অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
জুন ২০, ২০২৫
৬ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
জুন ২০, ২০২৫
৬ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হামিরউদ্দিন মিদ্যা -
নাবাল ভূমি

আবার ঝুঁঝকিডাঙা যাচ্ছে ঝিনুক। মাঠের ধান পেকে হলুদ হয়ে এলেই প্রতিবছর পুবে ধান কাটতে যায় ওরা। শুধু ঝিনুকের বাবা-মা, কাকা-কাকি, দাদু-ঠাকুমা নয়। এই এলাকার অনেকেই পাড়ি দেয় পুবে নাবাল খাটতে। বৈশাখ মাস এলেই ঝিনুকের মনটা বেশ ভালো যায়। প্রতিবছর বোরো ধান কাটার সময়টার জন্যেই ও অপেক্ষা করে থাকে।

বাঘমুণ্ডি পাহাড়ের কোলে এই গ্রামটা যেন পৃথিবীর মানচিত্রের বাইরে। খরা এখানে লেগে আছে বারোমাস। হা-ভাতে মানুষগুলোর সারাদিনের চিন্তা শুধু ভাত-কাপড়ের। বাচ্চাগুলোও জন্ম নেওয়ার পরই কঁকিয়ে কেঁদে ওঠে। বুঝে যায়, পৃথিবীটা বড়ই নিষ্ঠুর জায়গা। এখানে তাদের সারাজীবন লড়াই করেই বাঁচতে হবে। তাই গ্রামের স্কুলেই কিছুদিন অ-আ-ক-খ পাঠ শেষ করে বেরিয়ে পড়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে। কারও কারও সেই সুযোগও আসে না জীবনে। বাবা-মাকে যদি পেটের টানে ঘর-দুয়োর ফেলে হাঁড়িকুড়ি, কাঁথাকম্বল, তল্পিতল্পা গুটিয়ে বছরে চারবার পুবে খাটতে যেতে হয়, তাহলে ছোট ছেলেমেয়েগুলিকে কার ভরসায় রেখে যাবে!

এখানের জমি রুক্ষ, অনুর্বর। ডাঙা, টিলা, কাঁকুরে লালমাটি। জলের বড়ই অভাব। আকাশের পানে চেয়ে কেউ কেউ আমন ধান রোয়ায়। তবে রোয়ালেই যে সেই ধান ঘরে উঠবে এমনটা আশা করা যায় না। ছেলে-ছোকরারা বড় হলে অনেকেই স্বপ্ন গড়ার আশায় পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে চলে যায় পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র। কেউ ফেরে, কেউ কেউ বিয়েশাদি করে বাইরেই থিতু হয়। বাড়ির বয়স্ক মানুষরা, ঘরের বউ-ঝি, ছেলেপুলের মা— মানে যাদের আর কিছুই করার নেই, ঘর-সংসারের মায়াজাল ছিঁড়তে পারে না— তারা চাষবাসের কাজ, রাস্তা তৈরি, পাথর খাদানে জীবনটাকে সঁপে দেয়।

কিন্তু যত পুবে যাওয়া যাবে, তত বদলে যায় ভূ-প্রকৃতি। মা লক্ষ্মী যেন স্বয়ং নেমে এসে পুবের মাটিকে চুম্বন করেছিল। ক্যানেলের জলে বছরে দু’বার ধান ফলে ওধারের মাঠে। ভাত-মুড়ির কোনও অভাব নেই। সেই ভাতের টানেই পশ্চিমের মানুষ দলবেঁধে পাড়ি জমায়।
ধানকাটার সময়টা বড় বড় চাষিরা পশ্চিমের মুনিষদের ঠিকা বেতনে বাড়িতে রাখে। খোরাকির জন্য চাল দেয়, ডাল দেয়, আলু দেয়, তেল দেয়। চাষের কাজ সারা হলে তবে ছুটি।

আমন ধান রোয়া-কাটার কাজে ঝিনুকের বাবা-মা বেশি দূরে যায় না। বন-জঙ্গল পেরিয়ে সামান্য গেলেই আশুড়িয়া, বড়জোড়ার মাঠগুলোতে অনেক কাজ জুটে যায়। কিন্তু গ্রীষ্মকালে তো সব মাঠে বোরো চাষ হয় না। যারা শ্যালো-সাবমার্সিবলে পাতালের জল তুলে শখ করে চাষ করে, তারা গাঁ-ঘরের মুনিষজন দিয়েই কাজ সারে। ঝিনুকদের তাই বোরো ধান কাটতে যেতে হয় আরও দূরে, সেই শালী নদী পেরিয়ে দামোদরের কাছে। বোরো ধান কাটার সময় হলেই ঝিনুকদের ঘরগুষ্টি ঝুঁঝকিডাঙার ফজলু শেখের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। ঝিনুকের দাদুকে ফজলু শেখ বলে দিয়েছে, প্রতিবছর বৈশাখের পনেরো পেরোলেই তুমরা সপরিবারে চলে আসবে।

ধান রোয়ার সময়টা আশপাশের মুনিষজন দিয়েই কাজ সারে ফজলু শেখ। রোয়াতে আর ক’দিন লাগে! কয়েকটা দিনের জন্য এতদূর থেকে মুনিষ এসে থাকতে চায় না। কাটার সময় অনেক দিনের কাজ। যাদের জমি-জায়গা নেই, লোকের খেতে খামারে জন-মুনিষ খাটত তারাও এখন টাকা দিয়ে জমি নেয় বোরো চাষ করার জন্য। আর সময়টা যেহেতু ঝড়-বৃষ্টির। মাঠের ধান খামারে তুলতে নাকানি-চোবানি খেতে হয় চাষিদের। ভূমিহীন মানুষরাও নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে এই সময়টা। তাই চাষিদের ভরসা করতে হয় পশ্চিমের মুনিষদের ওপর।

দেখতে দেখতে ধানকাটার সময়টা এসে পড়ল। গ্রামের মানুষ বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে পড়বে নিজের নিজের ঠিকাবাড়ির উদ্দেশে। কয়েকদিন আগেই ফজলুর ছোট ছেলে নিয়ামত ফোন করেছিল ঝিনুকদের ফোনে। ঝিনুকের বাবা সনাতন জানিয়েছিল, দু-তিনদিনের মধ্যেই তারা বেরোচ্ছে। সেই মতোই রওনা হচ্ছে আজ। পুরো গ্রামটা এই এক-দেড়মাস খালি হয়ে যায় বললেই চলে। যাদের বাড়িতে লোক কম তাদের ভিটেয় বাতি জ্বালানোর মতোও কেউ থাকে না। সন্ধ্যে হলে পাহাড় থেকে, জঙ্গল থেকে নেমে আসে শেয়াল, হেঁড়ল। বাড়ির পাশে ঘুরঘুর করে। গাছের পাতা পড়ে, ধুলোবালিতে ভর্তি হয়ে যায় খড়ের চাল, টালির চাল, উঠোন। নাবাল খেটে ফিরে ঝাঁটপাট দিয়ে আবার বসবাসের যোগ্য করে তুলতে হয়।

এবারে ঝিনুকের দাদু আর ঠাকুমা যাচ্ছে না। গতবারে গিয়ে রোদ-গরমে খেটে খুব জব্দ হয়ে পড়েছিল। এই বয়সে চাঁদিফাটা রোদে কাজ করতে পারবে কেন! দু’দিন আগেই জনা পঞ্চাশের একটা দল বেরিয়ে গেছে গ্রাম থেকে। বাঁকুড়ার মাঠে ওরা প্রতিবছর খাটতে যায়। আজ ঝিনুকরা যাচ্ছে বর্ধমান। গ্রামের আরও পঁচিশ-ত্রিশজনের মতো মানুষ বেরিয়েছে।

স্টেশনে ভিড় দেখে ঝিনুকের বাবা বলল,

আজ আর বাসে উঠতে লারব মুনে হচ্চে। এত লোক একটা বাসে ধইরব্যাক?

সনাতনের পাশে দাঁড়িয়েছিল ওর বড়দাদা গুণধর। ছোটভাইয়ের মুখে এমন অলুক্ষণে কথা শুনে বলল,

উঠতে লারব কী কুথা! দুটা বাস সুকালেই পেরায় গ্যাছে। ছাদে বাম্পারে লোক। ইখন যদি বাসটা না ধরিন, তাইলে বারোটার টেরেনটা আর পাব নাই।

স্টেশনে দাঁড়িয়ে মুনিষরা বাসের জন্য অপেক্ষা করে আছে। কেউ নামবে বেলিয়াতোড়, কেউ দুর্গাপুর। ওখান থেকে বাস-ট্রেনের অনেক সুবিধা।
এই সময়টায় বাসগুলোতেও ভিড় হয় খুব। শুধু তো ঝিনুকদের গ্রামের মানুষ নয়। আশপাশের এই এলাকার অনেকেরই এখন ভরসা পুবের টাকা। বাসের কন্ডাক্টররাও প্যাসেঞ্জার নিতে কম করে না। পালুইয়ে খড় গোঁজার মতো যতগুলো পারে ঢুকিয়ে নেয়। ছাদে ওঠাতেও ছাড়ে না।
বস্তার ভেতরে হাঁড়িকুড়ি, থালাবাটি, দু-একটা পাতলা কাঁথা, সংসারের আরও প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস নিয়েছে প্রত্যেক পরিবার। মাথায় বস্তা নিয়ে, কেউ ছোট ছেলে কোলে। একটু পরেই সিটি মেরে হংসরাজ এসে থামল। প্রচণ্ড ভিড়! কোনও রকমে ঠেলে গুঁজে চেপে পড়ল ঝিনুকরা। পুরুষরা বস্তা নিয়ে উঠল ছাদে। বেশ কয়েকজন বাসটায় চাপতে পারল না।

এই রুটের হংসরাজেরই একমাত্র নতুন ইঞ্জিন। বাকি বাসগুলোর লঝঝরে অবস্থা। বুড়ো-বুড়িরা ভয়ে উঠতে চায় না।
দু-চারটে স্টপেজ পেরোতেই জানালার ধারে বসার জায়গা পেয়ে গেল ঝিনুক। জানালার বাইরে অচেনা অজানা গ্রাম, মাঠঘাট, গাছপালা দেখে দেখে যেতে খুব ভালো লাগে তার। ছোটতে একবার খুব বায়না করায় বাবা ছাদে তুলেছিল তাকে। এখন ছাদে উঠব বললেই মা খেঁকিয়ে উঠবে, ধিঙ্গি মেয়ে, ছাদে কী উঠবি! লাজলজ্জা নাই?
ঝিনুক ভাবে, সে কি খুব বড় হয়ে গেছে? তাদের পাড়ার টুনির সঙ্গেই তো স্কুলে গিয়েছিল বছর দুই। টুনি এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। ওর বাবা জামশেদপুরে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করে। টুনির মাকে পুবে নাবাল খাটতে যেতে হয় না। মাঝে মাঝে ঝিনুকের দুঃখ হয়, তার বাপটাও যদি টুনির বাপের মতো একটা কাজ পেত! তাহলে এখন সে টুনির সঙ্গেই পড়ত।

আজ কিন্তু ঝিনুকের মনে কোনও দুঃখ নেই। বরঞ্চ আনন্দই হচ্ছে। এক বছর পর আবার ঝুঁঝকিডাঙা যাচ্ছে তারা। সেলিমদের বাড়ি। সেলিমের জন্য মাঝে মাঝেই মনখারাপ হয় তার। তখন মাকে জিজ্ঞেস করে,

এটা কী মাস চলছে মা? বোরো ধান কাটা আর কত দেরি?

মা বলবে,

কেনে! বোরো ধান কাটার খবর লিয়ে তুর কী দরকার?


ঝুঁঝকিডাঙায় প্রথম কাজে গিয়েছিল ঝিনুকের দাদু। তার পরের বছর থেকেই ফজলু শেখের বাড়িতে ঠিকা মুনিষ হয়ে ঝিনুকদের ঘরগুষ্টি গিয়ে ওঠে। ঝিনুক প্রথম যখন ঝুঁঝকিডাঙায় গিয়েছিল, সেই দিনটার কথা আজও মনে আছে তার।
তখন তার বয়স আট কি নয়। বাবা-মা যেখানেই খাটতে যেত, সঙ্গে করে নিয়ে যেত তাকে। এতটুকুন মেয়ে ঘরে একলা থাকতে পারে!
পুবের মাঠে খেতভরা সোনালি ফসল দেখে ঝিনুকের চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, যেন স্বর্গে চলে এসেছে সে। এত শস্য ফলে এখানে!
জেঠি বোধহয় ঝিনুকের মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিল। বলেছিল, কী দেখিস ঝিনুক? ভাবছিস, আমরা কুন নরকে পড়ে আছি? বড় হ মা। এধারেই তুর বিয়ে দিব। খাওয়া-পরার কুনুদিন অভাব হবেক নাই।
মাঠের শেষে একটা বটতলায় সারি সারি তাঁবু পড়েছিল। যে চাষির মুনিষদের থাকতে দেবার মতো খালি ঘর থাকে না তারা তাঁবু খাটানোর জন্য দেয় তেরপল, বাঁশ।

ঝিনুক জিজ্ঞেস করেছিল,

মা আমরা কি ওমন তেরপলের ঘরে থাকব?

ঝিনুকের মা বলল,

কর্তা কীসের ব্যবস্থা করেছে, কী করে জানব মা!

ফজলু শেখ যেন মুনিষদের জন্যেই অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ। মোটাসোটা খালি গায়ে লুঙ্গি পরা মানুষটা ঝিনুকের দাদুকে দেখেই হাসিমুখে অভ্যর্থনা করেছিল।

আরে এসো এসো বিভূতি। এত দেরি হলো কেন? পথে তুমাদের কুনু অসুবিধা হয়নি তো?

না কর্তা। কারও কুনু অসুবিধা হয় নাই।

আচ্ছা, তুমরা আজকের দিনটা জিরেন নাও। কাল থেকেই মাঠে নামবে। এসো, থাকার ঘরটা দেখিয়ে দিই।

ঝিনুকের দাদু বলল,

আমি জানি কর্তা। আগের বছর যে চালাঘরটাই ছিলাম, ওটাই তো?

ফজলু বলল, না বিভূতি, সেটা লয়। ওই চালাঘরে এতজনে থাকবে কী করে! বড় গোয়ালঘরটা পরিষ্কার করা হয়েছে। এখন তো গোরু-মোষ বেশি নাই। একটা দুধেল গাই আর দুটো বকনা বাছুর। আগে এক গোয়াল গোরু-মোষ ছিল। এখন না আছে চরাবার লোক, না আছে চরবার জায়গা!

গোরুগুলো বাঁধবে কুথায়?

দু-তিনটে গোরু, চালাঘরটাতেই পার করে দিয়েছি।

বাইরে কথাবার্তা শুনে বেরিয়ে আসে ফজলুর বউ সরফন বিবি। সরফনের পিছু পিছু একটি সাত-আট বছরের ফুটফুটে ছেলে। ঝিনুক ড্যাবড্যাব করে ওই ছেলেটিকে দেখে।
সরফন বিবি বলল,

সেলিমের বাপ ঝুড়ি করে মাটি এনে গোয়ালের মেঝেটা বাগিয়েছে। শুধু চুলোটা কাটা নাই। তুমাদের ক’টা হাঁড়ি চড়বেক তা তো জানি না বাপু। ইট আছে, মাটি কেটে বানিয়ে নিবে। এই বেলা আমি তুমাদের খাবার ব্যবস্থা করছি। ভাত খাবে, না চিড়ে খাবে?

ঝিনুকের দাদু বলল,

চিড়ে-গুড় খেতে আসি নাই বউঠান। আমরা হলাম হা-ভাতে পশ্চিমের মানুষ। ভাত হলেই ভালো হয়।

গতবছর এমন সময়েই গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে ঝুঁঝকিডাঙা এসেছিল বিভূতি। ঠিকে বাড়ি ধরা থাকেনি। যাদের বাড়িতে উঠেছিল, তাদের এতগুলো মুনিষের দরকার ছিল না। সেই কর্তা ফজলু শেখের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। পরে ফজলু শেখের সঙ্গে কথা হয়ে যায় বিভূতির। পরের বার যেন গোটা পরিবার নিয়ে চলে আসে সে।
থাকার জন্য যে ঘরটা দেখাল ফজলু তাতে বিভূতির পরিবারের সবার থাকার জায়গার কোনও অভাব হবে না। তারা দুই বুড়ো-বুড়ি, ঝিনুক, ঝিনুকের বাবা-মা আর বড় ছেলে, বড় বউমা। মোট সাতটা মানুষ। মেঝেতে চারজন শুলে পিঁড়েতে তিনজনের আরামসে শোয়া হয়ে যাবে।
ভাত রান্না হলে সেই ফুটফুটে খোকাটি ডাকতে এলো ঝিনুকদের। বলল,

দাদি ডাকছে, তুমরা ভাত খেয়ে নিবে এসো।

ঝিনুকের মা জাপটে ধরল ছেলেটিকে। বলল,

আর যেতে দুব নাই তুকে। বল তুর নাম কী?

ভয় পেয়ে যায় ছেলেটি। বলে,

সেলিম।

বিভূতি ফোড়ন কাটে।

উ হলো কর্তার ছোট ছেলে নিয়ামতের ব্যাটা।

ঝিনুকের মা ঝিনুককে দেখিয়ে বলে,

এই দিদিটার সঙ্গে সই পাতাবি?

ছেলেটি লাজুক চোখে ঝিনুকের দিকে তাকায়। তারপর মাথা হেলায়।

ঝিনুকের স্পষ্ট মনে পড়ে সব। বাবা-মা মাঠে কাজে চলে গেলে সারাটাদিন সে সেলিমের সঙ্গে খেলে বেড়াত। বলতে গেলে কয়েকটা বছরের মধ্যেই ঝুঁঝকিডাঙা গ্রামটার পুরোটাই সে চষে বেড়িয়েছে। রোদে রোদে টো-টো করে ঝোপঝাড়, বনবাদাড় ঢুঁড়ে বেঁচফল, বনখেজুর, লোকের গাছের আম, বিলধারের ক্ষেত থেকে শশা তুলে নুন, লঙ্কা দিয়ে খেয়েছে। সেলিমের মা-ও তাকে খুব ভালোবাসে। সারারাজ্য চষে বেড়িয়ে এক গা ধুলো মেখে যখন বাড়ি ফিরত দুটিতে, সেলিমের মা বলত, যা কলে হাত-মুখ ধুয়ে আয়। দুধ-মুড়ি খেতে নিবি। গরম ভাত রান্না হয়ে গেলেও দিত। ভালো তরকারি হলে বাটি ভরে সেলিমের হাত দিয়ে রোজ পাঠিয়ে দিত তার জন্য।

দু-একদিন মাঠে যাবার জন্য খুব বায়না ধরত সেলিম। বাধ্য হয়ে কাঁধে চাপিয়ে মাঠে নিয়ে যেত ঝিনুকের দাদু। ঝিনুক আর সেলিম আলে বসে থাকত মাথায় গামছা ঢাকা দিয়ে। বসে বসে দেখত বড়রা কীভাবে কাজ করছে। আলে গজানো মধুচুষি ফুল তুলে চুষে মধু খেত।

মাঠ থেকে কাজ করে ফেরার পথে পশ্চিমের মুনিষরা খালে-ডোবায় হাতড়ে চ্যাং-ল্যাঠা মাছ, কাঁকড়ি, গেঁড়ি-গুগুলি আঁচলে ভরে নিয়ে আসে। আলের মাথায় গজানো কুলেখাড়া শাক, পুকুরপাড়ে কাঁচা ডুমুর, কলমি, শালুন্ত, কচুর শাক গেঁড়োসমেত তুলে আনে। ফজলু চাল-ডালের যোগান দিলেও মুখরোচক তরিতরকারির যোগানটা নিজেরাই করে নেয় ওরা।

প্রথমবারে যখন ঝুঁঝকিডাঙা গেল ঝিনুক, পুকুরপাড়ে সারি সারি কচুর শাক হেলাফেলায় পড়ে আছে দেখে আফসোস করে সেলিমকে বলেছিল,

তুদেরই গাঁ-টা কত ভালো রে। কুনু অভাব নাই। ইমন শাকপালা, কচু আমাদের গাঁয়েও যদি থাকত!

ধুর! এই কচুগুলো বদ কচু। এখানে কেউ খায় না। গলা কুট কুট করবে।

ঝিনুক মুখ ভেংচে বলল,

বদ কচু না আমড়ার আঁটি! টক দিলে সব কচু জব্দ!

একদিন ঝিনুকের বাবা মাঠ থেকে ধরে আনল একটা চার-পাঁচশো ওজনের জাড় ব্যাং। সাঁঝের বেলা ছাল-টাল ছাড়িয়ে পেঁয়াজ-আদা-রসুন দিয়ে খুব কষে রান্না করেছিল ঝিনুকের ঠাকুমা। ঝিনুকের মা বলল,

আমরা তো কুনুদিন ভালোমুন্দ কিছুই দিইনি সেলিমকে। ওর মা রোজ ডিমটা-মাছটা দিয়ে যাচ্ছে। ঝিনুক যা তো, ব্যাঙের মাংস সেলিমকে দু-চার পিস দিয়ে আয়।

শুনে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল দাদু,

করিস কী! শ্যাষে কি এই ঘর ছেড়ে বটতলার মাঠে তাঁবু খাটিয়ে থাকবি? ওরা সাপ-ব্যাং এসব কিছুই খায় না। কুনুদিন ভুলেও দিতে যাস না আর।

ঝিনুকেরও ইচ্ছে হয় সেলিমের মা যেমন কতকিছু দিয়ে পাঠায়, তার মা-ও যেন সেলিমকে কিছু দেয়। সে গিয়ে দিয়ে আসবে। কিন্তু দাদুটা না একটা মর্কট! ওই বুড়োর জন্য কিছুই দিয়ে আসতে পারে না। ডুমুরের ঝাল, কচুশাকের চচ্চড়ি, শালুন্তশাকের বড়া— এসব সেলিমের মা রাঁধে না। তার মায়ের হাতের রান্না একদিন সেলিম খেলে বুঝত কত স্বাদ!

বাসের জানালার ধারে বসে বসে ঝিনুক ঝুঁঝকিডাঙার কথাই ভাবছিল। বোরো ধান কাটতে সেলিমদের বাড়ি বেশ কয়েকবার যাওয়া হয়ে গেল তার। ওদের পরিবারের সঙ্গে ধীরে ধীরে একটা আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে। ঝিনুকরা এখন ওদের ঠিকা মুনিষ। মাঠের কাজ সেরে, ধান ঝেড়ে, মরাইয়ে তুলে দিয়ে তবে গ্রামে ফেরে। বিদায়ের আগে ঝিনুকের জন্য প্রতিবছর সেলিমের বাবা নতুন জামা, প্যান্ট, জুতো কিনে আনে বাজার থেকে।


বাস থেকে দুর্গাপুরে নেমে রেলস্টেশনের দিকে হাঁটা দিল মুনিষের দল। উলুরঝুলুর পোশাকে, উশকো খুশকো চুলে লাইন ধরে এগিয়ে চলেছে ওরা। ঝিনুকদের সঙ্গে এ বছর ঝুঁঝকিডাঙা যাবে হাঁসদাপাড়ার বেশারাম হাঁসদার পরিবার। বাকিরা গন্তব্য স্টেশনে নেমে নিজের নিজের ঠিকাবাড়ির উদ্দেশে টো টো ধরে রওনা দেবে। রেলস্টেশন থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে যাবে সব বিভিন্ন গ্রামের দিকে।

তল্পিতল্পা নিয়ে, হাঁড়িকুড়ির বস্তা মাথায়, মায়েরা ছেলে কোলে হনহনিয়ে হাঁটছে। কোনও ছিন্নমূল বয়স্ক মানুষ যদি এদের এখন দেখে, নির্ঘাত তার দেশভাগের স্মৃতি মনে পড়ে যাবে। মুনিষের দলও তো নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছে পুবে, শুধু পেটের টানে, বেঁচে থাকার তাগিদে।
স্টেশনে যখন পৌঁছল ওরা তখন বেলা সাড়ে বারোটা। কিছুক্ষণ আগেই ছেড়ে দিয়েছে লোকালটা। এর পর ঝুঁঝকিডাঙা লাইনের ট্রেন আছে দুটোর সময়।

ঝিনুক বলল,

মা, আমার খুব খিদা লেগেছে।

ঝিনুকের মা বলল,

খিদা সবারই পেইচে মা। আমরা এখুনি মুড়ি খেয়ে নিব।

স্টেশনের কাছাকাছি একটা অশ্বত্থগাছের তলায় চায়ের দোকান, চপও পাওয়া যায়। সেখানে চপ কিনল মুনিষরা। ঘর থেকে পলিথিনে মুড়ি বেঁধে এনেছে প্রত্যেকে। দলের বয়স্করা কেউ কেউ চা খেল। বিড়ি ধরাল।
দোকানের পেছনে ফাঁকামতো একটা জায়গায় বসে মুড়ি খেয়ে নিল সবাই। তার পর প্ল্যাটফর্মের শেডের নিচে গিয়ে বসল।
ঝিনুকদের ঝুঁঝকিডাঙায় পৌঁছতে বেশ বেলা হয়ে গেল। বেশারাম হাঁসদার পরিবার চলে গেল তাদের কর্তার বাড়িতে। ফজলু শেখের বাড়িতে গেল ওরা পাঁচজন। ঝিনুকের বাবা-মা ছাড়াও ওর জ্যাঠা-জেঠি এসেছে। জ্যাঠার এক ছেলে লাল্টু রাচিতে বউ-ছেলে নিয়ে থাকে। বাবা-মাকে টাকা পাঠায় না।
ফজলু শেখ বলল,

তুমরা মোটে পাঁচজন কেনে! আর দু’জন কই?

ঝিনুকের জ্যাঠা বুঝিয়ে বলল কর্তাকে, বাবা-মায়ের না আসার কারণ।

ফজলুর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। বলল,

সেটা ঠিক, ওদের বয়স তো অনেক হল। আর পারবেক কেনে খাটতে!

একটু থেমে বলল,

তাইলে গ্রামের আরও দু-চারজনকে যুগাড় করে আনলে নাই কেনে?

সনাতন বলল,

অনেক চেষ্টা করেলম কর্তা। কাউকে পাওয়া গেলেক নাই। সবার তো লিজের লিজের ঠিকাবাড়ি ধরা আছে। তাছাড়া পাথর খাদানে অনেক লোককে কাজে লিচ্ছে ইখন। হুড় হুড় করে লোক ঢুকছে সিখানে। চাষবাসে খাটতে আসতে চাইছে না অনেকেই। আমরা যারা দীর্ঘদিন খেতে-খামারে খাটচি, তাদের কুথা বাদ দাও।

কথাগুলো শুনে ফজলু শেখের মুখের বলিরেখা আরও ফুটে উঠল। বলল,

আমাদের এখানের ছেলে-ছোকরারা না হয় মাঠে নামতে চাই না। যাদের জমি-জায়গা নাই, কেরলা, মহারাষ্ট্র ছুটছে। কিন্তু আমরা তো তুমাদের পশ্চিমের মুনিষদের ভরসাতেই সাহস করে ধান লাগিয়ে আসছি এতবছর ধরে। এখন যদি খাটতে কেউ না আসতে চায় তাহলে তো অন্য ব্যবস্থা করতে হবেক গো!

কী আর করবে কর্তা। পাঁচদিন বেশি লাগুক, কম লাগুক, এই নিয়েই চালাতে হবেক।

তুমরা কি শুনেছ? ধানকাটার মেশিন আসছে এই এলাকায়। আমাদের গ্রামের মাঠে কাদার জন্যে এখনো নামেনি। গত আমনেই তো গোলসি, বিজড়ে, চকবেড়ের মাঠে নেমেছিল। একটু ডাঙা মাঠ ওদের। পানি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। সারা মাঠকে মাঠ মেশিন চলেছে।

সনাতন, গুণধর, গুণধরের বউ সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকাল ফজলু শেখের মুখের দিকে। ফজলু দেখল, পশ্চিমের মুনিষদের মুখেও কালো মেঘের ছায়া।

***
সেলিমের সঙ্গে এখন সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেরোনোর সময় নেই ঝিনুকের। গতবছর থেকেই বাবা-মায়ের সঙ্গে মাঠে নেমে হাতেনাতে চাষবাসের কাজগুলো শিখে নিচ্ছে। মা তাকে বুঝিয়েছে, আর খেলে বেড়ানোর সুময় নাই মা। বিয়ের পর পরের ঘরে যাবি কী নিয়ে? কাজগুলো মুন দিয়ে শিখে রাখ। আমাদের মতো ঘরের মেয়েদের সারাজীবন খেটেই খেতে হবেক রে!

সেলিমও আর সেই ছোট্ট খোকাটি নেই। এখন হাইস্কুলে সাইকেল নিয়ে পড়তে যায়। সকালে টিউশন। তবে বিকেলে ঝিনুকরা মাঠ থেকে ফিরলে দেখা হয়। সেলিম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের রান্নাবান্না দেখে। ঝিনুকের সঙ্গে গল্পগুজব করে। ঝিনুককে দেখে তার খুব দুঃখ হয়। কেমন ছিল, আর এখন রোদে খেটেখুটে গায়ের রঙটাই ছাইরঙা হয়ে গেছে।

সেলিম একদিন স্কুল থেকে এসে বলল,

জানিস ঝিনুক, আজ আমি ধানকাটা মেশিন দেখে এলাম। জৈথালির মাঠে মেশিন নেমেছে। কত উঁচু রে! রাস্তা দিয়ে যারাই যাচ্ছিল, দাঁড়িয়ে দেখছিল। বড় বড় জমিগুলো নিমেষেই শেষ করে দিচ্ছে।

ঝিনুক বলল,

আমি তো আর দেখতে যেতে পাবুনি। সারাদিন মাঠেই খাটি।

আচ্ছা, তুই এখন থেকেই কাজে যাস কেন বল তো? দাঁড়া, আমি কাকুকে আচ্ছা করে বলে দেব। তুর বাবা-মা তো কাজে যায়। তুর কাজে যাওয়ার কী দরকার!

ঝিনুক আঁতকে উঠল। বলল,

না না। একদম বাবাকে বলিস না একথা। তাইলে ভাববেক আমি বলেছি। মেরে পিঠের ছাল তুলে দিবেক আমার।

শুনে সেলিম কিছুই জবাব দিতে পারল না। চুপচাপ বসে রইল। ঝিনুক বলল,

বাবা-মায়ের কী আর দোষ বল। আমরা খুব গরীব রে! পুবে খাটতে আসি বলেই কয়েক মাস ভালোভাবে চলে। আমাদের গাঁয়ে গেলে বুঝবি, কত কষ্ট করে থাকি আমরা।

বড় হলে যাব তুদের গ্রাম। ওখানে অনেক পাহাড় আছে, তাই না?

পাহাড়ের কোলেই তো আমাদের গ্রাম। তবে জানিস, কয়েকটা ছোট ছোট পাহাড় ভেঙে খাদান করেছে। একটা বড় কোম্পানি অনেক টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে। পাথর কেটে কেটে চুনাপাথর বানিয়ে চালান করছে গাড়ি করে। কত লোক কাজ করে সেখানে! তুই আর কখন যাবি! আমাদের ওখানের বড় পাহাড়গুলোও বোধহয় আর থাকবেনি।

ঝিনুক মাঠে কাজে গিয়েও শুনল ধানকাটা মেশিনের কথা। পাশের একটা মাঠে কয়েকজন আলোচনা করছিল। ধান কাটা, ট্রলি করে খামারে বওয়ানো, ঝাড়া— সব মিলিয়ে মুনিষের যা খরচ, তাতে নাকি চাষিদের আর পোষাচ্ছে না। ধানকাটা মেশিনে কম খরচেই মাঠের ধান ঘরে উঠে যাচ্ছে। এই মাঠগুলো নিচু, জল শুকোতে শুকোয় না চট করে। কাদার জন্যেই ধানকাটা মেশিনটা নামছে না।

একজন বলল,

আরে শুনিসনি? চেনটানা একটা ইঞ্জিন উঠেছে। ওটা কাদা-জলেও চলে। এবার দেখবি ওই ইঞ্জিনও চলে আসবেক আমাদের এধারে।

মাঠে মাঠে কত লোক কাজ করছে এখন। সবাই যে মুনিষ তা নয়। চাষিরাও কাস্তে ধরেছে। কিছুদিন আগেই কালবৈশাখী আছড়ে পড়েছে। অনেক জমির ধান মাটিতে শুয়ে গেছে। ক্যানেলের শেষবারের ছাড়া জল মাঠ থেকে না শুকোতে শুকোতেই মেঘের জলে ভরে গেছে জমি। সবাই হাতেনাতে কাজ না করলে ধান উদ্ধার করা সম্ভব নয়। ধিক্কারে কিছু চাষি কাস্তে ঠেকায়নি জমিতে। মাঠ শুকোলে পাশের গ্রাম থেকে মেশিন এনে ধান কাটাবে বলে রেখে দিয়েছে।

মেঘ ধরে আসতেই সূর্য তার আসল শক্তি দেখাতে আরম্ভ করল। কয়েকদিন এমন রোদ দিল, মাঠে খাটতে আসা মানুষরা ছটফট করতে লাগল। এই মাঠ সমতল। পশ্চিমের মাঠের মতো ডাঙা-টিলা নয়। একটা গাছও নেই যে মানুষ ছায়ায় বসবে। অনেক দূরে জিওলনালার মাঠে পুকুরপাড়ে একটা নিমগাছ আছে। আর উত্তরে ক্যানেলের পাড়ে আকাশমণির বন। মাঝমাঠে খাটতে খাটতে রোদে-গরমে হাঁফিয়ে উঠলে অতদূরে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়াও সম্ভব নয়। আলের মাথাতেই মাথায় গামছা আড়াল দিয়ে বসতে হয়। বসে ঢক ঢক করে জল খায় মুনিষরা। রোদে তেতে জল তো আর জল থাকে না। ফুটন্ত জলের মতো হয়ে যায়। তা দিয়েই গলা ভিজিয়ে আবার উঠে পড়তে হয় মুনিষদের।
দিনকতক পর মাঠ থেকে কাজ করে এসে স্নান সেরে খেয়েদেয়ে পিঁড়েতে বস্তা বিছিয়ে একটু শুয়েছিল ঝিনুক। সেলিম হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে আসে।

ঝিনুক… ঝিনুক।

ঝিনুকের মা বলল, কী হইচে রে! ইত গাঙানোর কী আছে!

ঝিনুক কই কাকি? ওকে ডেকে দাও। জান, আমাদের গ্রামেও ধানকাটার মেশিন চলে এসেছে। মল্লিকপাড়ার চাষিরা এনেছে পাশের গ্রাম থেকে।

তা মেশিন এইচে তো তুদের কী!

সবে চোখের পাতা লেগেছিল ঝিনুকের। সেলিমের হাঁকডাকে ঘুম ভেঙে যায় তার। চোখ কচলাতে কচলাতে ফাঁকে বেরিয়ে আসে ঝিনুক। কোনও প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে সেলিম বলল,

দেখবি তো টপ টপ চ’ ঝিনুক। বেলেমাঠে ধানকাটার মেশিন নেমেছে।

ছুটতে ছুটতে দুই কিশোর-কিশোরী গ্রাম ছাড়িয়ে বেলেমাঠে গিয়ে হাজির হলো। বেলেমাঠের মোটা পগারে তখন অনেক মানুষের ভিড়। এতদিন কানাঘুষোয় যে মেশিনটার নাম শুনে আসছে সবাই, সেটা আজ তাদেরই গ্রামে! দর্শন না করে কেউ ছাড়ে! বেরিয়ে এসেছে ছেলেপুলের দল, বুড়োহাবড়া, জোয়ান।

এতবড় মেশিন দেখে চক্ষু ছানাবড়া ঝিনুকের। কত উঁচুতে ড্রাইভার বসে! সামনে রাক্ষসের দাঁতের মতো একটা হা-মুখওয়ালা চারকোণা জিনিস। মেশিনের চাকা যত এগোচ্ছে, ওই হা-মুখেই ঢুকে পড়ছে গাছসমেত ধান। পেছন দিয়ে গোরুর ছেরানির মতো বেরিয়ে যাচ্ছে পোয়াল। হোল্ডারে ধান জমা হলে একটা খালি ট্রাক্টর গিয়ে দাঁড়াচ্ছে মেশিনটার কাছে। বড় নল দিয়ে ঝুরো ধান বেরিয়ে লোড হচ্ছে ট্রলি। সেই ট্রলি ভর্তি ধান চলে যাচ্ছে সোজা চাষির বাড়ি।

সেলিম বলল,

দেখছিস কেমন মেশিন! বড় হলে আমিও এমন মেশিন চালাব।

ঝিনুকের মনে ততক্ষণে অন্য এক আশঙ্কা দানা বেঁধেছে। বলল,

হ্যাঁ রে, সবাই যদি এবার এই মেশিন দিয়েই ধান কাটায়?

আবেগে আপ্লুত হয়ে সেলিম বলল,

কাটাবেই তো। এ বছর মেঘে পানি হলো বলেই তাই! নাইলে আমাদেরও ধান কাটাত।

কিন্তু খড়গুলো যে চলে যাচ্ছে!

গেলিই-বা। গোরু-মোষ আর কে রাখে! এখন তো রোটার ফালে চাষ।

তাইলে আমাদের কী হবেক? কেউ আর ডাকবেক নাই আমাদের?

সেলিম নিরুত্তর।

তুর সাথে কি আর দেখা হবেক নাই?

সেলিম কোনও জবাব দিতে পারল না। দেখল ঝিনুকের চোখ দুটো ছলছল করছে। ওর একটা প্রশ্নের উত্তরও সেলিমের জানা নেই। কী জবাব দেবে সে? কোনও কথা না বলে দু’জনেই নীরব চেয়ে রইল বেলেমাঠের পানে। দেখল, প্রচণ্ড গর্জন করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে একটা দানব। ওই দানবের হা-মুখ থেকে কোনও কিছুই রেহাই পাচ্ছে না। সব একে একে ঢুকে পড়ছে ভেতরে।
————————————————————
Full Address:
Hamiruddin Middya
Vill- Ruppal
P.O- Birsinghpur
P.S- Sonamukhi
Dist- Bankura
Pin- 722207
West Bengal, India
Email- hamiruddinmiddya72@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email
হামিরউদ্দিন মিদ্যা

Read Previous

অগস্ত্যযাত্রা

Read Next

কিছু কথা অপ্রকাশিত থাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *