অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৩, ২০২৪
২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৩, ২০২৪
২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সালমা লুনা -
কামরাঙা ফুল ভোর

-এই অবস্থায় আমি তোমরারে ঢুকতে দিতে পারুম না, শেষ কথাটি বলে মুখের উপর যখন টিনের গেটটা বন্ধ করে দিলো মন্নাফ মিয়া, বুকটা কেঁপে উঠলো মাজেদার। তার বুকের কাঁপুনির সাথে পাল্লা দিয়ে ঠাস শব্দে বন্ধ হয়ে ল্যাগবেগে টিনের পাল্লাটাও কয়েক সেকেন্ড ধরে কাঁপলো। তালায় চাবি দেয়ার পরিচিত শব্দটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য ফাঁকা হয়ে গেল মাথা। তারা এখন যাবে কোথায়! শরীর ভেঙে আসছে ক্লান্তিতে। রাত বেশি না হলেও হলুদ সৌর বাতির নিচে নির্জন রাস্তা ভৌতিক লাগে।

মাজেদা আর রেখার মুখে সদ্যই পরতে শেখা নীল রঙা মুখোশ। মুখোশের উপর দিয়ে দুজন দুজনের চোখে তাকিয়ে থাকে । কাছের ফুটপাতে বসে পড়ে দুজনে। খেয়াল করে মাজেদা, কী সুন্দর লাল হলুদ রঙের উঁচু ফুটপাত। মাজেদা আশেপাশে তাকায়, দুপাশেই নতুন ফুটপাত, রাস্তাও মেরামত হয়েছে। তারা চলে যাওয়ার পর কয়দিনে এসব হয়েছে!  কতো সুন্দর লাগছে মসৃণ রাস্তাটা। যেন সিনেমায় দেখা বিদেশ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে, এই শহর সুন্দর হলেই তাদের মতো গরীবদের কী!

কে না জানে, এই শহরের সব সৌন্দর্য কেবল এই শহরের বড়লোকদের জন্য। গরীব যেমন অসুন্দর গরীবের বস্তি তারচেয়েও অসুন্দর। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার পাশে  অনেকটা জায়গা জুড়ে রিক্সা গ্যারেজ, গাড়ি মেরামত কারখানা আর প্রায় তিরিশটি আধাপাকা ঘর নিয়ে গড়ে উঠা নিম্ন আয়ের মানুষের বস্তি। মন্নাফ মিয়াও আসল মালিক না। আসল মালিক নাকি কোন এক নেতা! মন্নাফ মিয়া তার খাস লোক। তবু তাকেই সবাই বাড়িওয়ালা বলে।

বস্তি মানে পাঁচ ইঞ্চি পলেস্তারাবিহীন ইটের দেওয়াল আর টিনের হেলে পড়া ঠনঠনে একটা ফটকের ভেতরে বেশ কিছু নারকেল, আম, আর কাঁঠাল গাছের সাথে একটা বেঁটে সেগুন আরেকটা ঘন পাতার ঝোঁপালো কামরাঙা গাছের সহাবস্থানে সারি সারি একচালা খুপরি ঘর। খানিকটা উঠোন, তার সাথে বারোয়ারি রান্নাঘর, কলতলা, পায়খানা আর টিনের ঘেরাও দেয়া গোসলখানা।

পাশেই বাড়িওয়ালার পাকা বাড়ি। গ্রিলঘেরা একতলা। তার উপর ইটের দাঁত বের করা নির্মীয়মান অর্ধেক বাড়ি। সেটাও ভাড়া দেয়া। নিচের খুপরি ঘরগুলোর একটাতে মা আর আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে থাকে মাজেদা । রেখা তার ঘরে সাবলেট থাকে। এরও আগে মাজেদা মোশাররফের সঙ্গে থাকতো। মাত্র তিন মাসের পরিচয়ে দু-চারজন স্বাক্ষীর সামনে তিনবার কবুল পড়ে  বিয়ে হয়েছিল মোশাররফের সাথে। ভালোই কেটেছিল দেড়টা বছর।  তারপর ছেলে হলো। ছেলে পেটে থাকতেই  মোশাররফের আচরণ বদলে যেতে শুরু করলো। নাইট ডিউটির নাম করে ঘরে আসতো না তিন চারদিন।এরপর হঠাৎ হঠাৎ উধাও হওয়া শুরু হলে খোঁজখবর করে জানতে পেরেছিল আরেকটা বিয়ে করেছে মোশাররফ৷ বউ নিয়ে মাওনা চৌরাস্তায় থাকে।

জিজ্ঞাসাবাদে মোশাররফ স্বীকার করেছিল সব। সহ্য হয়নি মাজেদার। দেড় বছরের সংসারের সবকিছু পেছনে ফেলে এক বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে নিজের সবকিছু ফেলে নিজের কর্মক্ষেত্র গার্মেন্টস কারখানার কাছে এই বস্তিতে এসে উঠেছিল সে। মাকেও গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিল নিজের কাছে। বাবা নেই, ভাইরা মাকে ছাড়তে অমত করেনি। মায়েরও ঢাকা শহরে থাকার শখ ছিল। সন্তান আর মাকে নিয়ে একান্তই নিজের একটা সংসার গুছিয়ে নিয়েছিল সে। তার সংসারের সেই কর্তা, সেই মালিক এই ভাবনাটা থেকে থেকে তাকে অন্যরকম পুলক দেয়। মেয়েমানুষের স্বামী না থাকলে সে খোলা খাবার, তাতে মাছি বসবেই।  মসজিদের মাইকে জুম্মাবারে বহুবার শুনেছে সে একথা। আবার বিয়ে করার কথা মা ,ভাইরা এবং আরও অনেকেই বলেছে। তবু তার ইচ্ছা করে না। কতজন ইশারা ইঙ্গিত করে। কাউকেই ভালো লাগে না৷

এমন না যে মোশাররফকে সে ভালোবাসে। সারাজীবন একলাই থাকবে এমন চিন্তাও করেনি ।  ভেবেছে বিয়ে যদি আবার করতেই হয়, তবে এবার খুব হিসেব করে করবে। চাল,ডাল, তেল, নুনের হিসেব, বাড়ি ভাড়ার হিসেব, দৈনন্দিন বাজার খরচায় দুজনের হিসেব কত তা আগেই  মিলিয়ে নিয়ে তবে বিয়ে করবে।  আর ভালোবাসার হিসেব নয়। ভালোবেসে দেখেছে সে। এইসব ভাবনা-চিন্তা, চাকরি, মা আর ছেলেকে নিয়ে স্বাধীন জীবন ভালোই চলছিল। কিন্তু এই করোনা নামের এক বিদঘুটে অসুখ এসে সব বদলে দিলো।

ওদের গার্মেন্টস একদিনের ঘোষণায় হুট করে বন্ধ হয়ে গেল। এরপর যানবাহন বন্ধ হয়ে সারা দেশ অচল হয়ে যাবে- কানাঘুঁষা শুনে সবার মতো সেও মা আর ছেলেকে নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল। বাড়ির সকলেই ফোনের পর ফোন দিয়ে বলছিল,

-আইসা পর। গেরাম দেশে করোনা নাই।

তাদের সাথে রেখাও  গিয়েছিল।  ভালো বেতন পায়। ওভার টাইম করে। মোটের উপর অভাব নাই মাজেদার। নিয়মিত ভাড়া শোধ করে সে। বাড়িওয়ালাও লোক ভালো, ব্যবহারও খারাপ না। কিন্তু আজকে তার এমন ব্যবহার! ঢুকতেই দেবে না! বেশিরভাগ ঘর খালি। হুলুস্থূল করে তখন যারা চলে গিয়েছিল। এখন তারা ফিরে আসলেই, মন্নাফ মিয়া কাউকেই ঢোকাবে না বাড়িতে। তার কথা পরিষ্কার, এই রোগ বালাইয়ের দিনে তারা কতো লোকের সাথে মিলেমিশে রাস্তা দিয়ে, বাসে, ট্রাকে করে এসেছে। বাড়িতে ঢুকতে দিয়ে শেষে কি নিজেরা রোগে ভুগে মরবে নাকি! কোয়ারেন্টাইন নাকি কী করতে হবে। সেইটাই বা কীভাবে করে তাও জানা নাই কারো। তাই তারা যেনো যেভাবে পারে আজই গ্রামের বাড়ি চলে যায়।

গেটের ভেতর থেকে এই কথাগুলো শুনিয়ে তালা দিয়েছে মন্নাফ মিয়া। এখন যে তাদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি  নাই- কথাটা শুনলোই না মাজেদার। আশ্রয় নাই, পেটে দানা নাই। সন্ধ্যারাতেই দোকানপাট সব বন্ধ। লোকজন নাই, দোকান খুললে কেনাকাটা করবেই কে? অথচ এই রাস্তাটা সরগরম থাকতো মাঝ রাত অবধি। গ্যারেজে দোকানে হিন্দি গান বাজতো জোরে জোরে, দোকানে দোকানে সারাদিন ছোটো টিভিগুলো  চলতো। এখন কেমন সুনশান ঘুমন্ত ভুতুড়ে।

রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ দু-একজন মানুষ দ্রুতগতিতে হেঁটে যায়। সবার মুখেই মুখোশ। সবাই যেন চমকে চমকে উঠে পরস্পরকে দেখে। ভীষণ কান্না পায় মাজেদার। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। খাবার চাই, একটা বিছানা চাই ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরটা এলিয়ে দেয়ার জন্য। মাত্র কয় পা দূরেই নিজের ঘর, নিজের বিছানা। অথচ যেতে পারছে না। হোক ভাড়ার, তবু নিজের ঘরই আজ তার পর।

রেখা মেয়েটার বয়স কম। সে বসে ঝিমুতে ঝিমুতে ফুটপাতেই উড়না বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে। মেয়েটার বিয়ে হয়নি এখনো। সহসাই হবে বলে মনে হয় না। হাড় জিরজিরে চিকন একটা কালো মেয়ের সহজে বিয়ে হয় না এদেশে। আবার যদি তার ঘাড়ের উপর এক্সিডেন্ট করে পা ভাঙা পঙ্গু বাপ, অসুস্থ মা আর তিন ভাইবোনের দায়িত্বের জোয়াল চেপে বসে থাকে, তাহলে তো আরও হয় না। রেখাকে মানুষের বাসায় কাজে দিয়েছিল ওর মা। সেখানে ওর মন বসেনি। মানুষের বাসায় কাজের চেয়ে গার্মেন্টসের কাজটাকেই ওর বেশি ভালো মনে হয়েছে। তাই বছর দুয়েক এক বাসায় কাজ করে এক ঈদের পর বাড়ি ফিরে মাজেদাকে পেয়ে হাতেপায়ে ধরেছিল,

-বু গো, আমি গারমেন্স করমু। আমি বাসার কাম করতাম না। আমারে তুমার লগে নিয়া যাও। এমনে মায়ে আমারে দিতো না। তুমি বুজায়া কইলেই দিবো।

মাজেদার কথা শুনেছিল পাড়াত চাচি রেখার মা। এনে একটা গার্মেন্টসে প্রথমে ছোটখাট কাজে দিয়েছিল। রেখার ইচ্ছাশক্তি অনেক, বুদ্ধিও খুব প্রখর। দ্রুত কাজ শিখেছে। বছরখানেক হলো রেখা তার সাথে একই গার্মেন্টসে আছে। কাজে মনোযোগী, ভালো বেতন পায়, ওভারটাইম করে অনেক। চাকরি করে মায়ের আলসারের চিকিৎসা করিয়েছে। কীভাবে কীভাবে যেন বাপের জন্য কোনো এক সাহায্যকারী সংস্থা থেকে হুইলচেয়ার সাহায্য পেয়েছে। একমাত্র ভাইটা বখে গেলেও বোনরা স্কুলে যায়।

মাজেদা নরম চোখে রাস্তার অল্প আলোয় শুয়ে থাকা রেখাকে দেখে, ওর হাতে হয়তো টাকাও নেই।

মাজেদার হাতেও সামান্য কটা টাকাই আছে। টাকা থাকলে কী হবে! দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। অন্য সময় কেউ চিন্তাও করতে পারতো না এই এলাকার দোকানপাট এমন সন্ধ্যারাতেই বন্ধ হয়ে যায়। সেই ভোরে খেয়ে বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে। এরপর আর দানা পড়েনি পেটে। ভেবেছিল ফ্যাক্টরির গেইটের সামনে থেকে কিছু কিনে খাবে। সব বন্ধ। ফ্যাক্টরিতে এসে শুনেছে ছোটো ছোটো খাবারের দোকানগুলো নাকি খোলেই না। মাজেদার অস্থির লাগে, মালিকরা কি জানে না এই খবর? তারা এতগুলো মানুষ সারাদিন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। খাওয়া নাই, দাওয়া নাই। বেতনটাও দিলো না। এই মানুষগুলো খাবে কী একবারও ভাবলো না!

অথচ তাদেরকে দিয়েই মালিকদের কতো টাকা রোজগার হয়। সেই টাকায় তারা বিশাল বিশাল বাড়িতে থাকে। কালো গ্লাসে ঢাকা চকচকে গাড়িতে চড়ে। মাজেদা শুনেছে তাদের মালিকের বউ বাচ্চা নাকি সব বিদেশে থাকে। তারা সেইখানেই স্কুল-কলেজে পড়ে৷ তা হোক। যার যেমন জীবন। কিন্তু সবাই মানুষ তো! তাদেরকে মানুষ বলেই মনে করবে না এ কেমন কথা! রেখা ঘুমের মধ্যে হেসে উঠে, কী যেন বলে অস্ফুটে। আহারে মানুষের জীবন। ভাবে মাজেদা, সুখের খোঁজে ঘোরে, কত অল্পতেই সুখ। কিন্তু সুখ স্থির থাকে কই? হাতের ছোটো পলিব্যাগে করে দু-চারটে কাপড় এনেছিল তা থেকে একটা উড়না বের করে সস্নেহে রেখার গায়ে মেলে দেয় সে।

বাস বন্ধ। ট্রেনও বন্ধ থাকবে তারা বোঝেনি। রোগের প্রকোপ বেড়েছে তাই আর্মি নেমেছে। তারা কিছু চলতে দিচ্ছে না। টেলিভিশনে গার্মেন্টস খুলবে, কাজে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না এইরকম খবর দেখে তারা কয়েকজন বেরিয়ে পড়েছিল। গফরগাঁও বাজার থেকে আর্মির চোখ ফাঁকি দিয়ে ট্যাম্পু চলছে। পথে দুইবার ট্যাম্পু বদলে এসেছে গাজীপুর চৌরাস্তা। এসে দেখে, তার মত শত শত মানুষ হাঁটছে। যেন বিশাল মিছিল । ঠিক যেমন বর্ষাকালে বাড়ির পাশের কালীবানার নদীর স্রোতে অজস্র কচুরিপানা গায়ে গা লাগিয়ে তরতরিয়ে চলে, সেভাবেই মিছিলের সাথে ভাসতে ভাসতে শহরে এসে ঢুকেছে এতগুলো মানুষ। কচুরিপানার জীবনই তো তাদের। সেই যে কবে থেকে ভেসে চলেছে। তার শেষ কোথায় জানে না কেউ।

বিধ্বস্ত সবার সাথে তারা যখন ফ্যাক্টরির সামনে এসে পৌঁছেছিল তখন মধ্যদুপুর। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হলেও তখন অন্যকিছু  নিয়ে ভাবার সুযোগ হয়নি।

এসেই শুনেছে ফ্যাক্টরির দরজা খুলবে না। আবার বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি ঘোষণায়। হুট করে ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কারো বেতন হয়নি। যদি বেতনটা হয়, এই আশায় ওখানেই সবার সাথে বসে ছিল সন্ধ্যে অবধি। খাওয়া দূর, বেতনের কোনো সম্ভাবনা না দেখে  নিজেদের ডেরায় এসেছে। মাজেদা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বাড়িওয়ালার ঘরে বাতি জ্বলছে। পাশ দিয়ে মুখোশপরা একজন হেঁটে যেতে যেতে খুব কাছে এসে গান গায়, বড়লোকের বেটি লো লাম্বা লাম্বা চুল… আবছা আলোয় চোখদুটি দেখে কিছু বোঝা যায় না। গলাটা চেনা চেনা লাগে। দ্রুত হেঁটে চলে যেতে যেতে মানুষটা আবার পেছন ফিরে দেখে মাজেদাকে। পা টেনে টেনে হাঁটার ধরন দেখে বুঝতে পারে মাজেদা, এ পাড়ার দোকানদার শফিক! শফিকই একটা পা সামান্য টেনে হাঁটে। শিউরে ওঠে সে।

এই এলাকায় একমাত্র দোকানি সে যে চাল,ডাল, মশলাপাতিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখে। আবার বাকিও দেয়। এলাকায় অনেক গার্মেন্টসকর্মী। তারা সকলেই প্রায় বাকি নেয়। শফিকের আচরণ, চোখের চাউনি মাজেদার মোটেই ভালো লাগতো না, তাই পারতপক্ষে বাকি নিতো না সে। নেয়ার প্রয়োজনই হতো না তার। তবু শফিক প্রায়ই তাকে এটা সেটা দিতে চাইতো। ওজনে বাড়তি দেয়া, ছেলের জন্য ললিপপ, সুগন্ধি সাবান, বডি স্প্রে দেয়ার প্রস্তাব শক্তভাবেই ফিরিয়ে দিয়েছে সে প্রতিবার । শফিকের এইসব জিনিস দেয়ার আড়ালে আছে ঘিনঘিনে কুপ্রস্তাব- জানে সে। অনেকে বাধ্য হয়েই তার প্রস্তাবে সাড়া দেয়, এটাও জানে সে।

শফিক ক্ষমতাধর। মসজিদ কমিটিতে সে আছে আবার রাজনীতির মিছিলেও সে আছে। ওর ক্ষমতা আছে বলেই এখানে আর কেউ দোকান দিতে পারে না। সবাই বাধ্য হয় ওর কাছ থেকে সদাইপাতি নিতে। তবু শফিককে সে এড়িয়ে চলে। আজ সেই শফিককে এমন অন্ধকারে দেখে ভয় পায় মাজেদা। আড়চোখে দেখে নেয় পাশেই একটা আধলা ইট পড়ে আছে। আর তারা দুজন আছে, শফিক তো একলা- ঢোক গিলে ভাবে মাজেদা । দূরে গাড়ির শব্দ পাওয়া যায়, হইহই করে কেউ গান গাইছে। একটা হেডলাইট এগিয়ে আসে। মাজেদা তৃষ্ণার্ত চোখে অপেক্ষা করে কোনো মানুষের।

ঘন্টাখানেক পর নিজের ঘরের জানলা দিয়ে আকাশ দেখে মাজেদা। মাঝরাতে আকাশে অর্ধেক চাঁদ। চাঁদে কী মায়া! সেই মায়া ছড়িয়ে পড়েছে সেগুন আর কামরাঙা গাছে। কামরাঙা গাছটায় ঝেঁপে ফুল এসেছে। চাঁদের আলোয় ফুলগুলো চকচক করছে । কিন্তু রঙটা ভালো করে বোঝা যায় না। পাশে সেগুনের বড়ো বড়ো পাতাগুলো অদ্ভুতভাবে দুলছে। যেন হাত বাড়িয়ে থেকে থেকে থাবা দিয়ে ধরতে চাইছে নরম ফুলগুলোকে। ভুতুড়ে দৃশ্যটা দেখেও ভয় লাগে না মাজেদার।

ভয় মানুষকে পায় মাজেদা। মানুষই মানুষকে ভয় দেখায় আবার মানুষই মানুষের  উদ্ধারকর্তা – আল্লাহর এ কেমন  হিসাব বোঝে না মাজেদা। তবে এই হিসাব বোঝে যে, পেট খালি থাকলে ভয় জেঁকে ধরে। পেট ভরা থাকলে মানুষের সাহস বাড়ে। মাথার উপরে ছাদ থাকলে মানুষের সাহস আরও বাড়ে৷ মাজেদার এখন বুক ভরা সাহস। ভরাপেটে ছেলেগুলোর কথা ভাবে মাজেদা। যারা গাড়ি করে এসে ওদের দুইজনের হাতে দিয়ে গেছে সবজিমেশানো ল্যাটকা খিচুড়ি আর আধখানা ডিমের তরকারির একটা করে প্লাস্টিকের বাকসো । সেই সাথে গেট খুলিয়ে ওদেরকে বাড়িতেও ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। ওরাই মন্নাফ মিয়াকে বুঝিয়েছে, ঘরে থাকলে কিছু অসুবিধা নাই। শুধু বাইরে বের হলে মাস্ক পরে বের হলেই হবে।

এরপর সবাই মিলে হইচই করে গান গাইতে গাইতে চলে গেছে। কী যে ভালো লেগেছে মাজেদার ছেলেগুলোকে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, তার ছেলেটা যেন এই ছেলেগুলোর মতো হয়। যারা মানুষের কথা ভাবে। যারা খিদে পেটে কতো রকম ভয় নিয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকা মানুষকে ডেকে ডেকে খাবার দেয়। মানুষকে মায়া করে। জানলা দিয়ে উজ্জ্বল ছাইনীল রঙা আকাশের ফালিটুকু দেখে বোঝে মাজেদা, আর বেশি দেরি নেই। খুব শিগগিরই সকাল হবে। সেগুনের বড়ো বড়ো পাতাগুলো ভুতুড়ে লাগবে না আর। সেইসাথে কামরাঙা ফুলগুলো দিনের আলোয় নিজেদের মোলায়েম গোলাপি সুন্দর রঙ ফিরে পাবে। চারিদিক ঝলমল করে উঠবে, উঠবেই। জানে সে।

Read Previous

গোরকুই

Read Next

যে যার বৃত্তে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *