অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাসান মাহবুব  -
র‌্যাবিস

১.

সকালবেলা, যখন ছোট্ট মেয়েরা বাবাদের হাত ধরে স্কুলে যায়, যখন সিটি কর্পোরেশনের ঝাড়ুদাররা কমলা রঙের পোশাক পরে রাস্তাঘাট ঝাড়ু দেয়, এবং রাস্তার ধারে বসে যায় জমজমাট সবজি এবং সস্তা মাছের বাজার, তখন সিনথিয়া, একজন সাদা কলার কর্মজীবী কুকুর কর্তৃক দংশিত হলো। সিনথিয়া একজন দয়ালু এবং পরিশ্রমী মেয়েছেলে। সে সপ্তাহে ছয়দিন সকাল ছয়টার সময় ঘুম থেকে ওঠে, নাস্তা, গোসল আর পনের মিনিট পাওয়ার ওয়াক শেষ করে হনহন করে হাঁটতে থাকে বাসস্ট্যান্ডের দিকে। এই সময় ছোটো রাস্তার মোড়গুলিতে দেখা হয় কুকুর এবং বিড়ালদের সাথে। সিনথিয়া প্রায়শই থামে তাদের বিস্কুট এবং জল দেওয়ার জন্যে। কুকুরগুলি তার পরিচিত মানুষের মতোই হয়ে গেছে। তাকে দেখলে নানারকম আহলাদ করে, পিছে পিছে দৌড়ায়। তা ভালো। কিন্তু হুট করে এভাবে কামড় দিয়ে ফেলবে এটা কে ভাবতে পেরেছিলো! কামড়টা যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক। তার চেয়েও বড় কথা হলো, কুকুরটাকে দেখে জলাতঙ্কের ভাইরসাবাহী মনে হচ্ছে। দৃষ্টি কেমন উদভ্রান্ত। মুখ দিয়ে লালা বের হচ্ছে। এলাকার কুকুর হিসেবে সিনথিয়াকে দেখলে যেমন একটা আন্তরিক এবং সহৃদয়তা প্রকাশ পেতো তার লেশমাত্র নেই। এই কুকুরটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে নিষ্ঠুর, অপরাধী, এবং মরে যাবার আগে প্রাণী এবং বস্তুজগতের যতটা সম্ভব ক্ষতি করে যেতে চায়। সহৃদয় হোয়াইট কলার মেয়েছেলে সিনথিয়া পশুদের প্রতি সবসময় দয়ার্দ্র আচরণ করতো। কিন্তু এমন সহিংস আক্রমণের সম্মুখীন হবার পরে স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা প্রতিক্রিয়াবশত সে প্রতিহিংসা পরায়ন কুকুরটিকে খেদিয়ে দেওয়ার জন্যে কষে কয়েকটা লাথি মারলো। এতে করেও কুকুরটি দমে না যাওয়ায় পাশে পড়ে থাকা একটা রাবারের পাইপ দিয়ে প্রহার করা শুরু করলো। বাধ্য হয়ে তখন কুকুরটি চলে গেলো অন্য কারও মধ্যে জীবাণু ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে।

সাতসকালে কুকুরের কামড় খাওয়া কোন প্রীতিকর ব্যাপার না। সিনথিয়া বিরক্ত মুখে ব্যাগ থেকে স্যানিটাইজার বের করে দংশিত স্থানে মাখালো। বেশ জ্বলছে। রক্ত বের হচ্ছে। রক্ত একটা গ্ল্যামারাস ব্যাপার, যদি না গলা কেটে দু-টুকরো করা হয় অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গ খোয়া যায়। চিলতে খানেক কেটে গেলে, যা সামান্য পরিচর্যাতেই সুস্থ হয়ে ওঠে, সেটা প্রিয়জন এবং বন্ধুবান্ধবদের দেখালে তাদের মনোবৈকল্যের কারণ না হয়েই যথেষ্ট সহানুভূতি পাওয়া যায়। সিনথিয়ার সাথে বর্তমানে একজন মাদকসেবী, কিন্তু সুদর্শন এবং প্রতিভাধর ব্যাটাচ্ছেলে শিল্পীর সম্পর্ক হবো হবো করছে। তাকে দেখাবে বলে একটা ছবি তুলে রাখলো সে। এসব কাজকর্ম করতে গিয়ে তার পাঁচ মিনিট সময় নষ্ট হলো। সকালের এই সময়টা বেশ জটিল। সাতটার সময় মিরপুর-১ থেকে রওনা দিলে আটটার মধ্যে মতিঝিলে পৌঁছুতে পারবে। কিন্তু সাতটা পনেরো হয়ে গেলে নয়টা বেজে যাবে। তাই সিনথিয়া তার সুন্দর, পরিশীলিত, ধবধবে ফর্সা হাতের পরিচর্যা শেষ করে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। হ্যাঁ, এই ব্যাপারে সে সচেতন আছে যে, র‍্যাবিসের জীবাণুবাহী কুকুর কামড় দিলে জলাতঙ্ক রোগ হয়, এবং জলাতঙ্ক রোগ হলে মৃত্যু নিশ্চিত। এই মৃত্যুও স্বাভাবিক কোন মৃত্যু হবে না। অতীব যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। পানির তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসবে, কিন্তু পানি পান করতে গেলেই প্রচণ্ড ব্যথায় গলা সংকুচিত হয়ে যাবে। এই ধরণের কিছু ভিডিও দেখেছে সিনথিয়া। তবে এ নিয়ে এত চিন্তিত হবার কারণ নেই। কারণ জলাতঙ্ক হলে যেমন মৃত্যু নিশ্চিত, তেমনই জলাতঙ্কের টিকা নিলে মৃত্যু থেকে নিস্কৃতিও সুনিশ্চিত। এত সকালবেলা মনে হয় টিকা দেওয়ার লোকেরা এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। তাই এই মুহূর্তে সিনথিয়ার চিন্তায় অগ্রগণ্য হলো বাসে উঠে সময়মতো অফিসে পৌঁছোনো।

সময়মতো বাসে উঠল সে। সিটও পেলো। এবার একটু পড়াশোনা করা যেতে পারে ভয়ংকর রোগটি সম্পর্কে, সে ভাবলো। গুগলে তদন্ত করে সে জানতে পারলো যে জলাতঙ্ক প্রতিরোধে মোট ছয়টি টিকা দিতে হয়। প্রথমটি দংশিত হবার পর যত দ্রুত সম্ভব, এরপর তিন, সাত, চৌদ্দ, আটাশ এবং নব্বইতম দিনে। তাও ভালো। একটা সময় না কি ত্রিশটা টিকা দিতে হতো। সেটা যথেষ্টই যন্ত্রণাদায়ক ছিলো। এই আধুনিক সময়ের আশীর্বাদে কত সহজেই না নানান মৃত্যুমুখী বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে, এর পেছনে কত মনীষী, বৈজ্ঞানিক এবং গবেষকের কত বছরের গবেষণা আছে ভেবে কৃতজ্ঞতায় তাদের প্রতি চোখের জল বিসর্জন দিলো দয়ালু  সিনথিয়া। এখন, বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভাবা যাক। ওরা বলছে, দংশিত হবার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকা দিতে হবে। এই যত তাড়াতাড়িটা ঠিক কত, স্পষ্ট করে বলা নেই। আসলে ইন্টারনেটে সবকিছুর সমাধান পাওয়া যায় না। একটা মিনিমাম টাইম তো তারা বলবে, যার পরে পৌঁছুলে আর কিছুই করার থাকবে না, শুধু অপেক্ষা করতে হবে  গলা বুঁজে আসার এবং প্যারানয়ার। আজকে তার বেশ কিছু জরুরি কাজ আছে। প্রথমত,অফিসে সময়মতো পৌঁছুতে হবে। আজ হলো মাসের সেই তৃতীয় দিন, যেদিন বিলম্ব করলে বেতন কাটা যাবে। এর আগে দুদিন লেট হয়েছে।  দ্বিতীয়ত, একটা রিপোর্টের খানিকটা বাকি আছে, সেটা ঠিকঠাক করতে হবে। দশটার সময় একটা মিটিং আছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। এর আগের সপ্তাহের মিটিংয়ে সে আসতে পারেনি করোনার বুস্টার ডোজ নিয়ে কুপোকাত থাকার কারণে। এবারে সে আর কোনভাবেই মিস করতে চায় না। তো দেখা যাচ্ছে অফিসের প্রথম অর্ধে সে পুরো সময়টাই ব্যস্ত থাকবে। একটা থেকে দুইটা পর্যন্ত হলো লাঞ্চ আওয়ার। সিনথিয়া একজন স্বাস্থ্যবত্‌ উন্নত বিপাকক্রিয়া সম্পন্ন মেয়েছেলে। তাই তার ক্ষুধা বেশি পায়। একটা পনেরোর মধ্যে সে অফিসের ক্যান্টিনে বসে লাঞ্চ সেরে নিতে পারবে বলে আশা করা যায়। এরপর না হয় টিকা দেওয়া যাবে। আশেপাশে বেশ কিছু ফার্মেসি এবং হাসপাতাল আছে। সুতরাং দেড়টার মধ্যে টিকা দেওয়া হয়ে যাবে। সুন্দরমতো সবকিছুর পরিকল্পনা করে সিনথিয়ার প্রশান্তি বোধ হলো। সে সিটে গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

অফিসে পৌঁছেই কাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া কোনো স্বাস্থ্যকর অভ্যাস না। একজন প্রোডাকটিভ কর্মীকে অবশ্যই রিং-এ নামার আগে ওয়ার্ম আপ করে নিতে হবে। ডেস্কে বসে কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়াটাকে সিনথিয়ার একটা যুদ্ধ বলেই মনে হয়। তার আগে মিনিট দশেক সে সোশাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে। হাসি, কান্না, বিস্ময়ের অনুভূতি বিলি করে বেড়ায়। তার সদ্য পরিচয় হওয়া মাদকাসক্ত হবু প্রেমিকটি তাকে জিজ্ঞেস করলো সে কেমন আছে এবং একটা চুমু দিতে আগ্রহী কি না। সিনথিয়া হাসিমুখে তার আবদার পূরণ করলো। এরপর সে তার ব্যান্ডেজ করা হাতের ছবি পাঠালো। ছোট্ট দুটি ব্যান্ডেজ ঢেকে রেখেছে তার ক্ষতস্থানকে। হয়তো বা এর আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রাণঘাতী জীবাণু, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা খুব নিরীহ এবং আবেদনময়ী লাগছে। তার প্রেমিকটি মাদকাসক্ত হলেও অনুভূতিশীল। সে উদ্বেগ প্রকাশ করলো এবং  জানতে চাইলো কীভাবে কী হয়েছে।

“পাগলা কুত্তা কামড় দিছে”— এমন অশোভন প্রকাশ তার শিল্পী প্রেমিকটার অনুভূতি আহত করার পাশাপাশি  তাকে আতঙ্কিত করে ফেলবে, এমন আশঙ্কা থেকে সে করে মিথ্যে বললো- বাসের জানালার ভাঙা কাঁচের সাথে লেগে কেটে গেছে। সাথে এও জানালো যে সে সুচারূভাবে ড্রেসিং করেছে এবং ঔষধ দিয়েছে, তাই চিন্তার কিছু নেই। এসব শুনে আশ্বস্ত হয়ে প্রেমিকটি ঘুমুতে চলে গেলো। সারারাত জেগে সে গাঁজা টেনেছে আর ছবি এঁকেছে। অনেক কষ্ট হয়েছে তার। এখন বিশ্রাম দরকার।

সিনথিয়া একজন সুদক্ষ এবং সময়নিষ্ঠ কর্মী। সে যথাসময়ে তার মিটিংয়ের জন্যে প্রয়োজনীয় নথিপত্র প্রস্তুত করে ফেললো। তবে দশটা বেজে গেলেও মিটিং শুরু না হওয়ায় কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো সে। একটা পনেরোতে তার টিকা দিতে যাবার কথা। এসব মিটিং দেরিতে শুরু হলে কর্তাব্যক্তিরা নাওয়া-খাওয়ার কথা ভুলে যায়। সাধারণ কর্মচারীরাও ক্ষিধে চেপে নিজের এনার্জি বিলিয়ে দিতে থাকে। আর যদি তাদের মধ্যে কেউ দুপুরের খাবার না খেয়ে একটা কাজ সম্পন্ন করে, তাহলে তো কথাই নেই! হোয়াটজএ্যাপে, মেইলে, স্কাইপে ছড়িয়ে দিবে এই অসামান্য ত্যাগের খবর, “আলহামদুলিল্লাহ অমুক প্রজেক্টের প্রোপোজাল সম্পন্ন। দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি অবশ্য, সেটা কোনো ব্যাপার না”।

সাড়ে দশটা বেজে গেলে কর্মোদ্যমী সিনথিয়া কিছুটা উসখুস করা শুরু করলো। টিম লিডারকে গিয়ে বললো সে আধা ঘন্টার জন্যে একটু বাইরে যেতে চায়। টিম লিডার আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলো তার এত তাড়া কেন। সিইও এই এসে গেছেন বলে! গুগল ম্যাপে লোকেশন শেয়ার করা আছে। দেখিয়ে দিলো যে তিনি মাত্রা এক কিলোমিটার দূরের একটা সিগন্যালে আটকে আছেন। সিগন্যাল ছাড়লেই দুই মিনিটের মামলা। তিনি এও জানালেন সিনথিয়ার ওপর সিইও কত ভরসা করেন। তাকে না দেখলে তিনি উদ্বিগ্নতায় ভুগবেন। তার এমনি হাইপারটেনশনের সমস্যা। এসব শুনে দয়ালু সিনথিয়া আপ্লুত হয়ে গেলো। অনুপ্রেরণায় উদ্বেল হয়ে সে শক্ত হয়ে বসে নখ খুঁটোতে লাগলো।

পনেরো মিনিট পরেও দেখা গেলো গাড়িটা ঐ জায়গাতেই আটকে রয়েছে। টিম লিডার এই সুযোগে খোশগল্প আরম্ভ করলো। এর মধ্যে সিনথিয়ার হাতের ব্যান্ডেজটাও তার দৃষ্টিগোচর হলো। সে জানতে চাইলো কী হয়েছে। কুকুরের কামড়ের বিষয়টা সিনথিয়া এবারও এড়িয়ে গেলো। এই সুন্দর, শান্ত, কর্পোরেট ইউটোপিয়ায়, কিছুক্ষণ পর মিটিং রুমে জ্বলে উঠবে দামী বাতি, নিয়ে আসা হবে ঘন মালাইয়ের চা আর কলিজা সিঙ্গারা, আলোচনা হবে কোটি টাকার রেভিনিউ নিয়ে, সেখানে জলাতঙ্কের মতো একটা বদখত রোগের কথা বলে সবাইকে ঘাবড়ে দেয়ার কোনো মানে হয় না। নিজস্ব শারীরিক সংকটের পাশাপাশি সামষ্টিক মানসিক স্বাস্থ্যের কথাও সিনথিয়াকে ভাবতে হবে। সে ভাঙা কাঁচের ওপর দায় চাপিয়ে দিলো আবারও। টিম লিডার শুনে দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং সিনথিয়াকে সাবধানে চলার পরামর্শ দিলেন।

মিটিং এর প্রথম পর্ব শেষ হলো ঠিক একটার সময়েই। লাঞ্চ ব্রেকের পর ২-৩০ শার্প, মিটিংয়ের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে, জানানো হলো। যাক, সিনথিয়া স্বস্তি পেলো। তার মনে হলো এখন খেয়ে দেয়ে আসার চেয়ে তার বরং টিকা দেয়াটাই শ্রেয় হবে। যেহেতু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকা দেয়াটাই ভালো, তাই বেশি দেরি করলে সেটা বিচক্ষণতার পরিচায়ক হবে না।

দ্রুতপায়ে কিছুদূর হাঁটার পর তার মনে হলো হাতে ক্যাশ টাকা বেশি নেই, আর টিকা দিতে কত টাকা লাগে সেটাও সে জানে না। তাই বুথ থেকে কিছু টাকা তুলে নেয়া ভালো হবে। এখন হাতের কাছেই বুথ পাওয়া যায়। আগেকার দিন হলে ব্যাংকে যেতে হতো, এই কাউন্টার, সেই কাউন্টার! আর গেলেও দেখা যেত লাঞ্চ ব্রেক চলছে, সব মিলিয়ে একটা দীর্ঘ এবং বিরক্তিকর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো। আধুনিক সময়ে লাঘব হয়েছে এসব দুর্দশা। এ সমস্ত আশীর্বাদের কথা মনে করে আবারও অনুভূতিশীল সিনথিয়ার চোখে জল এলো। বুথ থেকে হাজার দুয়েক টাকা তুলে সে গেলো নিকটস্থ ফার্মেসিতে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলো তারা র‍্যাবিসের টিকা রাখে না। কোথায় টিকা দেয়া হয় তাও তারা জানে না। আরো দুইটি ফার্মেসি ঘুরে একই কথা জেনে সিনথিয়া এই অনগ্রসর ব্যবসায়ীদের প্রতি ক্ষুব্ধ হলো। এরা কবে নিজেদেরকে আপডেটেড করবে? বিরক্ত হয়ে সে ফার্মেসিতে ঘোরা বন্ধ করলো। কাছেই একটা বড় হাসপাতাল আছে। সেখানে গিয়ে সে টিকাটা নিয়ে নিবে। কিন্তু হায়! তারা তাকে জানালো যে র‍্যাবিসের টিকা দিতে হলে মহাখালি সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে যেতে হবে। মতিঝিল থেকে মহাখালি! এই পিক টাইমে! কখন যাবে আর কখন আসবে! দুইটা ত্রিশে মিটিং। অফিসের পর যাবে না কি? কিন্তু তখন যদি বন্ধ হয়ে যায়? বুদ্ধিমতী সিনথিয়ার নিজেকে একটা গবেট গুবড়ে পোকা মনে হতে লাগলো। নিজের জন্যে সে না জানি কী ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনছে! সুতরাং সে বাঁচার আদিম তাগিদে নিরুপায় হয়ে টিম লিডারকে জানিয়ে দিলো যে তার শরীর খুব খারাপ লাগছে এবং সে বাসায় যেতে চায়। ও তরফের নিস্প্রাণ গাঁইগুঁই আর লুকোনো হুমকিকে পরোয়া না করে চেপে বসলো ভাড়ায় চালিত মোটরবাইকে।

গুগল ম্যাপ থাকা সত্তেও আনাড়ি চালকের অদক্ষতায় হাসপাতালটি খুঁজে পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো তাদের। হাতিরঝিলের ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় ঠিক কোন রাস্তায় যেতে হবে এই সূক্ষ্ণ হিসাব গুগল ম্যাপ ঠাওরাতে ব্যর্থ হলো। ফলে পৌঁছুলো তারা আধা ঘন্টা দেরিতে।

হাসপাতালের টিকা প্রদানকারী লোকটা জিজ্ঞেস করলো কখন কুকুরটি কামড় দিয়েছে। সকাল সাতটার কামড় নিয়ে সাড়ে তিনটায় টিকা দিতে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করে যখন জানলো যে পরিশ্রমী মেয়েছেলে সিনথিয়া মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলো, তখন তার এই কর্মস্পৃহা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে সে আরেকটু হলেই জড়িয়ে ধরার উপক্রম করেছিলো। সে সিনথিয়াকে জানালো তিন মাস সময়ের মধ্যে তাকে মোট আটটি টিকা দিতে হবে। টিকা দেয়ার পরে যখন হাতা গুটিয়ে সিনথিয়া চলে যাবে, তখন লোকটি প্রসন্ন কণ্ঠে জানালো যে এত দেরি করে আসার ফলে এতক্ষণে ভাইরাস ছড়িয়ে গেছে বলে তার আশঙ্কা হচ্ছে। মানবিক মনের অধিকারী সিনথিয়া লোকটির আনন্দ দেখে দ্রবীভূত হলো। আধুনিক পৃথিবীতে  পরস্পরের প্রতি এইসব ছোটোখাটো অনুভূতির বিনিময়ই তো তৈরি করে একটি গতিশীল এবং টেকসই সমাজ ব্যবস্থা!

২.

দীর্ঘ তিন মাসে শেষ হলো সিনথিয়ার টিকা নেয়ার পর্ব। সিনথিয়া এখন  আগের চেয়ে ভালো বোধ করে। সকালে পনেরো মিনিট পাওয়ার ওয়াকের বদলে জগিং শুরু করেছে। নাস্তায় চিনি জাতীয় পদার্থ বাদ দিয়েছে। রাতে কার্বোহাইড্রেট কম খায়। পানি খায় চার লিটার করে। এর ফলে তার ত্বক হয়েছে উজ্জ্বল ও সুন্দর, শরীরের নিম্নাংশ হয়েছে আরও আকর্ষণীয়। এর মধ্যে বেতনও বেড়েছে এক প্রস্থ। এখন মাঝে মধ্যে বাসের বদলে সিএনজিতেও চড়ে। মাদকাসক্ত প্রেমিককে গাঁজার পাশাপাশি বিদেশি মদ খাওয়ার টাকাও দেয়। সেদিনের সকালের দুঃস্মৃতি ভুলে গিয়ে এখনও সে রাস্তার কুকুরদের সোহাগ করে। র‍্যাবিসের টিকা তো দেয়াই আছে, চিন্তা কী! এখন এক-আধটা কামড় খেলেও সমস্যা নেই। তবে মূল প্রশ্ন যেটা, সেটা হচ্ছে ইতিমধ্যেই তার শরীরে র‍্যাবিসের জীবাণু ঢুকে গেছে কি না। সেদিন প্রায় আট ঘন্টা দেরিতে টিকা দেয়াটা জীবন সংশয়ের কারণ হবে না তো? র‍্যাবিসের জীবাণু কখন কাজ করা শুরু করবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। সাত দিন থেকে এক বছরের মধ্যে হতে পারে। কেবল তিন মাস পার হয়েছে। এখনও বলা যায় না কিছু। তার স্বাস্থ্য আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে, মন আগের চেয়ে চনমনে হয়েছে, আর্থিকভাবেও স্বচ্ছল হয়েছে আগের চেয়ে, জীবনযাত্রার এই ঊর্ধমুখী উন্নয়ন সূচক তাকে ভীষণ মৃত্যুর কথা ভাবার সময় দিচ্ছে না তেমন। মৃত্যুকে নিয়ে একান্তে আতঙ্কযাপন করার একটা ঐকান্তিক ইচ্ছে তার  ভেতর কাজ করে, কিন্তু তার প্রতিদিনকার সুখ এবং সমৃদ্ধি তাকে সে অবকাশ দেয় না।

এক বিকেলে সে ধানমন্ডি লেকের ধারে বসে ছিলো তার প্রেমিকের সাথে। তারা খাচ্ছিলো চিনাবাদাম এবং রং চা। এই সস্তা খাবারও এক ধরণের শৌখিনতা! চাইলেই তো বসা যায় আলো আর ফুল দিয়ে সাজানো অভিজাত খাবারের দোকানে। কিন্তু সেগুলি একঘেয়ে হয়ে গেছে। সিনথিয়া তার প্রেমিকের কাঁধে মাথা গুঁজে তাকিয়ে ছিলো শান্ত হ্রদের দিকে। তার প্রেমিক মাঝেমধ্যে বুকে এবং নিতম্বে হাত দেয়ার চেষ্টা করছিলো। অন্ধকার হয়ে এসেছে, এবং মানুষজন খুব বেশি নেই বলে সিনথিয়া বাধা দিচ্ছিলো না। উপভোগও করছিলো না, কিন্তু প্রেমিকদের হাতে রাখতে হলে এসব সহ্য করতেই হয়। সিমেন্টের চাতালে অলস পড়ে ছিলো তাদের প্রেমো কামের ছায়া। হ্রদ থেকে একটা নীল পাখি উড়ে এসে আগ্রহ ভরে দেখছিলো তাদের। হাওয়ায় ভেসে আসা শুকনো পাতা পড়ছিলো তাদের চুলে। এমন সুখময় সময়ে হঠাৎ করে সিনথিয়ার শরীর খারাপ করতে শুরু করলো। হঠাৎ করেই একটা ভয়ানক দুর্বলতার অনুভূতি। মনে হচ্ছিলো যেন শরীর থেকে সমস্ত রক্ত কেউ সিরিঞ্জ দিয়ে এক নিমিষে টেনে নিয়েছে। হঠাৎ করে এমন হওয়ার কারণ বুঝতে পারলো না স্বাস্থ্যবতী যুবতী সিনথিয়া। মৃদু শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। সে সোজা হয়ে বসলো। তার প্রেমিক তাকে জিজ্ঞেস করলো তার কী হয়েছে।

কী হয়েছে সেটা বিস্তারিত বলা এই মুহূর্তে সমীচীন হবে না বলে মনে করলো সিনথিয়া। হতে পারে র‍্যাবিসের ভাইরাস তার মগজে পৌঁছে গেছে। হতে পারে এটা তার প্রথম ধাপ। যদি র‍্যাবিস হয়েই থাকে, জানা যাবে তিনদিনের মধ্যে। এর মধ্যে তার মধ্যে যে লক্ষণগুলি প্রকাশ পাবে সেগুলি হলো এ্যাংজাইটি, প্যারানয়া, জ্বর, র‍্যাশ, ক্ষুধা এবং তৃষ্ণার পরিবর্তন, ইত্যাদি। তারপর এসে যাবে সেই অপ্রত্যাগামী শেষ দশা। তখন আর সে কাউকে চিনতে পারবে না। তৃষ্ণায় কাতর হবে, কিন্তু পানি পান করতে পারবে না। তখনও কি তার প্রেমিক তাকে চুম্বন করতে এবং তার নিতম্ব এবং বুকে হাত বুলিয়ে দিতে চাইবে? এসব কথা মনে হলে তার বিরক্ত লাগে। সে রূঢ়ভাবে তার প্রেমিকের হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

জানিয়ে দেয় যে সে চলে যাবে। তার প্রেমিক একটু  হকচকিয়ে যায় এমন আচরণে। সে কোনো ভুল করে ফেললো না কি এটা ভেবে ভয় পায়। আজকে তার কিছু টাকা দরকার ছিলো। ভয়ে ভয়ে জানতে চায় কী কারণে সে চলে যেতে চাইছে। সিনথিয়া তাকে বলে, সে পরে জানাবে, অথবা যদি নাও জানায় সে এমনিতেই জানতে পারবে। বিভ্রান্ত প্রেমিককে অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে সিনথিয়া চলে আসে সরোবরের আঁধারঅঞ্চল থেকে।

রাতে তার জ্বর আসে। জ্বরের সাথে সাথে চলে আসে এ্যাংজাইটি। সে বুঝতে পারে না এটা সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করে, না কি আসলেই র‍্যাবিসের উপসর্গ হিসেবে এই জ্বরটা এলো। সিনথিয়া সুখ এবং সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হলেও ঔষধের তাকে রিলাক্সিন এবং ঘুমের ঔষধ সবসময় রাখে। অবিরত সুখকে সে বিশ্বাস করে না। সে দুটো স্নায়ু শান্ত করার ঔষধ খেয়ে নেয়। স্নায়ু শান্ত হয় না। জ্বর কমে না। ক্ষুধা লাগে না। যখন সে হয়ে উঠছিলো সুন্দর আর পরিপূর্ণ, তখনই এমন ভয়ংকর পরিণতি তাকে নিয়ে যাবে দোযখের দোরগোরায়, এটা প্রাচীন গ্রিক ট্রাজেডির মতোই অবিশ্বাস্য লাগে। তাপে আর বাষ্পে ভাসতে ভাসতে তার মনে হয় সে বাস করছে কোনো এক মহাশক্তিধর দানবের স্বপ্নের ভেতর।

র‍্যাবিস।

১০০% ফার্টিলিটি রেট।

কোনো নিস্তার নেই।

মানে হয়? আরে ওসব কিছু না। ঠিকমতো ঘুম দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। সিনথিয়া আরো দুটি ঘুমের ঔষধ খেয়ে নেয়।

ঘুম আসছে না। বেড়ে চলেছে তাপ। হ্যালুসিনেশন হচ্ছে না কি? ঘরটা মনে হচ্ছে ছোটো হয়ে আসছে। পিপাসা লাগছে? এখন কি পানি খেতে গেলে আতঙ্কে তার গলার পেশী সংকুচিত হয়ে আসবে? ভয় ঠিক না, এক ধরণের বুনো কৌতূহল নিয়ে সে পানির বোতলটা টেনে নেয়। তারপর দিব্যি ঢকঢক করে আধা বোতল পানি শেষ করে ফেলে। যাক, এখনও সেই দশায় উপনীত হয় নি। কিছুটা স্বস্তি পায় সে। এখন কি ঘুমিয়ে পড়া যাবে?

না। শুলেই শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। প্যানিক এ্যাটাক নিশ্চয়ই। র‍্যাবিসের মতো অতিপ্রাকৃত বাস্তবতায় পৌঁছোনোর সময় এখনও আসেনি। সিনথিয়া নিশ্চিত জানে।

ওহ! অথচ এই নিশ্চিত নির্ভরতায় বারবার ভয়ের অনুভূতি এসে বাগড়া দিচ্ছে। ঘরটা আরও ছোট মনে হচ্ছে। নার্ভাস ব্রেকডাউন। এখনও রাত দশটা বাজেনি। বাকি রাত কাটবে কীভাবে? অথবা, আদৌ কি কাটবে বাকি রাত? তার দরকার বিশুদ্ধ বাতাস। ফুসফুসে এক ঝলক বিশুদ্ধ বাতাস পেলেই সে এই দূষিত অনুভূতি থেকে মুক্তি পাবে।

সিনথিয়া বের হয়। দ্রুত হাঁটতে থাকে। এই তো ভালো লাগছে। আতঙ্ক কেটে যাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তায়, রাতের নির্জনতায় নির্জলা বাতাস এসে সখ্য করছে ফুসফুসের সাথে। সিনথিয়া অফুরান প্রাণশক্তি অনুভব করে। না, তার র‍্যাবিস হয়নি। হবে না। হতে পারে না। সে রাতভর হেঁটে বেড়াতে পারবে এই বাতাসের নগরে। নিয়মিত শরীরচর্চা করা আর সুষম খাবার গ্রহণের ফলে অর্জিত শক্তি সে এখন সাচ্ছন্দ্যেই কাজে লাগাতে পারবে। জমাট বাঁধা আতঙ্ককে দুধের সরের মতো সে ফেলে দেয়।

তারপর দৌড়োনো শুরু করে। তার খুব ভালো লাগছে। তার হালকা লাগছে। নিজেকে মনে হচ্ছে  পেঁজা তুলোর মতো। দৌড়ে দৌড়েই সে পেছনে ফেলে দেবে প্রাণঘাতী র‍্যাবিস অথবা ছোঁচা প্রেমিক, রক্তচোষা ঊর্ধতন অথবা মার্কেটিং প্ল্যান নষ্ট করে দেয়া বেয়াড়া কনজিউমারকে। আত্মীয় স্বজনদের শ্যেন দৃষ্টি, খাবারে বিষ, সবকিছু থেকে সে দূরে চলে যাবে। দৌড়াতে দৌড়াতে বড় রাস্তা পর্যন্ত এসে যায় সে। এখন সে উপভোগ করবে সুখ ও সমৃদ্ধিময় রাজ্যের বিবিধ ভোগ্যসামগ্রী।

ফিরে আসা যাক তবে সুখ আর সমৃদ্ধির রাজ্যে! পাশের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কিছু কিনে খাওয়া যাক স্বাস্থ্য উদযাপনের জন্যে। তাদের কোম্পানির নতুন বাজারে আসা চানাচুর দেখা যাচ্ছে। এটা ভালো ব্যবসা করছে নতুন প্রোডাক্ট হিসেবে। যেভাবে মার্কেট দখল করছে, সেটা অব্যাহত থাকলে এই বছরের শেষে মার্কেট লিডার হয়ে যেতে পারে। আর তাহলে বছর ফুরোনোর আগেই সিনথিয়া পেয়ে যাবে আরেকটা বড় ইনসেন্টিভ! তখন সে আয়েশ করে চিবিয়ে চিবিয়ে টাকাগুলি খাবে।

কিন্তু গলা ব্যথা করছে কেন? কণ্ঠনালী এমন শক্ত বোধ হচ্ছে কেন? “ও কিছু না” ভঙ্গিতে সিনথিয়া গলা খাকরি দিয়ে অস্বস্তিটা দূর করার চেষ্টা করলো। এরপর দোকান থেকে এক প্যাকেট চানাচুর কিনে কোম্পানির প্রবৃদ্ধির অংশীদার হলো।

৩.

চানাচুর নিয়ে এসে সে দাঁড়ালো ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে। তার মনে প্রদাহজর্জরিত গলা বলছে এই চানাচুর খেতে গেলেই সে গলায় আটকে মরে যাবে। এটা কি র‍্যাবিসের একটি পর্যায়? মনের মধ্যে ইতিবাচকতা বজায় রেখে, সাহস না হারিয়ে সে চনমনে ভাবে প্যাকেটটা খুলতে লাগলো। আর তখন ছয়তলা দালানের ওপর থেকে তার মাথার ওপর একটা ইট এসে পড়লো। প্রচণ্ড আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে। হ্যাঁ, এবার নিশ্চিত হওয়া যায়, যে সে কিছুক্ষণ পর মারা যাবে। এই তো, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, দৃশ্য আবছা হয়ে আসছে, ঘন অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে সব। আর কিছুক্ষণ পরেই নেমে যাবে পর্দা। সাঙ্গ হবে কাহিনি।

যাক, র‍্যাবিস হয়েছে কি হয়নি, এই দুশ্চিন্তা থেকে তো বাঁচা গেলো! এই আত্মতৃপ্তি নিয়ে সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, সাদা, ফর্সা, হোয়াইট কলার যুবতী সিনথিয়া চোখ বুজলো।

 

+ posts

Read Previous

রীতা ইসলামের যুগল কবিতা

Read Next

শিকড়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *