ভৌতিক ঘরানার চলচ্চিত্রে আমার তেমন আগ্রহ নেই। তারপরও কালেভদ্রে একটা-দুটো সে গোত্রীয় সিনেমা দেখা হয়ে যায়। সেরকমই একটি সিনেমা দেখলাম। নাম ক্রিস্টিন (Christine 1983)। একটা গাড়ির ভৌতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সিনেমা। গাড়ির নাম ক্রিস্টিন। গাড়ি বা তার মালিকের উপর কেউ কোনো বিরূপ ব্যবহার করলে ক্রিস্টিন তার শোধ তোলে। আর সেটা হয় খুব ভয়ঙ্কর মাত্রার। তো এরকম এক বদ গাড়ি ক্রিস্টিন, যার তৈরির সাল ১৯৫৮, হাতবদল হয়ে ১৯৭৮ সালে সে অ্যান্ডি নামের এক সতেরো বছরের আলাভোলা ছেলের মালিকানায় আসে। ২০ বছরের পুরোনো ক্রিস্টিনকে নিজের জমানো টাকায় কিনে অ্যান্ডির আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু সে আনন্দ বিষাদে পরিণত হতেও সময় লাগে না। যন্ত্র হলেও ক্রিস্টিন অনুভূতিসম্পন্ন। আর সে অনুভূতি মোটেও শুভবোধ সম্পৃক্ত নয়, যার কারণে গল্পের চরিত্রগুলোকে পোহাতে হয় নানান ভোগান্তি। মৃত্যুও ঘটে এক কেন্দ্রীয় চরিত্রসহ আরো অনেকের।
বোধশক্তি আছে এমন এক গাড়ির গল্প নিয়ে সিনেমাটি দেখতে দেখতে দুম করে আরেক সিনেমার কথা মনে পড়ে যায়। না, আমি ২০০৫-এ নির্মিত ইংরেজি চলচ্চিত্র ‘হার্বি ফুল্লি লোডেড’-এর কথা বলছি না। বলছি, ঋত্বিক কুমার ঘটকের সৃষ্টি বাংলা চলচ্চিত্র ‘অযান্ত্রিক’-এর কথা। ঋত্বিক ঘটক যে অনেক ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনায় তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায় কয়েক যুগ এগিয়ে ছিলেন, ‘ক্রিস্টিন’ দেখতে গিয়ে সে কথার সত্যতা আবারও নগদে টের পেয়ে দারুণ একটা অনুভূতি হলো। যে কারণে সাত তাড়াতাড়ি আরকবার ‘অযান্ত্রিক’ দেখে নেবার লোভ সামলানো গেল না।
মানুষটা চিন্তা-ভাবনায় শুধু যুগের তুলনায় অগ্রসরই ছিলেন না, একইসাথে যেন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাও ছিলেন। এত বছর পেরিয়ে যাবার পরও ঋত্বিক বন্দনায় ছেদ পড়বার নামগন্ধ নেই। বরং তাঁর সৃষ্টি সবেধন ৮টি চলচ্চিত্র নিয়ে ভক্তকুলের নিত্য-নতুন আবিষ্কারের আনন্দ মিছিল চলছেই… যেন তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টি কর্মের ভবিষ্যৎ। নইলে স্ত্রী সুরমার উদ্দেশে ওরকমটা কেন বলবেন!, ‘লক্ষ্মী! টাকা থাকবে না। কাজটাই থেকে যাবে। তুমি দেখে নিয়ো, আমি মারা যাওয়ার পর, সবাই আমাকে বুঝবে!’
সত্যিই তাই, তাঁকে বুঝতে চাওয়ার চেষ্টা আমাদের এখনও গেল না।
শিষ্যদের প্রতি সদম্ভে বলা কথাগুলোও মনে করা যেতে পারে, ‘শোনো, আরও আট-দশ বছর বাদে লোকে আমার ছবি নেবে। আমার ছবি পাগলের মতো খুঁজবে। তোমরা দেখে নিও!
ঋত্বিক নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন, সময়মতো সে সত্য বুঝতে বাঙালি ব্যর্থ হলেও… তাঁর চলে যাবার পর বাঙালির বিরাট একটা অংশ তাঁকে গুরু মানতে দ্বিধা করেনি। আর কে না জানে, গুরুবাক্য শ্রবণ, স্মরণ ও ধারণ করাকে দায়িত্বের বৃত্তে টেনে নেওয়া যায় অনায়াসে। সে দায়িত্ববোধের তাগিদে বারবারই ঋত্বিকের কাজের কাছে যেতে হয়…মনোনিবেশ করতে হয় তাঁর বিভিন্ন সময়ে বলা কথা বা সাক্ষাৎকারের কোলাজেও।
বেঁচে থেকে যে মানুষ নানা ভোগান্তি আর হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন, আজ মৃত্যুর এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পরও তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। যে আগ্রহ ঋত্বিক বৃত্তে আরেকবার ঘুরে আসার পথে ক্লান্তিবোধ করায় না। ঋত্বিকের সৃষ্টিতে আরকবার উঁকি দেবার সুযোগ করে দিলো ‘ক্রিস্টিন’। ক্রিস্টিনের নির্মাণ কাল ১৯৮৩। আর ‘অযান্ত্রিক’ নির্মিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে, মুক্তি পায় ’৫৮-তে। ঋত্বিক সম্পর্কে জ্ঞাতমাত্রই জানেন, নানা ভোগান্তি পেরিয়ে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’ তাঁর জীবদ্দশায় মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলা সাংস্কৃতিক দুনিয়ায় অসীম প্রতিভা নিয়েও এতটা দুর্ভোগ আর কাউকে পোহাতে হয়েছে কিনা জানা নেই। তাঁর জীবন বাড়ির দুয়ার বারবার ভেঙে পড়বার গল্প কম-বেশি অনেকেরই জানা। সেসব এ আলোচনার বিষয়ও নয়। ‘অযান্ত্রিক’কে ছুঁয়ে ঋত্বিক কুমার ঘটক নামের প্রতিভারধর, অভিমানী, আত্মবিধ্বংসী মানুষটার অযান্ত্রিক ভাবনার জগতে একটু উঁকি দিতে চাই।
‘অযান্ত্রিক’ সুবোধ ঘোষের একই নামের ছোট গল্প নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র। যে গল্পের চলচ্চিত্রায়নে ঋত্বিক নিজস্ব ভাবনা ছড়িয়ে দেবার স্বাধীনতা নিয়েছেন তাঁর নিজস্ব স্বকীয়তার রেখা টেনেই।
একবাক্যে অযান্ত্রিকের গল্পের মূল বিষয়বস্তু, একটা গাড়ি আর তার চালক। যেহেতু ঋত্বিক পরিচালক শব্দ ব্যবহারের ঘোরবিরোধী ছিলেন, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এ লেখায় তাঁর পছন্দনীয় শব্দবন্ধ ‘চিত্রস্রষ্টা’ ব্যবহার করবো। ‘অযান্ত্রিক’কেন্দ্রিক আলাপ গড়ানোর আগে, চট করে একবার কেন পরিচালক শব্দের প্রতি তাঁর ‘না’, সে বয়ানে চোখ রাখা যাক-
‘film is not made, film is built. আমি চিত্রপরিচালক নই আমি চিত্রস্রষ্টা। চিত্র সৃষ্টি করে একজন- সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন চিত্র সৃষ্টি করে, তারা (নিছক) চিত্রপরিচালক নন। একজন সৃষ্টি করেন, প্রণয়ন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘শকুন্তলা’ প্রণয়ন করেছিলেন, তিনি শুধু (তার) লেখক নন।’
উপমহাদেশে ঋত্বিকই প্রথম চিত্রস্রষ্টা, যিনি একটি যন্ত্র মানে একটি গাড়িকে তার সৃষ্টিকর্মের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে দেখতে আগ্রহী হন। এর বছর দশেক আগেই ভিত্তোরিও ডি সিকা নির্মাণ করে ফেলেছেন চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ঠাঁই করে নেওয়া অবিস্মরণীয় সৃষ্টি, ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’। এ চলচ্চিত্রের কাহিনিতে একটি বাইসাইকেল গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিল। কিন্তু সাইকেলটি ছিল অনুভূতিশূন্য। সেদিক থেকে দেখলে, ঋত্বিকই সম্ভবত প্রথম সিনেপর্দায় অনুভূতিশীল যন্ত্রের ব্যবহার করেছিলেন। এর পর বাঙালির আরেক গর্ব সত্যিজিৎ রায় ‘অভিযাত্রী (১৯৬২)’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন, যা ‘অযান্ত্রিক’ দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে মনে করা হয়। তবে অভিযাত্রীতে ব্যবহৃত গাড়িও ছিল অনুভূতিশূন্য। কাজেই ধরে নিতেই পারি, অন্যান্য যেসব চিত্রস্রষ্টা পরবর্তীতে অনুভূতিশীল যন্ত্র (এক্ষেত্রে গাড়ি) ব্যবহার করেছেন, তাঁদের পথিকৃৎ ঋত্বিক কুমার ঘটক।
অযান্ত্রিকের গল্প একটি গাড়ি আর তার চালককে ঘিরে আবর্তিত। স্বয়ং চিত্রস্রষ্টা ঋত্বিক সে গল্পটা বলছেন এভাবে- ‘অযান্ত্রিক completely একটা fantastic realism একটা car, একটা গাড়ি without any trick shot. ওটাকে animate করা হয়েছে। she is the heroine, আর ড্রাইভার হচ্ছে hero. Whole গল্পটা একটা ড্রাইভার আর তার গাড়ি। আর কিছু নেই।’
১৯২০ সালে তৈরিকৃত শেভ্রোলে গাড়িটিকে ঋত্বিক ঘটক অযান্ত্রিকের নায়িকা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, অর্থাৎ যন্ত্রটি নারীসত্তার অধিকারী (ঋত্বিকের মতে)। সুবোধ ঘোষের গল্পে এমন ধারণার ইঙ্গিত অনুপস্হিত। চালক বিমলের সাথে এই গাড়ির রয়েছে এক নিগূঢ় সম্পর্ক। নিশ্চিতভাবেই সে সম্পর্ক নারী-পুরুষের পুতু পুতু প্রেমের নয়। কেননা ঋত্বিক সেরকম গল্প বলায় একদমই অভ্যস্ত ছিলেন না। তাহলে বিমল আর তার লক্কর ঝক্কর গাড়ি যাকে সে ‘জগদ্দল’ নামে ডাকে, তার সাথে কেমন সম্পর্ক দেখিয়েছেন ঋত্বিক? যদিও তিনি তাঁর বক্তব্যে বলছেন, ‘গল্পটা একটা ড্রাইভার আর তার গাড়ি। আর কিছু নেই।’ সত্যিই কী তাই? এমন সাদামাটা সিনেমা দেখে দর্শক বাড়ি ফিরে খেয়ে-দেয়ে ঘুম দেবে এবং সেটা ভুলেও যাবে। এমন নিপাট সাদামাটা বক্তব্য সেলুলয়েডে তুলে ধরবার মানুষ একবগ্গা ঋত্বিক ঘটক নন। এমনটা যে তিনি নন, তাঁর নিজের বক্তব্যই সাক্ষ্য দেয় সে সত্যতার।
‘আমি কোনো সময়েই একটা সাধারণ প্রেমের পুতু পুতু মার্কা গল্প বলি না যে, একটি ছেলে একটি মেয়ে প্রেমে পড়েছে… সাজানো গল্প লিখে বা ছবি করে নির্বোধ দর্শকদের খুব হাসিয়ে বা কাঁদিয়ে ওই গল্পের মধ্যে involve করিয়ে দিলাম, দু’মিনিটেই তারা ছবির কথা ভুলে গেল, খুব খুশি হয়ে বাড়ি গিয়ে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এর মধ্যে আমি নেই…
আমি প্রতি মূহূর্তে একটা ধাক্কা দিয়ে বোঝাব it is not an imaginary story বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে hammer করে বোঝাব যে যা দেখছেন তা একটা কাল্পনিক ঘটনা, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে যেটা বোঝাতে চাইছি আমার সেই thesisটা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি। সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই আমি আপনাকে alienate করব প্রতি মুহূর্তে।’
কমেডি ড্রামা ধাঁচের চলচ্চিত্র অযান্ত্রিকের নিপাট সাদাসিধে গল্পের ভাঁজে ঋত্বিক তার থিসিসটা ঠিকই গুঁজে দিয়েছেন সযত্নে। বোদ্ধাদর্শকের দৃষ্টিতে যা ধরা পড়েছে, কিংবা এখনও আরো অনেকটাই পড়বার অপেক্ষায় আছে। আমি আকাঠ দর্শক, চোখ খুলে দেখলেও অতটা ভেতরের হদিস আমার পক্ষে পাওয়া অসম্ভব।
তবে এটুকু বলতে পারি, দ্বিতীয়বার দর্শনের অভিজ্ঞতা প্রথমবারের তুলনায় খানিকটা ভিন্ন। প্রথমবার দেখার পর বিমল তার চোখের মণি গাড়ির নাম কেন ‘জগদ্দল’ রেখেছে? এমন একটা প্রশ্ন উঁকি দিয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত সেটা হয়েছিল ঋত্বিক বিষয়ক পড়াশোনা একদম না থাকার কারণে। ইতিমধ্যে বিগত কয়েক বছরে যৎকিঞ্চিত ঋত্বিক বিষয়ক বইপুস্তক পাঠের পর শ্রদ্ধেয় মানুষটির ধ্যান-ধারণা বিষয়ে অতি সামান্য অবগত হওয়ার পর কেউ যেন আরেকটু অন্যভাবে তাঁর সৃষ্টিকে দেখে নেবার ফুসমন্তর দিচ্ছে। আমার পক্ষে এরকম আগ্রহ দেখানোটা স্পর্ধিত সাহস, কিন্তু প্রিয় চিত্রস্রষ্টার কথা সে সাহস দেখানোয় ভরসাও দিচ্ছে। তাঁর তো চাওয়াই ছিল, দর্শক তার সৃষ্টি দেখে ভাবুক, প্রশ্ন করুক! ‘ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।’ নিজের ভাবনার ছাঁচে আরেকবার ‘অযান্ত্রিক’কে বসানোর আগে খুব সংক্ষেপে চলচ্চিত্রের গল্পটা বলে নেওয়া যাক।
বিমলের গাড়িটা নড়বড়ে ভগ্নপ্রায়, সেকেলে হলেও বিশ্বস্ত সারথীর মতো রোদ-বৃষ্টি-ঝড় মাথায় নিয়ে যাত্রীকে নির্ধারিত গন্তব্যে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে দিতে পারঙ্গম। বিমল সেটা নিয়ে ভীষণ তৃপ্ত ও গর্বিত। অন্যরা গাড়িটাকে যন্ত্রজ্ঞান করলেও বিমল মানুষ জ্ঞানে তার সাথে কথা বলে, তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটানোর দিকে সযত্ন নজর রাখে। তার ঝরঝরে ভঙ্গুর গাড়ি সম্পর্কে সতীর্থ ড্রাইভারদের ব্যঙ্গ উপেক্ষা করে যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। গাড়িটা বিকল হয়ে কখনও হতাশ করেনি তাকে। এই গাড়ি যাকে বিমল আদর করে ‘জগদ্দল’ নামে ডাকে আর দশটা গাড়ির মতো তার সর্দি কাশি হয় না কখনও। বিমলকে খুব ভালো বোঝে জগদ্দল। বিমলের চোখের মণি গাড়িটা। তার দু’বেলার অন্ন জোগায় জগদ্দল। এক গ্যালন তেলে বাইশ মাইল ছুটে চলে। কারণ জগদ্দল জানে বিমল গরীব। একজন স্নেহশীলা মা কিংবা মমতাময়ী প্রেমিকা যেভাবে প্রিয়জনের অভাব অনটন বুঝে নেন, জগদ্দল যেন সেভাবে বুঝে নেয় বিমলের সাধ্য খুব সীমিত। দু’জনের মধ্যকার এতকালের বোঝাপড়া ও হৃদ্যতার মধ্যে একদিন এক নারীর ছায়া পড়ে। গাড়ির আরোহী নারী তার সঙ্গী পুরুষটিকে চলতি পথে চিরুনি দেখে কিনে দেবার বায়না ধরে গাড়ি থামানোর জন্য, বিমলের কাঁধ স্পর্শ করা মাত্র ‘জগদ্দল’ সংবেদনশীল প্রেমিকার ঈর্ষায় নিজের আপত্তি জানান দেয়। একপর্যায়ে সেই নারীর প্রতি বিমলের অতি সামান্য অনুরাগ জেগে উঠেছে, সেটা বুঝতে পেরে গাড়িটা এক দুর্গম পাহাড়ি পথে বিকল হয়ে যেন তার প্রতিশোধ নেয়। বিমল এই প্রথমবারের মতো গাড়িটাকে শাপান্ত করে, কটূক্তি করে, আঘাত করে। তবু কোনো কাজ হয় না, বরং অপমানের যাতনায় গাড়িটা যেন আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে জীবনের সব আশা মুছে ফেলে। বিমল গাড়িটাকে বহুকষ্টে ঠেলতে ঠেলতে নিজের বাড়িতে পৌঁছায়। তারপর অনেক টাকা খরচ করে গাড়িটাকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে অভিমানী গাড়িটা নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়। তারপর পরিত্যক্ত অচল গাড়িটাকে একদিন এক মাড়োয়ারি লোহা ব্যবসায়ী সের দরে টুকরো করে কিনে নিয়ে যায় ঠেলাগাড়িতে করে। নিরুপায় বিমলের বুক ফেটে যায় পনেরো বছরের সঙ্গী প্রিয় গাড়িটাকে এভাবে বিক্রি করে দিতে। শেষ দৃশ্যে বিক্রয়কৃত গাড়িটা ঠেলায় চড়ে চলে যাবার পর বিমল যখন উদাস চোখে পথের দিকে তাকিয়ে ছিল, তখন হঠাৎ মৃত গাড়িটার ভেঁপুটা বেজে ওঠে কোথাও। চমকে যাওয়া বিমলের দৃষ্টি তখন খুঁজে পায় গাড়ির পরিত্যক্ত ভেঁপুটি নিয়ে খেলার ছলে শব্দ বের করার চেষ্টা করছে প্রতিবেশী এক হাস্যোজ্জ্বল শিশু। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে বহুচেনা সেই ভেঁপুটিকে, তারপর ধীরে ধীরে শিশুর সেই সারল্যমাখা হাসিটা বিমলের মুখেও সঞ্চারিত হয় তার অশ্রুসজল চোখ ছাপিয়ে। সব হারানো মানুষ যেভাবে হেসে ওঠে নতুন কোনো আশ্বাসে।
অনামী সংঘের সাহিত্যানুরাগী বন্ধুদের অনুরোধে লেখা ‘অযান্ত্রিক’ সুবোধ ঘোষের প্রথম ছোটগল্প। এর মূল সুরটা ছিল একজন মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে সৃষ্ট সম্পর্ক। পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে থাকার চিরন্তন সংস্কার। ঋত্বিক এ গল্পের চলচ্চিত্রায়ন করতে গিয়ে গল্পের খোল নালচে একেবারে পালটে দেননি। বরং গল্পের ভাব মোটামুটি ঠিক রেখে নিজস্ব কিছু ভাবনা তাতে জুড়ে দিয়ে গল্পটিকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গেছেন। সে সৃষ্টি সম্পর্কে ঋত্বিকের মন্তব্য, ‘কতখানি সার্থক হয়েছি, সেটা আপনারা বলবেন, তবে আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। সুবোধ বাবুর মূল বক্তব্যের প্রতি আমি চেষ্টা করেছি বিশ্বস্ত থাকতে। জানি না কতখানি কৃতকার্য হয়েছি।’
সুবোধ ঘোষের গল্পের গাড়িটা ছিল ‘সাবেক আমলের একটা ফোর্ড, প্রাগৈতিহাসিক গঠন, সর্বাঙ্গে একটা কদর্য দীনতার ছাপ।’ আর চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত গাড়িটা শেভ্রোলে জেলপি (an old 1920 Chevrolet jalopy)। কৌতূহল জাগে ঋত্বিক গাড়ির মডেল বদলে নিলেও ‘জগদ্দল’ নামটি কেন বদলাতে আগ্রহী হলেন না? গাড়িটা তো বিমলের চোখের মণিবিশেষ, এমন আদরের বস্তুর এমন নামকরণটা অদ্ভুত নয়! জগদ্দল মানে তো ‘এমন গুরুভার যা নড়ানো যায় না’। বিকল হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত তো জগদ্দল বুড়ো হলেও অনেক নতুন গাড়িকে টেক্কা দেয় বলে গর্ব করতো বিমল। বিমলের চোখে পঙ্খিরাজসম গাড়ির নামকরণটা অক্ষত রাখার অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে কী?
‘মেঘে ঢাকা তারা’র কেন্দ্রীয় চরিত্রের নামের ক্ষেত্রে ঋত্বিক ব্যক্তিগতভাবে তাঁর আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। নিজেই ‘নীতা’ নামটি দিয়েছিলেন সযত্নে। ‘অযান্ত্রিক’-এ গল্পকারের দেওয়া নাম ‘জগদ্দল’ চাইলেই তো তিনি পালটে নিতে পারতেন। কিন্তু সেটা করেননি। এই না করার পেছনে ১৯৪৮ সালে চিরদিনের মতো নিজের জন্মস্হান ছেড়ে আসার গুরুভার, দুই বাংলা ভেঙে যাওয়ার জগদ্দল বেদনা উদযাপনের তাগিদ নেই তো! কী জানি…
‘ঋত্বিকদা, দুই বাংলার ভাগ নিয়ে আপনার সব ছবিতেই বড্ড মাতামাতি!’ সুহৃদদের এই অভিযোগ খণ্ডনে একরোখা ঋত্বিকের বক্তব্য সোজা আর স্পষ্ট- ‘মাতামাতি! বাংলাকে ভেঙে চুরমার করে দিল আর মাতামাতি! বিক্ষুব্ধ সময়ে মুজরো করব?’
প্রথম নির্মিত চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’ মুক্তি না পাওয়ায়, তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন তাঁর দ্বিতীয় নির্মাণ, কিন্তু প্রথম মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়া সৃষ্টিকর্মে নিজের বিক্ষুব্ধ অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটুক। সেটা তিনি কোথায় ঘটিয়েছেন ‘অযান্ত্রিক’-এ? চিরদিনের জন্য স্হির হয়ে যাওয়া জগদ্দলকে যে আর আগের অবস্হায় ফেরানো সম্ভব না, সেটা বিমলের মতো দক্ষ গাড়ি মিস্ত্রির অজানা তো ছিল না। তবুও নিজের বিক্ষুব্ধ মনের জেদটা নতুন কিনে আনা যন্ত্রপাতির মোড়কে জগদ্দলের মধ্যে প্রতিস্হাপনের চেষ্টায় কী দেখাতে চেয়েছেন ঋত্বিক? ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যুর’ এ সত্যিটা তিনি যেমন মানতেন..দুঃখ পেরিয়ে সুন্দর সকাল এসে দাঁড়ানোর, ‘তবুও অনন্ত জাগে’র প্রতিও তাঁর ছিল অগাধ আস্হা। তাই দর্শক মনে কেবল মাত্র হতাশা ছড়িয়ে তাঁর চলচ্চিত্রের পর্দা নামতো না। ধ্বংসে না সৃষ্টিতেই তিনি আস্হাশীল ছিলেন, যতটুকু বুঝেছি। তাই ‘অযান্ত্রিক’-এ চিরদিনের মতো বিকল হয়ে যাওয়া জগদ্দলকে বিদায় জানিয়ে, চোখে জল নিয়ে ছোট্ট শিশুর নির্মল হাসিতে বিমল নিজেও হেসে উঠে নতুনের আগমনকে স্বাগত জানায়। পুরোনোকে আঁকড়ে না থেকে তাকে বির্সজন দিয়েই তো নতুনের প্রতি আবাহনে যেতে হয়। দর্শক মনে এই বক্তব্য গেথে দেওয়ার আন্তরিকতাটুকু বেশ চোখে পড়ে।
গল্পে না থাকলেও ঋত্বিক তাঁর চলচ্চিত্রের কাহিনিতে বিশেষ তিনটি চরিত্র জুড়ে দিয়েছেন। বালক সুলতান, পাড়াতো দাদার সাথে পালিয়ে আসা আরোহী নারীটি, যার প্রতি বিমলের মনে দলছুট স্বপ্নেরা কিছু সময়ের জন্য আসন নেয়। মূল গল্পে গাড়ির পিস্টন ভেঙে, বিয়ারিং গলে গিয়ে একটা বড় রিজার্ভ নষ্ট হয়ে শেষমেশ চিরতরেই গাড়িটা বিকল হয়ে যায়। অর্থাৎ তার বিগড়ে যাওয়াটা সম্পূর্ণ যান্ত্রিক। চলচ্চিত্রে হুবহু সেরকম দেখানো হয়নি। অযান্ত্রিক এক বোধে, অতি সংবেদনশীল জগদ্দল পরনারীর প্রতি বিমলের অনুরাগেই যেন অভিমানে চিরদিনের জন্য মূক হয়ে গেল! আরেকটি চরিত্র বিমলের মৃত মা। যার মৃত্যুর পরই জগদ্দলের আগমন এবং পনেরো বছর ধরে বিমলকে কখনও প্রিয়সখা, কখনও অন্নদাতা অথবা মায়ের ছায়া হয়ে সঙ্গ দিয়ে গেছে। এই তিনটি চরিত্রই গাড়িটির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ছিল।
বিশাল দেশ ভারতে নানাজাতির বাস। ভিনভাষী সেসব জাতির আচার-ব্যবহারের দৃশ্য নিজের চলচ্চিত্রে ব্যবহারের বিষয়ে ঋত্বিক বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। ‘অযান্ত্রিক’ সিনেমাতেও সেরকম দৃশ্যের উপস্হিতি আছে।
গল্পে বিকল গাড়ি ‘ঠং ঠং ঠকাং ঠকাং’ শব্দে ভেঙে নেবার মধ্যে দিয়ে সমাপ্তি ঘটলেও ঋত্বিক চলচ্চিত্রের কাহিনিতে আরো একটু সংযোজন করেন। যা কিনা গল্পটিকে অন্য এক মাত্রা দেয়। আমরা দেখি, হাসিমাখা মুখে ছোট্ট এক শিশু জগদ্দলের পরিত্যক্ত ভেঁপুটি বাজাচ্ছে.. বুঝে যাই, ঘটে গেছে নতুনের কেতন হাতবদলের ঘটনা, আগামীকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত এক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে দুই বয়সের দু’জন মানুষ। হতাশা না, আশাবাদের বক্তব্য দিয়েই ঋত্বিক চাইতেন তাঁর সৃষ্টির সমাপ্তি টানতে। তাঁর এই ইতিবাচক স্বাক্ষরটি কম-বেশি সব সিনেমাতেই লক্ষণীয়।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর কথা এ প্রসঙ্গে আনা যেতে পারে। এটির উল্লেখ কেন করছি সেটা চিত্রস্রষ্টার বক্তব্যে স্পষ্ট হবে আশা করি, ‘তিতাসের গল্পটা অদ্বৈত মল্লবর্মণ যা বলবার চেষ্টা করেছেন তা হচ্ছে- নদীর ধারে একটা জেলেদের সমাজ এবং সেই নদীটা আস্তে আস্তে শুকোতে শুকোতে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, সেই সঙ্গে সেই সমাজটাও চুরমার হয়ে গেল। তার স্মৃতি বহন করছে শুধু একটি ব্যাপার আশপাশের গ্রামের লোক এখনও বলে যে, এখানে তিতাস নামে নদী ছিল। অদ্বৈতবাবু এখানে শেষ করা সত্ত্বেও আমি একটু টেনে ছেড়েছি। নদী আর নেই, কিন্তু ধানের ক্ষেত রয়েছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, একটা সভ্যতা শেষ হয়ে যাওয়াটাই শেষ নয়। তার মৃত্যুর মধ্যেই উপ্ত আছে নতুন সভ্যতার বীজ। এভাবেই মানব জীবন প্রবাহ চলে।’
একই ব্যাপার অযান্ত্রিকের শেষেও দেখতে পাই…
ঋত্বিকের আরেকটি নিজস্ব স্বাক্ষর হচ্ছে মামুলি চরিত্রের মুখে ওজনদার সংলাপ তুলে দেওয়া। সে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’র মুটের মুখে শোনা- ‘এ লড়াইয়ের জায়গা, কলকাতা শহর, দয়া মায়া কুছু নেই। যা ঘরে চলে যা।’ হোক, কিংবা ‘অযান্ত্রিক’-এর ক্ষ্যাপাটে লোকটার মুখে শোনা, ‘খালি আসা আর যাওয়া, তবে এলেন কী করতে?’ ‘পুরোনো গামলাটা? সেটা কবে ভুলে গেছি…এটা একেবারে চকচক চকচক করছে…’ এসব সংলাপ আপাত নিরীহ মনে হলেও এমন সব বক্তব্যের ভাঁজে চুপচাপ বসে থাকে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত আর এমন সব বক্তব্য পৌঁছে দিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন সৃষ্টি করতে চাওয়াটাই তো ঋত্বিকের প্রিয় বিষয় ছিল। আমাদের যান্ত্রিক জীবনে নেমে আসা হতাশা, বেদনার জটাজালকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে অযান্ত্রিক এক মানবিকতার জয়ধ্বনি শোনাবেন বলেই ঋত্বিক কুমার ঘটক চলচ্চিত্র মাধ্যমকে বেছে নিয়েছিলেন। আরো বহুদিন নীলকণ্ঠ ঋত্বিক ঘটকের স্মরণীয় সৃষ্টিগুলো বইয়ের পাতায় কিংবা সেলুলয়েড জুড়ে বারবার আমাদের প্রশ্নহীনতায় মগ্ন চৈতন্যে hammer করে করে বোঝাতে চাইবে, কেন প্রশ্ন করা প্রয়োজন। কোথায় প্রশ্ন করা জরুরি!
—————————
ঋণস্বীকার:
১) ‘নিজের পায়ে নিজের পথে’- ঋত্বিক কুমার ঘটক
২) ১৬টি সাক্ষাৎকার- সম্পাদনা উত্তম কুমার
৩) ‘অযান্ত্রিক’- সুবোধ ঘোষ
৪) ‘ঋত্বিক’- সুরমা ঘটক
৫) ‘চলচ্চিত্র সাহিত্য ও আমার ছবি’- ঋত্বিক কুমার ঘটক
৬) উইকিপিডিয়া
৭) ‘অযান্ত্রিক’-চলচ্চিত্র