অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মো. জাকির হোসেন -
শোধ

তেলিখালি বাজারের এখন হতশ্রী অবস্থা। প্রতিবছর নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বাজারটি ছোট হতে হতে এখন আর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। আগের যৌবন বা জৌলুস হারিয়ে গেছে। আগে লঞ্চঘাটে ঘণ্টায় ঘণ্টায় এসে লঞ্চ ভিড়ত। ঢাকা-বাগেরহাট, বারিশাল-বাগেরহাটসহ বিভিন্ন রুটের লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করত। এখন লঞ্চ চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বললেই চলে। কালেভদ্রে লঞ্চ ভেড়ে লঞ্চঘাটে। আগে বাজারে মানুষ গমগম করত, এখন সেই মানুষ নেই। থাকবে কী করে?

গ্রাম এখন অনেকটাই তরুণ-যুবক শূন্য। মানুষ এখন শহরমুখী। গ্রামে যারা পড়ে আছে তাদের বেশির ভাগই অচল বৃদ্ধ অসহায় মানুষ। তবে এক শ্রেণি আছে যারা ইচ্ছে করেই শহরমুখী হচ্ছে না। গ্রামই যেন তাদের কাছে স্বর্গ। শহরকে তারা কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারে না। এদের সংখ্যা অবশ্য কম। তবে তেলিখালি গ্রামের উন্নতিও চোখে পড়ার মতো। আগে যেখানে মানুষকে কাঁচা রাস্তা দিয়ে লুঙ্গি গুটিয়ে চলাচল করতে হতো আর সন্ধ্যার পর কুপি জ্বালিয়ে পথ চলতে হতো, সেটা আর করতে হয় না। এখন রাস্তাঘাট পাকা হয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গেছে। পোশাকআশাকেও পরিবর্তন এসেছে। এখানকার ছেলেমেয়েরা এখন শহুরে কায়দায় কাপড়চোপড় পরে। দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই এখন অন্যরকম। নদী ভাঙনের এলাকা সত্ত্বেও হতদরিদ্র লোকের সংখ্যাও কমে গেছে। শিক্ষিতের হার বেড়েছে। সব মিলিয়ে পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মতো। এক সময় যা ছিল কল্পনারও অতীত।

মুবিন আর রণি দুই বন্ধু। পাশাপাশি বাড়ি। একই সাথে পড়ালেখা করেছে। রণি ঢাকায় গিয়ে একটা কারখানায় চাকুরি নিয়েছে। মুবিন বাড়িতেই পড়ে আছে। চাকরি বাকরি পায়নি। অবশ্য চাকরির জন্য তেমন চেষ্টাও করেনি। বাজারে দোকান আছে কিন্তু সেই দোকানে বসে ব্যবসা করার মতো ধৈর্য মুবিনের নেই। বাবা-মা মুখ ফুটে কিছু না বললেও দিনে দিনে মুবিনের উপর বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। সহায়-সম্পদ যতই থাকুক না কেন বসে বসে কত দিন আর চলা যায়! বাবা মায়ের আচরণে মুবিনও অবশ্য বুঝতে পেরেছে যে, বেকার ঘুরে বেড়ানোর বিষয়টি তারা ভালো চোখে দেখছেন না।

ইতিমধ্যে মুবিন রণিকে ফোন করে ঢাকায় ওর জন্য একটা চাকরি ব্যবস্থা করার কথা বলেছে। মুবিনের কাছ থেকে ফোন পেয়ে রণি খুশিই হয়েছে। যাক মুবিনটার চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। একটা মানুষ কাজ-কর্ম না করে কীভাবে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে! মুবিনের কাজের জন্য চেষ্টা চালাবে রণি। মুবিনের জন্য অবশ্যই কিছু করতে হবে। এটা করবে দায়মুক্ত হওয়ার জন্য। কেননা মুবিনের কাছে ও অনেক ঋণী। মুবিন যেন কখনও রণির দিকে আঙুল তুলে বলতে না পারে, তোর মেট্রিক পরীক্ষার যাবতীয় খরচ আমি দিয়েছি। আমি তোর পড়ালেখার ব্যাপারে সাহায্য সহযোগিতা করেছি। আমি না থাকলে তোর পড়ালেখা হতো না। চাকরি-বাকরি কিছুই হতো না। এসব কথা মুবিন যাতে বলতে না পারে সেজন্যই মুবিনের জন্য কিছু করতে হবে।

রণি ঢাকা থেকে আজ বাড়ি ফিরবে। ঢাকা-মঠবাড়িয়া রুটের গাড়িতে আসবে। ও সকালের বাসে উঠেছে। বিকাল পাঁচটার আগে বাস ইকরি আসার কথা নয়। কিন্তু মুবিন বন্ধুর জন্য অধৈর্য হয়ে ওঠে। বিকেল চারটার দিকেই ইকরি বাসস্ট্যান্ডে চলে আসে ও। ইকরি তেলিখালি পাশাপাশি ইউনিয়ন। ইকরিতে মুবিনের অনেক বন্ধুবান্ধব। তাই বাসস্ট্যান্ডে আসার পর বেশ কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা হলো ওর। অনেক দিন পর দেখা হয়েছে বলে অনেকেই বেশ খাতিল যত্ন করল। জোর করে চা-নাশতা খাওয়ালো। ইকরি এসে মুবিনের সময়টা ভালোই কেটে গেল।

রণি সাড়ে ছয়টার দিকে বাস থেকে নামল। ওর দুই হাতে ভারী দুটি ব্যাগ। মনে হচ্ছে ঢাকা থেকে মেলা জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। মুবিন একটা ব্যাগ ওর হাতে নিয়ে নিল। ওদের হাঁটতে হলো না। পাশেই পরিচিত রিকশা দাঁড়ানো ছিল। ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরে কেউ সাধারণত রিকশা ভাড়া নিয়ে কথা বলে না। রণিও বলল না। মালপত্র নিয়ে উঠে বসল রিকশায়।

অনেকদিন পর রণিকে দেখল মুবিন। অনেক পরিবর্তন এসেছে রণির মধ্যে। গায়ের রঙটা মনে হচ্ছে আরও ফর্সা দেখাচ্ছে। চেহারার মধ্যে সেই গ্রাম্য ভাবখানা আর নেই। ওর মধ্যে কেমন শহুরে শহুরে একটা ভাব। কথা বলে মেপে মেপে। কথার মধ্যে আগের মতো উচ্ছ্বলতা নেই। মুবিন একটার পর একটা কথা বলে যায়। কিন্তু রণি হু-হা করে উত্তর দেয়।

গ্রামের মধ্যে দিয়ে পাকা রাস্তা। এখানে শহরের মতো জ্যাম নেই। অনেকদিন পরে রণি গ্রামে এসেছে। এরই মধ্যেই অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রাস্তার পাশে নতুন নতুন দোকান-পাট, স্কুল, ক্লাব এসবের দিকে নজর পড়ল রণির। এখন দিন বদলের পালা। সবকিছু দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। দেখতে দেখতে রিকশা তেলিখালি বাজারে কাছাকাছি চলে এসেছে। রণিদের বাড়ি বাজারের পাশেই। রাস্তা থেকে দুটি বাড়ি পরেই ওদের ঘর। রিকশাওয়ালা মেইন রাস্তা থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে সামান্য কাঁচা রাস্তা দিয়ে রণিদের ঘরের সামনে নিয়ে রিকশা থামাল। ঘরের সামনে রিকশা দেখে দুই তিন ঘর থেকে মানুষ বেরিয়ে এলো। মুহূর্তের মধ্যে মা, চাচি, খালা ফুফুরা এসে জড় হয়েছে উঠানে। আশেপাশের বাড়ি থেকে ছোট ছোট কিছু ছেলেমেয়ে এসেও হাজির হয়েছে। ঢাকা থেকে কেউ এলে এমনি করে মানুষ জড় হয় সবসময়। ঢাকা থেকে কে কি নিয়ে এলো এটা একটা আগ্রহের বিষয়। রণির মা এসে রণির গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেল।

‘রণি তুই এত হুগাইয়া গেছ ক্যা’
মায়ের আদুরে কথা শুনে রণি হাসে।
মুবিন বলল, ‘খালা রণি তো আরো মোটা হয়েছে, ফর্সা হয়েছে।’
রণির মা বলল, ‘মোডা অইলে কী অইবে। মুখটা কেমন হুগনা দেখছ?’
পাশের বাড়ির একজন বলল, ‘মায়ের চোহে পোলাপান সব সময় হুগনাই থাহে।’
এরপর রিকশাওয়ালা নিজেই মালপত্র ঘরে তুলে দিল। রণি উঠে ওদের খোলা বারান্দায় বসেছে। ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আত্মীয়স্বজন। রণির মা বড় একটা তালপাতার পাখা নিয়ে বাতাস করছে ছেলেকে।

রণি বলল, ‘গরম লাগছে না তো। বাতাস দেয়ার দরকার কী!’
মা রণির গলায় পিঠে হাত দিয়ে বলল, ‘তুই তো ঘামাইতাছো।’
ছেলের প্রতি মায়ের দরদ দেখে অভিভূত মুবিন। ও তাকিয়ে থাকে রণির মায়ের দিকে। তারপর বলল,‘খালা, খালুজানকে দেখছি না কেন?’
‘তোমার খালু রণি আইবে হুইনা বাজারে গেছে ইলশা মাছ আনতে। জোয়ারের সময় যারা জাল পাতছে হেরা জাল টাইনা আইলে মাছ নিয়া আইব। রণির আমাগো কচা নদীর তাজা ইলশা পছন্দ। আমি কইছি যদি জেতা ইলশা পাও হেইডাই কিনা আনবা। দাম যা নেয়, নেবে। ঢাকার মানু তো আর তাজা ইলশা দেহে না। এতদিন পর বাড়ি আইছে রণি। ওরে মন বইরা ইলশা খাওয়ামু।’
‘খালা, বড় সাইজের একটা আস্ত ইলিশ রেধে রণির প্লেটে দেবেন। ঢাকা গিয়ে যাতে গ্রামের কথা আর ভুলতে না পারে।’
এ কথা শুনে রণি মুবিনের দিকে তাকায়।
‘দোস্ত, আমি কী গ্রামের কথা ভুলে গেছি?’
‘মনে রেখেছ, তাই বা ভাবি কী করে? আগে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর করতি ইদানিং তো মনেই কর না।’
‘যেভাবে ব্যস্ত থাকি। ইচ্ছা থাকলেও তো কারও সাথে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয় না।’
‘তাই বলে নাড়ীর টান, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সব ভুলে যাবি?’

রণি মুবিনের কথার কোনো জবাব দেয় না। কথা বলতেও ইচ্ছে হয় না রণির। চারপাশে তাকে নিয়ে এত আগ্রহ এত আয়োজন সব কিছু কেমন বাড়াবাড়ি মনে হয়। বাড়ি ছেড়ে ঢাকা যাওয়ার পর এই প্রথম রণি বাড়িতে এসেছে। তাও মনের টানে নয়। মা প্রায়ই কান্নাকাটি করে। অনেকটা মায়ের কথা ভেবেই রণির বাড়ি আসা। রণির বাবা কাশেম পোদ্দারের রণির বাড়ি আসা না আসা নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই। ছেলে ভালো থেকে নিয়মিত বাড়ি টাকা পাঠালেই হলো। রণিরও একই ভাবনা। এত ব্যস্ত জীবন যাপন করে বাড়িতে আসার সময় কোথায়? বাড়ি আসা মানে কিছু মানুষের আবদার রক্ষা করা। কিছু আবেগ ভালোবাসার আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়া। রণির কাছে এসবের কিছু মূল্য নেই। ওর টাকা চাই। অনেক টাকা! উপরের ওঠার সিঁড়ির সন্ধান ও পেয়ে গেছে। এখন আর পিছু ফিরে তাকানোর সময় নেই। শুধু তরতর করে সামনে এগিয়ে যাওয়া।

রণির নীরবতা দেখে মুবিন বলল, ‘রণি, আমি এখন যাই। সময় পেলে কাল বিকেলে বাজারে দেখা করিস।’
‘এখনই চলে যাবি?’
‘যাই। জার্নি করে তুই ক্লান্ত। ক্লান্তি কাটুক। পরে কথা হবে।’
মুবিন চলে আসার জন্য পা বাড়াবে ঠিক তখনই কোথা থেকে রণির মা এসে মুবিনকে টেনে ধরল।
‘মুবিন এহন কোথায় যাও! মুই তোমার জন্য ভাত রানছি। তোমার খালু মাছ লইয়া আইলে আর বেশি সময় লাগবে না। তুমি না খাইয়া যাইতে পারবা না। এতদিন পর তোমার দোস্ত আইছে। ঘরে বইয়া তার লগে কতা-টতা কও।’

মুবিনের জন্য রণির মায়ের অন্তর পুড়ে গেলেও রণি তেমন আগ্রহ দেখায় না। রণি একবারের জন্যও মুবিনকে বসতে বলে না। মুবিন আর দেরি করে না। সে বলল, ‘যাই খালা। আরেকদিন আসব।’
‘রণি থাকতে সব সময় আমাগো বাড়ি আইতা। এহন তোমারে আর দেহি না। যাইও না মুবিন। রণির লগে ভাত খাইয়া পরে যাইবা।’
সম্ভবত মায়ের অতি আগ্রহের কারণেই রণি বলল, ‘আর একটু বস। ভাত খাইয়া দুজন বাজারে যাব।’
‘নারে, আজ আর তোর বাজরে গিয়ে কাজ নেই। কাল বিকেলে আসিস। আমি বাজারে থাকব।’ বলেই মুবিন পাকা রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করে। রাস্তার মুখে রণির বাবার সাথে দেখা হয়ে যায়। তার হাতে মাঝারি সাইজের একটা ইলিশ মাছ ঝুলানো। মাছটি জেলেদের নৌকা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। এখনও লাফাচ্ছে মাছটি। মুবিন কাসেম পোদ্দারকে দেখে সালাম দিল।
‘খালুজান জেতা মাছ নিলেন কোথা থেকে?’
‘জেলে নৌকা থেকে মাছ বাজারে ওঠার আগেই ঘাট থেকে নিয়ে নিলাম। তোমার খালায় জেতা মাছ দেইখা নিতে কইলো। অনেক দিন পর রণি ঢাকা থেকে বাড়ি আইছে ও জেতা মাছ দেইখা খুশি অইব।’
‘হু। ঠিকই বলছেন খালু। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যান। ইলিশ মাছ তো বেশিক্ষণ জেতা থাকে না।’
‘হ যাইতেছি। কিন্তু তুমি কই যাও?’
‘আমি বাজারের দিকে যাচ্ছি।’
‘এইডা কেমন কতা কইলা, মুবিন? এতদিন পর তোমার পরাণের দোস্ত ঢাকা থেকে আইল। আর তারে থুইয়া তুমি একা বাজারে যাইতেছ! চল, আমার লগে ঘরে চল। তোমার খালার মাছ রানতে দেরি লাগবে না। দুই দোস্ত খাইয়া বাজারে যাইবা। বাড়ির লগে বাজার। কোনো চিন্তার কারণ নাই। চা-বিস্কুট খাইতে খাইতে দোস্তের লগে গাল-গল্প করবা।’

মুবিন দাঁড়ায় না। সে হাঁটতে থাকে বাজারে দিকে। কাসেম পোদ্দারও বেশিক্ষণ অপেক্ষা করে না। মাছটা জেতা থাকতে থাকতেই সে ঘরে পৌঁছাতে চায়।

মুবিনের বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে। কিন্তু মুবিনের পড়াশোনায় কোনো দিনই মনোযোগ ছিল না। বাবা রহিম শেখের গুতাগুতিতে কোনো রকম আইএ পাস করেছে। তারপর অনেক বলে কয়েও ছেলেকে পড়াতে পারেনি। বাজারে তার বিশাল ব্যবসা। ছেলে সারাজীবন বসে খেলেও সম্পদ শেষ হবে না। তারপরও একটা মানুষ কাজকর্ম না করে বসে থাকে কীভাবে? কর্মহীন মানুষ তো স্রোতহীন নদীর মতোই। এক সময় শুকিয়ে যায়। মরে যায়। অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে।

মুবিনের কথা ভেবেও রহিম শেখের আক্ষেপ হয়। ছেলেটার কী হবে বুঝতে পারে না। মুবিন যদি ব্যবসাটা দেখাশোনা করত তবুও চিন্তা ছিল না। তাও করল না। সারাদিন শুধু পরপোকার নিয়ে আছে। নিজের দিকে কোনো খেয়াল নেই। নিজে পড়াশোনা শেষ করল না অথচ অন্যের লেখাপড়া নিয়ে তার মাথা ব্যথার অন্ত নেই। কে বইয়ের অভাবে স্কুলে যেতে পারল না, কে পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করতে পারল না। এ নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই। নিজের জন্য ওর কোনো খরচ নেই তেমন। সব খরচ শুধু বন্ধু-বান্ধব, অসহায় আর অভাবীদের পেছনে। এ নিয়ে রহিম শেখের অবশ্য মাঝে মাঝে গর্বও হয়। ছেলেটা উচ্চ শিক্ষিত হয়নি তাতে কী? মানুষ তো হয়েছে। আজকালকার দিনে পরপোকার করার ইচ্ছা কজনের মধ্যে থাকে। কাসেম পোদ্দাররে ছেলে রণির আইএ পর্যন্ত পড়ার খরচ বলতে গেলে সবই দিয়েছে মুবিন। এতেও রহিম শেখের বুকটা গর্বে ফুলে গেছে। রণি এখন চাকরি নিয়ে মা বাবার দেখাশোনা করছে। এটাও তো কম আনন্দের নয়।

মুবিন বিকেলেই বাজারে চলে এসেছে। দোকানে এসে বসলে চায়ের অর্ডার দিতে হয় না। মুবিনদের জায়গায় চায়ের স্টল দিয়ে বসেছে খোকা। বিশাল বটগাছের ছায়ায় খোকনের দোকান। চারদিকে টুল পাতা। মানুষ বসে আড্ডা দিতে দিতে চা খেতে পারে। চায়ের দোকান হওয়ার পর মুবিনের অনেক সুবিধা হয়েছে। অনেক লোকজন নিয়ে গল্পগুজব করতে করতে চা খেতে পারে। এখানে বসে নানা প্রসঙ্গে কথাবার্তা হয়। মানুষের সমস্যা, সম্ভাবনা, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মকর্ম গান বাজনা সব বিষয় নিয়েই কথা হয় এখানে। মুবিন খোকার দোকানে এসে বসার পরই আরও দই তিনজন চলে এসেছে।

ওরা সকলেই মুবিনের বন্ধু একই স্কুলে লেখাপড়া করেছে। মুবিন এসে বসার পরই খোকা গরম পানিতে চায়ের কাপ ডুবিয়েছে। চায়ের কেটলি নতুন করে চুলায় চাপিয়েছে। খোকা ভালো করেই জানে মুবিন ভাই দোকানে বসা মানেই হলো কাপের পর কাপ চা বিস্কুট আর কেকের অর্ডার। মুবিন ভাই এমন একজন মানুষ যে দোকানে এসে বসার সাথে সাথে মৌমাছির মতো মানুষ এসে ভিড় করে। বুদ্ধি পরামর্শ করে। তার কাছ থেকে কেউ কিছু না খেয়ে ফিরতে পারে না। দিলদরিয়া মানুষ। মানুষদের উপকার সাহায্য সহযোগিতা করতে পারলেই খুশি হন।

খোকা বলল, ‘মুবিন ভাই চায়ের সাথে অন্য কিছু খাবেন?’
মুবিন বলল, ‘চা একটু পরে দে। ঢাকার মেহমান আছে। ওর জন্য আর একটু অপেক্ষা করি।’
মুবিনের এক বন্ধু বলল, ‘কার কথা বলছ মুবিন?’
‘রণির কথা বলছি। ও কাল বিকেলে বাড়ি এসেছে। আজ বাজারে এসে চা খাওয়ার কথা।’
‘কোন্ রণির কথা বলছ?’
‘ওই যে বাজারের উত্তর দিকের বাড়ির রণি, আমাদের সাথে স্কুলে পড়ত মনে নেই?’
অন্য আর একজন বলল, ‘কাসেম পোদ্দারের ছেলে রণি, তাই না?’
‘হু।’ মুবিন জবাব দিল।
‘হে তো তোমার খুব প্রিয় একজন দোস্ত। খরচাপাতি দিয়া তুমিই তো তারে লেখাপড়া করাইছ। হুনছি রণি নাকি এখন ঢাকায় ভালো চাকরি করে।’
‘ঠিকই শুনেছিস। রণি ঢাকায় ভালো অবস্থায় আছে।’
‘মুবিন তুমিও রণির সাথে ঢাকা চলে যাও। বাড়িতে বেকার আর কতদিন কাটাইয়া দিবা।’

ঠিক তখন রণি এসে মুবিনের পাশে দাঁড়িয়েছে। ওর পরণে জিন্সের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। প্যান্টটার নিচের দিকে সুতা ওঠানো। হঠাৎ দেখলে মনে হবে প্যান্টে কোনো জানোয়ার খাবলা দিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে। গায়ে টি শার্ট। টি-শার্টের সামনের দিকে ভারতীয় নায়িকার বিশাল ছবি প্রিন্ট করা। কপালে ওঠানো সানগ্লাস। হাতে মোটা পাকানো শিকলের মতো ব্রেসলেট। পায়ে দুই সাইজ বড় পাতলা স্যান্ডেল। গায়ে দামি সেন্টের গন্ধ। দায়ে পড়ে মুবিনকে চিনলেও আশেপাশের বহু পুরানো চেনা মানুষগুলোকে ঠিক যেন চিনতে পারছে না রণি। মুবিন একটু সরে গিয়ে তাকে বসতে বলল। কিন্তু ওর কাছে বসার জায়গাটা ঠিক পছন্দ হয়নি। সে তীক্ষè দৃষ্টিতে টুলের দিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে ধূলায় তার দামি প্যান্ট নষ্ট হয়ে যাবে। চোখে মুখে একটা বিরক্তির ভাব। ভাবছে এ জগৎ সংসারে কোনো কিছুই তার জন্য প্রযোজ্য নয়।

মুবিন বলল, ‘আরে টুলের মধ্যে ধূলাবালি কিচ্ছু নাই, বস। তোর প্যান্ট নষ্ট হবে না।’
এ কথা শুনে রণি একটু লজ্জা পেল। সে আর দেরি না করে বসে পড়ল।
‘খোকা, এখানে চা দে। সাথে ভালো বিস্কুটও দিস।’
দুই মিনিটের মধ্যে চা দেয় খোকা। এরপর চা খেতে খেতে গল্প করে ওরা। রণির পোশাকের দিকে অনেক মুরব্বি বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায়। চিন্তা করে বিদেশি কোনো মেহমান বাজারে এসেছে। কিন্তু যখন রণিকে চিনে ফেলে তখন একটু হতাশ হয়। এই গ্রামেরই ছেলে রণি! বছর তিনেক ঢাকায় থেকে এরকম বদলে গেছে।

চা বিস্কুক খেয়ে অন্য বন্ধুরা উঠে যায়। মুবিন ও রণি বসে আরও কিছুক্ষণ নিরিবিলি কথা বলে।
রণি বলল, ‘মুবিন তোর জন্য একটা চাকরি ঠিক করে রেখেছি। আমার বসের সাথে তোর ব্যাপারে কথা হয়েছে। তুই রাজি থাকলে আগামি মাসেই জয়েন করতে পারিস।’

একটু ভেবে মুবিন বলল, ‘রণি, বাবা-মা আমার উপর কিছুটা বিরক্ত। আমি কিছু করি না, এটা ওনারা ভালো চোখে দেখছেন না। তাছাড়া এভাবে ঘুরে ফিরে তো জীবন কাটিয়ে দেয়া ঠিক না। বাবার ব্যবসাটা আমাকে দেখতে বলেছিল, তাও আমার দ্বারা সম্ভব হয়নি। তুই তো ভালো করেই জানিস, চাকরি আমার না করলেও চলে। তারপরও কিছু একটা করা প্রয়োজন। তুই যদি আমার জন্য ব্যবস্থা করতে পারিস তবে আমি চাকরি করব। আমার কিছু করার যোগ্যতা আছে সেটা বাবার কাছে প্রমাণ করা প্রয়োজন। আর এখন গ্রামে পড়ে থাকাও কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের মন মানসিকতার কেউ এখন গ্রামে নেই। সবাই শহরে চলে গেছে। আমিও আর এখানে পড়ে থাকতে চাই না।’
রণি বলল, ‘ঠিক আছে তুই এই মাসে শেষের দিকে ঢাকায় আমার কাছে চলে আসিস। আমি তোর জন্য ব্যবস্থা করে রাখব।

তারপর রণির কথামতো মুবিন ঢাকায় গিয়ে রণির ফাক্টরীতেই কাজে জয়েন করেছে। মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারবে কিনা এ নিয়ে শুরুতে দ্বন্ধ ছিল। কিন্তু কাজে এসে ঠিকই মানিয়ে নিয়েছে সে। দেখতে দেখতে পার করে দিয়েছে তিনটি বছর। ভালোই চলছিল মুবিনের। কিন্তু ইদানিং কাজে খুব সমস্যা হচ্ছে। আগের মতো অফিস আর চলছে না। নিয়মনীতির কোনো বালাই নেই। মালিক রণিকে ডেকে যেদিন ম্যানাজার বানিয়ে দিয়েছে সেদিন থেকেই অফিসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। রণি তার খেয়ালখুশি মতো অফিস চালাচ্ছে, লোক নিয়োগ দিচ্ছে। পুরানো অভিজ্ঞ লোকদের বিনা কারণে ছাটাই করে দিচ্ছে। পুরানো লোকজন মালিকের কাছে গিয়ে কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না। মালিক রণির কথা ছাড়া অন্য কারও কথা বিশ্বাস করছে না। রণিও বুঝতে পেরেছে যে, মালিককে সে ঠিকভাবেই কব্জা করতে পেরেছে। আর এই সুযোগে সে যা খুশি তা করে বেড়াচ্ছে।

ইদানিং মুবিনকে রণি একদম সহ্য করতে পারে না। সুযোগ পেলেই সে মুবিনকে বকাঝকা করে। অকারণেই কাজে ভুল খুঁজে বেড়ায়। কাজের নাম করে অফিসে আটকে রাখে। মুবিন সবকিছু বুঝেও মুখ খোলেনি। কিছুদিন ধরে ও সব কিছু নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে। মুবিনকে একা ডেকে কিছু বললে তাও মানা যায় কিন্তু রণি যখন অন্য কর্মচারীদের সামনে অকারণে অশ্লিল ভাষায় বকাঝকা করে তখন ওর খুব খারাপ লাগে। ইচ্ছে হয় কাজ ছেড়ে চলে যায়।

আজ ছুটির দিন। রণি কাজের কথা বলে মুবিনকে অফিসে ডেকে এনেছে। সকাল থেকে অফিসে বসে আছে। কোনো কাজ নেই। রণি তার অফিস রুমে বসে কাজ করার নামে আড্ডা বসিয়েছে। আজকাল প্রায়ই সে অফিসের মধ্যে আড্ডা বসায়। মুবিন কয়েকদিন লক্ষ্য করেছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামায়নি। দরকার কী। রণি এখন অফিসের কর্তাব্যক্তি। যা খুশি করতে পারে। কিন্তু আজ ধৈর্য্যরে বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। কাজ ছাড়া এভাবে অফিসে এসে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল দুটো বেজে গেছে। অসহ্য! আর কত বসে থাকবে সে? সকালে ঠিকমতো নাশতা হয়নি। এখন প্রচ- ক্ষুধা পেয়েছে। আর বসে থাকবে না। এখনই চলে যাবে। কিন্তু রণিকে না বলে তো যাওয়া যাবে না। তাহলে চাকরি নট হয়ে যাবে।

মুবিন অনেক বিরক্তি নিয়ে রণির রুমে ঢোকে। রণির সাথে রুমে আরও তিন চারজন বসে আছে। প্রত্যেকের হাতে গ্লাস। ওরা দিব্যি পান করে যাচ্ছে। টেবিলে রাখা বিদেশি বোতল। অনেক খাবার দাবার। রণির চোখ রক্তজবার মতো লাল। মুবিনকে দেখে চিৎকার করে রণি।
‘তোর কত্তো বড় সাহস! তুই অনুমতি ছাড়াই আমার রুমে ঢুকে পড়েছিস?’
মুবিন বলল, ‘আমি চলে যাব।’
‘চলে যাবি মানে? আমি অফিসে বসে আছি। আর তুই চলে যাবি? আমার অর্ডার ছাড়া এক পা নড়তে পারবি না। আমি বের হয়ে গেলে অফিস বন্ধ করে চলে যাবি।’

রণিকে চিনতে পারে না মুবিন। এই রণিই কি তার বন্ধু। তারই গ্রামের এক সময়কার অসহায় ছেলে, যাকে সে প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবেসেছে। বিপদে আপদে সাহায্য করেছে। বাবার পকেটের টাকা এনে পরীক্ষার ফি দিয়েছে। একসাথে খেলেছ, বেড়িয়েছে। ও আজ এই অফিসের বস। এটাই কী সব! মাথা ঘুরে যায় মুবিনের। সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। মানসম্মান হারিয়ে এখানে আর কাজ করার মানে হয় না।

মুবিন রণির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চাকরির নিকুচি করি। আমি চললাম।’
রণি চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে মুবিনের সামনে দাঁড়ায়।
‘শুয়োরের বাচ্চা! আগে অফিসের হিসাবনিকাশ দে। তারপর যাবি।’
‘রণি, সাবধান! মুখ সামলে কথা বলবি। আর একবার বাপ-মা তুলে গালি দিবি তো দাঁত ভেঙে দেব।’
‘কী বললি!’ বলেই মুবিনের গালে চড় বসিয়ে দেয় রণি।

সঙ্গে সঙ্গে মাথায় রক্ত চড়ে যায় মুবিনের। প্রচ- জোরে লাত্থি মারে রণির কোমর বরাবর। রণি বিদ্যুত গতিতে ছিটকে পড়ে টেবিলের ওপর। টেবিলের কোণায় লেগে রণির ঠোঁট কেটে যায়। দরদর করে রক্ত বেরোয়। এমন আঘাত পেয়েছে যে নড়ার শক্তি থাকে না। রণির মেহমানরা মুবিনকে ঝাপটে ধরে এলোপাথারি মারতে শুরু করে। একটু পর রণি উঠে আসে।

নিচুস্বরে বলে, ‘ছেড়ে দাও ওই শুয়োরটাকে। যা করার আমিই করব। ওকে আমি নিজের হাতে শাস্তি দেব।’
রণির কথায় ওরা মুবিনকে ছেড়ে দেয়। রণি ঠোঁটের রক্ত মুছতে মুছতে চেয়ারে এসে বসে। মুবিন তখনই অফিস থেকে বেরিয়ে আসে।

অফিস থেকে মেইন রোডে এসে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে মুবিন। জগৎ সংসার সবকিছু তুচ্ছ বলে মনে হয় ওর কাছে। মাথার মধ্যে কোনো কিছু কাজ করে না। উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে নিজের মেস ছেড়ে অনেকদূর চলে এসেছে। মেসে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না।

একটু আগে যে ক্ষুধা ছিল তা মরে গেছে। মন খুব উথাল পাথাল। এলোপাথারি পথ চলতে চলতে এক সময় শিউলির কথা মনে পড়ে। মাঠের পাশ দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে ডানে টার্ন করলেই শিউলির ঝুপরি। ঘুরা পথে না গিয়ে মুবিন মাঠের কোণাকুণি পাড়ি দেয়। মিনিট পাঁচেক হেঁটে শিউলির ঝুপরির সামনে এসে দাঁড়ায়। বাঁশের চাটাইয়ের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। বাঁশের মধ্যে খটখট আওয়াজ করে মুবিন। একবার দুইবার তিনবার। কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ মেলে না। দরজা যেহেতু ভিতর থেকে বন্ধ নিশ্চয়ই ঘরে কেউ আছে। এবার আরও জোরে শব্দ করে। একটু পরে দরজা ফাঁক করে উঁকি মারে শিউলির নানী। বুড়ি চোখে ঠাহর পায় না। চোখ গোল গোল করে চেনার চেষ্টা করে। কিন্তু মুবিনকে চিনতে পারে না।

বুড়ি ভিতর থেকে বলে, ‘কেডা?
‘আমি মুবিন, শিউলি কোথায়?’
‘শিউলি ঘুমায়। এখন ওরে ডাকা যাবে না।’
মুবিন একটু আশ্চর্য হয়। এখন মাত্র সন্ধ্যা। এই অবেলায় শিউলির ঘুমানোর কথা নয়।
‘কিচ্ছু হবে না, ওকে ডাকেন। বলেন, মুবিন এসেছে।’
বুড়ি অনড়। বলে, ‘যেই আসুক শিউলি ডাকতে মানা করেছে।’
এবার মুবিনের খুব রাগ ধরে যায়। ও বুড়িকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। ঘরের মধ্যে একটা মাত্র চৌকি। সেই চৌকিতে আড়াআড়ি শুয়ে আছে শিউলি। ও ঘুমিয়ে আছে কিনা বুঝতে পারে না।
চৌকির পাশে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়।
‘শিউলি। এই শিউলি।’
শিউলি চোখ খোলে। ওর চোখ টকটকে লাল।
বিরক্তমাখা কণ্ঠে বলল, ‘মুবিন, হঠাৎ এই সময় তুমি! কোনো খবর না দিয়ে?’
‘কেন খবর না দিয়ে এর আগে আসিনি কখনও? হঠাৎ আজ আগাম খবরের কথা আসছে কেন?’
‘না, আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তো তাই।’
‘কেন রাতে ঘুমাসনি?’
শিউলি শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলল, ‘না, কাল সারারাত ঘুমাই নাই।’
‘কোথায় গিয়েছিলি?’
‘হোটেলে প্রোগ্রাম ছিল।’
‘হোটেলে!’ অসম্ভব রকমের চমকায় মুবিন।
‘কার সাথে গিয়েছিলি?’
‘দেখ মুবিন, আমি কোথায় গিয়েছি, কার সাথে গিয়েছি এতকিছু বলতে বাধ্য নই। আমার নিজস্ব স্বাধীনতা বলতে কিছু আছে।’
‘বাহ্! এ কদিনেই বেশ কথা শিখে গেছিস, না?’

শিউলি চড়া গলায় বলল, ‘আমি বোবা থাকলে তোমার বুঝি খুব সুবিধা হয়, না?’
মুবিন দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘এতসব বুঝি না। তুই এখন চল আমার সাথে।’
‘কোথায় যাব?’
‘কোথায় যাব জানি না। তোকে নিয়ে সারা রাত ঘুরব। আমার মন মেজাজ ঠিক নাই। কোনো প্রশ্ন করবি না। আমি যেখানে যাই সেখানে যাবি।’
‘আমি তোমার সাথে কোত্থাও যাব না।’

মুবিনের মাথায় নতুন করে চক্কর দেয়। কী বলে শিউলি, যাবে না! একদিন আগেও যে মেয়ে হাতের তুড়িতে চিৎ হয়ে শুত। মুবিন যা বলত অক্ষরে অক্ষরে তাই পালন করত। আর আজ কিনা সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। একদিনেই সব বদলে গেছে!
জোর গলায় মুবিন বলল, ‘শিউলি তোকে আমার সাথে যেতেই হবে।’
‘মুবিন তুমি বোঝার চেষ্টা কর। তোমার সাথে যাওয়া আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘সম্ভব নয়! কেন?’
‘মুবিন, তুমি কিছু মনে কর না। আমি অন্য আর একজনকে কথা দিয়েছি। আমি তাকে ভালোবাসি। সেও আমাকে ভালোবাসে। আমার জীবনটাকে অন্যভাবে সাজাতে চাই। আমি আমার জীবনে নিরাপত্তা চাই। আমাকে ভুল বুঝ না।’

রাগে সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে মুবিনের। চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরোয়। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে মুবিন। দুই হাত দিয়ে গলা চেপে ধরে শিউলির।
‘বৈঈমান, হারামখোর! বল, কে সেই লোক? আমার বুকে ছুরি বসিয়ে যাকে তুই মালা পরিয়েছিস?’
শিউলি অস্ফূটস্বরে বলল, ‘তোমার বন্ধু। রণি। রণির ভালোবাসাকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারিনি। ও আমাকে খুব ভালোবাসে। ও কথা দিয়েছে শিগগিরই আমরা বিয়ে করব। তুমি ভুল বুঝ না। আমাকে ক্ষমা করে দিও।’

মুবিন আর্তনাদ করে ওঠে। রণি, তুই আমার হৃদপি-ের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিস। আমার ভালোবাসাকে খুন করেছিস। আমি এর চরম প্রতিশোধ নেব।
শিউলির মুখে রণির কথা শোনার পর মুবিন পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। অসংখ্য কথা ভেতরে আলোড়িত হয়। কিন্তু কোনো কথাই ঠোঁটে উচ্চরিত হয় না। শিউলির দিকে উদভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকে।

শিউলি নীচুস্বরে বলে, ‘মুবিন তুমি এখন চলে যাও। রণির আসার সময় হলো। ও এসে তোমাকে দেখলে একটা কেলেঙ্কারী কা- বাধাবে।’
মুবিন শিউলির ঘর থেকে বেরিয়ে আর পেছন তাকায় না। সোজা মেইন রাস্তায় চলে আসে। আবার ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে। এত বড় সাহস রণি তার কলিজা ধরে টান দিয়েছে! তার ভালোবাসার মানুষকে ছিনিয়ে নিয়েছে। টাকা-পয়সা, ধন- ধৌলত, সহায়-সম্পত্তি কেড়ে নিলেও একজন পুরুষ নিজেকে স্থির রাখতে পারে কিন্তু নিজের মেয়ে মানুষকে কেড়ে নিলে কে সহ্য করতে পারে! না এটা হতে পারে না। এটা সহ্য করা যায় না। এর চরম প্রতিশোধ নিতে হবে। অন্যের ভালোবাসার মানুষ কেড়ে নেয়ার সাধ ওকে টের পাইয়ে দিতে হবে। এটা যদি না পারে তবে মুবিন কোনো পুরুষের মধ্যেই পড়ে না।

এই তিন বছরে ঢাকা শহরের চালচিত্র ভালোই দেখেছে মুবিন। ভালোমন্দ অনেক মানুষের সাথে ওঠা-বসা ওর। জীবনে নোংরা, নর্দমা খাদের কিণারা দিয়ে বহু চলেছে কিন্তু কখনও খাদে নামেনি। যতটুকু পেরেছে মানুষের কল্যাণ করেছে, কারও এতটুকু ক্ষতি করেনি। আজ মুবিনকে অন্যরকম চিন্তা করতেই হচ্ছে। কেন করবে না? তার নিজের মাল চোখের সামনে অন্য আর একজন টেনে নেবে আর সে চেয়ে চেয়ে দেখবে তা তো হতে পারে না। রণিকে সে হজম করে ফেলবে। রণির এটাই পাওনা। ঢাকা শহরে একটা মানুষ ফেলে দেয়া কঠিন কিছু নয়। বর্তমানে খুনের চেয়ে সস্তা আর কিছু নেই। পেশাধার খুনি বা নেশাফেশা করে এমন একজনকে ডেকে কিছু ধরিয়ে দিলেই ব্যস। খতম করে দেবে। ভাবতে ভাবতে হনহন করে হাঁটে মুবিন।

হাঁটতে হাঁটতে শহরের একপ্রান্তে চলে আসে। রাত অনেক হয়েছে। পেটের ক্ষুধা জানান দেয় সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। খেতে হবে। দুনিয়া ওলটপালট হয়ে গেলেও ক্ষুধার মরণ হয় না। সে সময় মতো জেগে ওঠে। এদিকেই কোথাও খেয়ে নিতে হবে। মেসে ফিরে যাবার উপায় নেই। ও রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। আজ রাতে আর মেসে ফেরা হবে না। সারা রাত রাস্তায় কাটাবে। ক্ষুধার কথা মাথায় রেখে হোটেলের সন্ধান করে মুবিন। শহরের এদিকটা আবাসিক এলাকা। হোটেল রেস্তোরাঁ চোখে পড়ে না। এবার উল্টো পথ ধরে হাঁটতে থাকে। রাত এখন কত হলো কে জানে?

বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ। বাসস্ট্যান্ডের রেস্তোরাঁগুলো অনেক রাত অবধি খোলা থাকে। ও একজনের সাহায্য নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করে। ক্ষুধায় ক্লান্ত তবু খুনের নেশাটা মাথা থেকে দূর হয় না। তবে ওর চিন্তায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। এই কাজটা অন্যকে দিয়ে করাবে না। নিজে করবে। নিজের প্রতিশোধ নিজেই নেবে। শুধু ওদের কাছ থেকে একদিনের জন্য একটা মেশিন (পিস্তল) ভাড়া নিলেই চলবে। রণিকে সুবিধা মতো জায়গায় ডেকে নিয়ে ফুট্টুস! ব্যস হয়ে গেল কাজ! জীবনে একটামাত্র খারাপ কাজ, কী এমন আসে যায়!

এরপর মুবিন একটা রেস্তোরাঁর সন্ধান পেয়ে যায়। রেস্তোরাঁয় ঢুকে একটুও দেরি করে না। চোখের সামনে যা দেখে তাই অর্ডার দিয়ে খেতে বসে।
তিনদিন পর্যন্ত টানা মেসে কাটিয়ে দেয় সে। অফিসের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। রণির সাথেও দেখা হয় না। মুবিন তার করণীয় ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। এখন শুধু অপারেশন। তার কাজের প্লান অনুযায়ী খুব ভোর বেলা বেরিয়ে পড়ে। রণির মেসে চলে আসে ও। এই সময় রণি ঘুমিয়ে ছিল।

মুবিন দরজায় কড়া নাড়ে।
রণি ঘুম ঘুম চোখে বিরক্ত নিয়ে দরজা খুলে দেখে মুবিন দাঁড়িয়ে।
‘কিরে তুই এত সকালে, এখানে কী চাস?’
মুবিন কোনো কথা না বলে রণিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়।
‘দোস্ত গত তিনদিন ধরে আমার চোখে ঘুম নাই। সারাক্ষণ একটা অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আমি তো রক্তমাংসে মানুষ। জীবনের এক মুহূর্তের ভুলকেই কি বড় করে দেখবি? সেদিন আমি মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। আমাকে মাপ করে দে দোস্ত। তুই আমার পরাণের বন্ধু, মাপ না করলে আমি মরেও শান্তি পাব না।’

মুবিনের এমন আচরণ দেখে রণি একটু স্বাভাবিক হয়। বলে, মেহমানের সামনে তুই যে কাজটি করেছিস তা কিন্তু ঠিক করিস নি। আমি চাইলে তোকে সেদিন পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলতে পারতাম। যাক, তুই যখন ক্ষমা চাইতে এসেছিস তখন ব্যাপারটা আর সামনে গড়াব না। তবে তুই আর অফিসের দিকে যাস না। ওরা তোকে পেলে খারাপ কিছু করতে পারে। কারণ ব্যাপারটা অফিসের সবাই জেনে গেছে।’
‘দোস্ত আমার চাকরি চাই না। আমাদের বন্ধুত্বই বড়। তুই বল আমাকে ক্ষমা করেছিস?’
‘আচ্ছা যা, এখন আমি ঘুমাব। বিরক্ত করিস না।’
‘রণি, আমি একটা বিষয় নিয়ে এসেছি তোর কাছে। বলব এখন?’
‘কী বলবি বল।’
‘গাজিপুর ছেড়ে ময়মনসিংহের দিকে আমি একটা চমৎকার জায়গার সন্ধান পেয়েছি। জমির দামও খুব বেশি না। লোকেশন ভালো। একত্রে জমি কেনার জন্য তো আমরা কত জায়গায় ঘোরাঘুরি করলাম। কাল ছুটি আছে চল জায়গাটা দেখে আসি।’

এ কথা শুনে রণি বেশ নরম হয়। কারণ সে অনেকদিন ধরে ঢাকার আশেপাশে জমি কেনার কথা ভাবছে। রণি ভাবল, আর যাই হোক মুবিন এ ব্যাপারে একশো ভাগ সৎ। ও নিশ্চয়ই কোনো ভেজাল জমির সন্ধান দেবে না।
‘তা কালই যেতে চাস?’
‘হ্যা কালই। দেরি করলে হাতছাড়া হয়ে যাবে।’
‘ঠিক আছে তুই আমাকে ঘুম থেকে তুলে নিস।’
কথা বলে মুবিন মেসে ফিরে আসে।

পরদিন সকালে রণিকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে ওরা দুইজন নাশতার জন্য একটা দামি রেস্তোরাঁয় ঢোকে। মুবিনই অর্ডার দেয়। সকালের নাশতায় যত আইটেম আছে তার কিছু বাদ রাখে না। রণি অর্ডারের নমুনা দেখে অবাক হয়। বলে, এত অর্ডার কেন দিচ্ছিস? মুবিন হেসে বলে, দূরের পথে যাব। একটু ভালো করে না খেলে কেমন হয়। রণি খুব মজা করে নাশতা খায়। মুবিন চেয়ে চেয়ে দেখ আর ভাবে বন্ধু জীবনের শেষ নাশতাটা মনের মতো করে খেয়ে নাও। বিলটা অবশ্য আমিই দেব। কতকিছুই তো দিলাম। শেষ নাশতার বিলটাও দেব। ওরা নাশতা সেরে আয়েসি ভঙিতে চা খায় শেষে সিগারেট ধরায়।

ছুটির দিন বলে ব্যস্ত শহরের ঘুম ভাঙে দেরিতে। ওরা সকালের নরম হাওয়াও কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ায়। ঢিলাঢালাভাবে হাঁটে। যেন কোনো কিছুর তেমন তাড়া নেই। এমনিকরে অনেকটা সময় পার করে গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডে আসে। সুবিধা মতো একটা বাসে চেপে বসে দুজন। বাস যখন ছাড়ল তখন সকাল সাড়ে এগারোটা। শহরের ব্যস্ত রাস্তা পার হতেই দুঘণ্টার বেশি লেগে গেল। শহরের জঞ্জাল ব্যস্ততা ছেড়ে বাসটি এখন যেন গতি পেয়েছে। গাজিপুর চৌরাস্তা ছেড়ে এখন সাঁই সাঁই করে চলছে বাসটি। রাস্তার দুপাশে গজারি বন। বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে বনে। সেখানে গাছে নতুন সবুজ পাতা গজিয়েছে। এত সুন্দর সবুজ যে চোখ জুড়িয়ে যায়। মুবিন চেয়ে আছে বাইরের দিকে। রণি ঠাণ্ডা বাতাসের পরশ পেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। নির্দিষ্টস্থানে আসার পর মুবিন রণিকে ডেকে তুলল। ওরা বাস থেকে নামল। এই বাসস্ট্যান্ডটা বেশ নিরিবিলি।

ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে থেকে পশ্চিম দিকে একটা সরু গলি ঢুকে গেছে। রাস্তার দুপাশে কয়েকটিমাত্র দোকান। তার বেশিরভাগই বন্ধ। এ স্টেশনে ওরা দুজনই নেমেছে। এর আগে মুবিন এখানে এসেছে দুই একবার। লাল খোয়া বিছানো পথটি পশ্চিম দিকে বহুদূর চলে গেছে। সেখান থেকে আবার পায়ে হাঁটা মেঠোপথ। মেঠোপথ ধরে আরো দূরে। আরও গভীরে। রণির কাছে জায়গাটি সম্পূর্ণ নতুন। এখানে সে শুধু মুবিনকে অনুসরণ করবে। ও যেখানে যায় সেখানে যাবে।
ওরা রিকশা নিয়ে সরু গলিটার শেষ মাথায় চলে এসেছে। এবার রিকশা ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে লাগল। এদিকে বসতি চোখে পড়ে না। চারদিকে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ। কোনো মানুষজন চোখে পড়ে না। ওরা দুজন হেঁটে চলেছে। ঢাকা থেকে বহুদূরে কিন্তু জায়গাটা ভারি চমৎকার। অনেকদিন পর গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে চলতে গিয়ে রণির বেশ ভালোই লাগছে। আজকের দিনটা মন ভরে উপভোগ করছে সে।

রণি বলল, ‘আর কতদূর?’
মুবিন আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। ‘ঐ তো! সামনের ওই বড় বাগানটা পার হয়েই জায়গাটা।’
রণি একটুও বিরক্ত হয় না। মনের আনন্দে হাঁটে। সূর্য এখন গাছের আড়ালে হেলে পড়েছে। একটু পরে সন্ধ্যা নামবে। মুবিন ভাবল, এই জায়গাটাই কাজ সারার জন্য উপযুক্ত। ওরা এখন বনের ঠিক গভীরে। কোনো লোকজন নেই। ঠুস করে একটি মাত্র গুলির শব্দ। কেউ শুনতে পাবে না। ছোট্ট একটি শব্দ বাতাসের সাথে হারিয়ে যাবে। লাশটাকে টেনে শুধু পাশের খাদে ফেলে রাখতে হবে। কাজ সেরে পেছনের দিকে যাবে না মুবিন। বনের ভেতর দিয়ে বিকল্প আরও পথ আছে। সেই পথে চলে যাবে। এতক্ষণ রণি পেছনে ছিল। কায়দা করে রণিকে সামনে হাঁটতে দিল। রণি হাঁটছে। ওর আনন্দ যেন ধরে না। করুক রণি মন ভরে আনন্দ করুক। আর তো মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর সব শেষ। পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ সব কিছু ছেড়ে… মুবিন পকেটে হাত ঢুকায়। হাতে পিস্তল স্পর্শ করে নিশ্চিত হয়ে নিল। সবই ঠিকঠাক। সময় মতো মেশিনটা বের করে ট্রিগারে হাত রাখবে তারপর মাথা লক্ষ্য করে একট টিপ। গুলি করতে হবে খুব কাছ থেকে। তাহলে শব্দ কম হবে।

দুপাশের ঝোপঝাড়ের দিকে লক্ষ্য করে মুবিন। হ্যাঁ এদিকটা আরও ঘন। মেশিনটা পকেট থেকে বের করে একবার দেখে নিল। তারপর ট্রিগারে হাত রেখে রণির দিকে তাক করল। ঠিক সেই সময় চোখে পড়ল এক বুড়ি লাকড়ি কাঁধে করে বন থেকে ফিরছে। মুবিন মেশিনটা আবার পকেটে চালান করে দিল। ভাবল কাজে বাধা পড়েছে। এখানে নয়। মাঠ পেরিয়ে সামনে আরও সুন্দর নিরিবিলি জায়গা আছে। সেখানে বন আরও ঘন। ওরা মাঠ পেরিয়ে পরের জঙ্গলে চলে আসে। এটা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটা জায়গা। ঘন সবুজ বন। তারই মাঝে খুব সুন্দর একটা পুকুর। পুকুর পাড়টা মুবিনের পছন্দ হয়ে যায়। এখানেই কাজটা শেষ করতে হবে।

রণি হাসতে হাসতে বলল, ‘আর কতদূর মুবিন?’
‘এই তো চলে এসেছি। ঐ যে পুকুরটা দেখতে পাচ্ছিস না, তারপরের জায়গাটাই। এলাকা দেখার জন্য আমরা একটু ঘুরে এসেছি। ওদিক থেকে আরো একটা পথ আছে। সরাসরি জমিতে চলে আসা যায়।’
‘না, ভালোই করেছিস। এদিকটা আমার খুব ভালো লেগেছে। জমি কিনে চমৎকার একটা বাংলোর মতো বানাবো এখানে। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে চলে আসব। বেশ মজার আড্ডা জমবে, তাই না?’
মুবিন চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়। পুকুর পাড়ে ওঠার সময় পেছন থেকে গুলি ছুঁড়বে। তারপর লাশ টেনে মজা পুকুরে ফেলে রেখে অন্য পথ দিয়ে বেরিয়ে যাবে।

পুকুরের কাছে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায় রণি। কিছু বোঝার আগেই সাঁৎ করে মুবিন পিস্তলটা পকেটে লুকিয়ে ফেলে। জংলা কাটার গুতায় রণির পা কেটে গেছে। সামান্য রক্ত বের হয়েছে। মুবিন জঙ্গল থেকে এক ধরনের পাতা এনে তার রস লাগিয়ে দিল কাটা জায়গায়। মুবিনের মমতা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় রণি। বলল, বন্ধু তোমার তুলনা হয় না। বিপদেই বন্ধুর পরিচয়’
রণির কথা শুনে হাসে মুবিন।

‘তোর কী জায়গাটা পছন্দ হয়েছে।’
‘খুব পছন্দ হয়েছে।’
মুবিন বলল, ‘কিন্তু ঢাকা থেকে অনেক দূর।’
‘তাতে কী। এমন নিরিবিলি জায়গা মন জুড়িয়ে যায়।’

পায়ের ব্যথার কারণে রণি আর পুকুরের পাড়ে ওঠে না। কিন্তু মুবিন তরতর করে পাড়ে উঠে যায়। পাড়ে উঠে ও অসম্ভব রকমের মুগ্ধ হয়ে যায়। এমন সুন্দর জায়গা ও জীবনে কোনোদিন দেখেনি। সৌন্দর্যের সব রঙ মেখে প্রকৃতি যেন নতুন সাজে সেজেছে। মৃদমন্দ বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। দূর কোথাও থেকে পাখি উড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে গাছে। পাখির কলরবে জায়গাটা মুখরিত। ঝোপের মধ্যে পাখির বাসা। বাচ্চাগুলো মা পাখির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে খাবারের আশায়। মুবিন যেন হেরে যাচ্ছে। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। ওর মনের মধ্যে ট্র্যাফিক জ্যামের মতো আটকে থাকা কষ্টগুলো হাওয়ায় মিলে যাচ্ছে। সুন্দর প্রকৃতি যেন সব কিছু সুষে নিচ্ছে। শান্ত সুশীতল হচ্ছে ওর হৃদয় মন। প্রতিশোধের তীব্র আগুন নিভে গেছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য মুবিনকে নতুন দৃষ্টি দান করল। নিমেষে তার চোখের সামনে থেকে সব কষ্ট, সব ক্ষোভ মিলিয়ে যেতে থাকল। এখন চোখের সামনে যা কিছু দেখছে সবই সুন্দর। সবই অর্থপূর্ণ। মুবিন আর একবার পকেটে রাখা পিস্তলের উপস্থিতি দেখে নিল। তারপর রণির দিকে তাকাল। রণি তাকিয়ে আছে দূরে জঙ্গলের দিকে। ওর চোখে মুখেও একরাশ মুগ্ধতা।

একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। রাত পেরিয়ে নতুন সকাল শুরু হবে। আকশের দিকে তাকাল মুবিন। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। অজানা এক ভালোলাগার আবেশে ওর চোখে পানি এসে গেল। পৃথিবীতে শুধু ভালোবাসাই টিকে থাকে। মুবিন পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে হাতে নিল। এটাকে খুব অচেনা লাগছে এখন। মনে হচ্ছে পিস্তল নয় কালো দানব। যে শুধু মায়ামমতা, স্নেহ ভালোবাসা কেড়ে নিতে জানে। মায়ের বুক খালি করতে জানে। পিস্তলটা এখন মুবিনের কাছে সবচেয়ে ভারি আর অপ্রয়োজনীয় বস্তু মনে হচ্ছে। এটাকে আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সে হাতের পিস্তলটা পুকুরে ছুঁড়ে মারল। পুকুরের শান্ত জলে একটু ঢেউ তুলে তলিয়ে গেল পিস্তলটা।
তারপর দ্রুত নেমে এলো মুবিন রণির কাছে। আলতো করে রণির কাঁধে হাত রাখল।

রণি অবাক হয়ে তাকাল মুবিনের দিকে।
মুবিন বলল, ‘চল ঢাকায় ফিরে যাই।’
‘এখনই ফিরে যাবি! কিন্তু জমিটা তো দেখাই হলো না?’
‘কিছু মনে করিস না, রণি। আমি পথ ভুল করে এসেছি। জমিটা এখানে নয়। অন্য জায়গায়। আজ তো সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অন্য একদিন যাব।’
রণি বলল, ‘অসুবিধা নেই। তোর সাথে আজকের দিনটা আমার চমৎকার কাটল।’
মুবিন রণির দিকে তাকিয়ে হাসল একটু। এ হাসি পাহাড়ি ঝর্নার মতো স্বচ্ছ। কোনো প্রতিশোধ বা পাপ নেই এতে।
‘চল রণি, দেরি করলে ঢাকা ফেরার বাস পাব না।
ওরা আবার বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করে। তখন রাতের আঁধার নেমে এসেছে। ঘন জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে নীড়ে ফেরা পাখির কিচিরমিচির শব্দ।

 

Read Previous

রীতা ইসলামের যুগল কবিতা

Read Next

শিকড়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *