অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪
১৩ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪
১৩ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর -
ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ

লোকে যখন তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ বলে ডাকে, তখন তার যেন আনন্দের সীমা থাকে না। তিনিও তাদের সাথে হাসিতে যোগ দেন। অনেকে তার বোকার মতো হাসির জন্যও হাসে। তার বয়স হয়েছে। তার নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। যে কোনো কাজে ডাকলে তিনি যান। ঘরের ভিটি উঁচু করা থেকে শুরু করে চালের শন বদলে দেয়া, পাটখড়ির বেড়া থেকে টিনের বেড়ার রোয়া বদলে দেয়া, কাপড়ের তেনায় আলকাতারা লাগিয়ে টিনের চালের ফুটো বুজিয়ে দেয়া, আশ্বিন চারা রোয়া, শীতে গমক্ষেত নিড়ানো, বুনন, চৈত্রে হাল দেয়া, বীজ বোনা, আষাঢ়ে নালিতা কেটে জাঁক দেয়া আর ভাদরে পচা নালিতার পাট খসিয়ে ধুয়ে শুকানো, অঘ্রাণে ধান কাটা, মাড়াই, বিচালির গাদা বানানো কি-না করেন তিনি! তার কর্মের তালিকা করতে গেলে আমাদের মাথা ঘোরে। ছিপ আর জাল দিয়ে মাছধরার কথা প্রসঙ্গে ডোবার পানিতে ডুব দিয়ে কাদার ভেতর হাতিয়ে শিং, বাইন, কৈ ধরতে তাকে দেখা যায়। বলা যায়, এমন আরো কত গেরস্তালি কাজের কথা। তার কাজের ইয়ত্তা নেই। এক কথায়, যখন যে কাজে লোকে ডাকে তিনি সব কাজই করেন। কোনো কামে না নেই। সর্বকাজের কাজি বুঝি তাকেই বলা যায়।

তার দিন শুরু হয় ভোরবেলায় আজানের মধ্য দিয়ে, পাড়ার মসজিদে তিনি ফজরের আজান দেন। আমরা তাকে ফজরের পর ঘরে এসে সুর করে কোরআন পাঠ করতে শুনি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পাড়ার ছেলে, মানে আমাদের সঙ্গেও কখনো কখনো দাঁড়িয়ে গল্প করেন। ইদানীং বেশি বেশি আমাদের সঙ্গে গল্প করেন। আমরা বুঝতে পারি, নিজের ছেলের কথা মনে পড়লে আমাদের সঙ্গে গল্প করতে আসেন। আমরা কেউ স্কুল, কেউবা কলেজ পার হতে পারিনি। আর তার ছেলে, আমাদের সহপাঠী, বিত্তহীন একটি পরিবার থেকে সব বাধা অতিক্রম করে যখন আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেল এবং এরই মধ্যে অনার্স পাস করে ফেলেছে। তখন বন্ধুটির সরল পিতার প্রতি আমাদের সম্মানবোধ অজান্তেই বেড়ে গেল। তিনি কাজ না থাকলে অথবা মাগরিব পড়ে এসে আমাদের ক্যারম বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কোন গুটিটা এখন ফেলতে হবে এমন মতামত দেন। তার ভুল উপদেশে গুটি ফেলতে ব্যর্থ হলেও আমরা মনে কষ্ট পাই না। বরং ব্যর্থতার জন্য তাকে শুনিয়ে আফসোস করি। বলি, তার ছেলের কথা। সে এই ভুল করত না। আমরা জানি, আমাদের বন্ধুটি ভালো ক্যারম খেলতে পারে। ওর লক্ষ্য অব্যর্থ। আমরা ওর পিতার সামনে আরো বলি, তার লগে আমরা কেউ খেলায় পারতাম না। তিনি শুনে খুশি হন। তিনি বলেন, মানুষের জীবনে লক্ষ্য ঠিক কইরা আগাইতে হয়।

আমরাও জানি, আমাদের বন্ধুটির জীবনের লক্ষ্য ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া। আমরা চাই সে ম্যাজিস্ট্রেট হোক। তাতে আমরা গর্ববোধ করব। আমরা আমাদের বন্ধুকে নিয়ে গল্প করতে পারব। বন্ধুর পিতা বলে ওর পিতাকে চাচা বলি। চাচার সঙ্গে দেখা হলে আমাদের বন্ধুটির খবর তার কাছে জানতে চাই, যদিও আমাদের কেউ কেউ ঢাকা গেলে ওর সাথে হলে গিয়ে দেখা করে আসে। সে ছাত্র পড়িয়ে লেখাপড়া করে, আর এ কারণেই বাড়ি আসতে পারে না, আমরা সে কথা নিয়ে আলোচনা করি না। বরং চাচার কছে তার মেধাবী ছেলের গল্প শুনি। আমাদের বন্ধুটি যে কোনো পড়া একবারের বেশি পড়ে না এ কথা অনেকবার ওর পিতার মুখে শুনলেও তাকে কখনো মনে করিয়ে দিই না। তার কথা শোনার সময় আমরা দেখি, তার চোখ থেকে, চৈত্রের মেঘ থেকে যেন বৃষ্টি ঝরে, তার আশার জমিনে ফসল ফলছে। আমরা চুপ করে তার স্বপ্নের কথা শুনে যাই। আজান হলে তিনি নিজেই কথা থামিয়ে চলে যান। তার পরেও আমরা আমাদের বন্ধুটির মুখ মনে করে আরো ক্যারম খেলতে থাকি। সে থাকলে আমাদের আড্ডা কত জমজমাট হতো। এভাবে সময় কেটে যায়।

প্রায় দু’বছর পর আমাদের বন্ধুটি গ্রামে আসে। আমরা আন্দাজ করি, একটা ভালো খবর নিয়েই সে এতদিন পর গ্রামে এসেছে। আমরা আমাদের বন্ধুকে বহুদিন পর আবার ক্যারম খেলায় পাই। সে খেলা ভোলেনি, আগের মতোই লক্ষ্যভেদ করে। কিন্তু আমরা অবাক হই, আমাদের বন্ধুর বাপ কেন ওর পাস করার খবরটা আমাদের দিল না! বুঝতে পারি না, তিনি কেন এমন একটা খবর দিতে ছুটে আমাদের ক্লাবে এলেন না। আমরা অন্যভাবে খবর নিয়ে জানতে পারি, চাচার শরীর ভালো আছে। আমাদের বন্ধুটি বলে ওর বাপের মন খারাপ করেছে। অনার্স পাস করে ছেলে বাড়ি এসেছে আর চাচার মন খারাপ এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। চাচার মন ভালো করতে তার কাছে যাই। গিয়ে চাচির কাছে আসল ঘটনা শুনি। চাচি হেসে হেসে আমাদের সব বলেন।

আমরা জানতে পারি, ছেলেকে চাচা বিএ পাস দেখতে চেয়েছিলেন, ছেলে বি.কম অনার্স পাস করেছে বলে তার মন খারাপ। তিনি তাতে কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু ছেলেকে কষ্টের কথাটা বলতে পারেননি। আজ তিনি আমাদের স্কুলের ইংরেজির মাস্টার হরেন্দ্রনাথ বাবুকে সে কথা না বলে পারেননি।

হরেন্দ্রনাথ বাবু বলেছেন,

আপনি মিছামিছি মন খারাপ করছেন, আপনার ছেলে আপনার আশা পূরণ করেছে। সে ভালো ফল করেছে। আর বি.কম অনার্স বিএ পাস করার চাইতে খারাপ নয়, বরং ভালো।

তিনি মনে করলেন, মাস্টার বাবু তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তিনি বলেন,

কম পাস করলে আবার ভালো কেমনে হয়? আপনি আমাকে মিছা কথা কেন বলেন, মাস্টার বাবু? মাস্টার বাবু তখন তার নির্বুদ্ধিতায় আর না হেসে পারেননি। বি.কম মানে কমার্স, মানে বাণিজ্য। অনার্স মানে সম্মানসহ পাস। বাণিজ্য অনুষদের বিষয়গুলোতে পড়লে চাকরি পাওয়া অনেক সহজ হয়। আর আপনার ছেলে যে বিষয়ে অনার্স করেছে সে তো সহজেই ব্যাংকে ভালো চাকরি পাবে।

মাস্টার বাবুর এমন কথা শুনেও তিনি আঘাত পেয়েছেন। তার অসন্তোষ প্রকাশ না করে পারেননি।

আমি তো হেরে ব্যাংকে চাকরি করবার লাইগা লেখাপড়া করতে কই নাই।

তাহলে কী চাকরি করতে কন?

আমি চাই সে ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করব।

আপনার আশা অনেক বড়। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেসি তো কোনো চাকরি না। এটা একটা বিচারিক ক্ষমতা।

জি, বাবু। আমি কামলা মানুষ, আমার তো ক্ষমতা নাই। পাওনের আর কোনো উপায় নাই। আমি টাকা চাই না। পোলার মুখে হুনছিলাম, ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় হের লগে আগে আরেকটা পোলা পরীক্ষা দিতে বইছিল। ওই পোলা নকল কইরা লিখতে ছিল। ম্যাজিস্ট্রেট হাঁইটা যাইবারকালে আঙুল দিয়া ইশারা করতেই খাতা রাইখা পোলাডারে বাইর কইরা দিছিল! পরীক্ষার হলে ম্যাজিস্ট্রেট আইলে হগলে ডরে চুপ কইরা থাহে। আমি এমন তাজ্জব কথা হুইনা সেদিনই হেরে কইছি, ভালো কইরা পড়, তোর ম্যাজিস্ট্রেট অওন লাগব।

মাস্টার বাবু একজন দিনমজুর বাপের মুখে ছেলেকে নিয়ে এমন আশার কথা আগে আর শোনেননি। তিনি তাকে বলেন,

আপনার ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারবে। দেখবেন, সৃষ্টিকর্তা একদিন আপনার আশা পূরণ করবে।

আপনি হের শিক্ষক, আমার পোলার জন্য দোয়া করবেন। আপনার দোয়া আল্লাহ কবুল করব, আমি বিশ্বাস করি।

হরেন্দনাথ বাবুর সঙ্গে কথা বলার পর চাচার মন ভালো হয়ে গিয়েছিল।

চাচি আমাদের বলেন,

এখন তার মন ভালো হয়েছে। ছেলের জন্য বাজার করতে গেছে আর তোমাদের জন্য রসগোল্লা আনবে কয়া গেছে।

হ, চাচি, আমরা রসগোল্লা আজ খাবই।

আমরা বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করি, চাচা তো দূরের কথা বন্ধুরও দেখা নাই। কিন্তু রসগোল্লা তো আমাদের খাওয়া চাই। অগত্যা চাচার বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। বাড়ি তো নয়, কোনোরকম একটা ঘর। বন্ধুটি কাঁঠাল গাছের তলে একটা টুলে বসে একটা বই হাতে পড়বার ছলে কী যেন ভাবছে। আমরা উঠোনে দাঁড়িয়েই ওর সাথে কথা বলি।

বিকেল বেলায় তুই বাড়িতে এসে চুপ করে বসে রইলি যে! অনেক বিদ্বান হয়ে গেছিস, তাই? আমাদের আর বন্ধু মনে করিস না।

বন্ধু বলে, না। সে কথা না। আমার বাইর হতে লজ্জা লাগে।

কেন?

পাড়ার মুরব্বিরা মশকরা করে আমার আব্বাকে ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ বলে। আমার শুনতে ভালো লাগে না।

তাতে কী হয়েছে? তুই তো একদিন ম্যাজিস্ট্রেট হবি। চাচা-চাচির দোয়া আছে। আমরাও চাই, তুই ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে গ্রামের সম্মান বাড়াবি।

সে চেষ্টা আমি করব। তবে চাইলেই তো সকলে ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারে না। অনেক প্রতিযোগিতা। কত কত ভালো ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দেয়! হয় ক’জন মাত্র।

তুই পারবি। এখন আমাদের লগে চল। ঘুরতে যাব, রেললাইনের পাশে গিয়ে আড্ডা দেব। বহুদিন পর আমরা তোরে পাইছি।

আমরা রেললাইনের ধারে গিয়ে বসি। আমাদের মনে পড়ে, এই রেললাইনের রেলে চড়ে আমাদের বন্ধুটি একদিন অনেক দূরে, ঢাকা শহরে চলে গিয়েছিল। যেন সেদিনের কথা। যদিও এরপর মাঝে মাঝে আসে, তবু মনে হয় সেই যাওয়াই যেন ওর গ্রাম ছেড়ে শেষ যাওয়া ছিল। আমাদের বন্ধুটি চুপ করে বসে আছে, যেন আমাদের কাছে নেই সে। সে তাকিয়ে আছে দূরে। আমাদের সামনে সবুজ ধানক্ষেত, উপরে আকাশ, মেঘ ভাসছে, নানান রঙ ধরেছে। আমাদের মনে সেইসব দিন জেগে উঠতে চায়, আমরা সেগুলোকে সামনে আনতে পারি না। যদি সে নিজে থেকে সেসব দিন ওর স্মৃতি থেকে টেনে না তোলে, তাহলে কী করে আমরা আনি। আমরা তো আগের মতোই আছি, কেবল সে বদলে গেছে। ওর কথার ধরন বদলে গেছে। হয়তো চিন্তাও বদলে গেছে। আমরা জানি, সেও ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটকে বিচারকের আসনে বসতে আমরাও দেখেছি। তাকে বড় বড় উকিল মাথা নিচু করে সালাম দিয়ে কথা বলেন, তিনি অপরাধ করলে বিচার করে দোষী হলে জেল দেন। তার আদেশে পুলিশ যে কাউকে ধরে নিয়ে আদালতে হাজির করেন। আমরা বসে বসে আমাদের বন্ধুটিকে বিচারকের আসনে কল্পনা করি। তাই আগের মতো আর কথা বলতে পারি না। আজ তাকে অপরিচিত ঠেকে।

ঠিক তখন পাড়ার উচ্চবংশীয় একজন মুরব্বি এসে আমাদের কাছে দাঁড়ান। আমরা জানি, তার কলেজপড়ুয়া মেয়েকে আমাদের এই বন্ধুটি স্কুল থেকে পড়াত। মুরব্বির সুন্দরী মেয়েটি স্কুলে যাওয়ার সময় একজন কাজের মেয়ে ওর মাথায় ছাতা ধরে রাখত। আমাদের মনে হয়, আজও ওকে তার বাড়ি যেতে বলতে এসেছেন। আমরা দাঁড়িয়ে মুরব্বিকে সালাম দিই,

আসসালামু আলাইকুম।

তিনি সালামের উত্তর না দিয়ে আমাদের বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস করেন,

তুমি কি ম্যাজিস্ট্রেট হয়া গেছ?

জি, না।

তাহলে তোমার বাপ ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ হইল কেমনে?

বন্ধুটি চুপ করে থাকে।

চাইলেই কি ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারবা? মজুরের বেটা ম্যাজিস্ট্রেট হইতে শুনছ কোনোদিন? পিয়ন হয়, বড়জোর প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার হইতে পারে। তোমার বাপকে আমি বইলা দিছি, ভাঙাঘরে থাইকা চান্দে যাওয়ার আশা যেন না করে। লেখাপড়া তো করো মাইনসের পোলাপান পড়াইয়া, মাস্টারি বা কেরানিগিরি করতে পারলেই তোমার উপযুক্ত কাজ হইব। মজুরের বেটা হয়া ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার চিন্তা চান্দে যাওয়ার চিন্তার মতনই, এসব চিন্তা বাদ দাও, কয়া দিলাম।

মুরব্বি চলে যাবার আগে আরো বলেন,

তোমার বাপকে বলবা বাটপারি না করতে। আমার বাড়ির দিকে আর তুমিও পাও বাড়াইবা না।

আমাদের বন্ধু হ্যাঁ, না কিছু বলল না। চুপ করে শুনে গেল।
আমরা উঠে পড়ি। পাড়ার ক্লাবঘরে যাই। ক্যারম বোর্ডে গুটি সাজিয়ে ওকে স্ট্রাইক করতে দিই। সে এমন জোরে মারে অর্ধেকের বেশি গুটি ছিটকে বোর্ডের বাইরে চলে যায়। স্ট্রাইক রেখে দেয়। আমরা আবার গুটি সাজাতে থাকলে সে বলে,

আমাকে তোরা মাফ করে দিস।

এ কথা কেন বলছিস?

আমি আর গ্রামে আসব না।

কী কস! কেন আসবি না? চাচা-চাচিকে দেখতে আসবি না?

আমাদের বন্ধুটি আমাদের কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গেম না খেলেই চলে যায়। পরদিন সকালে জানতে পারি, আমাদের বন্ধুটি মধ্যরাতের ট্রেনে ঢাকা চলে গেছে।
আমরা তারপর রেললাইনের পাশে বসে বন্ধুর গল্প করি। চাচার সঙ্গে আমাদের দেখা হলে সালাম দিই। তাকে আগের মতোই হাসিখুশি দেখি। লোকে তারপরও তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, মশকরা করে। তবে তিনি কারো কথায় কান দেন না, কানে তোলেন না। এমন ভাব নিয়ে পথ হাঁটেন, কাজ করেন যেন এখন কানে শুনতেও পান না।
আমরা একদিন জিজ্ঞেস করি,

চাচা আপনার ছেলে চিঠিপত্র লেখে না?

তিনি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমাদের বলেন,

আমাদের বন্ধুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। তাই সে বাড়ি আসতে পারবে না। পরীক্ষা শেষ হলে আসবে। এভাবে বছর পেরিয়ে যায়।

অবশেষে আমরা খুশির সংবাদটা পেয়ে যাই। চাচা আমাদের ক্লাবে এসে জানিয়ে যান, তার ছেলে পরীক্ষায় পাস করেছে, সে ম্যাজিস্ট্রেট হবে। নিয়োগপত্র পেয়ে তারপর বাড়ি আসবে। আমরা তার কথা বিশ্বাস করি। পাড়ার ছেলেরা মিলে মিষ্টি কিনে নিয়ে আসি। ক্লাবে বসে বন্ধুকে ছাড়াই আনন্দ করি।
এর পর আরো ঘটনা ঘটে। আমাদের পাড়ায় একদিন পুলিশ আসে। এসে আমাদের বন্ধুটির বাড়ি কোনটা জানতে চায়। পাড়ার সেই মুরব্বি এগিয়ে এসে সন্দেহবশত পুলিশের কাছে জানতে চান, দারোগা সাব, মামলা কোন ধারার? কী করছে সে? পুলিশ বলে,

মামলা তার নামে কোনো মামলা না, তিনি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে মামলার বিচার করবেন। আমরা তার সম্পর্কে জানতে এসেছি।

পুলিশের জবাব শুনে মুরব্বি টাসকি খেয়ে স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে থাকেন আর আমরা পুলিশকে আমাদের বন্ধুটির বাড়ি নিয়ে যাই। বন্ধুর ঘরবাড়ি দেখে পুলিশের দারোগা বলেন,

মরুভূমিতেও ফুল ফোটে।

চাচা কার বাড়িতে কাজ করতে গেছে চাচি জানেন না। দারোগা সাহেব চাচিকে সালাম করে চলে যান।
ক’দিন পরের ঘটনা। পাড়ার সেই মুরব্বি আমাদের কাছে জানতে চান আমাদের বন্ধুটি কবে বাড়ি আসবে। আমরা তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না। তিনি আরো বলেন,

হের বাপ যে অসুস্থ তোদের দোস্ত কি সে খবর জানে?

আমরা অবাক হই। আমরাই জানি না! ঢাকা থেকে দোস্ত জানব কি? জিজ্ঞেস করি,

আপনে কেমনে জানেন?

মুরব্বি বলেন,

আমি কিছু ফল আর টাকা লয়া গেছিলাম, ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ হয়া দেমাক হয়ে গেছে। ফল আর টাকা রাখে নাই।

আমরা ছুটে যাই বন্ধুর বাড়িতে। গিয়ে দেখি, চাচার খুব অসুখ। তার পেটে ব্যথা, মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে কফের সঙ্গে রক্ত বের হয়। আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, সময় বেশি নাই। আলসারটা ক্যানসারে রূপ নিয়েছে। তার ছেলেকে দ্রুত খবর দাও। আমি দেরি না করেই ঢাকা চলে যাই। হলে গিয়ে দেখি, নিয়োগপত্র হাতে নিয়ে আমার বন্ধু কাঁদছে।

আমি ওকে বলি,

কাঁদবার অনেক সময় পাইবা। এখন বাড়ি চলো।

সে বলে,

আমি তো এখনো যোগদান করিনি।

আমি বলি,

সে কথা পরে হবে। সরকারের নিয়োগের চিঠি তো পাইছত?। চাচার অবস্থা ভালো না। তাড়াতাড়ি না গেলে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগপত্র যে পাইছিস সে কথাও চাচা নিজ কানে শুনে যেতে পারবে না।

আমরা রাতের ট্রেনেই ফিরে আসি। চাচার তখনও জ্ঞান আছে। তিনি তাকিয়ে আছেন। কুপির তেল ফুরিয়ে এসেছে। আমাদের বন্ধু চাচার মাথার কাছে বসে পিতার কপালে হাত রাখে। তিনি জিজ্ঞেস করেন,

তুমি ম্যাজিস্ট্রেট হইছ, বাজান?

আমাদের বন্ধু নিয়োগপত্রটা বাপের হাতে দিয়ে বলে,

হ আব্বা। আমি ম্যাজিস্ট্রেট হইছি। আমার পোস্টিং পাইছি। এক তারিখ আমি রাজশাহীতে যোগদান করব।

চাচা বলেন,

আমি দোয়া করি বাজান, আল্লাহ তোমার সম্মান অনেক বাড়িয়ে দিব।

আমাদের বন্ধু আমাদের বলে,

তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ডেকে আন। এখনই আব্বাকে হাসপাতালে নিতে হবে।

চাচা বলেন,

তার আর দরকার হবে না। আল্লাহর ডাক চলে আইছে। তার আগেই আমার আশা আল্লাহ পূরণ করছে। আমি ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ হইতে পারছি।

আমাদের সামনেই একজন ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ ম্যাজিস্ট্রেট পুত্রের হাত ধরে চোখ বুজলেন।

৩ আগস্ট ২০২১।

Print Friendly, PDF & Email
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর

Read Previous

কষ্টের হাসি

Read Next

সংযোগ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *