অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিশির আজম -
টেস্ট অব চেরি: আব্বাস কিয়ারোস্তামির মৃত্যুভাবনা ও সফট পপুলার কালচার সিনথেসিস

আব্বাস কিয়ারোস্তামি গল্প বলেন না। অনুভূতি প্রকাশ করেন। তাও সবটুকু না। দর্শকের জন্য অবারিত সুযোগ থাকে তার অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার। এমন কি পরানুভূতির উসকানিতে দগ্ধ হওয়ার।

Taste of Cherry কে সিনেমা না বলে পোর্ট্রেট বলা যায়। আত্মহত্যায় আগ্রহী ভাবলেশহীন এক মুখচ্ছবি। ব্যাকস্পেসে আছে পাথুরে হলুদ পাহাড়, রুক্ষ মরুভূমি আর ইরানের শহুরে শ্রমিকজীবন। মধ্যবিত্ত এক পুরুষের আত্মহত্যাকে উপজীব্য করে এই সিনেমা রচিত হলেও এই সিনেমার মূল স্পিরিটে আত্মহত্যা নেই। তাহলে কী আছে? কিছুই নেই। কিছুই বলতে চাননি আব্বাস। সিনেমায় আব্বাস কিছুই বলতে চান না। আব্বাসের দর্শক পরিণত, শিশুর মতো। তিনি কোনো দার্শনিকতা চাপিয়ে দিতে চান না দর্শকের ওপর। টেকনিকের কূটকচালি নেই। কী আছে? কী আছে সেটা দর্শক খুঁজে বেড়ান। আব্বাস দর্শককে সিনেমার অংশ মনে করেন। এমনকি টেস্ট অব চেরিতে বাদি নামে আত্মহত্যাকামী পুরুষের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন সেই হুমায়ন এরশাদিও পেশাদার অভিনেতা নন। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমায় আব্বাস কিয়ারোস্তামি কোনো পেশাদার অভিনেতার প্রয়োজনবোধ করেননি। তার পূর্বসূরি ভিত্তোরিও ভি সিকাও বারবার এটা করেছেন। ফরাসি রবার্ট ব্রেসোর ক্ষেত্রেও এটা আমরা দেখি।

প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামিজম জারিত ইরানে একজন খুব সাধারণ মানুষকে আমরা দেখি গাড়ি চালিয়ে নিরাবেগভাবে রাস্তায় ঘুরতে। বোঝা যায় তিনি কাউকে খুঁজছেন। বাদির এই ভ্রমণের ভিতর আব্বাস আমাদের সামনে হাজির করেন একের পর এক ল্যান্ডস্কেপ। আমরা সমসাময়িক ইরানকে দেখতে পাই। যদিও পরিচালক সচেতনভাবে এটা করেননি, দর্শককে সচেতনভাবে কোনো মেসেজ দিতে তার অনীহা। এই মুভিতে অল্প কয়েকটি মাত্র চরিত্র। সমালোচকগণ ট্র্যাডিশনালি এই মুভিকে বিশ্লেষণ করতে পারবেন না। আব্বাসের সব ছবির ক্ষেত্রেই কমবেশি এটা সত্যি। চরিত্রগুলোর কোনো কাজ নেই। পরিচালকের দিক থেকে, অভিনয়প্রবণতা নেই। তারা সব একেকটি পোর্ট্রেট। SHIRIN-(2008)-এ এটা আরও বেশি চোখে পড়ে)।

এই সিনেমায় কোন নাটকীয়তা নেই, ফ্যান্টাসি নেই।  এমনকি দর্শক ক্লান্তিবোধ করতে পারেন। কিন্তু এ ব্যাপারে পরিচালক একেবারেই নির্বিকার। দর্শককে তিনি কোনো গল্পে নিমজ্জিত করতে চাননি। এমনকি যতক্ষণ না তরুণ কুর্দি সৈনিকের সঙ্গে তার দেখা হয় তার সঙ্গে কথা বলার একেবারে শেষ পর্যায়ে আমরা জানতে পারি, বাদি আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছেন। তিনি এমন একজন লোক খুঁজছেন যিনি তাকে আত্মহত্যায় সাহায্য করবেন। এই কাজের জন্য তিনি পর্যাপ্ত টাকা দেবেন। কাজটা খুব সাধারণ। এই সাধারণ কাজটা করবার মতো লোক তবু তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। প্রথম যে দু’জন ব্যক্তিকে তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন তারা রাজি না। টাকার বিনিময়ে তারা আত্মহত্যায় সহযোগিতা করতে পারবেন না। ধর্মবিশ্বাস এ কাজে তাদের বাধা। তৃতীয় ব্যক্তি বাঘেরি একজন অধ্যাপক রাজি হন। তার ছেলে অসুস্থ। সুস্থ হতে অনেক টাকা দরকার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি বাদি সাহেবের আত্মহত্যায় সহযোগিতা করবেন। কাজটা কঠিন না। তেহরানের এক বিরান এলাকায় বাদি সাহেব নিজেই নিজের কবর খুঁড়ে রেখেছেন। তিনি অনেক ঘুমের ঔষধ খেয়ে রাতে কবরে শুয়ে পড়বেন। টাকা-পয়সা আর গাড়ি কাছেই রাখবেন। ভোরবেলা বাঘেরি সাহেব কেবল তাকে মাটিচাপা দেবেন। জাস্ট এটুকুই কাজ। কাজ হলে টাকা আর গাড়ি নিয়ে চলে যাবেন। গল্প এটুকুই।

কিন্তু এটা বলার জন্য পরিচালক ৯৫ মিনিটের সিনেমা বানাননি। সিনেমাটা স্লো। (এ দোষ আব্বাস কিয়ারোস্তামির পুরোনো) ‘টেস্ট অব চেরি’তে হিচককের সাসপেন্স নেই, ঋত্বিকের শেকড়চ্যূতির হাহাকার নেই, নেই তারকোভস্কির কাব্যময়তা। এমনকি চেরিফলও নেই। চেরি কি মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি? আব্বাস আমাদের তা বলেননি।

আপনি যদি আব্বাস কিয়ারোস্তামির সিনেমা পূর্বে না দেখে থাকেন, তাহলে ‘টেস্ট অব চেরি’ দেখতে দেখতে নিশ্চিত ঘুমিয়ে পড়বেন, আমি হলফ কবে বলতে পারি। কারণ এটা কোনো সিনেমা না এতে সিনেম্যাটিক কিছু নেই! সিনেমা বলতে আলাদা একটা মিথ আমরা তৈরি করে নিয়েছি অথবা বলা যায়, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সিনেমা বলতে এমন একটা ছাঁচ আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। যে কারণে আব্বাসের সিনেমা আমাদের কাছে সিনেমা মনে হয় না।

আব্বাস কি স্টিল লাইফ আঁকলেন? জেনে রাখুন, আব্বাস হতে চেয়েছিলেন ছবি আঁকিয়ে। তারপর পড়ে গেলেন ক্যামেরার মায়ায়। মুভির শুরু থেকে আপনি বাদি সাহেবের ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে যতো এগোবেন একের পর এক রঙ আর আলোছায়ায় আপনি জড়িয়ে পড়বেন। বাদির ভিতরকার উত্তেজনা (রঙ) আপনার ওপর প্রভাব ফেলবে। কিন্তু আপনি ভাববেন, এটা অতি স্বাভাবিক। যেমনটা আব্বাস ভাবেন। বিভিন্ন আর্ট মিডিয়ামের ভেতর পার্থক্য তিনি কমিয়ে আনেন, বলা যায় তাদের ভিতর সম্পর্কটা অনেক বেশি কমন, অনেক বেশি সমন্বিত হয়ে ওঠে দর্শকের মননে। একেবারে শেষে ছাড়া মুভিতে মিউজিকের ব্যবহার নেই। এতে দর্শকের কোনো সমস্যা হয় না। এক পর্যায়ে স্ক্রিন অনেকক্ষণ ব্ল্যাক করে রাখা হয়। কেন? এটা কি দর্শকের ওপর এক ধরনের চাপ? আব্বাস কি দর্শকের পরীক্ষা নিতে চান? আপনি যদি আব্বাসের দর্শক হয়ে থাকেন, তাহলে ওই ব্ল্যাক স্ক্রিন ছেড়েও আপনি উঠতে পারবেন না। কারণ আপনি ওই সিনেমার অংশ। দর্শকের প্রতি আব্বাসের শ্রদ্ধাবোধ আছে অথবা বলা যায়, এটা দর্শকের প্রতি আব্বাসের চ্যালেঞ্জ।

আপনি ঋত্বিক দ্যাখেন, গোঁদার দ্যাখেন, এমনকি ল্যাতিন আমেরিকানদের হাতে তৈরি Third Cinema কে আপন অস্তিত্বের সহজাত মনে করেন, তাহলে আমি কে? আপনি কি আমার অস্তিত্বের অংশ না? আব্বাসের এই অবচেতন জিজ্ঞাসাকে আপনি ধারণ না করে পারবেন না।

আরেকটা ব্যাপার মনে রাখা দরকার দেশটা ইরান। ধর্মীয় বিধিনিষেধ সেখানে আগাগোড়া সমাজকে বেঁধে রেখেছে। নারী হিসেবে, মানুষ হিসেবে প্রকাশিত হওয়া, বিকশিক হওয়া সেখানে অনেকটাই অসম্ভব। তাহলে সেখানে সিনেমা তৈরি হচ্ছে কীভাবে? এক্ষেত্রে ইরানি চলচিত্রকারদের শুধু প্রশংসা করলে কম করা হয়। তারা রীতিমতো বিপ্লব সাধন করেছেন। সিনেমায় কী দেখানো যাবে, কী দেখানো যাবে না এটা আগে শাহ ঠিক করে দিতেন। এখন ঠিক করেন খোমেনি ও তার চেলারা।

এর ভিতর ইরান, ইরানের জীবন, জীবনের বহুবর্ণিল ফলগুধারা ঠিকই দেখিয়েছেন ইরানি চলচিত্রকারগণ। আর এর নেতৃত্বে আছেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। ‘টেস্ট অব চেরি’র (একটা অংশে দুটো মাত্র মিডশটে বোরকা-হিজাবহীন এক তরুণীকে আমরা দেখি, তার বয়ফ্রেন্ডের (স্বামীও হতে পারেন) সঙ্গে। বাদিকে ওই তরুণী অনুরোধ করেন ওদের দু’জনের একটা ফটো তুলে দিতে। বাদি সে অনুরোধ পূরণ করেন। মুহূর্তটা অনেক কঠিন। মৃত্যু আকাঙ্ক্ষী এক ব্যক্তির মাধ্যমে আব্বাস আমাদের সামনে জীবনের ফ্যান্টাসি ও অসীমতাকে তুলে ধরলেন। এটাকে (ওই দৃশ্য বা চিত্রকল্প) মিরাকল বললেও কম বলা হয়। আব্বাস যেন সত্য আর মিথ্যাকে নিয়ে খেলা করছেন। জীবন ও মৃত্যুকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়েছেন। জীবনের চেয়ে বড় সত্য নেই।

ট্র্যাডিশনালি মুভিতে যেভাবে সংলাপ দেখি, সেই তুলনায় ‘টেস্ট অব চেরি’তে বাদি খুব কম কথা বলেন। অন্যান্য চরিত্রগুলোর কথা বাদই দিলাম। তাহলে এই মুভির চরিত্রগুলোর কিছু বলার নেই? আপনি নিশ্চয় তা মানবেন না। বাদির থমথমে মুখ নিশ্চয় আপনাকে আলোড়িত করে। এই মুভিতে রঙের ঘাটতি নেই। আছে অসাধারণ সব ল্যান্ডস্কেপ (চেরি গাছসহ), যা মনে করিয়ে দেয় গগাঁর তাহিতিকে, পিসারোর প্যারির রাস্তা অথবা মনের লিলিফুল। আব্বাস কাজটা করেন ক্যামেরা দিয়ে, যেটা একদিন তুলি দিয়ে করবেন বলে উনি স্বপ্ন দেখতেন।

‘টেস্ট অব চেরি’তে আপনি নির্বাক সিনেমার উত্তেজনা অনুভব করবেন। আপনি অনেক সময় হয়তো ভাবেন যে শব্দ এসে আপনার অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিয়ে গেছে। যে ভালোবাসা, যে যন্ত্রণা আপনি ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে চান, তা কেন মুখে বলে বোঝাতে হবে? সংলাপকে বেশি গুরুত্ব না দেবার প্রবণতা আব্বাসের সব ছবিতেই মোটামুটি দেখা যায়। রাস্তার একপাশে বাদি গাড়ি নিয়ে দাঁড়ালে কাজের খোঁজ করা শ্রমিকরা তার গাড়ির কাচের ওপর হামলে পড়ে। বাদি নির্বাক। এ এক চরম দ্বান্দ্বিকতা। একজন প্রত্যাশা করছে চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর সে মারা যাবে আর অন্যরা জীবন বাঁচাতে কাজ চায়, কাজ করে সেই উপার্জনে খেয়ে-পরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাঁচতে চায়। কি বৈপরীত্য! আপনি ভাবতে পারেন বাদির মুত্যুপ্রচেষ্টা একটা খেলা। চলচিত্রকার পরোক্ষভাবে বাদির আত্মহত্যা প্রচেষ্টাকে কটাক্ষ করছেন। যেন বলতে চেয়েছেন, জীবনটা ফেলনা না। এমনকি হলুদ পাথুরে পাহাড়ও দেখো কত জীবন্ত। তিনি চেয়েছেন কবিতা লিখতে, চেয়েছেন ছবি আঁকতে। তার মননে দর্শনে রাজনীতি। বলতে পারেন ‘টেস্ট অব চেরি’ এসব কিছুর সমবায়ক্ষেত।

যে ভাবে মুভিটা শুরু হয়েছে তা না হয়ে মুভিটা অন্যভাবেও শুরু হতে পারতো। পরিচালক মুভিটা এভাবে শেষ করবেন (যেখানে দেখা যাচ্ছে পরিচালক সিনেমার শুটিং করছেন।) এটা আপনি ভাবতেই পারেননি। মানে আব্বাস সিনেমার প্রচলিত ছকটা একেবারেই মানেননি। আসল কথা হলো ‘‘টেস্ট অব চেরি’তে আত্মহত্যার ব্যাপার নিয়ে পরিচালকের অতো মাথাব্যথা নেই। বাদি সাহেবের নিজেরও আত্মহত্যার বিষয়টা নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন দেখা যায় না। (গম্ভীর হতে দেখা যায় অবশ্য)। মুভিটা কি জীবন ও মৃত্যুর ভিতরকার দার্শনিক-ব্যবহারিক প্রতিযোগিতা, না কি জৈব ভাবনায় পরিবর্তনশীল রিদমিক্যাল প্যাটার্নের হ্যান্ডিক্রাফটস? আপনি ভাবতেই পারেন। কিন্তু আব্বাস কিয়ারোস্তামি এখানে অন্যদের থেকে আলাদা। তার The Wind Will Carry Us (1999) ev Certified Copy (2010) তেও এটা আমরা দেখি। আব্বাস শিশুর মতো আমাদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। আমরাও সিনেমার অংশ হয়ে যায়। ‘টেস্ট অব চেরি’ একটা Open Cinema.

+ posts

Read Previous

‘অযান্ত্রিক’ ঋত্বিকের চলচ্চিত্র

Read Next

হাসান আজিজুল হকের কলম : জীবন খননের হাতিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *