অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

এম মনজুরুল ইসলাম -
একটি অসময়ের দণ্ডিত পোস্টমর্টেম

ইলেকট্রিক তারের ওপর বেশ কদিন ধরেই তিন-চারটে মরা বাদুড় ঝুলে আছে। পাতলা ফিনফিনে পাখাগুলো শুকিয়ে গেছে। অনেকটা শুঁটকি মাছের মতো আড়াআড়ি দুই তারের ঠিক মাঝখানটায় অনাদিকাল ধরে ঝুলছে। এক দেড় ছটাক ওজনের শরীরগুলো একেবারেই ঝলসে গেছে। দুইশ বিশ ভোল্টের এমন ডিস্ট্রিবিউশন লাইনে এখন প্রায়ই বাদুড় ঝুলতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে মধ্যরাতে তীব্র আর্তনাদও শোনা যায় ইলেকট্রিক খুঁটিগুলোর নিচ থেকে। তার পাশেই প্রফেসর কলোনির মেইন গেট। ওখান থেকে একটু দূরে পরিত্যক্ত ম্যানহোলে কী যেন শোকার্ত কান্নায় চিউচিউ করতে থাকে সারারাত! ওই কলোনির মেয়েরা নাকি বয়ফ্রেন্ডদের সাথে ইদানীং লিভটুগেদারে যায়। বিধ্বস্ত হয়, পোয়াতিও হয় দু-চারজন। ওরা নাকি ওয়েস্টার্ন কালচারে বিলং করতে চায়! তাহলে কি অ্যাবরশন করা ওই ভ্রূণগুলোই ওরা ত্যানা ও তুলোয় পেঁচিয়ে ম্যানহোলে ফেলে দেয় রাত-বিরেতে?

গা গুলিয়ে ওঠে সামতানের। বেডরুমের জানালাটা খুলে দেয় সে। একরাশ দমকা বাতাস ওর চুলে আছড়ে পড়ে। মাথাভর্তি সোনালি কালারের চুলগুলো উড়তে থাকে। হুট করে চোখ থেকে মাইনাস জিরো পয়েন্ট টু-ফাইভ ডাইঅপ্টার পাওয়ারের চশমাটা খসে পড়ে মেঝের ওপর। চশমাটা তুলে নিয়ে বুক-শেলফের পাশে ইজি চেয়ারে বসে পড়ে সামতান। চোখ দুটো বন্ধ করে চুপচাপ থাকার চেষ্টা করে সে। কিন্তু পারে না। সমস্ত শরীর তিরতির করে কাঁপতে থাকে সামতানের। মনে হয় বুকের ওপর বিরাট আকারের কী যেন একটা শক্তভাবে চেপে বসে আছে! চারপাশে তাকায় সে। সবকিছু একদম ধু ধু, নিষ্পেষিত এবং বিচ্ছিন্ন মনে হয় ওর কাছে। তবে দু-একটা টিকটিকি ভেন্টিলেটারের চারদিকে ঘোরাফেরা করছে। আরশোলাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে বুক-শেলফের ফাঁক ফোঁকরে। পাশের রুমে সামতানের মা শুয়ে আছেন। হার্টের প্যাসেন্ট তিনি। স্ট্রোকও করেছিলেন গত বছর একবার। ওঘর থেকে তিনি ডাকছেন,

– বাবা সামতান, এখানে একটু আসবি?

সামতান বলল- জি মা, আসছি! সামতান ওর মা’র বিছানার পাশে গিয়ে বসল। জিজ্ঞাসা করল,

-এখন কেমন লাগছে মা?

-এখন একটু ভালো আছি বাবা। বউমা কোথায় রে?

-অর্পিতা তো শাওয়ারে মা। কিছু লাগবে তোমার? আমাকে বলো!

-কিছু লাগবে না আমার। বউমাকে সকাল থেকে একবারও দেখিনি তো, তাই মনে হলো বাইরে কোথাও গেছে কি না? তাছাড়া প্রেসক্রিপশন ধরে আমার ওষুধগুলোও তো দেখিয়ে দিয়ে যায়নি আজ! সামতান ওর মা’র মাথার চুলের ভেতর হাত বুলাতে থাকে।

-বলল, তুমি চোখ বন্ধ কর মা। ঘুমানোর চেষ্টা কর। কিছু ওষুধ আপাতত শেষ হয়ে গেছে। পরে আমি ফার্মেসি থেকে এনে দেব। এতসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের নিয়ে বড় বেশি টেন্সড্ থাকো তুমি। একটু পরেই খোঁপায় ভেজা টাওয়াল পেঁচিয়ে শাওয়ার শেষ করে অর্পিতা আসে রুমে।

-সামতান বলল, এসেছ? মা তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। সকাল থেকে একবারও নাকি এ রুমে আসোনি?

-আসিনি তা নয়, সময় পেলাম কই? ততক্ষণে সামতানের মা ঘুমিয়ে পড়েছেন।

-সামতান বলল, মা’র পাশে একটু বসবে অর্পিতা?

-এখন না, মা ঘুমিয়ে নিক। পরে বসব।

ওরা ওদের বেডরুমে এল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অর্পিতা। ভেজা চুল থেকে টাওয়ালটা খুলে ফেলল সে। ঘন কালো চুলগুলো আঁচড়ে নিলো। নীল রঙের শাড়িটা কুচি দিয়ে পরতে পরতে করিডরে এসে দাঁড়ায় অর্পিতা। প্রেসক্রিপশন হাতে সামতান ফার্মেসিতে যাওয়ার জন্য বাসার নিচে মেইন গেটে এসে দাঁড়ালো। এদিক-সেদিক রিকশা, ট্যাক্সিক্যাব কোনো কিছইু খুঁজে পেল না সে। হাঁটতে শুরু করল। প্রফেসর কলোনির কাছাকাছি আসতেই কেন জানি ম্যানহোলের দিকে নজর গেল ওর। উঁকি দেবে নাকি একবার? কত পাপ যে ওখানে ফেলে রেখেছে প্রফেসর কলোনির মেয়েরা, কে জানে?

হাঁটতে হাঁটতে সামতান পুরোনো এক রেল-স্টেশনের কাছাকাছি একটি পরিত্যক্ত প্ল্যাটফর্মের সামনে আসে। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চগুলো ভাঙা। ওয়েটিং রুমের জানালাগুলোর একটাতেও কোনো সিক নেই। মেঝের প্লাস্টার উঠে গিয়ে ইটগুলো বের হয়ে কঙ্কালসার হয়ে উঠেছে মেঝেটা। দিনে একটা ট্রেনও বোধ হয় আসে না এখানে। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে পড়ে সামতান। নিঃশেষ হতে থাকে সে। অপরিচ্ছন্ন কোনো এক ছায়া ওকে বিভাজিত করে তোলে। স্রেফ বিভাজন? নাকি ভিত্তিহীন দুশ্চিন্তা? উচাটন মনে এক ধরনের যন্ত্রণার আয়ু তরতর করে বাড়তে থাকে। বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে সামতান। মা’র জন্য ওর মন ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠে। এক্সপেনসিভ কিছু টেস্ট এক সপ্তাহ পরপরই করাতে হয়। ব্রেনের এমআরআই থেকে শুরু করে হার্টের স্ক্যানিং পর্যন্তও করাতে হয়েছে তিন-চারবার। ল্যাব এইডে টেস্টগুলো করিয়েছিল ওরা। তারপর ওষুধের ফার্মেসিগুলোতে তো যাতায়াত আছেই।

প্ল্যাটফর্ম থেকে উঠে ফোরলেন রাস্তা হয়ে হাঁটতে শুরু করে সামতান। বেশি হাঁটলে ওর রক্তে ট্রাইগ্লিসারেডের মাত্রা বেড়ে যায়। তারপরেও ওকে ফার্মেসিতে যেতেই হবে। চারদিকে গাড়ির বিদঘুটে হর্ন, টায়ার পোড়া ছ্যাঁচড়া গন্ধ, ফিটনেসবিহীন বিআরটিসি বাসগুলোর দুড়ুম দাড়ুম শব্দ। উহ্, এরকমভাবেও যে কেমন করে মানুষ ঢাকা শহরে বেঁচে থাকে? এসবের জন্যই তো মানুষের আয়ু দিন দিন নিম্নমুখী। শার্টের বুক পকেট থেকে টিসু পেপার বের করে মুখটা মুছে নেয় সামতান। ঝাঁঝালো কালো ধোঁয়া চারদিকে। চোখ মুখ জ্বলছে ওর। টিসু পেপারে চোখ মুখ মুছতে মুছতে হাঁটতে থাকে সে। মনে হলো বুকের ভেতর ওর ফুসফুস-হৃৎপিণ্ডের কোনো ধুকপুকানি নেই। নাহ, এভাবে হয় না।

রাস্তার পাশে একটা চা, সিগারেটের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে সামতান। হাঁটতে ভালো লাগছে না আর। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে ছাল উঠতে শুরু হয়েছে। গলাটাও খসখস করছে। চা’র কাপে চুমুক দিয়ে সিএনজি কিংবা ট্যাক্সিক্যাবের জন্য ওয়েট করতে থাকে সে। ওষুধের ফার্মেসি আরও অনেকটা দূরে। পায়ের মাংসপেশিগুলো ইতোমধ্যে ব্যথা করতে শুরু করে দিয়েছে। ওর সামনে দিয়ে গ্যাঁ গ্যাঁ শব্দে সিএনজি চালিত অটো রিকশাগুলো চোখের নিমেষেই চলে যাচ্ছে। কিন্তু একটাও ওর জন্য ব্রেক করছে না।

ঢাকা শহরে এটা যেন নৈমিত্তিক ঘটনা! ছিনতাই-এর ভয়ে গাড়িগুলো মাঝপথে কোনোভাবেই থামাতে চায় না। সেটা দিন, কী রাত! এখন কী হবে? খুব রাগ হয় ওর। ইচ্ছে করে চায়ের কাপটা দূরে কোথাও ছুঁড়ে ফেলে দিতে! চায়ের কাপ ভেঙে ফেললেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? কী অদ্ভুত মেন্টালিটি সামতানের! তাছাড়া চায়ের কাপেরই বা দোষটা কী? নিজের ওপর কন্ট্রোল আনার চেষ্টা করে সামতান। এমন একটা হেল্পলেস পরিস্থিতির সাথে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করতে পারছে না সে। চুপচাপ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ওর চোখে তখন অবাক বিস্ময়। সামান্য একটা ব্যাপারে কিসের এত বিস্ময়? ভ্রু কেঁপে ওঠে সামতানের। চোখের পাতা নড়তে থাকে বারবার। কোনো বিপদের আভাস নয় তো? বড্ড ক্লান্ত লাগছিল ওর। রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে সে। গাড়িগুলো বিরতীহীন ছুটে চলেছে দূরে কোথাও। একটার পেছনে আরেকটা। একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব দু-এক গজের বেশি নয়। যেকোনো মুহূর্তে ঘষা লাগতে পারে। একবার যদি একটার সাথে আরেকটার বিন্দু পরিমাণ টোকাও লাগে, তাহলে দুটোই ঘষটাতে ঘষটাতে গিয়ে যে কতদূর ছিঁটকে পড়বে- কে জানে?

শিউরে ওঠে সামতান। ওখান থেকে ফার্মেসির দূরত্ব কি খুব বেশি? তেমন তো নয়! এতক্ষণ হেঁটে গেলেও বোধ হয় যাওয়া যেত! এতগুলো ঝকমারি সহ্য করতে হতো না সামতানকে। এখান থেকে ইয়ারপোর্ট রোডের দূরত্ব আট-দশ কিলো। আট-দশ কিলো রাস্তাও কি কম হলো? বাসে যেতে পারলে সাত আট মিনিটেই যাওয়া যাবে। সামতান রোডের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। বাসগুলো ওর নাকের ওপর দিয়ে যায় যায় অবস্থা। ওর গায়ের ওপর উঠিয়ে দেওয়ার যোগাড় যন্তর। কোনো বাসেরই থামার কোনো দায় নেই। তবুও সে হাত উঠাল। গেট লক করা একটা বাস ঠিক ওর পায়ের কাছে এসে জোরসে ব্রেক কষলো। যাক, এত ঝক্কি-ঝামেলার পরেও যাওয়ার জন্য অন্তত একটা গাড়ি তো পাওয়া গেল।

সামতান লাফ দিয়ে বাসে উঠে পড়লো। কিন্তু ভেতরে কোনো সিট খালি নেই। কী আর করা! দাঁড়িয়ে থেকে সিক ধরে ঝুলিয়েই যেতে হবে ওকে। গাড়ির ভেতরে গায়ে গায়ে যাত্রী। এক একজনের শরীর ঘেমে ম্যাড়মেড়ে গন্ধ বের হয়েছে। মাস্ক পরে নিল সামতান। একটু হলেও বমি বমি ভাবটা যদি কমে! পঞ্চাশ-ষাট কিলো স্পিডে এগোচ্ছে ওদের গাড়িটা। ট্রাফিক আইন মানছে কি না- বোঝা যাচ্ছে না। এই ব্যাপারটা কেন জানি ভালোলাগেনি সামতানের। দাঁড়িয়ে থেকেই গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে ওর। গাড়িতে উঠলে একটু-আধটু ঘুম তো চোখে আসবেই। বাইরের প্রকৃতি সামতানের হৃদয় ক্যানভাসে রংধনু আঁকছে যেন! চোখের রেটিনায় ভর করছে সংবেদনশীল একটি দণ্ডিত সময়ের অস্তিত্ব। কিসের যেন একটা উত্তর খুঁজতে থাকে সামতান! অচেনা সে উত্তর। কিন্তু খুঁজে পায় না। অনেকক্ষণ ধরে নির্লিপ্তভাবে বাইরে তাকিয়ে থাকে সে। একটা অস্থির মুহূর্ত বারবার ওকে কাবু করে তুলছে। গাড়ি ছুটছে তো ছুটছেই। ড্রাইভার ব্রেকে পা রাখছে কি না- সেদিকে কারও খেয়াল নাই।

দুই.

কেবিন নাম্বর দুই বাই পাঁচ। ফিফথ ফ্লোর। সর্বশেষ কেবিন। তার সাথেই লাগোয়া অপারেশন থিয়েটার। অপারেশন থিয়েটার থেকে একটার পর একটা ডেডবডি বের করছে ওয়ার্ড-বয়রা। হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে একটা স্ট্রেচারও খালি ছিল না সেদিন। ইয়ারপোর্ট রোডে নাকি আজ আবার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে! সে তো প্রতিদিনই হয়! অনেকেই স্পটডেড। কারও কারও হাত-পা ছিঁড়ে গেছে, মগজ ছিঁটকে পড়ে আছে রাস্তায়, কেউ কেউ ওখানেই সেন্সলেস হয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে নিখোঁজ। এগুলো আর খুব একটা অবাক করে না ফারদিনকে। কিডনির প্রবলেমের জন্য ওকে মাঝে মাঝেই হাসপাতালে আসতে হয় ডায়ালাইসিসের জন্য। বেডে শুয়ে আছে সে। ডাক্তার নার্স কাউকেই পাওয়া যাচ্ছিল না তখন। ফারদিনের বুঝতে বাকি ছিল না যে- ঘটনা বেগতিক। হাসপাতালজুড়ে সব কিছুরই ক্রাইসিস চলছে। মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করে সে।

ফিফথ ফ্লোরের কোনো কেবিনই বোধ হয় আজ খালি পাওয়া যাবে না। পাশের কেবিনে অর্পিতাকে বসে থাকতে দেখে ফারদিন। ভীষণ অবাক লাগে ওর। কী ব্যাপার, অর্পিতা এখানে কেন? কার কেবিনের পাশে বসে আছে সে? তাছাডা কেবিনে ওটা শুয়েই বা আছে কে? তার সারা শরীরে ব্যান্ডেজ, রক্তমাখা ছেঁড়া শার্ট কেবিনের নিচে। অর্পিতা কাঁদছে আঁচলে মুখ গুঁজে। ফারদিন জিজ্ঞাসা করলো- আরে ভাবী, কে এটা? আপনি কাঁদছেন কেন? অর্পিতা ওর দিকে তাকায়। অর্পিতার চোখে মুখে একটা আশ্বস্ততার ছাপ ফুটে ওঠে। বলল, সামতান অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। এখনো সেন্সলেস সে। কথাটা শুনে কিছু ভাবতে পারে না ফারদিন। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ব্যান্ডেজে মোড়ানো সামতানের দিকে। কী করবে এখন সে? কিছু বুঝে উঠতে পারে না। তাহলে কি ইয়ারপোর্ট রোডের অ্যাক্সিডেন্টে সামতানও ছিল?

জগন্নাথ ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার পর সামতানের সাথে খুব একটা দেখা হতো না ফারদিনের। ব্যস্ততা কত কিছুই তো বদলে দেয়! সামতানের বিয়ের দিন জমিয়ে আড্ডা দিয়েছিল ওরা। তারপর থেকে তেমন একটা যোগাযোগ হতো না আগের মতো। অফিসে আসা যাওয়ার পথে মাঝে মধ্যে দূর থেকেই হাই হ্যালো হতো- এই আর কী! আজ এভাবে দেখা হয়ে যাবে- এটা ভাবতেই কেন জানি গা শিরশির করে ওঠে ফারদিনের।

ব্যান্ডেজের ফাঁক গলিয়ে শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে সামতানের। চোখ মুখ ফুলে উঠেছে। বাম চোখের নিচে রক্ত জমে কালচে হয়ে গেছে। কুচুটে দাগ সারা মুখজুড়ে। বেড থেকেই উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে ফারদিন। অর্পিতা তখন চুপচাপ। অপলক তাকিয়ে দেখছে সামতানকে। আশেপাশে আরও চার-পাঁচজন ইনজিয়োর্ড প্যাসেন্ট। সবাই সেন্সলেস। ডায়ালাইসিসে থাকার কারণে ফারদিন বেড ছেড়ে উঠতে পারছে না কোনোভাবেই। স্টেথিসকোপ হাতে ডাক্তার এসে বারবার পাল্স চেক করছে, স্যালাইনের গতির ওঠানামা দেখছে। অর্পিতা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল,

-ডক্টর, কেমন দেখলেন? ডক্টর বলল, এখন কিছুই বলা যাচ্ছে না। আরও অপেক্ষা করতে হবে। পেসেন্টের সারা শরীরে আঘাতের স্পট আছে। এগুলো সেরে উঠতে তো সময় লাগবেই। সময় তখন ক্ষ্যাপাটে হতে শুরু করলো। সময় তখন অসময় হয়ে বুকের ঠিক মাঝখানটায় পোড়া সিক সেধিয়ে দিতে থাকল। খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছে সামতান। না জানি আরও কতগুলো টেস্ট যে করাতে হবে সামতানের? থুপথুপ অন্ধকার হাসপাতালের করিডরে। এখান থেকেই যতটা দেখা যায় আর কী! বিকেল থেকে এমনি করেই সামতানের পাশে বসে আছে অর্পিতা। বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। মানসিক চাপ একেবারেই বিমর্ষ করে তুলছে ওকে। সামনে যদ্দুর দেখা যায়- পেসেন্ট ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না ওর। তখনো কোনো রেসপন্স নেই সামতানের।

আস্তে আস্তে অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে হাসপাতাল, হাসপাতালের সবগুলো কেবিন এবং অর্পিতা। সামতানের পাশে একটু তেরচা হয়ে বসে সে। শিরদাঁড়ার জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা করছে ওর। কম তো নয়, সেই বিকেল থেকে সামতানের পাশে বসে আছে ও! রাত উৎড়ে আরও গাঢ় হচ্ছে। অসাড় হয়ে আসছে চারপাশ। লোডশেডিং তো আছেই। ফারদিন ছটফট করছে খুব। একবার যদি সামতানের পাশে বসতে পারত সে! আর্মানিটোলার আব্দুর রহমান হলে থাকার সময় একবার ফারদিনের রক্তে হিমোফিলিয়া দেখা দিলে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এই সামতানই ওকে সঙ্গ দিয়েছিল সব সময়। এ চেম্বার থেকে ও চেম্বার, যাবতীয় টেস্টের রিপোর্ট কালেক্ট, প্রেসক্রিপশন ধরে ওষুধ প্যাকিং- কী করেনি সে সেদিন? ভীষণ গিল্টি ফিল করছে ফারদিন। এত কাছাকাছি থেকেও সে একবারের জন্যেও ছুঁতে পারছে না সামতানকে। কুঁকড়ে ওঠে ফারদিন। সে বালিশে মুখ সেধিয়ে ঠোঁট কামড়াতে থাকে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ে ফারদিন। তার মধ্যে আবার লোডশেডিং আরও অচেনা করে তুলছে হাসপাতালের অন্ধকারগুলোকে। জেনারেটর স্টার্ট করলেও তো পারে কর্তৃপক্ষ! ধুকপুক করছে বুক। না জানি কী হয় সামতানের! মনে হচ্ছে চারপাশের ঘুটঘুটে অন্ধকার ক্রমেই গ্রাস করছে একে অন্যকে। অর্পিতা কেবিন ছেড়ে হাসপাতালের করিডরে গিয়ে দাঁড়ায়। পুরো হাসপাতালের কোথাও কোনো বাল্ব জ্বলছে না। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো অবশ্য তখনো জ¦লছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্ট্রেচারের ওপর একটা লাশ দেখা যাচ্ছে দূর থেকেই। দু-চারজন বসেও আছে সেখানে। প্যাসেন্ট পার্টি বোধ হয়! কিন্তু স্ট্রেচারে রাখা লাশটা বেওয়ারিশ নাকি? বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে ওঠে অর্পিতার। এভাবে সামতানও যদি ইয়ারপোর্ট রোডের কোথাও মরে পড়ে থাকত- তাহলে কি ওকেও বেওয়ারিশ হিসেবে স্ট্রেচারের ওপর ফেলা রাখা হতো? আঞ্জুমান-ই-মফিদুলে দাফন করা হতো কাউকে ছাড়াই? আর কিছু ভাবতে পারে না অর্পিতা। চোখ ফেটে কান্না আসে ওর। আঁধারের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে অর্পিতার শরীর। একটা অপরাধ বোধ ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকে অনবরত। দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে যায় সে। সামতানের কাছে এল অর্পিতা। ততক্ষণে চোখ মেলে তাকিয়ে কী যেন এদিক-সেদিক দেখছে সামতান। কাউকে কি খুঁজছে সে? কী যে ভালো লাগছে অর্পিতার! অস্ফুট ভাঙা ভাঙা গলায় সামতান বলল, আমি এখন কোথায়?

অর্পিতা বলল, হাসপাতালে! তারপর আর বেশি কিছু বলতে পারল না সামতান। অর্পিতা ওর হাত ধরল শক্ত করে। একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কীই বা করতে পারত সামতানের জন্য অর্পিতা? অর্পিতার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। উঠুক! নির্ঘাৎ মৃত্যুকে কাছাকাছি থেকে দেখে ভেতরের দিকে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠাটা বড্ড স্বাভাবিক। ভেঙেচুরে এগিয়ে যাচ্ছে রাত। চোখজুড়ে কোথাও হালকা ঘুমেরও কোনো রেশ নেই।

তিন.

উৎকট গন্ধ। পচা মাংসের বিদঘুটে বিশ্রী গন্ধ। স্টেডিয়াম পার হয়ে মেথর পট্টিতে এলেই এ ধরনের গন্ধে অনেকে বমিও করে ফেলে। সিটি করপোরেশনের ক্লিনাররা মাসে বোধ হয় একবারও এদিকে আসে না। গলির ভেতরের দিকটা আরও বিশ্রি, আরও যত্ন-আত্তিহীন পরিস্থিতি। তবুও এদিক দিয়েই যাওয়া আসা করে সুরমি। স্টেশন রোডের ওদিক দিয়ে আসতে লজ্জা পায় সে। প্রফেসর কলোনির মেয়ে তো, তাই। ওয়েস্টার্ন কালচার ফলো করে। ডিভোর্সি। ওভার স্মার্ট। মডার্ন খুব। তবে শাড়ি পরে। বোঝাই যায় না- ওর হাজব্যান্ড ছিল! দেড় বছরের একটা ছেলেও আছে। ওরও ভ্রূণ নষ্টবিষয়ক অভিজ্ঞতা কম নয়! প্রফেসর ক্লাবের মেম্বাররা ক্ষেপেছে খুব। সামতানেরও মেম্বারশিপ আছে ওই ক্লাবে। আজ মিটিং হতে পারে ক্লাবে। এজেন্ডা লিভটুগেদার। ক্লাব কমিটি এতদিন সুযোগ দিয়ে এসেছে অনেক। এভাবে আর কত দিন? প্রফেসর কলোনির মেয়েগুলো পেয়েছেটা কী? ওদের জরায়ু কতটা উর্বর- সেটারই একটা শেষ দেখতে চায় ক্লাব কমিটি। সুরমি আজ একটু টেন্সড। একটু? নাকি অনেকটা? ওর মুখটা সকাল থেকেই শুকিয়ে আমসি।

আজ সে ফ্ল্যাট থেকে কোথাও বের হয়নি। ক্লাব থেকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে ওদের ফ্ল্যাটে। বেডে শুয়ে আছে সুরমি। কী দরকার ছিল অত লিভ টুগেদারের? লিভ টুগেদার যখন করতই, তাহলে প্রটেকশন নিলে কী হতো? কিচ্ছু ভেবে পায় না সুরমি। একবার দুবার নয়, চার-পাঁচবার অ্যাবরশন করে গর্ভের ভ্রূণ নষ্ট করেছে সে। যে ভ্রূণগুলো প্রফেসর কলোনির ম্যানহোলে পাওয়া যেত- সেগুলো কি তাহলে সুরমিরই ভ্রূণ? ভ্রূণগুলো আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে কি একবারও ওর মাতৃসত্তা কেঁদে ওঠেনি? কী নিষ্ঠুর মেয়ে ছেলে রে বাবা! পোয়াতি হতেও দেরি হয় না, আবার খালাস করতেও বুক কাঁপে না। একটা দুটো বিইয়ে দেখলেই তো পারত! বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে আসে সুরমি। নিজেরই গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে করে ওর। এমন চুনকালিমাখা মুখ নিয়ে সে কীভাবে বেঁচে থাকবে? পেট বাজানোর সময় সেকথা মনে ছিল না?

ওপরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। সেই দীর্ঘশ্বাসজুড়ে স্পষ্টই অনুতাপের বহিঃপ্রকাশ। কলঙ্ক তো মেয়েদেরই হয়, পুরুষদের কি আর অতটা হয়? সুরমি যা করেছে- সেটা নির্ঘাত পাপ। জরায়ুতে থাকা ভ্রূণের খবর খুব তাড়াতাড়ি সবাই ঠাওর করতে পারে, কিন্তু সেই ভ্রূণের প্রাণের উৎস কি কেউ সেরকমভাবে আন্দাজ করতে চায়? রুমে আসে সুরমি। ছেলের মুখের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে সে। কী নিষ্পাপ ওই মুখ! ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে একবারের জন্য হলেও বদলাতে চায় সে। ভালোভাবে বাঁচতেও চায় এখন। ক্লাব কমিটি কি ওকে সেই সুযোগ দেবে? ডুকরে কাঁদতে চেয়েও পারে না সুরমি।

কলোনিজুড়ে এখন শুধুই সুরমিকে নিয়েই চর্চা হচ্ছে। যাকে বলে টক অব দ্য কলোনি! এই মুহূর্তে কে পাশে দাঁড়াবে ওর? সামতানকে ফোন করে দেখবে নাকি একবার? সেও তো ওই ক্লাবের মেম্বার। কিন্তু সামতান তো অসুস্থ। হাসপাতাল থেকে ফিরেছে বেশি দিন হয়নি। এই তল্লাটে এমন কি কেউ নেই যে- ওকে হেল্প করবে? ওর প্রাণীসত্তা কি আজ থেকেই চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাবে? দিগ্বিদিক অন্ধকার হয়ে আসে সুরমির। দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে সে। এতবড় একটা ফ্ল্যাটে পাপ কি শুধু সুরমিই করেছে? আর কি কেউ এমন পাপ আর কখনো করেনি? কিংবা করে না?

বিকেল হয়ে আসছে। সন্ধ্যার পরেই ওকে ক্লাব থেকে নিতে আসবে। ছাদে যাওয়ার ইচ্ছে করছে ওর। বিকেলের পর বাকি সময়টা সুরমির ছাদেই কাটত। কিন্তু আজ কীভাবে সম্ভব? সবার নজর তো এখন ওর ফ্ল্যাটের দিকেই। ক্লাবের অপমান কি সে সহ্য করতে পারবে? ঘামতে থাকে সুরমি। ছাদে যাওয়ার দরকার নেই এখন। দরজায় কান পেতে থাকে সে। দেয়ালের অলমেটগুলোর ওপর দৃষ্টি যায় সুরমির। এক সময় খুব ভালো সেলাইয়ের কাজ করত ও। তখনই ওগুলো বানিয়ে বাঁধাই করে রেখেছিল।

কলিংবেলটা বেজে উঠল। কলিংবেলের আওয়াজে বুকটা ছিঁড়ে যাওয়ার মতো উপক্রম ওর। এখনো তো সন্ধ্যা হয়নি, তাহলে কে এলো? ক্লাবের কেউ নয় তো? জিজ্ঞাসা করল, কে?

-আমি অর্পিতা।

নামটা শুনে অবাক হলো সুরমি। দরজাটা খুলে দিল সে। চোখে মুখে ভীষণ অস্থিরতা ওর।

-বলল, ভাবী আপনি? ভেতরে আসুন। সোফায় বসতে বলল অর্পিতাকে।

-আমার এই দুঃসময়ে আপনাকে দেখে একটু হলেও স্বস্তি পেলাম ভাবী। সামতান ভাইয়ার কী অবস্থা এখন?

-ও এখন একটু সুস্থ। তবে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে হবে বহুদিন। সুরমির এই আতিথেয়তা বেশ অবাক করল অর্পিতাকে। এমন একটা পরিস্থিতিতেও কেউ যখন স্বাভাবিক রাখতে পারে নিজেকে- সেই হয়তো বা সব কিছুকে সামাল দিতে জানে! কিন্তু সুরমি কি সত্যিই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পেরেছে? অর্পিতা সবেমাত্র এসেই অতটা গভীরভাবে অ্যানালাইসিস করতে পারেনি ওকে।

-সে বলল, আপনি বসুন ভাবী, আমি কিচেন থেকে চা নিয়ে আসছি।

-তার আর দরকার হবে না। তুমি বোসো তো! জানো তো- সন্ধ্যায় প্রফেসর ক্লাবে তোমাকে ডাকা হবে?

-হ্যাঁ ভাবী, জানি।

-নোটিশও পেয়েছ হয়তো বা! ক্লাবের মেম্বার হিসাবে ইনফর্ম করার দায়িত্বটা সামতানের। সে অসুস্থ থাকার কারণে আমাকেই আসতে হলো।

-না ভাবী, এসে ভালোই করেছেন। আমি আপনাদের ওখানে ফোন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করিনি।

-তা ফোন করলে না কেন?

-সামতান ভাইয়া অসুস্থ তো, তাই।

-কিছু বলবে সামতানকে? আমাকেও বলতে পারো।

-ভাবী, আমি আমার ছেলেটার জন্য বাঁচতে চাই। প্রফেসর ক্লাবের মিটিং-এ অতগুলো মানুষের সামনে অপমান করা হলে আমার হয়তো বা বেঁচে থাকাটায় দায় হয়ে পড়বে।

অর্পিতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কালশিটে পড়েছে চোখের নিচে। ওর জন্য কী করতে পারে সে? বেঁচে থাকার কত আঁকুতি সুরমির সেই অনুরোধে! অর্পিতা কিছু একটা করতে চায়। ওর জন্য না হোক, ছেলেটার জন্য সুরমিকে বেঁচে থাকার একটা পথ বাতলে দিলে কী এমন ক্ষতি হবে অর্পিতার? অর্পিতা কি পারবে? বিকেল তখন পড়পড়। হারিকেন নেভা বাতাসগুলো জানালার ফাঁক গলিয়ে হু হু করে ঢুকছে ঘরে। সবগুলো পর্দা এলোপাথাড়ি উড়ছে তো উড়ছেই।

চার.

দুঃসহ সব কিছু। চোয়ালের ভেতরের দিকটায় ভীষণ ব্যথা। টনসিলের নয়, অ্যাক্সিডেন্টের। ঢোক গিলতেও কষ্ট হচ্ছে সামতানের। শেকড়-টেকড় গজায়নি তো আবার? সারা মুখে স্বাদ-টাদ বলতে কোনো কিছুই নেই। জিহ্বা মোটা হয়ে গেছে, দাঁতের গোড়ালি ফুলে উঠেছে, ঠোঁট দুটোতে চার-পাঁচটা সেলায়ের দাগ। পানি গিলতেও মাথার মগজ টেনে ধরে মনে হয়। শরীরের কোথাও কোথাও থেকে এখনো স্টিচগুলোও কাটা হয়নি। স্যাভলন দিয়ে ঘা-গুলো ধোয়ার সময় যা জ্বলে- তাতে নিঃশ্বাস থেমে যাওয়ার মতো কষ্ট পায় সামতান। ফারদিনের সাথে ড্রয়িংরুমে বসে আছে সে। ডায়ালাইসিস করার পর বেশ ভালোই থাকে ফারদিন। পার্মান্যান্টলি কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট না করা পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের মধ্যেই থাকতে হবে ওকে।

-ফারদিন বলে, এখন কেমন আছিস সামতান?

-মোটামুটি ভালো। অর্পিতার কাছে শুনলাম, তুই নাকি অ্যাক্সিডেন্টের দিন আমার পাশের কেবিনেই ডায়ালাইসিসে ছিলি?

-হ্যাঁ! কিন্তু তোর জন্য কিছুই করতে পারিনি রে। আই অ্যাম এক্সট্রেমলি স্যরি ফর দ্যাট। আই ওয়াজ ইন ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন। ডায়ালাইসিস ইজ মাই পার্ট অব লাইফ অ্যাট দিজ মোমেন্ট। ইউ নো দ্যাট বেটারলি।

-সামতান বলল, নো ইগো। দ্যাট সিচুয়েশন ওয়াজ কমপ্লিটলি আউট অব সেন্স। আই ডিডেন্ট মাইন্ড। আফটার অল আই অ্যাম ইয়েট আউট অব দ্য উড। আমিও তো তোর জন্য কিছুই করতে পারিনি ফারদিন।

-কীভাবে করবি, তুই তো সম্পূর্ণ সেন্সলেস ছিলি। তাছাড়া তোর সারা শরীর ব্যান্ডেজে মোড়ানো ছিল।

অর্পিতা চায়ের ট্রে হাতে ড্রয়িংরুমে আসে। দুটো কাপ এগিয়ে দেয় ওদের দিকে।

-সে বলল, তোমার ওষুধ আনব সামতান?

-না, থাক! মা কোথায় অর্পিতা?

-ওনার রুমে।

-ওষুধ দিয়েছ?

-জি, দিয়েছি।

অর্পিতার মুখটা ভীষণ রকমের শুকিয়ে গেছে, ত্বকে কালো স্পট পড়েছে, চোখ দুটো লাল। রাতে ভালো ঘুম হয় না নাকি ওর? ব্যাপারটা কী?

-সামতান জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে অর্পিতা তোমার? তোমাকে এত রোগাটে লাগছে কেন? আমাদের নার্সিং করতে করতে তুমি বোধ হয় হাফিয়ে উঠেছ, তাই না?

-কী যে বলো না সামতান! এটা আমার সংসার। পুরো সংসারকে আগলে রাখা আমার দায়িত্ব।

-তো কী হয়েছে তোমার? সামতানের এই জিজ্ঞাসায় আঁতকে ওঠে অর্পিতা।

-বলে, সুরমির আত্মহত্যাকে আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না সামতান। সে ওর ছেলের জন্য বাঁচতে চেয়েছিল। তোমাকে কত করে বললাম প্রফেসর ক্লাবের মিটিংটা তোমরা ক্যানসেল করে দাও। অল্টারনেটিভ কোনো ওয়েতে ওকে ক্লাবে কল কর।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সামতান। সামতান যে সুরমির জন্য কিছু করতে পারত না- তা কিন্তু নয়! সে অর্পিতার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেনি। অর্পিতা ওর ফ্ল্যাট থেকে আসার পর সবকিছু ম্যানেজ করার জন্য সামতানকে নিয়ে প্রফেসর ক্লাবে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু সেদিনকার সন্ধ্যার আগে সুরমি কারও ওপরই আস্থা রাখতে পারেনি। অর্পিতা ওর ফ্ল্যাট থেকে আসার পরই সে ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিল। সেদিন কেউই সুরমিকে ছাদে উঠতে দেখেনি। কেন দেখেনি? কে জানে সেকথা? অথচ সবার শকুনি দৃষ্টি তো সেদিন সুরমিকে ক্ষত-বিক্ষত করছিল বারবার। কী বীভৎস মৃত্যু!

অত বড় বড় অ্যাপার্টমেন্টগুলোর কার্নিশে সুরমির শাড়ির ছেঁড়া আঁচল পতপত করে উড়ছিল। মাথার চুলগুলো ছিঁড়ে গিয়ে আটকে ছিল থাই গ্লাস লাগানো বেশ কটা ঢাউস জানালার গ্রিলে। ছিটকে যাওয়া মগজের কুচুটে দাগ অ্যাপার্টমেন্টগুলোর ওয়ালে লেপ্টে ছিল পেইন্টিং-এর মতো। এভাবে কি কেউ নিজের প্রতি এতটা বিষিয়ে ওঠে? ওর দেড় বছরের ছেলেটার কী হবে এখন? সেই জন্যই কি অর্পিতা কদিন ধরে রাতে ভালো ঘুমাতে পারেনি, কিংবা পারে না? গা বাঁচানোর অভ্যাস তো অর্পিতার কখনোই ছিল না, নেইও। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে অর্পিতার। ওর বুকের ভেতর দুদ্দাড় শব্দ হতে থাকে অবিরাম। কিসের সেই শব্দ? দেয়ালে লটকানো ক্যালেন্ডারটা সশব্দে ঘষা খেতে থাকে দেয়ালের সাথেই। আকাশ যেন মুখ থুবড়ে পড়তে চাইছে বুকের ওপর। পড়ুক না! ডগ-লেগড সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠতে থাকে অর্পিতা। সব কিছু এক এক করে ভেঙে পড়তে থাকুক। ভেঙে পড়ুক ওপরকার ছাদ, ভেঙে পড়ুক রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট, দরজার ছিটকিনি এবং অসময়ের সাতকাহন।

একটি অসময়ের দণ্ডিত পোস্টমর্টেম

এম মনজুরুল ইসলাম

ইলেকট্রিক তারের ওপর বেশ কদিন ধরেই তিন-চারটে মরা বাদুড় ঝুলে আছে। পাতলা ফিনফিনে পাখাগুলো শুকিয়ে গেছে। অনেকটা শুঁটকি মাছের মতো আড়াআড়ি দুই তারের ঠিক মাঝখানটায় অনাদিকাল ধরে ঝুলছে। এক দেড় ছটাক ওজনের শরীরগুলো একেবারেই ঝলসে গেছে। দুইশ বিশ ভোল্টের এমন ডিস্ট্রিবিউশন লাইনে এখন প্রায়ই বাদুড় ঝুলতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে মধ্যরাতে তীব্র আর্তনাদও শোনা যায় ইলেকট্রিক খুঁটিগুলোর নিচ থেকে। তার পাশেই প্রফেসর কলোনির মেইন গেট। ওখান থেকে একটু দূরে পরিত্যক্ত ম্যানহোলে কী যেন শোকার্ত কান্নায় চিউচিউ করতে থাকে সারারাত! ওই কলোনির মেয়েরা নাকি বয়ফ্রেন্ডদের সাথে ইদানীং লিভটুগেদারে যায়। বিধ্বস্ত হয়, পোয়াতিও হয় দু-চারজন। ওরা নাকি ওয়েস্টার্ন কালচারে বিলং করতে চায়! তাহলে কি অ্যাবরশন করা ওই ভ্রূণগুলোই ওরা ত্যানা ও তুলোয় পেঁচিয়ে ম্যানহোলে ফেলে দেয় রাত-বিরেতে?

গা গুলিয়ে ওঠে সামতানের। বেডরুমের জানালাটা খুলে দেয় সে। একরাশ দমকা বাতাস ওর চুলে আছড়ে পড়ে। মাথাভর্তি সোনালি কালারের চুলগুলো উড়তে থাকে। হুট করে চোখ থেকে মাইনাস জিরো পয়েন্ট টু-ফাইভ ডাইঅপ্টার পাওয়ারের চশমাটা খসে পড়ে মেঝের ওপর। চশমাটা তুলে নিয়ে বুক-শেলফের পাশে ইজি চেয়ারে বসে পড়ে সামতান। চোখ দুটো বন্ধ করে চুপচাপ থাকার চেষ্টা করে সে। কিন্তু পারে না। সমস্ত শরীর তিরতির করে কাঁপতে থাকে সামতানের। মনে হয় বুকের ওপর বিরাট আকারের কী যেন একটা শক্তভাবে চেপে বসে আছে! চারপাশে তাকায় সে। সবকিছু একদম ধু ধু, নিষ্পেষিত এবং বিচ্ছিন্ন মনে হয় ওর কাছে। তবে দু-একটা টিকটিকি ভেন্টিলেটারের চারদিকে ঘোরাফেরা করছে। আরশোলাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে বুক-শেলফের ফাঁক ফোঁকরে। পাশের রুমে সামতানের মা শুয়ে আছেন। হার্টের প্যাসেন্ট তিনি। স্ট্রোকও করেছিলেন গত বছর একবার। ওঘর থেকে তিনি ডাকছেন,

– বাবা সামতান, এখানে একটু আসবি?

সামতান বলল- জি মা, আসছি! সামতান ওর মা’র বিছানার পাশে গিয়ে বসল। জিজ্ঞাসা করল,

-এখন কেমন লাগছে মা?

-এখন একটু ভালো আছি বাবা। বউমা কোথায় রে?

-অর্পিতা তো শাওয়ারে মা। কিছু লাগবে তোমার? আমাকে বলো!

-কিছু লাগবে না আমার। বউমাকে সকাল থেকে একবারও দেখিনি তো, তাই মনে হলো বাইরে কোথাও গেছে কি না? তাছাড়া প্রেসক্রিপশন ধরে আমার ওষুধগুলোও তো দেখিয়ে দিয়ে যায়নি আজ! সামতান ওর মা’র মাথার চুলের ভেতর হাত বুলাতে থাকে।

-বলল, তুমি চোখ বন্ধ কর মা। ঘুমানোর চেষ্টা কর। কিছু ওষুধ আপাতত শেষ হয়ে গেছে। পরে আমি ফার্মেসি থেকে এনে দেব। এতসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের নিয়ে বড় বেশি টেন্সড্ থাকো তুমি। একটু পরেই খোঁপায় ভেজা টাওয়াল পেঁচিয়ে শাওয়ার শেষ করে অর্পিতা আসে রুমে।

-সামতান বলল, এসেছ? মা তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। সকাল থেকে একবারও নাকি এ রুমে আসোনি?

-আসিনি তা নয়, সময় পেলাম কই? ততক্ষণে সামতানের মা ঘুমিয়ে পড়েছেন।

-সামতান বলল, মা’র পাশে একটু বসবে অর্পিতা?

-এখন না, মা ঘুমিয়ে নিক। পরে বসব।

ওরা ওদের বেডরুমে এল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অর্পিতা। ভেজা চুল থেকে টাওয়ালটা খুলে ফেলল সে। ঘন কালো চুলগুলো আঁচড়ে নিলো। নীল রঙের শাড়িটা কুচি দিয়ে পরতে পরতে করিডরে এসে দাঁড়ায় অর্পিতা। প্রেসক্রিপশন হাতে সামতান ফার্মেসিতে যাওয়ার জন্য বাসার নিচে মেইন গেটে এসে দাঁড়ালো। এদিক-সেদিক রিকশা, ট্যাক্সিক্যাব কোনো কিছইু খুঁজে পেল না সে। হাঁটতে শুরু করল। প্রফেসর কলোনির কাছাকাছি আসতেই কেন জানি ম্যানহোলের দিকে নজর গেল ওর। উঁকি দেবে নাকি একবার? কত পাপ যে ওখানে ফেলে রেখেছে প্রফেসর কলোনির মেয়েরা, কে জানে?

হাঁটতে হাঁটতে সামতান পুরোনো এক রেল-স্টেশনের কাছাকাছি একটি পরিত্যক্ত প্ল্যাটফর্মের সামনে আসে। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চগুলো ভাঙা। ওয়েটিং রুমের জানালাগুলোর একটাতেও কোনো সিক নেই। মেঝের প্লাস্টার উঠে গিয়ে ইটগুলো বের হয়ে কঙ্কালসার হয়ে উঠেছে মেঝেটা। দিনে একটা ট্রেনও বোধ হয় আসে না এখানে। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে পড়ে সামতান। নিঃশেষ হতে থাকে সে। অপরিচ্ছন্ন কোনো এক ছায়া ওকে বিভাজিত করে তোলে। স্রেফ বিভাজন? নাকি ভিত্তিহীন দুশ্চিন্তা? উচাটন মনে এক ধরনের যন্ত্রণার আয়ু তরতর করে বাড়তে থাকে। বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে সামতান। মা’র জন্য ওর মন ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠে। এক্সপেনসিভ কিছু টেস্ট এক সপ্তাহ পরপরই করাতে হয়। ব্রেনের এমআরআই থেকে শুরু করে হার্টের স্ক্যানিং পর্যন্তও করাতে হয়েছে তিন-চারবার। ল্যাব এইডে টেস্টগুলো করিয়েছিল ওরা। তারপর ওষুধের ফার্মেসিগুলোতে তো যাতায়াত আছেই।

প্ল্যাটফর্ম থেকে উঠে ফোরলেন রাস্তা হয়ে হাঁটতে শুরু করে সামতান। বেশি হাঁটলে ওর রক্তে ট্রাইগ্লিসারেডের মাত্রা বেড়ে যায়। তারপরেও ওকে ফার্মেসিতে যেতেই হবে। চারদিকে গাড়ির বিদঘুটে হর্ন, টায়ার পোড়া ছ্যাঁচড়া গন্ধ, ফিটনেসবিহীন বিআরটিসি বাসগুলোর দুড়ুম দাড়ুম শব্দ। উহ্, এরকমভাবেও যে কেমন করে মানুষ ঢাকা শহরে বেঁচে থাকে? এসবের জন্যই তো মানুষের আয়ু দিন দিন নিম্নমুখী। শার্টের বুক পকেট থেকে টিসু পেপার বের করে মুখটা মুছে নেয় সামতান। ঝাঁঝালো কালো ধোঁয়া চারদিকে। চোখ মুখ জ্বলছে ওর। টিসু পেপারে চোখ মুখ মুছতে মুছতে হাঁটতে থাকে সে। মনে হলো বুকের ভেতর ওর ফুসফুস-হৃৎপিণ্ডের কোনো ধুকপুকানি নেই। নাহ, এভাবে হয় না।

রাস্তার পাশে একটা চা, সিগারেটের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে সামতান। হাঁটতে ভালো লাগছে না আর। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে ছাল উঠতে শুরু হয়েছে। গলাটাও খসখস করছে। চা’র কাপে চুমুক দিয়ে সিএনজি কিংবা ট্যাক্সিক্যাবের জন্য ওয়েট করতে থাকে সে। ওষুধের ফার্মেসি আরও অনেকটা দূরে। পায়ের মাংসপেশিগুলো ইতোমধ্যে ব্যথা করতে শুরু করে দিয়েছে। ওর সামনে দিয়ে গ্যাঁ গ্যাঁ শব্দে সিএনজি চালিত অটো রিকশাগুলো চোখের নিমেষেই চলে যাচ্ছে। কিন্তু একটাও ওর জন্য ব্রেক করছে না।

ঢাকা শহরে এটা যেন নৈমিত্তিক ঘটনা! ছিনতাই-এর ভয়ে গাড়িগুলো মাঝপথে কোনোভাবেই থামাতে চায় না। সেটা দিন, কী রাত! এখন কী হবে? খুব রাগ হয় ওর। ইচ্ছে করে চায়ের কাপটা দূরে কোথাও ছুঁড়ে ফেলে দিতে! চায়ের কাপ ভেঙে ফেললেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? কী অদ্ভুত মেন্টালিটি সামতানের! তাছাড়া চায়ের কাপেরই বা দোষটা কী? নিজের ওপর কন্ট্রোল আনার চেষ্টা করে সামতান। এমন একটা হেল্পলেস পরিস্থিতির সাথে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করতে পারছে না সে। চুপচাপ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ওর চোখে তখন অবাক বিস্ময়। সামান্য একটা ব্যাপারে কিসের এত বিস্ময়? ভ্রু কেঁপে ওঠে সামতানের। চোখের পাতা নড়তে থাকে বারবার। কোনো বিপদের আভাস নয় তো? বড্ড ক্লান্ত লাগছিল ওর। রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে সে। গাড়িগুলো বিরতীহীন ছুটে চলেছে দূরে কোথাও। একটার পেছনে আরেকটা। একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব দু-এক গজের বেশি নয়। যেকোনো মুহূর্তে ঘষা লাগতে পারে। একবার যদি একটার সাথে আরেকটার বিন্দু পরিমাণ টোকাও লাগে, তাহলে দুটোই ঘষটাতে ঘষটাতে গিয়ে যে কতদূর ছিঁটকে পড়বে- কে জানে?

শিউরে ওঠে সামতান। ওখান থেকে ফার্মেসির দূরত্ব কি খুব বেশি? তেমন তো নয়! এতক্ষণ হেঁটে গেলেও বোধ হয় যাওয়া যেত! এতগুলো ঝকমারি সহ্য করতে হতো না সামতানকে। এখান থেকে ইয়ারপোর্ট রোডের দূরত্ব আট-দশ কিলো। আট-দশ কিলো রাস্তাও কি কম হলো? বাসে যেতে পারলে সাত আট মিনিটেই যাওয়া যাবে। সামতান রোডের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। বাসগুলো ওর নাকের ওপর দিয়ে যায় যায় অবস্থা। ওর গায়ের ওপর উঠিয়ে দেওয়ার যোগাড় যন্তর। কোনো বাসেরই থামার কোনো দায় নেই। তবুও সে হাত উঠাল। গেট লক করা একটা বাস ঠিক ওর পায়ের কাছে এসে জোরসে ব্রেক কষলো। যাক, এত ঝক্কি-ঝামেলার পরেও যাওয়ার জন্য অন্তত একটা গাড়ি তো পাওয়া গেল।

সামতান লাফ দিয়ে বাসে উঠে পড়লো। কিন্তু ভেতরে কোনো সিট খালি নেই। কী আর করা! দাঁড়িয়ে থেকে সিক ধরে ঝুলিয়েই যেতে হবে ওকে। গাড়ির ভেতরে গায়ে গায়ে যাত্রী। এক একজনের শরীর ঘেমে ম্যাড়মেড়ে গন্ধ বের হয়েছে। মাস্ক পরে নিল সামতান। একটু হলেও বমি বমি ভাবটা যদি কমে! পঞ্চাশ-ষাট কিলো স্পিডে এগোচ্ছে ওদের গাড়িটা। ট্রাফিক আইন মানছে কি না- বোঝা যাচ্ছে না। এই ব্যাপারটা কেন জানি ভালোলাগেনি সামতানের। দাঁড়িয়ে থেকেই গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে ওর। গাড়িতে উঠলে একটু-আধটু ঘুম তো চোখে আসবেই। বাইরের প্রকৃতি সামতানের হৃদয় ক্যানভাসে রংধনু আঁকছে যেন! চোখের রেটিনায় ভর করছে সংবেদনশীল একটি দণ্ডিত সময়ের অস্তিত্ব। কিসের যেন একটা উত্তর খুঁজতে থাকে সামতান! অচেনা সে উত্তর। কিন্তু খুঁজে পায় না। অনেকক্ষণ ধরে নির্লিপ্তভাবে বাইরে তাকিয়ে থাকে সে। একটা অস্থির মুহূর্ত বারবার ওকে কাবু করে তুলছে। গাড়ি ছুটছে তো ছুটছেই। ড্রাইভার ব্রেকে পা রাখছে কি না- সেদিকে কারও খেয়াল নাই।

দুই.

কেবিন নাম্বর দুই বাই পাঁচ। ফিফথ ফ্লোর। সর্বশেষ কেবিন। তার সাথেই লাগোয়া অপারেশন থিয়েটার। অপারেশন থিয়েটার থেকে একটার পর একটা ডেডবডি বের করছে ওয়ার্ড-বয়রা। হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে একটা স্ট্রেচারও খালি ছিল না সেদিন। ইয়ারপোর্ট রোডে নাকি আজ আবার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে! সে তো প্রতিদিনই হয়! অনেকেই স্পটডেড। কারও কারও হাত-পা ছিঁড়ে গেছে, মগজ ছিঁটকে পড়ে আছে রাস্তায়, কেউ কেউ ওখানেই সেন্সলেস হয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে নিখোঁজ। এগুলো আর খুব একটা অবাক করে না ফারদিনকে। কিডনির প্রবলেমের জন্য ওকে মাঝে মাঝেই হাসপাতালে আসতে হয় ডায়ালাইসিসের জন্য। বেডে শুয়ে আছে সে। ডাক্তার নার্স কাউকেই পাওয়া যাচ্ছিল না তখন। ফারদিনের বুঝতে বাকি ছিল না যে- ঘটনা বেগতিক। হাসপাতালজুড়ে সব কিছুরই ক্রাইসিস চলছে। মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করে সে।

ফিফথ ফ্লোরের কোনো কেবিনই বোধ হয় আজ খালি পাওয়া যাবে না। পাশের কেবিনে অর্পিতাকে বসে থাকতে দেখে ফারদিন। ভীষণ অবাক লাগে ওর। কী ব্যাপার, অর্পিতা এখানে কেন? কার কেবিনের পাশে বসে আছে সে? তাছাডা কেবিনে ওটা শুয়েই বা আছে কে? তার সারা শরীরে ব্যান্ডেজ, রক্তমাখা ছেঁড়া শার্ট কেবিনের নিচে। অর্পিতা কাঁদছে আঁচলে মুখ গুঁজে। ফারদিন জিজ্ঞাসা করলো- আরে ভাবী, কে এটা? আপনি কাঁদছেন কেন? অর্পিতা ওর দিকে তাকায়। অর্পিতার চোখে মুখে একটা আশ্বস্ততার ছাপ ফুটে ওঠে। বলল, সামতান অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। এখনো সেন্সলেস সে। কথাটা শুনে কিছু ভাবতে পারে না ফারদিন। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ব্যান্ডেজে মোড়ানো সামতানের দিকে। কী করবে এখন সে? কিছু বুঝে উঠতে পারে না। তাহলে কি ইয়ারপোর্ট রোডের অ্যাক্সিডেন্টে সামতানও ছিল?

জগন্নাথ ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার পর সামতানের সাথে খুব একটা দেখা হতো না ফারদিনের। ব্যস্ততা কত কিছুই তো বদলে দেয়! সামতানের বিয়ের দিন জমিয়ে আড্ডা দিয়েছিল ওরা। তারপর থেকে তেমন একটা যোগাযোগ হতো না আগের মতো। অফিসে আসা যাওয়ার পথে মাঝে মধ্যে দূর থেকেই হাই হ্যালো হতো- এই আর কী! আজ এভাবে দেখা হয়ে যাবে- এটা ভাবতেই কেন জানি গা শিরশির করে ওঠে ফারদিনের।

ব্যান্ডেজের ফাঁক গলিয়ে শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে সামতানের। চোখ মুখ ফুলে উঠেছে। বাম চোখের নিচে রক্ত জমে কালচে হয়ে গেছে। কুচুটে দাগ সারা মুখজুড়ে। বেড থেকেই উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে ফারদিন। অর্পিতা তখন চুপচাপ। অপলক তাকিয়ে দেখছে সামতানকে। আশেপাশে আরও চার-পাঁচজন ইনজিয়োর্ড প্যাসেন্ট। সবাই সেন্সলেস। ডায়ালাইসিসে থাকার কারণে ফারদিন বেড ছেড়ে উঠতে পারছে না কোনোভাবেই। স্টেথিসকোপ হাতে ডাক্তার এসে বারবার পাল্স চেক করছে, স্যালাইনের গতির ওঠানামা দেখছে। অর্পিতা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল,

-ডক্টর, কেমন দেখলেন? ডক্টর বলল, এখন কিছুই বলা যাচ্ছে না। আরও অপেক্ষা করতে হবে। পেসেন্টের সারা শরীরে আঘাতের স্পট আছে। এগুলো সেরে উঠতে তো সময় লাগবেই। সময় তখন ক্ষ্যাপাটে হতে শুরু করলো। সময় তখন অসময় হয়ে বুকের ঠিক মাঝখানটায় পোড়া সিক সেধিয়ে দিতে থাকল। খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছে সামতান। না জানি আরও কতগুলো টেস্ট যে করাতে হবে সামতানের? থুপথুপ অন্ধকার হাসপাতালের করিডরে। এখান থেকেই যতটা দেখা যায় আর কী! বিকেল থেকে এমনি করেই সামতানের পাশে বসে আছে অর্পিতা। বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। মানসিক চাপ একেবারেই বিমর্ষ করে তুলছে ওকে। সামনে যদ্দুর দেখা যায়- পেসেন্ট ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না ওর। তখনো কোনো রেসপন্স নেই সামতানের।

আস্তে আস্তে অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে হাসপাতাল, হাসপাতালের সবগুলো কেবিন এবং অর্পিতা। সামতানের পাশে একটু তেরচা হয়ে বসে সে। শিরদাঁড়ার জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা করছে ওর। কম তো নয়, সেই বিকেল থেকে সামতানের পাশে বসে আছে ও! রাত উৎড়ে আরও গাঢ় হচ্ছে। অসাড় হয়ে আসছে চারপাশ। লোডশেডিং তো আছেই। ফারদিন ছটফট করছে খুব। একবার যদি সামতানের পাশে বসতে পারত সে! আর্মানিটোলার আব্দুর রহমান হলে থাকার সময় একবার ফারদিনের রক্তে হিমোফিলিয়া দেখা দিলে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এই সামতানই ওকে সঙ্গ দিয়েছিল সব সময়। এ চেম্বার থেকে ও চেম্বার, যাবতীয় টেস্টের রিপোর্ট কালেক্ট, প্রেসক্রিপশন ধরে ওষুধ প্যাকিং- কী করেনি সে সেদিন? ভীষণ গিল্টি ফিল করছে ফারদিন। এত কাছাকাছি থেকেও সে একবারের জন্যেও ছুঁতে পারছে না সামতানকে। কুঁকড়ে ওঠে ফারদিন। সে বালিশে মুখ সেধিয়ে ঠোঁট কামড়াতে থাকে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ে ফারদিন। তার মধ্যে আবার লোডশেডিং আরও অচেনা করে তুলছে হাসপাতালের অন্ধকারগুলোকে। জেনারেটর স্টার্ট করলেও তো পারে কর্তৃপক্ষ! ধুকপুক করছে বুক। না জানি কী হয় সামতানের! মনে হচ্ছে চারপাশের ঘুটঘুটে অন্ধকার ক্রমেই গ্রাস করছে একে অন্যকে। অর্পিতা কেবিন ছেড়ে হাসপাতালের করিডরে গিয়ে দাঁড়ায়। পুরো হাসপাতালের কোথাও কোনো বাল্ব জ্বলছে না। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো অবশ্য তখনো জ¦লছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্ট্রেচারের ওপর একটা লাশ দেখা যাচ্ছে দূর থেকেই। দু-চারজন বসেও আছে সেখানে। প্যাসেন্ট পার্টি বোধ হয়! কিন্তু স্ট্রেচারে রাখা লাশটা বেওয়ারিশ নাকি? বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে ওঠে অর্পিতার। এভাবে সামতানও যদি ইয়ারপোর্ট রোডের কোথাও মরে পড়ে থাকত- তাহলে কি ওকেও বেওয়ারিশ হিসেবে স্ট্রেচারের ওপর ফেলা রাখা হতো? আঞ্জুমান-ই-মফিদুলে দাফন করা হতো কাউকে ছাড়াই? আর কিছু ভাবতে পারে না অর্পিতা। চোখ ফেটে কান্না আসে ওর। আঁধারের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে অর্পিতার শরীর। একটা অপরাধ বোধ ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকে অনবরত। দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে যায় সে। সামতানের কাছে এল অর্পিতা। ততক্ষণে চোখ মেলে তাকিয়ে কী যেন এদিক-সেদিক দেখছে সামতান। কাউকে কি খুঁজছে সে? কী যে ভালো লাগছে অর্পিতার! অস্ফুট ভাঙা ভাঙা গলায় সামতান বলল, আমি এখন কোথায়?

অর্পিতা বলল, হাসপাতালে! তারপর আর বেশি কিছু বলতে পারল না সামতান। অর্পিতা ওর হাত ধরল শক্ত করে। একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কীই বা করতে পারত সামতানের জন্য অর্পিতা? অর্পিতার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। উঠুক! নির্ঘাৎ মৃত্যুকে কাছাকাছি থেকে দেখে ভেতরের দিকে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠাটা বড্ড স্বাভাবিক। ভেঙেচুরে এগিয়ে যাচ্ছে রাত। চোখজুড়ে কোথাও হালকা ঘুমেরও কোনো রেশ নেই।

তিন.

উৎকট গন্ধ। পচা মাংসের বিদঘুটে বিশ্রী গন্ধ। স্টেডিয়াম পার হয়ে মেথর পট্টিতে এলেই এ ধরনের গন্ধে অনেকে বমিও করে ফেলে। সিটি করপোরেশনের ক্লিনাররা মাসে বোধ হয় একবারও এদিকে আসে না। গলির ভেতরের দিকটা আরও বিশ্রি, আরও যত্ন-আত্তিহীন পরিস্থিতি। তবুও এদিক দিয়েই যাওয়া আসা করে সুরমি। স্টেশন রোডের ওদিক দিয়ে আসতে লজ্জা পায় সে। প্রফেসর কলোনির মেয়ে তো, তাই। ওয়েস্টার্ন কালচার ফলো করে। ডিভোর্সি। ওভার স্মার্ট। মডার্ন খুব। তবে শাড়ি পরে। বোঝাই যায় না- ওর হাজব্যান্ড ছিল! দেড় বছরের একটা ছেলেও আছে। ওরও ভ্রূণ নষ্টবিষয়ক অভিজ্ঞতা কম নয়! প্রফেসর ক্লাবের মেম্বাররা ক্ষেপেছে খুব। সামতানেরও মেম্বারশিপ আছে ওই ক্লাবে। আজ মিটিং হতে পারে ক্লাবে। এজেন্ডা লিভটুগেদার। ক্লাব কমিটি এতদিন সুযোগ দিয়ে এসেছে অনেক। এভাবে আর কত দিন? প্রফেসর কলোনির মেয়েগুলো পেয়েছেটা কী? ওদের জরায়ু কতটা উর্বর- সেটারই একটা শেষ দেখতে চায় ক্লাব কমিটি। সুরমি আজ একটু টেন্সড। একটু? নাকি অনেকটা? ওর মুখটা সকাল থেকেই শুকিয়ে আমসি।

আজ সে ফ্ল্যাট থেকে কোথাও বের হয়নি। ক্লাব থেকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে ওদের ফ্ল্যাটে। বেডে শুয়ে আছে সুরমি। কী দরকার ছিল অত লিভ টুগেদারের? লিভ টুগেদার যখন করতই, তাহলে প্রটেকশন নিলে কী হতো? কিচ্ছু ভেবে পায় না সুরমি। একবার দুবার নয়, চার-পাঁচবার অ্যাবরশন করে গর্ভের ভ্রূণ নষ্ট করেছে সে। যে ভ্রূণগুলো প্রফেসর কলোনির ম্যানহোলে পাওয়া যেত- সেগুলো কি তাহলে সুরমিরই ভ্রূণ? ভ্রূণগুলো আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে কি একবারও ওর মাতৃসত্তা কেঁদে ওঠেনি? কী নিষ্ঠুর মেয়ে ছেলে রে বাবা! পোয়াতি হতেও দেরি হয় না, আবার খালাস করতেও বুক কাঁপে না। একটা দুটো বিইয়ে দেখলেই তো পারত! বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে আসে সুরমি। নিজেরই গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে করে ওর। এমন চুনকালিমাখা মুখ নিয়ে সে কীভাবে বেঁচে থাকবে? পেট বাজানোর সময় সেকথা মনে ছিল না?

ওপরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। সেই দীর্ঘশ্বাসজুড়ে স্পষ্টই অনুতাপের বহিঃপ্রকাশ। কলঙ্ক তো মেয়েদেরই হয়, পুরুষদের কি আর অতটা হয়? সুরমি যা করেছে- সেটা নির্ঘাত পাপ। জরায়ুতে থাকা ভ্রূণের খবর খুব তাড়াতাড়ি সবাই ঠাওর করতে পারে, কিন্তু সেই ভ্রূণের প্রাণের উৎস কি কেউ সেরকমভাবে আন্দাজ করতে চায়? রুমে আসে সুরমি। ছেলের মুখের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে সে। কী নিষ্পাপ ওই মুখ! ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে একবারের জন্য হলেও বদলাতে চায় সে। ভালোভাবে বাঁচতেও চায় এখন। ক্লাব কমিটি কি ওকে সেই সুযোগ দেবে? ডুকরে কাঁদতে চেয়েও পারে না সুরমি।

কলোনিজুড়ে এখন শুধুই সুরমিকে নিয়েই চর্চা হচ্ছে। যাকে বলে টক অব দ্য কলোনি! এই মুহূর্তে কে পাশে দাঁড়াবে ওর? সামতানকে ফোন করে দেখবে নাকি একবার? সেও তো ওই ক্লাবের মেম্বার। কিন্তু সামতান তো অসুস্থ। হাসপাতাল থেকে ফিরেছে বেশি দিন হয়নি। এই তল্লাটে এমন কি কেউ নেই যে- ওকে হেল্প করবে? ওর প্রাণীসত্তা কি আজ থেকেই চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাবে? দিগ্বিদিক অন্ধকার হয়ে আসে সুরমির। দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে সে। এতবড় একটা ফ্ল্যাটে পাপ কি শুধু সুরমিই করেছে? আর কি কেউ এমন পাপ আর কখনো করেনি? কিংবা করে না?

বিকেল হয়ে আসছে। সন্ধ্যার পরেই ওকে ক্লাব থেকে নিতে আসবে। ছাদে যাওয়ার ইচ্ছে করছে ওর। বিকেলের পর বাকি সময়টা সুরমির ছাদেই কাটত। কিন্তু আজ কীভাবে সম্ভব? সবার নজর তো এখন ওর ফ্ল্যাটের দিকেই। ক্লাবের অপমান কি সে সহ্য করতে পারবে? ঘামতে থাকে সুরমি। ছাদে যাওয়ার দরকার নেই এখন। দরজায় কান পেতে থাকে সে। দেয়ালের অলমেটগুলোর ওপর দৃষ্টি যায় সুরমির। এক সময় খুব ভালো সেলাইয়ের কাজ করত ও। তখনই ওগুলো বানিয়ে বাঁধাই করে রেখেছিল।

কলিংবেলটা বেজে উঠল। কলিংবেলের আওয়াজে বুকটা ছিঁড়ে যাওয়ার মতো উপক্রম ওর। এখনো তো সন্ধ্যা হয়নি, তাহলে কে এলো? ক্লাবের কেউ নয় তো? জিজ্ঞাসা করল, কে?

-আমি অর্পিতা।

নামটা শুনে অবাক হলো সুরমি। দরজাটা খুলে দিল সে। চোখে মুখে ভীষণ অস্থিরতা ওর।

-বলল, ভাবী আপনি? ভেতরে আসুন। সোফায় বসতে বলল অর্পিতাকে।

-আমার এই দুঃসময়ে আপনাকে দেখে একটু হলেও স্বস্তি পেলাম ভাবী। সামতান ভাইয়ার কী অবস্থা এখন?

-ও এখন একটু সুস্থ। তবে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে হবে বহুদিন। সুরমির এই আতিথেয়তা বেশ অবাক করল অর্পিতাকে। এমন একটা পরিস্থিতিতেও কেউ যখন স্বাভাবিক রাখতে পারে নিজেকে- সেই হয়তো বা সব কিছুকে সামাল দিতে জানে! কিন্তু সুরমি কি সত্যিই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পেরেছে? অর্পিতা সবেমাত্র এসেই অতটা গভীরভাবে অ্যানালাইসিস করতে পারেনি ওকে।

-সে বলল, আপনি বসুন ভাবী, আমি কিচেন থেকে চা নিয়ে আসছি।

-তার আর দরকার হবে না। তুমি বোসো তো! জানো তো- সন্ধ্যায় প্রফেসর ক্লাবে তোমাকে ডাকা হবে?

-হ্যাঁ ভাবী, জানি।

-নোটিশও পেয়েছ হয়তো বা! ক্লাবের মেম্বার হিসাবে ইনফর্ম করার দায়িত্বটা সামতানের। সে অসুস্থ থাকার কারণে আমাকেই আসতে হলো।

-না ভাবী, এসে ভালোই করেছেন। আমি আপনাদের ওখানে ফোন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করিনি।

-তা ফোন করলে না কেন?

-সামতান ভাইয়া অসুস্থ তো, তাই।

-কিছু বলবে সামতানকে? আমাকেও বলতে পারো।

-ভাবী, আমি আমার ছেলেটার জন্য বাঁচতে চাই। প্রফেসর ক্লাবের মিটিং-এ অতগুলো মানুষের সামনে অপমান করা হলে আমার হয়তো বা বেঁচে থাকাটায় দায় হয়ে পড়বে।

অর্পিতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কালশিটে পড়েছে চোখের নিচে। ওর জন্য কী করতে পারে সে? বেঁচে থাকার কত আঁকুতি সুরমির সেই অনুরোধে! অর্পিতা কিছু একটা করতে চায়। ওর জন্য না হোক, ছেলেটার জন্য সুরমিকে বেঁচে থাকার একটা পথ বাতলে দিলে কী এমন ক্ষতি হবে অর্পিতার? অর্পিতা কি পারবে? বিকেল তখন পড়পড়। হারিকেন নেভা বাতাসগুলো জানালার ফাঁক গলিয়ে হু হু করে ঢুকছে ঘরে। সবগুলো পর্দা এলোপাথাড়ি উড়ছে তো উড়ছেই।

চার.

দুঃসহ সব কিছু। চোয়ালের ভেতরের দিকটায় ভীষণ ব্যথা। টনসিলের নয়, অ্যাক্সিডেন্টের। ঢোক গিলতেও কষ্ট হচ্ছে সামতানের। শেকড়-টেকড় গজায়নি তো আবার? সারা মুখে স্বাদ-টাদ বলতে কোনো কিছুই নেই। জিহ্বা মোটা হয়ে গেছে, দাঁতের গোড়ালি ফুলে উঠেছে, ঠোঁট দুটোতে চার-পাঁচটা সেলায়ের দাগ। পানি গিলতেও মাথার মগজ টেনে ধরে মনে হয়। শরীরের কোথাও কোথাও থেকে এখনো স্টিচগুলোও কাটা হয়নি। স্যাভলন দিয়ে ঘা-গুলো ধোয়ার সময় যা জ্বলে- তাতে নিঃশ্বাস থেমে যাওয়ার মতো কষ্ট পায় সামতান। ফারদিনের সাথে ড্রয়িংরুমে বসে আছে সে। ডায়ালাইসিস করার পর বেশ ভালোই থাকে ফারদিন। পার্মান্যান্টলি কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট না করা পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের মধ্যেই থাকতে হবে ওকে।

-ফারদিন বলে, এখন কেমন আছিস সামতান?

-মোটামুটি ভালো। অর্পিতার কাছে শুনলাম, তুই নাকি অ্যাক্সিডেন্টের দিন আমার পাশের কেবিনেই ডায়ালাইসিসে ছিলি?

-হ্যাঁ! কিন্তু তোর জন্য কিছুই করতে পারিনি রে। আই অ্যাম এক্সট্রেমলি স্যরি ফর দ্যাট। আই ওয়াজ ইন ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন। ডায়ালাইসিস ইজ মাই পার্ট অব লাইফ অ্যাট দিজ মোমেন্ট। ইউ নো দ্যাট বেটারলি।

-সামতান বলল, নো ইগো। দ্যাট সিচুয়েশন ওয়াজ কমপ্লিটলি আউট অব সেন্স। আই ডিডেন্ট মাইন্ড। আফটার অল আই অ্যাম ইয়েট আউট অব দ্য উড। আমিও তো তোর জন্য কিছুই করতে পারিনি ফারদিন।

-কীভাবে করবি, তুই তো সম্পূর্ণ সেন্সলেস ছিলি। তাছাড়া তোর সারা শরীর ব্যান্ডেজে মোড়ানো ছিল।

অর্পিতা চায়ের ট্রে হাতে ড্রয়িংরুমে আসে। দুটো কাপ এগিয়ে দেয় ওদের দিকে।

-সে বলল, তোমার ওষুধ আনব সামতান?

-না, থাক! মা কোথায় অর্পিতা?

-ওনার রুমে।

-ওষুধ দিয়েছ?

-জি, দিয়েছি।

অর্পিতার মুখটা ভীষণ রকমের শুকিয়ে গেছে, ত্বকে কালো স্পট পড়েছে, চোখ দুটো লাল। রাতে ভালো ঘুম হয় না নাকি ওর? ব্যাপারটা কী?

-সামতান জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে অর্পিতা তোমার? তোমাকে এত রোগাটে লাগছে কেন? আমাদের নার্সিং করতে করতে তুমি বোধ হয় হাফিয়ে উঠেছ, তাই না?

-কী যে বলো না সামতান! এটা আমার সংসার। পুরো সংসারকে আগলে রাখা আমার দায়িত্ব।

-তো কী হয়েছে তোমার? সামতানের এই জিজ্ঞাসায় আঁতকে ওঠে অর্পিতা।

-বলে, সুরমির আত্মহত্যাকে আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না সামতান। সে ওর ছেলের জন্য বাঁচতে চেয়েছিল। তোমাকে কত করে বললাম প্রফেসর ক্লাবের মিটিংটা তোমরা ক্যানসেল করে দাও। অল্টারনেটিভ কোনো ওয়েতে ওকে ক্লাবে কল কর।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সামতান। সামতান যে সুরমির জন্য কিছু করতে পারত না- তা কিন্তু নয়! সে অর্পিতার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেনি। অর্পিতা ওর ফ্ল্যাট থেকে আসার পর সবকিছু ম্যানেজ করার জন্য সামতানকে নিয়ে প্রফেসর ক্লাবে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু সেদিনকার সন্ধ্যার আগে সুরমি কারও ওপরই আস্থা রাখতে পারেনি। অর্পিতা ওর ফ্ল্যাট থেকে আসার পরই সে ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিল। সেদিন কেউই সুরমিকে ছাদে উঠতে দেখেনি। কেন দেখেনি? কে জানে সেকথা? অথচ সবার শকুনি দৃষ্টি তো সেদিন সুরমিকে ক্ষত-বিক্ষত করছিল বারবার। কী বীভৎস মৃত্যু!

অত বড় বড় অ্যাপার্টমেন্টগুলোর কার্নিশে সুরমির শাড়ির ছেঁড়া আঁচল পতপত করে উড়ছিল। মাথার চুলগুলো ছিঁড়ে গিয়ে আটকে ছিল থাই গ্লাস লাগানো বেশ কটা ঢাউস জানালার গ্রিলে। ছিটকে যাওয়া মগজের কুচুটে দাগ অ্যাপার্টমেন্টগুলোর ওয়ালে লেপ্টে ছিল পেইন্টিং-এর মতো। এভাবে কি কেউ নিজের প্রতি এতটা বিষিয়ে ওঠে? ওর দেড় বছরের ছেলেটার কী হবে এখন? সেই জন্যই কি অর্পিতা কদিন ধরে রাতে ভালো ঘুমাতে পারেনি, কিংবা পারে না? গা বাঁচানোর অভ্যাস তো অর্পিতার কখনোই ছিল না, নেইও। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে অর্পিতার। ওর বুকের ভেতর দুদ্দাড় শব্দ হতে থাকে অবিরাম। কিসের সেই শব্দ? দেয়ালে লটকানো ক্যালেন্ডারটা সশব্দে ঘষা খেতে থাকে দেয়ালের সাথেই। আকাশ যেন মুখ থুবড়ে পড়তে চাইছে বুকের ওপর। পড়ুক না! ডগ-লেগড সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠতে থাকে অর্পিতা। সব কিছু এক এক করে ভেঙে পড়তে থাকুক। ভেঙে পড়ুক ওপরকার ছাদ, ভেঙে পড়ুক রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট, দরজার ছিটকিনি এবং অসময়ের সাতকাহন।

 

Read Previous

রীতা ইসলামের যুগল কবিতা

Read Next

শিকড়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *