অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

রীতা রয় -
মেইড ইন জাপান

E:\Anupranan Antorjal 3nd Issue- To Shafik For editing- 3rd Oct 2022\Antorjal 3rd Issue_22.10.2022\11.Antorjal 3rd issue- Choto Golpo-13\rita.jpg

বাড়িতে আজ সকাল থেকেই সাজ সাজ রব চলছে। ভোরবেলাতেই রান্নাঘর থেকে দিদিভাইয়ের গলার আওয়াজ, সাথে থালা বাসনের টুংটাং, ঝনঝন আওয়াজ ভেসে আসছে। আমেরিকা আসা ইস্তক অবশ্য কখন ভোর, কখন সন্ধ্যে টের পাই না। জানালায় এত ভারী পর্দা ঝোলানো থাকে, ভোরের আলো অথবা গোধূলির আলো কোনোটিই ঘরে ঢুকতে পারে না। তাই দিদিভাইয়ের হাঁটাচলা, কাজকর্মের ধরন দেখে বুঝে নেই কখন ভোর আর কখন সন্ধ্যে।

রান্নাঘরকে ওরা সবাই কিচেন বলে, আমি এখনও আমেরিকান হয়ে উঠতে পারিনি, তাই কথা বলার সময় মুখ ফসকে রান্নাঘর বেরিয়ে যায়। তো যা বলছিলাম, আজ ভোর থেকেই রান্নাঘরে দিদিভাইয়ের হাঁটাচলা শুরু হয়েছে যখন, তখন নিশ্চয়ই আজ খুব ধুম ধারাক্কা রান্নাবান্না হবে। মনে হয় সন্ধ্যের সময় দিদিভাইয়ের বন্ধুরা আসবে, পার্টি হবে। আনন্দ উঠসবকে আমেরিকায় ওরা পার্টি বলে। রান্নাঘরকে কিচেন বলতে না পারলেও আমি এখন আনন্দ উৎসবকে পার্টি বলতে শিখেছি।

পার্টি তো হবে বুঝতে পারছি, কিন্তু বুঝতে পারছি না কী উপলক্ষ্যে আজ পার্টি।

দিদিভাইয়ের জন্মদিন নয় আজ, এটা আমি জানি। তবে কি জামাইবাবুর জন্মদিন না-কি দিদি জামাইবাবুর বিবাহবার্ষিকী?

তবে সে যে উৎসবই হোক, বাড়িতে অতিথি এলে আমার খুব ভালো লাগে। সারা বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। জম্পেশ খাওয়া দাওয়া তো আছেই, জমজমাট গান বাজনাও চলে। সকলে গান করে, পদ্য বলে, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি।

বাড়িতে অতিথি এলে দিদিভাইয়ের কাজকর্মের অন্ত থাকে না। একবার রান্নাঘরে যাচ্ছে, একবার ভাঁড়ার ঘরে যাচ্ছে, আরেকবার শোবার ঘরে গিয়ে বিছানা বালিশ গোছাচ্ছে। এর ফাঁকে ফাঁকেই ঘরদোর ঝাড়পোঁছও চলছে। দিদিভাইয়ের ছোটাছুটি দেখে আমার মায়া লাগে।

হাতে হাতে কাজগুলো একটু এগিয়ে দেয়ার জন্য আজ পর্যন্ত কোনো বিন্তির মা, খেদির মা’কে আসতে দেখলাম না। দেশে থাকতে দিদিভাইকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে খেতে দেখিনি। হাঁক দিলেই বিন্তির মা জলের গ্লাস নিয়ে হাজির হতো। আর এখানে দেখো, জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ, রাজার দুলালিকেই সামলাতে হচ্ছে।

কেন যে দেশের সবাই শুধু আমেরিকা আমেরিকা করে, আমেরিকায় কী যে সুখ আছে বুঝতে পারি না বাপু। সাধের আমেরিকায় তো দেখি দিদিভাইকে একা হাতে সব কাজ করতে হয়।

দিনে দিনে আমাদেরও তো বয়েস কম হলো না, তার উপর দিনরাত টেবিলের উপর হাত গুটিয়ে বসে থাকি, বসে থেকে থেকে গায়ে হাতে ব্যথা হয়। হাঁক ডাক তো করতে পারি না, তাই কাউকে বলতেও পারি না শরীর ব্যথার কথা। কাকে বলবো, এই দেশে সকলেই দৌড়ের উপর থাকে, সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। ঘড়িও মাঝে মাঝে দম নেয়, দম নেয় না শুধু আমেরিকার মানুষ। আমাদের কথা শুনবে কখন, আমাদের দিকে তাকানোর ফুরসত নেই কারো। অবশ্য ছুটির দিনে ঘর-দুয়ার গোছানোর সময় দিদিভাই আমাদের শরীরটাও একটু ঝাড়পোছ করে।

দিদি যখন আমাদের গা ঝাড়পোছ করে, ব্যথায় আরামও হয়, আমাদের ধবধবে সাদা মসৃণ ত্বকে লেগে থাকা হালকা ধুলা ময়লাটাও পরিষ্কার হয়ে যায়। আমেরিকায় থেকে এই এক সুখ, দরজা জানালা বন্ধ থাকে, বাইরের ধুলোবালি মশা মাছি কিছুই ঘরে ঢুকতে পারে না, তাই আমাদের ফর্সা ত্বকে খুব বেশি ময়লা জমে না। সাবান সোডা দিয়ে ঘষামাজা ছাড়াই আমাদেরকে ঝকঝকে পরিষ্কার দেখায়।

আমি আবার খুব শৌখিন, সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করি। নিজে নড়াচড়া করার ক্ষমতা থাকলে প্রতিদিন নিজেই নিজের ত্বকের যত্ন নিতাম।

তবে দিদিভাই খুশিমনেই আমাদের যত্নআত্তি করে। শুধু গা ঝাড়া মোছা করেই ক্ষান্ত হয় না, প্রায়ই আমাদের গায়ে হাত বুলায়, আলতো করে নেড়েচেড়ে দেখে! আমি ঠিক বুঝতে পারি, আমাদের গায়ে দিদিভাইয়ের মায়ের হাতের ছোঁয়া লেগে আছে তো, আমাদের স্পর্শ করে দিদিভাই নিজের মা’কে অনুভব করে।

আমাদের জীবনে অনেক ওঠা-পড়া থাকলেও ভাগ্যটা কিন্তু খুব ভালো। জীবনভর মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। দেশে থাকতে দিদিভাইয়ের মা খুব ভালোবাসতো, এখানে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে দিদিভাই খুব ভালোবাসে। অতিথি এলে তাদের কাছে আমাদের সম্পর্কে রাজ্যের গল্প করে। একই গল্প শুনতে শুনতে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। এত আগ্রহ নিয়ে দিদিভাই আমাদের সম্বন্ধে গল্প করে, টেবিলে বসেই দেখতে পাই দিদিভাইয়ের মুখ চোখ কী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

আপনারা অবশ্য দূর থেকে আমার আকুতি কতটুকুই বুঝবেন? দিদিভাইও ধারে কাছে নেই যে আমাদের নিয়ে তার যত গল্প আছে আপনাদের শোনাবে।

দিদিভাই এখন রান্নাঘরে ভীষণ ব্যস্ত। একা হাতেই কুটনো কাটছে, বাটনা বাটছে, পোলাও বিরিয়ানি মাছ মাংস রান্না করবে, দই রসগোল্লা চমচম বানাবে। সন্ধ্যার আগে দম ফেলার ফুরসত পাবে বলে মনে হয় না।

আমার তো কিছুই করার নেই। আমি যদি গল্প বলি, শুনবে? অতিথিরা আসার আগে আমিই বরং তোমাদেরকে আমাদের গল্প শোনাই।

সেই কখন থেকে নিজের কথা বলতে গিয়ে ‘আমরা -আমাদের’ করে চলেছি, অথচ কথা শুধু আমি একাই বলে চলেছি। আমি একাই কথা বলছি, তাহলে প্রতি কথায় ‘আমাদের’ ‘আমাদের’ করছি কেন! এমন প্রশ্ন জাগছে না তোমার মনে? তবে শোনো, আমাদের গল্পই বলছি শোনো।

দুই

অনেক কাল আগের কথা, অনেক কিছুই ভুলে গেছি, সময়ের হিসেব, দিন তারিখের হিসেবেও গড়মিল হয়! তারপরেও এখনও যেটুকু মনে আছে সেটাও কম নয়।

শুরুতে আমরা ছিলাম ছয় ভাই ছয় বোন। সংসারে বাবা মা বলতে আলাদা কেউ ছিল না, আমাদের বাবা মা কোথায় থাকতো, তাদের নাম ধাম কিছুই জানতাম না। বুঝ হওয়ার পর থেকেই দেখছি আমরা দিদিভাইয়ের মায়ের বাড়িতে আছি। দিদিভাইয়ের মায়ের মুখেই শুনেছি আমাদের জন্ম জাপানে। জন্মের কিছুদিন পর জাপান থেকে আমরা চলে আসি পূর্ব পাকিস্তানে।

দেখো কাণ্ড, এতো কথা বলে যাচ্ছি অথচ আমাদের নামই বলা হয়নি। আমাদের নামগুলো খুব মজার। বোনেদের জন্য একটাই নাম ‘পেয়ালা’, ভাইদের জন্যও একটাই নাম ‘পিরিচ’। ভাইবোনে মিলে আমরা হলাম পেয়ালা-পিরিচ।

জাপানে জন্ম তো, তাই জাপানিজদের মতোই আমাদের গায়ের রঙ ধবধবে সাদা আর গায়ের ত্বক জাপানিজ মেয়েদের মতো মসৃণ আর ফিনফিনে পাতলা।

পেয়ালা পিরিচের ধবধবে সাদা পাতলা ত্বকে একপাশে কাজল কালো রঙে আঁকা বাঁশঝাড়ের ছবি, মাথার চারপাশে রুপোর জল দিয়ে সরু দাগে ফিতে আঁকা। ঠিক যেনো জাপানিজ পুতুল!

ভাইবোন হলেও পেয়ালা পিরিচের আকৃতি কিন্তু ভিন্ন। আকৃতি দেখেই চেনা যায় কোনটি পেয়ালা, কোনটি পিরিচ। পেয়ালার পা নেই, পেট খোলা গোল দেহ, দেহের এক পাশে বাইরের দিকে একটি করে হাত বসানো আছে। আর পিরিচের হাত পা পেট কোনোটিই নেই। ভাই পিরিচ বুক চিতিয়ে বসে থাকে বোনের জন্য। বোন দৌড়ে এসে যেন ভাইয়ের খোলা বুকে সুন্দর করে বসতে পারে।

পেয়ালার মাথায় আঁকা রূপোলি সরু ফিতের মতো রূপোলি জলে আঁকা সরু ফিতে হাতেও আছে।

পেয়ালা পিরিচ বোধ হয় বাংলা নাম। জাপানে জন্ম হলেও যেহেতু জন্মের পরই পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছি, তাই আমাদের নামটাও বাংলাতেই রাখা হয়েছে। জাপানে থাকলে আমাদের কি নামে ডাকা হতো জানি না। পূর্ব পাকিস্তানে পেয়ালা পিরিচকে অনেকে কাপ প্লেটও বলতো।কাপ প্লেট নিশ্চয়ই বাংলা নাম নয়, বুঝেছি ইংলিশ নাম।

সেইজন্যই দিদিভাইয়ের মা আমাদের পেয়ালা পিরিচ ডাকতো, কিন্তু আমেরিকায় আমাদেরকে কাপ প্লেট ডাকা হয়। পেয়ালা হচ্ছে কাপ, পিরিচ হচ্ছে সসার বা প্লেট।

আমার কিন্তু পেয়ালা পিরিচ নামটাই বেশি ভালো লাগে। বিশেষ করে পেয়ালা, পেয়ালা নামটাই অনেক আদুরে, আমরাও ভীষণ আদুরে।

তিন

সালটা মনে নেই, ষাটের দশকের শেষ হয়তো। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা, ঢাকার নিউমার্কেটের আলো ঝলমলে এক দোকানের শোকেসে আমাদের রাখা হয়েছিল। কতোদিন শোকেসে ছিলাম তা বলতে পারবো না।

বাহান্ন তেপ্পান্ন বছর আগের কথা, তখনও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, এক আলো ঝলমলে সন্ধ্যায় দারুণ সুন্দরী এক নারী কাঁচের দরজা ঠেলে দোকানের ভেতরে ঢুকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখছিল। হঠাৎ করে সবকিছু ছেড়ে সুন্দরীর নজর আটকে যায় আমাদের দিকে। আমরাও তাকিয়ে ছিলাম নারীর মুগ্ধ দৃষ্টির দিকে।

দোকানে প্রতিদিন কতো মানুষ আসতো, এটা কিনতো ওটা কিনতো, আমাদের দিকে কেউ তাকাতোও না, কেউ কাছেও আসতো না। দূর থেকে দেখেই চলে যেতো। কাঁচের দরজা বন্ধ শোকেসে থাকতে থাকতে আমরাও হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। কীভাবে বন্ধ খাঁচা থেকে মুক্তি পাবো, সেই আশায় দিন গুনতাম।

সেদিন সুন্দরী নারীর মুগ্ধ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আমাদের মনে ক্ষীণ আশা জেগেছিল, হয়তো তিনি আমাদের এই বদ্ধ ঘরের বাইরে নিয়ে যাবেন। আমরা নিশ্চয়ই ঘরের বাইরেটা দেখতে পাবো। প্রভু আমাদের মনের চাওয়া পূরণ করেছেন। সুন্দরী নারী সেই সন্ধ্যাতেই শোকেসের ভেতর থেকে আমাদের তুলে দোকানের বাইরের জগতে নিয়ে আসে।(সেই সুন্দরী নারীটিই দিদিভাইয়ের মা এবং সেদিন থেকে আমাদেরও মা)।

আমরা ছয় জোড়া ভাইবোন দিদিভাইদের বাড়িতে আছি, আলমারির ভেতর বেশ যত্নেই ছিলাম। আলমারির ভেতর আরও অনেক পেয়ালা পিরিচ থাকলেও রূপে সৌন্দর্যে আমরা ছিলাম অনন্য। বাড়িতে গণমান্য অতিথি এলে মা আলমারি থেকে আমাদের বের করতেন এবং চা বিস্কুট দিয়ে আমাদের সাজিয়ে অতিথির সামনে নিয়ে আসতেন। অতিথি চলে যাওয়া মাত্র মা আমাদের শরীর ধুয়ে শুকনো কাপড়ে মুছে আবার আলমারিতে তুলে রাখতেন। সাধারণ অতিথি এলে অবশ্য আমাদের বের করতেন না, সাধারণ চেহারার পেয়ালা পিরিচে চা বিস্কুট দিতেন।

এভাবেই দিন কাটছিল। হঠাৎ একদিন শুনলাম পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দিদিভাইয়েরা এই যুদ্ধকেই বলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, তার মানে তখন সময়টা ছিলো ঊনিশশ একাত্তর।

মুক্তিযুদ্ধের সময় দিদিভাই এই এতোটুকুন, ঝাঁকড়া চুল লাল ফ্রক পরা পুতুলের মতো দেখতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই নাকি পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিটারিরা পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের উপর হামলে পড়ে। কামান বন্দুক দিয়ে পাখি মারার মতো করে মানুষ মারতো। তখন পাকবাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য দলে দলে মানুষ এখান থেকে সেখানে পালিয়ে যেতো। কেউ যেতো এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে, কখনো ঝোপে জঙ্গলে। প্রচুর মানুষ পালিয়ে ভারতে চলে যায়। দিদিভাইয়ের পরিবারও শহর থেকে পালিয়ে প্রথমে গ্রামে, এরপর গ্রাম থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যায়। বাড়ি থেকে পালানোর সময় মা আমাদের ছয় জোড়া ভাই বোনকেও পোঁটলায় ভরে সাথে করে নিয়ে যায়।

পাকিস্তানী মিলিটারির ভয়ে রাতের অন্ধকারে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পালিয়ে যাওয়ার সময় নদীর ঘাটে এক দুর্ঘটনা ঘটে। নৌকা থেকে নামার সময় মা নৌকা থেকে জলে পড়ে যায়। আমরা ছিলাম মায়ের কোলে, প্রচন্ড আঘাতে সেই দুর্ঘটনায় আমার চার ভাই চার বো্নের দেহ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ওরা মারা যায়। আমরা দুই ভাই দুই বোন কেমন করে যেনো বেঁচে যাই।

মুক্তিযুদ্ধ চলেছিলো দীর্ঘ নয় মাস। একাত্তরের ২৫শে মার্চ পাকবাহিনী কাপুরুষের মতো হামলে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর, পূর্ব পাকিস্তানের সাহসি বাঙালিরা সংগঠিত হয়ে লাঠি বন্দুক দিয়েই পাকবাহিনীকে শায়েস্তা করে একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বার দেশ স্বাধীন করে ফেলে। শুনেছি ভারত বাঙালিদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে অনেক সাহায্য করেছিল। তাই নয় মাসেই যুদ্ধ শেষ হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তান বিজয়ী হয়েছিল। বিজয়ের পর পূর্ব পাকিস্তান নাম বদলে যায়, স্বাধীন নতুন দেশের নাম হলো বাংলাদেশ।

তখনও মা বাবা দিদিভাইদের সাথে আমরা চার ভাইবোন ভারতে ছিলাম।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দিদিভাইয়ের মা বাবার সাথে আমরাও ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসি। দিদিভাইয়ের মায়ের কাছেই ছিলাম, দিদিভাইকে বড় হতে দেখলাম, দিদিভাইয়ের বিয়ে হতে দেখলাম।

দিদিভাই যখন জামাইবাবুর সাথে আমেরিকা চলে যায়, আলমিরার ভেতর বসে সেটাও দেখেছি। দিদিভাই আমেরিকা চলে যাচ্ছে শুনে মনে মনে কতো ভেবেছি, আমেরিকা না জানি কতো সুন্দর। নইলে দিদিভাই কেনো মা বাবাকে ছেড়ে আমেরিকা চলে যাচ্ছে!

আমেরিকা চলে গিয়েও দিদিভাই আমেরিকা থেকে প্রত্যেক বছর বাংলাদেশে বেড়াতে আসতো। মা বাবার আদুরে মেয়ে তো, বাবা মা’কে না দেখে বেশিদিন থাকতে পারতো না।

তেমনই একবার বাংলাদেশে বেড়াতে গেলো দিদিভাই। মা আলমারি থেকে আমাদের বের করে দিদিভাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললো, এই পেয়ালা পিরিচগুলো এবার তুই আমেরিকা নিয়ে যা। মায়ের কথা শুনে আমরা চার ভাইবোন তো হতভম্ব! বুঝতে পারছিলাম না, আমেরিকা যাওয়ার কথায় খুশি হবো নাকি মন খারাপ করবো।

মায়ের ঘরে তো এতোকাল ভালোই ছিলাম, এখন দিদিভাইয়ের সাথে আমেরিকা যদি যাই তাহলে তো মা’কে ছেড়ে যেতে হবে! মায়ের সাথে আর কোনোদিন দেখা হবে না! আবার সাথে সাথে এটাও মনে হচ্ছিল, এতোকাল এক আলমারির ভেতর আটকে আছি, দিদিভাইয়ের সাথে গেলে তো আমেরিকা দেখতে পাবো।

আমাদের জন্ম জাপানে, এসেছিলাম পূর্ব পাকিস্তানে, এতোদিন ছিলাম বাংলাদেশে এবার যাবো আমেরিকা! মন্দ কি, কয়টা পেয়ালা পিরিচের ভাগ্যে এমন সুযোগ আসে! মানুষও তো এক জীবনে এতো দেশ দেখতে পায় না, আর আমরা পেয়ালা পিরিচ হয়ে এতো দেশ দেখছি! মন ঠিক করে ফেললাম। দিদিভাইয়ের সাথে আমেরিকা চলে এলাম।

চার

আমেরিকা এসে দিদিভাইয়ের লিভিং রুমে কাঁচের ছোটো টেবিলটার উপর আমাদের জায়গা হয়েছে। প্রথমে একটু অবাকই হয়েছি, এতো বড় বাড়িতে এতো জায়গা থাকতে দিদিভাই আমাদেরকে কেন এই খোলা হাটে এনে রেখেছে! লিভিং রুম তো খোলা হাটই। কোনো আব্রু নেই, যে যখন বেড়াতে আসে, এই রুমে এসেই বসে। কিছুদিন যেতেই বুঝেছি দিদিভাই কেন আমাদের এখানে বসিয়েছে। সুন্দর জিনিস অনেকেই তো ডিসপ্লে করতে পছন্দ করে। দিদিভাইও আমাদের ডিসপ্লে করার জন্যই এটা করেছে। অতিথিরা এসে তো লিভিং রুমেই বসে, আড্ডা দেয়। গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের দিকে সকলের চোখ পড়ে। আমাদের রূপ দেখে সকলেই মুগ্ধ হয়, তাতে দিদিভাই বেশ খুশি হয়।

কেউ বলে, ও আশা দিদি, তোমার এই কাপ প্লেটের বয়স কতো গো?

দিদিভাই বলে, বাহান্ন বছর।

ওরা বলে, ওমা! বাহান্ন বছর, কী বলছো! এতো বছর টিকে আছে, এ তো অ্যান্টিক গো! এই ডিজাইনের কাপ প্লেট এখন আর কোথাও পাওয়া যাবে না। আর দেখো, বাহান্ন বছর পরেও কেমন ঝকঝকে দেখাচ্ছে! লাগছে এক্কেবারে নতুনের মতো।

দিদিভাই বলে, আমার মায়ের ক্রোকারিজ সংগ্রহের নেশা ছিল। কত রকমের কত ডিজাইনের কাপ সসার প্লেট গ্লাস বোল বাটি যে মায়ের সংগ্রহে ছিল, বিভিন্ন দেশের তৈরি জিনিস সব, এগুলো মেইড ইন জাপান। মায়ের খুব প্রিয় সম্পত্তি এই কাপ প্লেটগুলো। এবার দেশে গেলাম, ফেরার সময় মায়ের প্রিয় সম্পত্তি আমায় দিয়ে দিয়েছে।

দিয়া ভাবী বললো, এতো মূল্যবান জিনিস, এখানে রেখেছেন কেন আশা’দি?

দিদিভাই বললো, অ্যান্টিক বলেই এখানে সাজিয়ে রেখেছি।

দিয়া ভাবী বললো, আমার ভয় লাগছে। আপনার মায়ের এত প্রিয় জিনিস, এমন খোলা জায়গায় রেখেছেন, যদি অসাবধানতায় ভেঙে টেঙে যায়!

অ্যান্ডি দিদি বলে, জাপানিজ জিনিস তো, ব্যাপারই আলাদা! বাহান্ন বছরেও কেমন টনটনে দেখাচ্ছে! বাংলাদেশ থেকে প্লেনে চড়ে চলে এসেছে কিছু তো হয়নি, তাহলে এখানেও কিছু হবে না। মেইড ইন চায়না হলে ভয় ছিল। আজ কিনো, কাল ভাঙো।

দিয়া ভাবী বলে, এটা ঠিক বলছো অ্যান্ডি। জাপানি জিনিস বলেই এতো সুন্দর আর টেকসই। চায়নিজ মাল হলে কি আর পঞ্চাশ বছর পরেও এমন সুন্দর থাকতো? কবেই টোকা লেগে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতো!

মোনালিসা বলে, দেখো দেখো কাপ প্লেটের গায়ের ডিজাইনটা! কী অপূর্ব! ধবধবে সাদা গায়ে চকচকে কালো রঙে আঁকা বাঁশঝাড়ের ছবি! কী সুন্দর কী সুন্দর!

অতিথিদের কথা শুনি, আমার বুকে আনন্দের বান ডাকে। জন্মভূমির কথা মনে পড়ে। চুয়ান্ন পঞ্চান্ন বছর আগে জাপান ছেড়ে চলে এসেছি। বাবা মায়ের ঠিকানা জানি না, তবুও দিদিভাইদের মুখ থেকে যখনই জাপানের প্রশংসা শুনি, আমার বুক গর্বে ভরে যায়!

সকলেই তো যার যার নিজের দেশের কথা ভাবে, নিজের দেশ নিয়ে গর্ব করে!

এই যে দিদিভাইরা আড্ডা আসরে বসলেই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, কিভাবে পাক আর্মির সাথে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হলো সেসব নিয়ে গল্প করে, স্বাধীন বাংলাদেশের কথা বলে, আমেরিকায় এতো বছর থেকেও বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়ার গল্প করে, বলিউডের গল্প, লেহেঙ্গা বেনারসি, জামদানি টাঙ্গাইল তাঁতের গল্প বলে, তবে আমরাই বা কেনো জাপানের কথা শুনে খুশি হবো না! আমরা পেয়ালা পিরিচ বলে কি আমাদের আবেগ অনুভূতি থাকতে নেই!

দিদিভাইদের একটা জিনিস আমার মনঃপুত নয়। ওরা বাঙালি হয়েও আমাদের পেয়ালা পিরিচ নামে ডাকে না, কাপ প্লেট বলে! কাপপ্লেট শুনতেই কেমন খটোমটো লাগে, আমাদের রূপের সাথে একটুও যায় না। পেয়ালা পিরিচ নামটা কতো মিষ্টি, তবুও ওরা পেয়ালা পিরিচ বলবে না!

তবে অতিথিরা যখন আমাদের প্রশংসা করে, দিদিভাইয়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আমার আর মন খারাপ থাকে না। মনকে সান্ত্বনা দেই, পেয়ালা পিরিচ তো বাংলা নাম, ওটা বাংলাদেশের জন্য। আমেরিকায় পেয়ালা পিরিচ নাম অচল, এখানে কাপ প্লেটই ভালো।

দিদিভাই মুখ উজ্জ্বল করে বলে, “আমার মায়ের খুব প্রিয় ছিল এই কাপ প্লেট জোড়া! মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, মানুষ প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটছে, আমার মা নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে এই কাপ প্লেটগুলো নিয়ে ছুটেছিল।

অলকা দিদি বলে, ওমা সে কি! প্রাণের মায়ার চেয়েও কাপ প্লেট বেশি হলো!

দিদিভাই বলে, মায়ের কাছে এই কাপ প্লেটগুলো প্রাণের চেয়েও দামি মনে হওয়ার কারণ ছিল। ছোটোবেলায় দেখেছি আশে পাশের সবার বাড়িতে গোবদা গাবদা ডিজাইনের সস্তা দামের ছোটো ছোটো কাপে চা খাওয়া হতো, আর আমার মা চা খেতো সিরামিকের তৈরি ডিজাইন করা কাপ প্লেটে। মায়ের পছন্দ খুব ভালো ছিল, নজরও ছিলো উঁচু। কাঁচের আলমারি ভর্তি ক্রোকারিজ থাকার পরেও সুন্দর ডিজাইন দেখলেই কাঁচের বাসন কিনতো।

অনেক দাম দিয়ে এই বাঁশঝাড় ডিজাইনের ছয় জোড়া কাপ প্লেট কিনেছিল, গর্ব করে বলতো ‘মেইড ইন জাপান’। কাপপ্লেটগুলো কেনার কিছুদিন পরেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এতো দাম দিয়ে কেনা কাপে একদিনও চা খাওয়ার সুযোগ হয়নি। এরমধ্যেই পাক আর্মি শহরে ঢুকে গেছে, নির্বিচারে গোলাগুলি করছে। সবাই তখন প্রাণ বাঁচাতে শহরের বাড়িঘর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে পাক আর্মি বেছে বেছে হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতো, হিন্দুদের মেরে ফেলতো। গ্রামে গ্রামে গিয়ে হিন্দু খুঁজে বের করে হত্যা করতো। তখন হিন্দুরা শহর ছেড়ে গ্রামে, গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে ভারতে। কী কঠিন সময় তখন। টাকা পয়সা, সোনাদানা, বই পুস্তক কাপড়চোপর সব বাড়িতে ফেলে এক কাপড়ে মানুষ ছুটছে অজানার উদ্দেশ্যে, শুধু মিলিটারির হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে। আমি তখন খুব ছোটো হলেও অনেক কিছুই মনে আছে।

সকলের মতো আমরাও শহরের বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম। প্রথমে গেছি গ্রামে, সেখানে দুই মাস থাকার পর বড়োরা বুঝলেন গ্রামে থাকা আর নিরাপদ নয়। তখন ঠিক হয় আমরাও ভারতে চলে যাবো।

এক কাপড়ে তো আর দেশ ছেড়ে যাওয়া যাবে না! তাই কিছু কাপড়চোপর, দরকারি কাগজপত্র আর ট্রাংকে রেখে আসা সোনা-গয়না টাকাপয়সা আনতে মা একদিন গ্রামের এক মুসলমান বউয়ের কাছ থেকে ধার করে আনা পরে ওই গ্রামেরই এক বৃদ্ধ মুসলমান চাচার সাথে শহরের বাড়িতে যায়। পথে পাকবাহিনীর ট্রাক জিপ চলছে, টুপি মাথায় বৃদ্ধ মুসলমান সাথে থাকায় বোরকায় মুখ ঢাকা আওরাত দেখে হয়তো মিলিটারিরা জিপ থামায়নি।

শহরে আমাদের বাড়িটা ছিল ভাড়া বাড়ি, বাড়ির মালিক মুসলমান। তাই মিলিটারির হামলার ভয় ছিল না। ততোদিনে ওই বাড়ির অন্য সকল ভাড়াটেরা কোথায় চলে গেছে, সকলের ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। পুরো বাড়ি আগলে রেখেছেন বুড়ো মুসলমান বাড়িওয়ালা।

শহরের বাড়িতে পৌঁছে মা দরকারি কাগজপত্র, টাকাপয়সা হাতব্যাগে নিয়েছে, টিনের একটা বালতিতে বিছানার চাদর, ঘরে পরার শাড়ি ব্লাউজের সাথে নতুন কেনা ছয় জোড়া মেইড ইন জাপান কাপ প্লেটগুলো নিয়েছিল। সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে, এবার গ্রামের দিকে রওনা হবে। অমনি সময় বাড়িওয়ালা দৌড়ে এসে জানালেন, “ আম্মা সর্বনাশ হইয়া গেছে। পাক আর্মি মহল্লায় এসে হানা দিয়েছে”।

পাক আর্মি হানা দেওয়ার কারণ আছে, অই পাড়াটা ছিলো হিন্দুপাড়া। তখন তো পাক আর্মি হিন্দু বাড়ি খোঁজে আর হিন্দুদের খোঁজে।

বুড়ো বাড়িওয়ালা ভয় পেয়ে আমার মা’কে একটা পরিত্যক্ত অন্ধকার বেড়ার ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়। তখনই পাক আর্মির বুটের শব্দ শোনা যায়। বিশাল বাড়ির ভেতর ঢুকে সব ঘরের দরজায় লাথি মারছে, দরজার তালা টেনে টেনে দেখছে, খুঁজছে তালাবন্ধ ঘরে হিন্দুরা লুকিয়ে আছে কিনা।

এমন ভয়ঙ্কর অবস্থায় মা অন্ধকার ঘরে বসে মিলিটারির বুটের আওয়াজ শুনে ভয়ে কাঁপছিল। একে তো হিন্দু, তার উপর তরুণ বয়সের সুন্দরী, নড়বড়ে বেড়ার দরজায় পাকসেনাদের একটা লাথিই যথেষ্ট! এসব ভেবে মায়ের নাকি হার্টফেল হওয়ার দশা।

মায়ের ভাগ্য ভালো ছিল বলতেই হবে, ভাঙাচোরা ঘরে কেউ থাকবে না ভেবেই হয়তো আর্মি অই ঘরের দরজা ধরে ঝাঁকুনি দেয়নি।

মিলিটারি যখন চলে গেছে বুড়ো বাড়িওয়ালা কাঁপতে কাঁপতে দরজার তালা খুলে মা’কে বের করে আনে। বাড়িওয়ালা চাচা মা’কে এক গ্লাস জল খাওয়ায় এরপর গ্রামের ওই মুরুব্বির সাথে রওনা হয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দেয়।।

এতো কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও মা টিনের বালতিটা ঘরে রেখে আসেনি। ঘরের দরজায় তালা দেওয়ার আগে কাঁচের আলমারি ভর্তি শখের ক্রোকারিজগুলোর দিকে একবার তাকিয়েছিল। একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে সবকিছু ওভাবেই ফেলে গ্রামে চলে এসেছিল।

আমরা যখন গ্রাম ছেড়ে ভারতের পথে যাত্রা করলাম, ভারতে পৌঁছা অবধি সারাপথ বালতিটা মা নিজের হাতেই রেখেছিল। মাঝখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটে। মধ্যি রাতে আমরা নৌকায় করে যাচ্ছিলাম। একটা ব্রিজ ছিলো, পাক আর্মির ট্রাক জিপ আসা যাওয়া করতো। মুক্তিবাহিনী যেনো ব্রিজ উড়িয়ে না দিতে পারে, তাই শিফট বদলে বদলে সেই ব্রিজ পাহারা দিতো আমাদের দেশেরই কিছু রাজাকার। শিফট বদল হওয়ার ফাঁকেই নৌকাগুলো ব্রিজের নিচে দিয়ে বিপদসীমা পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো।

আমাদের নৌকাও বিপদসীমা পেরিয়ে মাত্র তীরে এসে ঠেকেছে, মিলিটারির চোখ ফাঁকি দিতে পারার আনন্দে সকলেই এই অন্ধকারের মধ্যেই নৌকা থেকে লাফিয়ে ডাঙায় নেমে দ্রুত মাঠ পার হচ্ছিল। আমার মাও বালতিটা কোলে নিয়েই লাফ দিয়েছিল, লাফটা ঠিকমতো হয়নি। শাড়িতে পা জড়িয়ে গেছিল বোধ হয়, বালতি সমেত জলে পড়ে যায়। জলে ঝপ করে শব্দ হয়েছিল, এর সাথে ঝনঝন কাঁচ ভাঙার শব্দ। এতো জোরে শব্দ না জানি মিলিটারির কানে পৌঁছে যায়, এই ভয়ে সবাই মিলে মাকে জল থেকে টেনে তোলে আর সামনের দিকে হাঁটা দেয়।

কিছুদূর আসার পর মা বালতির কাপড় সরিয়ে দেখে চার জোড়া কাপ প্লেট ভেঙে গেছে, দুই জোড়া কাপ প্লেট মোটামুটি অক্ষত আছে! এই দুই জোড়া কাপ প্লেট সাথে নিয়েই মা ভারতে পৌঁছায়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা কলকাতা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে এলাম। ঘরে ঢুকে দেখা গেলো, ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো, বাবার কাঠের দেরাজ ভাঙা, মায়ের মিটসেফের দরজা ভাঙা, মিটসেফ ফাঁকা। মায়ের শখের ক্রোকারিজের একটাও নেই, মা বুঝে গেলেন সব লুট হয়ে গেছে। এই দৃশ্য দেখে মা খুব কষ্ট পেয়েছিল। আমি ছোটো ছিলাম, তারপরেও আমি মায়ের মুখের চেহারা দেখে বুঝেছিলাম মায়ের বুক ফেটে যাচ্ছে! ক্রোকারিজগুলো মায়ের খুব শখের ছিল, সোনা-গয়নার চেয়েও দামি। কে বা কারা ঘরের সব লুটপাট করে নিয়ে গেলো, কিছুই জানা গেলো না।

কী আর করা, কাচের দরজা ভাঙা আলমারির ভেতর এক কোণায় এই বাঁশঝাড় কাপপ্লেটগুলো রেখে দিয়েছিল। আজও মনে পড়ে, ভাঙা আলমারিটার কাছে দাঁড়িয়ে প্রায়ই মা চোখের জল মুছতো।

স্বাধীনতার কয়েক মাস পরের ঘটনা। রমজানের ঈদ, বাড়িওয়ালার বাড়ি থেকে আমাদের ঘরে সেমাই জর্দা পাঠিয়েছে। ট্রেতে সাজানো প্লেট দেখে মা তো স্তম্ভিত। মায়ের শোকেস থেকে লুট হয়ে যাওয়া ক্রোকারিজেরই এক সেট প্লেটে ওরা সেমাই পাঠিয়েছে। ধবধবে সাদা প্লেটে সবুজ ধানছড়ার ছবি। এই প্লেটগুলো আমার মায়ের ছাড়া আর কারো নয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে এই প্লেটে আঁকা ধানছড়ার ছবি দেখে আমি ছড়া কাটতাম, “ ধান নদী খাল, এই তিনে বরিশাল”! শখের জিনিস যেনো হারিয়ে না যায় তাই মা নিজের প্রতিটি জিনিসের উল্টোদিকে মার্ক করে রাখতো।

ওই ধানছড়া প্লেটের উল্টোদিকে মায়ের দেওয়া মার্ক তখনো ছিল।

আমি তো অনেক ছোটো, কিছুই না বুঝে ছুটে যাচ্ছিলাম বাড়িওয়ালার বাড়িতে। গিয়ে বলতাম, চাচী এই প্লেটগুলি আমাদের। দেখো, আমার মায়ের চিহ্ন আছে প্লেটের উলটো দিকে। কিন্তু মা পেছন থেকে আমার ফ্রক জাপটে ধরেছে। হাতের কাছে পেয়েও প্লেটগুলো মা ফেরত চেয়ে আনতে দিলো না দেখে আমার খুব জেদ হয়েছিল। পা দাপিয়ে জেদ করছিলাম।

তখন বুঝতে পারিনি কেনো মা আমাকে আটকেছিল। বড় হয়ে বুঝেছি দুটো প্লেটের জন্য মা ওদেরকে বিব্রত করতে চায়নি, লজ্জায় ফেলতে চায়নি। বাড়িওয়ালা ভাড়াটে সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়নি। তাদের সাথে উঠতে বসতে দেখা হতো, কথা হতো অথচ মা মুখ ফুটে কোনোদিন কিছুই বলতে পারেনি।

মা খুব আত্মমর্যাদবোধ সম্পন্ন নারী ছিলেন, অভিমানীও ছিলেন কিছুটা। বিশ্বস্ত মানুষের হাতেই শখের জিনিসের অপমৃত্যু হয়েছে, তাই হয়তো অভিমান করেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মা আর কোনো শখের জিনিস সংগ্রহ করেনি। এমনকি দরজা ভাঙা মিটসেফটাও আর ঠিক করায়নি। শখের ক্রোকারিজের গুচ্ছ থেকে এই বাঁশঝাড় কাপপ্লেট দুটো বাঁচাতে পেরেছিলো, তাই কাপ প্লেটদুটো মা মুক্তিযুদ্ধের চিহ্ন হিসেবে রেখে দিয়েছিল।

সর্বস্ব হারিয়ে দামি ক্রোকারিজের প্রতি মায়ের দুর্বলতা আর রইলো না। কাঁচের বাসন নিয়ে ফেরিওয়ালা আসতো, অন্য সকলের মতো মাও ফেরিওয়ালার কাছ থেকে গোবদা গোবদা কাপ প্লেট কিনতো চা কফি খাওয়ার জন্য।

পাঁচ

দিদিভাইয়ের অতিথিদের কারো কারো নজর খুব তীক্ষ্ণ, কেমন করে জানি দেখে ফেলে আমার এক পিরিচ ভাইয়ের শরীরে ফাটা দাগ, আরেক পেয়ালা বোনের হাত ভাঙা! দিদিভাই আমাদের খুঁত যতোই আড়াল রাখুক, অতিথিদের নজরে তা পড়েই যায়। অমনি জিজ্ঞেস করে, আশা দিদি, একটা প্লেট তো ফেটে গেছে, আরেকটা কাপের তো হাতল ভাঙা! কিভাবে ভাঙলো গো?

দিদিভাই সুন্দর করে উত্তর দেয়, একই গল্প বারবার শোনায়।

“ হ্যাঁ গো, ঐ ফাটা দাগ, হাত ভাঙাটুকুই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের গৌরব। আমরা যখন পাকিস্তানী মিলিটারিদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছিলাম, এক মাঝরাতে একটা ব্রিজের নীচ দিয়ে আমাদের নৌকা এসে থামে কাদামাটির মধ্যে।

মাথার ওপর ব্রিজ, ব্রিজে দিনে রাতে পাকসেনা টহল দেয় যেনো মুক্তিবাহিনী ব্রিজ দখল করতে না পারে। এই ব্রিজের সীমানা পার হতে পারলে তবেই নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যাবে। মাঝরাতে ব্রীজে পাহারা বদল হয়।

ওইজন্যই দালাল মাঝরাতে আমাদের ব্রীজ এলাকা পার করে দিচ্ছিল। অন্ধকার রাতে চুপেচাপে নৌকা থেকে একে একে সকলেই নামছিল।

সবার শেষে মা ছিল। নৌকা থেকে নামার সময় কেমন করে জানি বালতিসহ মা জলকাদার মধ্যে পড়ে যায়, সাথে সাথে চারদিকে কাঁচের বাসন ভাঙার আওয়াজ ওঠে।

মা শহরের মেয়ে, নৌকায় চড়ার অভ্যাস তো ছিল না। তার উপর এমন অন্ধকারে নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে গেছে! তাইতেইঁ বালতির ভেতরে থাকা কাপ প্লেট ঝনঝন করে ওঠে। এই ঝনঝন আওয়াজে চারদিক জেগে ওঠে, আশেপাশের সকলেই ভয় পেয়ে যায়।

ব্রিজের উপর তখন পাক আর্মির টহল জিপ যাওয়ার কথা, ঝনঝন আওয়াজ হতেই অন্ধকারে সবাই যে যার মতো ছুটে পালাতে থাকে। আর মা পড়ে থাকে কাদাজলে পা আটকে। সেজো মামা আর ছোটো মামা মা’কে ধরে ধরে কাদা থেকে তুলে দাঁড় করায়। প্রাণের মায়া নয়, মা নাকি তখনও বলছিল, এতো কষ্ট করেও কাপপ্লেটগুলি বাঁচাতে পারলাম না। মনে হয় ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে!

গ্রাম্য বাজারে পৌঁছে সকলে যখন জিরোচ্ছিল, মা তখন বালতির ভেতরে থাকা কাপড়চোপড় উলটে পালটে দেখছিল কাপপ্লেটগুলো ভেঙে গেছে কিনা! দেখতে পায়, চার জোড়া কাপপ্লেট ভেঙে টুকরো গেছে, আর বাকি দুই জোড়ার মধ্যে একটা প্লেট একটু ফেটেছে, একটা কাপের হাত ভেঙে গেছে।“

দিদিভাই বলছিল, ছোটোবেলা থেকেই আমার খুব নজর ছিল এই কাপ প্লেটের দিকে। দরজা ভাঙা শোকেসের ভেতর এক কোণে থাকা কাপ-প্লেটের দিকে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। কাপের গায়ে বাঁশঝাড়ের ছবিটা দেখলেই যতীন্দ্রমোহন বাগচির লেখা “বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ” কবিতার লাইনগুলো মনে পড়তো। কোনো এক কাজলা দিদির জন্য মন কেমন করতো, কল্পনায় আমিই যেনো খুকি হয়ে উঠতাম। কাজলা দিদিকে খুঁজতাম, কাজলাদিদির কথা মনে করে মাঝে মাঝে চোখ জলে ভরে উঠতো।

মা জানতো, এই কাপপ্লেটগুলো আমার খুব প্রিয়।

কত বছর হয়ে গেলো। দেশে বেড়াতে গেলাম, ফেরার সময় মা আমার হাতে এই কাপ-প্লেট জোড়া তুলে দিয়ে বললো, “ আমার খুব প্রিয় জিনিস, তোকে দিলাম। তুইই একমাত্র এর মূল্য বুঝবি। সোনা গয়নার চেয়েও দামি। নিছক পেয়ালা পিরিচ নয়, ইতিহাসের কয়েকটি ছেঁড়া পাতা। তুই তো অতীত খুঁজতে ভালোবাসিস, ইতিহাস জানতে ভালোবাসিস। এই পেয়ালার গায়ে পরতে পরতে অনেক ইতিহাস লেখা আছে। খুঁজলেই পাবি অনেক না-বলা সত্য। আমি বলেছিলাম, মা সব সত্যই আমি জানি। না-বলা সত্যগুলো জানে না যারা, অথবা জানতে চায় না, জানালেও মানতে চায় না, তাদের কাছে যদি এই কাপপ্লেটগুলো পাঠানো যেতো!

মা বললো, যত্ন করে নিয়ে যাস আমেরিকা, খুব সাবধানে। টোকাও যেনো না লাগে! টোকা লাগলেই ভেঙে যাবে। আমি হেসে বলেছিলাম, মা এদের কইমাছের প্রাণ! মুক্তিযুদ্ধের সময় তুমি নৌকা থেকে পড়ে গেছিলে, তাতেও যখন ওরা ভাঙেনি, আর ভাঙবে না! ওরা আমার স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি।

মা বললো, “ আমার বয়স হয়েছে, আর কয় বছর বাঁচবো জানি না। তোকে দেয়ার মতো ধনসম্পদও আমার কিছু নেই। তাই বেঁচে থাকতেই এই কাপ-প্লেট জোড়া তোকে দিতে চাই। আমি যখন থাকবো না, তোরও তখন দেশে আসার আগ্রহ কমে যাবে। ছেলেমেয়ে, স্বামী, সংসার নিয়ে ব্যস্ততা বেড়ে যাবে। মায়ের কথা ভাববার ফুরসত পাবি না।

মাত্র দুই জোড়া পেয়ালা পিরিচ, খুব ভারী কিছু তো নয়, শোকেসে রেখে দিস। ঘরদুয়ার ঝাড়পোছ করার সময় তোর প্রিয় বাঁশ ঝাড়ের ছবির দিকে নজর যাবে, ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চমকের মতোই মা’কে মনে পড়বে। কাপ-প্লেটের মাঝে আমাকে খুঁজবি, কাপ-প্লেটের গায়ে আলতো করে হাত বুলাবি, আজকের কথা মনে পড়ে যাবে। হয়তো চোখে জল আসবে, কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে যাবি। কাপের গায়ে আমাকে পাবি, প্লেটের গায়ে আমাকে পাবি! এই বাঁশপাতার ছাপে কতো গল্প, কতো স্মৃতি জমা আছে!

এই দরজা ভাঙা মিটসেফের দিকে তাকালে মনে পড়ে যায়, যে বাড়িওয়ালা আমাকে সেদিন পাক আর্মির হাত থেকে রক্ষা করলেন, তাঁর জিম্মাতেই বাড়িঘর, আসবাবপত্র সব দিয়ে গেছিলাম! ফিরে এসে দেখি সব ফাঁকা! এ তো কাপপ্লেট, মুক্তিযুদ্ধে কতো পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে! একটি দেশ স্বাধীন তো এমনি এমনি হয় না! লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, লক্ষ পরিবার সর্বস্ব হারালে তবেই স্বাধীনতা আসে।

এই কাপপ্লেটের দিকে তাকালেই আমার মনে পড়ে যায়, রাতের অন্ধকারে যখন নৌকা থেকে কাদাজলে পড়ে গেছিলাম, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সবাই যার যার মতো দৌড়ে চলে গেছিল, আমার বাবা মা স্বামীও। শুধু আমার ছোটো দুই ভাই নিজেদের প্রাণের মায়া করেনি, দিদিকে জলকাদা থেকে টেনে তুলেছিল! বিপদে সবাই ছেড়ে যায় না, কেউ না কেউ পাশে থাকে।

কাপ-প্লেট দুটো তোর কাছে থাকলে তুই আরও অনেক সত্য উপলব্ধি করতে পারবি। একান্তই যদি সত্য খুঁজে দেখার সময় না পাস, তাহলে নাহয় কাপ-প্লেটের দিকে তাকিয়ে আমার কথা ভাববি, শৈশব কৈশোরের স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করবি।

স্মৃতিই তো সব! মানুষ থাকে না, তার স্মৃতি থেকে যায়। আমিও থেকে যাবো তোর কাছে, এই বাঁশঝাড়ের ছবির মাঝে, তোর কল্পনার কাজলা দিদির মতো”।

আমেরিকায় জন্ম, আমেরিকায় বড়ো হতে হতে তোর ছেলেমেয়ে দুটো তো একদিন আমেরিকান হয়ে যাবে, হয়তো শেকড়ের সন্ধান হারিয়ে ফেলবে। এমনটা হতে দিস না। এই কাপ প্লেট দেখিয়ে ওদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের গল্প করবি, বাংলাদেশের গল্প করবি, কাপ প্লেটকে ওদের দিদা পেয়ালা পিরিচ বলতো তা বলবি, মুক্তিযুদ্ধের গল্প তুই যতটুকু জানিস, আমার কাছে যতটুকু শুনেছিস সবই গল্প করবি। ওরা যতোই আমেরিকান হয়ে উঠুক, শেকড় হারাবে না। ওরা জানবে ওদের শেকড় স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে গাঁথা আছে।

[ ওই দেখো, তোমাদের গল্প শোনাতে শোনাতে কখন বিকেল হয়ে গেছে! দিদিভাইয়ের রান্নাবান্না মনে হয় শেষ হয়ে এসেছে। রান্নাঘর থেকে টুংটাং, ঝনাত ঝনাৎ শব্দ আসছে না। দিদিভাইয়ের মায়ের কথাই ঠিক। মা মারা যাওয়ার পর দিদিভাই আগের মতো দেশে যায় না। ঘর-সংসার নিয়েই ব্যস্ত, তবে মা’কে একদন্ডের জন্যও ভোলেনি। প্রতিদিন দিদিভাই একবারের জন্য হলেও আমাদের গায়ে হাত বুলায়, কী যেন ভাবে। মাঝে মাঝে চোখ মোছে। দিদিভাইয়ের চোখে জল দেখলে আমাদের খুব কষ্ট হয়। আবার ভালোও লাগে, তবুও তো দিদিভাই আমাদের মাঝেই তার মায়ের পরশ পায়, তার দেশের গন্ধ পায়।]

 

Read Previous

হাফিজ রহমান-এর গুচ্ছকবিতা

Read Next

কলঙ্কিনী রাধা – দ্বিতীয় পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *