অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪
১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪
১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রদীপ আচার্য -
একান্তে গরলে ডোবা সন্ধ‍্যা নামে

বাড়িটার চারপাশে ইটের প্রাচীর। সদর দরজা বেশ সুরক্ষিত। বড় গেটটাতে সর্বদা তালা দেয়া। দক্ষিণের প্রাচীর লাগোয়া পাহাড়। ইটের প্রাচীরের ভেতরে একতলা পাকাবাড়ি। বাড়ির একপাশে আরেকটা পাকা রুম। রুমটা বেশ বড় আর সুন্দর করে সাজানো, আধুনিক সব ফিটিংস। রুমে ঢুকে একনজর চোখ বুলালে এতোসবের আয়োজকের বনেদি রুচি বোঝা যায়। আধুনিক সব গৃহস্থালি আসবাবের সাথে দুয়েকটা অ্যান্টিক জিনিসও চোখে পড়ে। এটা এ বাড়ির ড্রইংরুম। অতিথি কালেভদ্রে এ বাড়িতে আসে, কিন্তু প্রায় প্রতিরাতেই এ রুমে আলো জ্বলে শেষরাত্রি পর্যন্ত। এ বাড়ির কর্ত্রী জামিলা বেগমের বয়স পঁয়তাল্লিশের মতো। দুই সন্তানের জননী। এক মেয়ে আর এক ছেলে। সন্তানেরা থাকে ঢাকায়। মেয়ের বিয়ে হয়েছে আর ছেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। এ বাড়িতে ঢুকলে চোখে পড়ে স্টিলের ফ্রেমে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ঝকঝকে দোলনা। জামিলা বেগম বাড়ির উঠানে যত্ন করে দোলনাটি বসিয়েছেন। বেশ বড়। অনায়াসে দু’জন মানুষ বেশ আরামসে দোলনায় বসে দোল খেতে পারে।

এ বাড়িতে ছোট কোনো শিশু নেই। আছে চৌদ্দ বছর বয়সী এক কিশোরী। জামিলা বেগম একটি পরিবারকে রেখেছে বাড়ির দেখাশোনা আর নিজের দৈনন্দিন ফরমায়েশির জন্য। পারভীন, তার পঙ্গু স্বামী আর তাদের একমাত্র কিশোরী মেয়ে দিলরুবা, তিনজনের ছোট্ট পরিবার। পারভীনের পরিবারের থাকার জন্য মূল ভবনের সামনে টিনের একচালা ঘর। কয়েকটা ছোট ছোট রুম তাতে। বাড়ির অবশিষ্ট জায়গাজুড়ে বিভিন্ন ফলের গাছ। ফুলের গাছ তেমন চোখে পড়ে না আর বাড়ির সামনে লম্বা বারান্দায় টবে ঝোলানো বাহারি রকমের পাতাবাহার। যে কেউ বাড়িটা দেখেই একবাক্যে বলবেন পুরো বাড়িকে মায়ায় ঘিরে রেখেছে এ দোলনা। কিন্তু পারভীনের কিশোরী মেয়ে দিলরুবা দোলনায় কোনো আকর্ষণ বোধ করে না। সারাদিন তাই দোলনাটারও অলস সময় কাটে। তার স্থির দেহ নিষ্প্রাণ ঝুলে থাকে ফ্রেমে।  অপেক্ষা করে বিকেলের।

জামিলার সকালের ঘুম ভাঙে দুপুরে। সূর্যটা পশ্চিমের শেষপ্রান্তে হাই তুলতে তুলতে যখন ক্লান্ত হয়ে ঝিমোয়, তখন জামিলা বের হয়ে আসে ঘর থেকে। প্রতিদিন এ সময়েই প্রথম ঘর থেকে বের হয় সে। এসে বসে দোলনায়। আর তখনই দোলনায় প্রাণ জাগে। প্রতিদিনের মতো আজও সন্ধ্যে গড়িয়ে যাবার আগে বাড়ির খোলা উঠোনে জ্বলে একটি বাতি। তার আলো তীর্যকভাবে দোলনার ওপরে পড়ে। দেখে মনে হয় কালো এক বড় ছায়া দোল খায় একটি নির্দিষ্ট পরিসরে, বিরামহীন। যতক্ষণ পারভীনের কাজ শেষ না হয়, রাতের সব কাজ সেরে যতক্ষণ না সে জিরোবার অবসর পায়, ততক্ষণ পর্যন্ত জামিলা বেগম বসে থাকে দোলনায়। দোলনায় তার সঙ্গী একটি পানের বাটা। এ অঞ্চলের পান খুব বিখ্যাত। খেতে মিষ্টি। দূর থেকে পড়া বাতির মৃদু আলোতেও জামিলা বেগমের ঠোঁট লালচে দেখায়। সময় যত বাড়ে শুকিয়ে যাওয়া লালচে ঠোঁটের চারপাশে ভর করে খয়েরি রঙ। জামিলা আজ কাউকে ডাকে না। অন্যদিন হলে দিলরুবাকে ডেকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে। আজ কেমন এক শূন্যতা পেয়ে বসে তাকে। এ সময়ে পারভীনও বাড়িতে নেই। দিলরুবা এসে উঁকি দিয়ে যায়। অপেক্ষা করে জামিলার কথা শোনার। জামিলার আজ কোনো কিছুতে খেয়াল নেই। দিলরুবা তবু জিজ্ঞেস করে,

আপনার কিছু লাগবো? চা খাইবেন?

জামিলা মৃদুস্বরে বলে,

একটু পর।

দিলরুবার কানে উত্তরটা পৌঁছায় কি-না বোঝা যায় না। সে চলে যায়।

অগ্রহায়ণের মাঝামাঝিতে একটু একটু ঠান্ডা হাওয়া বয়। বিকেলের আলোকে বড় অচেনা মনে হয় আজ জামিলার, এ যেন অন্য এক আলো। অচেনা এক নীরবতা। নিজের হাতের দিকে চোখ পড়ে। গতকাল পারভীন মেহেদী দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছে। জামিলা দেখতে থাকে নিজের হাত দুটো। মেহেদি রাঙা হাত আজ কি প্রসারিত করতে চায় তার সীমানা আকাশের দিকে! মেয়ের বিয়ের সময় তার হাতে রাঙানো মেহেদি দেখে দেখে নীরবে কেঁদেছিল জামিলা। এক অকারণ কান্না। কেন কেঁদেছিল? উত্তর মেলেনি। আজও ভাবে জামিলা। ভাবনার কুলকিনারা পায় না খুঁজে। দোলনার মৃদু দুলুনি জামিলাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় জীবনের অন্য কোনো আখ্যানে। যেখানে পথটা অনেক দীর্ঘ। নারীর হৃদয়ে প্রেম কখন আসে সে প্রশ্নের উত্তর কি ব্যাখ্যাতীত নাকি সমাজের চিরায়ত নিয়মে শৃঙ্খলিত। যে কিশোরী খেলতে খেলতে বধূ হয় তার জীবনেইবা প্রেম কখন আসে? এমন কতশত বালিকা বধূর উত্তর মেলে না জীবনব্যাপী। কখনো তার ঝলক লাগা গোপন প্রেম মরে যায় গোপন হাহাকারে। এতোসব ভাবার সুযোগ হয়নি কিশোরী জামিলার।

একুশ বছর বয়সে প্রথম প্রেম আসে তার জীবনে। ততদিনে তার জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা স্বামীর সংসারে। ততদিনে জামিলা দু’সন্তানের মা। কিশোরী জামিলা বয়স্ক স্বামীর হাত ধরে স্বামীর বাড়িতে আসে পনেরো বছর বয়সে। স্বামী প্রবাসী। থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। অপরিচিত বয়স্ক এক মানুষের সাথে এক বিছানায় শোয়া, দৈনন্দিন কাজের মতোই যৌন সম্পর্কে যাওয়া, সন্তান ধারণ, এসবই কি তবে প্রেম! জামিলাকে শেখানো হয়েছিল এই হলো বন্ধন। এ বন্ধনকে ঘিরেই মানুষের সকল সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না। এতোকিছুর পরেও কোথাও যেন কী এক শূন‍্যতা থেকে গিয়েছিল জামিলার জীবনে। সে শূন‍্যতার নামই কি তবে প্রেম! যে বাঁধভাঙা আকর্ষণ তাকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল ঘর, সন্তান, আর সামাজিক পরিচয় থেকে! সেদিন এলাকায় সকাল থেকে কানাঘুষা শুরু হয়েছিল। দুবাই আমিনের বউ না-কি কারো সাথে পালিয়েছে। এ কী কথা! এও কি সম্ভব! দু-দুটো বাচ্চা রেখে এভাবে কি কোনো মা অন্যের সাথে পালিয়ে যায়! কিসের অভাবে। ছি ছি ছি। দুপুর হতে না হতে কানাঘুষা সত্য প্রমাণিত হয়। সেদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রেমিকের হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছিল জামিলা অজানার পথে।

ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়ে সেখানেই কথা হয়েছিল প্রথম। প্রথম দেখায়ই তাকে ভালো লেগেছিল জামিলার। তামাটে ফর্সা চেহারা, দীর্ঘদেহী, মুখে অল্প অল্প দাড়ি। তার ঘোলাতে চোখ, মনে হয়েছিল সে চোখে এই বুঝি নেমে গেল বর্ষার প্রথম ধারা। সে চোখ জোড়ায় আটকে গিয়েছিল জামিলার চোখ। সেদিনের আলাপের পর বুকের ভেতর কী যে এক আকর্ষণ অনুভব করেছিল জামিলা। শুরু হয়েছিল ফোনে কথা বলা, দেখা করা আর আরো কাছাকাছি থাকার প্রতিশ্রুতি। বন্ধন ভাঙার সাহস নিয়ে জামিলা জন্মেনি। স্বপ্ন দেখা তাকে শিখিয়েছিল সাহসী হতে। সেই প্রথম তার অন্তরাত্মা জানান দিয়েছিল পুরুষের স্পর্শের প্রত‍্যুত্তরে জাগা অমিয় অনুভব। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় জামিলা সাথে কিছুই নেয়নি সেদিন। সবাইকে ঘুমন্ত রেখে নীরবে বাড়ির গলিটার পথ ধরে হেঁটে এসে দাঁড়িয়েছিল বড় রাস্তার ওপর। আগেই দেখতে পেয়েছিল প্রেমিক দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। পাশে একটি সিএনজি অটোরিকশা। দূর থেকে তাকে দেখেই হাঁটার গতি বেড়ে গিয়েছিল জামিলার। কী এক দুর্বার অনুভব ভর করেছিল তার শরীর-মনে। প্রেমিকের কাছে গিয়ে দু’জনে একে অন্যের দিকে চেয়ে হেসেছিল এক ঝলক। কথাহীন নীরব চাহনি। অতঃপর হাত ধরে উঠে পড়েছিল অটোরিকশায়। পাগলা ঘোড়ার মতো রিকশা ছুটল অজানার পথে। প্রেমিকের বুকে মাথা রেখে জামিলা চুপ ছিল কিছু সময়।

তার ভাবনার সুতো ছড়িয়ে পড়েছিল এদিক-ওদিক। টিনের চালে শব্দ হলে ভাবনায় ছেদ পড়ে জামিলার। হয়তো গাছের ছোট কোনো বুড়ো ডাল ভেঙে পড়েছে টিনের চালে। দিলরুবাও আসে হাতে চা আর কয়েকটা বিস্কিট নিয়ে। জামিলার নিজের ফরমায়েশি কাজগুলো অধিকাংশই দিলরুবা করে। দু-এক ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে সে। এখন তার অধিকাংশ সময় কাটে গৃহস্থালি কাজে আর বাপের দেখাশোনায়। পারভীনের পঙ্গু স্বামী আজ তিন বছর হলো বিছানায়। রাজমিস্ত্রির কাজ করত লোকটা। তিনতলা থেকে সোজা নিচে পড়ে গেলে সবাই ভেবেছিল মরেই যাবে। সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও কোমরে চোট পেয়েছিল ভীষণ। তারপর আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না সে। উঠে বসতে গেলেও সাহায্য লাগে। পারভীন বাসাবাড়ি আর অফিসে কাজ করে সংসার চালায়। মাঝে মাঝে অন্য কাজের ডাক পড়লে সেখানেও যায়। অধিকাংশই রাতের কাজ। জামিলার বাড়িতে তারা আছে আজ তিনমাস। বিনে ভাড়ায়।

জামিলা বেগম একা থাকে। অন্তত কথা বলার মানুষ তো চাই! মানসিক বোঝাপড়া কখনো কখনো মানুষকে চালিত করে অপ্রত্যাশিত পথে। নিজেকে তখন চেনা যায় না। কামকেই মনে হয় প্রেম। এ এক সম্মোহন, যা জামিলাকে ডুবিয়েছে অতল গহ্বরে। এ গহ্বর থেকে ফেরার পথ বড় কঠিন। তেমন মুহূর্তগুলোতে মানুষ বড় একা। অসহায় আর নারী যেহেতু, তাই পৃথিবীর যাবতীয় অবহেলা তার প্রাপ্য। প্রেমিকের সাথে নতুন দাম্পত্যের কিছুদিন যেতে না যেতে জামিলা খেয়াল করে প্রেমিকের হৃদয়ের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়েছে, কমতে শুরু করেছে আবেগ। হাত দিলে অনুভূত হয় গাঢ় শীতলতা। চির ধরতে শুরু করে প্রেমিকের সাথে জামিলার দাম্পত্যে। প্রেমিক মনোযোগী হয় নতুন এক সুন্দরীতে। জামিলার বুঝতে আর বাকি থাকে না কিছু। এ তো প্রতারণা। সমাজ-সংসার যে বন্ধন শিখিয়েছিল সে তো ঢের ভালো ছিল। প্রেমের প্রকাশ তবে ঘোরতর পাপ! নিজেকে শেষ করতে চেয়েও পৃথিবী থেকে তার বিদায় নেয়া হয়নি, চিরতরে সে মুছে ফেলতে চেয়েছিল তার গ্লানি, পরম মমতায় আলিঙ্গন করতে চেয়েছিল মৃত্যুকে। এখানেও নিয়তিই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে বারবার। অবর্ণনীয় মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কেটেছিল তার অনেকটা সময়। বাকি ছিল কেবল মানসিক ভারসাম্যহীনতা।

সন্তানদের কথা চিন্তা করে প্রথম স্বামী তাকে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছিল আবার। জামিলাকে সুস্থ করতে বারবার শরণাপন্ন হয়েছিল মানসিক ডাক্তারের। বছর দুই পর সেই স্বামীও মারা গিয়েছিল জামিলার। হয়তো মনে মনে জানা হয়ে গিয়েছিল এ পৃথিবীতে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। তাই হয়তো চেষ্টা ছিল, সন্তানেরা অন্তত যেন বেড়ে ওঠে মাতৃস্পর্শে। জামিলা শতচেষ্টা করে ঘুরে দাঁড়ানোর কিন্তু একান্ত অবসর তাকে একাকী বাঁধনে বেঁধে রাখে একসমুদ্র কান্নায়। সময় গড়িয়ে যায়, কিন্তু জামিলার প্রণয় আর দাম্পত্যের বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা তাকে কুরে কুরে খায়। জামিলার ভাবনায় নীরবে হানা দেয় পারভীন। ঘোর কাটে জামিলার। পারভিন এসে দাঁড়ায় সামনে। মগ্নতা থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগে কিছুটা, তারপর বলে,

এই এলি?

হুম।

রাত কয়টা বাজে?

নয়টার কাছাকাছি।

গোসল করবি?

হুম গোসল কইরা আসি। ওমা, আপনে তো চা-টা খাইলেন না। ঠান্ডা বরফ হইয়া গেল যে।

ভুলে গিয়েছিলাম, যা তুই গোসল সেরে নে।

যাইতাছি।

আপনারে আরেক কাপ চা দিক?

না। লাগবে না। তুই যা। বলেই পানের বাটায় হাত দেয় জামিলা।

পারভীন সুশ্রী, দীর্ঘদেহী, বেতের মতো লিকলিকে আর মেদহীন দেহ। আঁধার নেমে এলে কোনো কোনোদিন তার ডাক পড়ে। সাজসজ্জার উপকরণ ব্যাগে নিয়ে বের হয়। চিরুনী, সস্তা বডি স্প্রে, খয়েরি লিপস্টিক। সেজেগুজে অপেক্ষা করে হোটেলের রুমে। পর্যটন নগরীতে পারভীনের মতো কতশত নারী দেহ বিক্রি করে, বিক্রি করতে হয়। জামিলা বোঝে পারভীনের সংগ্রাম। তাই পারভীনের ভরসা এ বাড়িতে হয়তো লম্বা একটা সময় থাকতে পারবে সে পরিবার নিয়ে। খদ্দেরের মনোরঞ্জন করে ঘরে ফেরে পারভীন। জামিলাকে বলে, অন্তত খেয়ে-পরে বেঁচে আছে তিনটা প্রাণ। জীবন তাকে শিখিয়েছে বাঁচতে হলে লড়তে হবে। গোসল সেরে রাতের খাবার খেয়ে পারভীন জামিলার কাছে যখন আসে, তখন রাত প্রায় দশটা। জামিলা অপেক্ষায় ছিল পারভীনের। প্রায় রাতেই জামিলা খায় না। অনিয়মই সয়ে গেছে তার প্রাত্যহিকতায়। ঘুম, খাওয়া কোনো কিছুরই ঠিক নেই। শাসন করার মতো কেউ কাছে না থাকলে মানুষ হয়তো এমনই নয়। একাকীত্বের জীবনে বাউণ্ডুলেপনা। জামিলা বললে পারভীন বাইরের রুমের তালা খোলে। জামিলা বলে, আমার চুলে আজ দিলরুবার মতো বিনি করে দে তো। আজ আমাকে সাজিয়ে দে কিশোরীর সাজে। আজ বড় ইচ্ছে করছে সে বয়সে চলে যেতে। আবার যদি কিশোরী বয়সের সে সময় থেকে শুরু করা যেত জীবন! পারভীন শুনে মৃদু হাসে। বলে না কিছুই। চিরুনী আর চুলের লাল ফিতে নিয়ে আসে। আসার সময় দিলরুবাকে বলে, তোর বাপে ঘুমাইলে লাইটটা নিভাইয়া দে। তুইও শুইয়া পর। কথাগুলো বলে দু’জনে পা বাড়ায় বসার ঘরের দিকে। পেছনে পড়ে থাকে দোলনাটা। সঙ্গীহীন রাতের এমন প্রহরে দোলনার বুকে পাষাণ ভর করে।

রুমের ভেতর মসৃণ, সুন্দর আর বড়সড় সোফা। জামিলা আর পারভীন পাশাপাশি বসে। জামিলা তার চুল ছড়িয়ে দেয়। পারভিন সযত্নে জামিলার চুলে চিরুনী চালায়। ইদানীং জামিলার একাকী জীবনের মনোবেদনার ইতিকথা শোনার একমাত্র সঙ্গী পারভীন। সন্তানদের মায়ের কাছে আসার সুযোগ নগণ্য। উৎসবে তাদের সাথে দেখা হয় মায়ের। জামিলা পারভীনকে বলে,

আমরা সমাজ থেকে শিখি আবার বইপুস্তকেও পড়ি, নারী পূর্ণতা লাভ করে সন্তান জন্ম দিয়ে। যে বয়সে আমি মা হই আজকাল সে বয়সী কিশোরীরা ছুটোছুটি করে। তখন কী-ই-বা বুঝলাম পূর্ণতা অপূর্ণতা। যখন একটু একটু করে বুঝতে শিখি তখন সন্তানদের কাছে আমি এক পরিচিত মানুষ ছাড়া অন্য কোনো পরিচয় দেখতে পাইনি নিজের।

কথাগুলো বলে থামে জামিলা। মনে মনে অনুচ্চারে বলে, তোমার সন্তানরা তোমারই মতো, আমাকে করুণা করে। এ যে দুঃসহ যন্ত্রণা! ঘৃণা করলে বেঁচে যেতাম।

এবার আয়নায় দেখেন কেমন মায়াগো লাহান লাগতাছে আপনারে!

পারভীন হেসে হেসে বলে। জামিলা আয়নার দেখে। পারভীন কত যত্ন করে চুলে বিনুনি করে দিয়েছে। জামিলা কল্পনায় ফিরে যায় কিশোরী বয়সে। মনে পড়ে বিয়ের দিনের কথা। শরীরে পুরুষের প্রথম স্পর্শ। মনের ভেতর ধুলোর প্রলেপে অস্পষ্ট অনেক মুহূর্ত ফুঁ দিয়ে সাফ করতে করতে সজীব হয়ে ওঠে মনের ভেতরটা। পারভীনকে বলে,

খদ্দের আজ কেমন ছিল রে?

পারভীন হেসে উত্তর দেয়,

চেংরা পোলা। এ লাইনে নতুন। ভয় পায়। বিছানায় শুইতে না শুইতে আউট।

বলতে বলতে দু’জনই হাসে।

রাতের এ সময়টাতে এ রুমে এলে দু’জনই মুছে ফেলে তাদের আত্মপরিচয়। যেন দু’জন কিশোরী। পারভীন গান ধরে, প্রাণ সখী রে ওই শোন কদম্ব তলে বংশী বাজায় কে… গাইতে গাইতে কার্পেটের ওপর নেচে ওঠে পারভীনের দেহ। একের পর এক গানের মূর্ছনায় বাড়তে থাকে রাতের প্রহর। একান্ত প্রহরে হানা দেয় বহু বছরের ঘুমিয়ে থাকা অতৃপ্ত বাসনা। যেন মস্তিষ্কের ভেতর অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে গড়িয়ে পড়ে দেহ-মনে নীলাভ লাভা। থরথর করে কাঁপতে থাকে জামিলার শরীর। রুমের এতো আলো আর যেন সহ্য হয় না। দরকার গভীরতম অন্ধকার। অন্ধকারেরও এক ধরনের আলো থাকে। পারভীন এ ক’মাসে জেনে গেছে সে আলোয় নতুনের আস্বাদ নিতে জামিলার আরেকটা সমর্পণ দরকার। সে জামিলার কপালে হাত রাখে। হাত বুলিয়ে দেয় কপাল থেকে মাথা পর্যন্ত। জামিলা আরো অনুভব চায়। পারভীন নিজের হাতের আঙুলে জামিলার আঙুল জড়ায়। জামিলার গোপন হাহাকার অশ্রু হয়ে ভিজে যায় দু’জনের গোপন প্রণয়ে। পারভীন ভালো করেই বোঝে জামিলাকে, জামিলার আজও বড় প্রয়োজন একান্ত আপন কাউকে…

Print Friendly, PDF & Email
প্রদীপ আচার্য

Read Previous

সংযোগ

Read Next

মৃত হাঁস, মাতাল ও একটি মানবিক গাছ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *