অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রফিকুজ্জামান রণি -
তৃতীয় প্রণয়

কুশীলব

চেয়ারম্যান: বশিরুদ্দিন বাসু; জেলে: রহমান; জেলের স্ত্রী: শেফালি; চেয়ারম্যানের চাকর: মধু; চেয়ারম্যান পুত্র: হাশেম; মেম্বার: মুখলেছ; মেম্বারের চাকর: রইচ; অন্যান্য চরিত্র: জেলে দল, পাড়া-প্রতিবেশি, ডাক্তার-নার্স, দলিল লেখক, ছকিনার মা এবং পুলিশ কর্মকর্তা।

দৃশ্য-১

[অন্ধকারাচ্ছন্ন পবিবেশে। হঠাৎ একঝাঁক মোটর সাইকেলের হর্ন বেজে উঠবে। মঞ্চের একপাশে কুণ্ডলি পাঁকিয়ে বসে থাকা কিছু লোকজন বিচলিত হয়ে উঠবে। হর্নের বেপরোয়া শব্দতরঙ্গ আর হেডলাইটের তীব্র আলোর ফোয়ারায় মুহূর্তের মধ্যে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠবে। ‘বাসু চেয়রমেনের আগমন, শুভেচ্ছার স্বাগতম, দয়ালপুরের পক্ষ থেকে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা’-এ প্রজাতির স্লোগান ভেসে উঠবে। মঞ্চে অপেক্ষমান জনতা নড়েচড়ে উঠবে। মুখলেছ মেম্বার অতীব আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা দেবে-

-ওই তো, ওই তো আমাগো এলাকার তিন তিনবারের সফল চেরমেন, আমাগো দলের থানা সভাপতি আইসে পচ্ছে। হে হে, সব্বাই খাড়াইয়া ভদ্দরলোকের লাহান সেলাম করেন।’ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে কয়েজন সঙ্গী-সাথী নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করবে বশিরুদ্দিন ওরুফে বাসু চেয়ারম্যান। জনতার উদ্দেশ্যে হাসিমুখে হাত নেড়ে নেড়ে বসার জন্যে অনুরোধ করবে এবং মুখলেছ মেম্বারের অনুরোধে নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসবে। মুখলেছ মেম্বার আনন্দে গ্রীবাদেশ ফুলিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করবে]

মুখলেছ মেম্বার : দয়ালপুরের বাই ও বইনেরা, আইজ আমাগো অনেক আনন্দের দিন। চেরমেন সাব, আমাগো এই এলাকাত পায়ের ধুলা দিছে। উনি আমনেগো উদ্দেশ্যি অনেক মুল্যবান কতা কইবো। আমনেরা দইয্য দইরা মোনোযোগ সহকারে হুনবেন। (মেম্বারে কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথা দোলাবে এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রইচ) তার আগে আমরা এট্টু উনারে পুল দিয়া বরণ কইরা লই। (ফুল এনে চেয়ারম্যানের হাতে তুলে দেবে একদল তরুণী, ফুল দেয়া শেষ হলে চেয়ারম্যান সাহেব মেম্বারের কানে কানে কিছু একটা বলবে। মেম্বার মাথা দুলিয়ে সায় দেবে এবং আবার বলতে শুরু করবে)।

-সম্মানিত দয়ালপুরবাসী, আইজ চেরমেন সাবের আরও অনেকগিলা জরুলি মিটিং আছে। এইহান থেইক্কা গিয়াই হেইগুলো ধত্তে অইবো। চটজলদি অনুষ্ঠান শেষ করনের জন্যি উনি তাগিদ দিছে। তাই বেকেরে বক্তিব্য করার সুযোগ দেওন যাইবো না বইল্লা আমরা দুঃকিত। এমুন ব্যস্ততার মইধ্যেও চেরমেন সাব আমাগো টানে ছুইট্টা আইছে এতেই আমরা ধইন্য হইছি। একন আমনেগো সামনে মুল্যবান বক্তিব্য রাখিবেন আমাগো সবার পিয় মানুষ, দয়ালপুরবাসীর নয়নের মনি, আমাগো পাটির সম্মানিত থানা সভাপতি, তিন তিনবারের সফল চেরমেন জনাব বশিরুদ্দিন বাসু বাই। (উপস্থিত জনতা করোতালি দেবে)।

চেয়ারম্যান : (অত্যন্ত বিনয়ী ও মিষ্টিসুরে) আমার অইত্যন্ত পিয় সম্মানিত বাই ও বইনেরা। আমনেরা আছেন বৈল্লাই আইজ আমি বাসু চিয়ারম্যান অইছি। আমনেগো জন্যি যাহা করি তাহা কিচ্ছুই না। তারপরেও আমনেরা আমারে বালোবাসেন বৈল্লাই বারবার চিয়ারম্যান করেন। আমার খুব কষ্ট লাগতাছে, আরও কিছু সোময় এইহানে থাকতে পারলাম না বইল্লা। ত কী আর করা, মিটিংগুলা অনেক জরুলি না অইলে আমনেগো দারেই থাইক্কা যাইতাম হারা রাইত। বেকের কতাই মোন দিয়া হুনতাম। আমরাই কেবল মঞ্চো খাড়াইয়া কতা কমু, আমনেরা কইবেন না, এইডা কিন্তুক হক বিচার অয় নাই আমি জানি।

যাগগা, আসল কতাত আহি- আগামীকাইল, মানি শনিবার দিন- আমাগো কলেজ মাডে পাটির বিশাল জনসভা। কেন্দ্রীয় নেতাগণ আইবো, গান বাজানা অইব, খাওন-দায়োনও আছে। অনেক বরো অনুষ্টান। লোকজন যদি না থাহে ত ক্যামুন অয় কন-চে দেহি, আমগোই ত বদনাম, তাই না? হেই জন্যি ত স্কুল-কলেজ-মাদ্দাসার মাস্টারগোরে কইয়া দিছে ছাত্তরছাত্তী, অবিবাবকসহ সকলতেরে লইয়া য্যান ঠিক সোময় উপস্থিত থাহে। না আইতে চাইলেও বাইধ্য কত্তে অইবো। আর আমারে দিছে আমনেগো দায়িত্ব। জাউল্লা বাইগো সুক-দুঃকের সঙ্গিসাতি হিসাবে সব সোময়ই আমি আমনেগো লগে থাহি এইডা বেকেই জানে। পাশের গিরামের মানুষ আমনেরা। আমনেগো লিগা আমার মনের মইধ্যে সারাক্ষণ হরান হরে আর হরান হরে। আমার বুকের ভিত্তে আলাদা একখান জমিন শুধু আমনেগো লিগাই বরাদ্দ কইরা রাইখছি। আমার দিক চাইয়া অইলেও আমনেরা অনুষ্টান সফল করিতে দলে দলে যোগদান করিবেন। উরপের কটিন নিদ্দেশ। উপস্থিত থাহন লাগবো।

সামনে গাঙে অবিযানের দিন আহে, অনুষ্টানে যারা না থাকবো তাগোরে জাউল্লা কাড, মানি জেলে কার্ড দেওন অইবো না। যারা গাউরামি কইরা না যাইবো তাগো জেলে নেবন্ধন বাতিল কইরা দেওন অইবো। আমি চাই না আমাগো গরিব অসহায় বাই-বইনগণ জাউল্লা কাড থিকা বঞ্চিত হউক। তাগো বিপদ অইলে ত আমারই কষ্ট লাগে হগলতের আগে। আমনেরা সবাই অনুষ্টানে থাইকেন। (হে হে গলা খাকানি দিয়ে একটু শব্দ করে হেসে) চিন্তা কইরেন না, বাসু চিয়ারম্যান থাকতে বয় নাই, অনুষ্টানের হরে বেকের জন্যি প্যাকেটের ব্যবস্থা আছে, হাজিরার খরচও আছে। তইলে আর চিন্তা কী। মেম্বর সাব লিস্টি পাডাইব। আমনেগোরে উপযুক্ত খরচ দিয়া দিমু। সালাম। আমনেরা বালা থাইক্কেন। আল্লাহ হাফেছ।

[বক্তব্য শেষ হলে, অনুষ্ঠানস্থলে কিছুটা হৈ-হুল্লর শুরু হবে, মুখলেছ মেম্বার সবাইকে শান্ত হয়ে বসার অনুরোধ করবে এবং সসম্মানে চেয়ারম্যান সাহেবকে বিদায় জানানো হবে]

 মেম্বার : হে হে (হেসে, কিছুটা কঠোর ভাষায়) হুনলেন তো মিয়ারা চেরমেন সাব কি কইলো? মোনে থাহে য্যান। অনুষ্টানে না গেলি আমনেগো কিন্তুক জাউল্লা কাড দেওন অইবো না। দুই মাস অবিযান, গাঙে মাছ দরন বন্দ থাকবো, জাউল্লা কাড না থাকলি কী খাইয়া বাঁচপেন, এ্যাঁ। তাছাড়া জনসভায় গেলি ত আর খালি আতে আইবেন না, হাজিরা পাইবেন, প্যাকেট পাইবেন। হে হে। সক্কলে মিল্লা যাইবেন, দলে দলে যাইবেন, ক্যামুন?

জেল দল : (সমবেত সুরে) ঠিক আছে মেম্বর সাব, আমরা থাহুম নে।

মেম্বার : তইলে এই কতাই রইল, আইজগার জন্যি উডি। সব্বাই বালা থাইক্কেন, কাইল সমাবেশে একলগে যামু নে ।

[মঞ্চবাতি নিভে আসবে। সবার প্রস্থান]

দৃশ্য-২

[বিকেলের মধ্যমায়, লোকালয়ে পড়েছে প্রকৃতির নিবিড় ছায়া। জনজীবনে এসেছে পরম স্বস্তি। তাবৎ পৃথিবীতে নেমেছে ছায়াশীতল এক কালখণ্ড। এমন সময় একটা হাজিরা খাতা নিয়ে মুখলেছ মেম্বার শশব্যস্ত। তাকে সহযোগিতা করছে রইচ উদ্দিন।]

মেম্বার : রইচ উদ্দি।

রইচ : জি, মেম্বর চাচা।

মেম্বার : কাইল ত সমাবেশ খুব জমছিল রে তাই না? বেকেই ত গেলো। কিন্তু রকমাইন্নারে যে দেহি নাই। অই বেডা কী যায় নাই?

রইচ : না চাচা, অই হোগার পুতে অনুষ্টানে যায় নাই। কাইল নিকি অর নিজের অনুষ্টান আছিল।

মেম্বার : অর অনুষ্টান আছিল মানি? জাউল্লার পুতের আবার অনুষ্টান কি রে রইচ উদ্দি, বিপদির সমুয় ত ঠিক ঠিক ছুইট্টা আহে, আতে-পায়ে দরে, বিপদ কাইট্টা গেলে পাত্তা নাই গা। অই হালা রে খবর পাডা। ক্যান যায় নাই জিগা। জাউল্লার বেডা অইয়া চেরমেন-মেম্বরের কতার দাম দেয় না। কত্ত বড়ো সাবাস।

রইচ : আমি জিগাইছি, কয় কী, বইনের বাইচ্চা অইছে, দেকতে গেছি।

মেম্বার : তুই কিছু কছ নাই হালা রে…?

রইচ : কই নাই মানি, দিব্যি কইয়া দিছি, চেরমেনের কথা কানে যায় নাই? মেম্বরের কথা কানে যায় নাই, বইনের বাইচ্চারে দুইদিন পর দেকতে গেলি কী অইতো। অনুষ্টান ত একদিনের বেপার। অই হালার পুতে কয় কী জানেন, কইলো যে, দলীয় অনুষ্টান অইলেই স্কুল কলেজের ছাত্তরছাত্তী আনো, মাস্টারমুন্সি আনো, জাউল্লাগোরে ডাহো। পাটির কি লোকজন নাই? দলের মানুষ থাকতে আমগো কামডা কি। বইনের বাইচ্চা বরো, না অনুষ্টান বরো।

মেম্বার : (ক্ষেপাটে গলায়) কী! হারাম খোরের বাইচ্চা এই কতা কইছে? অরে খবর দে। অক্ষুনি ফোন লাগা।

[হাজিরা খাতার ভেতর থেকে নম্বর তুলে রইচকে বলবে, রইচ ফোন দেবে এবং দ্রুত যেন মেম্বারের সঙ্গে দেখা করে যায় সেটা জানাবে]

রইচ : দিছি, আইতাছে হালায়। হালারে কয়ডা মিডা কতা হুনাইয়া দিয়েন চাচা। হালার মতিগতি বেশি বালা ঠেকতাছে না। মোনো অয় অইন্য দলের ভিত্তে গিয়া হানদাইছে।

[মঞ্চে রহমান প্রবেশ। মেম্বারকে উদ্দেশ্য করে সালাম ঠুকবে।]

রহমান : মেম্বার সাব, আমারে নিকি বোলাইছেন?

মেম্বার : [মুখে ভেংচি কেটে] তুমি অনেক দামি লোক, কুটিপতি মানুষ, দেখা করবা না নিজের থেইক্কা। তাই না ডাইক্কা উপায় কই? তাই না রে রইচ উদ্দি? (রইচ নিলর্জ্জের মতো হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে সায় দেবে এবং অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করবে।)

রহমান : এ…এইসব কি কন মেম্বর সাব, কিছুই ত বুছতাছি না।

মেম্বার : বুজবা ক্যামনে, ঠেলা না খাইলে ত বাঙালি কিচ্ছুই বুজে না। তোমাগোরে এত্ত ভদ্দর বাষায় চেরমেন সাব দাবাত দিলো অনুষ্টানে, সবাই গেলো, তুমি গেলা না। কামডা কি ঠিক করছো মিয়া?

রহমান : কাইল আমার বইনের বাইচ্চা অইছে। অই হানে গেছিলাম। নইলে ত থাকতাম। মাইনষের কি বিপদ-আপদ থাহে না মেম্বর সাব?

মেম্বার : যাইতে মানা কচ্ছে কেডা? অনুষ্ঠান শেষ কইরা কি বইনের ছাওয়াল দেকন যাইত না? নিকি ছাওয়াল লন্ডন পলাইয়া যাইত? তোমাগো জন্যি এত্ত কিছু করি, আর তোমরা থাহ নিজের সাত্ত লইয়া। এরপর থিক্কা বিপদি পল্লে বইনের ছাওয়ালরেই কইও উদ্দার কত্তে। যাও, আমাগো আর দরকার কী।

রহমান : মেম্বর সাব, একটা অনুষ্টানই ত কামাই দিছি। বেক সমুয়ই ত আমনেগো কথা মোতো চলি। আর বুল অইবো না। সামনের অনুষ্টানগিলাতে থাহার চেষ্টা করুম। গোস্সা কইরেন না।

মেম্বার : সামনের অনুষ্টানে অইবো ভাইয়ের ছাওয়াল, এরপরের অনুষ্টানে অইবো খালার ছাওয়াল, তারপরের অনুষ্টানে অইবো মায়ের ছাওয়াল, সে তোমাগোরে বালা কইরাই চিনি। যাও। যাও, তোমার লগে আর পিরিতের আলাপ কত্তে বাল্লাগে না। তোমগো জন্যি খাইট্টা এই পত্তিদান পাইলাম।

রহমান : মেম্বর সাব…

 মেম্বার : (বিরক্তিকুঞ্চিত হয়ে, হাত উচিয়ে) হু-হু, আর একটা কতাও না…যাও ।

[সালাম দিয়ে রহমানের প্রস্থান]

রইচ : চাচা, এই জাউড়ার গরের জাউড়ায় বউ-নেওটা মানুষ, বউ যেইডা কয় হেউডাই হুনে, অই হালারে জাউল্লা কাড না দিয়া গাঙে ফেলাইয়া দেন, হেইডা কামে লাগবো। হালার পুতে আস্তো একটা রেজাকার। নইলে এমন অনুষ্টান মিছ করে কেহ?

মেম্বার : খাড়া, খাড়া অরে একটা শিক্কা না দিয়া ছাড়ুম না। অপেক্কা কর। বিপদ অইলে ত মুখলেছ মেম্বরের পাও-ই দইরা বইয়া থাহে। বইনের বাইচ্চা ওরে দেহি এইবার বাঁচায় কেমতে। হু।

[মঞ্চের বাতি নিভে আসবে। বাজনা বেজে উঠবে। মেম্বার ও রইচের প্রস্থান]

দৃশ্য-৩

[মঞ্চের এক কোণে মন খারাপ করে বসে থাকবে রহমান। অনেকটা মাথা ব্যথায় আক্রান্ত রোগীর মতো কপালে হাত চেপে বসে থাকবে সে। এসময় প্রবশে করবে তার স্ত্রী শেফালি।]

শেফালি : কী অইছে তোমার। বিহান থেইক্কা দেহি মন খারাপ কইরা বইয়া আছো। (কপালে হাত দিয়ে) কুনো অসুখ ব্যারাম অইলো না ত?

রহমান : আরে না, হুদাই চিন্তা করো। কিচ্ছু অয় নাই। তুমি গরে যাও তো।

শেফালি : আইচ্ছা কী অইছে আমারে কইবা ত। আমি কি তোমার দুরাইর কেহ? তোমার মোন খারাপ থাকলি আমার কি মোন বালা থাহে, কও না কি অইছে?

[শেফালি অত্যন্ত চিন্তাকুল এবং আন্তরিক হয়ে ওঠে। রহমানের বাহুতে হাত রেখে পাশ-ঘেঁষে বসে পড়ে।]

রহমান : গাঙে আবার অবিযান পরছে, শেফু। কাইল থেইক্যা গাঙে নামা বন্দ। পুলিশ পাহারা দিবো। চেরমেনেরও কটিন নিদ্দেশ কুনো জাউল্লা-নাও দেকলেই দরাইয়া দিব। এদিকে মেম্বর হালার পুতেও আমাগো জাউল্লা কাড বাদ কইরা দিছে চেরমেনের দারে হাছামিছা কইয়া। আমি নিকি রেজাকার পাটির লোক। হেই জন্যি নাকি দলের অনুষ্টানে যাই নাই।

শেফালি : তুমি কিছু কও নাই মেম্বররে?

রহমান : কইয়া লাব কী। আমাগো কতা কেডা বিশ্বাস করে। কইলাম, চাচা আর বুল অইবো না। আমি সব অনুষ্টানে থাহুম সামনেতে। হুনে না। বলে কিনা, চেরমেন সাবের নিদ্দেশে কাড বাতিল অইছে। তার কুনো দোষ নাই। একন চেরমেন আপিসে গিয়া যোগাযোগ কত্তে। চেরমেন ছারা আর কারো ক্ষেমতা নাই কাড দিবার। হালায় নিজে কইরা অহন চেরমেনের নাম বেচে। হালার পুতের চামচা রইচ্চাও একটা খানকির পোলা। হেই হালায়ই যত প্যাচ খেলায়।

শেফালি : তুমি যাও তইলে, চেরমেনরে বুঝাইয়া কইলে নিশ্চয় হুনবো। অনেক বালা মানুষ উনি। তোমার কতা ফেলবো না। চিন্তা না কইরা চেরমেন আপিসে যাও।

রহমান : না। আমি যাইমু না, শরম লাগে। অনুষ্টানে যাই নাই। চেরমেনের নিদ্দেশ মানি নাই। গেলে উল্টা অপমান কইরা বাগাইয়া দিলে কী করুম।

শেফালি : তোমার লজ্জা লাগলে আমি যাই? আমি গিয়া কই যে বিপদির জন্যি অনুষ্টানে যাইতে   পারো নাই?

রহমান : (কিছুটা আশ্বস্ত হয়। তারপরও দ্বিধা-ভয় নিয়ে বলে) তুমি যাইবা? তুমি কষ্ট কইরা ক্যান যাইবা শেফু? তোমার লগে যদি খারাপ বেবহার করে। তকন কি অইবো। দরকার নাই। অগোরে বিশ্বাস করোন যায় না। অরা সাত্ত ছাড়া কিচ্ছু বুজে না। সব জাগাত অরা রাজনেতি খোঁজে কেবল। মানুষের কষ্ট বোজে না।

শেফালি : তুমি চিন্তা কইরো না তো। আমি যামু নে। আমি গিয়া চেরমেন সাবরে বুঝাইয়া কমু। অপমান করবো কিল্লাই। আমরা কি চোর না ডাকাইত। দুই মাসের অবিযান, কাড না থাকলি সরকারের চাইল-ডাইল কিচ্ছুই ত জুটবো না। কেমনে চলবা এদ্দিন। তোমার ত অইন্য কামও নাই।

রহমান : হেইডাই ত চিন্তা করি রে শেফু। এদ্দিন কী খাইয়া থাহুম। কেমনে কাডামু। মাছ না দরলি যে যানে বাঁচুম না রে শেফু। জাউল্লা কাডখান না থাকলি কেহ আমাগোরে কিচ্ছু দিবো না। সরকার তো হগলতেরেই কাড দেয় কিন্তুক চেরমেন-মেম্বররা রাজনীতি নিয়া টানাটানি কইরা মানুষগোরে ঠগায় আর নিজেগো সাত্ত উদ্দার করে। সারাক্ষণ চুরির দান্ধায় থাহে।

শেফালি : তুমি হুদাই চিন্তা করো। দেকবা চেরমেনের দুয়ারে গেলে সব ঠিক অইয়া যাইবো। (রহমানের বাহুতে হাত রেখে বসা থেকে উঠার তাগাদা দেবে।) উডো, চিন্তা না কইরা কিছু মুকে দাও। যা অওয়ার অইবে। আল্লায় মুক দিছে, খাওনও আল্লাই দিবো। চলো তো গরে চলো।

[দুজনের প্রস্থান]

 দৃশ্য-৪

[বাইরে কড়া রোদের উত্তাপে জনজীবন অতিষ্ঠ। শেফালি ঘামে একাকার হয়ে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে এসে হাজির হয়। এখানে চলছে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের কাজ। নিবন্ধিত জেলেরা সরকারি ত্রাণ নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় অপেক্ষা করার পর চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায় শেফালি। অফিস কক্ষে প্রবেশ করে।]

শেফালি : সেলাম চেরমেন সাব।

চেয়ারম্যান : ওয়ালাইকুমু।

[অবাক ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ারম্যান তাকিয়ে থাকবে এই অপরিচিত ভদ্র মহিলার দিকে। জেলে বউ হলেও শেফালির চেহারায় ও চলাফেরায় আভিজাত্যের ছাপ দেখা যায়। চেনার উপায় নেই যে স্বামী তার নৌকায় মাছধরা জেলে]

শেফালি : একটা জরুলি দরকারে পইরা আমনেরে জালাতন কত্তে আইছি চেরমেন সাব।

চেয়াম্যান : না না, জালাতন অইব ক্যান, আমি ত তোমাগো সেবার জন্যিই এই চেয়ারে বইলাম। ত কি কইবা তারাতারি কও- আমার এট্টু বাইর অইতে অইবো দুরুত। ডিসি আপিসে জরুলি মিটিং আছে। তয় তোমারে ত চিনতে পারলাম না, তুমি কেডা…

শেফালি : আমি দয়ালপুরের রকমান জাউল্লার ইস্তিরি। আমগো হে’ দলের অনুষ্টানে যাইতারে নাই বইল্লা জাউল্লা কাড বাদ অইয়া গেছে। মেম্বর সাব কইছে আমনের লগে যোগাযোগ কল্লে কাডখান ফিইরা পাওন যাইব। হেল্লেগ্গাই আইলাম।

চেয়ারম্যান : (একটু বিস্মিত হয়। একটা সাধারণ জেলের ঘরে এতো সুন্দর স্মার্ট স্ত্রী থাকতে পারে তার জানা ছিল না।) ও…হ্যাঁ, মনে অইছে। আসলে উরপের নিদ্দেশ ত.. আমাগো আর কী করবার থাহে কও, তবু যেতু আমার দুয়ারে আইয়াই পচ্ছ, কষ্ট কইরা এককান দরখাস্ত দিয়ে যাও, ঠিকানা ও মবাইল নম্বরসহ- দেহি কিচ্ছু করন যায় কিনা। তয় এইবার আপাদত কষ্ট কইরা থাহন লাগবো। কারণ, সব কাড বিলাই অইয়া গেছে। নতুন কইরা দেওনের সুযোক নাই। সামনেতে ঠিক ঠিক পাইয়া যাইবো।

শেফালি : না মানি, হইল গিয়া, মানি…

[কিছুকাল স্তব্ধ থাকবে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারবে না]

চেয়ারম্যান : কিছু কইবার চাও? ডর নাই। এইহানে লজ্জার কিচ্ছু নাই। কি কইবা কও দেহি।

শেফালি : চেরমেন সাব, যদি এইবার কিচ্ছু কইরা দিতেন বড়ো উপকার অইতো। দুই মাস। কুনো কাম কাইজ ত নাই লোকটার। আমরা কী খাইয়া বাঁচুম।

চেয়ারম্যান : উফ, বড়ো বিপত্তিতে ফেলাইলা যে। (পকেট কচলে হাজারখানেক টাকা বের করে শেফালির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে) টেকাডা রাহো। আপাদত কষ্টেসিষ্টে চালাইয়া যাও। কোনো বিপদ অইলে আমারে ফোন দিয়া কইও। আমি দেহি কিছু করন যায় কিনা।

শেফালি : (কিছুটা লজ্জিত হবে। টাকা নিতে সংকোচ বোধ করবে) না থাক, চেরমেন সাব। টেকা-পইসা লাগবো না। কাড-খান ঠিক কইরা দিলেই অইব।

চেয়ারম্যান : আরে শরমের কী আছে। বোকা। রাহো, রাহো, বাজারে জিনিসপত্তের যা দাম দেকতাছি। তাতে কিছু অইবো না জানি, তবুও রাহো। সমস্যা অইলে ত আমি আছিই। লজ্জা-শরমের কিচ্ছু নাই। অবস্থা বালা অইলে দরকার অয় দিয়া দিবা। না দিলেও আমার দাবি নাই। খোদায় আমারে বেবাক দিছে।

শেফালি : আমনের দয়া দেইক্কা খুব খুশি হইলাম চেরমেন সাব। আমগোলিগা আমনের অনেক মায়া।

চেয়ারম্যান : ধুর, কী যে কও, পত্তেকদিনই ত কত্ত কত্ত মাইনষেরে দিতে অয়। আমারে কি টেকা-পইসা কম দিছে নিকি আল্লায়। তোমরা বাঁইচ্চা থাকলেই ত আমি বাঁচি। তোমরা অইলা গিয়া আমার ভোডার। তোমাগো ভোডের জন্যিই আইজ এই চিয়ারে বইয়া আছি আমি। তাই না? তয় একটা কতা রকমানরে গিয়ে কইও, গাঙে য্যান ভুলেও অবিযানের সোময় না নামে। পুলিশ গুল্লি করবো এইবার, উরপের নিদ্দেশ, ডিসি সাব আর এসপি সাবও খুউব গরম। ইলিশ সম্পদ রক্কায় সরকার অনেক বেশি কটিন অবস্থানে চইলা যাইতাছে দিনদিন। আর আমিও দায়িত্ব পালোনের ভিত্তে অবহেলা করুম না। কারণ, এই অবিযানডা সফল কত্তাল্লে আমারলিগা অনেক সুবিদা অইবো। এইবার জিলার শ্রেষ্ট চিয়ারম্যান পুরস্কার পাইতেই অইব আমার। আমি কিন্তুক কাউরেই ছার দিমু না কইছি। শেষে কিন্তুক গোস্সা অইতারবা না… অইলেও কাম অইব না কইয়া দিলাম। হু।

শেফালি : ঠিক আছে চেরমনে সাব। কমু নে।

চেয়ারম্যান : (ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে) এইডা রাহো। দরকার পল্লে মবাইল কইরো। আমার ডিসি আপিসে মিটিং আছে। আইজ তাইলে উডি।

[চাকর মধুকে ডেকে শেফালিকে গাড়িতে উঠিয়ে দিতে নিদের্শ দেবে চেয়ারম্যান। চাকর সায় দেবে। শেফালিকে নিয়ে এগিয়ে যাবে। মঞ্চের বাতি নিভে আসবে। প্রস্থান।]

দৃশ্য

[মুখলেছ মেম্বার ও রইচ উদ্দিনের মঞ্চে প্রবেশ।]

মেম্বার : হুন রইচউদ্দি, কাইল থিক্যা গাঙে একটা জাউল্লা নাও য্যান না নামতারে খেয়াল নিবি । চেরমেনের সাফ কতা, সরকারি কামে অবহেলা কইরা পুলিশের আতে দরা খাইলে কারো জন্যি সুয়ারিশ কইবো না। ডিসি সাব নিকি কইছে, ইলিশ ধরার খবর যেই ওর্য়াডে হুনা যাইবো হেই ওয়ার্ডের মেম্বররেও বাঁশ দিবো। আমি চাই না আমার বদনাম অয়।

রইচ : চাচা, আমনে কোনো চিন্তা কইরেন না। কুনো হালারে গাঙের পাড়েই যাইতে দিমু না। (একটু হেসে) হে হে, চাচা, অই রকমান হালার বউ নিকি চেরমেনের আপিসে গেছে? হালায় দেহি কাড বাগাইয়া ছাল্লো! আমনে হাইরা গেলেন ওই রেজাকারের বাচ্চার লগে?

মেম্বার : আরে না, কাড কি এত্ত সোজা? টেকা-পইসা কয়ডা দিয়া আপদ বিদায় কচ্ছে চেরমেন সাব।

রইচ : তয়, চেরমেন সাব কামডা ঠিক করে নাই, দলের অনুষ্টানে যায় নাই তারপরেও সাহায্য করা মানি হালারে লাই দিয়া দেওন। হালায় তো অহন খুশিতে ফাল-ফারতাছে।

মেম্বার : আরে, হেইডা কোনো বেপার না। মাইয়া মানুষ, চেহারা সুরত বালা, কান্দাকাডি কল্লো, চেরমেন সাবের দয়া অইয়া গেলো, খালি আতে ফিরাইতে হাল্লো না। এই আর কি।

রইচ : হালায় কত্ত বরো বজ্জাত, নিজে না গিয়া বউরে পাডায়, বউয়ের রূপ দেইক্কা য্যান দয়া উতরাইয়া উডে, হালারপো হালায় হেই বুদ্দি লইছে, রেজাকারের ছাওয়াল দেহি বড় সেয়ানা অইয়া উডতাছে দিন দিন।

মেম্বার : তয় ওই রকমাইন্নার দিক নজর রাকবি। হালায় য্যান কুনোবাবে গাঙে নামতে না হারে। হালায় নামলেই খবর দিবি। চল। এলাকাত বেকেরে কইয়া দিয়া আহি গাঙের মইধ্যে নৌকা লইয়া য্যান না নামে দুই মাস। নামলে খবর আছে।

[মেম্বার ও রইচ উদ্দিনের প্রস্থান।]

দৃশ্য-৬

[মঞ্চে সন্ধ্যার আবহ বিরাজ করবে। শেফালি প্রবেশ করবে। ‘আমার মতো এতো সুখি, নয় তো কারো জীবন, কী আদর, স্নেহ ভালোবাসা, জড়ানো মায়ার বাঁধন, জানি এ বাঁধন ছিঁড়ে গেলে কভু, আসবে আমার মরণ’-আয়নার দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইবে। ভেতরটা তার অজানা কারণে আর্দ্র হয়ে ওঠবে। মিষ্টি সাজের মধ্যেও খুব বিমর্ষ দেখাবে। এ সময় প্রবেশ করবে রহমান। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরবে শেফালিকে। দুজনের খুঁনসুটি ও পায়চারি চলবে কিছুকাল]

রহমান : আইজগা খুব সোন্দর লাগতাছে রে শেফু…

শেফালি : ক্যান আবার নতুন কইরা রূপ জাগলো নিকি।

রহমান : জানি না, তয় খুব সোন্দর লাগতাছে এইটুক জানি।

শেফালি : থাক, থাক আর পাম মারোন লাগবো না। সবই বুঝি। হু।

[একটু লাজুক ও অভিমানীর ভান করে]

রহমান : (তপ্তশ্বাস ফেলে, তার চিবুকে হাত রেখে) তোমার মুকখানের দিক চাইলে অনেক কষ্ট লাগে রে শেফু।

শেফালি : ক্যান ক্যান, আমি আবার কি কচ্ছি।

রহমান : বেজায় আশা-বরসা লইয়া আমার গরে আইলা, ট্যাকা-পইসাওয়ালা বাপের মাইয়া তুমি। বাপ-মার অবাইদ্য অইয়া গর থেইক্কা বাইর অইয়া আইলা, বিয়া করলা আমারে। আইজও কারো সামনে গিয়া খাড়াইতারো না। কিন্তুক আমি তোমারে দুইবেলা ভাতও ঠিক মতোন খাবাইতারি না। নতুন একখান কাপরও না হারি কিন্না দিতে। আমার ঘরে আইসে বড় ঠগ খাইছো শেফু। খুব খারাপ লাগে কতাডা চিন্তা কল্লে।

শেফালি : ধুর, তোমারে কি কুনো দিন কইছি এইডা লাগবো, ওইডা লাগবো? অবাব নিয়া কুনোদিন বিরক্ত কচ্ছি? তুমি কাছে আছ এইডাই আমার সবচেয়ে বড় পাওনা। আমি অনেক সুকি অইছি। শুধু আমারে তোমার বুকের মইধ্যে বাইন্দা রাইক্কো। তইলেই অইবো।

রহমান : (শেফালিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। চুপিসারে) শেফু, আইজ ভাবছি গাঙে যামু।

শেফালি : (অবাক হয়ে বুক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে) না। তুমি গাঙে যাইবা না। না খাইয়া মইরা গেলেও যাইবা না। চেরমেনে কইছে পুলিশ গুল্লি করবো। আমার কিচ্ছু দরকার নাই। তুমি গরে থাহো।

রহমান : আরে ওইরম কয়ই, সব্বাই চুপেচুপে মাছ ধরতাছে। মেম্বরের লোকেরাও তলে তলে মাছ ধরতাছে। সরকারি কাডের চাইল-ডাইলও খাইতাছে। আর আমার লি¹া যত্ত বারণ নিষেদ। আমি যামু। তুমি মানা কইরো না। ঝামেলা দেকলে চইলা আমু।

শেফালি : তুমি যাইবা না। লাগবো না যাওন। কে কি দরে হেইডা ভাইব্বা লাব নাই আমাগো।

রহমান : ঘরের চাইল-ডাইল সব ফুরাইয়া যাইতাছে। দুইদিন বাদে কি খামু। কয়দিন মানুষের দারে গিয়া দারকর্য কইরা খাওন যায়। তুমি না কইলেও আমি ত বুঝি, তোমার ভিত্তরডা ফাইট্টা যাইতাছে। আমি আর সইয্য করতাহারি না শেফু। তুমি না কইরো না। আমি যামু গাঙে…

শেফালি : আইচ্ছা, তুমি কী অন্য কাম কত্তারো না। গাঙের দিক চাইয়া থাকলে অইবো?

রহমান : এইডাই তো বুল কচ্ছি শেফু, গাঙের মাছের লোব কইরা কইরা জীবনে অইন্য কুনো কামকাইজও শিকি নাই। বাপ-দাদার কামডা যে এমন কটিন অইয়া উডবো কেডা জানতো। নাইলে ত আর চিন্তা করোন লাগদো না। তুমি মানা কইরো না শেফু। ঝামেলা দেকলে ঠিকই পলাইয়া আমু।

শেফালি : আমার মন টানছে না, তোমার যাওন ঠিক অইবো না। আর ত বেশিদিন বাহি নাই অবিযানের। কষ্ট কইরা থাহোও না কয়ডা দিন। কি দরকার এত্ত বিপদির মইধ্যে গাঙে মাছের লোবে নাও চরানের।

রহমান : ধুর বোকা, বাপ-দাদার কাম এইডা, এইরম কত্ত আপদ-বিপদ আইলো গেলো, হেডি কোনো বেপার না। আমি ঠিক ঠিক চইলা আমু দেইক্কো। তুমি চিন্তা কইরো না। তুমি ঘরে থাহো। আমি যামু আর আমু। বেশি সোময় দইরা থাহুম না বাইরে। তুমি গরে থাহো।

[রহমানের প্রস্থান। শেফালি উদ্বিগ্নচিত্তে পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে চাইবে, পারবে না। মঞ্চবাতি নিভে আসবে। প্রস্থান]

দৃশ্য-৭

[রাত গভীর হয়ে আসে। মৃদুলয়ে প্রলম্বিত হয় আঁধারের কালো দেয়াল। রহমান বাড়ি ফিরে আসে না। ফোনে ট্রাই করা হয়। বন্ধ দেখায়। শেফালির ভেতরটা ভয়ে কেঁপে ওঠে। স্বগতোক্তি করে- ‘লোকটার কুনো বিপদ অইলো না ত!’ রাত গড়িয়ে সকাল হয়, ঘরে ফিরে না রহমান। ভোরের পাখি শিস দেওয়ার আগে আগে জেলেপাড়ার মাঝিদের ঘরে ঘরে হানা দেয় শেফালি, খোঁজ নেয়। হতাশ হয়। গতরাতে কোনো মাঝি মাছ ধরতে যায় নাই নদীতে। ‘চেরমেনের ডাইরেক্ট ওয়াডার, দরা খাইলে জাউল্লা কাড ত বাদ অইবোই, জেল জড়িপানাও আছে। পুলিশরাও গুল্লি করবো সামনে পাইলে।’ ইত্যাদি ইত্যাদি। যার কাছে যায় তার মুখেই একই কথার পুনরাবৃত্তি, অভিযানের সময় তারা কেউ মাছ ধরতে নদীতে নামেনি। সরকার তাদের চাল-ডাল সবই দেয়। তারা চেয়ারম্যানের কথার বাইরে যাবার লোক না। অবশেষে হতাশ হয়ে ঘরে ফিরে আসে এবং নিরবে নিভৃতে কাঁদতে থাকে শেফালি। ঘরে ফিরে না রহমান]

দৃশ্য-৮

[ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব কার্যালয়ে বসে আছে বাসু চেয়ারম্যান। আনমনে। আজ কোনো কাজকর্মের প্রতি তার বিশেষ মনোযোগ নাই। চেয়ারম্যান অফিসে লোকজনের ভিড়ও কম। এর মধ্যে দু-একটা ফোন আসবে, -চেয়ারম্যান জানিয়ে দেবে অন্যদিন দেখা করতে। আজ ঝামেলায় আছি। এরই মধ্যে মঞ্চে প্রবেশ করবে শেফালি। দূর থেকে তার উপস্থিতি টের পেয়ে কিছুটা কর্মমুখর হয়ে উঠার ভান করবে চেয়ারম্যান। ব্যস্ততার অভিনয় করবে। মর্মাহত শেফালি সালাম দিবে]

শেফালি : অনেক বিপদে পড়ইয়া আমনের দারে ছুইট্টা আইছি চেরমেন সাব। আমারে বাঁচান।

[কান্না শুরু করবে]

চেয়ারম্যান : (অপ্রস্তুত হয়ে) আরে, আরে… কী বেপার, কী অইলো আবার। অইদিন না তোমারে কইছি যেই কুনো জামেলায় পল্লে আমারে জানাইতে। বয় নাই। তুমি বহো। কী অইছে হেইডা কও আগে। দুনিয়ায় জামেলা দেয় আল্লায়, সমাদানও দেয় আল্লায়।

[রাঙা দাঁড়িতে আঙুলের চিরুনি কাটবে চেয়ারম্যান]

শেফালি : (কান্নাজড়িত কণ্ঠে) কাইল রাইতেরথন আমাগো হেরে খুঁইজা পাইতাছি না। মবাইলও ডুহে না। আমার খুউব ডর করতাছে চেরমেন সাব। হের কিচ্ছু অইলো না ত? (

[সজোরে কেঁদে উঠবে শেফালি]

চেয়ারম্যান : আরে কাইন্দ না ত। পুরুষ মানুষ। কুনোদিক গেছে অয়তো। সময় অইলে ফিইরা আইবো। এইডা নিয়া এত কান্দাকাডির কী আছে। আমি আছি না। যেইখানেই থাহুক রকমানরে আমি খুইঁজা বাইর করুমই। চিন্তুা কইরো না। তুমি ঠাণ্ডা অও আগে। কী খাইবা কও।

শেফালি : আমনের দুইখান পাও দরি চেরমেন সাব। অরে খুঁইজা বাইর কইরা দেন। অরে মোনো হয় পুলিশে লইয়া গেছে। কাইল রাইতে গাঙে যাইবো কইছিল। আমি বারবার মানা কচ্ছি। হোনে নাই। হেরপরথন আর খবর পাইতাছি না।

[অঝোরে কেঁদে উঠবে]

চেয়ারম্যান : আহারে! এত্ত কইরা কইলাম গাঙে যাইও না। কেডা হোনে কার কতা। বারবার মানা করলাম, কইলাম টেকা-পইসা লাগলে আমি আছি। জাউল্লা কাড গেছে ত কী অইছে। বাসু চিয়ারম্যান কি মইরা গেছে নিকি? কী জামেলায় পড়লাম এখন। উহু…

শেফালি : আমনে অরে মাফ কইরা দেন চেরমেন সাব। কতা দিতাছি জীবনে আর কুনোদিন অরে অবিযানের কালে গাঙে যাইতে দিমু না। আমনে আমার হেরে ফিরাইয়া আইনা দেন চেরমনে সাব। আমনের দুইখান পাও-এ দরি।

চেয়ারম্যান : চিন্তা কচ্ছিলাম, আইজ কুনোদিক বাইরমু না। উফ, কী বিপদে পল্লাম। আইচ্ছা ঠিক আছে থানায় গিয়া দেহি খবর পাওন যায় নিকি। চলো। ওসি সাবের লগে দেহা কইরা দেহি কিছু অয় কিনা।

[ চেয়ারম্যান ও শেফালি দুজনের প্রস্থান]

দৃশ্য-৯

[একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখা যাবে অফিসিয়াল কাজে ব্যস্ত। থানার অবয়বে সাজানো হবে পরিবেশটা। মঞ্চে প্রবেশ করবে চেয়ারম্যান ও শেফালি। ওসি সাহেবকে চেয়ারম্যান সালাম করবে, ওসি সাহেব মাথা তুলে চেয়ারম্যান সাহবেকে দেখে, মিষ্টি হেসে- উষ্ণ সম্ভাষণ জানাবে। ইলিশ রক্ষায় চেয়ারম্যানের ভূমিকার প্রশংসা করতে করতে দুজনকে বসতে বলবে। প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময় হবে।]

চেয়ারম্যান : ওসি সাব, গেল রাইতে দয়ালপুর এলাকা থিক্কা রকমান নামের একজন জাউল্লা নিখোঁজ অইছে। সেই হালায় নিকি গাঙে মাছ দরতে নামছিল। ভাবলাম আমনেরা অবিযান চালাইয়া গিরিফতার করলেন কিনা হেল্লেইগাই ছুইট্টা আইলাম। পোলাডা আমার নিজের মানুষ ত।

ওসি : কী বলেন? গতকাল তো এরকম নামের কাউকে থানায় আনা হয়নি। (এই ফাঁকে কাগজপত্র দেখে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়)। না, না দয়ালপুর এলাকা থেকে কোনো জেলে আটক হয়নি। আমি যতটুকু জানি, ওই এলাকার জেলেরা নাকি খুব সচেতন, তাই বিগত কয়েকদিন সেখানে অভিযান চালানো হয়নি। উনি হয়তো অন্য কোথাও গেছে।

শেফালি : (ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে) আমারে কইয়া গেলো গাঙে যাইব, হেরপর আর খবর নাই। মবাইলও বন্দ।

ওসি : কার সাথে গেছে, নাম বলছে? কার নৌকা নিয়া গেছে?

শেফালি : (চোখের জল মুছতে মুছতে, মূর্ছিত কণ্ঠে) না, হেইডা ত কয় নাই, আমিও জিগাই নাই।

ওসি : চেয়ারম্যান সাহেব, এটা অন্য কেইস হতে পারে। ঠিক আছে নাম ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দিয়ে যান, খোঁজ-খবর পেলে আমরা জানাবো। রহমান নামের কোনো ব্যক্তি আমাদের থানায় আসেনি এটা নিশ্চিত থাকুন।

[ওসি চা পানের নিমন্ত্রণ জানাবে। তারা জানাবে চা খাবে না এখন। তারপর নাম-ঠিকানা দিয়ে, চেয়ারম্যান ও শেফালির প্রস্থান। ওসি আবার কাজে মনোযোগী হয়ে ওঠবে। মঞ্চের বাতি নিভে আসবে]

দৃশ্য-১০

[মঞ্চে শেফালি ও চেয়ারম্যানের প্রবেশ। শেফালি প্রায় ভেঙে পড়েছে। চেহারাও বিধ্বস্ত। চেয়ারম্যান কিছুটা প্রাণবন্ত দেখালেও সেটা আড়াল করার চেষ্টা করবে।]

 চেয়ারম্যান : সবই তো হুনলা। আমার আর কি করার আছে কও চে দেহি।

[শেফালি শুধু কাঁদবে। কথা বলতে পারবে না]

চেয়ারম্যান : আহা! কান্দাকাডি কইরো না ত। খারাপ লাগে। তোমার সোয়ামী, তোমার যেমুন কষ্ট লাগে, আমার ইউনিয়নের ভোডার হিসেবে আমারও ত কষ্ট লাগে। সামনে ইলেকশান, একখান ভোডার কমলে ত আমারই লস। রকমান থাকলে কি আমারে ভোড না দিয়া থাকত? কত্ত বালা এক্কান পোলা। বেজায় সহজ সরল। আহারে, কই যে আরাইয়া গেলো জোয়ানমদ্দ পোলাডা, আল্লাই বালা জানে…(দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে)

শেফালি : আমনের কাছে হাতজোর করি, পাওয়ে দরি চেরমেন সাব, এইহানে আমার কুনো আপনলোক নাই। বাপ-মারে থুইয়া বাইগ্গা আইছিলাম অর জন্যি। কেহ আমারে মাইন্না লয় নাই। অহন আমনেই আমার বরসা। ওরে আমনে যেইহান থেইক্কা পারেন খুঁইজ্জা বাইর কইরা দেন, মইরা গেলেও আর অরে গাঙে যাইতে দিমু না। আমার দিকে এট্টু দয়া করেন চেরমেন সাব। আমনের অনেক দয়া, অনেক ক্ষেমতা। আমনে চেষ্টা কল্লে পারবেন।

[শেফালির কান্নার মাত্রা বেড়ে যাবে। ভেঙে পড়বে সে।]

চেয়ারম্যান : তুমি চিন্তা কইরো না, বাড়ি যাও, ওসি সাব যেতু কইছে একটা কিছু ত অইবই। চিন্তার কারণ নাই। দরকার পল্লে থানায় বেবাক টেকা-পইসা ডালুম, তবু রকমানরে আমি খুঁইজ্জা আনুমই। তুমি বাড়ি যাও। কুনো দরকার পল্লে খবর দিও, মবাইল কইরো, নইলে পরিষদে চইলা আইও। (পকেট হাতড়ে কিছু টাকা বের করে শেফালি হাতে গুঁজে দেয়। শেফালি নিতে লজ্জাবোধ করে।) আরে লজ্জা-শরম পাওনের কিছু নাই। নেও নেও। বিপদ ত আর আজীবন থাহে না, দিনক্ষণ বালা অইলে দিয়া দিও। আর না দিলেই বা কি। খোদা-তালা ত আর আমারে অভাবে রাহে নাই। তোমাগোরে সেবা কত্তে বেবাক দিছে।

[টাকা হাতে, চেয়ারম্যানকে সালাম ঠুকে, শেফালির প্রস্থান এবং চেয়ারম্যানেরও প্রস্থান]

দৃশ্য-১১

[বাড়ি ফিরে আসে শেফালি। শূন্য গৃহে সবকিছু কেমন ধোঁয়াশার মতো লাগে। বাঁধভাঙা ঝড়ের মতো কেঁদে উঠে সে। পাড়া-প্রতিবেশিরা এসে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে। দুই একজনে মন্তব্যও করে- ‘অন্য কাউরে লইয়া অয় ত বাইগ্গা গেছে রকমান, পুরুষ মিনসে বিশ্বাস নাই আইজকাইল…।’ নানান মহিলার নানান মন্তব্য হজম করে শূন্য ঘরে পড়ে থাকে সে। ছকিনার মা তাকে জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু শেফালি বারবার মূর্ছা যায়। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নিয়েও মিলে না রহমানের খবর। এর মধ্যে চেয়ারম্যানকে দুদিন ফোন করে জানে কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো কিনা। লাভ হয় না। ইদানিং চেয়ারম্যানও সকাল বিকাল ফোন করে কিংবা লোক পাঠিয়ে তার খোঁজ খবর নেয়, বাজার সদাই পাঠায়। কোনো সমস্যা আছে কিনা খেয়াল রাখে। এভাবে প্রায় পনেরো দিন কেটে যায়। কোনো খোঁজ মিলে না। মোটর সাইকেল চেপে দুদিন চেয়ারম্যান নিজেও এসে খোঁজ খরব জেনে যায়। সান্ত্বনা দেয়। খরচপাতি দিয়ে যায়।]

দৃশ্য-১২

[ইউনিয়ন পরিষদের অফিস থেকে চেয়ারম্যান বের হয়ে কোথাও যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় শেফালির প্রবেশ]

শেফালি : চেরমেন সাব, আমি আর পারতাছি না। আমারে বাঁচান। আমার যে সব শ্যাষ অইয়া গেলো।

চেয়ারম্যান : কী করুম কও, কত জাগাত খোঁজ নিলাম। কত টেকা-পইসা ডাললাম। কুনো কাম অয় নাই। কই যে গেলো পোলাডা। অনেক বালা জানতাম পোলাডারে, কই যে বাগলো।

শেফালি : আরেকবার যদি থানায় গিয়া খোঁজ নিয়া দেখতেন। কুনো খবর পাইলো কিনা পুলিশ।

চেয়ারম্যান : হাসাইলা শেফু, তুমি মনে করো আমি খোঁজ লই নাই? আরে দিনে কম কইরা অইলেও দুইতিনবার থানায় মবাইল করি ওসি সাবরে। তারা রকমানের কুনো চেমাও খুইজ্জা পায় নাই।

শেফালি : (কান্নাজড়িত কণ্ঠে) আমি এখন কই যামু, কার কাছে যামু, আমার যে সব শ্যাষ চেরমেন সাব।

চেয়ারম্যান : (কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে) টেকাগুলা রাহো। কামে লাগবো। আমি যতদ্দিন আছি বয় নাই। কিছু একটা ত অইবই। বয়ের কিছু নাই। সব ঠিক অইয়া যাইবো।

শেফালি : আমনের থেইক্কা আর কত নিমু চেরমেন সাব। আর কত রেইনের বোঝা বারাইবেন।

চেয়ারম্যান : (একটু আমতা আমতা করে) একখান কতা কমু? গোস্সা অইবা না ত শেফু?

শেফালি : কী কতা, কন, আমনে বিপদে কাছে আইছেন, আমনের লগে ক্যামনে রাগ হমু কন। আমনে মাইরা ফালাইলেও ত রাগোমু না।

চেয়ারম্যান : (আবারো কিছুটা আমতা আমতা করে) কইছিলাম কি, তোমারে এইবাবে টেকা-পইসা দেই, তুমি অনেক শরম পাও, নিজেরে ছোডো বাবো অনেক, এইডা আমার খ্ুউব কষ্ট লাগে শেফু।

শেফালি : হেইডা ত আমিও জানি, তয় কি করুম কন, দয়ার জিনিস কয় দিন লওন যায় চেরমেন সাব।

চেয়ারম্যান : হেইডা ঠিক কইছ, তাছাড়া আমার দারেই বা কয়দিন আইবা। মাইনুষেও একদিন দুইদিন তিনদিন দেইক্কা আজেবাজে কতা উডাইয়া দিবো। তুমিও ছোডো অইবা আমিও অমু। এই জন্যি কইছিলাম কি… তোমার যদি আপত্তি না থাহে আমি তোমারে বিয়া কইরা দায়িত্ব নিতাম চাই। বিপদের সময় পাশে খাড়াইতাম চাই।

 শেফালি : মানি!(বিস্মিত হয়ে)। এইডা আমনে কি কইলেন চেরমেন সাব?

চেয়ারম্যান : হ্যা, অইতারি আমি বুড়া মানুষ, তুমি অনেক জোয়ান মাইয়া। কিন্তুক একটা জোয়ান পোলার লগে পিরিত কইরা বিয়া কইরা ত দেকলা হেই পোলা তোমারে কত্ত ঠগাইছে। হেই পোলা শেষতক তোমারে গাঙে বাসাইয়া দিয়া পলাইছে। তোমার অসহায় মুকখান দেকলে আমার বুকটা ফাইট্টা যায় শেফু। হেল্লাই কইলাম, এই বুড়ারে বিশ্বাস কইরা দেহো একবার। জোয়ান পোলার লাহান ঠগ খাইবা না। আমার বাড়ি-গাড়ি, সহায়সম্পত্তির অবাব নাই। শুধু তোমার মতো এক্কান বালা মাইয়া মাইনুষের অবাব। আমার সবকিছুই ত তোমার অইবো। তুমি শুধু আমার এই বুইড়াকালে পাশে থাইক্কো। তোমার কষ্ট আর সইজ্জ অয় না শেফু। এজন্যি হারা জীবনের লিগ্গা তোমার পাশে খাড়াইতাম চাই। তোমারে বিপদ থিইক্কা বাচাইতাম চাই।

 শেফালি : আমনের কথা ত কিছুই বুজতাছি না। এগুলা কি কন চেরমেন সাব।

চেয়ারম্যান : ঠিক আছে, তোমার যদি আপত্তি থাহে দরকার নাই। অনেক বছর অইলো আমার গিন্নি মারা গেছে। ইচ্ছা আছিলো আর বিয়া করুম না। আমার টেকা-পইসা দেইক্কা অনেক জোয়ান মাইয়ারাও বিয়া কত্তে রাজি আছিলো। জীবনডা একলা একলা পার কইরা দিমু বাইব্বা এদ্দিন বিয়াশাদি করি নাই। কিন্তুক তোমার কষ্ট দেইক্কা আমার বাবনা পালডাইয়া লাইলাম। নতুন সপন দেকলাম। তুমি রাজি থাকলেই কেবল বিয়াডা করুম। রাজি না থাকলে দরকার নাই। আমি মুলত তোমারে বিপদ থেইক্কা উদ্দার করার লিগ্গাই কতাডা কইলাম। অইন্য কোনো বাজে উদ্দেশ্যি লইয়া কই নাই। বাইব্বা দেহো, টেকা-পইসা, ধনসম্পদ যার আছে হে কিন্তুক বুড়া হয় না কুনোদিন, বুড়া অয় গরিব অভাবী মানুষগুলান। অরা মন থেইক্কাও বুড়া, ধন থেইক্কাও বুড়া। অরা নীতি কতা ছারা আর কিচ্ছুই করতারে না শেফু। তোমার নিরাপত্তার জন্যিই তুমি চাইলে একটা বাড়িও দরকার লাগে লেইক্কা দিমু, তবুও রাজি থাকলে কইও। আমি তোমারে বিপদ থেইক্কা বাচাইতেই বিয়া করুম। তোমারে এইভাবে কষ্টে কষ্টে মরতে দেইক্কা আমারও মইরা যাইতে মুঞ্চায়, অনেক কষ্ট লাগে শেফু।

শেফালি : এইডা আমনে কেমনে কইলেন চেরমেন সাব। আমনে ত আমার বাপের লাহান। এইডা কেমনে সম্ভব। তাছাড়া আমার গরের মইধ্যে ত জামাই আছে। আমনে আমারে মাফ কইরা দেন। আমি বিয়া করতারুম না। লোকে হুনলে থুতু মারবো।

চেয়ারম্যান : ঠিক আছে। সমস্যা নাই। বিয়া না কইরা যদি বালা থাহো তাইলে ত আরও বালা। আমি ত কেবল চাই তুমি বিপদ-আপদ থেইক্কা মুক্ত থাহো। হেই জন্যিই বিয়া করার কতাডা কইলাম। গোস্সা কইরো না। তয় এইডা কিন্তুক হাছা কতা, তোমার সোয়ামী তোমারে ঠগ দিছে। মানুষ আরাইয়া গেলে পাওন যায়, পলাইয়া থাকলে পাওন যায় না শেফু। অই পোলার জন্যি অপেক্কা কইরা জীবনডা নষ্ট না কইরা, সোময় বালা থাকতে দরকার অয় অন্য কাউরে অইলেও বিয়া কইরা লাও। আমারেই বিয়া কত্তে অইবো এইডা কুনো কতা না। তোমার ভবিষ্যত চিন্তা কইরা একনই অন্য কাউরে বিয়া কইরা ফেলানো উচিত। আবেগ দিয়া ত দুনিয়া চলে না, ভাগ্যি বালা যে পেডে ছাওয়ালটাওয়াল দিয়া যায় নাই অই বদমাশই রকমান। নইলে তুমি আরো মহাবিপদে পড়ইয়া কানতা শেফু। যাও বাড়ি যাও, যে কুনো জামেলা অইলে আমারে খবর দিও। আর আমার কতাডাও এট্টু মোন দিয়া চিন্তা কইরা দেইক্কো, হাছা কইছি না মিছা কইছি নিজেই পরমান পাইবা।

[শেফালি মৃদুলয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে, ভরাক্রান্ত মনে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। মঞ্চবাতি নিভে আসবে। দুজনের প্রস্থান]

দৃশ্য-১৩

[শেষ বিকেলের নদী কিছুটা শান্ত, স্থির। ভারাক্রান্ত মনে নদীর কাছে এসে দাঁড়ায় শেফালি। ‘হে নদী, তুই ত জানছ আমার রকমানের কতা। একবার ক, শুধু একবার ক, আমার রকমান কই; অর জন্যি আমি বাপ-মা সব ছারছি, অর জন্যি আমি আইজ মাইনষের আতের পুতুল হইয়া গেছি রে নদী’- কথাটা বলেই সজোরে কেঁদে ওঠে সে। কাঁদতে কাঁদতে দুই হাতে মুখ চেপে ধরে, কান্নারত অবস্থায় ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। ‘চান্দের হাসি ছিলো আমার সোনার সংসারে, সে হাসি তুই কাইড়া নিলি ভাইঙ্গা বারে বারে’ মনির খানের ‘নদী রে ও নদী রে তুই’ গানের অন্তরা বেজে উঠবে। নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়াবে মধু। হাতে বাজার-বোঝাই ব্যাগ। কান্নামুখি হয়ে, শেফালির নাম ধরে ডাক দিবে। মাথা তুলবে শেফালি এবং মুহূর্তে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে]

মধু : শেফু, চেরমেন সাব পাডাইছে আমারে। (বাজার সদাইয়ের পোটলাটা তার দিকে বাড়িয়ে) তোমার লগে নিকি আইজগা চেরমেন সাব খুউব খারাপ বেবহার কচ্ছে। হেইজন্যি, নিজে নিজে অনেক কষ্ট পাইতাছে লোকটা। আমারে পাডাইয়া কইছে, মাফ চাইতে। কইছে, তুমি য্যান রাগ-গোস্সা না করো। তোমার যেই কুনো আপদ-বিপদে উনি পাশে থাইক্কা সাহায্যি-সযোগিতা করবো। তোমার লাহান তুমি চলো। তোমার উরপে কুনো সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দিবো না চেরমেন সাব। চেরমেনের কতাই কেবল হোনতে অইবো হেইডা কুনো কতা না। তুমি রাগ অইও না শেফু, চেরমেন সাব খুব অনুতক্ত অইছে। খুউব কষ্ট পাইতাছে বেচারা।

শেফালি : কী কন, কই, কোন সোময় আমার লগে খারাপ বেবহার কচ্ছে উনি। উনিতো আমার লগে সোন্দর কতাই কইলো। বালা বুদ্দি দিলো।

মধু : হেইডা আমি কইতারুম না। আমারে যা কইছে কইয়া গেলাম। তুমি চেরমেনের উরপে রাগ রাইক্কো না। উনি খুব শরম পাইছে। চেরমেন সাব অনেক বালা মানুষ, লোকাটা কাউরে এক্কান ধমক দিলেও পরানডা খালি কান্দে আর কান্দে। চক্ষের পানি বাইর অয় কেবল বানের পানির লাহান।

শেফালি : আমনে কইয়েন, আমি চেরমেনের কাছে কৃরতজ্ঞ। হের উরপে আমার ভক্তি আছে, কুনো রাগ নাই। আমি হের উরপে অনেক খুশি। বিপদ-বালার বন্দু আমার চেরমেন সাব।

মধু : আইচ্ছা, তয় গেলাম রে, যাও বাড়ি যাও, মন খারাপ কইরো না। দিনরাইত চেরমেন সাব চেষ্টা করতাছে রকমানরে খুঁইজ্জা বার কত্তে। পায় নাই। বেডা হালার-পো হালা তোমারে ফাঁকি দিছে শেফু। তোমার লগে চিটিং কচ্ছে। তুমি সরলসোজা মনের মাইয়া মানুষ দেইক্কা পাগল অইয়া ঠগতাছ। অই হালারে বুইল্লা যাও, অসইভ্য মানুষরে মোনো রাইক্কা লাব নাই, কেবল কষ্ট বাড়বো, সুক আইবো না। গেলাম…

[মধুর প্রস্থান। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, ব্যাগ হাতে শেফালি বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। ধীরে ধীরে অন্ধকার বাড়তে থাকে, আলো নিভে আসবে।]

 দৃশ্য-১৪

[সকাল সকাল দরোজায় মানুষের হাতের টোকা পড়লে চেয়ারম্যানের ঘুম ভেঙে যায়, বিরক্তিকুঞ্চিত হয়ে সে দরোজা খোলে এবং বিস্মিত হয়। চারপাশে সকালের আবহ বিরাজ করবে]

চেয়ারম্যান : (বিস্ফাতির চোখ) আরে শেফু! তুমি, এত্ত বিহান বেলা? কী মোনো কইরা। কুনো খুশির খবর আছে নিকি? রকমান কি বাড়ি ফিরছে? আহো আহো ভিত্তে আহো। বহো।

শেফালি : (ঘরে ঢুকতে ঢুকতে এবং চারপাশে তাকিয়ে) খুশির খবর কিনা কইতারি না, তয় রকমান বাড়ি ফিরে নাই এডাই সইত্য। ফিরার দরকারই বা কী।

চেয়ারম্যান : কী কও পাগলের মতোন। তোমার সোয়ামী না…

শেফালি : চেরমেন সাব, আমনে নিকি আমার জন্যি কষ্ট পাইতাছেন, আমার বেবহারে নিকি শরম পাইছেন? কী কমু, কন, সবই ত দেহেন, বুজেন।

চেয়ারম্যান : আরে না না, বোকা, তোমার উরপে জোর খাডাইয়া সিদ্ধান্তখান চাপাইয়া দিতে চাইলাম এই জন্যি খুব খারাপ লাগতাছিল।

শেফালি : না না, ছি ছি, কী যে কন, জোর কল্লেন কই। আমনে যা কইছেন, হক কতাই ত কইছেন। বাস্তব আর আবেগ ত এক না, চিন্তা কইরা দেকছি। আমারে ত আমনে বালা বুদ্দিই দিছেন। কেহ পলাইয়া গেলে হের জন্যি জীবন নষ্ট কইরা কী লাব, কেবল নিজেরই ক্ষতি। লাভ নাই এট্টুও।

চেয়ারম্যান : তার মানি, তুমি বিয়া কত্তে রাজি আছ?

শেফালি : জানি না, তয় আমনেরে আমার বাল্লাগে, বিশ্বাস অয়। আশ্রয়-বরসা মোনো অয়। আমনের লাহান মহৎ মাইনষের সেবা-যত্তন কত্তে পারাডাও আমার ভাগ্যির বেপার। আমি আমনের কথায় রাজি।

[লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলবে শেফালি]

চেয়ারম্যান : হাছা কইতাছ! আমার যে কী আনন্দ অইতাছে, কইয়া বুঝাইতারুম না শেফু। আহা! কও, কবে, কবে আমরা বিয়া করুম। তোমার ইচ্ছাতেই সব অইব।

শেফালি : (লজ্জা ও বিনয় মিশিয়ে) আমনে চাইলে আইজও অইতারে। আমার বারণ নাই। আমনের ইচ্ছা, যকন কইবেন তকনই…

[চেয়ারম্যান খুশিতে শিশুর মতো আচরণ করতে শুরু করে এবং জড়িয়ে ধরে শেফালিকে। ‘আরে আরে, অহন না। বিয়াডা আগে অইয়া-লউক না, তারপর না অয়…’ দুজনেই সজোরে হেসে উঠবে। বিয়ের বাজনা বেজে উঠবে এবং একটি চমৎকার আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবে।]

দৃশ্য-১৫

[মঞ্চে প্রবেশ করবে চেয়ারম্যান পুত্র হাশেম। উত্তপ্ত বাক্যে সবকিছু গরম করে তুলবে সে। বৃদ্ধ বয়েসে পিতার বিয়ের ঘটনায় সে বেশ মর্মাহত। দরোজার সামনে চেয়ারম্যান ও শেফালির খুঁনসুটি চলছে তখন। তাদের দিকে আঙুল নাচিয়ে]

হাশেম : না, না না, এই বিয়া আমি কিছুতেই মানি না, মাইনষের দারে মুখ দেকাইতারি না একন। বুইড়ার ভীমরতি আমি ছুডামু। ওই লুইচ্চা মাগিডা আমার বুইড়া বাপটারে ফুসলাইয়া বিয়া করছে। নিজের সোয়ামীরে খাইয়া, আমাগো সোনার সংসারডা খাইতে আইছে একন। টেকা-পইসা, ধনসম্পত্তির লুবে এই বাড়িতে ডুকছে। আমি বাঁইচ্চা থাকতে অর খায়েশ মিডাইতে দিমু না। হু।

[বিয়ের দুদিন যেতে না যেতে এমন অনাকাঙিক্ষত ঘটনায় বিব্রত হয়ে লজ্জা এবং ভয়ে এতটুকু হয়ে যায় শেফালি। চেয়ারম্যান তাকে আশ^স্ত করে]

চেয়ারম্যান : (হাশেমের কথা না শোনার ভান করে শেফালিকে উদ্দেশ্য করে নতবাকে) আরে পোলাপাইন মানুষ। রক্ত গরম। দুই-চাইর দিন গেলে সব ঠিক অইয়া যাইব গা। আপাতত চুপ থাহো। কিচ্ছু কওনের দরকার নাই। চলো ঘরে চলো।

[শেফালির হাত ধরে তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দেবে। এসময় বেজে ওঠবে-‘এই ফাগুন ও পূর্ণিমা রাতে চল পালাইয়ে যাই’ গানের অংশ বিশেষ। উঠোনে দাঁড়িয়ে গরম কথার আবার পুনরাবৃত্তি করবে হাশেম এবং হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়ে মায়ের স্মৃতিচারণ করবে। কিছুসময় পায়চারি করে-‘আমিও দেইক্কা নিমু এই বাড়িত কেমনে থাহো তোমরা।’ কথাটা বলে কাঁদতে কাঁদতে মঞ্চ ত্যাগ করবে। যে কোনো করুণ একটি গানের বাজনা বেজে ওঠবে। বাতি নিভে আসবে।]

 দৃশ্য-১৬

[বিয়ের প্রায় ১৫দিন পর হঠাৎ এলাকায় দেখা যাবে রহমানকে। হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরবে সে। দরোজায় দাঁড়িয়ে হন্যে হয়ে শেফালিকে ডাকবে। পাশের ঘর থেকে ছুটে আসবে ছকিনার মা, ‘কোথায় আছিলি, ক্যান নিরুদ্দেশ হইলি’ এই জাতীয় প্রশ্ন জিজ্ঞাসা শুরু করবে এবং তার স্ত্রী শেফালি চেয়ারম্যানের বউ হয়ে ঘর করার কথাটাও অত্যন্ত মর্মাহতচিত্তে বলে দিবে]

ছকিনার মা : এদ্দিন তুই কই আছিলিরে বাজান, তোর বউডা কত্ত কষ্ট কল্লো, কত্ত খোঁজাখুঁজি কল্লো। শেষতক দিশকুল না পাইয়া বাসু চেরমেনরে বিয়া কল্লো।

 রহমান : কী কন চাচী। শেফালি চেরমেনরে বিয়া কচ্ছে মানে!

ছকিনার মা : তোর কুনো খোঁজখবর নাই, পুলিশও খুঁইজ্জা পায় নাই। মাইয়াডা দিনরাইত কাইন্দা কাইন্দা, না খাইয়া মইরা যাইবার যোগার অইলো, শেষমেষ চেরমেনের দয়া অইলো। অরে বিয়া কইরা ঘরে তুইলা নিলো, খোদা অর দিকে মুক ফিইরা চাইলো, জামাই বুইড়া অইলে কি অইব, খুউব আদর-যত্তন করে, অনেক সুকে আছে মাইয়াডা। তোর আশায় থাকলে এদ্দিনে না খাইয়া মইরাই যাইতে। ঐহানে গিয়া অন্তত নাইয়া-খাইয়া বালাই আছে। তয়, হুনছি চেরমেনের পোলাডা এট্টু জামেলা করে। বিয়া মাইন্না নিতে রাজি অয় নাই, খালি আন্দোলন করে। চেরমন অবিশ্যি পাত্তা দেয়া না এইসব।

রহমান : (কেঁদে ফেলে) চাচী! শেফালি এইডা কী কল্লো চাচী।

ছকিনার মা : অর দোষ নাই, ঘরে সোয়ামী নাই, খাওন নাই, পরার কাহর-চোহর নাই, পাড়ার লোকের নজর বালা না। শেষতক চেরমেনের দয়া অইলো, আমিও কইলাম রাজি অইয়া যা। বাজান, আমি কী আর জানতাম তুই বাঁইচ্চা আছত। আহারে! কী অইয়া গেলো এগিলা।

রহমান : না চাচী, আমি চেরমেনরে ছাড়–ম না, আমার জীবনডা দংশ কইরা দিছে ওই বাসু চেরমেন। আমি শেফালিরে নিয়া আমু চাচী। আমার শেফালিরে ছাড়া আমি বাচুম না চাচি। ওই হালার পুতে পুসলাইয়া অরে বিয়া কচ্ছে। আমি অরে ছাড়–ম না চাচী। আমি খুন করুম হালার পুতেরে।

[দৌড় দিয়ে রহমানের প্রস্থান। পেছনে পেছনে ছকিনার মা তাকে ডাকতে ডাকতে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যাবে এবং আলো নিভে আসবে।]

দৃশ্য-১৭

[বাসু চেয়ারম্যান বাড়ির উঠোনে চেয়ার পেতে বসে আছে। পেছনে দাঁড়িয়ে তার পিঠ চুলকিয়ে দিচ্ছে মধু। কখনও কখনও হাত-পা’ টিপে টিপে দিচ্ছে। যে কোনো একটি হাস্য-রসাত্মক গানের বাজানা বেজে উঠবে]

চেয়ারম্যান : খেলাডা ক্যামুন জমলো রে মধু…

মধু : এক্কেবারেই ফাটাফাটি। যারে কয় ব্যাডে-বলে ছক্কা ওস্তাদ, হে হে।

[কৌতুকপ্রদ অঙ্গভঙ্গি করবে মধু]

চেয়ারম্যান : চুপ বেডা আস্তে কতা ক। তুই হালারে লইয়া এট্টু গোপন আলাপও করাতারি না, ফাডা বাঁশের লাহান গলা এক্কান। দে দে আরেট্টু জোরে টিইপে টিইপে দে। বরো আরাম লাগে। আহা! কী শান্তি তোর আতের মালিশ রে মধু।

[মধু বোকার মতো হাসে এবং মাথা দোলায়। এমন সময় ‘চেরমেন, চেরমেন, অই চেরমেনের বাচ্চা, কই তুই’ কর্কট ভাষায় গালাগাল দিতে দিতে রহমানের প্রবেশ। দুজনের তামাশা কেটে যাবে এবং অচিরেই নজর করে দেখবে ধারালো দা হাতে রহমান তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। দুজনেই হিমশিম খেয়ে ওঠবে]

রহমান : অই চেরমেন! তুই আমার জীবনডা নষ্ট কইরা দিছত। আমারে লুকাইয়া রাইক্কা তুই শেফালিরে জোর কইরা বিয়া কচ্ছত। আইজ তোরে আমি খুন কইরা ফালামু খানকির বাচ্চা।

[চেয়ারম্যান এবং মধু ভয়ে ভড়কে যাবে। এমন কাণ্ড দেখে অবাক হবে। মধুকে সামনে বাড়িয়ে দিয়ে নিজে পেছনে সটকে পড়বে]

মধু : (নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে) আরে করো কী! করো কী রকমান! তোমার জন্যি চেরমেন সাব এত্তকিছু কল্লো। আর তুমি এহন তারেই মারবার চাইছ। উপকারের এই পত্তিদান দিলা?

রহমান : ওই মধুর বাচ্চা মধু, চামচামি কত্তে আইছ না। তোর চেরমেন আমার জন্যি কি কচ্ছে রে হারামজাদা। এ্যাঁ। আমারে লুকাইয়া রাইক্কা পুসলাইয়া আমার শেফালিরে বিয়া কচ্ছে। এইডা উপকার? তুই হর, নাইলে তোরে সহ খুন কইরা ফালামু হোগার পুত। (মধুরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চেয়ারম্যানকে কোপ দিতে উদ্যত হয় রহমান)

[‘সাবধান! এক পাও সামনে আইবি ত তোর মাথা আমি ঘাড় থেইক্কা নামাইয়া দিমু।’ চিরচেনা মেয়েলি কণ্ঠে এমন শব্দ শুনে থমকে দাঁড়াবে রহমান। নজর করে দেখবে লম্বা বটি দা হাতে দাঁড়িয়ে আছে শেফালি। হা করে তাকিয়ে থাকবে সে]

শেফালি : তুই আমারে মিছা সপন দেখাইয়া বিয়া কচ্ছত, বাবা-মারে ছাইরা তোরে বিশ্বাস কইরা আইছি। তুই আমারে ফালাই পলাইছত অইন্য মাইয়া-লোক লইয়া। এই লোক, এই চেরমেন সাব, আমার আপদে-বিপদে সামনে খাড়াইছে। আশ্রয় দিছে। খাওন দিছে। জামা-কাহর দিছে। আমার কষ্ট দেইক্কা নিজের ঘরের বউ কইরা আনছে। অহন তুই আমার সুকের গরে আগুন দেওনের লিগ্গা আইছত শুয়োরের বাচ্চা? আমার সোয়ামির গায়ে একটা আগাত করবি ত তোর মাথাডা আমি দুই ভাগ কইরা দিমু হারামির বাচ্চা, হারামি।

রহমান : (বিস্মিত হবে। হাত থেকে দা পড়ে যাবে। প্রিয়তমা শেফালি আচরণে স্তম্ভিত হয়ে যাবে।) এইডা তুমি কী কও শেফু। আমি পলামু কেনে। কারে নিয়া পলামু। এই চেরমেন আমারে গুণ্ডাবাহিনী দিয়া লুকাইয়া রাকছে। তোমারে বিয়া করনের লিগ্গা নাটোক বানাইছে। বালা মানুষ সাইজ্জা বইয়া আছে।

চেয়ারম্যান : (চতুর ভঙ্গিতে) দেকলি মধু, দেকলি ত, কার জন্যি এত্ত কষ্ট কল্লাম। কি পত্তিদান পাইলাম। দেকলি তে…, যাও শেফু তুমি ঘরে যাও, রকমানরে কইয়া যাও আমারে কাইট্টা গাঙে বাসাইয়া দিতে। উপকার করার পত্তিদান দিতে।

রহমান : চেরমেন তুই মিছা নাটোক করবি না কইছি, আমি জানি তুই এট্টা হারমজাদা। তুই অসইভ্য, লুচ্চা। তুই শেফুরে ভাও দিয়া বিয়া কচ্ছত। আমি তোরে ছাড়ুম না চেরমেনের বাচ্চা চেরমেন।

শেফালি : চেরমেন তোরে কোন জাগাত লুকাইয়া রাকছে ক। কাগোরে দিয়া উডাইয়া নিছে ক হারামজাদা।

রহমান : হেইডা ত কইতারি না, আমার চোক বাইন্দা, মুক চাপা দিয়া নিয়া লুকাইছে। একটা বাড়িতে আটকাইয়া রাকছে। থাকতে দিছে, খাওনও দিছে, আইজগা ছাইড়া দিছে। ছাড়া পাইয়া আমি ছুইট্টা আইছি তারাতারি।

শেফালি : গপ কওনের আর জাগা পাছ না, না? তুই এইহান থেইক্কা যা কইছি, নাইলে তোরে আমি খুন কইরা লামু শুয়োরের বাচ্চা। তোর চেহারা দেইক্কা কেহ কইব তোরে কেহ লুকাইয়া রাকছে? তুই কি টেকা পইসা যে তোরে পকেটে কইরা লুকাইয়া রাকবো? অভিনয় বাদ দিয়া এইহান থেইক্কা যা কইছি, নাইল তোর লাশ পরবো।

[শেফালি উদ্যত হবে। চেয়ারম্যান তাকে থামায়বে। ভালো মানুষ সাজবে।]

চেয়ারম্যান : আহা! করো কী, করো কী শেফু, পাগল হইয়া গেলা নিকি। আরে রকমান জোয়ান-মদ্দ পোলা, রক্ত গরম। আমারে দুই কতা কইবো, দাও দিয়া কোবাইবো, দরকার অয় খুন করবো। আমার ভোডার, ওগো ভোডে চেরমেন অইছি। তাই বইলা অরে তুমি খুন করবা এইডা কেমুন কতা। যাও যাও ঘরে যাও।

[এরই মধ্যে লোকজন জড়ো হয়ে যাবে। নিরাপদ ভেবে শেফালির হাতের দা চেয়ারম্যান কেড়ে নেয়। মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে এবং শেফালিকে ঘরে যেতে বলে। কাঁদতে কাঁদতে ঘরের দিকে ছোটে শেফালি]

মধু : তুই চেরমেন সাবরে চিনলি না রকমান, তুই মিছা অপবাদ দিয়া কামডা বালা করোছ নাই।

চেয়ারম্যান : হে হে (বিজ্ঞের হাসি হেসে কিছুটা কটাক্ষ্যের ভঙ্গিতে) আইচ্ছা কও ত রকমান, এই লোকগুলান ত সব আমার লোক। এগোলার মইধ্যে কেডায় তোমারে বাকসার মইধ্যে বইরা লুকাইয়া রাকছে? কও কও, আমি অক্কুনি অর বিচার করুম। শেফুরেও কমু আমার বিচার কত্তে। কও কও…

[রহমান সবার মুখের দিকে তাকাবে এবং সন্দেহজনক কারো মুখ খুঁজে পাবে না। ‘হু, তোর বিচার আল্লায় করবো চেরমেন, খোদার গজব পড়বো তোর উরপে।’ গালি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে যাবে রহমান। চেয়ারম্যান বিজ্ঞের হাসি হাসবে এবং সবাইকে কাজে যেতে বলবে, আর মধুকে কর্কট ভাষায় ডাক দেবে]

চেয়ারম্যান : মধু!

 মধু : (ভয়ার্তকণ্ঠে) জি ওস্তাদ।

চেয়ারম্যান : ওই শুয়োরের বাচ্চা এদিকে আইলো ক্যামনে। শুয়োরের বাচ্চা ত দেহি বারাবারি আরম্ভ করতাছে।

মধু : ওস্তাদ, চিন্তা কইরেন না, ওই হালারপুত বেশি বাড়াবাড়ি কল্লে কব্বরে নিয়া লুকাইয়া রাহুম, য্যান জীবনেও আর না উঠতারে। তয় ওস্তাদ…(কথা শেষ করতে পারবে না)

[হাল্লাচিল্লা করতে করতে হাশেমের প্রবেশ-‘এইবার কোডে যামু, এদ্দিন একলা আছিলাম, এইবার রকমান ভাইয়েরে পাইছি। তোমগো দুইজনের বিয়ার খায়েশ মিডায়াই দিমু। মামলা করুম মামলা। আমি সাক্ষী দিমু তোমরা ভিত্তে ভিত্তে মিসকা শয়তান, বাপ বইল্লা অন্যায় করবা, আকাম করবা, আমি কী ছাইড়া দিমু নিকি’। চেয়ারম্যানের দিকে আঙুল তুলে কথাগুলো বলতে বলতে ঘরের দিকে ঢুকবে হাশেম। ভয়ার্তকণ্ঠে চেয়ারম্যান মধুকে ডাকবে]

 চেয়ারম্যান : মধু।

  মধু : জি, ওস্তাদ।

চেয়ারম্যান : ঘটনাডা ত বালা ঠেকতাছে না। তোগোরে দিয়ে আর কাম অইলো না। কী জামেলায় পড়লাম! উফ!

মধু : এইডা কোনো বিষয় না ওস্তাদ। চাইয়া থাহেন কেবল। সবকিছু কেমন পানির লাহান ঠাণ্ডা কইরা দেই।

চেয়ারম্যান : যত তারাতারি পারছ আপদ বিদায় কর। মহাবিপত্তিতে পড়লাম ত। উফ! মানুষগুলান দিনদিন অসইভ্য হইয়া উঠতাছে। মুরব্বি মানে না।

[মঞ্চবাতি নিভে আসবে এবং প্রস্থান।]

 দৃশ্য-১৮

[নিজের ঘরের টেবিলে বসে বই পড়বে হাশেম। মনটা বিষণ্ন। এরই মধ্যে বিদ্যুাৎ চলে যাবে। পড়ার টেবিলে বসে বিপন্নতা বোধ করবে সে। জেদ করে বই ছুঁড়ে ফেলবে। উপর-নিচে তাকিয়ে, বিদ্যুৎ কর্মকর্তাকে গালি দেবে আর শার্টের কলার নেড়ে গরম নিবৃত্ত করার চেষ্টা করবে। হঠাৎ পেছন থেকে ঠাণ্ডা হওয়ার আভাস পেয়ে ঘাড় বাকিয়ে তাকাবে এবং হাতপাখা হাতে শেফালিকে দেখে বিস্মিত হয়ে বসা থেকে ওঠে পড়বে]

হাশেম : একি! আমনে, আমনে..এইহানে…

শেফালি : ক্যান, কুনো সমস্যা আছে নিকি?

হাশেম : না মানি, আমনে এইহানে আইছেন ক্যানে?

শেফালি : আমনে গরমে কষ্ট পাইতাছেন। তাই পাংকা লইয়া আইলাম। আমনের নিজের মা অইলে কী পোলাডারে এমুন কষ্ট পাইতে দিতো? আমি সৎমা বইলা কি কুনো দায়-দায়িত্ব নাই?

[মৃত মায়ের কথাটা বলায়, হারিয়ে যাওয়া মায়ের ছবি মনের মধ্যে ভেসে উঠবে, একটু চুপসে যাবে হাশেম। পলকহীন তাকিয়ে থাকবে শেফালির দিকে। এই প্রথম সে মেয়েটাকে এত কাছ থেকে দেখেছে- সৌন্দর্য এবং আচরণে মুগ্ধ হয়েছে]

শেফালি : কী অইলো। কতা কন নাই কেনে…

হাশেম : (আমতা আমতা করতে করতে) কী কমু। খাড়াইয়া আছেন কেনে, বহেন।

শেফালি : না থাক। খাড়াইয়াই কতা কই। আইচ্ছা, আমনেরে একখান কতা জিগাই?

হাশেম : হ্যা, জিগান।

শেফালি : আমি কি অনেক খারাপ মাইয়া মানুষ? কতাবার্তা, চালচলনে কি আমারে খুব খারাপ মাইয়ালোক মোনো অয় আমনের?

হাশেম : না, তা অইবে ক্যানে? আমনে অনেক বালা, অনেক সোন্দর।

শেফালি : তাইলে আমনে ক্যানে আমনের বাপরে খালি বকেন, অপমান করেন, আমারেও বকেন, গালি দেন- আমি কি আমনেগো কুনো খতি কচ্ছি?

হাশেম : ইয়ে, আসলে ইয়ে…না, মানি অইলো গিয়া…

শেফালি : (খুব আবেগ প্রবণ হয়ে) জানেন, আমনের বাপের কুনো দোষ নাই। সব দোষ আমার কপালের। আমার জামাই রকমান জাউল্লা আমার লগে চিটিং কইরা পলাইয়া গেছে। আমি না খাইয়া মরি মরি অবস্তা। আমনের বাপ আমারে আশ্রয় দিছে। খাওন দিছে। বিপদ থেইক্কা উদ্দার করোনের লিগ্গা বিয়া কচ্ছে। শ্যাষ আশ্রয়খান দিছে লোকটা আমারে। আমনে কি চান আমার আশ্রয়খান কাইরা লইয়া যাইতে?

 হাশেম : কী কন এই সব?

শেফালি : আমনে ত মোনো করতাছেন জাগাজমি, বাড়িগাড়ি টেকা-পইসার লুবে আমি হেরে বিয়া কচ্ছি? তাই না? আসলে হেইডা না। আমি এট্টু আশ্রয়ের জন্যি বিয়া কচ্ছি। আমি রকমানের গরের থেইক্কা এইহানে বুইড়া বেডার গর কইরা অনেক বালা আছি। অনেক সুকে আছি। এট্টা কতা কমু..?

হাশেম : জি কন…

শেফালি : যদি আমনের বাপেরে কই, এই বাড়িগাড়ি জাগাজমি আমনের নামে লেইক্কা দিতো। আমারে শুধু এট্টু আশ্রয়ের জাগা দিলেই অইব। তকন ত আর আমনের ডর থাকবো না। তাই না?

হাশেম : আমনে এইগুলান কী কইতাছেন আমি কিচ্ছু বুজতাছি না।

শেফালি : কইতাছি যে, আমনের বাপেরে আমি কমু আমনের সব পানা-দেনা এহনই বুজাইয়া দিতে। তকন আর আমনের ওয়ারিশ হারাইবার ডরবয় থাকবো না, যেই সয়-সম্পত্তি থেইক্কা বঞ্চিত অইবার ডরে আছেন হেইডা কাইট্টা যাইব। আমনে শুধু আমারে কতা দেন, আর কুনোদিন জামেলা করবেন না। মামলা-মকদ্দমা করবে না। আমি আমনের পাওনা সব আদায় কইরা দিমু। আমি চাই না আমার লিগ্গা আমনে ঠগ খান।

হাশেম : (একটু নীরব থেকে) দেকেন আমনের লগে কতা কওনের আগে খুব খারাপ মোনো করতাম। এহন দেহি আমনে অনেক বালা মানুষ, মহৎ মহিলা। আমার জাগাজমি লাগবো না। আমি আর কিচ্ছু কমু না। আর জায়জামেলাও করুম না। আমি বালা অইয়া যামু আইজথন।

শেফালি : আমি চাই আমনে সবকিছু আগে আগেই বুইজ্জা নেন। সকলতে মিল্লামিশ্শা থাহুম আমরা।

হাশেম : আমনে যেইডা কইবেন, হেইডাই অইব। আমি আর কিচ্ছু কমু না।

শেফালি : তাইলে এই কতাই রইলো। আমনের বাপেরে বুজাইয়া কমু সব। গেলাম।

[মঞ্চের বাতি নিভে আসবে। হাশেম ও শেফালির প্রস্থান]

দৃশ্য-১৯

[বড়োসড়ো একটা মিষ্টির প্যাকেট আর কিছু খবরের কাগজ হাতে খুব উৎফুল্ল ভঙ্গিতে প্রবেশ করবে বাসু চেয়ারম্যান। শেফালি ও মধুকে গলায় খুব দরদ মিশিয়ে ডাকবে। দুই দিক থেকে দুজন ছুটে আসবে।]

শেফালি : কী অইলো আইজগা এত্ত খুশি খুশি ভাব কেনে আমনের?

চেয়ারম্যান : আরে দেহো, দেহো খবরের কাগুজে কি লেকছে দেহো। আমি জিলার শ্রেষ্ট চেরমেন পুরস্কার পাইছি!  ডিসি সাব ফোন দিছে। নেতাগণও ফোন দিছে। কইছে যে, আগামী মাসো সরকারি খরচে মালুশিয়া ঘুরনের জন্যি নিকি আমার নামও লেহা অইছে। মনের আশাডা পুন্য অইলো এদ্দিন পর। শ্রেষ্ট চেরমেনও অইলাম। সরকারের টেকায় বিদেশ দেহনেরও সুযোক পাইলাম। গাঙে মাছ ধত্তে না দিয়া বালাই কচ্ছি, ইলিশ রক্কায় সহযোগিতা কইরা এত্ত বড় পুরস্কার পাইলাম বুঝলা শেফু?

[মধু আনন্দে লাফালাফি শুরু করবে। শেফালিও খুশি হয়।]

শেফালি : (দুষ্টামির ছলে) শ্রেষ্ট চেরমেনও আমনে, বিদেশ ঘুরবেনও আমনে, আমরা কেবল মিষ্টি খামু হে হে। আমরা ত আর বাসু চেরমেন না যে সরকার আমগোরে পুরস্কার দিবো। আর বিদেশ ঘুরাইবো।

(সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে)

চেয়ারম্যান : আইজগা তুমি যেইডা চাইবা হেইডাই পাইবা শেফু, মনডা অনেক বালা।

[শেফালিকে জড়িয়ে ধরবে চেয়ারম্যান। শেফালি ছাড়িয়ে নিতে চাইবে। খোলা জায়গায় এমন কাণ্ডে সে বিব্রত হবে]

শেফালি : হাছা কইতাছেন!

চেয়ারম্যান : হ, খাঁটি হাছা কতা কইতাছি!

শেফালি : আমনের পোলাডা কত কষ্ট নিয়া পইরা আছে গরে। কইছিলাম কি, অরে এট্টু ডাইক্কা আনেন। আমনের পোলা হিসাবে অর যা পাওনা সব একনই লেইক্কা দেন। তকন ত আর আমগো বিবাদ থাকবো না। সব্বাই মিল্লাজিল্লা থাকতারুম। খুব মায়া হয় পোলাডার জন্যি। আপন মা না অই, মায়ের জাত তো!

চেয়ারম্যান : অই হারামজাদা তোমারে হারাদিন বহে আর তুমি দেহাও দরদ।

শেফালি : ছি অরে হারামজাদা কন কেনে। মা নাই। তাই বইল্লা কি কেউ হারামজাদা অয়? জোয়ান পোলা। বাপে বিয়া কচ্ছে এট্ট লাজ-শরম ত করবই। তাই বইল্যা কি ভুইল্যা যাইবেন?

চেয়ারম্যান : আমি ত অরে সবই দিতাছি, তারপরেও বেডা তেরামি করে কেনে। অর অভাবডা কোনাই কও ত দেহি।

শেফালি : হুনেন, অরে আমনে আমনের সম্পত্তি পুরডাই লেইক্কা দেন। আমার বারণ নাই। আমার শুধু আমনে থাকলেই অইবো। তবুও শান্তি আইবো সংসারে এইডাই বালা। অশান্তি বাল্লাগে না আর।

চেয়ারম্যান : হেইডা কি অয় শেফু? তোমার ভবিষ্যত আছে না। দিলে তোমগো দুইজনরেই দিতো অইবো। নাইলে কেউরেই দিমু না।

শেফালি : আমারে দেন বা না দেন দুঃক নাই। পোলাডারে দেন। পোলাডার লগে আর বিবাদ রাকা দরকার নাই। সবকিছু বুইজ্জা পাইলে আর বিবাদ করবো না। কেহ পুসলাইলেও লাব অইবো না তকন।

চেয়ারম্যান : (মনে মনে ভাবে ভালো বুদ্ধি তো। রহমানকে দমাইতে হলে নিজের পোলারেই আগে দমানো উচিত। তাই বিজ্ঞের মতো হেসে) হে হে, তুমি সুন্দর বুদ্দি দিছ শেফু, অরে সবকিছু রিডি কত্তে কও, আমি তোমগো দুইজনের নামেই সয়-সম্পত্তি সব লেইক্কা দিমু নে। তোমার মতোন বউ পাইছি, আমার আর ডরবয় কিয়ের। আমি না থাকলে তোমারে ঠগাইব লোকে, তাই তোমারেও লেইক্কা দিমু। বিদেশ গিয়া বাঁচি না মরি ঠিক ঠিকানা ত নাই। কুনো বিবাদ রাইক্কা লাভ নাই। অরে কও সবকিছু ঠিক কত্তে। কাগুজপত্তর রিডি কত্তে। আমি দস্তখত কইরা দিমু।

[শেফালি আনন্দচিত্তে মঞ্চ ত্যাগ করবে। চেয়ারম্যান মুগ্ধ হয়ে হাসবে। মঞ্চের বাতি নিভে আসবে।]

 দৃশ্য-২০

[মঞ্চে চেয়ারম্যান, কোট-পরা একজন ভদ্রলোক, হাশেম ও শেফালিকে দেখা যাবে। চেয়ারম্যানকে ঘিরে বসবে তারা। চেয়ারম্যান দলিলের কাগজপত্র সই করবে। মধু সবাইকে আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকবে।]

চেয়ারম্যান : বাবা হাশেম, শেফু তোমার সৎ মা অইতারে, কিন্তুক কামখান কচ্ছে আপন মায়ের লাহান। তোমার প্রাইপ্য অধিকার বুঝাইয়া দিতে আমারে বুঝাইছে। আমি কাইল চইলা যামু মালুশিয়া। মাস দুইয়েক বিদে আমু। তুমি তোমার মার দিকে নজর রাইক্কো। ইজ্জত সম্মান দিয়া কতা কইও। আমার উরপে রাগকষ্ট রাইক্কো না বাপজান। বুড়া বয়সে যা কচ্ছি তোমার লজ্জাশরম পাওনের মতোনই কাম এইডা, তারপরেও আমি ত পথেঘাটে খারাপ কাম না কইরা বিয়া কচ্ছি, গুনার কাম ত করি নাই বাজান। একখান অসহায় মাইয়ালোকেরে ঠিকানা দিছি। তোমার মার দিকে নজর রাইক্কো বাবা।

হাশেম : না বাজান, আমার আর কুনো রাগ নাই। উনি অনেক বালা মানুষ। উনারে অনেক বকাবাদ্যি কচ্ছি আগে। এহন শরম লাগে মোনে আইলে। ঠিক করি নাই কামডা।

শেফালি : এবার আর কুনো বিবাদ নাই। আমরা সব্বাই মিল্লাজিল্লা সুকে শান্তিতে থাহুম। চেরমেন সাব বিদেশ থিক্কা মোডা চাইয়া একখান দরি নিয়া আইবেন। কেহ যদি বিবাদ করে হেরে গাছের লগে বাইন্দা থুমু, কী কন মধুচাচা?

মধু : হ্যা, হ্যা, ঠিক কইছেন বেগম সাব। হা হা।

[সবাই সমস্বরের হেসে ওঠবে। মঞ্চের বাতি নিভে আসবে।]

দৃশ্য-২১

[হাশেম মঞ্চে প্রবশে করবে। শেফালির ঘরের দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। তেঁতুল জাতীয় কিছু একটা খাবে আর মুখ চকটাকবে]

হাশেম : মা, মা, ওমা, মাগো..

শেফালি : (ক্রদ্ধ হয়ে তেড়ে আসবে) এই যে মিয়া, আমারে কি মায়ের লাহান লাগে? এ্যাঁ, আমি কি বুড়া অইয়া গেছি যে মা মা কইয়া ডাক পাত্তে অইব, হু। (মুখ ভেংচি দিবে)।

হাশেম : (ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে) তইলে কী কমু আমনেরে।

শেফালি : (খুব আয়েশি ভঙ্গিতে) চেরমেন বাড়ির বউ কইবেন। আরও কতো সোন্দর সোন্দর নাম আছে হেগুলো কইবেন। আইচ্ছা, আমি কী আমনের থেইক্কা বয়সে বড়ো?

হাশেম : জানি না ত। তয় আমরা হোমান বয়সিই অমু মোনে হয়।

শেফালি : তইলে আমনে আমনে কইরা কন কেরে?

হাশেম : নাইলে কী কমু!

শেফালি : তুমি কইরা কইবেন, আমি আমনের ছোডু। তুমি কইরা কইবেন। বুঝলেন?

হাশেম : ঠিক আছে, তাইলে আমনেও তুমি কইরা কইবেন আমারে..আমিও কমু। ঠিক আছে?

শেফালি : আবারও আমনে কইরা…(দুষ্টুমিসূচক ধমক)

হাশেম : ঠিক আছে, তুমিও আমারে তুমি কইরা বোলাইবা..আমিও বোলামু। অইলো ত?

 শেফালি : ঠিক আছে। হা হা।

[দুজনের হাসি। হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করবে মধু]

মধু : বেগম সাব, চেরমেন সাবের কোনো খবর পাইছেন?

শেফালি : তিন-চাইর দিন আগে একবার মবাইল দিছিলো। কইছে হেই দ্যাশে ভালাই আছে। তয় আবহওয়া লচ্ছে বইল্লা নিকি এট্টু জ¦র-ঠাণ্ডায় পাইছে।

মধু : চেরমেন আপিসের সচিব সাবের দারে কেডা য্যান ফোন দিছে, চেরমেনের নিকি অনেক অসুক। দ্যাশে চইলাইতাছে। মোনো হয় আইয়া পচ্ছে। সচিব সাব কইছে আপনেরা কেহ যাইতেন। কতা আছে নিকি।

হাশেম : কী! তাইলে আমি যাই। জাইন্না আহি কী অইলো বাজানের।

[এক দৌড়ে হাশেমের প্রস্থান। পেছন দিয়ে মধুও যেতে চাইবে কিন্তু কোমলস্বরে শেফালি ডেকে উঠবে]

শেফালি : মধু চাচা।

মধু : জী বেগম সাব।

শেফালি : (একটু আনমনে হয়ে) একটা কতা জিগাই হাছা কইবেন ত?

মধু : কী কতা! কন। কমু বেগম সাব। কমু।

শেফালি : আমি আমনের মাইয়্যার মতোন। আমার মাথা ছুঁইয়া কন হাছা কতা কইবেন? কতা দিতাছি কেউ জানবো না, কাউরে বুজতেও দিমু না। আমার যা অইবার ত অইছেই। শুধু জানুনের লিগ্গা জিগামু। আর কিচ্ছু না।

মধু : খোদার কসম আমনের লগে মিছা কতা কমু না। আমার মাইয়্যাডার কসম খাইয়া আমি মিছা কতা কইতারুম না।

শেফালি : হাছাই কী রকমানেরে চেরমেন সাব লুকাইয়া রাকছিল? আমারে বিয়া করনের লিগ্গা কি হাছা হাছাই নাটোক বানাইছিলো চেরমেন?

মধু : (প্রথমে একটু চুপ মেরে রয় মাথা নিচু করে, এমন প্রশ্ন শুনতে সে প্রস্তুত ছিলো না) থাক বেগম সাব এইসব নিয়া আর গাডাগাডি করনের কী দরকার। কী যে কন। যাই আমার তাড়া আছে। পরে কতা কমু নে…(যেতে মোড় নেয়)

শেফালি : (রূঢ় গলায়) না! আমনে যাইবে না। আমার কতার জবাব দিয়া যান। আমনের মাইয়্যার কসম দিলাম হাছা কইরা কন।

মধু : (কেঁদে ফেলে) হ, মেম সাব, হ। সবকিছু নাটোক। রকমান পলায় নাই। অরে লুকাইয়া রাকছি আমরা। সব কিছু আমি কচ্ছি মেমসাব। টাকার লোবে আন্দা অইয়া গেছি। আমারে মাপ কইরা দেন। আমি আমনের সব্বনাশ কচ্ছি মেমসাব।

শেফালি : (তপ্তশ্বাস ফেলে) আমনের আর কী দোষ মধু চাচা। আমার তো আর খতি অয় নাই। চেরমেন বাড়ির বউ অইছি। টেকা-পইসা ধনসম্পদ পাইছি। আমার আর অভাব কী। আমি একন বুঝি রকমানরে বিয়া করা আমার আসলেই ঠিক অয় নাই। অর্থকড়ি না থাকলে ভালোবাসা কয় দিন থাহে কন। ভালোবাসতে অইলেও কিছু থাহন লাগে, খালি আতে পিরিত হয়, সংসার হয় না মধু চাচা।

মধু : তয় চেরমেন সাব আমনেরে অনেক ভালোবাসা করে। আমনেরে ঠগাইবো না। আমনে চিন্তা কইরেন না মেমসাব।

শেফালি : (নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে) জানি, জানি, সবই জানি, আইচ্ছা মধু চাচা। রকমান একন কই থাহে, কী করে, জানেন কিছু?

মধু : হেই যে গেলো আর দেহি নাই। পোলাডার জন্যি শেষতক আমারও কষ্ট লাকছে। কিন্তু টেহা-পইসা সব কষ্ট ভুলইয়া দিছে মেমসাব। খবর লই নাই আর।

[কথার ফাঁকে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসবে হাশেম। দুজনে কথা অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করবে]

হাশেম : বাজান দ্যাশে চইলা আইছে, শইল্লের অবস্তা নিকি বালা না। পেলেন থেইক্কা নাইম্মা নিকি হাসপাতলে ভত্তি অইছে। ওইহান থেইক্কাই ফোন আইছে। যাওনের কতা কইলো আমগোরে।

শেফালি : চলো চলো, আমরা অকনই ছুইট্টা যাই। আহারে! বয়স্ক মানুষ। হটাৎ কইরা কী হইয়া গেলো যে…

হাশেম : তুমি রিডি অও, আমিও অইতাছি।

[মঞ্চের বাতি নিভে আসবে। সবাই প্রস্থান করবে।]

দৃশ্য-২২

[সাদা এ্যাপ্রোন পরা একজন ডাক্তার টেবিলে বসে নার্সকে নির্দেশ দেবে বিদেশ ফেরৎ রোগীদের শেষ পরিস্থিতি জেনে আসার জন্যে। এমন সময় একটা কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে হাশেম ও শেফালির মঞ্চে প্রবেশ]

হাশেম : (কাগজটা ডাক্তারের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে) আমি বাসু চেরমেনের পোলা। বাজান নিকি এইহানে ভত্তি অইছে। মালুশিয়া থেইক্কা আইজ ফিরছিলেন।

ডাক্তার : ও…আপনারা এসেছেন? শুনুন আপনার বাবার যে সমস্যা ওটা অনেক ক্রিটিকাল প্রবলেম। বিষয়টা আপনাদের জানানো উচিত। সতর্ক থাকা ভালো।

শেফালি : কী অইছে উনার?

ডাক্তার : উনার যে রোগ, এই রোগ থেকে সেরে উঠা সম্ভব হবে কিনা জানি না, তবে আমার মনে হয় এটা উনার শেষ স্টেজ। ভাগ্য ভালো হলে ফেরত আসতেও পারে। তবে না আসার শঙ্কাই বেশি।

হাশেম : কী কন। কই আমার বাজান। আমি অক্ষুনি বাজানের কাছে যামু।

ডাক্তার : শুনেন, সেখানে আপনাদের যাওয়া উচিত হবে না। কারণ, রোগটা অত্যন্ত ভয়ংকর। এ জাতীয় রোগ মারাত্মক ছোঁয়াছে। ভাইরাসজনিত রোগ তো, তাই যে যাবে রোগ তাকেই আক্রমণ করবে। এই রোগের ভালো কোনো ঔষুধপত্র আবিষ্কার হয়নি এখনও। পৃথিবীর সব দেশেই এখন এই রোগ নিয়ে ভয়ে আছে মানুষ। শরীরের উপর নির্ভর করে। যাকে ধরবে তার মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। খুব একটা বাঁচার সম্ভাবনা থাকে না। গুরুতর হলে হাজারেও দুই একজন বাঁচে না। বেশির ভাগই মারা যায়।

[ডাক্তারের কথা শুনে দুজনেই আঁতকে উঠবে]

হাশেম : কী কন! বাজান মইরা যাইতাছে দেকতারুম না এট্টু, এইডা কেমুন কতা? আমার যা অইবার অইব। মরলে মরুম। আমি যামু। আমি আমার বাজানরে এক নজর দেকমু।

[কথাটা বলেই উঠে দরোজা দিকে ছুটে যাবে হাশেম। পেছন থেকে ডাক্তার তাকে ডাক দেবে এবং ছুটে যাবে শেফালি। সামনে গিয়ে দুই হাত মেল পথ আটকে দাঁড়াবে)

শেফালি : তুমি যাইবা না, আমার কসম তুমি যাইবা না। ডাক্তার কইছে এই অসুক খুউব খারাপ, রুগির বাঁচে না। এই রুগির দারে যে যায় সেও বাঁচবো না। সামনে তোমার অনেক বিরাট ভবিষ্যত আছে। তুমি মরতে পারো না। তুমি থাহো। আমি যামু। আমার কুনো ভবিষত নাই। এক সোয়ামি পলাইয়া গেছে। আরেক সোয়ামি মরনের পতে। আমার কুনো আশা-ভরসা নাই। আমি মরলে কুনো ক্ষতি অইবো না কারো। সোয়ামির লগে আমিও মইরা গেলেই ভালা অইব। আমার জীবোনের ত আর দাম নাই। আশ্রয় দেওনের মানুষটা দুনিয়াত না থাকলে আমার বাঁইচ্চা থাইক্কা কী লাব কও? তুমি না, আমি যামু..

[কান্নামুখো হয়ে শেফালি যাবার জন্যে মোড় নেবে। পেছন থেকে সজোরে হাত চেপে ধরবে হাশেম।]

হাশেম : না। তুমিও যাইবা না। তুমি গেলে তুমিও মইরা যাইবা। তোমারে আমি মত্তে দিমু না। একজন রোগা মাইনষের জন্যি আরেকজন ভালা মানুষ মরতারে না। তুমিও মরবা না আমিও মরমু না। চলো আমরা দুইজনেই বাইচ্চা যাই।

শেফালি : মানি!

হাশেম : এই যে তোমার হাত ধচ্ছি। এইডা আর ছাড়ুম না। চলো আমরা পলাইয়া যাই। যেইখানে নাই খারাপ কুনো অসুক-বিসুক, যেইখানে আমরা দুইজনেই নিরাপদ, সেইখানে থাকুম, চলো সেইখানেই গিয়া গর বান্দি।

শেফালি : (চোখের পানি মুছতে মুছতে) হাছা কইতাছ? কিন্তুক সমাজ কী আমগোরে মানবো?

হাশেম : সমাজ ত তুমি আর আমিই। আমরা দুইজনে মাইন্না নিলেই অইবো..চলো পালাই। আমার হাতের উরপে হাত রাখো, চলো আমরা নিরাপদ একখান দুনিয়ার দিকে ছুইট্টা যাই।

[হাশেম হাত পেতে ধরলে মৃদুহেসে হাতের ওপর হাত রাখবে শেফালি এবং দৃঢ়তার সঙ্গে বলে উঠবে- ‘চলো…।’ আড়াল থেকে বেজে উঠবে-‘মধুমালতি ডাকে আয়, ফুল ফাগুনে এ খেলায়…’ ধীরে ধীরে গানের মুকের অংশ বাজতে থাকবে। বাহারি রঙের বাতি জ্বলে ‌উঠবে এবং এক সময় নিভে যাবে সকল বাতি]

সমাপ্ত

নাট্যকার পরিচিতি :————————————–

রফিকুজ্জামান রণি এ সময়ের অত্যন্ত সুপরিচিত একজন কবি ও কথাসাহিত্যিক। খুব অল্প বয়সে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখে লেখক হিসেবে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন তিনি। তার একাডেমিক নাম- মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। পিতা- মোহাম্মদ কামরুজ্জামান খোকা, মাতা- লাভলী জামান। জন্ম ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ; চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায়, দোঘর গ্রামে। তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করে কুমিল্লা বঙ্গবন্ধু ল’ কলেজ থেকে আইন বিষয়ক ডিগ্রী লাভ করেন। বর্তমানে তিনি চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। যুক্ত আছেন একাধিক ছোটকাগজ প্রকাশনার সঙ্গেও।

কবি, কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার রফিকুজ্জামান রণি স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন: জেমকন তরুণ কবিতা পুরস্কার- ২০১৯; চাঁদপুর জেলা প্রশাসক পুরস্কার- ২০১৮; ‘এবং মানুষ তরুণ লেখক পুরস্কার- ২০১৯; দেশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার-২০১৮; নাগরিক বার্তা লেখক সম্মাননা- ২০১৯; চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার- ২০১৪; স্বরচিত কবিতাপাঠে জেলা শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার-২০১৬; জাতীয় সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা-২০১৪; দৈনিক চাঁদপুরকণ্ঠের বিশেষ সম্মাননা-২০১৫; ছায়াবাণী লেখক সম্মাননা- ২০১৬; পাঠক সংবাদ লেখক সম্মাননা-২০১৯, শপথ সম্মাননা-২০১৯ এবং ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম পদক- ২০১৩ সহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা।

তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা চার : ‘দুই শহরের জানালা’(ছোটগল্প), ধোঁয়াশার তামাটে রঙ’(কবিতা), ‘চৈতি রাতের কাশফুল’(গল্প) এবং ‘মুঠো জীবনের কেরায়া’(কবিতা)। গল্প-কবিতার পাশাপাশি লিখছেন নাটকও।

+ posts

Read Previous

পাথুরে মাটির কিষাণ

Read Next

মাসুদ রানা জনপ্রিয় যে কারণে
মাসুদ রানা’র জনপ্রিয়তার কারণ: কতিপয় চিন্তাসূত্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *