অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ১৭, ২০২৪
৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ১৭, ২০২৪
৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দীলতাজ রহমান -
প্রতিদান

আশপাশের মানুষের গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফাসুর থেকে তসিরন উদ্ধার করলো, তার বিশ বছরের ছেলে জামশেদ পাশের বাড়ির আরেক লোকের বিয়ে করা বউ, তার দুই সন্তানের মাকে নিয়ে লটর-পটর করছে। তসিরন কোনোকালে যে কোনো বিষয় নিয়ে বাড়ি মাথায় তোলার মানুষ ছিলো না! আজও কথাগুলো বুঝে ওঠার পরও কারো কাছে ধরা দিলো না। স্বভাব অনুযায়ী তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মানুষের উদ্দেশে নিজের চোখ দুটো এমনই পিটপিট করে দেখাতে লাগলো যে, সবার তাতে ভাববার কথা, তসিরনের শরীরটা কষে যাওয়ার কারণে চোখ জ্বালা করছে। নিজের শারীরিক অস্বস্তিতে কারো কথা তার কানেই ঢোকেনি!
এরপর ক’দিন ছেলে জামশেদের কাছেও ভাবখানা নিত্যদিনের মতো গৎবাঁধা করে রাখলো। ওদিকে আশপাশের ঘরের মানুষের কান চব্বিশ ঘণ্টাই তসিরনের ঘরের দিকে খাঁড়া। নিত্য খেয়োখেয়ির দশ-বারো শরিকের সবাই ভেবেছিল, অকাল বিধবা তসিরনের একমাত্র অবলম্বন পুত্র ওই জামশেদ এমন দুষ্কর্মের জন্য এবার অন্তত মায়ের তাড়া খেয়ে বাড়িছাড়া না হয়ে পারে না।
কিন্তু তসিরন বোঝে, বিষয়টা বেমালুম না বোঝার ভান করে থাকলেও অবস্থা আরো বাড়াবাড়ি হবে! ছেলে তার এমনিতে নিজে থেকে কারো সঙ্গে লড়াই-ফ্যাসাদে জড়িয়েছে, তেমন একটা শোনা যায় না। কোনো কাজকর্ম সে এখনো করে না। তবে কখনো সখনো সংসারে কিছু খরচপাতি আর জামশেদের শার্ট-প্যান্ট, মাফলার, জুতোয় নজর পড়ে কিছু কাঁচা টাকার আনাগোনা টের পায় প্রতিবেশীরা। এ বিষয়ে মানুষের খুচরো প্রশ্নের জবাব হয়, এলাকার কন্ট্রাক্টরের হেলপার হিসেবে কাজ করছিলাম। তাই ওস্তাদ মজুরি হিসেবে কিছু টাকা দিলো। এর বাইরে তসিরন এ বয়সেও যেখান থেকে যা জোগাড় করে আনে তা-ই বিনাবাক্যে খেয়ে উঠে চলে যায় পুত্র জামশেদ।
জোয়ান ছেলে অকর্মা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর খাওয়ার সময় হলেই শুধু ঘুরঘুর করে বাড়ি ফেরে। রাতেও আর যখন না ফিরলে নয়, তখনি কেবল ফেরে। তবু মা-ছেলে কারো বিরুদ্ধে যেন কারো কোনো অভিযোগ থাকতে নেই!
সে না-হয় দুনিয়ার তাবৎ বিষয় নিয়ে না থাকলে নেই! কিন্তু এখন? প্রতিবেশী কয় ঘরের পেটের ভাত চাল হয়ে যাচ্ছে! যারা কিনা জামশেদের বাবার চাচাতো ভাই, দাদারও চাচাতো ভাইয়ের আওলাদ কয়েক ঘর এবং তাদের ছেলেমেয়ে, বউয়েরা। মাথা তোলা সব তাদের নাতিপুতিরাও এই বিষয়ে খোলাসা করে জানতে বিস্ময়করভাবে কৌতূহলী! জামশেদের এমন অপরাধের যথাবিহিত শাস্তি মায়ের কাছে কী হয়, তা দেখতে উদগ্রীব তারা। কিন্তু মা তসিরনকে তো আগে ডুকরে উঠতে হবে! তারপর বিচার নির্ধারণে মা অক্ষম হলে দায় এক দুই সিঁড়ি দূরের হলেও চাচারা নিতেই পারে!

একটি মাটির ঘরের ভেতর মুলিবাঁশের বেড়া। ভেতরের এই বেড়াটা বাঁশের না হয়ে বাইরের দেয়ালের মতো মাটির হলে প্রসঙ্গ তুলতে তসিরনকে ছেলের কাছে যেতে হতো, কিন্তু তসিরন ঠিকঠাক হয়ে শুতে শুতে একদিন মনের ভেতর জড়তাগুলো চূর্ণ হতে একটু সময় নিলো। তারপর আচমকাই বলে উঠলো, ‘জামশেদ, তুই বলে আকবর আলীর কোন বাড়াটিয়া বেডার বউবেডি, সে বলে আবার দুই পোলাইপানের মা, হ্যার লগে ভাব জমাইছোস?’
অনেকক্ষণ পার হয়ে গেলো, ছেলের মুখে কথা নেই। শুধু চৌকিটা মচর-মচর করে ওঠায় তসিরন বুঝলো, জবাব না দিয়ে ছেলের এই নিশ্চুপ পাশ ফিরে শোওয়াই প্রমাণ করে, কথাটা মিথ্যে নয়। মিথ্যে হলে এক্ষুনি লাফ দিয়ে তার সামনে এসে টেনে তুলে বলতো, তুই একবার খালি ক মা, এই না হক কতা তরে কে কইছে, তারে দুই ফালা কইরা দিয়াসি!
ছেলের কাছে কোনো এক মেয়েমানুষঘটিত প্রসঙ্গ তোলার সেই বাড়ন্ত রাত থেকে তসিরন নিজের ভেতরে নিজে আরো সমঝাতে লাগলো। জামশেদ ওপাশ থেকে টের পেয়েছিল মা তসিরনের দাঁত কিড়মিড় শব্দ। আর এই ঘটনা ঘটলো যখন, বাড়ির সবাই তখন ঘুমিয়ে কাদা! অঘ্রানের শীত হামাগুড়ি দিয়ে নামায় প্রতিটি ঘরের জানালা এখন সেঁটে যায় ঘরের মানুষ বিছানায় যাওয়ার আগেই। তারপর মাটির দেয়ালেরও তো কিছু ক্ষমতা আছে মানুষের গোপনীয়তা রক্ষার।

রাত পোহালে জামশেদ বিছানায় থাকতে থাকতে তসিরন এককাঠা জমির ওপর খোলা বাড়িঘর ঝাড়পোছ করে, জামশেদের জন্য সকালের খাবার সাজিয়ে রেখে সেই কবে থেকে একসঙ্গে পরপর তিন বাড়ি কাজ করে যা পায়, দুপুর নাগাদ একবোঝা সস্তা মাছ-তরকারি কিনে এনে ঝড়ের গতিতে রান্নাবান্না শুরু করে দেয়। প্রতিদিন এই ঝড়ো আয়োজনের ভেতরই জামশেদ এসে হাজির হয়। মায়ের রান্নার সঙ্গে তাল রেখে সে গোসল করে গায়ে তেল মাখে। মায়ের রান্না হতে দেরি হলে ধারে-কাছে বসেই সস্তা মোবাইলটি টেপাটিপি করে ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে একটু যোগাযোগ, খুনসুঁটি চালাতে থাকে। আর এরই ফাঁকে মা তসিরনের অনর্থ কথাবার্তার যে উত্তর দেয়, তার ভেতরই ধরা থাকে জগতের যত অর্থময়তা। বাড়ির বাইরের ছেলেদের সঙ্গে নিজের ছেলের ওই যোগাযোগটুকুও মা তসিরনের ভালোই লাগে। তসিরন কত কত সময় বলেই ফেলে, বাড়িতে তো থাকন লাগে একবাড়ি কুমিরের তোপের মুখে। বাইরে কিন্তু কারুর লগে মন কষাকষি কইরো না বাজান!
মা-ছেলের একসঙ্গে এটুকু ফুসরতের জন্যই যেন সৃষ্টিকর্তা এতভাবে পৃথিবীটাকে ঢেলে সাজিয়ে রেখেছেন! তাই তো ফুল ফোটে, পাখিও গান গায়।
আরো ক’দিন কেটে গেলো জামশেদের সঙ্গে অন্যের স্ত্রীকে জড়িয়ে কথা শোনার। এ নিয়ে প্রতিবেশীর চোখে তসিরনকে ভাবলেশহীন ঠেকালেও, বিষয়টা তসিরনকে ভেজা গামছার মতো চিপড়াচ্ছে। কিন্তু মীমাংসার কোনো সোজা পথ সে খুঁজে পাচ্ছে না! ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে? কিন্তু বাড়ি কি তার নিজের? জামশেদের বাপেরও পূর্বপুরুষের জমি এটা। ভাগের ভাগ, তার দাদাই পেয়েছিলো তার বাবার থেকে এইটুকু। শ্বশুরও তার স্বামীর মতো অকালে গত হয়েছিলো।
শহর বড় হওয়াতে গ্যাস-বিদ্যুৎ না থাকলেও রেললাইনের পাশে দত্তপাড়ার কেউ কেউ কম জায়গার ভেতরেও দুই একখানা বাড়তি ঘর তুলে ভাড়া দিচ্ছে। দিনে দিনে তাই এটুকু জমির মূল্যও অনেক টাকা হয়ে গেছে। জামশেদের বাপের স্ত্রী হিসেবে সে পাবে এই জমির আটভাগের একভাগ। সেটুকু দিয়ে জামশেদই যদি তাকে বের করে দেয়! অতখানি ভেবে চমকে ওঠে তসিরন অথবা এমন হলো, কিছুই দিলো না! মেয়েমানুষ কবে তার বাপ-ভাই-স্বামীর থেকে সম্পত্তি বের করে নিতে পেরেছিলো!
জীবন কি তাকে কম শিখিয়েছে! জামশেদের বাপ সেই জোয়ানকালে হঠাৎ ঘুমের ভেতর মরে থাকলো। খালি ঘরে শোকে তিষ্ঠোতে না পেরে ছয় বছরের জামশেদকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে উঠেছিলো তসিরন। সপ্তাহ না যেতে নিজের বাপ এসে তাকে আবার এই শূন্য বাড়িতে রেখে গেলো। বলে গেলো, বাড়িছাড়া হয়ে থাকলে তোর শ্বশুরের জায়গাটুকু শরিকেরা দখল করে নেবে। পরে তা উদ্ধার করতে করতে তোর জীবন পার হয়ে যাবে। মা-রে মাটি কামড়ে পড়ে থাক। বাবা যখন তাকে রেখে যায়, তার হাতে একটা টাকা বা ঘরে একমুঠ চালও ছিলো না। তবে মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয় চোখের দেখাটা কখনো দেখতে আসতো!
তসিরন গালগল্পে কারো সঙ্গে এঁটে ওঠে না! তাই তার নিজের কাছ থেকে অন্তত তার কোনো বিষয় আগে থেকে কেউ জানতে পারে না। এমনকি নিজের ছেলে জামশেদও না। সে মনে মনে মাত্র ভাবতে শুরু করেছিল, পোলার বয়স কুড়ি পার অইছে, এবার একটা বউ আনতে পারলে আমি এট্টু রেহাই পাই। দিনকাল যা পড়ছে, হরহামেশাই সংসার ভাঙতাছে।
নিজেদের ভেতর থেকে কারো একটা পছন্দসই মেয়ের সাথে সে জামশেদের বিয়ে দেবে! কিন্তু জামশেদ কোনো কাজকর্ম শুরু না করলে কে তাকে মেয়ে দেবে! বিয়ের কথা তুললেই তো পাত্রীপক্ষ জিজ্ঞেস করবে, ছেলে কী করে? বিয়ের সময় জামশেদের বাপের দেওয়া তার এক-আধটু সোনা-রুপার গহনা যা আছে, তা ঘরের এক কোণায় কাচের একটা ছোট্ট বয়ামে করে মাটির নিচে পোঁতা আছে, যা জামশেদও জানে না। কতদিন তসিরন ভেবেছে, ওগুলো বিক্রি করে জামশেদকে একটা কিছু করতে দেয় অথবা খালি জায়গায় দুটো ঘর তুলে ভাড়া দেয়। কিন্তু জামশেদ কী যে করতে পারবে, মা তসিরন তাই বুঝে উঠতে পারছিলো না। তসিরন আবার এটাও ভাবছিলো, সংসারের জোয়াল একবার কাঁধে তুললে সে তো আর নামার নয়, তাই ধীরে ধীরেই ছেলের কাঁধে তা উঠুক! ছেলে তো ওই একটাই। মাকড়সার ছাও তো তার পুরা বুকই না খাইয়া নামে না!
নিজের মতো করে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে গা ঝাড়া দেয় তসিরন, মুরগির ছাওয়ের মতো যারে ছাও বানাইয়া পাখনার নিচে রাখছি অহন তরি, সেই পোলাই কিনা এত্ত বড় কামডা কইরা ফেললো!
নিজের অজান্তে কখন আবার ভাবনা উল্টাতে শুরু করে, এত্তটুক বয়সে বাপ মরছে, পোলাডার কি কম কষ্ট অইছে এদ্দূরা বড় অইতে! এহনো পাতের মাছ বাইচ্ছা দেওন লাগে। বহু বছর আগে থেকেই পাতের মাছ না বাছলেও চলে। কিন্তু জামশেদের পাতের মাছ বেছে দেওয়ার ছল করে নিজের পাতেরটুকুও মিলিয়ে দেওয়াই তসিরনের আসল উদ্দেশ্য। আর জামশেদও যখন প্রতিবার বাড়িতে ঢোকে, ‘মা, মা কই গেলি গোওওও…।’ শুধু এই ডাকটুকুর উত্তর দেওয়ার জন্যই বুঝি তসিরনের বেঁচে থাকাটা জরুরি। শুধু এইটুকুর জন্যই তসিরন সেই ভোর সকালে বেরিয়ে তিনবাড়িতে একটানা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যা পায়, তাই দিয়ে যা পারে কিনে প্রতিদিন একইতালে ঘরের দিকে তার উল্লম্ফ ছোটা। ছেলের ডাকে প্রতিবার চিকন স্বরে সেই একই উত্তর তার কাছে জমা, ‘এই তো এইহানে! কই আর যামু! কোন যমেই বা নেয় আমারে!’

মা-ছেলের বরাবরের এমন ছকের ভেতর একদিন পড়ন্ত দুপুরে জামশেদ বাড়িতে কখন ঢুকেছে তসিরন টের পেলো না। রান্নাবান্না সেরে সে মাত্র ঘরের পেছনের দিকে লাগোয়া বারান্দা থেকে সামনের বান্দায় এসে জামশেদকে জড়সড় হয়ে বসে থাকতে দেখে চমকে উঠলো। এমন তো কোনোদিন হয়নি বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে ছেলে বলেনি, ‘মা, কই গেলি মা…?’ তার ওপর ছেলের পাশে জড়সড় হয়ে বসে থাকা এমন এক মেয়ে! যার মুখে মেয়েত্ব’র কোনো ছাপ নেই! সে বেনওল মেয়ে মুখ নামিয়ে রাখলেও তসিরনের চোখ এড়ায় না, মেয়েটির চেহারার ভেতর ফুটে থাকা মা মা-ভাব! মুখে উঁকি দিচ্ছে অকাল বলিরেখার মৃদু আঁচড়ও। আগে থেকে রটনার সব জের তসিরনের চোখে স্পষ্ট মিলে গেলো। তসিরন হিতাহিত জ্ঞান ভুলে ছেলের দিকে চোখ পাকিয়ে জানতে চাইলো, ‘বিষয়ডা কী তর? মাইয়ামানুষ ধইরা আইনা বাড়ির ভেতর কী মনে কইরা থম মাইরা বইসা আছোস? বাড়িতে এই মাইয়া লইয়া ঢোকার অনুমতিডা তরে কে দিলো?’

জামশেদ মায়ের আক্রোশের মুখে আর কোনো উপায়ন্তর না দেখে একলাফে দাঁড়িয়ে বললো, ‘মা, ওয়ারে আমি বিয়া কইরা লইয়াইছি!’ ছেলের মুখের কথা শেষ না হতেই তসিরন উঠোনের কোণা থেকে চেলাকাঠ হাতে নিয়ে জামশেদের দিকে ছুটে যেতে যেতে বলতে লাগলো, ‘গোলামের পুত, ওয়ারে তুই বিয়া করছোস সংসার করতে, না ওয়ার দুধ খাইতে? তর মায় তরে দুধ খাওয়াইয়া বড় করে নাই লো গোলামের পুত! একডুখানি পোলা তুই আমার, তুই আরেক পোলাপাইনের মারে ধইরা লইয়াইছোস। কাইলকা হুনলাম, তর বিয়ার রোখ চাপলো, আর আইজকাই তুই কারে না কারে ধইরা লইয়াইলি। আমি তর কেউ না লো গোলামের পুত! বুকের টাটকা রক্ত খাওয়াইয়া আমি তরে মানুষ করছি। আর তুই আমার পাতে ছাই তুইল্লা দিলি। তর বুকডা এট্টু কাঁপলো না লো আমার কতা মনে কইরা?’
বাড়ির পাশে পুরোটাই খালি জায়গা। মায়ের হাতে লাঠি ওঠার আগেই এ-ঘর ও-ঘরের ফাঁক গলিয়ে জামশেদের পালাতে কষ্ট হলো না। কিন্তু এতদিন যারা তসিরনের অসম্ভব নির্লিপ্ততায় তাজ্জব বনে ছিলো, তারা সবাই এসে ভিড় জমিয়েছে ছোট্ট উঠোনের পুরো জায়গায় ঠাসাঠাসি করে। চাচা, জ্যাঠা সম্পর্কের পুরুষগুলো তসিরনের উদ্দেশে বলতে লাগলো, বাপ না থাকলে চাচারা ভাতিজারে শাসন করতে পারে। তুমি তো আমাগোরে গোনায়-ই ধরো না, তাই তো গুষ্ঠীর মুখে তোমার পোলা চুন-কালি ল্যাপতে পারলো!

তসিরনের মুখ আজ বল্গাহীন। সে ছেলে ছেড়ে ছেলের চৌদ্দগোষ্ঠীকে ধরলো, ‘যান, যান, যার যার কামে যান! এগুলা গটনা আপনেগো বিতরে আরো গটছে! সেগুলোর বিচার আগে করেন গিয়া! আর আমার পোলায় এই দোষটা ছাড়া কবে কোন দোষটা করছে যে আপনেগো আতে আমার পুলারে ছাইড়া দিমু? আমি অহনো মরি নাই, বুজলেন? কবে আপনেরা চাচা-জ্যাঠার দায়িত্বডা পালন করতে আইছিলেন? কবে একথালি ভাত লইয়া তার না খাইয়া থাহনের কোনবেলা আইছিলেন?
যান আপনেরা, যার যার কামে যান। আমার উঠান ছাড়েন। আমাট্টা আমারে বুইজ্জা লইতে দ্যান।’

সবাই একসঙ্গে না গেলেও তসিরনের উঠোন ক্রমে ফাঁকা হয়ে গেলো। কিন্তু বারান্দা ভরাট করে কোণায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ আগে জামশেদের সঙ্গে করে আনা মেয়েটি। তসিরন এখনো যার নাম জানে না। তসিরন আগের জায়গায় দাঁড়িয়েই চোখের তারা ঘুরিয়ে দেখলো জামশেদকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তারপর সে শিউলির পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেভাবে চোখ বোলাতে লাগলো, তাতে পর্যবেক্ষণের কোনো দৃষ্টি ছিল না। ছিল তার প্রতিটি সত্তাটিকে পুড়িয়ে ঝামা করে দেওয়ার আগুন। কিন্তু শিউলির স্বাভাবিক জড়তা তাকে আগাছার মতো ছাপিয়ে রেখেছে। তার চোখে পলক ফেলারও যেন ক্ষমতা নেই। চোখের তারা ডাঙায় তোলা মরা মাছের মতো নিশ্চল।
অন্তরে বড় অনীহা। তবু তসিরনের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘ঘরে ঢোকো!’
তসিরনের একঘেয়ে নিস্তরঙ্গ জীবনে শিউলি যে একটি মস্ত বড় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, এ হ্যাপা সামাল দিতে তার বুক-পিঠ এক হয়ে যাবে, তসিরন তা বুঝে গেছে। তার এত্তটুকুমাত্র স্বপ্নসাধ মুখে বলিরেখা ফুটে ওঠা এই মেয়েটি বালুর ঘরের মতো চুরমার করে দিয়েছে। একে ক্ষমা করার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু কী করবে সে! কারো কাছে গিয়ে হামলে পড়ে কেঁদে বুকের ভার কমাবে, তেমন কেউই যে তার নেই! বাবাকে আজ তার বড় দরকার ছিল। কিন্তু এত বছরে কি এত খবর পাঠিয়েও আনতে পেরেছে তাকে! একবার শুধু লোক মারফত খবর পেয়েছিল, বাবা জানিয়েছে, দিনাজপুর থেকে গাজীপুর এতটা পথের খরচ জোগাতে পারে না বলে সে আসতে পারে না মেয়ে আর নাতিকে দেখতে!
ধূসর চাদরের মতো সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে গেছে। জামশেদ এখনো বাড়িতে আসেনি। আজ দুপুরে খাওয়া হয়নি তসিরনের। জামশেদও ধাওয়া খেয়ে কোথায় ছুটে গেলো। শিউলি সেই দুপুর থেকে তসিরনের চৌকির এককোণায় বসে আছে। মাটির দেয়াল, চালে খসেপড়া টিনের সতেরো বন্দের ঘরখানার ভেতর তসিরন শিউলির থেকে বিরাট দূরত্বে সরে থাকতে একটা দেখানো ব্যস্ততা জাহির করে চলছে। আর সারাজীবনের জমে থাকা বিষের উদ্গীরণ ঘটাচ্ছে। যেন শিউলি মনে করতে না পারে, অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও তাকে জামশেদের বউ হিসেবে সে মেনে নিয়েছে। আবার বের করে দিলেও কী বিপদ ছেলের জন্য অপেক্ষা করছে, উকিলবাড়িতে এতদিন ধরে কাজ করে তাও আঁচ করে ফেলেছে তসিরন।
তাই এভাবে আর কতক্ষণ? যত বড় শত্রুই হোক তাকে তো কিছু খাবার দিতে হয়! কিন্তু সংসার ভেঙে বেলেল্লাপনা করে উঠতি বয়সী আরেক ছেমড়ার সঙ্গে যে মেয়েমানুষ বের হয়ে আসে আর সেই ছেমড়ার মা হয়ে তাকে খেতে দেওয়া মানে তো তাকে অনায়াসে মেনে নেওয়া! কিন্তু এই মাইয়ামানুষকে সে এটা ভাবার সুযোগ এত তাড়াতাড়ি দিতে চায় না। বরং আক্রমণের স্বরে শিউলির সঙ্গে দ্বিতীয়বার যে কথা বলে উঠলো, অহন তুমি কী করবা বইলা ভাবছো?
শিউলি খুব স্বাভাবিকভাবে বললো, ‘আপনে কন!’
‘আমি কমু মানে? আমারে কি জিগাইয়া তুমি এই কাম করছিলানি?’
শিউলির মুখে আর কথা ফুটলো না। সে চুপ করেই থাকলো। এদিকে ঘরের জানালায় বিভিন্ন বয়সের মানুষেরা উঁকি মেরে একদল চলে যাচ্ছে তো আরেক দল আসছে। চুনোপুঁটি ধরনের থেকে যাচ্ছে কেউ না কেউ। তাদের না দেখার ভান করে তসিরন যেন জোঁকের মুখে লবণছিটা দিচ্ছে। তসিরন ক্রমে টের পাচ্ছে, সংসারে আজ তার ভূমিকাটা ব্যাপক। নিত্যদিনের মতো গৌন নয়। তাই কারো কাছেই নিজের মূল্য হারালে চলবে না!
কিন্তু জামশেদ গেলো কই? প্রতিদিনই তো সে রাত করে বাড়ি ফেরে। তাতে তসিরনের কোনো দুশ্চিন্তা হয় না। কিন্তু আজকের কথা ভিন্ন। সে মনে মনে চিন্তা করে, আরেক পুরুষের বউ ভাগাইয়া নিয়াইছে। বিয়েডা আসলে অইছে কিনা! বিয়া অইলেও আগে যার বউ আছিল এই ছেমড়ি, সেই মরদে ধইরা জামশেদরে যদি ছাতু বানাইয়া দেয় গুণ্ডাপাণ্ডা লইয়া, কিচ্ছু করার নেই তার। কিন্তু নিজের ছেলেকে নিয়েও এই অনিবার্য ঘোর দুশ্চিন্তা সে মেয়েটিকে দেখাতে চায় না কোনোভাবেই এখন।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর আজ ভুতুড়ে নির্জনতা নেমে আসছে! বাতিটা অবশ্য শিউলি জ্বালিয়েছিল তসিরনের অনুমতি না নিয়েই। মাঝরাত পার হতেই ছেলের পরিণতি চিন্তা করে তসিরনের দাঁতে দাঁত বাড়ি খেতে লাগলো। বুকের ভেতর থরথর কাঁপুনি টের পাচ্ছে সে। এর ভেতরও সে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিমাপটুকু ভোলেনি।
তবু যখন দেখলো, এখন আর না বললেই নয়, সে শিউলিকে বললো, ‘তুমি চাইরডা খাইয়া লও!’
শিউলি বললো, ‘আপনে না খাইলে আমি খাইতাম না!’
তসিরন ঝামটা মেরে উত্তর দিলো, ‘আমার সাথে কি তোমার জোড়া নাকি? তুমি বুঝতে পারছো, তুমি আমার এতিম পোলাডারে কোন বিপদে ফালাইছো? তোমার জামাই তারে পাইলে আস্ত রাখবোনে?’
‘এহন আপনের পোলাই আমার জামাই! তার লাইগা দুশ্চিন্তা আমারও কম অইতেছে না!’
‘আমার এইটুক পোলারে জামাই কইতে শরম করতেছে না তোমার? কী দেইকখা তার হাত দইরা আমার বাড়িতে আইসা উঠলা! আচ্ছা, তুমি আমার বেক্কল পোলাডার মইধ্যে কী দেখলা? ছয় বছর বয়সের এই পোলারে লইয়া আমি বিধবা অইছিলাম। জীবনে আর কোনো পুরুষের দিকে ফিইরা তাকাই নাই। ভাবছি, যে আরেকটা বিয়া বইলে আমার পোলাডারে যুদিন হ্যায় বালো চোউখে না দেহে! খালি হেই ডরে! নাইলে রূপ তোমারতন আমার কম আছিল না, বুঝলা? কেমনে তুমি দুইডা পোলাপান থুইয়া, জলজ্যান্ত তাগো বাপেরে থুইয়া আমার অকর্মা পোলাডার লগে বাইর অইয়া আইলা?’
‘আমি আইছি আমার নিজের ভরসায়। মেলা কয় বছর ধইরাই আমি চাকরি করি। সংসার চালাই। তয় আপনার পোলাডা বেক্কল না, যতডা আপনে কইতাছেন। তাই আমি তারে বিয়া করছি তারে বাঁচাইতে! নাইলে আমার নিজেরে গোপন কইরা রাখার সুযোগ লইয়া আপনেগো এই বাড়ির মানুষসুদ্ধা আমার আগের বেডার লগে বুদ্ধি পাকাইয়া তারে ফান্দে ফেলতো।’
‘কী কইলা, ভাইঙ্গা কও তো আমারে!’ মেয়েটি পুরোনো কথায় ফেরে না। সে নিজের মতো বলে যায়- ‘…আর আমিও প্রকাশ্যে থাকতে চাইলে একা পারুম না। আমার একটা মানুষ দরকার আছিলো। আপনের পোলা ভালো মানুষ…।’
এবার তসিরন তাকে থামায়। ধমকের সুরে বলে, ‘আমার পোলারে আমার তোমার কাছ থেইকা চিনোন লাগবো? আর আমার পোলারে কে কী করতো, সেইডা আমি বুঝতাম!’
‘আপনে আপনের পোলার যেইদিক দেখছেন, সেইদিক আমি দেহি নাই। আর আমি যেইদিক দেখছি, সেইদিক আপনে দেখেন নাই।’
‘কথা তো ভালোই কও। লেহাপড়া জানা মাইনষের মতন। নাম কী তোমার?’
তসিরনের প্রথম প্রশ্নটা এড়িয়ে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তটাই দেয় শিউলি। শুধু নিজের নাম বলে সে, ‘শিউলি!’
‘যাও ভাত খাইয়া লও!’
‘আপনে না খাইলে আমি খাইতাম না!’
‘আমার অবস্থা বুঝবার পারছো তুমি, আমার পোলাডার লাইগা এই সময়ডা কী বিপদের। তার ওপর রাইতের বেলা সে ঘরের বাইরে। এই বাড়ির মাইনষে তারে কয়বার গলাডা টিইপ্পা ধরছে। আমারে কলঙ্কিনী করবার কত্ত চেষ্টা করছে। ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমির আমাগো মা-বেটা দু’জনার লাইগা। এহন তুমি আনলা আৎকা ঠাডা! বাজপড়া বিপদ!’
‘একটা ফোন দেই, আমার কাছে মোবাইল আছে!’
তসিরন বালিশটা টেনে শরীর এলিয়ে কাত হতে হতে বলতে লাগলো, ‘দৌড়ানির লগে তো মোবাইল ফালাইয়া থুইয়া গ্যাছে। কই জানি তুইল্যা রাখলাম। তুমি ভাত খাও। খাইয়া তুমিও শুইয়া পড়ো। দেহো, সব খাওন বালো আছেনি, সবই তো আইজ পচনের কতা। নসিবই যহন পচা…।’
শেষ কথার খোঁচাটা বুঝলো শিউলি। আজ তারও ক্ষুধাতৃষ্ণা, বেগ-আবেগ কিছু নেই। সে গুটিগুটি পায়ে ঘরের কোণাটি থেকে সরে এসে তসিরনের তেরছা হয়ে থাকা বালিশটা মৃদুটানে ঠিক করে দিয়ে গায়ের ওপর একটা কাঁথার ভাঁজ খুলে ছড়িয়ে দিলো! তারপর নিজে তার পাশে কোনো বালিশ-কাঁথা ছাড়াই কুণ্ডুলি পাঁকিয়ে পড়ে থাকলো নিজের আঁচলে পুরো শরীরটা মুড়ে।

তসিরনের ঘুম আসার প্রশ্নই আসে না। নানারকম বোধ তার মাথার ভেতর খেলছে। সে ভাবছে, এই মাইয়ামানুষটা যদি সরাসরি তার ছেলের বিছানায় চলে যেতো, তার কিচ্ছু করার ছিল না। সে নিজে তার বালিশ-কাঁথা ঠিক করে দিলেও আরো কাঁথা-বালিশ চৌকিটার কোণায় পড়ে থাকা সত্ত্বেও নিজে এমনিই তার পাশে কাত হয়ে পড়ে আছে। দু’বছর আগে মাত্র জামশেদের জন্য আরেকটা চৌকি কেনা। মা-বেটা দুইজনে মিলে ঘরের মাঝখানে বেড়া দেওয়া। তারপর থেকে তো তসিরন এই বিছানায় একাই শোয়। তসিরনের আজ একটু ভার ভার লাগে। যেন পরনের আটপৌরে শাড়িতে একগোছা চাবির ভার! অথবা হালকা শীতে নকশিকাঁথার উষ্ণতা। কারণ আজ কেউ তার পাশে আছে, তা যে কারণেই হোক। তবু এটুকু সময়ের ভেতর যা যা সে করেছে, এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি উদার হওয়ার উপায় তার নেই। সে কিছুতেই কণ্ঠা ঝেরে বলতে পারে না, ‘ও মাইয়া, আরেকখান কাঁথা লইয়া, আরেকটা বালিশ লইয়া তুমি ঠিক অইয়া শোও। তার আগে চাইরডা ভাত খাইয়া আসো!’
বরং বিচ্ছিন্ন করার অনিবার্য কথাগুলো ঘুলিয়ে তোলে। তসিরন হঠাৎই বলে ওঠে, ‘আইচ্ছা, আমার পোলার লগে তোমার এই কাণ্ডটা কেমনে গটলো, আমারে এট্টু খুইলা কও তো। আমি পরের মুখের রসলাগাইন্যা কথা শুনতে চাই না!’
‘আমার পোলাপানের বাপ আরেকটা বিয়া করছে। সে অনেকদিন ধইরা আমারে খাওনপিন্দন দেয় না! ঘরভাড়া দেয় না। বরং আমি যা জোগাড় কইরা আনি, তাই তারে রাইন্দা খাইতে দিলে আমারে উল্টা বকে, আরো ভালো খাওনের লাইগা। তারপর গরের ভিতর অন্যমানুষ আইনা জুয়া খেলে। তারপরও পোলাপাইনেরে বাপছাড়া করতে চাই নাই বইলা আগে উচ্চবাইচ্চ করি নাই। কিন্তু যহন টের পাইলাম, সে চায়, তার জুয়া খেলার ওইসব সাথীরা আমার সাথে ভাব জমাক, কথাকাটাকাটির ভেতর সেইদিনই আমি তার মুখে থু মারছিলাম।’
‘থামো তুমি! তার মানে, তুমি কইতে চাও আমার পোলা জুয়াও খ্যালে?’
‘তারে আমি খ্যালতে দেহি নাই। তয় তার সঙ্গী-সাথীরা তো যাইতো। তাগোরে ডাকতে যাইতো। আবার কেউ ফোন দিয়া পুরি, সিঙ্গাড়া কিনা দিয়াইতে কইতো।’
‘এর বিতর তোমার লগে ভাবটা অইলো কহন?’
একদিন আমারে আমার পোলাপানের বাপে এলাপাথাড়ি মারতেছিল জুয়া খেলোইন্যা ওগো সবতের সামনে, আপনের পোলা সবতের মইধ্যে একলা আমার দিকে তাকাইয়া কইয়া উঠলো, আপনে নিজে যহন চাকরি করেন, তয় এই নরকে পইড়া থাকোনের কাম কী? এরপর যতবার দেহা অইছে, কইছে, ‘আমার মায়েরে গিয়া দেইখা আইয়েন। হ্যায় কেউরে তোয়াক্কা কইরা চলে না। আর আপনে তো কিছুডা লেখাপড়া জানেন।’ তার কথায় আমি সাহস পাইয়া আলাদা বাসা লইয়া নিজেরে গোপন রাখছিলাম। এমনকি আগের অফিসের চাকরিও ছাইড়া অন্য অফিসে চাকরি নিছি। কুনোভাবে আমারে য্যান ওরা কেউ খুঁইজ্জা না পায়!
‘শ্যাষে…?’ কণ্ঠে কোনো আঁঠাকষা নেই, তবু ঘটনাটা এতদূর এলো কী করে, তাই জানতে তসিরন উন্মুখ হয়ে উঠলো।
‘আমারে খুঁইজ্জা না পাইয়া আপনের পোলার ওপর জুলুম করতে উইঠাপইড়া লাগলো। বুদ্ধি পাকাইতেছিলো সগলতে মিইল্লা। আর এইটা আমি টের পাইলাম যহন, বুঝলাম, থানা-পুলিশের কাছে আপনার পোলার নামে বেহুদা একটা মামলা করলেও পুলিশ তারে পিটাইয়া আধমরা কইরা ছাড়ব। আবার আমারে পাইলেও তালাক না দেওনে স্বামী থাকনের অধিকারে সে যা খুশি আমারে করতে পারে। তাই এইটা ছাড়া আমার উপায় আছিল না। এহন তো আমি অন্যের বউ, এহন আমারে কিছু কইয়া দেহুক!’
‘তোমার বয়স কত?’
‘এরশাদ যেদিন ক্ষেমতা ছাড়ছে, মায় কইছে সেইদিনই আমার জন্ম।’
তসিরন মনে মনে স্মৃতি হাতড়ায়। তার মনে পড়ে, জামশেদ তখন হাঁটতে শিখছে। আর সেই সময়ের স্মৃতির ভেতর ঢুকে পড়ে তার ভেতর থেকে বেরোতে কিছুক্ষণ ভুলে যায় তসিরন। যেন যুবক স্বামী তাকে এখনি জাপটে ধরবে! ঘন নিঃশ্বাসের ভেতরই আবার জানতে চাইলো, ‘পোলাপান কই তোমার?’
‘আমার মায়ের কাছে। বাড়ির অবস্থা একেবারে খারাপ না আমাগো। তবু আমি মাসে মাসে টাকা পাঠাই।’
‘কাজ করো কই?’
‘গাজীপুরেই একটা সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে।’
রাত ফুরিয়ে যায় অসম বয়সী দুই নারীর এই ক’টা কথাতেই। বহুদিনের অভ্যাস আজানের সঙ্গে সঙ্গে উঠে দরজা খোলা। কিন্তু আজকের ভোরটা তসিরনের কাছে ভয়ঙ্কর লাগছে। তবু সে আজ বিছানায় আড়মোড়া না ভেঙে একটানে উঠে দরজা খুললো। অন্ধকার তখনো ফর্সা হয়নি। হাঁটুমুড়ে বসে থাকা মানুষের মতো উঠোনের এককোণায় মেন্দি গাছটার ঠিক নিচে কী একটা দেখে তসিরন বেশ আঁতকে উঠলো। মনের ভেতর ছেলেকে নিয়ে কু ডাকতেই গাছটির তলায় গিয়ে দেখে, জামশেদ গুটিসুঁটি মেরে বসে আছে। সারারাত যার জন্য চোখের পাতা বন্ধ করতে পারেনি, তবু তাকে এত কাছ থেকে দেখেও আবার গর্জে উঠলো তসিরন, ‘সারা রাইত কই আছিলি বান্দির পুত?’
জামশেদের কোনো উত্তর না পেয়ে আবার গতকালের পড়ে থাকা চেলাকাঠটি তুলে নিয়ে ছুটে আসে তসিরন। কিন্তু আজ জামশেদ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু জেগে ওঠা আস্ফালনটি তো বৃথা যেতে দিতে পারে না তসিরন। সে দু’ঘা লাগিয়েই বলে, যেইহানে ছিলি, সেইহানে যা গোলামের পুত!
ঠিক আছে, তুই তাইলে আমার বউয়েরে দিয়া দে, যাইগা, যেদিকে দুই চোখ যায়!
তসিরনের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। কী বললো তার নিজের ছেলে! জামশেদ তো শুধু তার ছেলেই নয়, একমাত্র অবলম্বনও তো! এই এক্ষুনি বউকে দিয়ে দিলে সে মা-কে ফেলে চলে যাবে! যার সাথে বিয়েটাই হয়েছে কি হয় নাই, সে সন্দেহই দূর হয় নাই তসিরনের। আর সেই মাইয়া মানুষটার জন্য ছেলে তারে ফেলে দিয়ে চলে যাবে!
তসিরন যখন দোটানায় দীর্ণ, শুধু ঢোক গিলে গিলে গলা ভেজাচ্ছিল, চাইছিল এই মুহূর্তে তার নিজের মরণ হোক, যেন তার এই বিশ্বাসঘাতক ছেলে সেই শোকেই জব্দ হয়। এর থেকে কম শাস্তি সে ছেলের জন্য কিছু খুঁজে পেলো না। মায়ের খাবিখাওয়া ফুসরতে জামশেদ বলতে লাগলো, ‘কাইল সন্ধ্যা রাইততন আমি চুলার কাছে কুত্তার লগে পইড়া রইছি, খোলা বাতাসে আমার কইলজাসুদ্দা ব্যথা করতাছে! আমি কি পারতাম না কুনো দোস্তের বাড়ি গিয়া থাকতে? কিন্তু তরে থুইয়া আমি কোনোখানে আইজতক একটা রাইত থাকি নাই! তারপরও যদি বাইর কইরা দ্যাছ, দে, যাই গিয়া!’
ছেলের কথা আর বাড়তে দিলো না তসিরন। পুরোনো ঝাঁজের রেশ টেনে হাতের চেলা দিয়ে পথ দেখিয়ে বললো, তুই যা যেদিকে চোউখ যায়। কলমা যহন পড়ছোস, কইতাছোস, তয় বউ অইলো বংশের ইজ্জত, হ্যারে লইয়া কই যাবি? একলা যা, টাকা-পয়সা কামাই কইরা বাড়িত আইস!
জামশেদ কথা বাড়ায় না। সাতসকালে বাসিমুখে ক’জন তাদের ধারে-কাছে জমে উঠছে টের পেয়ে তসিরনও দ্রুত বড়সড় মুড়া ঝাড়ুটা নিয়ে ঝড়ের বেগে ঠাসঠুস করে উঠোনটি ঝাড়ু দিতে দিতে বলতে লাগলো, ‘বাসি উডানে বাসিমুখের মানুষ, কপালে এতদিনে দুখখ বুঝি জাঁকাইয়া বইলো।’
ঝাড়ুটা দরজা বরাবর আড়াআড়ি ফেলে রেখে রণ-রঙ্গিনী হয়ে ঘরে ঢুকলো তসিরন। দেখলো জামশেদ ঘরে নেই। বরং এইটুকু সময়ের ভেতর ঘরদোর গুছিয়ে, হাঁড়ি-পাতিলের পচে ওঠা ভাত-তরকারি সব ফেলে, মেজেধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলেছে শিউলি। যেন এ সংসারে সে অতি অভ্যস্ত একজন। তসিরনের করার মতো ঘরে আর কিছুমাত্র কাজ বাকি নেই।
যা নিয়ে সে ব্যস্ত হতে পারে। অগত্যা সে কী আর করে, এবার বুঝি ঘটনার তোড় তাকে টলাতে থাকে। ভাসিয়ে কোনো কূলে নেয় না। ছেলে তাকে বলেছে ‘আমার বউয়েরে দিয়ে দে…!’ মানে ছেলের জীবনে এখন তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেউ এসে গেছে! আর সে হলো গাছের মরা বাকল! আধদিন আর একরাতের ভেতর এই পরিবর্তনের ধকল তার বেশ লাগছেই, যেভাবে ঝড়ের সময় ঢেউয়ের বাড়ি গায়ে লাগে কলিজা বরাবর!
তসিরনের বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছে। কিন্তু টাল সামলে না রাখলে যা হবে, তাও তসিরন জানে। কিন্তু নিজের সে পতিত অবস্থা দেখার আগে তসিরন নিজের মরণ চায়। এর ভেতরই আচমকা সে গলা বাড়িয়ে জামশেদকে ডাক দিলো, এদিকে আয় লো বীর পুরুষের ব্যাডা!
জামশেদের ভয় কাটার কোনো কারণ নেই। তবু সে কাছে এসে সাহস করে মার মুখের ওপর বলে ফেললো, ‘গোলামের পুত আর বান্দির পুত ছাড়া মা, তুই যে আরেকটা গালিও জানোস, এইডা তো শুনি নাই কোনোদিন! এইডার মানে ক’ আগে?’
তসিরন ছেলের হাতে ছোট একখানা খন্তা দিয়ে ঘরের দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে বললো, ‘এইখানে খোঁড়!’
জামশেদ তাজ্জব বনে বললো, ‘কী করুম এইখানে খুঁইড়া?’
‘দ্যাখতে অইবো না তুই আমার কব্বরডা ক্যামনে খুঁড়োস? সেইটা তো তরই করণ লাগবো, নাকি?’ জামশেদ পারে না খন্তাখানা ঠিকমতো ধরতে। তসিরন অসহিষ্ণু হাতে শেষে নিজেই খুঁড়ে মাটির একটু নিচ থেকে দেড়যুগ সময় ধরে পুঁতে রাখা তার সামান্য কিছু সোনা-রুপার গহনা তুলে ছেলের হাতে দিয়ে বললো, ‘ওই বেডিরে ওগুলো পরাইয়া দে!’
জামশেদ কোনোদিনই টের পায়নি তার মা’র এটুকু সম্পদ আছে। একখানা একখানা করে সে নিজের চোখের সামনে হালকা-পাতলা গহনাগুলো তুলে দেখতে দেখতে তার চোখে-মুখে এক আশ্চর্য আলো ফুটে উঠলো। অভিভূত তার কী বোধ জাগ্রত হলো, সে ভেজাকণ্ঠে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমারে তো কুনোদিন কস নাই মা, তর এত্তকিছু আছে? আমি তো খালি স্বপ্ন দেখছি, রোজগার করতে শুরু করলে, তরে আগে এমুন একখান হার বানাইয়া দিমু! এককাম কর মা, কয়দিন পরে দে! ওয়ারে তো এহনো আমি ভালো কইরা চিনিই নাই! পরে যুদিন তরে না মানে? কয়দিন দ্যাখ!’
‘বুকের টাটকা রক্ত খাওয়াইয়া এই যে তরে একা একা বড় করলাম, তুই দেহি একটু আগে আমারে ফালাইয়া ওই না চেনা মাইয়ামানুষটারে লইয়াই পথে নামতে চাইলি! আর আমারে আমার যে শান্তির দুনিয়া থেইকা ছিটকাইয়া নামাইলি, সেইখানে তো আর আমারে পৌঁছাইয়া দিতে পারবি না বাপ! তয় তোর হার বানাইয়া দেওনের স্বপ্নডা আমার লাইগা কম দামি না!’
‘ওইডা তো মা কথার কথা, যেইডার লাইগা তুই কষ্ট পাইতাছোস্…!’
‘কথার কথা দিয়াই বাপ আসল অবস্থা মানুষের আসল রূপ ঠিকরাইয়া পড়ে। আর আসল কথা হইলো চেলাকাঠের মতো, যা না জ্বালাইলে চুলা জ্বলবো না! কথার কথা কোনোভাবে জ্বালানো যায় না বইলা, মাইনষের বাঁচাটা ওইটুকুই সহজ করে। আনন্দের করে।’
জামশেদ মায়ের এতকিছু বোঝে না। রাখঢাক না রেখেই শিউলির সামনে বলে উঠলো, ‘তরে কই কি মা, ওরে এহনি জিনিসগুলা দেওনের কাম নাই। আগে ওরে চিইনা লই!’
‘তরে আগে থেইকা চিনলে বুঝি এম্তে আগলাইয়া রাখতাম? কম চেনার ভেতরই যত সুন্দর হইবার ইচ্ছা, আশা, আনন্দ লুকাইয়া থাকে। তারপর প্রত্যেকদিনই তো একজন আরেকজনরে চেনার পালা! চেনানোর পালা। যার যা জানা হয় নাই, যার যা চেনা হয় নাই, সে নিজেরে ক্যামতে আরেকজনের কাছে চিনাইবো, জানাইবো এইটাই তো তার চেষ্টা! ফুলের মইদ্দে গন্ধ আছে বইলাই তো ফুল তা ছড়ায়। তয়, মানুষ তো আর ফুল না! বুইঝ্যা শুইনা মন্দ কাজডা না করলেই অইলো। মানুষেরে নিজের মন্দ রূপটা না দেখাইলেই হইলো!’ এটুকু বলেই তসিরন জামশেদের মুখ থেকে শিউলির মুখের ওপর দৃষ্টি বিদ্ধ করে আবার বলতে লাগলো, ‘ও মাইয়া, শোনো, একটা গুণ আমি তোমার টের পাইছি, তোমার সেই গুণের জোরেই তুমি সারাজীবনের লাইগা আইজ পার পাইয়া গেলা। নিজে দেইকখ যেটুকু বুঝলাম, তা হইলো, তুমি অন্যের মেজাজ-মর্জি ভালো বোঝো। না অইলে যার বাড়ি তার লাই থুইয়া এতক্ষণ কই থাকতাম, জানি না! আমার মনে অইলো, মাইয়াডা তুমি খারাপ না। সুযোগ পাইলে তুমি পারবা, দুনিয়ার এই সংসার নামক খোঁয়াড়ডারে ফুলের বাগানও বানাইতে পারবা…।’
শিউলি তসিরনের পা ছুঁয়ে সালাম করলো না বটে, কিন্তু নিজের মাথাটা তসিরনের বুকে গুঁজে রাখলো এবং তসিরনের গহনার বয়ামটি ঠেলে সরিয়ে বললো, ‘আমার-আপনার বলে কোনো কথা এই সংসারে থাকতে পারবো না মা! যা আপনের তাই আমার। যা আমার তাই আপনের! আমারও কিছু গহনা আছে। সেগুলা আমার মা’র কাছ থেইকা আইনা লই, আমি আপনে দুইজনে মিইলা পরবো।’

+ posts

Read Previous

হাসিন আরার দুটি অণুগল্প

Read Next

চোখের আলোয় দেখেছিলেম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *