অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৪, ২০২৪
২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৪, ২০২৪
২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জুলিয়ান সিদ্দিকী -
আংটি

বলা নেই কওয়া নেই হুট করে বাড়িতে চলে আসে আলমাস। আমি যে হঠাৎ কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। নিদারুণ অভাব আর পারিবারিক সংকটের মধ্য দিয়ে পার করছিলাম দিনগুলো। স্বভাবসুলভ কারণে বাইরে থেকেই হৈচৈ আরম্ভ করে দেয় সে। ইশারায় হনুফা জানতে চায়, কে?

মুখে তর্জনী ঠেকিয়ে তাকে চুপ থাকতে বলি।

আলমাসকে বলি, ঘরে আয়। চিনলি ক্যামনে?

ঘরে ঢুকে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে প্লাস্টিকের চেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আলমাস। বলে, একগ্লাস পানি খাওয়া। ভাবী আছে তো, মানে হনুফা?

আছে, আছে। আগে তোর জন্য পানি নিয়া আসি। বলতে বলতে আমি ঘরের ভেতরের দিকে যাই।

আলমাসের কথা শুনতে পেয়েই হয়তো আগেই গ্লাসে পানি ঢেলে রেখেছে। সে পানিভর্তি গ্লাস নিয়ে আলমাসের কাছে ফিরে আসতে আসতেই শুনতে পাই বেশ চিৎকার করে কিছু বলছে বেবি। আলমাসের হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে কান পাতি। শুনতে পাই, হারামজাদায় একটা মাগী আইন্যা ঘরে লইয়া বইছে। দামড়া দামড়া মাইয়াগোরে লইয়া একটা ঘরের ভিত্রেই ঘুমায়, ছি ছি! লাজ-শরমও নাই। মা, মাইয়া সবডির লগেই থাহে হারামজাদায়!

পানি খেয়ে গ্লাস নামিয়ে রেখে আলমাস বলে, এসব কী বলছে রে আর কে-ইবা এই বদমাশ মহিলা? কাকে বলছে এসব?

আমি বলতে পারি না যে, আমারই সহোদরা। একমাত্র বোন। সাহিত্য, সাহিত্যিক আর শিল্পীদের সঙ্গে যার নিবিড় সংযোগ, তার বোন যদি এমন হয়, তাহলে কি শিক্ষা পরিবেশ আর পরিবার নিয়ে প্রশ্ন জাগে না? আমার বোন এমন হতে পারে কেউ বিশ্বাস করবে? বলি, বাদ দে তো! গ্রামদেশে এমন হয়ই। সব দিকে চোখ কান দিতে হয় না।

কিন্তু আলমাসের মনোযোগ বেবির প্রলাপের দিকে। আমার কথায় তার ভাবান্তর হয় না। কিছুক্ষণ পর সে হঠাৎ বলে ওঠে, সত্যি করে বল তো কে এই মহিলা? যতটুকু বুঝতে পারছি তোকে উদ্দেশ্য করেই বলছে। এটা তোর সেই বোনটা না তো?

বলি, এত দিকে কান দিস না। আগে বিশ্রাম নে, ফ্রেশ হ। তারপর খাওয়া-দাওয়া কর।
আলমাস চোখ বড় বড় করে বলে, সত্যি খাওয়াতে পারবি, আজ রান্না হয়েছে তো?
তারপরই আমাকে অবাক করে দিয়ে সে চিৎকার করে বলে ওঠে, ভাবী, এই ভাবী! কোথায় আপনি?

গ্রাম্যনারী হনুফা আমার স্ত্রী হলেও জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনও। তার ওপর কম পড়ুয়া বলে আমি ছাড়া অন্য কারও সামনে তেমন সহজ হতে পারে না। তবে ভেতরের রুমের দরজায় হনুফাকে দেখা যায় ঘোমটা মাথায়। আলমাসের উদ্দেশে বলে, কিছু বলবেন?

– বলেন তো আমাকে কী খাওয়াবেন?

জড়তাহীন কণ্ঠে হনুফা বলে ওঠে, আমরা যা খাই তাই খাবেন। নতুন কইরা কিছু করতে হবে না।

মনে মনে আলমাসের উদ্দেশে বলি, নে শালা, এবার জবাব দে!

মোটেও বিচলিত না হয়ে আলমাস আবার বলে, শর্ট পড়বে না তো?

– পড়লে পড়লো! আপনের সঙ্গে ভাগযোগ কইরা খাবো।

– হুম!
বলে, কিছুক্ষণ গোঁফ পাক দেয় সে। তারপর মুখ তুলে হনুফার দিকে তাকিয়ে আবার বলে, আমার এই বন্ধুটারে কি বুঝতে পারেন?

– পারি দেইখ্যাই তো এত ঝড় তুফানেও টিক্যা আছি।

– হয়তো আপনেই ঠিক। আমি কিন্তু এরে মোটেও বুঝতে পারি না।

– তাইলে বন্ধু হইলেন ক্যাম্নে?

– হয়তো বন্ধু না।

আলমাসকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখায়। তবু সে বলে, বলতে পারেন অনেক দিন একসঙ্গে চলার ফলে একটা অভ্যাস। লেখালেখি নিয়া আলাপ-সালাপই হয়তো মূল কারণ। বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায় তা হয়তো না।

– আইচ্ছা, এইসব ভারী কথাবার্তা আমি বুঝি না। ফ্রেশ হইয়া আসেন। আমি খাবার দিতাছি।

– আচ্ছা, যান।

বলে, উঠে দাঁড়ায় আলমাস। তারপর আমার উদ্দেশে ফের বলে, চলরে!

সিগারেট টানতে টানতে আলমাস হঠাৎ বলে ওঠে, গ্রামদেশের এই একটা দিক আমার ভালো লাগে। যেখানে এখনও নির্জনতা খুঁইজা পাওয়া যায়। সাদামাটা ঝোলঝাল আর মামুলি শাকপাতারেও সুস্বাদু মনে হয়।

আলমাস মন থেকেই কথাগুলো বলল নাকি ঘুরিয়ে আমাকেই কটাক্ষ করলো বুঝতে পারি না। হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটিয়ে সে বলে ওঠে, একটা কথা ক দেখি, ইগো প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে?

– পড়তে পারে আবার কী। পড়েই তো। সম্পর্ক ভাইঙ্গাও যায়।

– তাইলে বুঝাইয়া ক দেখি আমারে।

– ক্যাম্নে বোঝাই! আচ্ছা ধর, প্রেমিকা কোথাও যাইতাছে। পথে প্রেমিকের লগে দেখা হইল। প্রেমিক ব্যস্ততার কারণে কিছু কইলো না বা হাই, হ্যালো পর্যন্ত করলো না। এমন সিচুয়েশনে প্রেমিকা উলটাইয়া যাইতে পারে। আবার প্রেমিকারে প্রেমিক কইল, তোমারে সাগরের নিচে আংটি পিন্দামু। প্রেমিকা রাজি হইলে দুইজনেই ডাইভিং স্যুট পিন্দা সাগরে নাইমা পড়বে। আমি তো আমার প্রেমিকারে ফুটপাতে দাঁড়াইয়া আংটি পরাইতে চাইছিলাম, কিন্তু সে পরে নাই। এই ক্ষেত্রে তার ইগো বেড়া হইয়া দাঁড়াইছিল।

আলমাস অবাক হয়ে বলে, কই, আমি তো জানলাম না কে তোর সেই প্রেমিকা আর এমন প্রেম তুই করছিলিই-বা কবে?

– তখন তো তুই মালয়েশিয়া ছিলি। তরে একটা এক বাচ্চার মা ডিভোর্সি মহিলার কথা বলছিলাম না?

– হুম, ওই একবার এক হিন্দু মহিলার কথা বলছিলি।

– শুধু নামটা বলছিলাম তরে। তার ধর্মের কথা বলি নাই।

– নাম দিয়াও ধর্ম বোঝা যায়। আইচ্ছা, তারপর?

– তারপর আর কী? ফুটুস!

চোখ দুটো বড় বড় করে তাকায় আলমাস। প্রেম এত সস্তা হইয়া গেল তোর কাছে? এত জাগা থাকতে ছোটলোকের মতন ফুটপাতে কেন?

– কথা তো এইখানেই।

– মানে কী? তোর কথাবার্তা তো কিছুই বুঝতে পারতাছি না!

– তোর মনে যেমন লাগছে ফুটপাত খারাপ জায়গা। গ্ল্যামারলেস। টোকাই আর পাগল-ছাগলের উপযুক্ত। তারও হয়তো তেমন লাগছিল। আর সেই তেমন লাগাটাই হইল ইগো।

আলমাস আরও গম্ভীর হয়ে বলল, আর কিছুটা পরিষ্কার কর!

বলি, ক্লিক করলো না। এইটা তো সহজ ব্যাপার। ধর, কোনো রাইতে লিখতেছি বা পড়তেছি, আমার চা বা কফি খাইতে ইচ্ছা হইল। নিজের হাতে চা-কফি বানাইয়া বউরে ঘুম থাইকা জাগাইয়া অফার করবো। তার হাতে মগ ধরাইয়া বলবো, বাইরে আস, উঠানে বইসা গল্প করি। তেমন ক্ষেত্রে আমার ইচ্ছার মূল্য সে দিবে না। পাগলামি ছাগলামি মনে কইরা বলবে, ঘুমাইতে দাও, বিরক্ত কইরো না। কাজেই এমন মানুষ নিয়া বেশিদিন চলা যাবে না।

– উলটাটাও তো হইতে পারতো।

– এমন ঘটে না। এইগুলা হইল সম্পর্কের জঞ্জাল। ভালোবাসা হইল একে অন্যের শখ, আগ্রহ, ইচ্ছা মাইনা নেওয়া, সম্মান করা। এমনকি পাগলামি বা বোকামি হইলেও।

আলমাস দু’ঠোঁট ভেঙেচুরে কিছু একটা নিয়ে ভাবে। তারপর বলে, আমার ইচ্ছাটা তোর মতন ছোটলোকি ব্যাপার ছিল না। বলছিলাম ছবির হাটে বইসা নয়তো সাভার স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়াইয়া তারে আংটিটা পরাইয়া দিবো।

– তারপর?

আমার কৌতূহল বেড়ে যায়।

– মুনা কইল, তোমার মতো সাইকোর সঙ্গে আমার হবে না। এখন, এই মুহূর্ত থাইকা আমাদের সম্পর্ক শেষ। ফারদার আমাদের দেখা হইলেও কথা হবে না।

– এরপর?

– খবর নাই।

– কতদিন?

– তিনমাস।

– তাইলে আমার প্ল্যানে ছোটলোকির কী ছিল?

– স্যরি! অতটা ডিপে যাই নাই। তো তোর বউটা কেমন, তোর মতন তারছিঁড়া?

বলে, মিট মিট করে হাসে আলমাস।

বলি, তারছিঁড়া না হইলেও মন্দ না। পাঁচ বছর তো হইয়া গেল, এখনও কথা কইতে কইতে কোনও কোনও রাত ফুরাইয়া যায়।

আলমাসকে এবার বিষণ্ন মনে হয়। বলে, অভাবের ঘরে না প্রেম থাকে না?

আমার হাসি পায়। বলি, এইটা কেতাবি কথা। যারা লাভের আশায় লাভ করে তাদেরটা এমন হয়। আমরা দুইজনই লুজার। দরজা ভাঙা। জানালা ভাঙা। তাই প্রেমটাও হয়তো কনফিউজড হইয়া পালায় না।


চল চা খাইয়া আসি। সূর্যের তেজ কইমা গেছে। বলে, আলমাসের হাত ধরে টানি। কিন্তু আমার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে সে বলে, শালা ফকিরা, তোর ঘরে চা-পাতা চিনি নাই?
বলি, আছে।

আলমাস বলল, দোকানের চা খাবো না। গ্রামদেশে দোকানের চা একেবারে জঘন্য। রঙ চায়ের নামে চিরতার পানিতে চিনি গুলিয়ে দেয় এমন মনে হয়।

– তাইলে ঘরেই যাই। আমরা দুইজনেই কিন্তু ভালো রঙ চা বানাই।

– তাইলে তো ভালোই। আর শোন, চা খাইয়াই কিন্তু আমি বাইর হবো। কাল অফিস আছে।

– হুম। খুব সকাল সকাল তোরে বাসে তুইলা দিয়া আসবো। এক ঘণ্টায় ঢাকা চইলা যাবি।

– নাহ। আমার অন্য কাজও আছে।

– আইচ্ছা, তাইলে তোর দেরি করাবো না।

দূর থেকেই হনুফাকে দেখা যায় দরজায় দাঁড়ানো। আবার অদৃশ্যও হয়ে যায়। হয়তো দেখতে পেয়েছে আমরা ফিরে আসছি।

আলমাস আমার একটা বাহু ধরে একবার ঝাঁকি দিয়ে বলে, তাহলে আমারে একটা বিয়ে করিয়ে দে। অল্প স্বল্প পড়ুয়া।

অবাক হয়ে বলি, এ কেমন কথা! কম পড়ুয়া বউ নিয়া সমাজে চলবি ক্যাম্নে? বউ কি তোর কবিতা বুঝবে?

– এমনটাই চাই। কবিতা না বুঝলে আমাকে আজাইরা সন্দেহ করবে না। আমি সংসার করতে চাই।

– আমারও তো ছিল। যে আমার লেখা একটা লাইনের কথাও বলতে পারবে না। সংসার তো টিকলো না!

– তাইলে একটা পরামর্শ দে।

– তা সম্ভব না। নিজের বউ নিজে ঠিক করে নে।

– তেমন কেউ নাই। আর যারা আছে তারা অভিজ্ঞ বলে বিয়েটা পছন্দ করে না।

– অপেক্ষা কর!

– কত দিন, কত মাস, কত বছর?

– আচ্ছা, আগে ঘরে চল। চা খেতে খেতে ঠিক করা যাবে।

আমরা ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই ট্রেতে করে চা আর চিড়া ভাজা নিয়ে আসে হনুফা। বলি, তোমারটা কই?

– আছে।

বলতে বলতে টেবিলের ওপর ট্রে নামিয়ে ফিরে যায় সে।

আলমাস একটা কাপ তুলে নিয়ে বিছানায় দু পা তুলে আরাম করে বসে। তখনই আমি ডাকি, ভাউজ, ও ভাউজ!

হনুফা চায়ের কাপ হাতে এগিয়ে এলে বলি, তুমি সত্যিই চা ভাগে পাইছ কিনা দেখতে চাইছিলাম।

– এই যে দেখ, সত্য না মিছা!

বলেই আমার মুখের সামনে এনে চায়ের পরিমাণ দেখায় সে। তারপরই বলে, আমি যাই, কাজ করতাছি।

হনুফা চলে গেলে গলার স্বর খাদে নামিয়ে আলমাস বলে, বউরে কেউ ভাবী ডাকে, বদমাশ?

চায়ে চুমুক দিয়ে বলি, তোরাই তো বলিস যে, সম্পর্ক কখনও বদলায় না। তা ছাড়া হনুফা যে আমার ভাবী ছিল, এইটা তো মিছা না।

– রাবেয়া এই কথা জানলে দেওর-ভাবির রসায়ন নিয়া তরে অবশ্যই কিছু ঝাড়তো।

– আচ্ছা, ভালো কথা, প্রেম-পূজা-ভোগ বইটা পাবলিশের পরে তারে কিন্তু ব্লগে বা ফেসবুকে দেখা যায় নাই। তুই জানিস কিছু?

– আমি তো ব্যক্তিগতভাবে তারে জানি না। ব্লগ আর ফেসবুকে তার যে কয়টা লেখা পড়ছি। এই তো! হইতে পারে সংসার নিয়া ব্যস্ত।

– সংসারই লেখালেখির বারোটা বাজায়।
অনেক লেখক এই কারণে কোনোদিন বিয়াই করে নাই।

আলমাসের পকেটে মোবাইল ফোন বেজে উঠতেই চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে ফোন বের করে পকেট থেকে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন লালচে হয়ে ওঠে তার মুখ। চাপা স্বরে বলে, মুনা!

সঙ্গে সঙ্গেই বলি, কথা বল, কথা বল!

অনিশ্চিত স্বরে সে বলে, তুই বলতেছিস?

– কী বলতে চায় শুনবি না বলদ?

– হ্যালো, কেমন আছ? বলতেই তার মুখটা কেমন বেঁকেচুরে যায়। চোখ দুটো টলমল করে। আমি শুধু তার মুখে আচ্ছা আচ্ছা শুনতে পাই।

কথা শেষ করে ফোন পকেটে রেখে আবার সে বলে, দেখা করতে বলছে। দেখা করবো?

– তোদের ব্যাপারে আমি কিছু না বলি।

হঠাৎ হাসি হাসি মুখ করে সে বলে, কৃতকর্মের জন্য স্যরি বলছে। আমার আন্তরিকতারে আর অসম্মান করবে না।

আমিও সুযোগ পেয়ে বলি, এবার বলবি যে, লঞ্চের ছাদে দাঁড়াইয়া আংটি পরাবি।

আলমাসের মুখের হাসিটা ছড়িয়ে পড়ে আরও। যেন জগতের একমাত্র সুখী মানুষটি সে।

(সমাপ্ত)

Read Previous

কিছু কথা অপ্রকাশিত থাক

Read Next

অজ্ঞাতবাস

One Comment

  • খুশি হইলাম। ধন্যবাদ অনুপ্রাণন। এই গল্পটা কোথাও আলোর মুখ দেখবে কি না ভরসা পাচ্ছিলাম না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *