অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হামিদা বানু মৌসুমী -
প্রত্যাবর্তন

বিনু জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে, উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। ইদানীং তার খুব শরীর খারাপ, একা একা, অস্থির লাগে। অবশ্য এসময়ে সব মেয়েরই হয়তো এমন লাগে। মিনি ওর পায়ের উপর গড়াগড়ি করে। ‘বিনু ও বিনু, কী করো, কী করো? অভি ও অভি, অভি,’ মিঠু ক্রমাগত ডাকতে থাকে।

‘তুই থামবি মিঠু!’ বিনু ধমকে দিয়ে মিঠুকে পানি আর কলা খেতে দেয়।

বিনু এ বাড়িতে এসেছে নয় মাস। এখানে ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী ওর পোষা বেড়াল মিনি, ময়না মিঠু আর বাড়ির পুরোনো কাজের লোক হোসেন আলী। অভি সেই সকাল সাড়ে আটটায় অফিসে চলে যায় আর বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা। অভি যে এই সময়ে ওকে একটু বেশি বেশি সময় দেবে সে সুযোগও নেই। নতুন চাকরি, মাত্র বছর খানেক হলো একটা প্রাইভেট ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার হিসেবে জয়েন করেছে। নয়টা পাঁচটা অফিস কিন্তু পাঁচটার পরও দীর্ঘক্ষণ ওকে অফিসে থাকতে হয়।

বিনু পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিন বছর আগে অভির সাথে পারিবারিকভাবেই ওর বিয়ে হয়। জুটি হিসেবেও ওরা বেশ ভালো। যাকে বলে মানিকজোড়। দুজনের বোধ বুদ্ধি আর চিন্তা চেতনায়ও অনেক মিল। সবচেয়ে বড়কথা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বোঝাপড়া আর ভালোবাসা ওদের সম্পর্ককে এই তিন বছরে যেন অনেক দৃঢ় করেছে।

বিয়ের পর দুই বছর বিনু ওর শ্বশুরবাড়িতেই ছিল। গাছগাছালি আর সবুজ ছায়াঘেরা নির্জন নিরিবিলি ছোট্ট গ্রাম বিনোদপুর। দূরে ছোট ছোট পাহাড় উঁকি দেয়। গ্রামের পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। গ্রামে অভিদের অনেক নামডাক। অভির বাবা, দাদা দীর্ঘদিন এই গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন। অভিরা দুই ভাই অবশ্য এ লাইনে যায়নি। অভির বড় ভাই আদিত্য গ্রামেরই কলেজে শিক্ষকতা করেন। শ্বশুর, শাশুড়ি, ওর বড় জা মিলি, মিলির মেয়ে লিলি সবাইকে নিয়ে ওর সময় বেশ কেটেছে। ওর জা মিলির সাথে ওর খুব ভাব। প্রতিদিন বিকেলে ওরা নদীর ধারে গিয়ে বসত। অবশ্য অভির সাথেও অনেক গেছে। দুজন নদীর ধারে বসে কতো সূর্যাস্ত দেখেছে তারপর সন্ধ্যার পর অনেক রাত পর্যন্ত বসে থেকেছে শান্ত নদীর ধারে। কত কথা, কত হাসি! সব ব্রহ্মপুত্রের জলে মিশে আছে।

অভি আজ সন্ধ্যে সাতটার মধ্যেই বাড়ি ফিরতে পেরেছে। তাড়াতাড়ি ফিরতে না পেরে ওর মনে মনে খুব কষ্ট হয়, এরই নাম বোধ করি চাকরি! ইদানীং বিনুকে একেবারেই সময় দিতে পারে না অথচ এখনই ওকে বেশি সময় দিতে হতো। অভি ঠিক করে কিছুদিনের জন্য বড় ভাবি মিলিকে বাসায় নিয়ে আসবে। এতে বিনুরও সময় কাটবে ও নিজেও নিশ্চিন্তে থাকবে। অভি রাতে খাবার টেবিলে বিনুকে বলে, ‘মিলি ভাবিকে কিছুদিনের জন্য আনলে কেমন হয়?’ বিনু ভীষণ খুশি হয়ে বলে, ‘কালই হোসেন আলী চাচাকে পাঠাও ভাবিদের আনতে।’ মিলি যে ওর শুধু জাই না বন্ধুর মতো, বন্ধুই। আর লিলিকেও ও খুব ভালোবাসে, মিস করে। ওর যখন বিয়ে হয় তখন লিলির বয়স সাত বছর। সারাটাক্ষণ ওর সাথে সাথেই থাকত। এমনকি ও বাড়িতে প্রথম লিলির সাথেই ওর ভাব হয়। মিনি ওর পায়ের কাছে বসে ডাকে, ‘মিঞ, মিঞ।’ মিঠু বারান্দায় ডাকাডাকি করে ‘বিনু, বিনু, ও বিনু, বিনু। অভি, অভি, অভি…’

পরেরদিন হোসেন আলী গ্রামে গিয়ে মিলিদের নিয়ে আসে। কতদিন পর দেখা! রাতে সবাই মিলে অনেক গল্প আর মজা হলো। এ ক’মাসেই লিলি যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। আচরণেও কেমন যেন একটু পরিবর্তন কিন্তু কী পরিবর্তন বিনু ঠিক ধরতে পারল না।

মিলিরা আসার পর বিনুর সময়গুলো ভালোই কাটছিল। কিন্তু দু-তিন দিন পর থেকে এ বাড়িতে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকে! একদিন সকালে ও ঘুম থেকে উঠে দেখে ওর প্রিয় ময়না মিঠু মরে পড়ে আছে। কে যেন ওর গলাটা খুব খারাপ ভাবে মুচড়ে দিয়েছে। কিন্তু কে? কেন? এর কোনো উত্তরও খুঁজে পায় না। বিনুর খুব কষ্ট হয়। ওর মন বিষণ্নতায় ছেয়ে যায়।

মিঠুর মৃত্যুর রেশ না কাটতেই এই ঘটনার ঠিক সাতদিন পর মিনিকে বাড়ির কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাড়ির ছাদে মিনিকে মৃত পাওয়া যায়। বিনুর ভীষণ কান্না পায়। ও ভেবে পায় না কে এসব করছে? মিঠু আর মিনি ছিল ওর সারাবেলার সঙ্গী, সন্তানের মতো, অনেক আদরের। ওদের হারিয়ে বিনু দিশেহারা বোধ করতে থাকে। অভি, মিলি, হোসেন আলী সবাই ওকে সান্ত্বনা দেয়। অভি বিনুকে আবারও ময়না পাখি আর বিড়াল কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বিনুর মন কিছুতেই যেন শান্ত হয় না। হোসেন আলীর বুক অজানা এক আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে।

হোসেন আলী খেয়াল করল লিলি অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখে। লিলির মুখটা খুব অচেনা মনে হয় তার কাছে আবার খুব চেনাও। মনে হয় বহু বছর আগে লিলির জন্মেরও অনেক বছর আগে এই মুখ সে দেখেছে। একজন বয়স্ক নারীর মুখ। মনে হয় ওই মুখে একজন বয়স্ক নারীর মুখ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ এই মুখ, এই মুখই। কিন্তু কোথায়? কোথায় দেখেছে? হোসেন আলী কিছুতেই মনে করতে পারে না। সে আবারও ভালো করে তাকায়। এ তো লিলি, লিলিরই মুখ কোন বয়স্ক নারীর মুখ নয়। সেভাবে বয়স হয়েছে তাই হয়তো এ সব ভুল ভাবছে বা দেখছে।

সেদিন হোসেন আলী ছাদে কাপড় শুকাতে দিয়েছিল কিন্তু নিয়ে আসতে ভুলে যায়। যখন মনে পড়ে তখন একবারে সন্ধ্যা। সে তাড়াতাড়ি ছাদে যায় কাপড় আনতে। ছাদে গিয়ে সে যা দেখে তার জন্য তার চোখ মোটেই প্রস্তুত ছিল না। প্রথমে ভাবে সে হয়তো ভুল দেখছে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় না সে ঠিকই দেখছে। ছাদের রেলিং ধরে লিলি দৌড়াচ্ছে খুব দ্রুত। এই দৃশ্য দেখে সে খুব ভয় পেয়ে দ্রুত নিচে নেমে আসে। নিচে এসে দেখে, লিলি মায়ের পাশে বসে আছে। তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ও চোখ যেন তার ভেতর-বাহির সব পুড়িয়ে দিচ্ছে। তার অতীত ভবিষ্যৎ সব পড়ে ফেলছে। ও চোখ যেন কোনো মানুষের চোখ নয়, কোনো হিংস্র জন্তু জানোয়ারের চোখ। হোসেন আলী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।

মিলির খুব অস্বস্তি হচ্ছে। ওরা এ বাড়িতে আসার পর থেকেই কতগুলো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। ওর কিছুদিন থেকেই লিলির আচার আচরণ ভালো লাগছে না। প্রায় রাতেই ওর ঘুম ভেঙে গেলে দেখে লিলি জেগে আছে, কখনো বা ঘুমের মধ্যেই হাঁটাহাঁটি করছে। ওর ঘোর সন্দেহ! এসব ঘটনার সাথে লিলির কোনো যোগসূত্র নেই তো? কিন্তু মা হয়ে নিজের মেয়ের কথা অন্যদের জানাতেও পারছে না। অজানা ভয়ে ওর বুক কেঁপে ওঠে। মেয়ের জন্য খুব চিন্তা হয়। ও মনে মনে ঠিক করে কাল সকালেই গ্রামে চলে যাবে তারপর মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে লিলিকে নিয়ে যাবে। লিলির উপর হয়তো খারাপ কোনো আত্মা ভর করেছে। ইমাম সাহেব খুব কামিল মানুষ। নিশ্চয়ই সব ঠিক করে দিবেন। হঠাৎই ও খেয়াল করে লিলি ওর দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। সেই দৃষ্টি যেন কোন মানুষের নয়, কোনো জানোয়ারের! ওর খুব ভয় করতে লাগল!

রাতে মিলির গোঙ্গানির শব্দে সবার ঘুম ভেঙে যায়। অভি তাড়াতাড়ি এসে দেখে মিলির শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, ওর মুখের ওপর একটা বালিশ চাপা দেওয়া। পাশেই লিলি অঘোরে ঘুমাচ্ছে। অভি বালিশ সরিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিলে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়। পরের দিন মিলির আর গ্রামে যাওয়া হয় না।

পরেরদিন দুপুরে হোসেন আলী ছাদে যায় আচার রোদে দেওয়ার জন্য। সে গিয়ে দেখে লিলি রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তার যাওয়ার শব্দে লিলি ঘুরে একভাবে তাকিয়ে থাকে। হোসেন আলী চমকে ওঠে, চিৎকার করে ডাকে, ‘আপু মনি নেমে আসো পড়ে যাবে।’ লিলি তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হোসেন আলীর আবারও মনে হয় এ যেন লিলির মুখ না কোনো বয়স্ক নারীর মুখ। এ মুখ তার চেনা খুব চেনা। সে আগে দেখেছে! কিন্তু কোথায়? সে মনে করার চেষ্টা করে খুব এবং অবশেষে মনে পড়ে।

প্রায় ৩০ বছর আগের কথা অভিরা দুই ভাই তখন খুব ছোট। একজনের বয়স ১ আরেকজনের ৫ বছর। অভির বাবা আতাহার সাহেব তখন বিনোদপুরের চেয়ারম্যান। গ্রামের দক্ষিণ দিকে নদীর ধারে শ্মশানঘাট আর ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গলের ধারে এক ভয়ংকর তন্ত্র সাধিকার ডেরা ছিল। সে নানারকম কালো জাদুর চর্চা করত। সবাই তাকে জরি পাগলি বলে ডাকত। গ্রামের লোকজন কেউ সচরাচর ওদিকে যেত না। সবাই তাকে ভয় পেত। সেই সময় একবার গ্রামে নানাবিধ অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে থাকে। প্রায়ই সবার বাড়ি থেকে গবাদি পশু কুকুর বেড়াল উধাও হতে থাকে। সবাই বলাবলি করতে থাকে এসব জরি পাগলির কাজ। একদিন একজনের নবজাতক শিশু উধাও হয়ে যায়। সবার সন্দেহ গিয়ে পড়ে জরি পাগলির উপর। তখন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এবাং পাশের গ্রামের এক তান্ত্রিক বিষুর সাহায্যে গ্রামের সবাই মিলে জরি পাগলির ডেরায় যায়। সেদিন ছিল ঘোর অমাবস্যার রাত। সবাই যখন জরি পাগলির ডেরায় পৌঁছল তখন রাত দশটা। চারদিকে ঘন জঙ্গল নির্জন শুনশান। ঘন অন্ধকারে রাত দশটাকেই মনে হচ্ছিল গভীর রাত। সবাই পৌঁছে দেখে জরি পাগলি একটা বেদিতে বসে ধ্যান করেছে। তার সামনে যজ্ঞের আগুন জ্বলছে। যজ্ঞের আগুন থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে ধোঁয়া উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। ধোঁয়ার মধ্যেই এক পাশে নবজাতককে একটি লাল কাপড়ে মুড়িয়ে রেখেছে। কপালে সিঁদুরের টিপ। শিশুটি ক্রমাগত কেঁদে যাচ্ছে। বিষু তান্ত্রিক ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় যজ্ঞের দিকে। সে যজ্ঞের আগুনে ধুলো মতো কিছু ছিটাতেই দপ করে আগুন নিভে যায়। জরি পাগলি ক্ষুব্ধ হয়ে চোখ খোলে। যজ্ঞের আগুন যেন তার চোখে জ্বলে উঠে। সে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। তান্ত্রিকের গায়ে তরল আঠালো জাতীয় কিছু ছিটিয়ে দিতেই বিষু তান্ত্রিক যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে। সে নিজেকে সামলে নিয়ে তার কাঁধের ঝোলা থেকে একটা ছোট লাল বোতলে থাকা তরল জরি পাগলির গায়ে ছিটিয়ে দেয়। আর জোরে জোরে মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকে। জরি পাগলি রাগে চিৎকার করে ওঠে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে সে অভিশাপ দিতে থাকে যে, ‘তোরা আমার যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে দিলি না, তোদের কাউকে আমি ছাড়ব না, আমি প্রতিশোধ নেব। ভয়ংকর প্রতিশোধ।’ বিষু তান্ত্রিক আবারও ঐ তরল জরি পাগলির গায়ে ছিটিয়ে দেয়। জরি পাগলি যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।

সবাই ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। শিশুর মা দৌড়ে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়। সংক্ষুব্ধ লোকজন জরি পাগলির ডেরা ভাঙচুর করে। এই ঘটনার পর জরি পাগলিকে আর কখনো দেখা যায়নি। সে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তার ডেরায় বা গ্রামে কেউ আর তাকে কখনই দেখতে পায়নি।

হ্যাঁ, অবশেষে সে চিনতে পেরেছে। এটা ঐ তন্ত্র সাধিকা জরি পাগলির মুখ। সে খুব অবাক হয়! লিলির চেহারার সাথে জরি পাগলির চেহারার এতো মিল! অথচ এতদিন তারা কেউই তা খেয়াল করেনি।

এমনকি জরি পাগলির কপালের ডান পাশে একটা কালো জন্ম দাগ ছিল, লিলির কপালেও ডান পাশে একইরকম জন্ম দাগ আছে। হোসেন আলী খুব ভয় পেয়ে যায়। সে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। সে তার পেছনে কোনো কিছুর অস্তিত্ব টের পেয়ে ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকাতেই কে যেন তাকে সজোরে ধাক্কা দেয়। সে গড়াতে গড়াতে নিচে পড়ে যায়।

হোসেন আলীকে গুরুত্বর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার মাথা ফেটে গেছে, ডান হাত ভেঙে গেছে। অজ্ঞান অবস্থায় ঘোরের মধ্যে সে শুধু প্রলাপ বকছে, বিপদ, বিপদ বড় বিপদ। লিলি, অভি বিনু মার বড় বিপদ। দুই দিন পর হোসেন আলীর জ্ঞান ফেরে। ডাক্তার বলেছে অল্প থেকেই বেঁচে গেছে। তিন দিন পর রিলিজ করে দেবে। বাড়ি গিয়ে ঠিকমতো ওষুধপথ্য খেলে সে খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে।

ইতোমধ্যে গ্রাম থেকে অভির বাবা-মা এসেছে। হোসেন আলীর মুখে সব ঘটনা শুনে অভির বাবা আবার গ্রামে ফিরে গেলেন বিষু তান্ত্রিকের খোঁজে। অনেক বছর আগে এই তান্ত্রিকের সাহায্যেই তারা জরি পাগলির কাছ থেকে নবজাতক শিশুটি উদ্ধার করতে পেরেছিল। কাউকে না পাঠিয়ে তিনি নিজেই গেলেন বিষু তান্ত্রিকের কাছে। সব শুনে তান্ত্রিক বলল, ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না চেয়ারম্যান সাহেব, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সব ব্যবস্থা করছি। আগামীকাল অমাবস্যা। কাল রাতেই যা করার করতে হবে।’ পরদিন সকালে অভির বাবার সাথে বিষু তান্ত্রিক শহরে পৌঁছাল সাথে আরও তিনজন সহযোগীকে নিয়ে।

সন্ধ্যার পরপরই শুরু হলো যজ্ঞের প্রস্তুতি। আগুন জ্বলছে, চারপাশে চার তান্ত্রিক বসে আছে। বিষু তান্ত্রিক যজ্ঞের আগুনে একটু পর পর ঘি ঢালছে আর মন্ত্র উচ্চারণ করছে। যজ্ঞের আগুন থেকে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। দ্রুত মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছেন তান্ত্রিকগণ। একপর্যায়ে লিলিকে এনে আগুনের পাশে বসানো হয়।

বিষু তান্ত্রিক মন্ত্র উচ্চারণ করে কিছু ধুলো লিলির উপর ছিটিয়ে দিয়ে জানতে চায়, ‘বল তুই কে?’

লিলি ঘোরের মধ্যে উত্তর দেয়, ‘আমি জরি পাগলি।’

‘মিলিকে কেন মারতে চেয়েছিস?’

‘মিলি আমাকে সন্দেহ করেছিল।’

‘হোসেন আলীকে কেন মারতে চেয়েছিস?’

‘হোসেন আলী আমাকে চিনে ফেলেছিল।’

‘এখানে কেন এসেছিস?’ বিষু তান্ত্রিক জিজ্ঞেস করে।

‘প্রতিশোধ! প্রতিশোধ নিতে।’ লিলি বলে।

‘তোদের জন্য আমার ১২ বছরের সাধনা নষ্ট হয়েছে। এত সাধনা করেও আমি যজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারিনি শুধু তোদের জন্য। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই।’

‘কিন্তু তোর সে চাওয়া কোনোদিন পূরণ হবে না।’ এই বলে বিষু তান্ত্রিক লিলির উপর মন্ত্র পড়া কর্পুর ছিটাতে থাকে। অন্য তান্ত্রিকগণ জোরে জোরে মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করে। ঘরের মধ্যে একটা কাচের বয়াম ছিল একসময় বয়ামটি বিকট শব্দে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। ধোঁয়ার মতো কিছু একটা কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরের দিকে উঠে যায়। লিলি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সারারাত ধরে চলে যজ্ঞ। চার তান্ত্রিক মিলে রাতভর মহাযজ্ঞ সম্পূর্ণ করে বিদায় নিলেন ভোর বেলায়।

যজ্ঞ সম্পন্ন হওয়ার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। লিলির আচরণও আগের মতো শিশুসুলভ হয়ে যায়। মিলি আর লিলি গ্রামে ফিরে গেলে শাশুড়ি রাহেলা বেগম বিনুর কাছে থেকে যায়।

চার মাস পর বিনুর একটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তান হয়। সবাই ভীষণ খুশি। রাহেলা বেগম নাতনির নাম রাখলেন অনু। বিনু প্রথমবার কোলে নিয়ে মেয়ের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কারণ অনু দেখতে অবিকল লিলির মতো। কপালের ডান পাশে একটা কালো জন্মদাগ।

 

+ posts

Read Previous

প্রখ্যাত তাজিক কবি লায়েক শের আলির কবিতা

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৪র্থ সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *