অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রীতা রায় -
চোখের আলোয় দেখেছিলেম

আজ অরুণা কলিংবেল একবার টিপতেই শরীফা খালা দরজা খুলে দিল। অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে অরুণা বলল, কী ব্যাপার খালা, অন্যদিন বেল টিপতে টিপতে আঙুল ব্যথা হয়ে যায় আর আজ একবার বেল টিপতেই দরজা খুলে দিলেন! আপনি কি আমার পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন! নাকি আমার গায়ের গন্ধ পেয়েছেন!

-ওমা, তুমি জানো না যে, আমি মাইনষের পায়ের আওয়াজ শুনতেও পাই, পায়ের আওয়াজ গুনতেও জানি। আইজ তোমার পায়ের আওয়াজ গুনতে গুনতে যেই দরজার ধারে পৌঁছাইছি, অমনি তুমি বেল টিপছো।

-ইস রে, পায়ের আওয়াজ গুনতে জানেন! তাহলে অন্যদিন বেল টিপে আমাকে একঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কেন?

-বুড়া হইছি তো, মাঝে মাঝে গণনায় ভুল করি।

-উফ! কথা একদম রেডি থাকে।

-এই চাপার জোরেই তো এহনও সংসারে টিকে আছি।

লিভিং রুমের পর্দা সরিয়ে শরীফা বেগম অরুণাকে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলেন। ফুল ছাপা বিছানার চাদর দিয়ে ঢাকা দেয়া বড় একটা সোফা, অরুণা বসার আগেই শরীফা বেগম চাদরটা তুলে ভাঁজ করে রাখলেন। তারপর হাতের তালু দিয়ে সোফার ঢাকাটা আরেকটু টান টান করে দিলেন। এবার অরুণাকে নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন।
নতুন সোফা, সোফাটা তিনি নিজের টাকায় কিনেছেন। নিজের টাকায় কেনা সোফায় নিজে বসতেও ভালো লাগে, কাউকে বসাতে পারলেও খুব ভালো লাগে। অবশ্য শরীফা বেগমের কাছে অরুণা ছাড়া আর কেউ আসেও না। অরুণাকে তিনি খুব পছন্দ করেন, অরুণাকে একটু আদর যত্ন করতে পারলে শরীফা বেগমের বুকে অন্যরকম শান্তি লাগে।

যদিও এই বাড়িটাকে অরুণা শরীফা খালার বাড়ি বলেই ভাবে, তবে অরুণা জানে এই বাড়ির মালিক শরীফা বেগমের মেয়ে জিনিয়া আর ওর বর কেনেডি। শরীফা বেগম মেয়ের বাড়িতে থাকেন। তবে মেয়ের বাড়িতে থাকলেও মেয়ের সংসারটাকেই নিজের সংসার মনে করেন। মেয়ে, মেয়েজামাই দুজনই চাকরি করে, শরীফা বেগম ওদের সংসার আগলে রাখে।

শরীফা বেগম আমেরিকা এসেছেন অনেক বছর হয়ে গেলো। আমেরিকায় উনার মেয়ে ছাড়াও বড় ছেলে বাবরও থাকে। বড় ছেলেই স্পনসর করে নিয়ে এসেছিল বৃদ্ধ বাবা-মাকে। আমেরিকা এসে বাবরের বাড়িতেই ছিলেন, খুব যে আদরে আপ্যায়নে থেকেছেন তাও নয়।
ছেলে কাজকর্ম নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকতো, ছেলের বউ বাড়ির কর্ত্রী হয়ে শাশুড়ি শ্বশুরের মাথায় ছড়ি ঘোরাতো। বউ এদিকের কুটো, ওদিকে নাড়াতো না, স্বামী কাজে বেরিয়ে গেলেই শাশুড়িকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করাতো আর সারাক্ষণ ক্যাচ ক্যাচ করতো।
স্বামী ঘরে ফিরলে দেশী নিয়মে বউ শাশুড়ি-শ্বশুরের নামে নালিশ করতো। শ্বশুর আবার বাড়ির সামনের রাস্তায় পানের পিক ফেলেছে, শাশুড়ি প্রতিদিন বাথরুম ভিজিয়ে রাখে, আজ আরেকটু হলেই বউ পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলো। শাশুড়ি ভেজা শাড়ি-ব্লাউজ ঘরে শুকায়, ঘরে ভেজা গন্ধ থাকে। এই জন্যই ওদের বাবুটার ঠান্ডা-সর্দি ছাড়ে না।। আরও অনেক কিসিমের অভিযোগ।
ব্যস, শুরু হতো ছেলের বকাবকি। এই দেশটা আমেরিকা, এইটা বাংলাদেশ না। এখানে দেশী স্টাইলে চলা যাবে না। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও বউ খুব ছোটোলোকি করতো। শরীফা বেগম গামলা ভরে ভাত খায়, রুটি খেতে গেলে দুই রুটিতে কেন পেট ভরে না!
শরীফা বেগম নিত্য দুঃখের কথা মাঝে মাঝে ফোনে মেয়ের কাছে বলতেন। মেয়ে তো কম যায় না, পালটা ফোন করে বড় ভাইকে শাসাতো, ভাবীকে শাসাতো। হুমকি দিতো, পুলিশে কল দিয়ে জানাবে যে ছেলে, ছেলের বউ বুড়া বাবা-মাকে অত্যাচার করছে!
একদিন বাবর বলেছে, বাবা-মায়ের জন্য এত দরদ থাকলে জিনিয়া যেন বাবা-মাকে ওর কাছে নিয়ে রাখে। মা-বাবার খরচ বাবদ সে মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাবে।

বাবরের কথা শুনে জিনিয়া একটু ভয় পায়। বাবা-মাকে সত্যি সত্যি যদি ওদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় ওরা। দুজন বুড়োকে কীভাবে ও সামলাবে। ওর বর আমেরিকান। এই দেশে বাবা-মা কখনও ছেলে-মেয়ের সাথে থাকে না। যাদের নিজের বাড়ি আছে, তারা থুত্থুরে বুড়ো হয়ে গেলেও নিজের বাড়িতেই থাকে। ক্রিসমাসে অবশ্য ছেলে-মেয়েরা আসে বাবা-মায়ের কাছে, কিন্তু ছুটি কাটিয়ে যে যার ডেরায় ফিরে যায়। জিনিয়ার বাবা-মা তো আমেরিকান নয়, এই দেশে তাঁদের নিজস্ব ঘর-বাড়িও নেই। ওদের থাকতে হলে হয় ছেলের কাছে থাকতে হবে, নইলে মেয়ের কাছে। ছেলের কাছে তো ছিলোই, কেন যে জিনিয়া আগ বাড়িয়ে বড় ভাইয়াকে শাসাতে গেলো!

কেনেডি আমেরিকান, কেনেডির মা-বাবা আলাদা বাড়িতে থাকে। এসবই ঠিক, তারপরও কেনেডি তার ভিনদেশী শ্বশুর-শাশুড়ির অসহায় অবস্থার কথা অনুভব করতে পারতো। জিনিয়াকে কিছুই বলতে হয়নি, কেনেডি নিজে থেকেই একদিন জিনিয়াকে ডেকে বলেছে, বাবা-মাকে আমাদের কাছে বেড়াতে নিয়ে আসো। উনারা ছেলের বাড়িতে তো আছেনই, মেয়ের বাড়িতেও কিছুদিন থাকুন।

কেনেডির কথা শুনে সেদিন কৃতজ্ঞতায় জিনিয়ার চোখে জল চলে এসেছিলো। একদিন কেনেডি আর জিনিয়া বাবরের বাড়িতে গিয়ে সারাদিন কাটিয়ে ফেরার সময় বুড়ো বাবা-মাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। সেই যে শরীফা বেগম আর উনার স্বামী আমেরিকান জামাইয়ের বাড়িতে এলেন, সেই থেকে এখানেই থেকে গেলেন। দুই বছর আগে শরীফা বেগমের স্বামী এই বাড়িতেই মারা যান।

মেয়েজামাই আমেরিকান সাহেব হয়েও বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজেদের কাছে নিয়ে এসেছে। দেশে থাকতে তিনি জানতেন, আমেরিকায় বাপ-মা বুড়া হইলে ওল্ড হোমে পাঠিয়ে দেয়, ছেলে-মেয়েরা কেউ বাপ-মায়ের খোঁজখবর করে না। তখন তিনি নিজেও আমেরিকানদের গালি দিয়ে চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেছেন। আজ যখন নিজের চার ছেলে-মেয়ে থাকার পরেও আমেরিকান জামাই উনাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে, তখন কোন মুখে তিনি আমেরিকানদের বদনাম করবেন।

বসার ঘরের নতুন সোফাটার দিকে তাকিয়ে তিনি খুব তৃপ্তিবোধ করেন। বিদেশ বিভুঁইয়ে নিজের টাকায় কেনা, থুক্কু নিজের ডলারে কেনা সোফা। তিনি চাকরি করেন না, সোশ্যাল সিকিউরিটি বাবদ সরকার থেকে টাকা পান। এই সোশ্যাল সিকিউরিটির টাকার ব্যবস্থাও জামাই করে দিয়েছে। উনার স্বামী বেঁচে থাকতেই সোশ্যাল সিকিউরিটির টাকা পেতেন। কেনেডি বলেছিলো, এটা শ্বশুর-শাশুড়ির নিজের উপার্জনের পয়সা, এই পয়সার মালিক উনারা দুই বুড়োবুড়ি।
শরীফা বেগমের আত্মসম্মানবোধ খুব প্রবল। দেশে নিজের সংসার ছিলো, কারো উপর নির্ভরশীল ছিলেন না। সবসময় হাত উপুড় করে দিয়েছেন, হাত পেতে কিছু নেন নাই। এটা মেয়ের বাড়ি হলেই কি, নিজের সংসার তো নয়। এই বাড়ির সবকিছুই মেয়ে-মেয়েজামাইয়ের।

জামাই বাবাজি যতই বলুক সোশ্যাল সিকিউরিটির পুরো টাকার মালিক উনি, মাসে মাসে টাকা যখন হাতে আসেই, মেয়ের বাড়িতে একেবারে বিনে পয়সায় থাকবেন কেন!
জামাইয়ের হাতে তো আর সংসার খরচ বাবদ টাকা দিতে পারেন না, সোশ্যাল সিকিউরিটি বাবদ পাওয়া টাকা থেকে কিছু তুলে মেয়ের হাতে দেন সংসার খরচের জন্য। বাকিটা জমিয়ে রাখেন। জামাই অবশ্য কিছুই জানতে পারে না, তবে সংসারের আসল মানুষটির মুখ বন্ধ থাকে এটাই শরীফা বেগমের শান্তি।

শরীফা বেগমের খুব ইচ্ছে করে জামাই বাবাজির জন্য কিছু করতে। কিন্তু কী করবেন, কীভাবে বাবাজিকে খুশি করবেন, সেটাই ভেবে কূল পান না। বাবাজির কোনো কিছুর অভাবও নেই, কোনো চাহিদাও নেই। তবে মাঝে মাঝে শরীফার হাতের ফিরনি, পোলাও খেয়ে ‘গ্রেট গ্রেট’ ইয়াম্মি ইয়াম্মি আর ডেলিশাস বলে। তাতে শরীফা বেগমের আশা মেটে না, জামাই বাবাজির জন্য আরও বেশি কিছু করতে মন চায়।

জিনিয়া কিন্তু খুব হিসাবি, মা যে ওর বাড়িতে আছে, অন্য ভাই-বোনেরা কেউ মায়ের দায়িত্ব নেয়নি, তা নিয়ে ভাই-বোনদের খুব কথা শোনায়। বাবর বলেছিলো মায়ের খরচ বাবদ মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাবে, কিন্তু পাঠায়নি। জিনিয়া বড় ভাইকে ছেড়ে কথা কয় না, মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দেয় মায়ের খরচ বাবদ টাকা পাঠানোর কথা। একবারও বলে না, শরীফা বেগম যে প্রতি মাসে সোশ্যাল সিকিউরিটির পয়সা থেকে থোক কিছু টাকা জিনিয়ার হাতে দেয়। ছেলে-মেয়েদের আচার ব্যবহারে এমন ক্ষুদ্রতা দেখে উনার মন খারাপ হয়, সংসারে উনার কোনো অবদান নেই বলেই তাকে নিয়ে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এই রশি টানাটানি!

এই যে লিভিংরুমের নতুন সোফা সেটটা শরীফা বেগম নিজের জমানো টাকা থেকেই কিনেছেন। কার জন্য কিনেছেন! সোফাটা তো জিনিয়ার লিভিংরুমে থাকবে বলেই কিনেছেন। কেনেডি কত খুশি হয়েছে সোফা দেখে। “ও মাই মা, ইউ আর গ্রেট” বলে শরীফা বেগমকে জড়িয়ে ধরেছে। কই, জিনিয়া তো উনার নিজের পেটের সন্তান, মাকে তো ধন্যবাদটুকুও বললো না!

দুই

শরীফা খালার বাড়ির খুব কাছেই অরুণাদের বাড়ি। খালার সাথে পরিচয় হওয়ার পর অরুণা প্রায়ই আসে এই বাড়িতে। শরীফা খালার সাথে অদ্ভুতভাবে পরিচয় হয় অরুণার। ওদের বাড়ির কাছেই একটা গ্রোসারি শপ আছে। পায়ে হেঁটেও যাওয়া যায়, গাড়িতেও যাওয়া যায়। হাঁটাপথে পনেরো মিনিট লাগে যেতে। অরুণা সেদিন গাড়ি নিয়েই গেছিলো। বাজার সদাই করে দোকান থেকে বেরোনোর সময় অরুণা খেয়াল করলো, ভারতীয় চেহারার এক বৃদ্ধা নারী শপের বাইরে বিছানো এক বেঞ্চে বসে একা একা কথা বলছে। গাড়িতে উঠতে গিয়েও অরুণা দাঁড়ালো, দেশী চেহারার বৃদ্ধাকে দেখে পাগল মনে হচ্ছে না, ভিখিরিও মনে হচ্ছে না। অথচ বৃদ্ধা একা একা হাত নেড়ে কথা বলে যাচ্ছেন। অরুণা একটু কাছে গেলো, স্পষ্ট কানে এলো বুড়ি বাংলায় কথা বলছে। “ও মাইও গো, এত্ত বড় বোয়াল আমি কাটমু ক্যামনে? জিনিয়ার বাপের কি আর বুদ্ধি হইতো না। আমি একলা হাতেনি পারি এতদিক সামলাইতে!”

অরুণা বৃদ্ধার পাশে গিয়ে বসলো। বৃদ্ধার পিঠে হাত রেখে ডাকলো, মা! বৃদ্ধার কোনো হেলদোল নেই। সে আপনমনে কথা বলে চলেছে। এমন সময় দোকানের এক কর্মচারী আপেলের ট্রলি নিয়ে দোকানের ভেতর যাচ্ছিল। অরুণাকে দেখে বললো, উনি কে হন আপনার?
অরুণা বললো, আমি তো উনাকে চিনি না। আজই দেখলাম প্রথম। উনার বাড়ির ঠিকানা যদি কেউ আমাকে বলে দেয়, আমি পৌঁছে দিতে পারি।
সেই কর্মচারীটিই বললো, উনার বাড়ি কাছেই। নাম-ঠিকানা লেখা কাগজ উনার হাতব্যাগে থাকে। মাথার ঠিক নেই, প্রায়ই একা একা বাড়ি থেকে বের হয়। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার বাড়ি ফিরে যান। মাঝে মাঝে দিশা হারিয়ে ফেলে, তখন নিজে নিজে আর বাড়ি ফিরতে পারে না। অবশ্য বুদ্ধি আছে, পথ হারিয়ে ফেললে এই দোকানে এসে বেঞ্চিতে বসে থাকে। উনার মেয়ে এসে নিয়ে যায়।
সেদিন কর্মচারীটির কথামতো অরুণা বৃদ্ধার কাছে বাড়ির ঠিকানা লেখা কাগজটা চাইলো। বৃদ্ধা হাতের ব্যাগটাই অরুণার কোলে ছুড়ে দিলেন। কর্মচারীকে সামনে রেখেই অরুণা বৃদ্ধার ব্যাগ খুললো, উপরের দিকেই ঠিকানা লেখা কাগজটা। বৃদ্ধাকে হাতে ধরে অরুণা নিজের গাড়িতে তুললো, এরপর বৃদ্ধার বাড়ি পৌঁছে দিলো।

এগুলো দুই বছর আগের কথা। শরীফা বেগমের স্বামীর মৃত্যুর পর শরীফা বেগম খুব একা হয়ে পড়েছিলেন। জিনিয়া আর কেনেডি কাজে চলে যাওয়ার পর এত বড় বাড়িতে শরীফা বেগম একলা থাকতেন। স্বামীর শোকে অথবা জীবনের শেষ বাঁকে পৌঁছে এত প্রতিকূলতা দেখে ভয়ে দুর্ভাবনায় হয়তো ডিপ্রেশনে চলে গেছিলেন। ডিপ্রেশন থেকে মাথায় গোলমাল।

অরুণা যেদিন শরীফা বেগমকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলো, জিনিয়া কাজ থেকে না ফেরা পর্যন্ত অরুণা ওই বাড়িতেই শরীফা বেগমের পাশে বসেছিলো। জিনিয়া সেদিন বোধহয় একটু তাড়াতাড়িই ফিরেছিল বাড়িতে। অরুণার সাথে পরিচয় হলো, দুজনেই জানতে পারলো, ওরা খুব কাছাকাছি দূরত্বে থাকে। জিনিয়া বলল, মাকে ডাক্তার দেখাবে। মাকে সারিয়ে তুলতে হবে।
অরুণার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে শরীফা বেগমের মাথার গোলমালটাও অনেক কমে গেছে।

তিন

অরুণার বাড়িতে মাত্র দু’জন সদস্যের বাস। অরুণা আর অরুণার স্বামী মনোময়। একমাত্র ছেলে রাতুল অন্য স্টেটে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। মনোময় পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, অনেক ভালো বেতনের চাকরি করে, তাই অরুণার টাকা-পয়সার অভাব নেই। এসবই শরীফা বেগম কথার ছলে জেনে নিয়েছে।

মা মরা মেয়ে অরুণা, শরীফা বেগমকে খালা ডাকে। প্রায়ই অরুণা খালার বাড়ি চলে আসে, খালার সাথে গল্পগুজব করে। ভালো কিছু রান্না করলে বাটিতে করে খালার জন্য নিয়ে আসে। আজ অবশ্য খালি হাতেই এসেছে।

শরীফা বেগমের নিজের পয়সায় কেনা নতুন সোফায় বসতে বসতে অরুণা বলল, খালা, কাল বাড়িতে ফোন করে আমাকে না পেয়ে মেসেজ রেখেছিলেন। সরি খালা, কাল ডাক্তারের কাছে গেছিলাম, তাই বাড়ি ফিরেই মেসেজ চেক করতে পারিনি গো, এই জন্যই কাল আসতে পারিনি।

-সরি কওনের কিছু নাই। তোমারে ফোন কইরা যখন পাই নাই, বুঝছি কোনো কাজে ব্যস্ত। তাই মেসেজ রাখছিলাম। ডাক্তারের কাছে গেছিলা ক্যান? কার অসুখ, তোমার নাকি বাবাজির?

-কারো অসুখ না। মেমোগ্রাম আর প্যাপসমিয়ার টেস্টের ডেট ছিল। কাল সারাদিনই ক্লিনিকে কেটেছে খালা। বাড়ি ফিরে এত টায়ার্ড ছিলাম যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সন্ধ্যার সময় ঘুম ভাঙছে। তখন ফোনে আপনার মিস কল দেখি। হাসতে হাসতে অরুণা বলল, খালা আপনি কী সুন্দর করে মেসেজ রেখেছেন, “মাইও, একবার আমগো বাসায় আইতে পারবা?”।

-তুমি তো অনেক দুষ্টু, আমার গলা নকল করতাছো। আমি তো তুমাগো মতন শুদ্ধ ভাষা কইতে পারি না। কথা কইতে গেলে মাটির ভাষা আইয়া পড়ে।

-খালা, আপনার মাটির ভাষা শুনতে আমার এত্ত ভালো লাগে! আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। আমার মা-ও শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারতো না।

-কাইল কী কইছে ডাক্তার? সবকিছু ভালো আছে?

-ডাক্তার রিপোর্ট চেক করে দেখবে, সমস্যা পেলে ক্লিনিক থেকে আমাকে ফোন করে জানাবে।

-মাগো মা, এইসব শুনলে ডর করে। আমগো জিনিয়াও তো এইসব পরীক্ষা করতে যায়। আমারেও কয় যাইতে। আমি ওর কথায় গাও করি না, কী শরমের কথা কও তো। আমি বুইড়া মাগী, কবে কুনকালে পোলাপান বুকের দুধ খাইছে, সন তারিখ ভুইল্লা গেছি। অহন আমার বুক পরীক্ষা কইরা কি পাইব?

-খালা, মেয়েদের জোয়ান-বুড়া কোনো বিষয় না। আমার এক ফুপু মারা গেছে ব্রেস্ট ক্যানসারে। উনার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।

-এমুন দুই একটা ঘটনা সবখানেই ঘটে। তাই বইলা আমি পঁচাত্তর বচ্ছইরা বুড়ি, আমার বুকের দুধে আছেডা কি শুনি? চামড়া কুচকাইয়া বুনি দলা অইয়া গেছে।

খালার এমন খোলামেলা কথা শুনে অরুণার অস্বস্তি হচ্ছিল। তবুও বলল, “খালা, কিছু সমস্যা না থাকুক। একবার না হয় পরীক্ষা করিয়ে ফেলুন। জিনিয়া আপাও মনে শান্তি পাবে।

-না গো মাইও, এক পাও কব্বরে দিয়া রাখছি, এহন আর এইতা কইরা কি অইব? আমার ডর করে। বুকের মাই ধইরা টানাটানি করব, ব্যথা পামু ত।।

-খালা, আপনার ব্রেস্ট ধরে কিছুই করবে না নার্স। একটা মেশিনের সামনে আপনাকে দাঁড় করিয়ে নার্স আপনার ব্রেস্ট এক্সরে ট্রের উপর রেখে অন্য একটা মেশিন দিয়ে হালকা চাপ দিয়ে পরীক্ষা করবে, ব্যথা পাবেন না।

-না গো, শরম করে।

-খালা, নার্স তো মেয়ে। এদেশে ওরা ব্রেস্ট টেস্ট নিয়ে লজ্জা-শরম করে না। আমি নিয়ে যাব আপনাকে, পাশে দাঁড়িয়ে আপনার হাত ধরে থাকবো।

-এইডা তো গেলো বুক, আরেকটা কিয়ের কথা কইলা।

-প্যাপসমিয়ার টেস্ট। এটা না হয় পরে করা যাবে।

-এইডাও কি বুকের পরীক্ষা?

মায়ের বয়সী এই বৃদ্ধার সাথে মেয়েলি সমস্যা নিয়ে কথা বলা কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে মেমোগ্রাম করতেই যিনি শরমে মরে যাচ্ছেন, প্যাপসমিয়ার টেস্ট করার পদ্ধতি শুনলে না জানি বৃদ্ধা হার্ট ফেইল করে।
অরুণাও জানতো না যে বুড়িদেরও ব্রেস্ট ক্যানসার, ইউটেরাস ক্যানসার হয়। ক্লিনিকে মেমোগ্রাম করতে গিয়ে প্রতিবছর এক-দু’জন বুড়ি্র দেখা পায়, যাদের ব্রেস্ট ক্যানসার হয়েছে।

অরুণা বললো, “খালা, প্যাপসমিয়ার টেস্ট বুকের পরীক্ষা নয়, জরায়ুর পরীক্ষা। এটা করলে জানা যায় মেয়েদের জরায়ু ঠিক আছে কিনা।”

-কী কও! নাউজুবিল্লাহ, জরায়ু, বুকের দুধ এগুলি মাইয়ালোকের শরমের জিনিস। নার্সেরা বেডি অইলেই কি আর আমি বুড়ি অইলেই কি, বুড়ি বইলা কি নার্স বেডির সামনে লেংটা হইয়া ঘুরমু?

-আহ হা রে খালা, কি সব বলেন, শুনে আমারই লজ্জা লাগছে।

-তুমিই কও, হাতে-পায়ে না অইয়া শরমের জিনিসে ক্যান ক্যানসার হইব? আসলে পরীক্ষা করার নামে সব টাকা খাওনের ধান্দা, বুঝলা? এইসব ইতং বিতং কথা কইয়া ডর দেখায় আমগোরে।
তাইলেই দৌড়াইয়া যামু হাসপাতালে, আর ডাক্তাররা আমাগো গলা কাইট্টা এত্ত বড় এক বিল পাঠাইব।

-অরুণা হেসে ফেললো। খালা, এদেশে এই সব টেস্ট ফ্রি। আপনার চিকিৎসাও তো ফ্রি।

-তুমি এত কথা শিখলা ক্যামনে?

-ইন্টারনেটের যুগ খালা, ইন্টারনেটে সব কিছু দেয়া আছে। গুগল মামুরে জিজ্ঞেস করলেই গুগল মামু এমনভাবে সব বুঝিয়ে বলে দেয় যে, আমি তো আমি, অন্ধ কানার কাছেও সবকিছু দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যায়।

তাছাড়া আমি তো ক্লিনিকে গিয়ে নার্সদের সাথে গল্প জুড়ে দেই। ওদের কাছ থেকেও অনেক গল্প শুনেছি। আমার কি মনে হয় জানেন খালা, মেয়েদের তো জরায়ুতে বাচ্চা হয়, দশ মাস থাকে বাচ্চা ওইখানে। বাচ্চাও তো একটা হয় না, কয়েকটা হয়। জরায়ুর উপর অনেক চাপ পড়ে তো, সেই থেকেই হয়তো ক্যানসার-ম্যানসার হয়ে যায়। আর ব্রেস্ট ক্যানসার? বারোমাস বাচ্চা বুকের দুধ খায়। বছর বছর বাচ্চা হলে, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে দুধের উপর ধকল কি কম যায়, বলেন? অবশ্য ডাক্তাররা বলেন, যারা বাচ্চাকে বুকের দুখ খাওয়ায় তাদের নাকি ক্যানসার হবার ভয় কম থাকে, যারা ব্রেস্টফিড করায় না তাদের ক্যানসার হওয়ার ভয় বেশি থাকে।

-তাইলে আমার বুক পরীক্ষার দরকার নাই। আমার চাইর পোলা মাইয়ারে বছর ভইরা বুকের দুধ খাওয়াইছি। আর তুমার জড়ায়ু পরীক্ষার দরকার নাই, তুমার তো মোটে একটা সন্তান। তোমার জরায়ুতেও অধিক সন্তানের চাপ পরে নাই।

তবে কইতে পারো আমার জরায়ু পরীক্ষা করণের দরকার আছে। এই জরায়ুর উপরে অনেক ধকল গেছে।

দশবার পেডে বাচ্চা আইছিল। তহনও বাজারে মায়া বড়ি আসে নাই, পেট থিকা এক বাচ্চা খালাস হইতে না হইতেই আরেকটা আইয়া পড়তো। চাইর সন্তান বাইচ্চা আছে, তিনডা ছডি ঘরেই মইরা গেছে। আরও তিনবার পোয়াতি হইছিলাম। তুমার খালুর তহন কান্দের উপরে সংসারের বিরাট বোঝা। ভাই বইন, মা-বাপ, লগে নিজের চাইর পোলা মাইয়া। শেষে আমিই দাই ডাইক্কা তিনবার বাচ্চা নষ্ট করছি!

-খালা, বাচ্চা নষ্ট করার পর আপনার মন খারাপ হয়নি?

-ইচ্ছা কইরা তো বাচ্চা নষ্ট করি নাই। তহন জন্মনিয়ন্ত্রণের জমানা আছিল না। সোয়ামি স্ত্রীর সম্পক্কটাই আছিল বিছনার মইদ্যে। সারাদিনে তো সোয়ামি ইস্তিরিতে দেখা অইতো না, তুমাগো মতো ‘হানি, সুইটি’ কইব কখন? সোয়ামি বাইরে খাটতো, ইস্তিরি বাড়ির ভিতরে। দুইজনে দেখা অইত রাইতের বেলা বিছনায় গিয়া, সারাদিনের ভালোবাসা পীড়িতি আইয়া ভর করতো রাইতের বিছনায়। কাজেই যা হওয়ার তাই হইত।

শরীফা বেগমের কথা শুনে অরুণার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। বৃদ্ধা এখন ঘোরের মধ্যে আছেন। চোখ দুটো ঘোলাটে দেখাচ্ছে, চোখের দুই কোণে জল চিক চিক করছে।

অরুণা বলল, খালা তাহলে আপনার জন্য একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফেলি?

-করো যা ভালো মনে লয়। আমেরিকায় না আসলে কি জানতে পারতাম, মাইয়ালোকের জীবনেরও এত মূল্য আছে?

-কেন খালা, মেয়েদের জীবনের মূল্য জানতে আমেরিকায় আসতে হবে কেন? আমাদের দেশে কি মেয়েদের জীবনের মূল্য নেই?

-নাহ! আমাগো দেশে মাইয়ালোকের জীবনের কোনো মূল্য নাই। পুরুষের কাছেও নাই, মাইয়ালোকের কাছেও নাই।

-খালা, আপনার কথা শুনলে মাঝে মাঝে আমার বোধ-বুদ্ধিতে কাঁপন ধরে।
-শোন গো মাইও, জীবনের একটা পর্যায়ে পৌঁছাইলে বেবাক মাইয়ালোকেই একলা অইয়া যায়। তহন তারা জীবনের হিসাব-নিকাশের খাতা লইয়া বসে। হিসাব মিলাইতে পারে না, তয় বুঝতে পারে, তাগো জীবনডার কোনোই দাম আছিল না বাজারে। জন্মের পরের থন মাইয়ারা জানে বাপ তার, ভাই তার, বিয়ার পরে সোয়ামি তার, পোলা-মাইয়া তার, আসলে কেউই তার না গো। মাইয়ালোক জোয়ান থিকা বুড়া হয়, বুড়া বয়সে কোমর ভাইঙ্গা গুঁজা অইয়া যায়, আমগো দ্যাশে কোন বেডি জানে কও যে, ‘কেলসিয়ামের’ অভাবে কোমর বেঁকা অয়?

-খালা, আপনি জানেন ক্যালসিয়ামের অভাবে যে মেয়েদের হাড়গোড় নরম হয়ে যায়, কোমর বাঁকা হয়ে যায়?

-হ, শিখছি গো মাইও, নিজের জেবন দিয়া শিখছি। আগে জানতাম না, আমেরিকায় আইসা জানছি। জিনিয়া কেলসিয়াম খায়, আমারেও খাইতে দিছে। আমি খাই না, এত্ত বড় টেবলেট গলা দিয়া নামতে চায় না। জিনিয়া ধমকায়, কয় কোমর বেঁকা হইয়া গেলে ওল্ড হোমে পাঠায়ে দিব।
অনেক বড় একটা শ্বাস ছাড়লেন শরীফা বেগম। আনমনে বললেন, এত কিছু জানতে লেখাপড়া শিখতে হয়। আমি লেখাপড়া করার সুযোগ পাইলাম কই? বুদ্ধি ভালো আছিল, চউখ কান খোলা ছিল বইলা চইলা গেছি। যেটুকু জ্ঞান সঞ্চয় করছি, চারিপাশ দেইখা। আমেরিকা আসার পর চউক্ষের উপর থিকা পর্দা সইরা গেছে। জীবনের আরেক দিক যে আছে তা জাইনা ফেলছি। দেশে থাকলে তো জীবনের কত কিছুই জানা হইতো না, অন্ধকারেই থাইকা যাইতাম। সত্য কিনা কও।
-সব সত্য বলেছেন। তবে আপনারও দোষ আছে। জিনিয়া আপা বলার পরেও ক্যালসিয়াম খাচ্ছেন না, মেমোগ্রাম করাতে যাচ্ছেন না, এটা কি ভালো?

-বয়সকালে কেউ খাতির করলো না, এখন মরার বয়সে পৌঁছাইছি, এখন আমার খাতির! বুঝো নাই, এত খাতির করতাছে তার নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা কইরা। ঘরে ফিরা তৈরি ভাত পায়, তৈরি চা-পরোটা খাইয়া অফিসে যায়, মায় যদি কোমর বেঁকা হইয়া পইরা যায়, তাইলে তো সব বন্ধ হইয়া যাইব! হি হি হি হি

-খালা, এত কঠিন সত্য বইলেন না, তাহলে সংসারে সুখ পাবেন না। জীবন আপনার, যতদিন বাঁচেন, নিজের জন্য হলেও সুস্থ থাকুন। বুড়ো বয়সে পৌঁছে এখন যখন বুঝতে পেরেছেন নিজের জীবনের মূল্য, নিজের চোখের আলোয় দেখতে পাচ্ছেন নিজেকে, তাহলে আর অন্ধকারে থাকবেন কেন? নিজেকে কষ্ট দিবেন কেন?

চার

খুব বিশ্রী ধরনের স্বপ্ন দেখে অরুণার ঘুম ভেঙেছে আজ। ও এমনিতেই ভীতু ধরনের, তার উপর দুস্বপ্ন দেখেছে। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়, কিন্তু স্বপ্নটা যখন দেখেছে তখন ভোর নাকি গভীর রাত ছিল অরুণা জানে না। দুঃস্বপ্নের কথা কাউকে বলে দিলে নাকি ফাঁড়া কেটে যায়। কার কাছে বলবে দুঃস্বপ্নের কথাটা। রাতুলের বাবার কাছে বলার প্রশ্নই উঠে না, তাহলে খালার কাছে? সব কথা কি সবার কাছে বলা যায়?

এখন ক’টা বাজে? জানালায় ভারী পর্দা ঝুলে থাকার কারণে বাইরে দিন বা রাত কিছু বুঝা যায় না। রাতুলের বাবা বিছানায় নেই! অরুণাকে কিছু না বলেই সে ভার্সিটিতে চলে গেলো! নাকি সে কাল রাতে বিছানায় আসেনি!

গত সন্ধ্যায় রাতুলের বাবার সাথে একটু ঝামেলা হয়েছিল ওর। খুব সাধারণ কথায় ওকে বিশ্রী কথা শুনিয়েছে মনোময়। মনোময়ের কাছে ধমক খেলে অরুণা শুধু চোখের জল ফেলে, মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। গত সন্ধ্যাতেও চোখের জল মুছতে মুছতে বিছানায় এসে শুয়েছিল, কখন ঘুমিয়ে গেছে টের পায়নি।

নাহ! মনোময় বাড়ির কোথাও নেই, রোজ দিনকার মতো আজও সকাল সাড়ে সাতটায় নিশ্চয়ই বেরিয়ে গেছে। মনোময় কি ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছে নাকি খালি মুখেই চলে গেছে!

কিচেনে এলো অরুণা, বাসন-কোসন চারদিকে ছড়ানো, রাতের খাবারের জন্য যে তরকারির বাটিগুলো ফ্রিজ থেকে বের করে রেখেছিল কাল, সব তেমনই পড়ে আছে। বেসিনে অবশ্য পরিষ্কার, কোনো থালা-বাটি জমে নেই। মনোময় আজকাল কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে চায় না। ঘরে গুচ্ছের প্লেট থাকার পরেও মনোময় ওয়ান টাইম প্লেট, ওয়ান টাইম বাটি, ওয়ান টাইম চামচ কিনে নিয়ে আসে। তার প্লেট গ্লাস অরুণা ধোবে, পরে রাতের বেলায় কোঁকাবে, “ইস, দেশে থাকলে কত ভালো হতো। একজন হেল্পিং হ্যান্ড থাকতো, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, মাছ মাংস কেটে দেয়ার কাজগুলো করে দিত। আমেরিকায় সব নিজেকে করতে হয়, সন্ধ্যে হতেই হাত-পা গিঁটে গিঁটে ব্যথা করে”—এসব শুনতে রাজি নয় সে।

হ্যাঁ, অরুণা আজকাল এই ধরনের কথা বলে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের নানা জায়গায় ব্যথা বেদনা বাড়ছে, তাই ব্যথার কথা বলে। সে তো কথার ছলে বলে, মনোময়ের প্লেট-বাটি-গ্লাস ধুয়ে ওর হাত-পা ব্যথা করে, এমন তো বলেনি।

অরুণা এখন এসব নিয়ে কিছুই বলে না। মনোময় ওয়ান টাইম প্লেটে খায়, অরুণা কর্নিং অয়ারের প্লেটে খায়। প্রথমদিকে শুধু একদিন বলেছে, “দেখো তো, ওয়ান টাইম প্লেট গ্লাসের মতো ওয়ান টাইম হাঁড়ি, কড়াই, ফ্রাইপ্যান, ক্রোকারিজ কিনতে পাওয়া যায় কিনা! তাহলে বাসন মাজার ঝামেলাই থাকবে না। ওয়ান টাইম হাঁড়ি কড়াইয়ে রান্না করব, রান্না শেষে তোমার প্লেট গ্লাসের মতো হাঁড়ি কড়াইও গার্বেজ করে দেব।

চিকেনের বাটি দেখলো অরুণা, একদিক থেকে কিছু ঝোল কম দেখা যাচ্ছে। যাক বাবা, মনোময় কাল রাতে খেয়েছে। আচ্ছা, ও যে একা একা খেলো, অরুণা যে খেলো না, সেটা খোঁজ নিলো না? ও কি পারতো মনোময়কে রেখে একা একা খেয়ে নিতে? একটু কথাকাটাকটি হয়েছে বলে একা খাওয়া-দাওয়া করলো, আলাদা বিছানায় ঘুমালো, সকাল হতেই অরুণাকে কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়লো! এমন কিছু ঝগড়াও হয়নি ওদের মধ্যে! যা বলার তাতো মনোময়ই বলেছে একতরফা, তাহলে?
ঘটনা তেমন কিছুই না, গতকাল সকালে শরীফা খালাকে নিয়ে অরুণার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। মনোময় তা জানতো। হসপিটালে রওনা দেয়ার আগে অরুণা খেয়াল করলো, ওর ব্যাগে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা নেই। সারা বাড়ি আতিপাতি করে খুঁজেও লাইসেন্স পাওয়া গেলো না। অগত্যা লাইসেন্স ছাড়াই ওর গাড়িতে খালাকে হসপিটালে নিয়ে গেছিলো। ঘরে ফিরে আরেকবার আতিপাতি করে খুঁজলো লাইসেন্সটা যদি কোথাও পড়ে গিয়ে থাকে, কিন্তু পাওয়া গেলো না।
সন্ধ্যায় মনোময়কে বলেছিল, “জানো, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটা পাওয়া যাচ্ছে না।
-হোয়াট! লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছে না মানে কি?
-কি হয়েছে শোন, আমি তো ড্রাইভিং লাইসেন্স, ক্রেডিট কার্ড, গাড়ির চাবি, খুচরো ডলার একটা পাউচে রাখি। খুচরো পয়সা জমে পাউচটা ভারী হয়ে যাচ্ছিল, তাই পাউচ থেকে সব বের করে বিছানায় রেখে বাথরুমে গেছি। ওমা, বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি সব আছে শুধু লাইসেন্স নেই। সারা বাড়ি খুঁজলাম, কোথাও নেই। পরে লাইসেন্স খোঁজা বাদ দিয়ে খালাকে নিয়ে হসপিটালে চলে গেছি।
-কি বললে? তুমি ড্রাইভারস লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালিয়েছো? কি সর্বনাশ। তুমি তো আমাকে পাগল না করে ছাড়বে না।
-তোমাকে পাগল করবো কেন?
-আলবত করবে। রাস্তায় যদি পুলিশ ধরতো, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে যে বিশাল অংকের জরিমানা হয়, ক্ষেত্রবিশেষে জেল হয়, জানো না? তার উপর বয়স্ক একজন মানুষকে সাথে নিয়েছো।

-আমি কি ইচ্ছে করে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালিয়েছি? আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস করলে আরেক অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে কত দেরি হতো!

-আমার কথা হচ্ছে, দরকারি জিনিস তুমি হারাবে কেন?
-আরে, এত অল্পতেই তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?
-রাগবো না মানে, তুমি সবসময় দরকারি জিনিস হারিয়ে ফেলো। আমার এখন এসব আর সহ্য হয় না।
-আচ্ছা, তুমি একটু ওদের অফিসে ফোন করে দেখবে, যদি আরেকটা নতুন লাইসেন্স করা যায়!
-তুমি ফোন করো।
-আমার ভয় লাগে ওদের সাথে কথা বলতে। তুমি একটু দাও না আমার এই উপকারটা করে।
-আমি পারবো না। আমার কাছে এসব অন্যায় আবদার করবে না। আর কত? সারাটা জীবন সবই আমাকে করে দিতে হবে? কেন, নিজে পারো না কিছু করতে?
-কি বলছো এসব? তোমাকে সব করতে হয়? বাজার সদাই, ব্যাংক, বিল দেয়া, পোস্টঅফিসে যাওয়া সব কাজ তো আমি করি। ঘরেও হালকা-ভারী সব কাজই তো আমি করি। তোমাকে কি কিছু করতে দেই? একটা ফোন করতে অনুরোধ করেছি, তাইতেই এত রেগে গেছো? তুমি ছাড়া আর কাকেই বলবো বলো?
-বেশ করেছি রেগেছি। কিচ্ছু করতে হবে না তোমাকে। আমার জন্য কিছুই করতে হবে না। আমার থালা-বাসন ধুতে হয় না, আমার জামা-প্যান্ট ধুতে হয় না, ভাত-তরকারিও রাঁধতে হবে না। ব্যাংক পোস্টঅফিসের কাজও করতে হবে না। তোমার ক্যাচ ক্যাচ, ভ্যাজ ভ্যাজ সহ্য হয় না। আজকাল অসহ্য লাগে তোমার কথাবার্তা। আমি অ্যালুফ থাকতে চাই, আমি এখন একা থাকতে চাই। না হলে আমি পাগল হয়ে যাব।
-কী বলছো এসব? আমার কথাবার্তা অসহ্য লাগে? আমি তোমার পাশে কয় মিনিট থাকি? তোমার সাথে কয়টা কথা বলি? তুমি তো অ্যালুফই থাকো। তুমি থাকো তোমার জগত নিয়ে, সেই জগতে আমি কোথায়?
-হ্যাঁ, আমি আমার জগত নিয়েই থাকতে চাই। বললাম যে, আমি একদম একা থাকতে চাই।
-এত বড় কথাটা আমায় বললে? ‘একদম একা’ থাকতে চাওয়ার মানে কি হয়? একদম একা থাকতে পারবে যদি আমার মৃত্যু হয়। মৃত্যু তো আমার হাতে নেই, তাই না? একমাত্র আত্মহত্যা করা ছাড়া মরতেও পারবো না। তোমাকে একদম একা থাকার সুযোগ কীভাবে দেয়া যায় বলো! বোবা হয়ে থাকবো, সে উপায়ও নেই। কাশি দিলেও তুমি শুনে ফেলবে, হাঁচি দিলেও শুনবে। মরতে ভয় লাগে আমার, আত্মহত্যা করতেও ভয় লাগবে। না হলে তোমাকে ‘একদম একা’ থাকতে দেয়ার জন্য আত্মহত্যা করতাম। কী করবে বলো, আমার মৃত্যু পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে!
কাল সন্ধ্যার কথাগুলো মনে পড়ে খুব কষ্ট হচ্ছে অরুণার। টেবিলে সাজানো খাবারগুলো যেমনটা তেমনই আছে। একটা রাতই তো, একটা মাত্র রাত বরের উপর রাগ করে অরুণা একটু আগেই বিছানায় শুয়ে পড়েছিল, বেখেয়ালে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তাই কিচেনে আসতে পারেনি। তাই বলে মনোময় খাবারের বাটিগুলো তুলে রাখবে না? কাল যে এত একা থাকার জন্য চেঁচালো, এখন যদি আমি মরে যাই, মনোময় রান্না-খাওয়া করবে না? একা হয়ে বাতাস খাবে? বাইরে থেকেও যদি খাবার কিনে নিয়ে আসে, সেই খাবার গরম করতে হবে না? খাবারের খালি প্যাকেটগুলোও তো ফেলতে হবে! একা থাকার শখ বেরিয়ে যাবে!

পাঁচ
অরুণা বলল, “খালা জানেন, এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। যখন বয়স কম ছিল, তখন আপনজনের যে আচরণে কষ্ট পাইনি, এখন আপনজনের কাছ থেকে সেই একই ব্যবহার পেলে মনে কষ্ট পাই। মাঝে মাঝে খুব অপমান লাগে”।
শরীফা বেগম চোখ সরু করে অরুণার মুখের দিকে তাকালেন। পাশে রাখা প্লাস্টিকের কাপের ঢাকা সরিয়ে পুচ করে পানের পিক ফেলে কাপের মুখ ঢেকে কাপটা আগের জায়গায় রাখলেন। বাঁ হাতের তালুতে ঠোঁটের দুই পাশে লেগে থাকা পানের রস মুছলেন।
অরুণার চেনা দৃশ্য। যখনই এই বাড়িতে আসে, দুই-তিন ঘণ্টার আগে খালা ওকে ছাড়ে না। এই দুই-তিন ঘণ্টায় খালা এই কাপটার মধ্যে কত বার যে পানের পিক ফেলে! নিঃসঙ্গ এই বৃদ্ধার জন্য বুকের মধ্যে ও ভীষণ মমতাবোধ করে। খালার ছেলে-মেয়ে সবই আছে, তবুও খালা অসহায়। গত বছর পুজোর বাজার করতে গিয়ে খালার জন্য খুব সুন্দর একটা পিকদান কিনেছিল অরুণা। উপহার পেয়ে খালা কী যে খুশি হয়েছিল! অরুণাকে বুকে জড়িয়ে অনেক আদর করেছিল। পিকদানটা খালা ব্যবহার করে না, মেয়ের ভয়ে লুকিয়ে রেখেছে। মেয়ে দেখে ফেললে খুব রাগ করবে, মাকে হ্যাংলা বলবে।
শরীফা বেগম অরুণার পিঠে হাত রেখে নরম স্বরে বললেন, “মাইও গো, জামাই বাবাজি কিছু কইছে?”
অরুণা তাকিয়ে আছে দেয়ালে টাঙানো পেইন্টিংটার দিকে! চোখ না সরিয়েই বলল, “না খালা, কেউ কিছু বলেনি। এমনিই মনে হলো, তাই বললাম”।
শরীফা বেগম বললেন, “মাইও গো, তোমার বয়স আমারও আছিল একদিন। আমার কাছে কিছু লুকাইতে পারবা না। মাথাডা আউলা ঝাউলা কি এমতে এমতেই অইছে? তয় কথা কি জানো, তোমার মতো মাইয়া গো সারা জীবন সইয়া যাইতে হয়। হইতা আমার মাইয়া গো মতো, জামাই বাবাজি পত্থম দিন থিকাই মেনি বিড়াল হইয়া থাকত।
শরীফা বেগমের কথা শুনে অরুণা হেসে ফেললো।
“খালা, আপনি তো আমার সাথে গাড়িতে চড়ে এদিক সেদিক বেড়িয়েছেন। আপনার কি কখনও মনে হয়েছে যে আমি গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করার মতো গাড়ি চালাই? আমার গাড়িতে চড়লে কি আপনার ভয় লাগে? আমাকে কি খুব ফালতু ড্রাইভার মনে হয়?

-কী যে কও তুমি! মাইয়ালোকে গাড়ি চালাইতে পারে হেইডাই তো জানতাম না। আমেরিকা আইসা দেহি বেবাক মাইয়া গাড়ি চালায়। আমগো জিনিয়াতো হের সাহেব জামাইর ট্রাক চালায়।
-খালা, এই ধরেন, কোনো একদিন ভুল করে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা বাড়িতে ফেলে এসেছি, গাড়ি চালাচ্ছি, পুলিশে ধরলে কি আপনার মনে হয়, আমাকে জেলে ঢুকাবে?
-কি যে কও, এমুন সোনার পিত্তিমার মতো চেহারা দেখলে পুলিশের বুক কাঁইপা উঠবো। পুলিশ তোমার হাতে কড়া পরাইবো কি, ভুল কইরা হে নিজের হাতে কড়া পরাইবো। হি হি হি। বুঝলা কি কইছি?
-ধ্যাঁৎ খালা, সবসময় খালি ঠাট্টা করেন। আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার কথা বলেন।
-অরু মা, কি হইছে? জামাই কি কিছু কইছে? তুমি যে আমারে লইয়া এহানে সেহানে ঘুরো বেড়াও, বাবাজি কি রাগ করছে?

-না গো খালা, আপনাকে আমি একটু সঙ্গ দেই, তাতে সে খুশিই হয়। আপনি বয়স্ক মানুষ, আপনাকে একটু সঙ্গ দেই, এর বেশি কিছু তো করি না। গতকাল আমি আপনাকে হসপিটালে নিয়ে গেলাম, আমার সাথে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। লাইসেন্সটা বিছানার উপর রেখে বাথরুমে গেছিলাম, এসে দেখি নেই। লাইসেন্স ছাড়া আপনাকে নিয়ে গাড়ি চালিয়েছি, ও খুব রাগ করেছে।
-বিছানা থিকা লাইসেন্স হারায় ফেলছো, এমন আজগুবি কথা শুইনা বাবাজি রাগ করবো না কি তুমারে কোলে লইয়া নাচব?
-খালা, জীবনের অনেকটা সময় আপনার জামাই বাবাজি আমাকে সত্যি সত্যি কোলে নিয়েই নাচতো। তখন ভাবতাম আমার মতো এমন ভাগ্যবতী মেয়ে খুব কম আছে। বাপের বাড়ি গিয়ে বৌদিদের কাছে স্বামীর প্রশংসা করতাম। বান্ধবীদের স্বামীরা বদমেজাজি, ওরা যদি ওদের দুঃখের কথা বলতো, আমি খুব গর্বের সাথে নিজের স্বামীর প্রশংসা করতাম। এখন মনে হয়, খুব বোকামি করতাম। বান্ধবীরা যেখানে স্বামীর অত্যাচারে দিশেহারা, আমার তখন উচিত হয়নি নিজের স্বামীর প্রশংসা করা। বান্ধবীরা নিশ্চয়ই মনে মনে হিংসে করেছে, আক্ষেপ করেছে, অভিশাপ দিয়েছে।
বলে অরুণা কাঁদতে শুরু করলো। অরুণাকে এর আগে কখনও এভাবে কাঁদতে দেখেননি শরীফা বেগম।
একটু পরেই অরুণা চোখের জল মুছে সহজ হয়ে বসলো, “সরি খালা, মনটা ভালো লাগছে না।

-কি হইছে আমারে খুইল্লা কও তো ।
এরপর অরুণা গত সন্ধ্যার ঘটনা থেকে শুরু করে ভোর রাতে দুঃস্বপ্ন দেখা, কিচেনে গিয়ে সব এলোমেলো দেখার কথা খুলে বলল।
শরীফা বেগম বড় করে শ্বাস ফেললেন! বললেন, “শোন গো মাইও, একখান হাচা কথা কই। সোয়ামি আর ইস্তিরির সম্পক্কে প্রেম মহব্বত বইলা কিছু থাহে না। সোয়ামি আর ইস্তিরির সম্পক্কটা হইতাছে অভ্যাসের মতো। এই যেমুন ধরো গিয়া, ডাইল আর ভাতের কথাই যদি ধরি। বাঙ্গালি গো সামনে যতই পোলাও-কোর্মা সাজাইয়া দাও, পিজা-বার্গার দেও, পত্থম পত্থম চাকুম চুকুম কইরা খাইব।
দুইদিন পরেই ডাইল ভাত খাওনের লাগি বাঙ্গালির পরান আই ডাই করব। সোয়ামি আর ইস্তিরির ব্যাপারটাও তেমুনই। সোয়ামি বেডায় যতই বাইরে ঘরে সুন্দরী মাইয়ার লগে রাসলীলা করুক না ক্যান, জ্বর আইলে, ঠ্যাং ব্যথা করলে, মাথার চুল টাননের দরকার হইলে তখন আর সখী দিয়া কাম হয় না, বিছনায় পইরা ইস্তিরির খোঁজই করে।
-খালা, আপনি আমার কথা বোঝেননি। আমার স্বামী বাইরে কোনো সুন্দরীর পিছে ঘোরে না, ঘরের সুন্দরীর প্রতিও মোহ নেই। সে এখন একদম একা থাকতে চায়। গত রাতে সে একা একা ভাত খেলো, আমাকে একটাবার ডাক দিলো না। খালা, কষ্টে অপমানে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। দুটো ভাত বড় নয়, যার ভরসায় নিজের আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে এই ভিনদেশে একদম একা জীবন কাটাচ্ছি, সেই কিনা আমাকে বলছে, সে আমার কাছ থেকে আলগা থাকতে চায়! আমায় ফেলে সে দিব্যি খেয়ে ফেললো! এত বছর মায়ার সংসার তৈরি করেছিলাম খালা, মায়ার জাল আজ ছিঁড়ে গেছে!
-আমি তো সেই কথাই কইছি। এত বড় কথাডা কইলো জামাই বাবাজি তোমারে, হের পরেও তো রাইতের বেলা তোমার রান্দা ভাতই খাইছে। সোয়ামিরা এমুনই। বউ তাগো কাছে পুরান লাগে, বউ থিকা সইরা সইরা থাকতে মন চায়।
কিন্তু খাওনের সময় বউর রান্দা ভাত খাইব, বউর হাতে পাতা বিছনায় ঘুমাইবো। অন্যে বিছনা পাতলে চলতো না। বউ ছাড়া আর কেউ বুঝতো না সাহেবের ঘাড়ের তলে কুন বালিশ লাগব, সাহেবের বিছনার চাদ্দর টান টান থাকতে হইব, কোলবালিশ ডাইনদিকে থাকতে হইব। এগুলি জানে ইস্তিরি। এইডাই হইল সোয়ামিগো খাসলত। মানতে পারলে তুমি সুখি, মানতে না পারলে তুমি দুঃখি। বুঝলা?
-খালা, আমি এতকাল রাতুলের বাবার জন্য যা কিছু করেছি, ভালো বেসেই করেছি। এই যে রাতুলের বাবা কাগজের প্লেটে বাটিতে খায়, মনে মনে খুব অপমান লাগে তবুও তার প্রতি ভালোবাসা কমে না। তাই বলে একদম একা থাকতে চাইবে?
-মন খারাপ কইরো না, ইস্তিরি সারা জীবনভর সোয়ামির সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য জীবনপাত করে বইলাই সোয়ামিগো এত দাপট। মাঝে মইদ্দে ইস্তিরির লাইগা ছুনু পাউডার কিনা লইয়া আহে, মন চাইলে ইস্তিরিরে লইয়া বছরে এক দুইডা সিনেমা দেখে, বোকা মাইয়ালোক ভাবে, সোয়ামি তারে খুব ভালোবাসা দেখাইছে। ভালোবাইসা এগুলি করে না, অভ্যাস থিকা করে। আর ইস্তিরিও যে খুব ভালোবাইসা সোয়ামির ঠ্যাং টিপা দেয়, হেইডাও না।
সোয়ামি তিনবেলা ভাত দেয়, পিন্দনের কাপড় দেয়, হেইর বিনিময়ে ইস্তিরি সোয়ামিরে এই সার্ভিসটুক দেয়। হা হা হা হা! গত রাইতে সোয়ামি একলা থাকতে চাইছে, আইজ রাইতেই দেখবা তোমার আঁচল দিয়া মুখ ঢাইকা শুইব।
-না খালা, রাতুলের বাবার গতরাতের কথাগুলো আমার বুকের ভেতরে শেলের মতো বিঁধেছে। এই কথাগুলো সে বলার সুযোগ খুঁজছিল, বলতে পারছিল না। গতকাল বলে দিল।
-জামাই বাবাজিরে আমার খুব ভালা লাগে, ঠান্ডা সুস্থির মানুষ, কত বড় চাকরি করে। মাঝে মাঝে সবতেরই ইট্টু আট্টু ঊনিশ-বিশ হয়।
-খালা, আমিও তাকে তেমনই জেনেছি। সে শান্ত ভদ্র মায়াবী একজন মানুষ। মাঝে মাঝে রাগ সকলেরই হতে পারে, সেটা বড় কথা নয়। সেও আমার সাথে মাঝে মাঝে রাগ করতো। সমস্যা হচ্ছে, যেসব কারণে সে রেগে উঠে, কারণগুলো মোটেও রেগে ওঠার মত নয়। অনেকবার এমন হয়েছে, তার মনমতো কথা না হলেই সে খুব রেগে যায়, রেগে গেলে মুখে যা আসে তাই বলে দেয়।
আগে আমি তাকে খুব ভয় পেতাম তাই তার রাগের সময় চুপ করে থাকতাম। কিন্তু মনে মনে বোঝার চেষ্টা করতাম, কেন সে রাগ করলো! ইদানীং বুঝতে পারছি সে কেন রাগ করে। আসলে সে নিজেকে সুপিরিয়র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। যদি তার মনে হয় কোনো বিষয়ে আমি তার থেকে একটু বেশি বুঝে ফেলেছি অথবা বেশি জানি, সে তখনই রেগে ওঠে।
আমিও যে কিছু বিষয়ে তার চেয়ে বেশি জানতে পারি বা বুঝতে পারি, এটাই সে মানতে পারে না। কথা হচ্ছে, আমি তো তাকে এমনিতেই সুপিরিয়র ভাবি, সুপিরিয়রের মর্যাদা দেই। তবুও তার মনে একটা কমপ্লেক্স কাজ করে, সে ভাবে, আমি বুঝি তাকে যতখানি সুপিরিয়র ভাবার ততখানি ভাবি না।
-কী কও এই সব?
-হ্যাঁ খালা, অনেক বছর আগের এক ঘটনা বলি। কাউকে বলিনি, আপনাকেই আজ বলছি। আমি একটা স্কুলে চাকরির দরখাস্ত পাঠাবো। আমার সার্টিফিকেটগুলো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। রাতুলের বাবাকে বললাম, “শুনছো, আমার সার্টিফিকেটগুলো পাচ্ছি না। তুমি কি জানো, ওগুলো কোথায়?”
-আমি কি করে জানবো তোমার সার্টিফিকেট কোথায়?
-তুমি তো সব কাগজপত্র গুছিয়ে রাখো।
-আমি আমার কাগজপত্র গুছিয়েই রাখি, আমি তো তোমার মতো অগোছালো নই।
-আমিও অগোছালো নই, আমি যেখানে দরকারি জিনিস রাখি, সেখানে সার্টিফিকেটগুলো নেই। আমার যতদূর মনে পড়ছে, সেবার কানাডা যাওয়ার ব্যাপারে কথা হচ্ছিল, আমার সার্টিফিকেটের ফটোকপি করার জন্য তুমি চেয়ে নিয়েছিলে, আর আমাকে ফিরিয়ে দাওনি। তুমি কি একটু দেখবে তোমার ড্রয়ার, যদি সেখানে থাকে।
জানেন খালা, এই কথা বলার সাথে সাথে সে চোখ মুখ লাল করে আমার দিকে তেড়ে এসে বলল, “এক চড় দিয়ে তোমার এই গালের দাঁত ওই গালে নিয়ে যাব। ভাবো কি নিজেকে? মুখে যা খুশি এলো, বলে দিলেই হলো?”
সে আমাকে চড় দিবে বলছে, আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি, ভেবেছি দুষ্টামি করছে। কিন্তু সে তেমন রেগেই বলছে, তোমার সার্টিফিকেট দিয়ে আমার কাজ কি? ফাজলামি করো আমার সাথে?
আমি শুধু অবাক হয়ে বললাম, তুমি আমাকে চড় দিবে বললে, যাহ! এটা হতে পারে? তুমি কি ঠাট্টা করে বলেছো?
সে আর কিছু না বলে অন্য রুমে চলে গেছিলো। সেই দৃশ্যটা আজও আমার মনে আছে। জানেন খালা, আমার সার্টিফিকেটগুলো পরে তার ড্রয়ারেই পাওয়া গেছিলো। সে আমাকে সরিও বলেনি, যদি সরি বলতো তাহলে সেদিনের এই অপমানটা বুকে পুষে রাখতাম না।
এমন আরও অনেক ঘটনা আছে, কত দিন বলেছে, “তোমাকে মুক্তি দিয়ে দিতে চাই। তোমার সাথে আমার বনবে না। তুমি তোমার মত থাকো, আমি আমার মতো”।
এগুলো শুনেছি, একা কেঁদেছি, আবার রাতের বেলা স্বামীর কোমল হাত শরীর স্পর্শ করতেই সব অভিমান ভুলে গেছি।
-মাইও গো, কি কইতাম! আমি তো আমেরিকায় না আইলে জানতেই পারতাম না আমারও আলাদা একটা জীবন আছে, সেই জীবনের আলাদা সুখ আছে, আলাদা দুঃখ আছে! দেশে মাইয়ারা সংসারে টিকে থাকে কেমনে জানো? আল্লাহ মাইয়াগো রে দুই চোখ দেন ঠিকই, দৃষ্টিশক্তি দেন না বইলা মাইয়ারা বোবা কালা আন্ধা ধেন্দা হইয়া নিগ্রহের সংসারে টিকা থাকে। আমেরিকায় অইলে কত সংসার ভাইঙ্গা যাইত!
-খালা, সংসার ভেঙে যাওয়া কি ভালো?
-চোখ বন্ধ কইরা সোয়ামির কুকীর্তি, সোয়ামির অত্যাচার সহ্য করার চাইতে সংসার ভাইঙ্গা যাওয়া ভালো। তোমার খালুর লগে যদি আমেরিকায় সংসার শুরু করতাম, হেই সংসার ভাঙ্গতোই ভাঙ্গতো।
-কি যে বলেন খালা।
-অরুণা, সাতাইশ বছর আগের ঘটনা। তোমার খালু হজ্জ্বে যাইতে চায়। আমগো ধর্মে আছে, সংসারের সকল দায় দায়িত্ব ভালোভাবে সম্পন্ন করার পর তুমি হজ করতে যাইবা। হজ করতে যাওয়ার সময় কোনো পিছুটান, কোনো ঋণ রাইখা যাইতে পারবা না। স্বামী ইস্তিরি একসাথে যাইতে পারলে ভালো। কিন্তু আমাদের তখন এত পয়সাও নাই, আমারও ধর্মে কর্মে তেমুন মনোযোগ আছিল না। আমি সদা সত্য কথা কই, সৎ পথে চলি, মানুষের ক্ষতি করি না, এইটাই আমার ধর্ম। কিন্তু তোমার খালুর খুব হজ করার শখ, তারেই হজ করতে পাঠাইলাম।
-হজ কইরা ফিরলো তোমার খালু এক মাস পরে। তার মুখ দেখেই আমি খুশি। সেইদিন বিকালে সে আমারে কয়, “বাবুরের মা, তুমি গেলা না। কত দেশ থিকা যে মানুষ আসছে, সবাইর সাথে বউ আছে। তাগো দিকে দেখি আর মন খালি তোমারে পাইতে চায়। খুব কষ্ট পাইছি।
-কী কন এই সব? পবিত্র কাবা শরিফের কাছে গিয়াও আপনার চউখ ছিল বেডিগো দিকে, মন চাইছিল আমারে পাইতে?
-তোমার খালু হজে যাওয়ার আগেই কিন্তু আমাগো বিছানা আলাদা কইরা ফেলছিলাম। কারণ আমাদের মধ্যে আর কুন ভালোবাসা ছিল না, কিন্তু তার মিলনের খুব খায়েশ ছিল। ভালোবাসা ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিলন ঘটলে সেই মিলন খুবই কষ্টের হয়। তুমি এখনও ছোট, তুমি বুঝবা না। আরও বয়স হইলে বুঝবা। আমারও খুব কষ্ট হইতো, অপমানও লাগতো। ভালোবাসার কথা ছাড়া, আদর সোহাগের কথা ছাড়া সেক্স করে পশুপাখি, কারণ তারা বোবা। মানুষ করবে কেন?
এই জন্যই হজে যাওয়ার আগে থেকেই তারে মানসিকভাবে আল্লাহর সেবায় নিয়োজিত করার চিন্তা কইরা বিছানা আলাদ করছিলাম। সেই মানুষ হজ থিকা ফিরা এই কি শুনাইলো। ওইখানেই যদি শেষ হইত ঘটনা, তাইলে কিছু মনে করতাম না। কিন্তু রাইতের বেলা সে নিজের বিছানা ছাইড়া আমার বিছানায় আইছে এবং আমার উপরে হামলে পড়ছে। তারে আটকাইতে পারি নাই। নিজের শরীরটারে মনে হইছিল একটা মাংসের দলা আর তারে মনে হইছিল ক্ষুধার্ত নেকড়ে। চউখ দিয়া ঝরঝর কইরা পানি পড়তেছিল।
সব শেষে তোমার খালুরে কইলাম, “এই শেষ। আর কোনোদিন আমার বিছানায় আসবা না।” সে আমার দিকে হা কইরা তাকাইয়া ছিল, সত্যই আর আমার কাছে আসে নাই।
-শরীফা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে অরুণার ভয় করতে লাগলো। দুই চোখ লাল টকটকে, শ্বাস নিচ্ছেন অনেক দ্রুত। অরুণা বলল, “ও খালা, আপনি শান্ত হোন। খালা, আমি আপনার জন্য জল নিয়ে আসছি। একটু জল খান। খালা, আমি তো আপনার মন খারাপ করিয়ে দিলাম।
-দূর পাগল, সেসব কথা কি মনে ধরে রাখছিলাম? তখন তো আর দশটা মাইয়ার মতো আমিও ছিলাম সংসার প্রেমে অন্ধ। সংসার ভালোবাসছি বইলাই তো তোমার খালুর সাথে সংসার করে গেছি আরও ২৩ বছর। ভালোবাসায় কমতি ছিল না আমার, ভালোবাসছি তারে আগের মতোই, সেবাও করছি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। শুধু তার প্রতি আর শ্রদ্ধা ছিল না। তুমি মন খারাপ কইরো না, জামাই বাবাজি একা থাকতে চায়, তারে একা থাকতে দাও।
-খালা, তারে একা থাকতে দেয়া মানে আমার আরও বেশি একা হয়ে যাওয়া। সে ছাড়া আমার আপনার জন কে আছে বলেন? তাকেই যদি পাশে না পাই, প্রেমে ভালোবাসায় কাছে টানতে না পারি, এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে আমি বাঁচি কেমন করে?
-বাঁচবা, বাঁচবা। আমেরিকায় আছো, আমেরিকার মাইয়া গো মতো বাঁচো।
-খালা, আমেরিকায় কি আমার পাশের দরজার বিয়ে না করে বয়ফ্রেন্ডের সাথে হৈ-হুল্লোড় করা মেয়ের চোখে জল গড়ায় না কখনো!
-গড়াইবো না ক্যান, নিশ্চয়ই গড়ায়। তবে চক্ষের পানি ফালাইতে ফালাইতে আমেরিকায় কুন মাইয়াই সারাজীবন পার করে না। জীবনডারে আমি দেখছি বেশি গো মাইও। দুই গোলার্ধে থাইকাই জীবনডারে দেখছি। আর কিছু না হউক, আমেরিকায় নিজ জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়া যায়। আমেরিকার স্বাধীনতা জুয়ান বুড়া সবতের লাইগাই অনেক সুখের। সিরিয়া দেশের এক বুড়ির গল্প শোন। তখন আমি বাবরের বাড়িতে থাকতাম।
বাবরের বাড়ির এক বাড়ি পরেই থাকতো সিরিয়ার ওই বুড়ি। বুড়ি সবসময় দুই হাতে তিন চাইরটা ঘড়ি পইরা থাকতো। একদিন কাছে গিয়া আধা ভাঙা ইংরাজিতে জিজ্ঞেস করছিলাম, দুই হাতে এতগুলি ঘড়ি পরার কারণ কি? বুড়িও আধা ভাঙা ইংলিশেই কইলো, সে যখন দেশে ছিল মানে সিরিয়ায় ছিল, হাতঘড়ির খুব শখ ছিল বেচারার। কিন্তু এই সামান্য শখও পূরণ হয় নাই সে মাইয়ালোক বইল্লা। তাগোর দেশে বেডিরা হাতে ঘড়ি পরে না। হের লাগি আমেরিকায় আইসা বুড়ি দুই হাত ভইরা ঘড়ি পরতো।
তোমার বয়স কম, জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা পুরা হয় নাই। তুমি এহনও সোয়ামির আচরণে ওঠানামা হওয়ার কারণ বুঝে উঠতে পারো না। তবে তোমার কপাল ভালো, অল্প বয়সেই তুমি আমেরিকায় আইছো। আমেরিকার মাইয়াগো মতো বাঁচতে কইছি, মানে তোমারে নাইট কেলাবে গিয়া হুল্লুড় করতে কই নাই। আমেরিকান মাইয়াগো মতো ডাঁট লইয়া বাঁচো। সোয়ামিরে ভালোবাইসো, তবে তোমার ভালোবাসার অমর্যাদা হইতে দিবা না।
সোয়ামির রাগ পাত্তা দিবা না। খাইতে ডাকবা, ‘আমি পরে খাব’ কইলে তুমি তারে দুইবার সাধবা না। তুমি একা খেয়ে উঠবা। ছয় মাস পর দেখবা তোমার সোয়ামির চউক্ষের থিকা ‘দেশি’ পর্দা সইরা যাইব, সেও তখন জীবনটারে আমেরিকান আলোয় দেখতে পাইব। আমেরিকান সাহেব গো মতো সেও তখন তোমার সাথে সমানে সমান জীবন কাটানোর চেষ্টা করবো। নিজের চক্ষের আলোয় দেখা জীবনের অভিজ্ঞতা থিকা কথাগুলি কইলাম।

Read Previous

প্রতিদান

Read Next

কবিতা অন্ত প্রাণ অমিতাভ মীর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *