অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসরাত জাহান -
কিছু কথা অপ্রকাশিত থাক

চা-টায় চুমুক দিতেই আঁশটে গন্ধটা আমার নাকে এসে লাগে। পাঁচতারা হোটেলের হেঁসেল থেকে আসা দামি পানীয় কেন আঁশটে গন্ধযুক্ত হবে! আমি ভেবে পাই না আর গন্ধটা কি শুধু আমি একাই পাচ্ছি, না সবাই পাচ্ছে জিজ্ঞেস করা হয় না কোনো কারণ ছাড়াই। তবে গন্ধটা আমার শরীরে ঢুকে যাচ্ছিলো চুমুক চুমুকে। চা-টা কোনো রকমে শেষ করে বের হই সমুদ্র দর্শনে। রাত নয়টা। ঢাকার হিসাবে কেবল রাতের শুরু আর এখানে চারপাশ নীরব। এতো রাতে সমুদ্রে দেখার কিছু নাই, তারপরও আমি সবার সাথে বেরিয়ে পড়ি। কিছু সময় নিঃসঙ্গতার সাথে সাগরের গর্জন উপভোগ করা।

সমুদ্রের কাছে এলে আমার জীবনটাকে কেন যেন তুচ্ছ মনে হয়। এর বিশালতা, গর্জে ওঠা আবার শান্তভাব সবকিছু ভাবায় আমাকে। সমুদ্রের জলে ফসফরাস থাকে, তাইতো গভীররাতে ঢেউগুলোকে স্পষ্ট দেখা যায়। মনে হয় অন্ধকারকে শাসিয়ে আলোর পানে ছুটে এসেছে প্রিয় সঙ্গীর টানে। একটার পর একটা আলোর স্রোত আছড়ে পড়ছে বালুকাবেলায়। বালির চরে পা ভিজিয়ে আবারও চলে যায় সীমাহীন কৃষ্ণগহ্বরের দিকে। সমুদ্রের জোয়ারে হলো প্রেমের জলোচ্ছ্বাস আর ভাটা তার বিরহী কাতর রূপ। মানব মনের সাথে কত মিল এই সমুদ্রের। অন্ধকারের মাঝে হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে যায় বিজলি। চারদিকটা গুমোট হয়ে আছে। কান্না আগে একটু ফুঁপিয়ে নেয়া যেন। একটু পরে বৃষ্টি আসবে মনে হয়।

ধীরে পায়ে হেঁটে এসে ছাতা দেয়া চেয়ারটায় বসি একটু দম নেয়ার জন্য। দূরেই আমার সঙ্গীদের কোলাহল এসে কানে পৌঁছায়। প্যান্ডামিকের কারণে অনেকদিন গোমড়া মুখে ঘরে বসে থাকার কারণে কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমে যাওয়ায় লকডাউনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মানুষ এখন ছুটছে অরণ্য, সমুদ্রের পানে। তাইতো ঢাকা থেকে ছুটে এসেছি সাগরের ঘ্রাণ নিতে দুইদিনের ব্যাপ্তি।

এখানে এলে কত স্মৃতি মনে পড়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া কিছু প্রিয় মুখ, কিছু মুখোশ। বারবার মনের কোণে উঁকি দেয় তারা। ভুলগুলো ভাবায় আমাকে। তন্দ্রার এসে চোখের কোণে জড়ো হওয়ায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি। মেয়েলি কণ্ঠের রিনিঝিনি নিস্বন আমায় জানান দেয় আশপাশে কেউ আছে। চোখে খুলে বায়ে তাকিয়ে দেখি সবুজ রঙের (আলোর তারতম্যের কারণে সঠিক রঙটা বোঝা যাচ্ছিলো না) শাড়ি পরিহিতা এক নারী। আমার পাশের চেয়ার পরে বসে আছে, দূরত্ব চার কদম। ফোনে নিচুস্বরে কথা বলছে। শাড়ির আঁচলটা নিঃশব্দে উড়ে তার মুখমণ্ডলের আশপাশে ঘোরাঘুরির কারণে মুখটা স্পষ্ট দেখা যায় না। তবে যেটুকু দৃষ্টিগোচর হয় তাতে নিঃসন্দেহ বলা যায় তিনি সুন্দরী। অজানাকে জানার নেশা আমাকে পেয়ে বসে। আমি অপেক্ষা করি সেই নেশার কারণে। হঠাৎ বিজলির সাথে অধিবৃত্তি হয়ে বৃষ্টি এসে হাজির হয়। আদতে সেটায় লাভই হয় আমারই। দীর্ঘসময়ের প্রতীক্ষার অবসান।

কারণ মেয়েটা আমার দিকে তাকায়।

চেহারটা সাদামাটা, কিন্তু চাহনিটা অত্যুত্তম, অন্যরকম। দৃষ্টি ফেরানো যায় না। সৌজন্য একটা হাসি ছুড়ে দেয় আমার দিকে, আমিও। বেশিক্ষণ সেটা স্থায়ী হয় না বন্ধুদের ডাকে। ফেরার জন্য উঠে দাঁড়াই। আমার দাঁড়ানো খানিক পরে সেও দাঁড়ায়। ফোনটা ছোট ঝুলব্যাগে রাখতে রাখতে আমাকে জিজ্ঞেস করে,

আপনাদের টিমে আপনি মনে হয় সব থেকে কনিষ্ঠ।

আপনি জানলেন কীভাবে? আমি পাল্টা প্রশ্ন করি।

আজ আপনারা যখন আসলেন, তখন আমরা সবাই লবিতে ছিলাম। মুচকি হাসি দিয়ে জানায়। কাজল দেয়া চোখটা মায়া জড়ানো। দৃষ্টি আটকে রাখে।

আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে কথা না বাড়িয়ে হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করি। আমার মনের ভাবনায় সাদামাটা মুখখানি কেন যেন ছোটাছুটি করে। তন্নতন্ন করে স্মৃতি ঘেঁটে বের করতে চাই, কোথায় দেখেছি এই মায়াবতীকে। তবে সেটা যে এই হোটেল লবিতে নয়, সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ধীর পায়ে হাঁটতে থাকি, যেন সে আমার তালে তাল মিলিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে পারে। টিমের চারজন বন্ধু কিছুটা সামনে।

কত নম্বর রুমে উঠেছেন? এটা বলার সময় কিছুটা আড়ষ্টতা তার কণ্ঠে লক্ষ করি। আমি সেটা বাড়তে না দিয়ে আস্তে করে বলি ৫১১ নম্বরে। আপনি?

আমি ৬১২ নম্বরে। কবে ফিরছেন?
কথার পিঠে কথা না বললে গল্প হয়তো এগোবে না, তাই প্রশ্ন শুরু করে আবারও।

দুইদিনের জন্য , পরশু ফিরবো ব্যস্ত শহরে। আপনারা কবে?

‘আমরা আছি, আরো কয়দিন। আমার স্বামী এসেছে অফিসের কাজে। আমরা তার সঙ্গী হয়ে। তাইতো সারা দুপুর লবিতে কাটে আমার’

এই কথা বলতে বলতে হাত ঘড়িতে চোখ বুলায়। একটু বলে ওঠে, ‘অনেক রাত হয়ে গেলো’

আমি আশ্বাস দিয়ে বলি, ভয় নেই। সমানে চারজনও আমার পরিচিত। আর হোটেল তো চোখের সামনে। আপনি চাইলে… এই কথাটা বলতে গিয়ে থেমে আসে কণ্ঠস্বর। অচেনা এক নারীর সাথে এতটা ছেঁড়াছেঁড়া কথা বলা ঠিক না। বিবেক বাধা দেয়। এরই ভেতরে আমরা হোটেলের বিশাল গেটের সামনে এসে পড়ি। ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে আমি অন্য রাস্তা ধরে এগোতে থাকি। সৌজন্য বিদায় না জানিয়ে।

আবার দেখা হবে… পিছন থেকে কথাটা ভেসে আসে।

লবিতে এসে দেখি আমার সিনিয়র বস সবার জন্য আইসক্রিম অর্ডার করেছে। আমাকেও বসতে বলে। বসতে বসতে পাশ থেকে আমার কলিগ ইমরুল ভাই বলে ওঠে,

শায়েক, গতকাল চলো সবাই মিলে টেকনাফ থেকে ঘুরে আসি। জিপ ভাড়া পাওয়া যায়। স্যার বলেছে।

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাই, চোখ খোঁজে সেই নারীকে। এতোক্ষণে লবি পার হয়ে রুমে চলে যাওয়ার কথা। এখনও আসছেন না কেন উনি? কোথায় গেলো? নিজের মনে প্রশ্ন উত্তর পর্ব চলতে থাকে। কফি চলে আসে এরই মধ্যে। কফিতে চুমুক দেয়ার আগে ঝলকের মতো করে সেই মায়াবতী আমার চোখের সামনে দিয়ে লিফটের দিকে চলে যায়। আমি না দেখার ভান করে, অন্যদের কথায় মন দেই। মনে মনে স্বস্তি অনুভব করি হঠাৎ করে। কিন্তু কেন নিজেও জানি না।

রুমে এসে ঘুমানোর আগে বাসায় ফোন করি স্ত্রীকে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে ‘শুভরাত্রি’ বলে ফোনটা রেখে দেয়। আমার স্ত্রী নাহার, চার মাস আগে আমাদের তৃতীয় সন্তান পৃথিবীতে এসেছে। তিন বাচ্চার লালন পালন করতে করতে বেচারা পুরোই কাহিল। তাই স্বামীর সাথে প্রেম করার সময় এখন আগের মতো হয় না। তাছাড়া বেশি প্রেমের ফল তিনি হাতেনাতে পাওয়ার কারণে প্রেম, কাম থেকে এখন নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেন।

আমার রুমমেট ইমরুল ভাই। এসেই বাথরুমে ঢুকে পড়ে শাওয়ার নেয়ার জন্য। আমি টিভি ছেড়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ি। আবারও চোখে ঘুম নেমে আসে। ঘুমিয়ে পড়ি।

মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়। জানালার ভারী পর্দাটা সরাতেই ধবধবে সাদা আলো এসে আমার বিছানায় লুটোপুটি খায়। আমি শুয়ে থাকতে পারি না। উঠে বসে পড়ি। পাশেই ইমরুল ভাই গভীর ঘুমে মগ্ন। গোসল না করায় শরীরটা কেমন যেন ভারী ভারী লাগে। আমার প্রতিদিন দুইবেলা গোসল করার অভ্যাস। বিছানা ছেড়ে দাঁড়ানোর সাথে সাথে মাথাটা কেমন যেন গোলকধাঁধার মতো মনে হয়। রুমটা চলমান আর আমি স্থির। তাল সামলাতে না পেরে বসে পড়ি। কিছুসময় কেটে যায়, রুপালি থালার মতো চাঁদের সাদা আলো আমাকে বিমোহিত করে রাখে। আমার রুমে থাকতে ইচ্ছে করে না। শাওয়ার না নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ি। সার্বক্ষণিক চালু থাকার শর্তাধীন দুটো লিফটেই বন্ধ। হয়তো মধ্যরাতে, না হয় কোনো ক্রটির কারণে। একটু অপেক্ষা করতেই লিফটে আলো জ্বলে ওঠে। বাটনে আঙুল রাখার সাথে সাথে লিফটের দরজা খুলে যায়। লবিতে এসে দেখি চারপাশ একেবারে নিস্তব্ধ। রাত তিনটা ত্রিশে কেউ যে এখানে ভিড় করবে না, সেটা আমার জানা আছে। তারপর গল্প করার জন্য একজন সঙ্গী খোঁজে এই চোখ। লবির ছাদের দিকে তাকিয়ে ফুঁৎকার করে ঝাড়বাতির আলোর তারতম্য খেয়াল করার সময়টুকুতে অনুভব করি পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে। সেই মায়াবতী। হঠাৎ তাকে দেখে আমার পিলে চমকে যায়। ‘এতো রাতে কোথা থেকে’ জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ঠোঁটের আগা থেকে কথাটা আবার ফিরিয়ে এনে বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলি। তবে মনে মনে আমি তাকেই আশা করছিলাম। মানুষের মনের গোপন কিছু ইচ্ছে থাকে। এটাও আমার তেমনিই কিছু।

আপনি এখানে?

এই কথা বলতে বলতে তিনি আমার পাশের সোফায় টুপ করে বসে পড়েন।

আপনি বা কেন?

আমি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি উনাকে। নীরব একটি হাসি ছুড়ে দিয়ে সামনে থাকা পত্রিকাটায় হাত বুলায়। আমার চোখ চলে যায় তার আঙুলের ডগায় আর চারপাশেটায়। তখন পত্রিকাটিকে কেন যেন নিজের থেকে বেশি সৌভাগ্যবান বলে মনে হয়। তাই আড়চোখটা সরিয়ে চারপাশটায় চোখ বুলাই। দুই-একজন লবিতে ঘোরাফেরা করছে। যাদের কাউকে আমার বিশেষ গল্প করার উপযোগী বলে মনে হয় না।

যাবেন? বিচ থেকে ঘুরে আসি।

এখন রাত গভীর, এতো রাতে যাওয়াটা নিরাপদ হবে না।

আপনি কি আমার কারণে নিরাপত্তার অভাব অনুভব করছেন?

একগাল হাসি দিয়ে কথাটা বলে। তখন আমার খেয়াল হয়, এই হাসিটার সাথে আমার স্কুল লাইফের এক প্রেমিকার হাসির খুব মিল। সেই মেয়েটাকে জীবনে প্রথম চুমু খেয়েছিলাম স্কুলের বাথরুমের দরজা ভেজিয়ে। বাহিরে বন্ধুকে পাহারায় বসিয়ে। মেয়েটার নামটা মনে করতে পারি না, স্মৃতিগুলো বিস্মৃতি হবার কারণে।

তা কেন হবে। সবারই হতে পারে। আপনার একধরনের বিপদ, আমার হয়তো অন্যধরনের। বিপদটা যে কারো হতে পারে।

তাহলে চলুন, সামনের সাইমিংপুলের পাশটায় গিয়ে বসি।

আপনার সাথে আর কেউ আসেনি? আমি কিছু প্রয়োজনবিহীন কথাটা বলে ফেলি, অনেকটা বেকুবের মতো।

এসেছে, ঘুমাচ্ছে রুমে। আমার ছানা আর স্বামী একরুমে। শাশুড়ি, শ্বশুর অন্যরুমে। আমার ঘুম আসছিলো না, তাই রুম থেকে বেরিয়ে পড়েছি।

চলুন সামনের দিকটা দেখি।
আমি আমার বেকুবগিরি ঢাকতে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াই লবি থেকে বেরোনোর জন্য।

সুইমিংপুলটা বেশ নির্জন। আমি চেয়ার টেনে বসি, সে পানিতে পা চুবিয়ে। মিষ্টি একটা গন্ধ এসে নাকে লাগে। আমি চোখ বন্ধ করে ফুলের গন্ধটা অনুভব করার চেষ্টা করি। বেলী ও হাসনাহেনা দুই ফুলের ঘ্রাণ যৌথভাবে চারপাশটা আবেশিত করেছে বুঝতে পারি। সাইকাস গাছের কোল ঘেঁষে বের হয়েছে লম্বা এক অভিযাত্রীদলের নতুন অভিযান। বাঁধানো ইটের উপর দিয়ে লম্বা সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলছেন তারা। আমি তাদের অভিযাত্রা দেখতে থাকি, কোথা থেকে এসেছে কোথায় যাচ্ছে।

এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছেন? পিঁপড়াদের দলের সাথে অন্তর্ভুক্ত হবেন নাকি?

না বোঝার চেষ্টা করছি, বৃষ্টি হবে কিনা।

কীভাবে?

তাহলে তো আপনাকে বলতে হয়। আগে আমাদের নানি-দাদিরা এমন পিঁপড়াদলের সারিবাঁধা অভিযান দেখলেই বলতো বৃষ্টি বা বন্যা হবে। আপনি শুনেছেন কখনো?

হুম শুনেছি। আমার কাছেও আশ্চর্য লাগতো। ম্যাজিক মনে হতো। আমি তো আমার দাদিকে সর্বজ্ঞানে জ্ঞানী মনে করতাম ছোটবেলায়।

সাথে সাথে আমি একটু ভাব ধরে ফেলি, শুরু করি আমার জ্ঞানের ভাবতরঙ্গ দেখানো।।

‘এটা আসলে কোনো ম্যাজিক না, আশ্চর্য ঘটনাও না। এটা প্রকৃতির একটা সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি। জানেন পিঁপড়ের শুঁড়গুলোতে সেন্সর থাকে। সেইগুলো বাতাসের আর্দ্রতা, উষ্ণতা বুঝতে পারে। এটা কেউ ওদের বলে দেয়নি, কিন্তু বহু কোটি বছরের বিবর্তনে এই রূপ পেয়েছে। সেই বিবর্তনের পথেই তাদের শিখিয়েছে, আর্দ্রতা আর উষ্ণতা মানে বৃষ্টি, উঁচু জায়গায় যেতে হবে। পিঁপড়েরা বিবর্তনের ফলে এটা পেয়েছে। এটা তাদের সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি। মানুষ বিবর্তনের ফলে পেয়েছে উন্নত মস্তিষ্ক, এটা আমাদের সেন্সর। এটা মানুষের সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি।’

আমার কথা শেষ হবার পরে খেয়াল করি, আমার দিকে একজোড়া পলকহীন দৃষ্টি।
আমি কিছুটা লজ্জা পেয়ে হেসে ফেলি, আমার হাসিটা তাকেও সংক্রমিত করে। পুল থেকে পা দুটো তুলে উঠে আসে পানি থেকে। কাছাকাছি চেয়ারটা টেনে কাছে এসে বসে।

আমাকে চিনতে পেরেছিস? এতোটা সময় হয়ে গেলো চিনতে তো পারার কথা বন্ধু।
আমি তার চোখে চোখ রাখি, সেই চোখ দুটো ছিলো গভীর কোনো গিরিখাদ, সেখানে একটি হৃদ আছে স্থির, অচঞ্চল। তবে যে কোনো সময় চঞ্চল হয়ে উঠতে পারে।

তার ‘বন্ধু’ কথাটা মস্তিষ্কের নিউরনে আলোড়ন তোলে, বহুকাল আগের প্রিয় কিছু মুখচ্ছবি ফ্রাশ আউটের মতো সামনে এসে দাঁড়ায়। আমাকে চেনাতে সাহায্য করে। কিন্তু আমি চিনতে পারি না।

মাথা নেড়ে বলি, ‘চিনতে পারছি না’। আমার কথায় মুখটা মলিন হয়ে যায় তার।

‘থাক চিনতে হবে না। আগে আমি আর এই আমি কি এক মানুষ নাকি? প্রাণহীন মানুষকে চিনে কি হবে? খোলসের মড়মড়ে আওয়াজ পাবি।

শূন্যদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে আর আমি তাকিয়ে থাকি তার দিকে, চিনতে চেষ্টা করি।

পরিবেশটা সহজ করতে আমি কথা শুরু করি আবার, করোনাকালের এই পুরো সময়টা কি বাসায় ছিলেন? কাজের জন্য বাহিরে যেতে হয়নি?

‘না’, শুধু একটি শব্দ দিয়ে আমায় থামিয়ে দেয়। কণ্ঠের দৃঢ়তা কারণে আমি আর এগোতে পারি না।

আমি বাসায় ছিলাম, হোম অফিস করেছি। যেচে পড়ে কথাগুলো বলতে গিয়েও বলতে পারি নাই।

আকাশটার মেঘগুলো লালচে হয়ে আসে সূর্যের আভায়। ‘চলেন হেঁটে আসি বিচ থেকে’ আমি আমন্ত্রণ জানাই। হালকা একটু হাসি দিয়ে বলে, পরে যাবো। রুমে যেতে হবে।
তার দ্রুতগামিতার কারণে আমার আর তার ফোন নম্বরটা নেয়া হয় না। ভেতরে ভেতরে খুঁজতে থাকি তার সাথে বন্ধুত্বের সমীকরণ। আমার নানা স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়েছিলো। কিন্তু মিলাতে পারি না কারো সাথে।

রুমে এসে দেখি ইমরুল ভাই বসে আছে বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে। আমি কারণ জানতে চেয়ে রুমে রেখে যাওয়া আমার মোবাইলটা খুঁজতে থাকি।

আবার জিজ্ঞস করি, ‘কি হয়েছে ইমরুল ভাই?’

আমার বড় মামার মেয়েটা গতকাল দুপুরে ২টায় মারা গেছে রোড অ্যাক্সিডেন্টে। বাই রোডে কক্সবাজার আসছিলো। শায়েক আমাকে ঢাকায় ফিরতে হবে। আপনি যাবেন আমার সাথে?

অবশ্যই যাবো। চলেন। আপনি বসুন, আমি সব ঠিক করছি।

ঢাকায় ফেরার সব ব্যবস্থা করতে করতে আমার আর সেই মায়াবতীর সাথে দেখা হয় না। একটু টান অনুভব করতে থাকি।
ইমরুল ভাইকে নিয়ে বিদায় নেবার আগে, রিসিপশনে একটা চিরকুট রেখে আসতে যাই।

‘৬১২ নম্বর রুমের ম্যাডামকে বলবেন ৫১১ নম্বর রুমের স্যার চলে গেছে আর এই চিরকুটটা দেবেন।
প্লিজ. একটু গোপনীয়। আমার বন্ধু তো, তাই বলে যাবার সময় পেলাম না।’

কিছুসময় পরে,
সরি স্যার, ৬১২ ও ৬১৩ নম্বর রুম দুটো গতকাল থেকে খালি আছে। বুকিং লিস্টের গেস্টরা আসেনি।

আমি চিরকুটটি ফেরত নিয়ে কিছুটা নির্বাক হয়ে গাড়িতে উঠে বসি এয়ারপোর্ট যাবার জন্য। ইমরুল ভাই মাথাটা সিটে এলিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করে তার মামাতো বোনের কথা।

‘শায়েক জানো সুচীর স্বামী, বাচ্চা, শাশুড়ি বেঁচে আছে। সুচী আর ওর শ্বশুর নেই। আমাকে এতো দেরিতে কেন খবরটা দিলো ওরা।’ আবারও নিজ মনে বকতে শুরু করে।

কিছুসময় পরে আবেগে কেঁদে ফেলে, তখন মোবাইলটা আমার হাতে দেয় বোনের ছবি দেখানোর জন্য।

ছবিটা দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। হারানোর শোকে না নিজেকে নতুন করে ফিরে পাওয়ার আনন্দে, বুঝতে পারি না। চুপ করে শুনতে থাকি ইমরুল ভাইয়ের স্মৃতিচারণ। মনে মনে ভাবি, কিছু কথা অপ্রকাশিত থাক।

Read Previous

নাবাল ভূমি

Read Next

আংটি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *