত হয়েছে, গা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে আছে। প্রবল মমতায় ও চড়ুইটাকে তুলে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে। ওর বুকের উষ্ণতায় চড়ুইয়ের শরীর ক্রমে উত্তপ্ত হতে থাকে। একটুপর ও খেয়াল করে ঝড়ের প্রকোপ বেশ খানিকটা কমে এসেছে। ভোরের দিকে ঝড় একেবারে থেমে যায়। ধীরে ধীরে আকাশ পরিষ্কার হয়ে সূর্যের ঝলমলে আলোয় চারপাশ ভরে উঠে। চারদিকে শান্ত সুন্দর নির্জন পরিবেশ দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় রাতের তাণ্ডব আর আতঙ্ক।

সবাই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ইতিমধ্যেই  মাঝি আর আনিস ইঞ্জিনের ফ্যান লাগিয়ে ফেলেছে। নৌকা ছাড়ার প্রস্তুতি চলছে। নৌকা বালির মধ্যে আটকে ছিল তবে গত রাতের ঝড়ের দোলায় ভেসে  উঠেছে। মাঝি নৌকা স্টার্ট  দিলে অনিক শেষবারের মতো রেইনট্রি গাছের দিকে তাকায়, ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই পাখি বসে আছে। ভোরের মিষ্টি বাতাস আর আলো-হাওয়ায় ওরা এগিয়ে চলে। ওরা যখন কামারজানি ঘাটে পৌঁছলো তখন সকাল সাতটা। গত রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সাথে নিয়ে সবাই নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অনিক মনে মনে ভাবে, ভাগ্যিস আজ শুক্রবার সারাদিন ঘুমাতে পারবো।

পরেরদিন। অনিক অফিসে গিয়ে সার্ভের কাগজপত্র ঠিক করছে। বারোটার মধ্যে পরিচালকের টেবিলে রিপোর্ট দিতে হবে। সংস্থার পরিচালক ফয়সাল সাহেব ষাটোর্ধ্ব বয়সী হলেও পরিশ্রমী মানুষ। সবসময় হাসি খুশি থাকতে পছন্দ করেন। পরিচালকের রুমে যাওয়ার সময় অনিক খেয়াল করে আজ কেনো যেনো অনেকগুলো চড়ুই বারান্দায় জটলা করছে। ও ফাইল নিয়ে পরিচালকের রুমে ঢুকতেই দেখে সামনে একটা অল্প বয়সী মেয়ে বসে আছে।

-ফাইল রাখো আমি পরে দেখ নেবো, পরিচালক আনন্দিতমুখে মেয়েটিকে দেখিয়ে ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়,

-আমার মেয়ে ঝুমঝুমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ছুটিতে এসেছে।

অনিক অবাক বিহ্বল চোখে তাকিয়ে মনের মধ্যে অজান্তেই জপতে শুরু করে ঝুমঝুমি! ঝুমঝুমি! ঝুমঝুমি! হঠাৎ করেই অফিসের জানালায় একগাদা চড়ুই এসে বসে।

+ posts

Read Previous

হারকিউলিস মাদার

Read Next

উন্নয়ন

One Comment

  • অনেক ভালো লাগলো পড়ে। ভবিষ্যতে আরও গল্প পড়তে চাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *