ঘুমের আগে অনেকটা পথ চলার আছে বাকি
বর্ষার নতুন পানি দেখে অঞ্জনার খুশি দেখে কে? বাবার বাড়ির প্রিয় ও চিরপরিচিত বাহির বাড়ির আঙিনায় হাঁটু অবধি পানিতে কাপড় ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে মজা করছে আর বাগানের বেড়ার ভেতর যে মাধবীলতা, কামিনীর ঝোঁপ, রঙ্গন, গন্ধরাজের জঙ্গল, তার ভেতর হাতে রাখা গাঁদা ফুল ও সূর্যমুখীর বীজ ছড়াচ্ছে। যদি কিছু বীজ আটকে যায় গাছগাছালির ডালপালার ভেতর, তবে পানি শুকোলে অবশ্যই চারা গজাবে। এই খুশিতে যখন সে মশগুল ঠিক তখনই অঞ্জনের ফোন এলো। সে মুক্তাগাছা ট্রেনিংয়ে গেছে। ভিডিও কল দিয়েছে অঞ্জন। মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির সিঁড়িতে বসে আছে সে, সিঁড়ি ভর্তি থইথই পানি। ওর গায়ে অঞ্জনার প্রিয় ও পছন্দের ফুলশার্ট কালোর মধ্যে হালকা সোনালি স্ট্রাইপ ও সাদা ফুলপ্যান্ট।
‘তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।’
‘হ্যাঁ, তোমার পছন্দের ড্রেস পরেছি যে, সুন্দর তো লাগবেই। তা তুমি হাঁটু অবধি পানিতে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ঢোঁড়া সাপের কামড় খাওয়ার জন্য?’
‘আরে না। ফুলগাছের বীজ ছড়াচ্ছি। যাতে পানি সরে গেলেই চারা গজাবে।’
‘উলুবনে মুক্তো ছড়াচ্ছ না তো? বর্ষার পানিতে বীজ ভেসে যাবে না? চারা গজাবে কীভাবে? কী ফুলের বীজ ছড়াচ্ছ শুনি?’
অঞ্জনা খুশি হয়ে বলে, ‘মেরিগোল্ড ও সানফ্লাওয়ার।’
‘তা বাংলায় ফুলের নাম বললে কী হতো? সারাজীবন বাংলাচর্চা করে ফুলের নামের সময় ইংরেজি। এ কেমন অপচর্চা বল দেখি?’
‘আরে ধুর! অপচর্চা হবে কেন? ফুল দু’টির কারিশমা বাড়িয়ে দিলাম। সানফ্লাওয়ার নামের মুভিটি আমার খুব প্রিয় আর গাঁদার চেয়ে মেরিগোল্ড শুনতে বেশি ভালো লাগে আমার। আচ্ছা বাজে প্যাঁচাল বাদ দাও। ফোন দিয়েছ কেন তাই বলো।’
অঞ্জন বলে, ‘চলে এসো না মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি! তোমার না পানি খুব প্রিয়। বেড়িয়ে যাও এসে।’
‘ধ্যাত! পানি প্রিয় বলে এই আষাঢ় মাইসা ঢলে বানভাসি হতে যাব নাকি? আমি অতো বোকা নই। পানিবন্দী জীবন। হেঁটে মজা করে কোথাও বেড়ানো যাবে না। না না, এখন আমাকে কোথাও যেতে বলো না। বরং ট্রেনিং শেষ করে তাড়াতাড়ি চলে আসো তুমি।’
ওমা! নিমেষে অঞ্জন উধাও। ফোন কেটে দিল নাকি রাগ করে। অঞ্জনা চোখ কচলে ভালো করে তাকিয়ে দেখে দেয়াল ঘড়িতে রাত তিনটে বাজে। এ কেমন স্বপ্ন! অঞ্জন না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার পর এই ছয়মাস ধরে প্রায় প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখে তাকে। কিন্তু কোনোদিন কথা হয় না। আজ হঠাৎ ভিডিও কলে আমন্ত্রণ। না না। ‘মরিতে চাহি না আমি এ সুন্দর ভুবনে।’
মৃতেরা ডাকলে নাকি তাড়াতাড়ি মৃত্যু হয়, এমনটাই মানে অঞ্জনা। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি মরতে চায় না সে।
‘দ্যা উডস আর লাভলি, ডার্ক অ্যান্ড ডিপ,
বাট আই হ্যাভ প্রমিসেস টু কিপ,
অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফর আই স্লিপ
অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।“
ওয়াক্!
শামীম আরা জীবনে বুয়া ছাড়া কেমন করে ঘর-সংসারের কাজকর্ম করে জানেন না। একদিন বুয়া না এলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। প্রেগনেন্সির সময় তো কথাই নাই। স্বামী মোহন সাহেবের আহ্লাদে কুটোটি নেড়ে দেখেন না। শুধু শুয়ে শুয়ে প্রিয় উপন্যাসে চোখ বুলিয়ে যান। সেদিন মোহন সাহেব মর্নিং ওয়াক করে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নাশতা কী?’
শামীম আরা সুনীলের ‘সেই সময়’ ভলিউম বইটিতে চোখ রেখেই বললেন, ‘বুয়া জানে।’
স্বামী বেচারা একটু মনঃক্ষুণ্ন হয়ে বললেন, ‘তুমি এত বুয়া নির্ভর হয়ে গেছ?’
শামীম আরা গা করলেন না। সুনীলের বই বলে কথা। টান টান উত্তেজনা। মোহন সাহেবও কিছু আর ঘাটালেন না স্ত্রীকে। প্রথম প্রেগনেন্ট। কিসের থেকে আবার কী হয়।
ছেলেমেয়েরা সবাই এখন প্রতিষ্ঠিত। শুধু মোহন সাহেব নেই। ডায়ালাইসিস করতে করতেই পরপারে পাড়ি জমালেন একসময়। এতে শরীর মন ভেঙে পড়ায় বুয়া আর ছাড়তে পারলেন না। এদিকে কোভিড ১৯-এর মহাপ্রলয় কাণ্ড। গৃহিণীরা বুয়া ছাড়িয়ে দিয়ে ঘর-সংসারের কাজে মন দিলেন। এতে বাড়তি মেদ ঝরে পড়তে সাহায্য হলো গৃহিণীদের। করোনার মতো ভয়াবহ ভাইরাস নাকি বাড়ি বাড়ি ঢুকে বুয়ারাই ছড়ায়। শামীম আরা এটা বিশ্বাস করেন না। সেদিন বাড়িওয়ালি ভাবীর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র বুয়াটি। হঠাৎ একটা হাঁচি এসে গেল বুয়ার। আর পায় কে? বাড়িওয়ালি পড়িমরি করে ছুটে এসে বুয়ার পাওনা টাকা দিয়ে বিদায় করে দিলেন।
না, শামীম আরা প্রাণে ধরে এটা পারবেন না। বুয়া বাদ দিয়ে নিশ্চিন্ত জীবনের বারোটা বাজানো। স্বাধীনতা, মানে বইপড়ার কোনো সময়ই থাকবে না হাতে। তা ছাড়া রান্নাঘরে গলদঘর্ম হয়ে রান্না করার মতো ঝক্কি! এর মধ্যে ফার্মেসিতে গিয়ে ডায়াবেটিস মেপে দেখলেন খাওয়ার পর সুগারের পরিমাণ ৭.৮। সর্বনাশ! ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে মোহনের মতো কিডনি দখল করে বসবে। তখন অসময়ে মৃত্যু ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না, যেহেতু তাঁর হাঁটার অভ্যাস নেই। ফার্মেসির মজুমদার সাহেব পরামর্শ দিলেন ৫০০ পাওয়ারের দুটো করে ট্যাবলেট দুই বেলা খেয়ে যাবেন। যে কথা সেই কাজ। প্রায় আট-দশমাস যাবত চলছে এই অনুশীলন। চিনি বর্জন। রোজার মাসের এই নিয়ম চললো। শুধু ফলমূল দিয়ে ইফতার। শরবত বর্জন। শামীম আরা দুর্বল হতে দুর্বলতর হয়ে চললেন। ভাবলেন গরম আর রোজা তাকে কাবু করছে। ঈদের দিনটা মোটামুটি সুস্থভাবেই রান্নাবান্না করে ছেলেদের নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করলেন। পরদিন বুয়া দেশে গেল তিনদিনের জন্য। তেরো দিনেও এলো না। তিনি আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়লেন। ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে যাবেন। হাঁটতে পারেন না। কাছেই ফার্মেসি। বড় ছেলে ধরে ধরে নিয়ে গেল।
প্রথমেই বললেন, আমার ডায়াবেটিস চেক করেন তো, তারপর ওষুধ নেব। দেখা গেল সকালে খাওয়ার পর শামীম আরার ডায়াবেটিস ধরা পড়লো ২.৮। ভয়ে তিনি ওষুধ কেনা বাদ রেখে ঘরে চলে এসে বিছানা নিলেন। তিনদিন ধরে চুলা জ্বলছে না। ছোটটি বলে, গরম তেল ছিটে আসে গায়ে ডিম ভাজতে পারবো না। ফ্রিজে ভাত আছে তিনদিন আগের। গরম করতেও পারবে না। বড়টি গ্যাসের চুলা ধরাতে গেলে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি ছুড়ে দেয় হাতে তাপ লাগার ভয়ে। অতএব চুলা বর্জন। প্রতিদিন চিড়া-কলা, পাউরুটি-কলা এসব খেয়ে অরুচি ধরে গেলে হোম ডেলিভারির খাবার খেতে লাগলো। সেদিন রাতে তন্দুরী আর ঝালফ্রাই অর্ডার করলো। এত ঝাল শামীম আরা সহ্য করতে পারলেন না। লুজ মোশনে বিছানা নিলেন। চারদিন হয়ে গেল ভাত খেতে পারছেন না। বুয়ার তো দেখাই নাই।
তিনি ধোঁয়া ওঠা এক বাটি গরম ভাত আর সবুজ রঙের করলা ভাজির জন্য মনে মনে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লেন। প্রথমে মেয়েকে ফোন দিলেন। ধরলো না। কেয়ারটেকারকে ফোন দিলেন। সে ঘুমাচ্ছে। ভাইয়ের ছেলে সজীবকে ফোন দিলেন। সে বললো, একজন বুয়া রাখেন ফুপু। আহা! ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, করলা ভাজি। বলা হয় না বৌ কি মনে করে আবার। ভাগ্নি চামেলিকে ফোন দিলেন। করলা ভাজি, গরম ভাত। ভাগ্নির হাতের ব্যথা এখনও ভালো হয়নি। একমাস ধরে গলার সঙ্গে হাত বাঁধা। অতএব কোনো আশা নেই। মেয়ে ফোন দিয়ে বিস্তারিত শুনে বললো, ‘তুমি ডায়াবেটিসের ডক্টরের কাছে না গিয়ে ফার্মেসির কোথাকার কোন মজুমদারের কাছ থেসে ওষুধ খেয়ে ডায়াবেটিস জিরো বানিয়ে ফেলছিলে। তো মসজিদের হুজুরের পানিপড়া খেলেই পারতে ডায়াবেটিস নিরাময়ের জন্য।’ মেয়ের বিদ্রুপ হজম করলেন বাধ্য হয়ে। মেয়ে বললো, ‘আম, দুধ আর মুড়ি পাঠালাম।’
‘এখন আবার আম পাঠাচ্ছিস কেন?’
‘রাজশাহী থেকে পাঠিয়েছে এক শুভানুধ্যায়ী। পচে যাবে না? তোমার ডায়াবেটিস কমে গেছে। শুধু আম খেতে থাকো। দেখবে দুদিনেই বাপ বাপ করে ডায়াবেটিস ৭-এ উঠে যাবে। ‘শুধু আম খাও বুঝেছ, শুধু আম।’
‘ওয়াক্!’ অনেক কষ্টে বমি চাপলেন শামীম আরা।
দুপুরে সজীব এলো। হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে। ‘আপনি অসুস্থ। তাই ভালো জাতের মিষ্টি আম নিয়ে এসেছি।’
চারদিনের বুভুক্ষু শামীম আরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সজীব আর তার আনা প্যাকেটের দিকে। সজীব বলে, ‘একটা খেয়ে দেখেন ফুপু! খুব মিষ্টি। এই আম খেলেই আপনি ভালো হয়ে যাবেন।’
‘ওয়াক!’
তিনি দৌড়ে গিয়ে বিছানা নেন। একসময় ঘুমিয়ে পড়েন। স্বপ্নে দেখেন তার মা যেন তার মুখে কিছু ঠেসে দিচ্ছেন। ‘ওয়াক্! ’
‘ওয়াক না ওয়াক না ফুপি, দেখেন ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত আর সবুজ করলা ভাজি দিয়ে মাখা লোকমা। খেয়ে দেখেন।’
পড়ন্ত বিকেলে তিনি তাকিয়ে দেখেন মা নয়, চামেলি। মায়ের মতো মমতামাখা হাতে তার মুখে ভাতের গ্রাস তুলে দিচ্ছে।