এই জাউরর্যা, কড়া কইর্যা এক কাপ রঙ চা দে। চিনি বেশি দিবি।
—দেরি অবে!
—দেরি অবে ক্যা? মাগনা খামু? দুই টাহার চায়ের দোহানদারি কইর্যা জমিদার মনে করো নিজেরে! তোর চা তুই মাথায় ঢাল হালার পুত! এই গ্যালাম!
গঞ্জ করতে করতে লোকটা দোকান থেকে বেরিয়ে মহাসড়কের ওপারে গিয়ে অন্য দোকানে ঢোকে। স্বর্ণাভ তার গমন পথের দিকে আনমনে চেয়ে থাকে।
হেমন্তের সকাল। পাতলা কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্য দিনের প্রথম রশ্মিজাল বিছিয়ে দিয়েছে। রাস্তার পাশে ফুটে থাকা বুনোফুলের মঞ্জরীর উপর একটা ঘাসফড়িং আপন মনে খেলছে। পাশেই বিরাট এক মাকড়সার জাল বিছানো। জালের তন্তুগুলো শিশির জড়িয়ে সকালের রোদে মুক্তার মতো জ্বলছে। ঘাসফড়িংটা উড়তে গিয়ে হঠাৎ করে জালে জড়িয়ে যায়। তারপর প্রাণপণে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে। যত পাখা ঝাপটায় ততই জালে জড়িয়ে পড়ে। শিশিরের জলে ভিজে পাখা ভারী হয়ে উঠছে। সারারাত অভুক্ত বিশাল মাকড়সাটাও একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। ঘাসফড়িংটা তার শেষ চেষ্টা করে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু ভেজা পাখনাটা বোধহয় ছিঁড়েই গেল! সুযোগ বুঝে মাকড়সাটা ছুটে এসে তার আট বাহু দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঁকড়ে ধরে ঘাসফড়িংটাকে। শেষ শক্তিটুকু দিয়ে ঘাসফড়িংটা নিজেকে মুক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে স্থির হয়ে যায়।
স্বর্ণাভর আর ভালো লাগছিল না। সকালটা কেমন ভারী হয়ে ওঠে। সে চোখ ফেরায় চায়ের দোকানদারের দিকে।
চুলা থেকে অবিরাম ধোঁয়া উঠছে। আর দোকানদার একটা বাঁশের চোঙ মুখে লাগিয়ে অনবরত ফুঁ দিয়ে চলছে। গাছের ফাঁক দিয়ে ভোরের সূর্য এসে তার শুকনো মুখখানা উদ্ভাসিত করে তুলেছে। চুলাটা দপ করে জ্বলে উঠতেই দোকানির চোখে-মুখে একটা প্রশান্তি ফুটে ওঠে। স্বর্ণাভর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে— স্যার চা খাবেন?
পকেট থেকে একটা পুদিনা পাতা বের করে দোকানদারের হাতে দিয়ে বলে— এটা কাপের মধ্যে দিও আর চিনিটা কম দিও।
—আমার কাছে জিরো সুগার ট্যাবলেট আছে। আপনে চাইলে দিতে পারি। তয় চায়ের দাম এক টাকা বেশি পড়বে- ছয় টাকা।
দোকানদারের অভিজ্ঞতা দেখে স্বর্ণাভ মনে মনে হাসে। বলে— জিরো সুগার লাগবে না। আমার ডায়াবেটিকের সমস্যা নেই। এমনিতেই চিনি কম খাই।
দোকানদার খানিকটা বিস্মিত হয়ে বলে— কন কী স্যার? আমার দোকানে যারা চা খাইতে আসে ডায়াবেটিক না থাকলে সবাই চিনি বেশি চায়। চায়ের দাম তো আর পাঁচ টাকার বেশি দেবে না! যত বেশি চিনি খাইতে পারে তত লাভ! কেউ কেউ তো চিনির শরবত খাইতে চায়! স্যারে মনে হয় আমাদের এলাকায় নতুন?
—হ্যাঁ, সপ্তাহ দুই হলো এসেছি।
—আপনারে দেইখ্যাই বুঝতে পারছি!
—কীভাবে?
—আমার এখানে তো আপনার মতো শিক্ষিত লোক কেউ আসে না! আমার কাস্টমার অইলো ওই খালপাড়ে যে স্ব-মিল দেখছেন না, ওইগুলোর লেবার, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা আর অচেনা নতুন লোকজন। তারা তো এত সকালে কেউ আয়না।
—শিক্ষিত লোকজন আসে না কেন?
—আমার দোকান তো ভাঙ্গাচোরা! কাস্টমারের বোধহয় পছন্দ হয় না। আর এখানে নিত্য নতুন লোকজন প্রায় আসে না বললেই চলে। চেনাজানা লোকজন সবাই যায় ওপাশের কফি হাউসে। সে দোকান সাজানো-গোছানো তো!
—তোমার নাম কি?
—জহুরুল হক।
—একটা কথা বলব? কিছু মনে করবে না তো?
—না স্যার! আমার আর মনে করা! আমাগো মতো মানুষের কি মন আছে!
—তুমি তো বেশ সুন্দর করে কথা বল! আচ্ছা, ওই যে লোকটা রাগ করে চলে গেল তাকে তুমি যেতে দিলে কেন? দিনের প্রথম ক্রেতা চলে গেলে ভালো লাগে?
—ও একটা অমানুষ স্যার! শোনলেন না, আমার নামটা পর্যন্ত গালাগালির পর্যায়ে নিয়ে গেছে!
—তাই তো! কেন এমন হলো জহুরুল হক?
—সে অনেক কথা। আপনার শোনার সময় হবে?
—আজ আমার তো ছুটি! তাই তোমার দোকানে চলে এলাম নতুন জায়গায় চা খাব বলে।
—তাইলে আগে চা নিয়ে আসি! তারপর কথা কই! আট-নয়টার আগে আমার এখানের লোকজন আয় না।
স্বর্ণাভ চায়ে চুমুক দিয়ে বুঝতে পারে সবটুকু যত্ন ঢেলে চা-টা করা। সে বেশ তৃপ্তির সাথে চুমুক দিতে দিতে বলে— এবার বলো তোমার কথা।
জহুরুল হক কাঁধের গামছা দিয়ে বসার টুলটা মুছে আয়েশ করে বসে। তারপর একটা বিড়ি বের করে আবার কী যেন মনে করে রেখে দিয়ে বলতে থাকে— বাবা যতদিন বাঁইচ্যা ছিল ততদিন স্কুলে গেছি। নামটাও ততদিন বাঁইচ্যা ছিল। আর ছিল কৃষি জমি, গরু-বাছুর। সাথে বাবার ছোট একটা আড়ত ছিল। কৃষি কাজের অবসরে বাবা কাঠের ব্যবসা করতেন।
বাবা মারা যাইতেই স্কুল ছাড়তে হয়। আর নামটাও বদলাইতে থাকে। জহুরুল হক দিয়া প্রথমে জরুল, তারপর জরু, সবশেষে জউর্যা। আমার মত যাদের দশা ওরা সবাই নামটারে তামাশা কইর্যা গালাগালির ভাষা কইরা ফ্যালাইছে।
স্বর্ণাভ বিস্মিত হয়ে ভাবছিল মানুষের নামটা পর্যন্ত কীভাবে হারিয়ে যায়! এটাও তো এক একটা নক্ষত্র মরে কৃষ্ণগহ্বর হয়ে যাওয়ার মতোই আশ্চর্য! জন্মের সময় পাওয়া একটা নামকে দারিদ্র্য কীভাবে একটু একটু করে গ্রাস করে ফেলে!
কাঁধ থেকে গামছাখানা সরানোর জন্য জহুরুলের নগ্ন শরীরটা চোখে পড়ে। বুকের দু’পাশে সুবিন্যস্ত হাড় ক’খানা দেখা যায়। গোটা শরীরে কোথাও মাংসপেশি আছে বলে মনে হয় না। শ্বাস-প্রশ্বাসের তালে তালে বুকটা মৃদু ওঠানামা করছে। শুকনো মুখমণ্ডল দেখে বয়স অনুমান করা যায় না। তবে বোঝা যায় অকাল বার্ধক্য নেমে আসছে। তার মধ্যে মলিন মুখে একফালি হাসি লেগে আছে।
স্বর্ণাভকে অপলকে চেয়ে থাকতে দেখে জহুরুল হক বলতে শুরু করে— বাবা এক মহাজনরে সারা বছর কাঠ দিতেন। কখনো নগদ টাকায় আবার কখনো বাকিতে। অল্প অল্প করে একবার অনেক টাকা বাকি পড়ে যায়। বাবার শরীলটা তখন ভালো নাই। হার্টের সমেস্যা, পেশারে কাহিল অবস্থা। ডাক্তারের কাছে নেওয়া দরকার। কিন্তু কোথাও টাকা নাই। শেষে আমিই একদিন যাই মহাজনের কাছে টাকা চাইতে।
প্রথমটায় সে আমারে চেনতেই পারে না। আমি বুঝি— ওসব ভান; টাকা না দেওয়ার ছুতা। তাই মেজাজটা বিগড়াইয়া যায়। একটু গরম সুরে কই— বাবার চিকিৎসার জন্য টাকা লাগবে। কোনো অজুহাত চলবে না। আইজ টাকা না নিয়া আমি যামু না।
মহাজন আমার দিকে লাল চোখে চায় একবার। তারপর যেন কিছুই হয় নাই এমনি নির্লিপ্ত সুরে বলে— তোর বাপে তো আমার কাছে কোনো টাকাই পাবে না! তোর বাপরে যাইয়া জিগাইস। হয়তো তোরে ধার নিতে পাঠাইচে। কী কইতে কি কইয়া ফেলছিস নিজেই জানো না। যাক ওসব কথা, আমার নানান ঝামেলা আছে। পরে একদিন আইস। চেষ্টা কইর্যা দেখমু।
বাবা কথাগুলা শুইন্যা কিছুদিনের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস রাখে। তার আগে জমির তিন ভাগের দুই ভাগ চইল্যা যায় বন্ধকী মহাজনের হাতে।
বাবা মারা গেল যে লোকটা জমি বন্ধক রাখছিল সে একদিন আসে লোকজন নিয়া— হয় টাকা ফেরত দাও নয় জমি কাগজে-কলমে লেইখ্যা দাও! কিন্তু টাকা তখন কোথায় পামু! তাই জমিটুক শেষ পর্যন্ত লেইখ্যাই দিতে হয়।
তারপর কিছুদিন মানুষের বাড়ি এটা সেটা করতাম। কিন্তু তাদের মতের একটু এদিক সেদিক হইলেই অনায়াসে বাপ-মা তুলে গালাগাল দিত। এই ধরেন, আকাশে খুব মেঘ গর্জন আর বর্ষা। গরুটা মাঠে ছিল। আমি কেন গরু আনতে পারি নাই, কেন গরুটা ভিজল তার জন্য আমাকে গালাগাল শোনতে হইত। কিন্তু আমি যে মানুষ, ওই মেঘ গর্জনের মধ্যে গেলে আমিও যে মারা যাইতে পারি সে কথা কেউ ভাবে না! মানুষের চাইতে সকলের গরু-বাছুরের দিকে দরদ বেশি! তারপরও লাথি-ঝাঁটা খাইতে খাইতে দিন কাটছিল। কিন্তু আসমা আসার পর আর মানুষের বাড়ি কাজে যাইতে দিতে চাইল না।
—আসমা কে? তোমার বউ?
জহুরুল হকের শুকনো মলিন মুখমণ্ডলে কে যেন একটা রঙিন আভা বিছিয়ে দেয়। একটু লাজুক হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
—আসমা কি জানত যে লোকে তোমাকে গালাগাল করে?
—জানবে না কেন! সেও তো টাকাওয়ালা ঘরের মেয়ে না! অমন গালাগাল তারও কত হজম করতে হইচে! তাই আমার অবস্থা সে ভালো কইর্যাই জানত! সে যে কোনো মূল্যে আমারে কামলা খাটা দিয়া উদ্ধার করার চেষ্টা করে।
—তোমার আসমা তো তাহলে বেশ বুদ্ধিমতী! তোমার সম্মান রক্ষার দিকে তীক্ষ্ন নজর!
—হ্যাঁ, সে ভালোই চাইছিল। কিন্তু ভাগ্যে সইল না যে!
কথা শেষ না হতেই দু’জন লোক এসে দোকানে ঢোকে আর জহুরুল হকের মুখখানা শুকিয়ে যায়। চোখে-মুখে একটা আশঙ্কা দোল খেতে থাকে। স্বর্ণাভর সেটা চোখ এড়ায় না। একজন কর্কশ স্বরে বলে— কাল দু’দুবার এসে তোমকে পাওয়া গেল না। পালিয়ে ছিলে নাকি?
জহুরুলের গলা থেকে শব্দ বের হয় না। শুধু না সূচক মাথা নাড়ে। কিন্তু আগন্তুক লোকটা তাতে খুশি হয় না। তার গলা ক্রমশ সপ্তমে চড়তে থাকে— টাকা কি মামা বাড়ি থেকে আসে? ঋণ নেওয়ার সময় মনে ছিল না যে সময় মতো কিস্তি পরিশোধ করতে হবে? বেশি কথার সময় নেই, কিস্তির টাকা বের কর। টাকা না নিয়ে আজ যাচ্ছি না। লোক দু’টো গ্যাঁট হয়ে বসে।
জহুরুলের মুখের দিকে তাকানো যায় না। সে মুখ মড়ার মতো ফ্যাকাশে। বিষয়টা বুঝতে আর বাকি থাকে না। অগত্যা স্বর্ণাভ জহুরুলকে আড়াল করার একটা শেষ চেষ্টা করে। লোক দু’টোর কাছে গিয়ে বসে সবাইকে চা দিতে বলে। কিন্তু তারা সে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলে— সাত সকালে আমরা চা খেতে আসিনি। আপনি বরং টাকাটা দিতে বলুন। আমরা চলে যাই।
জহুরুল হক চায়ের কাপ হাতে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোকের দিকে চেয়ে আছে দেখে স্বর্ণাভ তাড়া দেয়— কী হলো, চা দেবে না?
—আপনাকে তো চিনলাম না! আগন্তুকদের একজনে স্বর্ণাভর কাছে জিজ্ঞেস করে।
—আমি এখানে নতুন এসেছি। আজ ছুটির দিন বলে সকালবেলা চা খেতে বেড়িয়েছি। আপনারা বুঝি—
স্বর্ণাভকে থামিয়ে দিয়ে লোকটা বলে ওঠে— ‘সৌভাগ্য’ এনজিও থেকে এসেছি। এই দোকানদারের গতকাল এক হাজার টাকার কিস্তি ছিল। কিন্তু দুই বার এসেও দেখা করতে পারিনি। বোধহয় টাকা জোগাড় করতে না পেরে পালিয়ে ছিল। পালিয়ে ক’দিন থাকবে বলুন? আমাদের এনজিও-র মালিক হচ্ছে এখানকার মন্ত্রীর শ্যালক। কিস্তি না দিলে ওকে নিংড়ে টাকা বের করে নিয়ে যেতে পারি। কেউ চোখ তুলে তাকাতেও সাহস করবে না।
—বুঝতে পারছি আপানার কথা। শুধু আজকের দিনের জন্য আমার অনুরোধে ওকে সুযোগ দিন। পরের বৃহস্পতিবার জহুরুল ঠিক টাকাটা দিয়ে দেবে।
—একবারে দুই সপ্তাহের কিস্তি কি করে দেবে? যে এক সপ্তাহের টাকাই দিতে পারে না!
—আমি বললাম তো! একটা ব্যবস্থা ঠিক করে নেবে। আজকের দিনটা শুধু—
লোক দু’টো গটগট্ করে চলে যায়। প্রায় সাথে সাথে এতক্ষণ রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা এসে ঢোকে।
জহুরুল বোধহয় তার জন্য প্রস্তুত ছিল। সে জীর্ণ ক্যাশ বাক্সটা একপাশে সরিয়ে নিচ থেকে পাঁচশ’ টাকার একটা নোট বের করে আনে। লোকটার হাতে দিতে দিতে বলে— ভাই, দেখলেনই তো সৌভাগ্য এনজিওর কর্মীদের ব্যবহার। সামনের সপ্তাহে ওগো আর খালি হাতে ফেরানো যাবে না। তাই আপনারে যদি না দিতে পারি একটু রেহাই দিয়েন।
—আপনার কোনো চিন্তা নেই। ‘সোনালি আশা’ এনজিওর কর্মীরা কারও সাথে এমন দুর্ব্যবহার করে না।
লোকটা যথাসময়ে তার কিস্তি পেয়ে খুশি মনে চলে যায়।
স্বর্ণাভ ভেবে পায় না যে সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও জহুরুল হককে কেন কিস্তি দিতে হচ্ছে! আর এনজিও কর্মীরাইবা ছুটি ফেলে টাকা আদায়ে আসছে কেন! জহুরুল হকের মুখের দিকে চেয়ে দেখ সে মুখ হতাশা, লজ্জায় মলিন। তাকে স্বাভাবিক করার জন্য আগের কথার জের ধরে স্বর্ণাভ বলে— তারপর কী হলো?
—আসমার পরামর্শে চায়ের দোকান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু টাকার ব্যবস্থা করতে পারি না। আমারে কে টাকা দেবে কন! তাই বাধ্য হইয়া ‘সুখী জীবন’ আর ‘নতুন ভবিষ্যৎ’ প্রথমেই এই দুইটা এনজিও দিয়া লোন আনি। কিন্তু টাকাগুলা ব্যবসায়ে খাটাইতে পারি নাই।
—কেন, তুমি তো ব্যবসা করার জন্যই লোন নিয়েছিলে!
—হ্যাঁ, কিন্তু আসমা সেই সময় প্রথম কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। টাকা সব হাসপাতাল আর ডাক্তারের পেছনে খরচ হইয়া যায়। কোনো কাজকর্মও নাই। একটা টাকা আয় নাই। বউ-মেয়ের খাবার জোগাড় করাই মুশকিল। তারপর আবার সপ্তাহে দুই দিন কিস্তি নিতে আসে। তখন ভাবলাম, নাকের উপর জল এক ইঞ্চি হইলেই মরে আর দশ হাতেও মরে। আমি তো মরেই আছি, আরও লোন লই!
এবারে চারটা এনজিও দিয়া লোন লইয়া প্রথম দুইটার টাকা শোধ করে বাকি টাকা দিয়া এই দোকান শুরু করি। প্রথম দিকে মন্দ চলছিল না। কিন্তু একদল লোক খালি বাকি খাবে। টাকা চাইলে আর আমার দোকানে আসে না। অন্যদিকে চোখের পলক না ফেলাইতেই কিস্তির দিন চইল্যা আসে। দোকানে মালপত্র নাই। তখন নিরুপায় হইয়া আরও তিনটা এনজিও দিয়া লোন আনি। এখন সপ্তাহের সাত দিনই কিস্তি থাকে। যেদিন যারে টাকা দিতে না পারি সেদিন সে গালাগালি কইর্যা আমার চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধার করে। মরা বাপ-মাও রেহাই পায় না। কী করমু কন? যে আসমা আমারে কামলা খাটাবে না বইল্যা এত চেষ্টা করল এখন সে নিজেই মানুষের বাড়ি দাসীগিরি করে। তারপরও কুল পাই না।
—প্রতিদিনের বিক্রির টাকায় কিস্তির টাকা হয়?
—তা কোনো কোনোদিন হয়। কিন্তু সংসারের খরচ আছে না! বলতে গেলে নিজেরা না খাইয়াই থাকি বেশির ভাগ দিন। কিন্তু বাচ্চা-কাচ্চার মুখে তো কিছু একটা দেওয়া লাগে! তখন আর কিস্তি দেওয়ার সামর্থ্য থাকে না। তাই মাঝে মাঝে দোকান বন্ধ রাইখ্যা পালাই।
—তাতে কোন লাভ হয়?
—নাহ্ লাভ আর কী? এই তো গতকাল টাকা জোগাড় করতে না পাইর্যা পালাইছিলাম। ব্যাটারা আজ আইলো। আপনি না থাকলে তো ওরা আরও গালাগাল করত, ভয় দেখাইত। আমার তখন চুপ থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। টাকা তো আনছি!
—আচ্ছা, তুমি আর এক কাপ চা দাও।
জহুরুল হক ফিরে গিয়ে নিভে যাওয়া চুলায় ফুঁ দিয়ে জ্বালানোর চেষ্টা করে। স্বর্ণাভর চোখ যায় সেই মাকড়সার জালে আটকে থাকা ঘাসফড়িংটার দিকে। ততক্ষণে ঘাসফড়িংটার রঙিন পাখা দুই জোড়া অবশিষ্ট আছে। বাকি সব মাকড়সা গ্রাস করে নিয়েছে। হায় সোনালি পাখা! আর তোমার আকাশে ওড়বার সাধ্য নেই! শুধু ওড়ার ইচ্ছেটুকু হয়তো থেকে গেল! কিন্তু তা কোনোদিন সত্য হবে না। স্বর্ণাভর মনে একটা বিষণ্নতা এসে বাসা বাঁধে। সে চোখ ফিরিয়ে দেখে ধোঁয়ার আড়ালে জহুরুল নামক মানুষটা প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে।
স্বর্ণাভ সোনালি রোদে ঝলমল করে ওঠা সকালে চারদিকে ভয়ঙ্কর পুঁজিবাদের একটা অদৃশ্য আঁধারের উপস্থিতি টের পায়। যে আঁধার জহুরুল হকের মতো দরিদ্র মানুষদের ওই ঘাসফড়িংটার মতো ঊর্ণজালে জড়িয়ে তাদের অস্তিত্ব মুছে দেয়।
সন্তোষ কুমার শীল ১৯৭৩ সালের ১৫ অক্টোবর (সার্টিফিকেট অনুসারে) পিরোজপুর জেলার বাটনাতলা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শেষে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করেন এবং একই পেশায় বর্তমান আছেন। রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ ভক্ত এ নিভৃতচারী ঔপন্যাসিক মূলতঃ একজন সর্বগ্রাসী পাঠক। বই পড়া, গান শোনা এবং সাহিত্য সাধনায় সময় যাপন তাঁর একান্ত প্রিয়। শিক্ষকতার পাশাপাশি ছোট গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ এবং রম্য রচনার চর্চা করেন। এ পর্যন্ত তাঁর আটটি বই প্রকাশিত হয়েছে। “একাত্তরের কথকতা” তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস।