অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রীতা রায় মিঠু -
পুনর্জন্ম

মেলবোর্নের মনাশ ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি রেল স্টেশন কার্নেগি। স্টেশন থেকে বের হলেই বাস স্টপেজ। স্টেশন স্টপেজ থেকে দুই স্টপেজ পেরিয়ে কার্নেগি এলিমেন্টারি স্কুল। স্কুলের পাশের গলিটার নাম ডেনভার লেইন। ডেনভার লেইনে ঢুকে দুটো বাড়ির পরের ছিমছাম সুন্দর দোতলা বাড়িটাই সাব্বিরের।

সাব্বিরের বাড়ির কাছাকাছি দূরত্বে বাংলাদেশ আর কলকাতা মিলিয়ে বেশ কিছু বাঙালি বসবাস করে। প্রায় বারো বছর হতে চললো সাব্বির বাঙালি পাড়ায় এই বাড়িটা কিনেছে। বাঙালিদের এখানে সকলের সাথে সকলের যাতায়াত আছে। দুই বাংলার বাঙালিদের আড্ডা হয়, মাঝে মাঝে পিকনিক হয় আর প্রতি উইকএন্ডে পার্টি তো লেগেই থাকে।

সাব্বির মনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেছে এবং বর্তমানে একই ইউনিভার্সিটিতেই ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে এসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত। ফিজিক্সের মতো কঠিন বিষয় পড়ালেও মানুষ সে একটুও কঠিন নয়। আড্ডাবাজ বন্ধুবৎসল পরোপকারি তো বটেই, গানবাজনা, খেলাধুলাতেও সে পারদর্শী। লম্বায় এগারো ফিট, সুন্দর স্বাস্থ্য, পোশাক সচেতন এবং স্টাইলিস। বন্ধুমহলে সাব্বিরকে সকলেই খুব পছন্দ করে।

সাব্বিরের স্ত্রী সীমা, সুন্দরী ,শিক্ষিতা, ধীর-স্থির। সাব্বিরের মতো অতো চঞ্চল নয়, বিনয়ী তবে স্বল্পভাষী। বন্ধুদের আড্ডা-গল্পে উপস্থিত থাকে, সকলের কথা শোনে, নিজে বলে কম। সুন্দরী তার উপর কম কথা বলে, বন্ধুমহলে ভাবী-বৌদিরা আড়ালে সীমা সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে সুখকর কিছু বলে না। দেমাগি, অহংকারী তো বলেই, সাব্বিরের মতো এমন প্রাণচঞ্চল পুরুষের পাশে সীমাকে বেমানান মনে করে!

সাব্বির এবং সীমার দুই ছেলে, আট বছরের সম্রাট আর চার বছরের রাজা। দুজনেই স্কুলে যায়। সম্রাট খুব শান্তশিষ্ট বুঝদার ছেলে, রাজা জেদি এবং ছিঁচকাঁদুনে।

বাংলাদেশের ঢাকায় সাব্বিরদের বাড়ি। সাব্বিরের বাবা বেঁচে নেই, সাব্বিরের মা সাহানা বেগম বছরে দুই বার ছেলের কাছে বেড়াতে আসেন। তিন চার মাস ছেলে বৌমা নাতিদের সাথে কাটিয়ে আবার দেশে ফিরে যান। এখন তিনি এখানেই আছেন। গত মাসে এসেছেন। সাহানা বেগম এলে সাব্বির খুব খুশি হয়। সীমার চেহারায় অভিব্যক্তি কম তাই শাশুড়ির আগমনে তার খুশি বা অখুশি বোঝা যায় না।
আগে ছেলের কাছে বেড়াতে এসে সাহানা বেগম ছেলে বৌমার সাথে মেলবোর্নের সুন্দর সুন্দর স্থান ঘুরে দেখতেন। এখন আর সেটি হয়ে ওঠে না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁর হাঁটাচলা ধীর হয়ে আসছে, ডাক্তারের পরামর্শে স্বাস্থ্যবিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয়। তাই দিনের অধিকাংশ সময় তিনি বাড়ির ভেতরেই থাকেন, নিজের ঘরের বিছানায় বসে টিভি দেখেন, নামাজের ওয়াক্তে নামাজ পড়েন, দোয়া পড়ে নাতিদের মাথায় ফুঁ দিয়ে দেন।

দুই.
আজ শুক্রবার, ফ্রাইডে নাইট পার্টি। এই সপ্তাহে ভেন্যু সাব্বিরের বাড়ি। আজ সীমার কাজের অন্ত নেই। ঘরদোর পরিষ্কার, রান্নাবান্না সবতো সীমাকে একা হাতে করতে হবে। সাব্বির বাড়িতে থাকলে হেল্প করে, কিন্তু শুক্রবারে সাব্বিরকে ইউনিভারসিটিতে যেতেই হয়।

দ্রুত দুই পিচ্চিকে স্কুলে রওনা করিয়ে দিয়ে সীমা শাশুড়িকে চা-ব্রেকফাস্ট দিয়েছে। এরপর সাব্বিরকে ব্রেকফাস্ট দিতে গিয়ে বুঝলো, ব্রেকফাস্ট না করেই সাব্বির ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছে। সীমা অবাক হয়নি, তবে মনটা খারাপ হয়েছে।

সাহানা বেগম বিছানায় বসেই লক্ষ্য করেছেন, সীমার মুখখানায় আজ হাসি নেই। অভিজ্ঞ চোখ কখনও ভুল দেখে না। নিশ্চয়ই সাব্বিরের সাথে মনোমালিন্য হয়েছে।

সীমাকে সাহানা বেগম পছন্দ করেন, খুব লক্ষ্মিমন্ত মেয়ে। কথা একটু কম বলে, তবে শাশুড়ির যত্নে কোনো অবহেলা করে না। শাশুড়িকে শ্রদ্ধা-ভক্তিও করে, তারপরেও সাহানা বেগমের মনে হয়, মেয়েটা যদি আরেকটু চটপটে হাসিখুশি হতো, প্রাণ খুলে কথা বলতো। সাহানা বেগম বুঝে উঠতে পারেন না কখন সীমার মন ভালো থাকে, কখন মন খারাপ থাকে। এটুকু বুঝতে পারেন, সাব্বিরের সাথে মনোমালিন্য হলে বৌমার মুখে হাসি থাকে না। অন্ধকার মুখ নিয়ে যন্ত্রের মতো সব কাজ করে যায়।

আজও সকাল থেকে মেয়েটা পাকঘরেই ব্যস্ত। সন্ধ্যার সময় মেহমান আসবে। আজকের দিনে সাব্বিরের উচিত হয় নাই বউয়ের সাথে ঝগড়া করা। মেহমান আসবে, তাদের জন্য রান্না করতে হবে। মনে দুঃখ থাকলে, রাগ থাকলে রান্নার উপর তার ছাপ পড়ে। খাবার সুস্বাদু হয় না। মরিচ কম হলে লবণ বেশি হয়, নয়তো তরকারিতে তেল-মশলা ঠিকই থাকে লবণ বাদ যায়।

রান্নাবান্না শেষ করে সীমা বাথরুমে এসেছে। বাথরুমে আসার সময় শাশুড়ির রুমের দরজাটা ফাঁক করে বলে এসেছে সীমাকে এখন বাথরুম পরিষ্কার করতে হবে, কিছু দরকার থাকলে এখনই বলতে। কারণ বাথরুমে ঢুকে গেলে ঘর থেকে আম্মা ডাকলেও সীমা শুনতে পাবে না। সাহানা বেগম ইশারায় বলেছেন, উনার আপাতত কিছু দরকার নাই।

বাথরুম পরিষ্কার করছিল সীমা। কমোডে ব্রাশ ঘষতে ঘষতেই শুনতে পাচ্ছিল ডাইনিং রুমের ফোনটা বাজছে। দৌড়ে গিয়ে যে ফোন কলটা রিসিভ করবে সেই উপায় নেই। আম্মা আছেন পাশের ঘরে, উনি নিশ্চয়ই ফোনটা তুলবেন। কিন্তু রিং হচ্ছে, উনি ফোন তুলছেন না। সীমার খুব খারাপ লাগছে, যিনি ফোন করছেন হয়তো খুব জরুরি প্রয়োজনেই করছেন। এ বাড়ির তিন রুমে তিনটি ফোন সেট রাখা আছে। মাস্টার বেডরুম, স্টাডিরুম আর ডাইনিং রুমে।

এই বাড়িতে রাতে বিরাতেও ফোন আসে। ফোন বাজার শব্দে আম্মার বিশ্রামে ব্যাঘাত হতে পারে তাই আম্মার রুমে ফোন রাখা হয়নি। লিভিং রুমেও ফোন সেট রাখা হয়নি। কারণ বাড়িতে অতিথি এলে লিভিং রুমে বসেই আড্ডা চলে। আড্ডা চলাকালীন সময়ে ফোন বেজে উঠলে আড্ডায় ব্যাঘাত ঘটে। তাছাড়া অতিথির সামনে ফোনে কারো সাথে কথা বলতে সীমা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।

নিচতলায় ডাইনিং রুমের পাশের রুমটায় আম্মা থাকেন। বয়স্ক মানুষ, সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়। তাই সবদিক চিন্তা করে শাশুড়ির জন্য নিচতলায় ডাইনিং রুমের পাশের ঘরটা সীমা সাজিয়ে দিয়েছে। এই রুম থেকে কিচেন, ডাইনিং, বাথরুম সবই দেখা যায়। সুবিধে-অসুবিধেয় সীমাকে কাছাকাছি পাওয়া যায়।

বাতের ব্যথা ছাড়া আম্মার শরীরে আর কোনো সমস্যা নেই। খাওয়া-দাওয়া, হাঁটাচলা ধীর হলেও ঠিকঠাক আছে। আম্মার রুমে টিভি আছে। দিনের প্রায় অধিকাংশ সময় তিনি বিছানায় বসে পান চিবোন আর টিভিতে নাটক দেখেন। নাটক দেখার ফাঁকে ফাঁকে সীমাকে সংসার ধর্ম নিয়ে পরামর্শ দেন, ধর্মীয় উপদেশও দেন।

এসব উপদেশ বাণী অবশ্য সীমার মুখস্থ। ছোটোবেলা থেকেই মা, খালা, নানী, দাদিদের বলতে শুনেছে। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত, স্বামীর মুখে মুখে তর্ক করা ভালো না, পুরুষের রাগ বেশি। মেয়েদের সহ্যশক্তি থাকা সংসারের জন্য ভালো, যে নারী যত ধীর স্থির-শান্ত, আল্লাহতায়ালা সেই সংসারে বরকত দান করেন। স্ত্রীকে শাসনে রাখা স্বামীর কর্তব্য আর স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে স্বামীকে সবসময় খুশি রাখা। সীমা চুপচাপ শুনে যায়, হুঁ হাঁ করে না।

বাড়িতে গেস্ট এলে সীমার খুব ভালো লাগে। সারা বাড়ি যেন জেগে ওঠে। মেলবোর্নে কত বছর হয়ে গেলো! প্রথমে সাব্বির একা এসেছিল মনাশ ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি স্টুডেন্ট হিসেবে। মাস ছয়েক পর সীমা আসে।

শুরুর দিকে ওরা ব্র্যান্চউইক নামের শহরতলীতে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকতো। ওখানে বাসা ভাড়াও কম, প্রচুর বাংলাদেশি আছে। কিছুদিন যেতেই দেখা গেলো, পয়সা কিছু সেভ হলেও মনাশ থেকে ক্লাস ল্যাব শেষ করে ব্র্যাঞ্চউইক ফিরতে সাব্বিরের খুব কষ্ট হয়। দুই শহরে দূরত্ব অনেক, ট্রেনে যাতায়াত করতে হয়। বেশি রাতে ট্রেন থাকে না। সাব্বিরের বাড়ি ফিরতে প্রায়ই রাত হয়ে যেত, সারা দিন সীমাকে একা থাকতে হতো। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশে সীমা একা একা ঘরের বাইরে বের হতে ভয় পেতো।

এক বছর পর ওরা ব্র্যাঞ্চউইক ছেড়ে ইউনিভারসিটির কাছাকাছি শহরতলি কার্নেগিতে চলে আসে। এখানে এসে বেশ কয়েকটি বাঙালি ফ্যামিলির খোঁজ পেয়ে যায়। সকলের সাথে আলাপ পরিচয় হয়, ধীরে ধীরে বেশ ভাব হয়ে যায়।

কার্নেগিতে সকলেই ওদের দুজনকে খুব পছন্দ করে। তবে সীমা জানে, মহিলা মহলে সীমাকে জয়া বৌদি ছাড়া আর কেউ তেমন পছন্দ করে না। আর গান-বাজনা জানে বলে সাব্বিরকে ভাবী-বৌদিরা একটু বেশি পছন্দ করে। সাব্বিরও মনে হয় ভাবীদের কাছ থেকে গানের আহবান শোনার অপেক্ষায় থাকে। সাব্বির ভাই, প্লিজ মান্না দে’র ওই গানটা শোনান, বলতেই সাব্বির শুরু করে,

“ও কেন এতো সুন্দরী হলো—-‘’
সাব্বিরকে বাইরে-ঘরে প্রত্যেকে খুব ভালো জানে। সুপুরুষ, গান-বাজনা করে, টেবিল টেনিস খেলে, উদারভাবে সকলের সাথে মেলামেশা করে, এমন একজনকে পছন্দ না করে পারা যায়! সাব্বিরের গানের গলা খুব চমৎকার, গায়ও চমৎকার। রোমান্টিক গান বেশি গায় ও। সাব্বির যখন গায়, সীমাও মুগ্ধ হয়ে শোনে। কিন্তু মুগ্ধতা কেটে যায় যখন ভাবীরা হাসি ঠাট্টার সুরে বলতে থাকে সীমার ভাগ্য খুব ভালো, এমন একটা স্বামী পেয়েছে যিনি রূপে-গুণে-ধনৈশ্বর্য্যে সবার সেরা। সীমা অবশ্য বুঝতে পারে না, সাব্বিরের সাথে বিয়ে হওয়াটা এত ভাগ্যের মনে হচ্ছে কেনো ভাবীদের কাছে?

এভাবেই চলতে থাকে একের পর এক গান। আড্ডার পুরুষেরা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে গান শোনে, তারপর যে যার মতো দেশের পলিটিক্স নিয়ে সরগরম হয়ে যায়। সাব্বির ঐ পলিটিক্স আসরে না গিয়ে ভাবীদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে।

সম্রাটের বয়স এখন আট, রাজার চার। বিয়ের পর বাচ্চার জন্য সীমাকে বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিয়ের প্রথম রাতেই সাব্বির বলেছিল, ফ্যামিলির বড়ো ছেলে সে, ফ্যামিলির প্রতি তার কর্তব্য সবার আগে, এরপর বাচ্চা-কাচ্চার চিন্তা। কর্তব্য তো বেশ ভালোভাবেই পালন করে সীমা। এত বছরে শাশুড়ি-স্বামীর ভালোমন্দ সব কিছুতেই সীমা অভিজ্ঞ এবং অভ্যস্ত হয়ে গেছে। শাশুড়ির পান-সুপারির জোগান দেয়া, সময়মত চা দেয়া, ঠিক সময়ে খেতে দেয়া এ সবই সীমার মুখস্ত। তারপরেও সম্রাটকে আড়ালে নিয়ে সাব্বির জিজ্ঞেস করে, দাদির সাথে ওর মা ভালো ব্যবহার করে কিনা!

তিন.
বেসিন ঘষা হয়ে গেছে, বাথটাব মাজতে গিয়ে সীমা প্রায় আধভেজা হয়ে গেছে। আবার ফোন বাজছে। এভাবে ভেজা শরীরে বাথরুম থেকে বের হওয়া যাবে না। গোসলটা সেরেই বের হতে হবে। সীমা খুব দ্রুত কাজটা সারতে চাচ্ছে। কী আশ্চর্য, আম্মা কি কানে তালা দিয়েছেন নাকি! এতবার রিং হচ্ছে, উনার ছেলেও তো ফোনটা করতে পারে! বিছানা থেকে নেমে গিয়ে ফোনটা ধরলে কী এমন ক্ষতি হয়! টিভিতে সিরিয়াল চলছে, দুই মিনিটে সিরিয়াল তো ফুরিয়ে যাবে না।

সীমা কি করবে! সন্ধ্যায় গেস্ট আসবে, বাথরুমগুলো মেজে ঘষে চকচকে না করলে চলে না! এমনিতেই বাথরুম আর রান্নাঘরের ব্যাপারে সীমা খুঁতখুঁতে। বাইরে কোথাও গেলে পারতপক্ষে ও পাবলিক টয়লেটে যায় না। বন্ধুদের বাড়িতে গেলেও জয়া বৌদির বাড়ি ছাড়া আর কারো বাড়িতে ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। জয়া বৌদির রান্নাঘর, বাথরুম এতো পরিচ্ছন্ন পরিপাটি করে সাজানো যে ঘরে পা দিতেই মন ভালো হয়ে যায়।

এতবার ফোন বাজছে, সাব্বির ফোন করছে না তো! মনটার মধ্যে অস্বস্তি হচ্ছে। সকালবেলা বিছানা ছাড়ার আগেই দুজনে ঝগড়া হয়েছিল। আজ সে ব্রেকফাস্টও করেনি, সেই থেকেই সীমার মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। শাশুড়ির উপস্থিতিতে সাব্বিরের সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে না, তাছাড়া সীমা ঝগড়ুটে মেয়েও না। সাব্বির বাইরে এতো ভালো অথচ বাড়িতে ঠিক উলটো। বেখেয়ালেও যদি কাজে বা কথায় সীমা ভুল করে ফেলে,সাব্বির রেগেমেগে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে।

আম্মা এলেই সাব্বিরের মনে হয় জোর বেড়ে যায়, যখন তখন স্বামীত্ব জেগে উঠে। আজকের কথাই ধরা যাক, সকালে ঘুম থেকে উঠে রাজা ঘ্যানঘ্যান করছিল। সীমা প্রথমে ভেবেছে পেট ব্যথা হয়তো। বুঝিয়ে সুঝিয়ে টয়লেটে নিয়ে গেছে কিন্তু পটি না করেই রাজা চলে এসেছে। কিন্তু ঘ্যান ঘ্যান বন্ধ হয়নি। কোথায় ব্যাথা, স্কুলে যেতে ভয় লাগছে কিনা, জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলে না। শুধুই জেদ আর পা দাপাদাপি করছিল।

সম্রাট কাছে এসে ছোটো ভাইকে একটু আদর করতে যেতেই রাজা ওকে খামচে দেয়। কেমনটা লাগে, সম্রাট শান্ত বলে ওর উপর রাজা এত জুলুম চালায়! ছোটো বলে সকলেই ওকে আদরটা বেশিই করে, তাই এমন বাঁদর হচ্ছে। গত জানুয়ারি থেকে স্কুলে যেতে শুরু করেছে, এর মধ্যেই রোজ স্কুল থেকে নালিশ আসে, রাজা ক্লাসের অন্য বাচ্চাদের মারে। এখন থেকে একটু ডাক না দিলে ছেলেটা বেয়াড়া হয়ে উঠবে। বিদেশ বিভুঁইয়ে এটা অনেক বডড়ো সমস্যা। খামচির দাগ বসে গেছে সম্রাটের গালে, নিশ্চয়ই জ্বালা করছে। বেচারা মুখে কিছুই বলছে না, কিন্তু চোখ জলে ভরে উঠেছে। সীমা আলতো করে রাজার কান মলে দিয়েছিল, তাতেই রাজা ভ্যা ভ্যা চিৎকার জুড়ে দেয়।

এটাই দোষ হয়েছে সীমার। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে সে কি গর্জন সাব্বিরের। কেনো রাজাকে কাঁদালে? কে বলেছে এত ছোটো বাচ্চাকে শাসন করতে? বাপের চেহারা দেখে বাচ্চা দুটোও ভয় পেয়ে গেছে। সম্রাট তো কেঁদেই ফেলেছে। আব্বু, আমার কিছু হয়নি। তুমি মায়ের উপর রাগ করো না, মাকে বকো না। আমার ভয় লাগছে। আর রাজা তো বাপের রাগ দেখে থমকে গেছে। বুঝতেই পারছে না, ওর বাবা কাকে বকছে! ওকে বকছে নাকি দাদাকে বকছে, মাকে বকা দিচ্ছে? মাকে বকা দিলে বেশ হয়।

চার.
গোসল সেরে বাথরুম থেকে বের হতেই ফোনটা আবার বেজে উঠলো। এবার দুই রিং হতেই সীমা রিসিভার তুললো,
-হ্যালো, কে বলছো? ও বৌদি? কেমন আছেন? আসছেন তো সন্ধ্যেবেলা?
-ভাবী, আগে বলেন আপনি কেমন আছেন?
-আমি খুব ভালো আছি, রান্নাবান্না শেষ, আপনাদের আসার অপেক্ষায় আছি।
-রান্নাবান্না শেষ মানে কি? অসুস্থ শরীর নিয়েই রান্না করেছেন?
– কি বলছেন! আমি অসুস্থ হতে যাবো কেন? গোসল সেরে এলাম, শরীর-মন একদম তরতাজা লাগছে!
– সাব্বির ভাই ফোন করেছিল। বললো, আজ সকালে নাকি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাসপাতালে নেয়ার মতো অবস্থা! তা কি হয়েছিল ভাবী?
– কখন ফোন করলো সম্রাটের আব্বু?
-এই তো ঘন্টাখানেক আগে। আজকের নিমন্ত্রণ পোস্টপন্ড করতে হচ্ছে বললো। নিমন্ত্রণ ক্যানসেল করেছে বলেই বেশি ভয় পেয়েছি। সেই কখন থেকে ফোন করছি, কেউ ফোন ধরছে না দেখে আরও বেশি ভয় পেয়ে গেছিলাম। যাক গে, আপনার গলার আওয়াজ শুনে শান্তি পেলাম।
-বৌদি, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার রান্নাবান্না কমপ্লিট, বাথরুমে ছিলাম বলে ফোন ধরতে পারিনি, এই মাত্র গোসল করে বের হয়েছি আর আপনার ফোন এসেছে।
-ভাবী, সত্যি বলছি আমিও তো কিছু বুঝতে পারছি না। সাব্বির ভাই ঠাট্টা করেছেন বলেও মনে হয় নি।
-বউয়ের অসুখ নিয়ে কি কেউ ঠাট্টা করে!
– আচ্ছা, স্বামী-স্ত্রীতে মান অভিমান হয়নি তো? সাব্বির ভাই তো শিল্পী মানুষ,বউয়ের উপর অভিমান হয়েছে! নাকি ইচ্ছে করে দুষ্টুমি করেছেন!

উনি তো জানেন, আপনার অসুস্থতার সংবাদ পেলে আমরা সবাই খোঁজ নেবো। আপনি যখন বলছেন রান্না বান্না কমপ্লিট, তাহলে বৌদির সাথে সাব্বির ভাই নিশ্চয়ই দুষ্টুমি করেছেন, আজ সন্ধ্যায় যাই, মজা বুঝাবো।
এবার সীমার চোখে পানি এসে গেলো। ছি ছি ছি, সাব্বির এ কী ছেলেমানুষি করেছে! জয়া বৌদি অতি চমৎকার একজন মানুষ, সীমাকে বিব্রত হতে দিবেন না বলেই বিষয়টাকে হালকা করার জন্য এতো কথা বলছেন। বৌদি খুব বুদ্ধিমতি, বুঝে গেছে- ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। সীমা বুঝতে পারছে না সাব্বির কেন এই উদ্ভট কাজ করেছে! এখন আর লুকোছাপা কিছু করার নেই। বৌদিকে সত্যি কথা বলে দিবে। হাতের উলটোপিঠে চোখের পানি মুছে সীমা বললো,

-বৌদি, আজ সকালে সত্যিই ওর সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়েছে। তবে এমন বিরাট কিছু ব্যাপার ছিল না। রাজাকে একটু বকা দিয়েছিলাম, তাতেই সে যাচ্ছে তাই করে বকেছে আমাকে। এরপর কিছু না বলেই বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। আমি তো ব্যাপারটা এত সিরিয়াস ভাবিনি বৌদি, ছি ছি! কী সর্বনেশে কান্ড বলুন তো! সুস্থ স্ত্রীকে মহা অসুস্থ বানিয়ে আজকের দাওয়াত ক্যানসেল করে দিয়েছে! আমি তো এখন সত্যিই অসুস্থ বোধ করছি, কিছুই ভাবতে পারছি না। এমন রাগারাগি ও প্রায়ই করে, কিন্তু এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটালো।
-ভাবী, সাব্বির ভাই রাগারাগি করে? যাহ! কি যে বলেন, এই কথা কিভাবে বিশ্বাস করি বলেন তো। সাব্বির ভাই এতো মাই ডিয়ার টাইপের মানুষ!
-হুম, মাই ডিয়ার তো আপনাদের কাছে, আমার কাছে মাই ডিয়ার হতে যাবে কেন! আমার এই চাঁদমুখ সকাল থেকে রাত অবধি দেখতে দেখতে বেচারার চোখে পর্দা পড়ে গেছে!
-ধুস, এমন মন খারাপ করা কথা বলবেন না তো! মন খারাপ করে লাভ নেই। বুঝতে পারছি, সাব্বির ভাই আজ তালগোল পাকিয়েছে! কে জানে, হয়তো এর মধ্যেই আর সবাইকে ফোন করে নিমন্ত্রণ ক্যানসেল করে দিয়েছে। ওরাও হয়তো ফোন করবে আপনার শরীর-স্বাস্থ্যের খোঁজ নেয়ার জন্য। ভাবী শোনেন, আমাকে যা বলেছেন, বলেছেন। অন্যদের কাছ্বে এত সত্যি বলার দরকার নেই। বলে দিয়েন যে শরীরটা আসলেই খারাপ করেছে।
-বৌদি, আমার খুব খারাপ লাগছে, ভীষণ অপমান লাগছে। ও কেনো এটা করলো? কার সম্মান বাড়লো এটাতে?
-ভাবী, মন খারাপ করবেন না। আসলে সাব্বির ভাই আমাদের সবার সাথে খুব হৈ-হুল্লোড় করে বেড়ালেও আপনাকে আমি অনেক বেশি পছন্দ করি। আপনি একজন কবি, তাই আপনার অনুভূতিগুলো খুব সূক্ষ্ম।
– আরে! কীসের মধ্যে কি, আমি কবিতা লিখি, এ খবর কে দিল আপনাকে?
-হা হা হা! ভাবী, একটা প্রবাদ আছে, চেনা বামুনের পৈতে লাগে না। আপনার কবি প্রতিভা লুকিয়ে রাখতে চাইলেও তো লুকোতে পারবেন না। আমি নিজে কবিতা লিখতে না পারলেও কবিতা ভীষণ ভালোবাসি। ছদ্মনামে ফেসবুকে যাই শুধু এর-ওর ওয়ালে ট্যাগ করা কবিতা পড়ার জন্য। ওখানেই আপনার লেখা কবিতাও পড়ি। আপনার কবিতায় কমেন্টও করি।
-আমার মা কবিতা লিখতেন। মাকে দেখেছি তো, তাই জানি কবিরা অন্যরকম হয়। সংসারের কুটকচাল তাদের জন্য না। সাব্বির ভাই তো জানে, আপনার কবি প্রতিভার কথা!
-না, সম্রাটের আব্বু এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না। বৌদি, কবিতার কথা বাদ দিন। সম্রাটের আব্বু তো আপনাদের দাওয়াত ক্যানসেল করেছে, এখন আপনাকে রাতের জন্য রান্না করতে হবে, তাই না?
-কী আর করা! ভেবেছিলাম, আজ সীমা ভাবীর বাড়িতে ডিনারের নিমন্ত্রণ যখন, একদিন রান্নাঘর থেকে ছুটি নেবো, দুপুরে দই চিড়া খেয়ে থাকবো। এখন তো আর সেটা হবে না, রান্না করতেই হবে। সাব্বির ভাইটা যে কী সর্বনাশ করে দিল।
-বৌদি, আমার তো রান্না কমপ্লিট। আপনাকে আজ রান্না করতে হবে না। দাদাকে নিয়ে চলে আসেন সন্ধ্যেবেলা, আমরা একসাথে খাওয়া দাওয়া করি। আপনাদের দেখে সম্রাটের বাপ কি করে দেখি!
-না ভাবী, আজ থাক। সাব্বির ভাই আজ খুব বেশী রেগে আছে। ফোনে নিমন্ত্রণ ক্যানসেল করার পরও যদি সন্ধ্যায় গিয়ে হাজির হই, আমাকে উনি ভুল বুঝবেন। তার চেয়ে ভাল, উনার ভুল উনাকেই বুঝতে দিন।
-ঠিক আছে বৌদি, আপনার কথাই থাক। আপনার হাতে সময় আছে? আরও কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছে করছে। একটা সুখবর দিতে চাই। আপনাকেই প্রথম বলছি, এবারের বইমেলায় আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হবে।
-সত্যি? ভাবী দারুণ সুখবর তো! হ্যাটস অফ ভাবী! সাব্বির ভাই জানেন?
-ওকে বলেছিলাম বই প্রকাশ করার কথা, ও হয়তো বিশ্বাস করেনি তাই পাত্তা দেয়নি। কী যে যন্ত্রণার মাঝে আছি। আপনজন কাউকে বলতে পারি না প্রথম বই বের হওয়ার কথা, এটা নিয়ে সম্রাটের আব্বু অশান্তি করে!
-অশান্তি করে কেনো? ভাইয়ের তো গর্ব করার কথা। যাক গে, ভাইয়ের কথায় মন খারাপ করবেন না। কবিদের অতো সহজে মন খারাপ করতে নেই। ভাবী, গত সাতদিনে আপনার নতুন কোন কবিতা পোস্ট হতে দেখিনি কিন্তু!
– কিভাবে দেখবেন বৌদি, আমার ফেসবুকে যাওয়াই তো বন্ধ। ওর ধারণা, ফেসবুকে গিয়ে আমি বেশি স্মার্ট হয়ে যাচ্ছি। আজকাল ওর সাথে কথায় কথায় তর্ক করি!
-ও! এইজন্যই তো ইদানিং আপনাকে ফেসবুকে দেখি না। কী আশ্চর্য, সাব্বির ভাইকে দেখে তো মনে হয় না, উনি এতো বেশি ডোমিনেন্ট। বউ কবি, বউয়ের প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হচ্ছে। কোথায় সাব্বির ভাই মাইক বাজিয়ে সবাইকে জানাবে, তা নয়!
-কবিতা তো আমি নতুন লিখছি না, স্কুলে থাকতেই কবিতা লিখতাম। স্কুল জীবনেই আমার কবিতা দেশের প্রথম সারির পত্রিকা ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় ছাপা হতো। যখন কলেজে পড়ি, তখন তো রীতিমতো তরুণ কবি হয়ে গেছি। কলেজে আমার এক কবি বন্ধু ছিল, নাম শুভংকর। শুভংকর আর আমি পাল্লা দিয়ে লিখতাম, কবিতা পাঠাতাম ইত্তেফাকে। আমার প্রতিটি কবিতাই ছাপা হতো, কিন্তু শুভংকরের কবিতা মাঝে মাঝে ফসকে যেতো।
-শুভংকর নামটা এত স্পেশাল! আমার খুব কাছের একজনের নামও শুভংকর, সেও আপনাদের মত কবি। আপনার বন্ধু শুভংকর কি আপনার ক্লাস ফ্রেন্ড ছিল, নাকি প্রাক্তন ছিল?
-না, ও আমার চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতে পড়তো। কবিতার আসরে পরিচয়। খুব ভালো ছেলে, প্রাক্তন নয়, আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল ও। কবিতার ভেতর দিয়ে আমরা নিজেদের মাঝে এক ধরনের টান অনুভব করতাম, তবে সেটার মধ্যে কোনো খারাপ কিছুই ছিল না। ছেলে আর মেয়েতেও যে খুব ভালো বন্ধুত্ব হতে পারে, আমি আর শুভংকর ছিলাম তার উদাহরণ।
আমাদের দুজনের কবিতা পত্রিকায় ছাপা হলে শুভংকর খুব খুশি হতো। কিন্তু কোনো এক সংখ্যায় যদি শুভংকরের কবিতা ছাপা না হতো, তাহলেই বাবুর অভিমান।

নাক মুখ কুঁচকে বলতো, “ মেয়ে কবিদের অনেক সুবিধা। আর সেই কবি যদি তোর মতো নাক বোঁচা, চোখ ছোটো সুন্দরী হয়, তাহলে তো কথাই নেই। ছাইপাশ যা-ই লিখো না কেনো, পত্রিকাওয়ালারা খাতির করে ছাপিয়ে দেয়”।

ওর কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তাম। বাড়ি ফিরে আব্বুকে সব গল্প শোনাতাম। আব্বুও খুব মজা পেতো। শুভংকর আমাদের বাড়িতে এলে কপট রাগ দেখিয়ে আব্বু বলতো, “এই যে তরুণ কবি, আমার কবি মায়ের সাথে হিংসে করো কেন”! আব্বুর সামনে শুভংকর মুখ নিচু করে শুধুই হাসতো।

আব্বু ওকে একদিন পাশে বসিয়ে বলেছিল, ‘বাবা, তোমার কথা আমি শুনেছি সীমার কাছে। অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়েছো, বিধবা মায়ের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য এই বয়সেই কত পরিশ্রম করছো। তুমি তো তোমার মায়ের অহংকার। তুমি একদিন অনেক বড়ো হবে, অনেক বড়ো। দোয়া করি তোমার জন্য’।

ভালোই কাটছিল আমাদের দিন, কিন্তু হঠাৎ এক রাতে ঘুমের মধ্যেই আমার আব্বু মারা গেলেন। আমার ভাইগুলো দিশেহারা হয়ে গেল। আমাকে নিয়েই যেন ওদের যত চিন্তা! শুভংকর বাড়িতে আসে, আমার ভাইয়েরা অস্বস্তি বোধ করে।

– তারপর কি হলো? বাড়ি থেকে আপনার জন্য বিয়ের পাত্র দেখা শুরু হয়ে গেলো?
-বৌদি, কিভাবে বুঝলেন?
– এ তো আমাদের বাঙালির ঘরের রোজ নামচা ভাবী। আপনি তখন কলেজে পড়েন, দারুণ সুন্দরী তার উপর কবিতা লিখেন, কবিতা পাগল ছেলে বন্ধুর সাথে সহজ মেলামেশা করেন। তার উপর সদ্য বাবাকে হারিয়েছেন আপনারা। বাবা নেই মানে মাথার উপর ছাদ নেই, তাই বাড়ির সবাই ভয় পেয়ে গেছে। কবিরা তো এমনিতেই একটু মাথা আউলা হয়, বোনের জন্য দাদাদের চিন্তা তো হবেই। ওই বয়সেই তো ছেলেমেয়েরা উলটা পালটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। তাছাড়া শুভংকর অন্য ধর্মের, এমন মেলামেশা পাড়া প্রতিবেশিরাও নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখতো না। এই ভয়েই বাবা মায়েরা মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়।
-হ্যাঁ, আমার বেলাতে তাই হয়েছিল। সম্রাটের আব্বুর মতো এমন সুন্দর, ভদ্র বংশের উচ্চশিক্ষিত পাত্রের সন্ধান পাওয়া মাত্রই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললো।

শুভংকর খুব ভালো ছেলে, কবিতা ছিল ওর প্রাণ। ওর সাদা মনে কাদা ছিলো না। আমি ছিলাম ওর খুব ভালো বন্ধু। আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে ও খুব অবাক হয়েছিল। শুধু বলেছিল, ‘সীমা, আমার জীবনে দুইটা বন্ধু পেয়েছিলাম, কবিতা আর তুমি। আমার দিনের অর্ধেক কেটে যায় রুটি-রুজির ধান্ধায়, বাকিটুকু পড়াশুনা, কবিতা চর্চ্চায়। যে বয়সে সকলের একদল বন্ধু থাকে, সে বয়সে আমাকে কঠিন লড়াই করতে হচ্ছে। তুমি খুব উদার মনের মানুষ, আমার মতো অতি সাধারণ এক ছেলের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলে। চাচার কথা আমি জীবনেও ভুলবো না। উনি আমাকে অনেক স্নেহ করতেন, উনি বেঁচে থাকলে হয়তো তোমাকে এতো তাড়াতাড়ি শ্বশুরবাড়ি পাঠাতেন না। তারপরেও তুমি মেয়ে, একদিন না একদিন শ্বশুরবাড়ি যেতেই হবে। তুমি আমার প্রাণের বন্ধু, সেই দাবিতেই বলি, কবিতা লেখা চালিয়ে যেও। অনেক বড়ো কবি হবে তুমি। ভাগ্যে থাকলে আমাদের আবার দেখা হবে কবিতার মাঠে।

-শুভংকরের সাথে আর দেখা হয়নি??
– দুই বছর আগে দেশে বেড়াতে গিয়েছিলাম, তখন ওর সাথে দেখা হয়েছে। মস্ত বড়ো কবি সে, এর মধ্যেই পনেরোটি বই বের হয়েছে। খুব কাটতি তার বইয়ের। আমার এতো ভালো লেগেছে, আব্বুর কথা মনে পড়ে গেছে। আব্বু ওকে বলেছিল, একদিন ও অনেক বড় হবে, তাই হয়েছে।
-বিয়ের পর আপনি কবিতা লিখেননি?
-বৌদির যে কথা! বিয়ের পর কবিতা? সংসারের চরকায় তেল দিয়ে গেছি। হা হা হা! এই যে দেশে গিয়ে শুভংকরের সাথে দেখা হলো, তখনই শুভংকর আমাকে আবার কবিতার জগতে ফিরিয়ে আনতে চাইলো। ফেসবুকে প্রোফাইল খুলে সেখানে প্রতিদিন একটা করে নতুন কবিতা পোস্ট করতে বলেছিল। আগে শুভংকর আমায় ঈর্ষা করতো, এখন আমি ওকে হিংসে করি। হিংসের চোটেই কবিতা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করা শুরু। শুভংকরের সহযোগিতাতেই আমার প্রথম কবিতার বই বের হতে যাচ্ছে।
– সাব্বির ভাই জানে শুভংকরের কথা?
-সবই বলেছি ওকে, বিয়ের পরেই তো শুভংকরের গল্প করেছি, শুভংকরের সাথে ওর আলাপও করিয়ে দিয়েছিলাম। আমার মনে তো কোনো খারাপ কিছু ছিল না। এবারও বই বের করার গল্প ওকে বলেছি।
-ভাই কিছু বলেনি?
-নাহ! ভালো-মন্দ কিছুই বলেনি।
-ভাবী, এমন কি হতে পারে যে আপনার বন্ধুর কথা শুনেই ভাই আপনার উপর এমন রেগে আছে? অথবা আপনার কবি প্রতিভাকে হয়তো ঈর্ষা করছে! কথাটা কিন্তু মজা করে বললাম।
-কী জানি, আমি তো খারাপ কিছু করছি না বৌদি। তাছাড়া, বিয়ের পর তো আমি কবিতা লেখা ছেড়েই দিয়েছিলাম, তাতেই কি সব কিছু বদলে গেছে! আমার উপর ও অনেক মানসিক অত্যাচার করেছে, ওর কথার বাইরে যাওয়ার জো নেই, একটু এদিক সেদিক হলেই ও রেগে যায়।
-খুব কম মানুষই পারে অপরকে ঈর্ষা না করার গুণাবলি অর্জন করতে। মানুষের সহজাত ধর্মই হছে, পরস্পরকে ঈর্ষা করা।
-বৌদি, কথাটা ভেবে দেখার মতো। হতেও পারে, আপনার কথাই ঠিক।
-ভাবী, খারাপ কথা নিয়ে আজ নাহয় আর কিছু না বলি। তার চেয়ে কবিতার বই বের হচ্ছে, এই সুখবরটাই আমরা সেলিব্রেট করি।
-কিভাবে সেলিব্রেট করতে চান বৌদি?
-আজ তো হবে না, আগামীকাল বিকেলে আমি আসবো আপনার বাসায়। আপনাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সোজা চলে যাব প্যাকেনহাম। সমুদ্রের তীরে বসে কফি খাব আমরা। নতুন কবিকে পাঠকের তরফ থেকে প্রথম অভিনন্দনটা আমি জানাতে চাই।
-বৌদি, আমি খুব আপসেট ছিলাম সত্যিই, তবে এখন খুব খুশি। ভাগ্যিস আজ ওর সাথে ঝগড়া হয়েছিল, আর ও আপনাকে ফোন করে নিমন্ত্রণ ক্যানসেল করেছিল। সেজন্যই তো আপনি ফোন করলেন। আমিও এই প্রথম কারো সাথে আমার বুকের ভেতর যত্নে রাখা কথাগুলো শেয়ার করতে পারলাম। আপনি আমার কবিতা পড়েন, এটা জেনেই তো আপনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। সব খারাপের মধ্যেও ভালো লুকিয়ে থাকে, সব আঁধারের ফাঁকে ফাঁকে আলো থাকে! বৌদি, আজ সকল খারাপ ছাপিয়ে আমার কাছে ভালোটুকু এসেছে, আঁধারের ফাঁক গলে আলো এসেছে। কবিতার বই বের হওয়ার খবরটা আর কাউকে বলবেন না কিন্তু, ঠিক আছে? বই বের হলে সবাইকে সারপ্রাইজ দেবো।
-না, ভাবী, কাউকেই বলবো না। আপনি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আর ঐ যে বললাম, আর কেউ ফোন করলে বলবেন, শরীরটা আসলেই খারাপ।

পাঁচ.
বেলা বাজে সাড়ে বারোটা। সাব্বিরের লাঞ্চ ব্রেকের সময় হয়েছে। লাঞ্চ ব্রেকে সাব্বিরের খুব তাড়া থাকে। দ্রুত লাঞ্চ শেষ করেই আবার ল্যাবে ফিরে যায়। সীমা খুব তাড়াহুড়ো করছিল। মাছের ঝোলটা হয়ে গেছে, ডাল গরম করতে হবে। শাশুড়ি স্যালমন মাছ খান না, উনার জন্য একটা ডিম ভাজলেই হবে! আজ সন্ধ্যায় আতিক ভাইয়ের বাড়িতে দাওয়াত আছে। দুপুরে খাওয়ার জন্য অযথা বেশি আইটেম রেঁধে কি হবে? তরকারি বাসি হবে। বাসি তরকারি সাব্বির খায় না, আম্মাকেও দেয়া হয় না।

ছেলে দুটোও বাড়িতে নেই, দুদিন আগেই চলে গেছে আতিক চাচ্চুর বাড়ি। আতিক ভাইয়ের ছেলে আদনানের সাথে ওদের গলায় গলায় ভাব। মাঝে মাঝেই ছেলেরা এ-বাড়ি ও-বাড়ি করে।

সীমার মনটা খচখচ করছে। খেতে বসে সাব্বির যদি বলে ফেলে, দুপুরবেলা আম্মার জন্য শুধু ডাল আর ডিমের অমলেট? ঘরে কি আর কিছু নাই? সীমা রেফ্রিজারেটার খুলে দেখছিল, যদি একটা বেগুন বা টমেটো পাওয়া যায়, পুড়িয়ে আম্মার জন্য ভর্তা বানিয়ে দেয়া যাবে। ডোরবেল বাজছে, রেফ্রিজারেটারের দরজা বন্ধ করে সীমা এক ছুট লাগালো দরজার দিকে। সাব্বির চলে এসেছে, ও দরজার বাইরে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে চায় না।
দরজা খুলতেই দেখল, পোস্টম্যান দাঁড়িয়ে আছে। রেজিস্ট্রি খামে চিঠি এসেছে, রিসিট সাইন করে চিঠি নিতে হবে। বেশ মোটা ও চওড়া খাম, সীমার নামে পাঠানো। রিসিট সই করে খামটা হাতে নিয়ে সীমা ঘরে ঢুকে গেল। উত্তেজনায় বুকটা ধুক ধুক করছে। নিশ্চিত শুভংকর পাঠিয়েছে এই পার্সেল। তার মানে, ওর কবিতাগুলোর কারেকশান হয়ে গেছে। কতদিন হয়ে গেলো, নতুন বই সম্পর্কে কোনো আপডেটই পাচ্ছিল না সীমা । এজন্য এতদিন খুব অস্বস্তিতে ভুগছিল। তিনদিন আগে শুভংকরকে একটা টেক্সট পাঠিয়েছিল, কোন উত্তর আসেনি দেখে সীমা ধরেই নিয়েছিল, ওর বইটি এ বছর বের হচ্ছে না! খুবই খারাপ লাগছিল, এমন কি শুভংকরের উপর একটু বিরক্তও হয়েছিল মনে মনে।

সীমার সংসারের অবস্থা শুভংকর খুব ভাল করেই জানে, কতো সমস্যার ভেতর দিয়ে ওকে যেতে হয়। সব জেনেও শুভংকর ওর সাথে এমন ছেলেখেলা করলো!‘ কবিতার বই বের করবো, কবিতার বই বের করবো’ বলে স্বপ্ন দেখিয়ে এখন একেবারে চুপ হয়ে গেলো! কথার কোনো দাম নেই! সীমার মনটা হতাশায় ভরে যাচ্ছিল। তার মধ্যে সাব্বিরের সাথে চলছে টানাপোড়েন। কাহাতক ভালো লাগে! এখন তো দুজনের মধ্যে কথাবার্তাও বন্ধ। সেদিন দাওয়াত ক্যানসেলের ঘটনার পর থেকে সীমা সাব্বিরের সাথে পারতপক্ষে কোনো কথা বলে না।

খুব লজ্জা লেগেছে, অপমান লেগেছে, ঘরে যা কিছু করার তা তো করছোই, মানুষকে দাওয়াত দিয়ে বিনা কারণে দাওয়াত ক্যানসেল করে মানুষের সামনে সীমাকে এমন অপদস্থ করে কী লাভ হলো! খামটা হাতে পেয়ে সীমার মন থেকে যত কষ্ট, ব্যথা, অপমান সবই যেনো নিমিষে কোথায় মিলিয়ে গেলো। খামটি কি এখন ছিঁড়বে নাকি দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার শেষে খুলবে! খাওয়া-দাওয়া শেষ করে খোলাই ভালো। আয়েস করে বসে বসে কবিতার কারেকশানগুলো দেখবে।

কবি পাভেল রহমানকে দিয়ে কবিতাগুলো ঠিকঠাক করানোর কথা। পাভেল রহমান যদি ঠিক করে দেয়, এর উপর আর কারো কোন মাতব্বরি চলবে না। খামটা পাশের কম্পিউটার টেবিলের উপর রেখে সীমা কিচেনে চলে গেলো। ওর নামে পার্সেলের প্যাকেট এসেছে, এতটাই অভিভূত সে, শাশুড়ির জন্য বেগুন ভর্তা বানানোর কথা ভুলে যাচ্ছিল। সাব্বির চলে আসলেই মা-বেটা দুজনকে একসাথে খেতে দিতে হবে। আম্মা পরিমাণে অল্পই খান। ডাল আর ডিমেই হয়ে যেতো যদি সাব্বির ফেরার আগেই উনাকে খাইয়ে দেয়া যেতো। সেটা হওয়ার জো নেই। ছেলে ঘরে না আসা পর্যন্ত উনি না খেয়ে বসে থাকেন।

প্রথম প্রথম সাব্বির অশান্তি করতো সীমার সাথে, মায়ের যত্ন ঠিকমতো হচ্ছে না বলে। আম্মাকে কেনো সকলের আগে খেতে দেয়া হয় না! সম্রাট যখন বলেছে যে মামণি তো দাদুকে খেতে ডাকে, দাদু তোমার জন্য অপেক্ষা করে। এরপর থেকে সাব্বির এ বিষয় নিয়ে খোঁটা দেয়া বন্ধ করেছে। কত কষ্টের ভেতর দিয়ে একটা মেয়েকে যেতে হয়, কেউ কি তা জানে! শুভংকরের দশ-পনেরোটি বই বের হয়েছে, অথচ শুভংকরের চেয়েও অনেক বেশি ভালো কবিতা সীমা লিখতো। আজ শুভংকর কোথায়, আর সীমা কোথায়!

সীমার খুব কান্না পাচ্ছিল, আব্বার কথা মনে পড়ছে। এই একটা মাত্র মানুষ ছিল তার জীবনে, যে খুব উৎসাহ দিতো কবিতা লিখায়। কিন্তু কী যে হয়ে গেলো, আব্বা মারা যাওয়ার সাথে সাথে ভাইয়ারা এত কম বয়সে ওর বিয়ে দিয়ে ওর জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিল! আব্বু বেঁচে থাকলে আজ ওকে সাপোর্ট দিতে পারতো!

আবার ডোর বেল বাজছে! এবার সাব্বির চলে এসেছে। আজকে ওর সাথে আর অভিমান করে থাকা যাবে না। খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলেই পার্সেলটা দেখাতে হবে। ও আদৌ খুশি হবে কিনা কে জানে, তবুও এই মুহূর্তে আনন্দটুকু ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য হলেও সাব্বিরকে সব বলা দরকার।

এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই সাব্বির ঘরে ঢুকে গেলো। এখন কোনো কথা বলবে না সীমা, একেবারে খাওয়া দাওয়ার পর খামটি দেখিয়ে ওকে সারপ্রাইজ দেবে! সাব্বির গটগট করে বেডরুমের দিকে চলে গেলো, আর সীমা শাশুড়ির রুমের দিকে গেলো।

আম্মাকে খেতে ডাকতে হবে, উনার একটু সময় লাগে উঠে আসতে। বুড়ো হলে যা হয় আর কি! শাশুড়িকে অনেক যত্ন করে সীমা, তবুও কেন যে সাব্বির খুশি হয় না। কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। সাব্বির সেই দলের।

কড়াই থেকে মাছের ঝোলটা বাটিতে ঢালতে গিয়ে হাতে খুব বড়ো রকমের ছ্যাঁকা খেল সীমা। ইশ! এই এক যন্ত্রণা, প্রায় প্রায় ওর হাতে গরম ছ্যাঁকা লাগে। ফোস্কা পড়ে পড়ে ফর্সা হাতের পাতায় কতো যে কালচে দাগ হয়ে গেছে! একদিকে ভালোই হয়েছে, সাব্বিরের দেয়া কালশিটেগুলো সবার কাছে গরম ছ্যাঁকা বলে চালিয়ে দেয়া যায়।

দুই সপ্তাহ আগেও সাব্বির ওর হাতে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছিল। ঐ সময়টাতে সীমা খুব ব্যস্ত ছিল কবিতার বই নিয়ে। পুরানো কবিতাগুলো শুভংকরের কাছে পাঠানোর আগে এডিট করছিল। সাব্বিরকে বলেছেও সেই কথা, তবুও সাব্বির মানতে চায়নি। ওর এক বন্ধুর বৌ নাকি ঠাট্টা করে বলেছে, সীমাকে আজকাল ফেসবুকে খুব বেশি একটিভ দেখা যায়। ফেসবুকে কিন্তু খুব পরকিয়া চলে। সাব্বির যেন বৌয়ের দিকে একটু বেশি নজর দেয়। এমন নোংরা কথা শুনে সীমার খুব রাগ হয়। এই নিয়ে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে বলেছিল,
-আমার সাথে ঘর করতে হলে আমার নির্দেশমতো চলতে হবে, নাহলে তালাক দিয়ে দেবো।

সিগারেটের ছ্যাঁকা খেয়ে সীমা এতটাই অবাক হয়েছে যে তালাকের কথায় কোনো উত্তর দিতে ইচ্ছে করেনি। সেদিনই সাব্বির সীমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাকটিভেট করে দিয়েছে। অবশ্য ততদিনে সীমা ওর সমস্ত কবিতার ফাইল শুভংকরকে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

এসব কথা মনে হতেই সীমার মুখটা তেতো হয়ে গেল। মাছের ঝোলের বাটিটা খাওয়ার টেবিলে নিয়ে যাচ্ছিল। সাব্বির কম্পিউটার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে ওর খামটা দেখছে। খাওয়ার ঘরে যেতে হলে কম্পিউটার টেবিলটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। এই কম্পিউটার সীমা ব্যবহার করে, সাব্বিরের নিজস্ব ল্যাপটপ আছে। তবুও সাব্বির মাঝে মাঝেই সীমার টেবিল ঘাঁটাঘাঁটি করে, গুপ্তধন খুঁজে বেড়ায়! সীমা সবই টের পায়, কিন্তু কিছু বলে না। এখন সাব্বিরের হাতে খামটি দেখে একটু আগের তেতো হয়ে যাওয়া মুখটা আরেকটু যেনো তেতো লাগলো। ও প্ল্যান করেছিল, খাওয়া দাওয়ার শেষে ওকে সারপ্রাইজ দেবে খামটি দেখিয়ে, ওর বন্ধুর বৌয়ের কথা শুনে নিজের স্ত্রীকে অবিশ্বাস করেছিল, আজকে কবিতার সমস্ত কপি দেখালে হয়তো ওর ভুল ভাঙবে।

সাব্বির খামের উপর সীমার নাম দেখেই কৌতুহলী হয়ে উঠলো, প্রেরকের নাম দেখে চমকে গেলো। শুভংকর নামের বাস্টার্ডটা পাঠিয়েছে এই প্যাকেট। কত বড়ো সাহস! সীমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সাব্বির খামের মুখটা ছিঁড়ে ফেললো। এটুকু দেখেই সীমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। খাওয়ার ঘরে না ঢুকে মাছের ঝোলের বাটি হাতে ও সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো। সাব্বির খামটিকে হাতেই ধরে রেখেছে, সীমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-কতদিন ধরে চলছে চিঠি চালাচালি?
-তোমারই তো ভালো জানার কথা! আমার নাড়ি-নক্ষত্র তো তোমার হাতেই বাঁধা আছে। তুমিই খুঁজে দেখো।
-একদম চুপ, দাঁত খুলে ফেলব অসভ্য মেয়েছেলে কোথাকার!
-মুখ সামলে কথা বলো, সভ্যতা আমাকে শিখিও না। অন্যের চিঠি খুলে পড়া কোনো সভ্যতার মধ্যে পড়ে? তুমি কেনো আমার নামে আসা খাম খুললে? খামটা খোলার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছো?
-ওরে আমার সতী-সাবিত্রীরে! কোথাকার কোন ভ্যাগাবন্ড দুই পয়সা দামের কবি আমার বাড়ির ঠিকানায় আমার বৌকে প্রেমপত্র পাঠাবে, আর সেই প্রেমপত্র তোমার অনুমতি নিয়ে খুলতে হবে আমাকে, এতটাই ভেড়া ভেবেছো আমাকে?
-খবরদার! মুখ খারাপ করবে না। আমাকে গালি দিচ্ছো দাও, শুভংকরকে গালিগালাজ করো না। নিজেকে ছোটো করো না। আমি তোমার সম্পত্তি, শুভংকর তোমার সম্পত্তি না। সে দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত কবি, তাকে গালিগালাজ করে নিজেকে আর ছোটো করো না।
-বাবা রে! এ যে দেখছি কবি রাজত্ব হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠিত কবি, হাহ্! ভাগ্য ভালো, দেশের প্রেসিডেন্ট বলোনি! কবি! কবি রবীন্দ্রনাথ! যত্তসব! আমাকে বলো, শুভংকরের সাথে এখনও তোমার যোগাযোগ আছে কিভাবে? ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েও দেখছি প্রেম বন্ধ করতে পারছি না। আজকে তোমার হবে, দাঁড়াও। হাতে-গলায় গরম ছ্যাঁকা নিয়ে সন্ধ্যার পার্টিতে যাবে। বন্ধুরা কিছু জানতে চাইলেই আমাকে ডাকবে। আমি উত্তর দেবো।
-পারভার্টেড কোথাকার! শুভংকরের নাম নেয়ার আগে মুখ ধুয়ে নিও, তাহলে গুনাহ মাফ হবে। ছি! এমন একজন মানুষকে গালাগালি করতে লজ্জা করে না? তার কী দায় পড়েছে তোমার বউয়ের সাথে প্রেম করার! সে কি অথর্ব? তার মতো এমন নির্লোভ, সৎ মানুষের কপালে কি একটা বউও জোটেনি ভেবেছো? তোমার মতো মানুষের যদি এত বান্ধবী থাকতে পারে, শুভংকরের কেন দুই একটা বান্ধবী থাকতে পারবে না? তোমার কথা শুনে আমার সারা শরীর ঘিনঘিন করছে। এতো ঈর্ষাও থাকে মানুষের মনে।

আমার কবিতার একটা বই বের হবে, তোমাকে আমি সব বলেছি, শুভংকর নিজ দায়িত্বে কাজটুকু করে দিচ্ছে, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে কাজ, আর তুমি বলছো এমন নোংরা কথা। আমার লেখা বই বের হলে তোমার হিংসে হবে, তাই না? দশটা মানুষ জানবে, তোমার বউয়েরও কিছু যোগ্যতা আছে, সেটা জেনে ফেললেই তোমার সমস্যা, তাই না? ভাবীদের কাছ থেকে আর সহানুভূতি পাবে না, তাই না?

সীমা পাগলের মতো বকে যাচ্ছিল। খেয়াল করেনি, সাব্বির খামের ভেতর থেকে কবিতার স্ক্রীপ্ট টেনে বের করে ফেলেছে। যখন সীমার খেয়াল হলো, ততক্ষণে সাব্বির স্ক্রীপ্টের গোছা ছিঁড়তে শুরু করেছে। সীমা হতবিহবল দৃষ্টিতে দুই সেকেন্ড সাব্বিরের কর্মকান্ড দেখছিলো। তারপরেই চিৎকার দিয়ে সাব্বিরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হাত থেকে মাছের ঝোলের বাটি মেঝেতে পড়ে গেলো, সেদিকে খেয়াল নেই সীমার। সাব্বিরের দুই হাত জাপ্টে ধরে শুধু বলে চলেছে,

-না না, ছিঁড়ো না, ছিঁড়ো না। প্লিজ, তোমার দুইটা পায়ে পড়ি! আমার কবিতাগুলো ছিঁড়ে ফেলো না, আমি অনেক কষ্ট করে লিখেছি। শুভংকরের সাথে আমার কোনো খারাপ সম্পর্ক নেই, বিশ্বাস করো, কবি পাভেল রহমানকে দিয়ে আমার কবিতার কারেকশান করে শুভংকর পুরো প্যাকেট মেইল করেছে। তুমি খুঁজে দেখো, এর ভেতর কোনো চিঠি ফিঠি নেই। শুভংকরের ঘরে সুন্দরী বৌ আছে, আমি ওর বন্ধু, ছেলেবেলার বন্ধু, ছিঁড়ো না, প্লিজ ছিঁড়ো না।

সাব্বিরের গায়ের জোরের সাথে সীমা পারবে কেনো! এক ঝটকায় সীমার হাত ছাড়িয়ে হাতের কাগজগুলো কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেললো। সীমা বেশ কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে। ওর সমস্ত কবিতার গায়ে মাছের ঝোল মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে, ও তাকিয়ে আছে সেদিকেই। ওর চটক ভাঙলো বাম গালে খুব জোর এক চড়ের আঘাতে। মুখ তুলে সাব্বিরের দিকে তাকাতেই দাঁতে দাঁত পিষে সে বললো,
-এই জন্যই তখন বাড়িতে ঢুকেই মুখে অমন চাঁদের ঝিলিক দেখেছিলাম। অন্য সময় মুখ পাতিলের তলার মতো করে রাখো, আর আজকে মহাকবি শেকস্পীয়ারের চিঠি পেয়ে খুশিতে খলবল করছিলে, তাই না? কবি হয়েছো তুমি, কবি সুফিয়া কামাল। বাব্বা! কী ভাগ্যবান আমি, কবি সুফিয়া কামাল আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নোবেল প্রাইজ পাবে কবিতা লিখে! কবিতা লেখা বার করছি, আজকেই উকিলের কাছে যাবো।

সীমা আর একটি কথাও বললো না। বাথরুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। সাব্বিরের নোংরা কথার ঢেউ বাথরুমের দরজায় আছড়ে পড়ছে। এগুলো শুনতে চাইছে না সীমা, পানির ট্যাপ ফুল স্পিডে ছেড়ে দিল, এখনও শোনা যাচ্ছে নোংরা কথা, বাথটাবে নেমে শাওয়ারের চাবি খুলে দিল। এবার আর আগের মতো শোনা যাচ্ছে না সাব্বিরের গলা। সীমার মাথায় আগুন জ্বলছে। আগুন কোনোভাবেই নিভবে না। কার কাছে নালিশ জানাবে ও, আপনজন বলতে কেউ নেই! হঠাৎ করেই ওর চোখের সামনে আব্বুর মুখ ভেসে উঠলো, শৈশব ভেসে উঠলো, দুই বেনি দুলিয়ে ছোট্ট মেয়েটি আবৃত্তি করে চলেছে, ‘কাঠবেড়ালী, কাঠবেড়ালী, পেয়ারা তুমি খাও——‘

হাতে ক্রেস্ট নিয়ে সেদিনের উদীয়মান কবি, সীমা আখতার নেমে আসছে মঞ্চ থেকে। নিচে দাঁড়ানো তার প্রতিদ্বন্দ্বী শুভংকর বোস, নিচে নামতেই সীমার হাতে এক চিমটি কেটে দিলো। মুখ ভেংচে ভেংচে বলছে, ‘মেয়ে হয়ে জন্মালে কতো ভালো হতো রে! পত্রিকায় কবিতা ছাপা হতো, পুরস্কার পাওয়া যেতো, শালার ছেলে হয়ে জন্মেই সব মাঠে মারা গেলো’।

বাথরুমের দরজায় ধাক্কা পড়ছে। কে ধাক্কাচ্ছে, কেনো ধাক্কাচ্ছে, আমি তো আর কবি সীমা আখতার নই, আমি মিসেস সীমা খান, সাব্বির খানের বউ। আহ! তবুও ধাক্কাচ্ছে। আরে! আমি আর কবিতা লিখবো না, বলেছি তো।

শাওয়ারের পানিটা বেশ ঠাণ্ডা তো, আরাম লাগছে। দরজায় ধাক্কাধাক্কির আওয়াজ কমে এসেছে, সীমার ঘুম পাচ্ছে। কানের কাছে একটা কথাই শোনা যাচ্ছে,
‘বিয়ের পরও কবিতা লেখা চালিয়ে যেয়ো। তুমি অনেক বড়ো কবি হবে।‘

“ আরে! কবি সীমা আখতার যে! কবিতা লেখা ছেড়েই দিলে! ছি ছি! নিজের প্রতি অবিচার করতে লজ্জা করলো না। সীমা, আবার কবিতা লেখা শুরু করো। কী ভালো কবিতা তুমি লিখতে, তুমি পুরস্কার পেতে, আর আমি ছিলাম লবডঙ্কা। সেই আমি এতগুলো বই বের করেছি, আর তুমি লবঙ্কা করেছো। সীমা, তুমি আবার লিখো, আমি তোমাকে সাহায্য করবো, আগামী বই মেলাতেই তোমার বই বের করবো, সবাই জানতে পারবে হারিয়ে যাওয়া কবি সীমা আখতারকে। প্লিজ, আবার লেখা শুরু করো, আবার লেখো, আবার শুরু করো—–‘’

ছয়.
সীমার খেয়ালই ছিল না ঠিক কতক্ষণ সে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। শাওয়ারের ঠাণ্ডা পানির ধারায় প্রথমদিকে বেশ আরাম লাগছিল, দুচোখের পাতা ভারী হয়ে আসছিল। হঠাৎ করে গায়ে শীত কাঁপুনি দিতেই ওর আরামের ঘোর কেটে গেলো। মনে পড়ে গেলো, একটু আগে ঘটে যাওয়া সমস্ত অঘটনগুলো।

ও যখন বাথরুমে ঢুকেছিল, মাথায় তখন আগুন জ্বলছিল, সাথে বাম গালে সাব্বিরের দেয়া চড়ের জ্বলুনি। আর কিছুই মাথায় ছিল না। ওর এতো মূল্যবান কবিতার স্ক্রিপ্টগুলো যে মেঝেতে স্যামন মাছের ঝোলের সাথে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছিল, সে কথাও মাথায় ছিল না। নাহলে তখনই কিছু কবিতা অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা যেতো।

শীতে শরীর কাঁপছে, শাওয়ারের চাবি ঘুরিয়ে বন্ধ করে কার্টেন রডে ঝুলিয়ে রাখা টাওয়েল দিয়ে নিজের ভেজা মাথা মুছতে গিয়েই খেয়াল হলো, রাগের মাথায় বাথরুমে ঢুকেছিল, সাথে শুকনো কাপড়-চোপর ছিল না, এখন তাকে ভেজা কাপড়েই বের হতে হবে। ইস! কী যন্ত্রণা। টাওয়েলে মাথা পেঁচিয়ে ভেজা কাপড়েই সীমা বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা ড্রেসিংরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে আশেপাশে শাশুড়ি বা সাব্বির, কাউকেই দেখতে পায়নি। মেঝেতে মাছের ঝোল আর ওর কবিতার ছেঁড়া পান্ডুলিপি তখনও পড়ে আছে। এগুলোর জন্য আর খারাপ লাগছে না। ওর মনে হচ্ছে, চুলোয় যাক সবকিছু, কিসের কবিতা, কিসের কি? ওর জন্মই হয়েছে স্বামী আর শাশুড়ির খেদমত করার জন্য। এখন স্বামীর খেদমত করছে, আরও কয়েক বছর পরে ছেলেদের খেদমত করবে, তারও পরে, যদি শাশুড়ির মতো শত বছর আয়ু পায়, তখন ছেলে বউদের খেদমত করবে। কার যেনো লেখা, ‘কবিতা আজ তোমায় দিলেম ছুটি’, সীমার কাছেও মনে হচ্ছে, ‘কবিতা, শুধু আজকের জন্য নয়, সারা জনমের জন্য তোমায় দিলেম ছুটি’।

শুকনো কাপড়-চোপর পরে সীমা শাশুড়ির ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। গত এক ঘন্টার হট্টগোলে বুড়া মানুষটির খাওয়াই হয়নি। ছি, উনি কী ভাবলেন কে জানে! দরজায় এসে সীমা খুব আস্তে করে ডাকলো,
-আম্মা, ভাত দিচ্ছি, খেতে আসেন।
শাশুড়ি দরজার দিকে পেছন দিয়ে শুয়ে আছেন। সীমার কথায় একটুও নড়লেন না। সীমা আবার ডাকলো,
-আম্মা, ঘুমিয়ে পড়েছেন? অনেক বেলা হয়ে গেছে, খেতে আসেন।
-আমার ক্ষিদা নাই, তুমাগোর মারামারি দেইখা পেট ভইরা গেছে।
-আম্মা, রাগ করবেন না, আমাদের ভুল হয়েছে, আপনি খেতে আসেন। না খেয়ে থাকলে আপনার শরীর খারাপ করবে।
-এতই যদি বুঝো, তাইলে আমার পুলাটার সাথে এমন করো কেন? ওর মাথাটা একটু গরম থাকে, পুরুষ মাইনষের মাথা একটু আধটু গরম থাকতেই পারে, তুমি তার বিয়া করা বউ, তার কথা মাইনা চললেই তো হয়।
-ঠিক আছে আম্মা, আপনার ছেলের কথা মেনে চলবো। আপনি খেতে আসেন, আপনার খাওয়া হলে আমি একটু শোব। শরীর ভালো লাগছে না।
-কইলাম তো, আমি খামু না।
-ঠিক আছে, আমি তাহলে একটু শুই, ক্ষিদে পেলে আমাকে একটু ডাকবেন, উঠে খেতে দিব।
-তার আর দরকার হইবো না, তুমি আরাম কইরা ঘুমাও। আমার পুলাটা না খাইয়া বাইর হইয়া গেলো, মা হইয়া আমি কোন মুখে খাই?
সীমা আর কথা বাড়ালো না। ছেলে না ফেরা পর্যন্ত উনি না খেয়ে থাকবেন। এক কাপ দুধ গরম করে শাশুড়িকে দিতে হবে, বুড়ো মানুষ, এতো বেলা পর্যন্ত না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ করতে পারে।
ডোর বেল বাজছে। কে আসলো আবার? যন্ত্রণা হয়েছে, একটু শোবে, সে উপায়ও নেই। শাড়ির আঁচলে শরীর ঢেকে দরজা খুলেই দেখে, জয়া বৌদি। সীমা এতটাই অবাক হয় বৌদিকে দেখে যে মুখে কোনো কথা সরে না। জয়া বৌদিই প্রথম কথা বললো,
-ভাবী, ভেতরে ঢুকতে দেন।
-ওহো, হ্যাঁ হ্যাঁ, বৌদি আসেন, ভেতরে আসেন। কী ব্যাপার, হঠাৎ এমুখো হলেন যে!
-সাব্বির ভাই ফোন করে আসতে বলেছে। বাথরুমে ঢুকে গলায় দড়ি দিলেন কিনা, তা দেখার জন্য। একা একা বোধ হয় সাহস পাচ্ছিলো না। কিন্তু এভাবে কতোদিন চলবে ভাবী?
-বৌদি, মেয়েদের প্রাণ, কই মাছের প্রাণ, আপনিই সেদিন বলেছিলেন। ম্যানিলা দড়ি দিয়ে প্যাঁচালেও মরবো না। মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখেন, আমার প্রাণ স্যামন মাছের ঝোলের সাথে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
– কি ছেলেমানুষি যে করে সাব্বির ভাই!
-বৌদি, এ বছর আমার কবিতার বই বের হচ্ছে জেনে সেদিন কত খুশি হয়েছিলেন। আমাকে নিয়ে কফি খেয়ে আসলেন। বই বের হলে আমাকে নিয়ে আরও কতোকিছু করবেন বলেছিলেন, তার কিছুই হবে না। আজকেই দেশ থেকে আমার কবিতাগুলো মেইলে এসেছিল। মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যে কবিতার এই দশা হয়েছে!
-ছি ছি! সাব্বির ভাইয়ের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? উনি তো আমাকে কিছুই বলেননি। শুধু ফোন করে বলেছেন, তাড়াতাড়ি আসতে। আপনি নাকি রাগারাগি করে বাথরুমের দরজা আটকে দিয়েছেন। ডাকাডাকি করেও সাড়া পাচ্ছিলেন না বলেই ভয় পেয়ে গেছেন। ভেবেছেন হয়তোবা রাগের বশে কিছু একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছেন। ভাবী, মাছের ঝোলের বাটি কি ভাইয়ের গায়ে ছুঁড়েছিলেন?
-হাহ! সেটা করতে পারলে তো হতোই। কবিতার গোছা টেনে ছিঁড়ছিলো দেখে থামাতে গেছিলাম। হাতে ছিল মাছের ঝোলের বাটি, ছিটকে পড়ে গেছে।
-পরে ঘটনা শুনবো, আসেন তো, আগে আপনার লেখাগুলো উদ্ধার করি। এখনও কিছু কিছু শব্দ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
-না, বৌদি, ওগুলো আর আমার দ্বারা হবে না। দেশের প্রথিতযশা কবিকে দিয়ে কারেকশান করিয়ে মূল কপি আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল শুভংকর। হাতে লেখা কারেকশানের তো কোনো ফটোকপিও থাকে না। কাজেই একটু আধটু উদ্ধার করেই বা কী লাভ! যাক, জাহান্নামে যাক ওগুলো।
-ভাবী, আপনার বন্ধুর ফোন নাম্বার আছে আপনার কাছে? থাকলে আমাকে দিন তো, আমি কল করবো। সে তো আপনার সংসারের হাল কিছু কিছু জানে, দেখি, হয়তো তার কাছে ফটোকপি থাকতে পারে। এখনই অতো হতাশ হবেন না। তার আগে আমাকে একটু চেষ্টা করতে দিন। দেখি, ঝোল মুছে ছেঁড়া কাগজ জোড়া দিয়ে কতটুকু উদ্ধার করা যায়। মাসিমা কোথায়?
-আছে, পাশের ঘরে, ছেলে বৌয়ের উপর রাগ করে না খেয়ে শুয়ে আছেন।
-হুম! যতো দোষ নন্দ ঘোষ। যাক গিয়ে, আমি কাজ শুরু করে দেই।

জয়া বৌদি কলকাতার মেয়ে। তবে ওর বাপের বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গে। ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে ওর বাবার পৈতৃক ভিটে এখনও নাকি আছে। কি আছে কি নেই, তা নিয়ে জয়া ভাবে না। ছোটোবেলা থেকেই বাবা-মায়ের মুখে সব সময় ঢাকার গল্প শুনতে শুনতে ঢাকার প্রতি জয়ার মনে দুর্বলতা আছে। মেলবোর্নে অবশ্য বাঙালিদের মধ্যে দুটো গ্রুপ আছে। কলকাত্তাই বাঙালি, বাঙাল বাঙালি। জয়া দুই বাংলাতেই আছে। কলকাত্তাই আসরে যখন বাঙালদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করা হয়,জয়ার খারাপ লাগে। আসরে থাকে, তবে কোনো মন্তব্য করে না। বাঙালদের সাথে মিশে বলে ওর বন্ধুরা ওকে নিয়েও খুব মজা করে। আবার ঢাকাইয়া অনুষ্ঠানেও যখন জয়া আসে, ওখানেও ক্যালকেশিয়ানদের নিয়ে খুবই স্থুলভাবে রসিকতা চলে, সেটাতেও জয়ার খারাপ লাগে, কিছুই বলে না। বাংলাদেশি ভাবীদের মধ্যে একমাত্র সীমাকে জয়ার খুব পছন্দ। কারণ, সীমা কখনওই এইসব কুটকচালের মধ্যে থাকে না। সব সময় অন্য এক ভাবের জগতে বিচরণ করে। জয়া জানে, কবিরা অমনই হয়, ফেসবুকে ওর লেখা কবিতা জয়া পড়ে। বেশ ভালো লেখে। অবশ্য ঢাকার ভাবীরা সীমাকে নিয়ে আড়ালে খুব ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে, নিজেদের মধ্যে প্রায়ই বলাবলি করে,

– সাব্বির ভাইয়ের মতো এমন স্মার্ট-সুদর্শন পুরুষের কপালে এ কেমন বউ জুটেছে! হাবাগোবা টাইপ, স্টাইল জানে না, সাজগোজের কিছুই বোঝে না। এমন স্থূল ধরনের কথা শুনতে জয়ার ভালো লাগে না, তবে আসর ছেড়ে উঠেও যেতে পারে না।
সাব্বিরকে দুই বাংলার মহিলারাই খুব পছন্দ করে। কারণ, সাব্বির দেখতে শুনতে যেমন ভালো, তেমনই তার অনেক গুণও আছে। পেশায় ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, খুব ভালো গান করে, খেলাধুলোতেও ভাল আর দেখতে তো রীতিমতো সুপুরুষ। এইজন্যই মহিলা মহলে তার খুব খাতির।

জয়া অবশ্য জানতো না, সাব্বির ভাই বাড়িতে সীমা ভাবীকে এমন বিশ্রিভাবে ডোমিনেট করে। কানাঘুষা কিছুটা শুনেছে অবশ্য, তবে খুব খোলামেলাভাবে সেদিনই ধরা পড়েছে জয়ার চোখে, যেদিন সাব্বির ভাই ফোন করে বলেছিল,
-ইয়ে বৌদি, একটু সমস্যা হয়ে গেছে। আমাদের বাড়ির আজকের অনুষ্ঠানটা ক্যানসেল করতে হচ্ছে। সীমার শরীর খুব খারাপ, হসপিটালে নিতে হতে পারে! কিছু মনে করবেন না, আজকের দাওয়াত ক্যানসেল করছি বলে।
-আরে! না না, কী বলেন, দাওয়াতের কথা পরে হবে, ভাবীর কি হয়েছে? হসপিটালে নিতে হবে কেনো? সাব্বির ভাই, আমি কি আসবো?
আমতা আমতা করে সাব্বির ভাই বলেছিল,
-না, আপনাকে আসতে হবে না। আমিই পারবো।

সাব্বিরের সাথে কথা শেষ হওয়ার পর সীমার শরীরের খোঁজ নেয়ার জন্য জয়া ফোন করেছিল। জয়ার ফোন পেয়ে সীমা অবাক হয়ে যায়, সেদিনই সীমার কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা জানতে পারে। সীমার মুখে সব শুনে জয়া খুব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল সেদিন। সীমা বলেছিল, বাইরে সাব্বির এমন ভদ্র, বিনয়ী হলেও ঘরে তার সাথে পুরোপুরি বিপরীত আচরণ করে।

সীমার লেখার হাত খুব ভালো, প্রচুর বন্ধু ওর। একটা করে কবিতা পোস্ট করে, আর মুহূর্তের মধ্যে ‘লাইক’ পড়তে থাকে। জয়াও ‘লাইক’ দেয়, মন্তব্য করে, তবে ছদ্মনামে। জয়া খুব বুদ্ধিমতী, আসল নাম ব্যবহার করে না। কে জানে, কে কখন কি বলে বসে! হয়তো জয়ার স্বামীর কাছে নানাজনে কান ভাঙানি কথা বলবে। চোখের সামনেই তো সীমা ভাবীর করুণ হাল দেখতে পাচ্ছে।

সাব্বির ভাইয়ের কান ভারী করার মতো লোক এই মেলবোর্ন শহরে প্রচুর আছে। তাদের মধ্যে থেকেই কেউ না কেউ সীমা ভাবীর নামে উলটা-পালটা কথা লাগিয়েছে, আর সাব্বির ভাইও বেকুবের মতো স্ত্রীর ফেসবুক একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। জয়া ভাবে, সাব্বির ভাই তো কচি খোকা নয়, অন্যের কথা শুনে নিজের স্ত্রীর উপর এমন হম্বিতম্বি করার কোনো মানে হয় না।

অনেক সময় নিয়ে জয়া মেঝেতে পড়ে থাকা ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলো তুললো। পরিষ্কার ন্যাকরা পানিতে ভিজিয়ে অনেক যত্ন করে কাগজের গায়ে লেগে যাওয়া তেল হলুদের ঝোল মুছে লেখাগুলোকে স্পষ্ট করতে চাইলো। জয়ার মনটা যেমন কাঁচের মতো স্বচ্ছ, কাজও খুব পরিষ্কার। জয়ার মা কবিতা লিখতেন, পত্রিকায় ছাপাও হতো। ওর বাবা অনেক সহযোগিতা করতেন স্ত্রীকে কবিতা লেখার ব্যাপারে। ও জানে, কবিদের চেতনার স্তর থাকে অন্য তারে বাঁধা। সাধারণের মতো ওরা ভাবতে পারে না, একটু উঁচুতারে বাঁধা থাকে তাঁদের অনুভূতিগুলো। ইস! কী বিশ্রি অবস্থা হয়েছে স্ক্রিপ্টগুলোর। এগুলো জোড়া দেয়া ভীষণ কষ্টকর হয়ে যাবে। কাগজগুলো পরিষ্কার করে কিচেন কেবিনেটের উপর ছড়িয়ে দিল শুকানোর জন্য।

দূর থেকে নির্লিপ্তভাবে সীমা সব দেখছিল। ওর মনটা ভারী হয়ে আছে। জয়া বৌদিকে দুপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুই বলা হয়নি। বলতে ইচ্ছেও করছে না। কী করে বলবে যে, ওর স্বামী বিয়ের পনেরো বছর পরেও কলেজের বন্ধুকে জড়িয়ে এমন নোংরামি করতে পারে! শুভংকর তো ওর কলেজের বন্ধু ছাড়া আর কেউ না। কলেজে পড়ার সময় ওরা দুজনেই কবিতা লিখতো, সেই কবিতা লিখার সূত্র ধরেই ওদের পরিচয় আর বন্ধুত্ব। সীমা তখন বেশ পরিচিতি পাচ্ছিল নবীন কবি হিসেবে। সেসব দিনগুলো আজ ইতিহাস হয়ে গেছে, বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছিলো সেই সময়, সোনালি সময়ের উপর ধুলো জমে গেছে।

শুভংকরের সাথে বন্ধুত্ব ওর ভাইয়েরাও ভালোভাবে নেয়নি। অথচ সীমার বাবা নিজের মেয়ের প্রতিভাতে যেমন মুগ্ধ ছিলেন, শুভংকরকেও অনেক পছন্দ করতেন। ওসমান সাহেব ছিলেন খুব উদারমনা মানুষ। মেয়ের প্রতিভায় উনি এতটাই উচ্ছ্বসিত ছিলেন যে, মেয়ের কবিতা পত্রিকায় ছাপা হওয়ার সাথে সাথে অফিসের সহকর্মীদের নিয়ে দেখাতেন আর বলতেন,

-আমার একটা মাত্র মেয়ে, দেখুন, এতো অল্প বয়সেই কী সুন্দর কবিতা লিখে! ইত্তেফাকের মতো প্রথম সারির পত্রিকায় ওর লেখা ছাপা হয়!
সাব্বিরের অনেক গুণ থাকলেও স্ত্রীর ব্যাপারে সে খুবই কনজারভেটিভ। বিয়ের পর মেয়েদের সংসারধর্ম পালন করা ছাড়া আর কিছু করার থাকতে পারে, এমনটা সাব্বির কখনওই বিশ্বাস করে না। তাই সীমার কবি প্রতিভা আর বিকশিত হতে পারেনি। ভাইয়েদের উপর একবুক অভিমান নিয়ে সীমাও আর কবিতা লিখার চেষ্টা করেনি। শুভংকরের সাথেও যোগাযোগ রাখেনি।
শ্বশুরবাড়ি এসে সাব্বিরের পরিবারের সকলের দেখভাল করেই সীমার দিন কাটছিল। এরপর তো স্বামীর সাথে অস্ট্রেলিয়াতেই চলে এলো। দুই ছেলে জন্মালো, ছেলেদের বুকে পেয়ে জীবনের অনেক অপূর্ণতা ভুলেও গেছিলো, ভুলেই গেছিলো যে এক সময় খুব ভালো কবিতা লিখতো ও।
দুই বছর আগেই সীমা দেশে বেড়াতে যায়। কাকতালীয়ভাবে সময়টা ছিল ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি, ঢাকায় চলছিল বইমেলা উৎসব। ভাইয়ের দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে সীমা একদিন বইমেলাতে গেছিলো। হঠাৎ করেই পেছন থেকে কেউ একজন ওর লম্বা বেনি ধরে এক টান দেয়, সীমা ‘আঃ’ বলে পেছনে তাকিয়ে একেবারে চমকে গিয়েছে। শুভংকর দাঁড়িয়ে ওর পেছনে।
-শুভংকর, তুমি!!
-যাক! তবুও আমাকে চিনতে পেরেছো! তা এতোকাল পরে পথ ভুল করে এখানে এসেছো নাকি?
-অনেকটা তাই। পথ হারিয়েছি সেই কবে! পনের-ষোলো বছর আগেই। তুমি কেমন আছো? সেদিন পত্রিকার পাতায় বইমেলা সংবাদে কবি শুভংকর বোসের খুব প্রশংসা ছেপেছে।
-হা হা হা! কি আর করা, কবি সীমা আখতার কবিতাকে বিদায় জানানোর পর থেকে কবি শুভংকর কবিতাকে ভালোবেসে গ্রহণ করেছে! কেমন আছো বলো? কবে এসেছো? কতদিন থাকবে বলো।
-আস্তে! আস্তে, একসাথে কতগুলো প্রশ্ন! আগের মতোই রয়ে গেছো, একই রকম ছটফটে, একই রকম হিংসুটে। এতো বছর পর দেখা, তবুও কেমন হুল ফুটানো কথা বলছো। আমি সামনের সপ্তাহে চলে যাচ্ছি। এ বছর তোমার দুখানা বই বের হয়েছে! খুব খুশি হয়েছি।
-আচ্ছা! কবিতাকে ছুটি দিয়েও দেখছি পুরোপুরি ছুটি দিতে পারোনি! কবিদের সংবাদ ঠিকই রাখো তাহলে! বাঃ খুব ভালো, আমার দুখানা বই বের হয়েছে, এটাও জেনে ফেলেছো, তা তুমি কি কবিতা লেখা ছেড়েই দিয়েছো?
-হ্যাঁ, মেয়েদের আবার কিসের কবিতা লেখা? আমি বুঝি সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছি, আর তুমি বলছো কবিতা লেখা ছেড়ে দিলাম কিনা! কবিতা লিখবে ছেলেরা, বউয়েরা ভাতের থালা থেকে ভাতের দলা কবির মুখে গুঁজে দেবে, আর আত্মভোলা কবি মুখে ভাতের দলা নিয়ে কবিতা লিখে যাবে!
-শোন, তোমরা শুধু শুধুই সংসারের দোষ দেখাও, স্বামীর দোষ ধরো। আসল কথা হচ্ছে যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। তুমি নিজেই নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে জানো না। যদি জানতে, তাহলে আজ এই বই মেলাতে তোমার দুই দুগুণে চারটি বই বের হতো।

আরও বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলার পর ওরা যার যার গন্তব্যে পা বাড়িয়েছিল। বাকি যে কটা দিন সীমা ঢাকা ছিল, শুভংকর প্রায় প্রতিদিন ওদের বাড়িতে গিয়েছে। সীমাকে অনেক বুঝিয়েছে যেনো ওর প্রতিভা নষ্ট না করে। বারবার বুঝানোর পর সীমা সিদ্ধান্তে এসেছিল যে সে আবার কবিতা লেখা শুরু করবে। শুভংকর কবিতাগুলো বই আকারে বের করার ব্যাপারে সাহায্য করবে।

সেভাবেই চলছিল সীমার কবিতা লেখার চর্চা। কবিতা লিখে আর ফেসবুকে পোস্ট করে। এভাবেই ওর অনেক পাঠক ভক্ত তৈরি হয়ে গেছে। ছয় মাস আগে থেকে শুভংকরের সাথে বই বের করা নিয়ে সীমার কথা হচ্ছিল। ঠিক হয়েছিল, পুরানো নতুন সবগুলো কবিতা একটি ফাইল করে শুভংকরের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে। প্রকাশকের সাথেও সব ঠিকঠাক করাই ছিল।

কিছুদিন আগে ফেসবুক নিয়ে সাব্বিরের সাথে সীমার গন্ডোগোল বাঁধে। সাব্বির কোনোভাবেই সীমাকে ফেসবুকে ঢুকতে দিবে না, আর সীমাও ফেসবুকে যাবেই। এই নিয়ে তোলপাড়ের এক পর্যায়ে সাব্বির সীমাকে বাধ্য করে ফেসবুক একাউন্ট ডিএক্টিভেট করে রাখতে। ফলে সীমার সাথে শুভংকরের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

মনটা খুব উচাটন হয়েছিল সীমার। এতদিনে সীমা বুঝে গেছে, সাব্বির মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ, আর খুবই ঈর্ষাপরায়ণ। সীমার আর কোথাও যাওয়ার নেই। বাবা নেই, ভাইদের কাছে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। স্বামী-শাশুড়ির মন যুগিয়ে চলা ছাড়া কলেজ পাশ সীমার বিকল্প কিছু করার ছিল না।

মতের অমিল হলেই সাব্বিরের হাতে চড়-চাপর খায়, প্রায়ই ডিভোর্সের হুমকি শুনতে হয়। এসব কথা তো কাউকেই বলা যায় না। জয়া বৌদি খুব বুদ্ধিমতী এবং মানুষ হিসেবে খুব ভালো, কারো নিন্দে-মন্দ করেন না। সীমাকে খুব ভালোবাসে এই বৌদি। এইজন্যই বৌদির কাছে সীমা সব কথা খুলে বলেছিল একদিন।

আজও নির্লিপ্তভাবে বসে সীমা দেখছিল, জয়া বৌদি ছেঁড়া কাগজগুলোকে জোড়া দিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষণ আগেও ভেবেছিল, এ বছর ওর কবিতার বই বের হবে না, এই জনমেও আর হবে না।

যদিও শুভংকর নিজের দাম্পত্য জীবনের গল্প সীমার কাছে করে না। তবে সীমা জানতে পেরেছে, শুভংকরের স্ত্রী খুব লক্ষ্মি একটা মেয়ে, স্বামী-স্ত্রীতে খুব ভাব ভালোবাসা। শুভংকর জানে, সীমার দাম্পত্য জীবনের অশান্তির কথা। এইজন্যই হয়তো শুভংকর নিজের সুখ-সাফল্যের গল্প করে যৌবনের এই বন্ধুটির মন খারাপ করে দিতে চায় না। আপ্রাণ চেষ্টা করছে কী করে সীমাকে আবার কবিতার পৃথিবীতে টেনে আনা যায়।

-ভাবী, আসেন তো, দেখেন সাজিয়েছি সবগুলো কাগজের টুকরোকে। দেখেন তো, এগুলো থেকে আপনার প্রয়োজনীয় অংশগুলো বের করতে পারবেন কিনা।
-বৌদি, আর জনমে কি আপনি আমার বোন ছিলেন?
-তা তো জানি না। তবে, আর জনমে কেন, এই জনমেই আপনার বোন হতে অসুবিধা কোথায়?
-বৌদি, আজকেই শুভংকরের কাছ থেকে রেজিস্ট্রি চিঠি এসেছে। চিঠি মানে, কারেকশান হওয়া কবিতার গুচ্ছ। সম্রাটের আব্বু অযথা সন্দেহ করে আমার অনুমতি না নিয়েই আমার নামে আসা খামের মুখ ছিঁড়ে সব কবিতার এই অবস্থা করেছে। বৌদি, কি বলবো, আজকেই আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল। কবিতাগুলো ছিল আমার প্রাণ, ও আমার প্রাণ ভোমরা গলা টিপে মেরে ফেলেছে বৌদি।
-বোন, কাঁদবেন না তো। একজন আপনার প্রাণ ভোমরার গলা টিপতে চেয়েছিল, ঈশ্বর আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার প্রাণ ভোমরার পাখা জোড়া দেয়ার জন্য। দেখুন তো, আর কতটুকু হলে আপনি আবার সব ঠিক করে ফেলতে পারবেন? আমাকে এখন বাড়ি ফিরতে হবে। আপনি এর মধ্যে জোড়া দেয়া পাতাগুলো দেখে রাখবেন। সন্ধ্যাবেলা আতিক ভাইয়ের বাড়িতে দেখা তো হচ্ছেই। আপনার বন্ধুর ফোন নাম্বারটা দিতে ভুলবেন না। আমি কথা বলবো তার সাথে। আমার বাড়ির ঠিকানা দেবো, আপনাকে লেখা তার সমস্ত মেইল আমার ঠিকানায় আসবে। আপনি আপনার বাড়ি থেকে আর কোনো রকম যোগাযোগ করতে চেষ্টা করবেন না বন্ধুর সাথে।
-বৌদি, সম্রাটের আব্বু যদি জানতে পারে, খুন করে ফেলবে আমাকে। থাক, দরকার নেই কবিতার বই। ভালোই তো ছিলাম, সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। শাশুড়ির যত্ন করছি, দুই ছেলেকে বড়ো করছি, স্বামীর সেবা করছি। এই তো একটা মেয়ের জীবন, আর কী চাই।
-ভাবী, আমার লক্ষ্মি ভাবী, আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। আমাদের খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে, নাহলে বই ছাপা হবে না। মান-অভিমান তো সারা জীবনই চলে, কিন্তু সুযোগ তো সব সময় আসবে না। ভয় নেই, সাব্বির ভাই কিছুই টের পাবে না। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি।
-ভাবী, একটা কথা বলি, আমার জন্ম কলকাতাতে হলেও আমার বাবা জন্মেছেন ঢাকার বিক্রমপুরে। আমার দাদু ছিলেন স্বদেশি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার দাদু, বাবা দুজনেই আগরতলা গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ত্রান তহবিলে টাকা-পয়সা দিয়ে আসতেন। কেনো করতেন, বলেন তো! বাংলামায়ের টান, নাড়ির টান বলে কথা। ভৌগোলিক সীমা দিয়ে দেশ ভাগ করা যায়, কিন্তু মাতৃভাষা যে কঠিন জিনিস, ভাষার টান কে তো আলাদা করা যাবে না। আপনার সাথে আমার ভাষার সম্পর্ক, নাড়ির টানে জড়িয়ে আছি আমরা। এখানে হিন্দু, মুসলমান বলে কিছু নেই, ঘটি-বাঙ্গাল বলে কিছু নেই ভাবী। যারা ওভাবে ভাবে তারা ভাবুক, আপনি কবি, আমি কবিতাপ্রেমী। দুজনেরই দায়বদ্ধতা আছে উত্তম সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে। একটুও মন খারাপ করে না লক্ষ্মি বোন।

জয়া চলে যাওয়ার পর সীমা অনেকক্ষণ কাঁদলো। দুপুরে সাব্বিরের কাছে অপমানিত হয়ে ও বাথরুমের দরজা বন্ধ করেছিল। তখন মনে হয়েছিল, এই জীবন আর রাখবে না। আব্বুকে মনে মনে ডাকছিল আর বলছিল, ওকেও তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আব্বু নিশ্চয়ই বেহেশতে বসে মেয়ের এই দুর্দশা দেখে অস্থির হয়েছেন। আব্বুই জয়া বৌদিকে পাঠিয়েছেন। আরেকটু হলেই তো রাগের মাথায় ঘর পরিষ্কার করার উছিলায় সমস্ত কবিতার এঁটো পাতা জড়ো করে সীমা ডাস্টবিনে ফেলে দিতো। জয়া বৌদি এসে ওর প্রাণ ভোমরার পাখা জুড়ে দিয়ে গেলো। ইস! পৃথিবীতে আল্লাহ কাউকেই একেবারে মেরে ফেলেন না, এক হাতে মারেন, আরেক হাতে বুকে টেনে নেন।

একটু পরেই হয়তো সাব্বির এসে পড়বে, ঘরের মেঝে ভালো করে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেললো সীমা। মনটা ফুরফুরে লাগছে! একদিনে অনেক কিছু ঘটে গেলো। সবচেয়ে বড়ো পাওয়া হলো, জয়া বৌদি। আজকেই সীমা বুঝে গেলো, জয়া বৌদি ওর অনেক কাছের মানুষ। নিজেকে আর একাকী মনে হচ্ছে না। জোড়া দেয়া সমস্ত কাগজগুলো ভালো করে দেখে নিলো সীমা। খুব একটা কষ্ট হবে না কবিতার কারেকশানগুলো পাঠোদ্ধার করতে। আগামী কয়েকদিন ঘরের কম্পিউটার ব্যবহার করা যাবে না। অসুবিধা নেই, অনেক আগেই সম্রাটকে দিয়ে সবগুলো কবিতা জাম্প ড্রাইভে ট্রান্সফার করিয়েছিল। আজই সন্ধ্যায় আতিক ভাইয়ের বাড়িতে বসে জয়া বৌদির সাথে কথা বলে সব ঠিক করে রাখবে। কাল উনার বাড়িতে গিয়ে কবিতাগুলো ফাইনাল কারেকশান করেই শুভংকরকে মেইল করে দিবে।

আহ! সীমার সারা দেহে ক্লান্তি নেমে এলো। গত তিন চার ঘন্টার একটানা অশান্তির পর নিজের অজান্তেই ক্লান্ত দেহটিকে ছেঁড়া কবিতার জোড়া দেয়া পাতার উপর বিছিয়ে দিলো।

+ posts

Read Previous

দ্যা স্কেচ আর্টিস্ট

Read Next

বন্ধু আমার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *