প্রথম পর্বের পর……
সম্পূর্ণ গ্রন্থের সূচিপত্র
অধ্যায়-১
পটভূমি
– যেখানে জীবনের যাত্রা
– গল্প সংকলন থেকে গবেষণা
– অধ্যায়গুলোর আগের কথা
– একটি অর্থহীন উত্থান হবে না তো (!)
অধ্যায়-২
জন্মই আমার আজন্ম পাপ
– ভূমিকা
– পেছনের কথা
– নীরবতা
– প্রসারিত হল না কারও দু’হাত
– পছন্দের সীমাবদ্ধতা
– নির্যাতন
– সংস্কৃতিক সামাজিক বিষয়াদি
– পেশাজীবীদের অভিজ্ঞতা
– অপর্যাপ্ত পরামর্শ বা কাউন্সিলিং
– বিশেষ প্রক্রিয়াটি
– গর্ভপাত পরবর্তী সময়
– ফিরে দেখা সমাজ আবার
অধ্যায়-৩
– গল্পের মরালিটি ও গবেষণায় নৈতিকতা
– পেছনের কথা
– গর্ভপাত সংক্রান্ত নৈতিক প্রশ্নগুলো
– নৈতিকতার সীমানা নারীবাদী মতামত ও বাংলাদেশ
– প্রাচীন দর্শন ও গর্ভপাত প্রাচীন দর্শন ও গর্ভপাত নৈতিকতা কি ধর্মীয় রীতিভিত্তিক— খ্রিস্টান, ইসলাম, হিন্দু
– সুতরাং এথিকস কি সাবজেক্টিভ, বৈশ্বিক নাকি আপেক্ষিক?
– গবেষণায় নৈতিকতা ফোকাস ও উদ্দেশ্য
– ফলাফল – প্রয়োজনীয়তা
– গল্পগুলো সংগ্রহের কথা ও সেগুলোর ব্যবস্থাপনা : এথিককসের আলোকে
– গল্প সংগ্রহে ঝুঁকি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা
– নৃবৈজ্ঞানিক নৈতিক নির্দেশনা তথ্য উন্মোচনে, বলায়
– গল্প সংগ্রাহকদের ঝুঁকি ও ব্যবস্থাপনা
– তথ্য মালিকানা ও প্রকাশ ও CDA’র নির্দেশনা
– উপসংহার : CDA’র বিড়ালটা বেড়ায় বসে থাকে
অধ্যায়-৪
কলঙ্কিনী রাধা
– চিরস্থির দৃশ্যপট (?)
– কলঙ্কের সূত্রগুলো কে বানাল
– গর্ভপাত ও চারপাশের দেশ
– গর্ভপাত ও নারীদের ধারণা
– গর্ভপাত কলক আর সামাজিক ভাষা
– তিসকোর্য চিন্তাভাবনা সমাজ তেমুখের মডেল
– কাজ ও টেক্সটভিত্তিক মডেল; সামাজিক ইন্টারএকশনের মাঝে টেক্সট বা মায়েদের গল্পগুলো
দেখার পদ্ধতি
– একটি তুলনামূলক আলোকপাত
– প্রতিবাদ হিসেবে লেখা
– ক্যাথারসিস, অভিজ্ঞাতার সম্মিলন
– কলঙ্কিনী রাধা : মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার
অধ্যায়-৫
– মুসলিম অধ্যুষিত দেশসমূহের গর্ভপাত আইন : একটি ইসলামিক ডিসকোর্স বিশ্লেষণ ও নীতিপ্রণয়ন সম্ভাবনা
– আলোচনার সূত্রপাত
– মৌলিক উৎস কোরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা
– বিবেচ্য অন্য বিষয়সমূহ
– সুফিবাদ ও বৃহত্তর ইসলামি নীতি
– সুবিধাভোগী মহল ও আবারো নারীবাদ
– বহুজাতিক ইসলামি সংস্থা/ ডোনার
– মুসলিমপ্রধান দেশসমূহে গর্ভপাত আইনের বহুমাত্রিকতা
– নীতি প্রণয়নের জন্য সুপারিশ
– উপসংহার নয় মোটেই
অধ্যায় ৬
– আমি কুলহারা কলঙ্কিনী
– যাদের কথা এই বইয়ের রসদ
– মাহজাবিন : তুই তো বিপদজনক এক উত্তরাধিকারী শুধু
– জেনিফার : আমার আত্মার আত্মীয়টা কই
– চামেলী : কোথায় লুকাল নাছোড় যন্ত্রণা
– দাসিরা : আমি আর কত বড় হলে
– রায়না : আমার পালিত যন্ত্রণার খাঁচা
অধ্যায়-৭
– অদৃশ্য পালকের সম্ভার
– ব্যাখ্যার বদলে রাজপথের সোগান
– গবেষণার আয়নার আমার মুখচ্ছবি
– উন্মোচিত হোক শোকের মোড়ক
– CDA’র বিড়ালটা আর আমাদের দেখার জমিন
– আনওয়ান্টেড ‘গর্ভ’ বনাম আনওয়ান্টেড ‘গর্ভপাত’
– সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চাপের স্বীকৃতি
– বিস্রস্ত বর্ণে অজ্ঞাত বিষয়
– প্রদোষের আলোয় কিছু দ্রষ্টব্য
– পরিশিষ্ট
নোট : ৭টি অধ্যায়ে লিখিত প্রবন্ধ গ্রন্থটির, অধ্যায়-৩ ও অধ্যায়-৪, ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্বে সঙ্কলিত করা হয়েছে।
কলঙ্কিনী রাধা, দ্বিতীয় পর্ব
অধ্যায়-৩
গল্পের মরালিটি ও গবেষণায় নৈতিকতা
“প্রতীক হও, প্রতীকের বড় প্রয়োজন”
পূর্ণেন্দু পত্রী
পড়ার আগে
গল্পগুলো গল্প নয়, যেমন বোঝায়। গল্পগুলো মায়েদের অভিজ্ঞতা, তাদের চোখের ভাষা, মুখের ভাষা, তাদের সমুদয় প্রকাশভঙ্গি। এগুলো মোটেই কল্পিত গল্প নয়। আমরা ‘গল্প’ বলতে যেমন বুঝি, যেমনটি ডিসকোর্স। গল্প কেন সর্বদাই কাল্পনিক হবে?
গল্প সংগ্রাহক, আমি-সহ যারা মাঠে কাজ করেছেন। সবাই।
গল্পের মরালিটি ও গবেষণায় নৈতিকতা
– পেছনের কথা
– গর্ভপাত সংক্রান্ত নৈতিক প্রশ্নগুলো
– নৈতিকতার সীমানা নারীবাদী মতামত ও বাংলাদেশ
– প্রাচীন দর্শন ও গর্ভপাত
– নৈতিকতা কি ধর্মীয় রীতিভিত্তিক : খ্রিস্টান, ইসলাম, হিন্দু
– সুতরাং এথিকস কি সাবজেক্টিভ, বৈশ্বিক নাকি আপেক্ষিক?
গবেষণায় নৈতিকতা ফোকাস ও উদ্দেশ্য
– ফলাফল ও প্রয়োজনীয়তা
– গল্পগুলো সংগ্রহের কথা ও সেগুলোর ব্যবস্থাপনা : এথিককসের আলোকে
– গল্প সংগ্রহে ঝুঁকি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা
– নৃবৈজ্ঞানিক নৈতিক নির্দেশনা তথ্য উন্মোচনে, বলায়
– গল্প সংগ্রাহকদের ঝুঁকি ও ব্যবস্থাপনা
– তথ্য মালিকানা ও প্রকাশ ও CDA’র নির্দেশনা
উপসংহার : CDA’র বিড়ালটা বেড়ায় বসে থাকে
পেছনের কথা
এথিকস বা মরালিটির বাংলা নৈতিকতা হিসেবে দেখব। কখনোবা সমার্থক হিসেবে আসতে পারে। গর্ভপাত বিষয়ে নীতি বা নৈতিকতার আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের দেখা দরকার ‘নৈতিকতা’ আসলে কী? পশ্চিমা সমাজে যেখানে ছেলে/ বয়ফ্রেন্ড নিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে বাড়ি আসতে পারছে, রাতে থাকছে, যেখানে ধর্মীয় কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, অর্থাৎ সেটি নৈতিক। ঠিক, উল্টোটা বাংলাদেশের সমাজে। আবার ইসলাম ধর্মে যেখানে মদ্যপান হারাম; সেখানে ক্যাথলিক চার্চে পাদ্রী রোববারের ধর্মীয় প্রার্থনায় নিজ হাতে সবাইকে পানপাত্রে মদ নিচ্ছেন, তাহলে কোনটা নৈতিক? গর্ভপাত, যেখানে কোনো কোনো দেশে আইনি বাধা নেই; যেমন জাম্বিয়া, ভিয়েতনাম, আমেরিকার কোনো কোনো রাজ্যে, সেখানে আইনগতভাবে নৈতিক। বাংলাদেশ অনৈতিক। কিন্তু, আবার হচ্ছে বাস্তবে। সেটা কি তাহলে প্রাণ-হত্যা বা মানব হত্যা? গর্ভপাত না করলে; হয়তবা সুস্থ সুন্দর একটি মানব শিশুর জন্মই হত যথাসময়ে। তাহলে, গর্ভপাত কি হত্যার নামান্তর? নাকি শুধু একখণ্ড কোষ সরিয়ে ‘মাসিক’টা নিয়মিত করে দেওয়া?
পিটার সিংগারের ভাষ্য হল, যেহেতু বাংলাদেশে গর্ভপাত হচ্ছে; বাস্তবে এটা বিদ্যমান, সেহেতু বাস্তবতার আলোকেই দেখা উচিত। বাস্তবতার আলোকেই আমরা গর্ভপাত সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখব। একইসাথে আরও কিছু প্রশ্ন উদিত হয়, নৈতিকতা বা এথিকস কি সারা বিশ্বের জন্যে একই নাকি আপেক্ষিক। নৈতিকতার মানদণ্ড বা সীমারেখা কি ধর্মভিত্তিক নাকি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে তৈরি? যেমন, খ্রিস্টান বা ইসলাম ধর্মেও মানুষকে ক্রীতদাস করা যায়। যিশু খ্রিস্ট বা মহানবী (সা.) ক্রীতদাস প্রথা নিয়ে কথা বলেননি।
তার মানে হল, সময় পরিক্রমায় নৈতিকতার সীমা বা গাইডলাইন বদলায়। আমরা এসব বিষয়ে আলোকপাত করছি।
দ্বিতীয় ভাগে এই গবেষণায় কী কী নৈতিক গাইড লাইন অনুসরণ করছি; এই গবেষণার ফলাফল কী হতে পারে; গল্পগুলো সংগ্রহের উপায়, সেগুলোর সংরক্ষণ ও আইনি বাধ্যবাধকতা আমরা দেখব। আরও দেখব, গল্পগুলো সংগ্রহে ঝুঁকি কী কী, এবং আমরা কীভাবে তা ফেস করেছি; মানবসৃষ্ট ঝুঁকিগুলো কী কী ছিল, কিংবা যারা মাঠে কাজ করেছেন তারা কীভাবে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন সেগুলোও। সর্বশেষ অংশে সংগৃহীত তথ্যগুলোর মালিকানা, এগুলোর প্রকাশনা ও ডিসকোর্স এনালাইসিসের নির্দেশনা কী তা আমরা পর্যালোচনা করছি।
গর্ভপাত সংক্রান্ত নৈতিক প্রশ্নগুলো : বাস্তব নৈতিকতা
বলা হয়ে থাকে, নৈতিকতা বিষয়টি কেতাবি অর্থাৎ বইয়ের পাতাতেই মানায় ভালো, বাস্তবে নয়। কিন্তু, বিপরীত অর্থটা আমাদের কাছে আরও অর্থপূর্ণ। যদি কোনো নৈতিক গাইড বাস্তবে ভালো না হয়; বুঝতে হবে তার গাইড লাইনের মাঝেই সমস্যা। সাধারণত মনে করা হয়, নৈতিক নীতিমালা বাস্তব দুনিয়াতে প্রযোজ্য নয়, যেমন ‘মিথ্যা বলো না’ ‘চুরি কোরো না’ কিংবা ‘হত্যা করো না’ কিন্তু জটিল সামাজিক আবহে এগুলো মেনে চলা ভীষণ কঠিন। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে, সহজ নীতিগুলোর অনুসরণ ভয়াবহ ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। গর্ভপাত করানো অবিবাহিত মেয়েটি বলছে যে কারও শয্যাসঙ্গী হয়নি। যদি বলে, ইহজীবনে তার বিয়ে হবে না। কিন্তু, একটা মিথ্যা কি তাকে ‘অনৈতিক’ মানুষ হিসেবে গণ্য করবে? আবার, পুঁজিবাদী বাংলাদেশের সমাজে, যেখানে ক্লিনিক বা হাসপাতাল থেকে ‘গর্ভপাতে’ উৎসাহিত করা হচ্ছে, সেখানে তারা অনৈতিক কীভাবে হবে? রাষ্ট্র যেখানে তাকে ব্যবসা ও মুনাফা করার অনুমতি দিচ্ছে। আবার যদি, একটি গর্ভ বা ভ্রূণ যথা সময়ে মানব শিশুরূপে জন্ম নেয়, তাহলে গর্ভপাত কেন মানব হত্যার সমতুল্য হবে না?
এছাড়া, যেহেতু একজন মা কনসেন্ট ফর্মে বা অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর দিয়ে তারপর অপারেশন থিয়েটারে যাচ্ছেন; তাহলে গর্ভপাত করানো প্রশ্নে ডাক্তার বা নার্স বা হাসপাতালকে ‘নৈতিক’ বা ‘অনৈতিক’ বলা হবে কোন যুক্তিতে? আরও একটা জোরাল প্রশ্ন; ভ্রূণকে নবজাতক শিশুর মতো শিশু অধিকারের অওতায় আনা যাবে কি না? একই সাথে, পশ্চিমা দুনিয়াতে, যদি গর্ভকালে দেখা যায়, বাচ্চার মধ্যে কোনো সিরিয়াস সমস্যা, যেমন অটিজম, তাহলে মাকে সেই বাচ্চা রাখা বা না রাখার এখতিয়ার দেওয়া হয়। ডাক্তার বা মা মনে করেন এই শিশু মায়ের ভবিষ্যৎ মানসিক সমস্যার কারণ হয়ে থাকবে; এবং বাচ্চাটা অসহনীয় কষ্টের স্বীকার হবে। কারণ সে স্বাভাবিক নয়। আবার, ভ্রূণকে যদি হত্যাই করা হয়, কোনো সমস্যা চিহ্নিত না করে, সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যত মানব শিশুই হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এগুলোর কোনোটাই একটা ভ্রূণ হত্যার বা গর্ভপাত করানোর পক্ষে যথাযথ কারণ হবে না।
কেউ কেউ বলে থাকেন, যদি পিতা-মাতার আর্থিক সমস্যা থাকে, সে ক্ষেত্রে, ভ্রূণ হত্যার বা গর্ভপাত করানোর যুক্তি থাকতে পারে। আমাদের কাজে দেখেছি, মায়েরা তাদের হারানো সন্তাকে নিয়েই ভবিষ্যাতের স্বপ্ন আঁকতেন। কেউ কেউ বাচ্চার সম্ভাব্য জন্মদিনও পালন করেন। কেউবা মৃত্যু দিবস। সুতরাং ইমোশনাল চাপকে কীভাবেইবা অস্বীকার করা যায়?
বায়ো এথিকসের গুরু পিটার সিংগার এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন। তাঁর মতে একটি ভ্রূণ আসলে কী কিংবা ভ্রূণকে মানব শিশু বলা যাবে কিনা, সে বিতর্ক অর্থহীন। বরং নৈতিকতার বিচারে প্রশ্ন রাখা উচিত, আমরা একটি নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করছি কি না? এর বিপরীতে ভ্রূণকে মানব শিশু বলা যাবে না কারণ ভ্রূণের মাঝে, প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাণ বা সোল আসে না। কিন্তু উপসংহারে বলছেন মানব ভ্রূণ হত্যা করা অনৈতিক আরও বলা হয়, এ সব প্রশ্ন অবান্তর, কখন মানব ভ্রূণের মাঝে প্রাণ আসছে, কখন জন্ম হচ্ছে, কখন মানব শরীরের আকৃতি পাচ্ছে।
ভ্রূণ, ঠিক কোন সময়ে মানব প্রাণ পায়, সেটি মোটামুটি আজও স্পষ্ট। যেমন একটি ভ্রূণমায়ের গর্ভ থেকে এনে কৃত্রিমভাবে প্রযুক্তির সাহায্যে লালন করা যায় তাহলে কী এটা পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে রূপান্তরিত হবে? কিন্তু চিকিৎসা প্রযুক্তি এখনও সেই পর্যায়ে যায়নি। এবং যদি প্রযুক্তি আসেও তখন পশ্চিমা সমাজের মায়েরা এই সুবিধা ভোগ করতে পারলেও বাংলাদেশের মতো সমাজের মায়েরা এই সুবিধা পাবে না; তাহলে নৈতিক প্রশ্ন কোনটি?
আবার জন্মের বিষয়টিও অপরিষ্কার, অস্পষ্ট। কারণ কোনো বাচ্চা জন্মের এক সপ্তাহ পরের এবং জন্মেও এক সপ্তাহ আগের— এই দুই সময়ের বাচ্চার মধ্যে তেমন কোনো শারীরিক বা মানসিক পরিবর্তন ঘটে না। ভ্রূণের নড়াচড়া মায়েরা বুঝতে পারেন না ঠিক কোনো সময় শুরু হয়। আবার প্রশ্ন, মা হয়ত ঠিক সেই সময়টাতে ঘুমাচ্ছেন, তাহলে কীভাবে বুঝবেন?
কিংবা ভ্রূণটির নড়ে ওঠা খুবই সূক্ষ্ম ও হালকা যে, মা বুঝতেই পারেননি। আবারও, ভ্রূণ কখন পেইন বা ব্যথা অনুভব করতে পারে? মেডিকেল বিজ্ঞান বলছে সাত সপ্তাহ সময়কালে একটি ভ্রূণ পেইন বা যন্ত্রণা বুঝতে পারে। তাহলে একই প্রশ্ন, ভ্রূণটি সরানো কী মানুষ হত্যা হবে না? কারণ এতে প্রচ্ছন্ন প্রাণের অনুভূতি আছে।
এবার দেখি, যদি ভ্রূণকে আমরা মানুষ মনে করি তাহলে কী হোমোসেপিয়ান্স গোত্রের একজন সদস্য নাকি ‘ব্যক্তি মানুষ’?
যদি ভ্রূণকে সচেতন ব্যক্তি মানুষের সাথে তুলনা করা যায়, তাহলে ভ্রূণ হত্যা আর মানুষ হত্যার সমার্থক। বিপরীতে, যদি ভ্রূণকে হোমোসেপিয়ান্স গোত্রের একজন সদস্য মনে করা হয়, ‘ব্যক্তি মানুষ’ নয়, তাহলে এখানে প্রশ্ন আসবে, অন্যান্য প্রাণীকে আমরা যেমন আমাদের প্রয়োজনে হত্যা করি; এখানেও সেই যুক্তি প্রযোজ্য হবে কি না? কারণ সে তো পূর্ণাঙ্গ মানুষ/ ব্যক্তি হয়ে ওঠেনি তখনও।
পিটার সিঙ্গার আরও বলেন যে ভ্রূণকে নৈতিক তাৎপর্যেও ভিত্তিতে বিবেচনা করা উচিত। ভ্রূণের ব্যক্তি মানুষ হয়ে ওঠার বা বিবেচনা করার যে মৌলিক বৈশিষ্ট্য— সেল্ফ কনসাসনেস ও রেশনালিটি; এ দুটি না আসা পর্যন্ত ভ্রূণকে ব্যক্তি মানুষ বলা যাচ্ছে না। আর তাই, নৈতিকভাবে ভ্রূণকে সরানোর অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। সাম্প্রতিক এথিকস বইপত্রে বলা হচ্ছে যে, এক্ষেত্রে একমাস সময় দেওয়া যেতে পারে ভ্রূণকে নষ্ট করা বা গর্ভপাত করানোর। এমনকি ভ্রূণটির অনুভূতি চলে এলেও যুক্তি— সেল্ফ কনসাসনেস ও রেশনালিটি নাই।
ভোগবাদী দুনিয়াতে অথবা ইউটিলিটারিয়ান দৃষ্টিভঙ্গিতে, একজন মা’কে এইটুকু স্বাধীনতা দেওয়ার পক্ষেই কথা বলেন পিটার সিংগার মহোদয়। একজন মা যদি মনে করেন ভ্রূণটি তার পক্ষে রাখা আবশ্যক তাহলে রাখতে পারেন। আমার ব্যক্তিগত মত হল, একটি ভ্রূণ হয়ত প্রথম চার সপ্তাহের মধ্যে সেলফ কনসাসনেস ও রেশনালিটি পাবে না সত্য, কিন্তু বিশেষ কোনো সমস্যা না হলে এ দুটো বৈশিষ্ট্য যেকোনো ভ্রূণের বেলাতে প্রযোজ্য হবেই হবে।
আবারও সিংগারের কাছে যাই; সিংগারের যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কার্যকরণ যুক্তির সাপেক্ষে; এমনকি যদি গর্ভপাত অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ও, তবুও এটা ভুল বা অনৈতিক বিবেচিত হচ্ছে। তিনিই উদাহরণ দিচ্ছেন, একজন মহিলা দু’মাস পরে দেখতে পেলেন যে তিনি গর্ভবতী ও তিনি গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেন; কারণ তাকে বাচ্চা ধারণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ শেষ করতে হবে। পরবর্তীকালে আবার বাচ্চা নেন। সিংগার বলেছেন, এ মহিলার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। হয়তবা তিনি ব্যক্তিগতভাবে ‘স্বার্থপর’ কিংবা ‘খারাপ’। কিন্তু ভোগবাদী/ পুঁজিবাদী বিশ্বের কাছে এইসব কারণ অর্থহীন একেবারে। কারণ ভ্রূণটি তো আর মানবশিশু হয়ে উঠেনি। সেলফ কনসাসনেস ও রেশনালিটি নেই বা গ্রো করেনি। কিন্তু, গর্ভপাতের পর, বাংলাদেশের মায়েদের বর্ণনায় আমরা দেখেছি যে, কতটুকু নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে; পারিবারিক সম্পর্কেও বেলায়, স্বাভাবিক জীবনের চলার পথে।
নৈতিকতার প্রশ্নে ক্রোম নামে একজন বিজ্ঞ লোক বলেছেন যে, ভোগবাদী দর্শনে অনুপ্রাণীতদের কাছে গর্ভপাত হয়ত কেবল অযাচিত ‘টিস্যু’ বা ‘সেল’ বা মাংসপিণ্ডের অপসারণ। ব্যক্তিগত সুখ আর চাহিদা অর্জনে যদি আনওয়ান্টেড কনসিভ হয়, তা অপসারণ করাই বাঞ্ছনীয় যেটা আমরা, স্বামী বা সঙ্গীদের মুখে শুনেছি; মায়েরা বলছেন। কিন্তু ক্রোম বলছেনে এটা সাবজেকটিভ, সাময়িক।
একই সাথে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত গুণাবলি যা তার ‘সুখ’ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে যুক্ত থাকে। যেমন, দয়া, মায়া, মমতা, সাহস, স্বকীয়তা যা প্রত্যেকের মাঝে কম-বেশি বিদ্যমান। আর এসব ব্যক্তিগত গুণাবলি থাকে বলেই আমরা তাকে ‘মানুষ’ হিসেবে বিবেচনা করি। মানুষ তার কাজ-কর্মের মাঝেই এসব গুণাবলি প্রমাণ দিয়ে থাকে। সুতরাং একজন স্বামী যদি তার স্ত্রীকে গর্ভপাত করানোর বিষয়ে ‘জোর’ দিয়ে থাকে, তাকে কী আমরা ‘অনৈতিক’ বা ‘অমানবিক’ বলব?
গর্ভপাত করানোর ফলে হয়ত সে আর্থিক লাভবান হবে, পারিবারিক সঞ্চয় বাড়াতে পারবে, কিংবা সে এখন ‘বাচ্চা’ ভরণপোষণের মতো অবস্থায় নয়, সেক্ষেত্রে একজন স্বামী যদি তার ব্যক্তিগত গুণাবলি এমন মায়া মমতা যা স্নেহ ইত্যাদি বিরুদ্ধে গিয়ে কঠোর হয়ে ওঠে, সে ক্ষেত্রে, এই পুঁজিবাদী সমাজকাঠামোয় বাংলাদেশে তাকে আমরা কতটা ‘অমানবিক’ বলতে পারছি?
কিংবা একজন স্বামী কেন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সুখকে বির্সজন দিয়ে স্ত্রীর প্রতি আরও কেয়ার বা যত্ন নিচ্ছে না ও বাচ্চাটার প্রতি? কেনইবা সে বাচ্চার প্রতি দেখানো আবেগকে শ্রদ্ধা না করে, কেবলই ‘বস্তুগত’ স্বাচ্ছন্দ্যের কথা বিবেচনায় আনছে?
গর্ভপাত করানো নিঃসন্দেহে, একজন স্বামীর প্রতিষ্ঠিত গুণাবলির বিপরীতে অবন্থান নিচ্ছে; তার সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে স্ত্রীর গর্ভে থাকা সন্তান তাই সিংগার বলেছেন, এখানে কার্যকারণ দেখা দরকার। এথিক্যাল উপসংহার টানতে তিনি ‘রিজনিং’ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত গুণাবলিকে ধরে রেখে, চর্চা করে যদি কোনো এথিক্যাল উপসংহার দেওয়া যায়, আমার ব্যক্তিগত মতামত, সেটাই হবে বাস্তব বা রিয়েল এথিকস। বস্তুগত সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনের মানে নয়। ভোগবাদী দর্শনের চোখে বস্তুগত সাফল্যই শেষ কথা, কিন্তুবস্তুগত সফলতা আর ‘সুখ’ এক জিনিস নয় কখনই।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক কালে পূর্বোল্লেখিত Guibiline and Minervai লেখাকে কেন্দ্র করেও বেশ বিতর্ক হয়ে যায়। যেখানে পিটার সিংগারও থাকেন। গর্ভপাত সংক্রান্ত মৌলিক প্রশ্ন আবর্তিত হয় দু’টোকে ঘিরে।
এক. Pro-life –যারা ভ্রূণকে দেখছেন ব্যক্তি হিসেবে
দুই. Pro-choice –ভোগবাদী মানসিকতা অনুসারী
ক্রিস্টোফার কাকজর তাঁর সাম্প্রতিক লেখাতে বলেন, গর্ভপাত তো কেবল একটা উসিলামাত্র। কিন্তু হাসপাতাল ক্লিনিক, নার্স, স্বামী, পরিবার ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য, বন্ধু, পাড়া-পড়শি, আত্মীয়, জ্ঞাতি সবাইকে এ সংক্রান্ত প্রশ্ন করা যায়। প্রশ্নের আওতা আরও বড় হয় যখন নীতি নির্ধারকদের দিকে চোখ তুলে কথা বলা হয়, যারা সামাজিক চর্চাকে প্রভাবিত করতে পারতেন, রাজনীতিবিদদের, যারা ভোটের হিসেব গুণতে থাকেন। গর্ভপাত বিষয়ে কথা বলতে, সমাজকর্মী যারা দাতাদের ফরমায়েশ দেখে কাজ করেন। এবং সবার সাথে মায়ের বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় যখন গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত একা চলে আসে মায়ের কাঁধে।
গর্ভপাত প্রশ্নে দার্শনিকরা যখন বিভক্ত তখন তাদের সংজ্ঞাতেও বিভক্তি দ্রষ্টব্য। যেমন, কেউ বলেন এটা নাকি মায়ের শরীর থেকে ভ্রূণটাকে সরানো। যদি তাই হয় তাহলে প্রত্যেকটা সিজারিয়ান বাচ্চার জন্মও তো একই সংজ্ঞার আওতায় পড়ে!
নৈতিকতার সীমানা : নারীবাদী মতামত ও বাংলাদেশ
নৈতিকতা বৈশ্বিক নাকি আপেক্ষিক? আমার বাংলাদেশের নৈতিক মানদণ্ড কি আলপসের ওপারের দেশেও প্রযোজ্য? যেহেতু গর্ভপাত বিষয়ের সাথে একজন মা জড়িত আছেন, এবং তিনিই গর্ভধারণ করেন, সেহেতু মনে হচ্ছে, বিশ্বের নারীবাদীরা কী বলছেন দেখি–
শেরউইন, উলফ প্রমুখ এ বিষয়ে প্রধান ভোকাল। শেরউইন বলেন, গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত একজন ‘নারীর চাহিবা মাত্র দিতে বাধ্য থাকিবেন’। গর্ভকালীন যেকোনো মুহূর্তে। কোনো ‘এপোলোজি’ ছাড়াই। আর ভ্রূণের তো আদতে কোনো নৈতিক অবস্থান নাই। উলফ অবশ্য বলেন, যদি একজন মা মনে করেন তার জন্য ভালো হবে, তিনি যেন গর্ভপাত করানোর অধিকার রাখেন। উলফ মনে করেন, একজন মা গর্ভপাত করাতে পারেন, কিন্তু যেহেতু তিনি জৈবিক কারণে ‘মা’ এবং তাকেই শারীরিক মানসিক ও নৈতিক সমস্যার মুখেমুখি হতে হয়, সেহেতু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হয়।
ক্রিস্টোফার কাকজুর মন্তব্য করেন, নারীবাদীরা, সাধারণভাবে গর্ভপাত বিষেয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না। নারীবাদীরা গর্ভপাত মায়েদের জন্য ভালো কি মন্দ সে বিষয়ে অনেকটা চুপচাপ। তারা বলতে চান না গর্ভপাত মায়েদের জন্য ভালো কিংবা ভ্রূণের একটা নৈতিক মূল্য আছে; অথবা গর্ভপাতকে আইনসম্মত করা হোক কিংবা নৈতিক সমর্থন দেওয়া হোক।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, আমি নারীবাদী গবেষক, চিন্তাশীল ও উন্নয়নকর্মী, কারও কোনো কাজ দেখিনি। হাতেগোনা কিছু কাজ আছে যা মূলত কীভাবে কোথায় গর্ভপাত করানো হয় এসব বিষয়ে। নারীদের উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন, সচেতনতা ইত্যাকার বিষয়ে আমাদের নারীবাদীরা লেখেন, কাজ করেন, কথা বলেন। রাজনীতিতে নারীদের কোয়ানিটিটি কম সত্য, কিন্তু কোয়ালিটি মানে পদাধিকারী অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। কিন্তু, ঐ যে, কাকজুর বলেছেন, ভোটের হিসাব দেখতে হয়, জনসমর্থন ভাবতে যেয়ে ‘গর্ভপাত’ নিয়ে কথা বলার অবকাশ নেই। অবশ্য বাংলাদেশে যে সব সংস্থা কাজ করছে; এবং সরকারিভাবেও গর্ভপাত শব্দটি অফিসিয়ালি ব্যবহার করা যায় না। অফিসিয়ালি ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে মেন্সট্রুয়াল রেগুলেশন বা এম. আর.।
আমাদের ইন্টারভিউ চেকলিস্টেও এম. আর. ব্যবহার করেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমরা নারীবাদী কতিপয় ভাবুকের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম; তারা নাকি এখনও ভাবছেন না। সময় হয়নি এখনও!
প্রাচীন গ্রীক দর্শন ও গর্ভপাত
আমরা যখন গর্ভপাত নিয়ে নীতি বিজ্ঞানের লেখাজোকা দেখছি; তখন আপনাদের মনে একটা সংগত প্রশ্ন আসে,
‘আইনগতভাবে গর্ভপাত বিধিসম্মত কিন্তু নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কি?’
এ প্রশ্নের উত্তর আমরা দর্শনের বইপুস্তকে পাই। বিজ্ঞানের জন্মভূমি দর্শন, সুতরাং সঙ্গত কারণেই দর্শনের দিকে হাত বাড়াতে হয়।
প্রায় দু’হাজার বছর আগে এ্যারিস্টটল মানুষের জন্ম এবং বিকাশ সম্পর্কে বেশকিছু কথা বলে গেছেন, যা আজকের এমব্রুলোজির বইতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত। তাঁর মডেলে একজন কুমার মাটি দিয়ে একটি পাত্র বানাচ্ছে তেমনই পুরুষ বীর্যে আছে pneuma যা একজন নারীর মাসিকের রক্তের সাথে মিশে যায়। তাঁর মতে প্রাণ সঞ্চারণ হয় সাত দিন পর। এবং চল্লিশ দিন পর পূর্ণাঙ্গ আত্মা হিসেবে প্রকাশিত হয় সেই রক্ত বা বীর্য। থমাস একুইনো, এ্যারিস্টটলের অনুসারী বলেন, চল্লিশ দিনের মধ্যেই ‘গড,’ এখানে আত্মা দিয়ে থাকেন। প্রথম সাত দিনে মিশ্রিত রক্ত কিন্তু সম্ভাব্য আত্মা, যেটাকে এ্যারিস্টটল বলছেন
Vegetative Soul or Sensitive Soul, চল্লিশ দিন পর তা পূর্ণ মানুষেরই আত্মা, যেটাকে বলছেন Rational Soul এই রেশনাল সোলই হচ্ছে সময়ের পরিক্রমায় মানুষ, শারীরিক কাঠামো, পূর্ণাঙ্গ মানুষ। যদিও তাঁর কিছু কিছু মতামত সমালোচিত হচ্ছে। পশ্চিমা দর্শনে, এমনকি প্রাচ্য দর্শনেও এ্যারিস্টটল প্রাসঙ্গিক আজও। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এ্যারিস্টটলের বায়োলজিক্যাল গ্রোথের ধারণাকে সংশোধন করেছে; একই সাথে তাঁর নীতিমালাকে বৈধতা দিচ্ছে। আর এজন্যই এখানে এ্যারিস্টটলের আলোচনা এবং প্রাসঙ্গিকতা।
আরও একটি কারণ হচ্ছে, কেন মায়েরা গর্ভপাত করানোর পরও বিলাপ করছেন যা বাস্তবে আর নেই কিংবা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবতায় ছিল না। এ্যারিস্টটলের মেটাফিজিক্স-এ দেখি, তিনি কোনো জিনিসের আল্টিমেট রিজন এবং বাস্তব বিষয়ের মূল কারণ অনুসন্ধানের ব্রতী ছিলেন। মায়েদের এই বিলাপ, আহাজারির কারণটাও খুঁজে বের করার জন্য দর্শনের দিকে হাত বাড়াতে হয়।
এ্যারিস্টটলের সূত্রে তিনি মানুষের শরীরের উপর কাজ করেন। কিন্তু অবধারিতভাবে সেটা অদৃশ্য বিষয়ের দিকে ধাবিত হয় কারণ; গভীরভাবে সেই দেখা বা দৃশ্যমান বস্তু থেকে কীভাবে আরও একটি বস্তুতে রূপান্তরিত হচ্ছে। মনে করা যাক, একখণ্ড কাঠ। সেটা নিরেট, কঠিন কাঠের টুকরো। কিন্তু, যখন আপনাদের কথা বলা হচ্ছে সেটি হতে পারে ছাই। আবার গ্যাস। সুতরাং এর ‘মূল’ কাঠখণ্ডটি ‘সম্ভাব্য’ ছাই বা গ্যাস হতে পারে। পরিবর্তন সাপেক্ষে কাঠর মূল কাঠামো বদলে যাবে, হবে ছাই অথবা গ্যাস। একটি মানব দেহকে বুঝতে হলে, একচুয়ালিটি বা মূল বিষয়টি বুঝতে হবে, সেই সাথে বুঝতে হবে পোটেনশিয়ালিটি বা সম্ভাব্যতা। এ্যারিস্টটলের মেটাফিজিক্স, প্রাণীর পুনরুৎপাদন যা বিশেষত মানব শিশুর জন্ম নিয়ে আলোচিত হয়। তিনি দেখেন একজন মহিলা, কনসিভ করলে মায়ের ‘মাসিক’ বন্ধ হয়ে যায়। আবার, একজন মহিলা কনসিভ করছেন না সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স ব্যতীত। তাই তার ধারণা হয়, পুরুষ সিমেন্স ছাড়া একজন মহিলা কনসিভ করবেন না। মেটাফিজিক্স-এর সূত্র মতে, পুরুষ সিমেন হল একটিভ এজেন্ট বা সিমেনের মাঝেই প্রাণ আছে, এমনটি না বললেও তাঁর মতে ‘…That which imparts the motion and as the from” তাঁর মতে, মায়ের মাসিক রক্তের মাঝেই আছে মানবশিশুর আকৃতি প্রদানের সকল উপাদান বা Potence, সকল বিশেষ মূহর্তেও সিমেন pneuma–র সাথে যুক্ত হয়, তাঁর মতে, …in this way menstrual blood becomes alive whith vegetative soul on from the time of conception”
যখন সিমেন, মাসিক রক্তের সাথে মিশে যাচ্ছে, তখনই হচ্ছে Kunµπa (Kumia) সেটাকে অনুবাদ ‘embryo’ এরিস্টটলের মতে, The First motive of male and female”
উল্লেখ্য, তিনি এই সংমিশ্রণের তুলনা করেন নিংড়ানো দুঃখের সাথে, সিমেন এবং মাসিকের রক্ত মিশে থাকে ৭ দিন এবং জন্ম হয় embryo তিনি বীজের সাথেও তুলনা করেন। যে বীজ গাছে অঙ্গুকরণ করবে না যত্ন না মাটিতে রাখা হয়। মায়ের গর্ভেই; এখানে এরিস্টটলের মাটি। একটি নতুন জীবনের সূচনা হয় এই সাত দিনের মধ্যেই মায়ের ভেতর। সুতরাং, তাঁর মতে `The soul is the cause and first principle of living body’। উল্লেখ্য, তিনি আরও বলছেন, মায়ের মাসিকের রক্ত; যাকে মেটাফিজিক্সের ভাষায়, Actuality বলা হচ্ছে না কিন্তু Potency বা সম্ভাবনা। সিমেন এর সাথে সংমিশ্রনের পরও এটা কোনো প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে না ৭ দিন পর্যন্ত। সুতরাং সাত দিনের মধ্যে যদি এমব্রও-কে নষ্ট করা হয়, তবে সেটা Nutritive আত্মা পাচ্ছে না– ঠিক তেমনি চল্লিশ দিন পর্যন্ত।
প্রশ্ন হল, দুই হাজার বছর আগের ভাবনা যখন চিকিৎসা বিজ্ঞান, গবেষণায়, ক্লিনিক হাসপাতাল ছিল না, তখনকার এ ধারণা আজকের যুগে কতটা প্রযোজ্য। কিন্তু, সেটা ছিল নিছক জীববিজ্ঞান বিষয়ক তথ্যের অপ্রতুলতা। তাঁর দেওয়া মাটি ও কুমারের মডেলই যথেষ্ট যে সিমেনের মাঝেই pneums থাকে, যা Final comes ও process থাকে, যা এর মধ্যে দিয়ে নতুন জীবনের সত্তার হয়।
দার্শনিক ধর্মতাত্ত্বিক থমাস একুইনোর চিন্তা ভাবনাতেও প্রভাব রাখে। কিন্তু একুইনো মনে করেন, Sensitive Soul আগে থেকেই থাকে, তবে সিমেন ও মাসিক রক্তের সংমিশ্রনে তা ‘Actual’ হয়ে উঠে। আবার একুইনো বলেছেন যে, চল্লিশ দিন পর্যন্ত আত্মা পূর্ণতা পাচ্ছে না। আবার এরিস্টটলের জীব বৈজ্ঞানিক ধারণা বাতিল করেন উইলিয়াম হারভি, যিনি রাজা প্রথম চালর্সের এক হরিণের উপর গবেষণা করেন। ১৯১৬ সালে তাঁর Anetimical বক্তব্য বলেন, It is the Male is Whom residres the Formahave power, the achicve principle, The female in whom there mataral wherefore the first Principle of jemerokon besion in the male and perfected in the female– The Maker Seeks his maternal the heat of the heaven the earth bless.
টমাস ফেইনাস, ফ্লেমিশ চিকিৎসক ১৬২০ সালে দেখান, সিমেন মাত্র তিনদিন সময় নেয়। মাসিকের রক্তকে Rational Soul-এ রূপান্তরিত করতে। যেটা আগের ধারণা ৪০ দিন।
১৯৭০ সালে এসে ডনসিল দেখান, চল্লিশ সাত বা তিন দিনের হিসাব গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে কনসেপশনের সময় কি আমরা প্রাণ পাচ্ছি মায়ের শরীরে? একজন নতুন মানুষের? জোসেফ ডনসিল নিজেও একজন দার্শনিক ও নৃবিজ্ঞানী। থমাস একুইনোর মতো চিন্তা করলেও তাঁর নিজের অবস্থানকে এভাবে দেখা যায়–
জীববৈজ্ঞানিক তথ্যেও কমতি আছে, কিন্তু তাঁর [থমাস একুইনো] দার্শনিক অবস্থানকে এটা প্রভাবিত করে না। তিনি ভালো করেই জানেন প্রথম দিকের Embryo-তে পূর্ণাঙ্গ মানুষের অবয়ব থাকে না; তাই, এমতাবস্থায় Embryo-তে মানবাত্মা থাকার ধারণাকে বাদ দিতে পারি।
আমরা এতসব দার্শনিক কথাবার্তা শুনলাম, যার সাথে মায়েদের দুঃখ-কষ্ট ও নীতিশাস্ত্র জড়িত। আলোচনা থেকে আমরা কিছু প্রশ্ন নিয়ে আসতে পারি।
–গর্ভপাতের মাধ্যমে তাহলে কেবল মাংসপিণ্ড বা কিছু কোষ সরিয়ে ফেলছি না, বরং এটা আসলেই একটি প্রাণ; তাই নয় কি?
–গর্ভপাত আইনগতভাবে নিষিদ্ধ নাও হতে পারে; কিন্তু, নৈতিকভাবে কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
–জীববিজ্ঞান ও Embryology তে যে গ্রোথ তালিকা দেখা যায়, তা কি স্পষ্ট হয় না যে, গর্ভপাত একটা মানুষের মৃত্যু ঘটায়?
–যে সব মায়েরা অনিচ্ছকৃতভাবে গর্ভপাত করাচ্ছেন; এবং আক্ষেপ করছেন, তারা তাদের আপন সন্তানকেই হত্যা করছেন, সেই ধারণার কি কোনো দার্শনিক ভিত্তি নেই? কিংবা নৈতিক ব্যাখ্যা? নৈতিক ভিত্তি?
–নৈতিক অনুমতি আর লিগ্যাল অনুমতি কি একই বিষয়?
পয়েন্ট ধরে আলোচনা করার চাইতে আমরা উপসংহার অধ্যায়ে এগুলোর বিশ্লেষণ পাব। বরং আমরা এবার নৈতিকতা এথিকস এর অন্যান্য অনুষঙ্গ দেখার চেষ্টা করব।
নৈতিকতা কি ধর্মীয় রীতিভিত্তিক?
ধর্ম হল, বিশ্বাস ও বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা আচার অনুষ্ঠান। সুতরাং প্রত্যেকের বিশ্বাস অনুযায়ী আচার অনুষ্ঠান বা কাজকর্ম পালিত, চর্চিত হয়ে থাকে। আমার ধর্ম বিশ্বাস আর আরেকজনের ধর্ম বিশ্বাস যদি এক না হয়। তাহলে আমাদের দু’জনের আচার আচরণত পার্থক্য আসতে পারে। একই প্রশ্ন আমার আচার আচরণের ধর্ম বিশ্বাস যদি এক না হয়। তাহলে আমাদের দুজনের আচার আচরণের মাঝেই যদি নীতি, নৈতিকতা, ভার্চুস তথা গুণাবলির প্রকাশ পায়, তাহলে আমার নৈতিকতা আয় অন্যজনের নৈতিকতা ভিন্ন হতেই পারে। হবে। কারণ আমাদের বিশ্বাস ভিন্ন। সুতরাং নৈতিকতার ভিত্তি কি তাহলে ধর্ম? ধর্মীয় রীতিনীতি বা গাইড লাইনের ভিত্তিতে কি নৈতিক মানদণ্ড নির্মিত হয়, বা পরিচালিত হয়। যেমন– সৌদি আরবে হত্যার সাজা হত্যা। তাদের এটা কি নৈতিক? আর নৈতিকতার ভিত্তি হল ধর্ম। অন্যদিকে, নরওয়তে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ; কারণ একজনের জীবন হরণ করা হচ্ছে। সেটার ভিত্তি কিন্তু ধর্ম নয়, বরং সামাজিক নর্মস ও ভেল্যুজ। আবার ধর্মীয় বিশ্বাসে তারা অধিকাংশেই খ্রিস্টান। সুতরাং, ধর্ম যেমন নৈতিকতার ভিত্তি হতে পারে; নৈতিকতার আলোকপাতে আইন হতে পারে। তেমনি, সামাজিক কাঠামোর আলোকপাত এ নৈতিক মানদণ্ড পরিচালিত হতে পারে।
কাকজুর বলেন, যেহেতু আমরা একটি জীবনের জন্যে হুমকি হয়ে যাচ্ছি গর্ভপাতের জন্যে; সেহেতু প্রশ্নটা আমরা নৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা উচিত। এখানে ধর্ম বা আইনের মতামত নেওয়ার প্রয়োজীয়তা নেই। যদিও তিনি ছোট্টা করে জিজ্ঞাসা করেন, এখানে মায়ের কোনো সুবিধা আছে কি না?
পিটার সিংগারের মতামত হল “I Shall treat ethics as entirely independent of religion.” গর্ভপাতের বেলাতে যেমন আমরা ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে আইন করে গর্ভপাতকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। যদিও ধর্মীয় দৃষ্টিতে [বুদ্ধধর্ম] গর্ভপাত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আবার কেউ বলেন নীতি আর নৈতিক মানদণ্ড ধর্ম ব্যতীত হতে পারে না। প্রথাগতভাবে ধর্ম আর এথিকসের যোগসূত্র হল যে, ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হয় সঠিক বিষয়টি বাস্তবে চর্চা ও বিশ্বাস করার জন্যে। এখানে ধর্ম দিয়ে Reasioning করা হয়, এবং ব্যক্তির কাজকে বৈধতা দেওয়ার জন্যে এবং সেই সঠিক কাজের পুরস্কার আসবে পরকালে। ধর্মীয় বিশ্বাসকে মনে করেন, তারা ব্যতীত বাদবাকি সকলের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। কিন্তু সকল তাত্ত্বিক কিন্তু এমনটা মানতে রাজি না। যেমন, ইমানুয়াল কান্ট। ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত ধার্মিক খ্রিস্টান। তিনি নিজের বিবেবের কাছে জিজ্ঞাসিত হতেন; এবং পালন করতেন। কিন্তু আমাদের প্রত্যাহিক জীবনের কাজ কর্মে, চলনে বলনে আমরা কী পরকালের হিসাব করি? অবশ্যই করার প্রয়োজন হয় না; তেমনি জাহান্নাম আর জান্নাতের হিসাব করে কেউ সবাই এথিকাল শব্দটি ব্যবহার করে না।
আবার যদি নৈতিকতা, সম্পূর্ণ অর্থে স্রষ্টা হতে নির্ধারিত হয়ে আসে, তাহলে, শিম্পাঞ্জি, বেবুন যারা মানব জাতির কাছে মানুষ, তারা তো কোনো নৈতিক কোড মেনে চলছে না। তার মানে হল বিবর্তনের লম্বা পরিক্রমায় আমরা ভালো মন্দ, নৈতিক অনৈতিক এর কোডগুলো তৈরি করেছি। এর মাঝে কিছুটা আবার এসব শিম্পাঞ্জি, বেবুনদের মাঝে প্রবল লক্ষণীয়, যেমন— পারস্পরিক আদান প্রদান/ রিসিপ্রসিটি। অর্থাৎ, সোশ্যাল ম্যামাল যারা আছে, তাদের মাঝেও নৈতিক ব্যবহার দেখা যায়। মানুষ ভাষা প্রকাশের পর ধীরে ধীরে নৈতিক মানদণ্ড তৈরি করেছে। এবং একই সাথে যখন অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন বিবাহ, ধর্ম, অনাচার বা ইনসেন্ট ট্যাবু ইত্যাদি তৈরি করার মধ্য দিয়ে গর্ভপাত এবং গর্ভপাতকে সামাজিক সংজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসা হয়।
আর অবধারিতভাবে সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ধর্ম গর্ভকে সংজ্ঞায়ন করে দিয়েছে তার অনুসারীদের মাঝে। সংজ্ঞায়িত করে দিয়েছে বৈধ সন্তানের। মায়ের ভূমিকার। মায়ের সংজ্ঞার। মায়ের দায়িত্ব-কর্তব্যের। সন্তানকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন তার বাবার পরিচয়সহ; কারণ, উত্তরাধিকারের প্রশ্ন এখানে জড়িত।
খ্রিস্ট ধর্মের আলোকে গর্ভপাত
খ্রিস্ট ধর্মে, মূলত ক্যাথলিক ট্রাডিশনের অংশ দেখছি। এতে মাতৃগর্ভে মানব শিশুর জীবন সর্ম্পকে অনেক অনুচ্ছেদ বাইবেল সিরিজে আছে। কিন্তু সরাসরি বাইবেল গ্রন্থাবলিতে ‘গর্ভপাত’ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা নেই। কিন্তু, বাইবেল বর্ণিত জীবনের সূচনা, মানব শিশুর জন্ম এসবে এরিস্টটলের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
বইপত্র ঘাটলে দেখা যায়, ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত গর্ভপাত সংক্রান্ত সরাসরি কোনো নির্দেশনা ক্যাথলিক ধারাতে ছিল না। অফিসিয়ালি ক্যাথলিক চার্চ গর্ভপাত সম্পর্কে আলোকপাত করে তখন। এবং ক্যাথলিক ধারা শিক্ষা দেয় যে, গর্ভ হওয়ার মুহূর্ত থেকেই জীবনের সূত্রপাত। ক্যাথলিক চার্চ দাবি করে থাকে যে, আধুনিক জেনেটিক বিজ্ঞান তাদের সমর্থন করে। যদিও তাঁদের দাবিতে স্পষ্ট করা হয়নি, কখন ভ্রূণ-এর মাঝে প্রাণের সঞ্চার হয়। [যদিও আমার ধারণা, এটা বিজ্ঞানের কাজ]।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলতেই হয়, খ্রিস্টান ক্যাথলিক ধারায় গর্ভপাতকে প্রাণের হত্যার সাথে তুলনা করা হয়। ১৯৭৪ সালের `Declaration’ থেকে এটা স্পষ্ট বলা হচ্ছে যে, “যে মুহূর্ত থেকে ফার্টিলাইজেশন হল, সে মুহূর্ত জীবনের সূচনা। আর সে নতুন জীবনটা তার মা থেকেও নয়, এবং এটি নতুন জীবন Novi Viventis Human যার আছে স্বতন্ত্র প্রাণ, স্বতন্ত্র বেড়ে উঠা”। এই ডিক্লারেশনে আরও বলা হচ্ছে, এই নতুন জীবনের অপারেশন বা গর্ভপাত, কোনো অবস্থাতেই জীববিজ্ঞানের প্রশ্ন নয়; বরং প্রশ্নটা নৈতিকতার, দর্শনের। নৈতিক দৃষ্টি বিচারে এটা স্পষ্ট, যদি ভ্রূণের বিষয়ে কোনো সন্দেহও থাকে, তথাপি এটাকে সরিয়ে হত্যার দায়ভার নেওয়া যাবে না, এটা পাপাচার। The Man who will be a men is already here এবং পোপ দ্বিতীয় জন পল যখন মেলবোর্নে আসেন, প্রায় দেড় লক্ষ মানুষের সামনে বলেন, “…Nothing should be done which is against life in the realy of a concrte individual existence, no matter how underdeveped or how advanced.” সুতরাং, পোপের বক্তব্যতেই এটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার, খ্রিস্টান ক্যাথলিক ধারাতে, গর্ভপাত কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। যে কোনো বিচারে।
ইসলামের দৃষ্টিতে গর্ভপাত
পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সুরায় বিভিন্ন আয়াতে জীবন সম্পর্কে উল্লেখ আছে। যেমন, একটি তাৎপর্যপূর্ণ বাণী হল ‘মানুষ হত্যা করা গুরুতর পাপ’ (সুরা ৫:৩২) শেষ বিচারের দিনে সে সকল মাতা পিতাকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে, যারা তাদের সন্তানকে হত্যা করেছিল; এবং সেই সকল সন্তান তাদের পিতামাতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে (সুরা ৮১:৪-৯)।
শুধু তাই নয়, অর্থের অভাব, টাকাপয়সা এখনো জমানো হয়নি ইত্যাদি অজুহাতিদের জন্যে বলা হচ্ছে “তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না, আমিই তাদের খাবার দিয়ে থাকি; এবং তোমাদেরকে (সুরা ৬:১৫১)”। উল্লেখ্য, ইসলামে গর্ভপাত নিয়ে বলা হচ্ছে সরাসরি কোরআন ও হাদীস [মহানবী (সা.)-এর বাণী] নেই। এমনকি কোনো নির্দেশনা; যদিও এই বইয়ে ইসলামের (সুন্নী ধারার) বিভিন্ন মতামত আলোচনা করছেন। কিন্তু, এখানে গর্ভপাত বিষয়ে ইসলামের অন্যান্য উৎস ও দেখেছেন। যেমন : সমসাময়িক ফতোয়া, ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ। এবং শেষ অংশে মুসলিম অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশের গর্ভপাত সংক্রান্ত তথ্য ও দিচ্ছেন। আমি বিস্তৃত আলোচনায় যাচ্ছি না। ৪৭টি দেশের মধ্যে ১৮টি দেশে গর্ভপাত নিষিদ্ধ, যে কোনো গর্ভপাত অবস্থায়, যদি না মায়ের জীবন হুমকিতে থাকে। ১০টি দেশে গর্ভপাত অনুমতি সাপেক্ষ তবে অনরিকোয়েস্ট। আমার যেটা ফোকাস করার বিষয়, মুসলিম মেজোরিটি দেশ হওয়া স্বত্বেও এসব দেশের গর্ভপাত নীতিমালা এক নয়। যেমন, মিশর, সৌদি আরবে ‘ফতোয়া’ বা বিশেষ ব্যক্তির মতামত গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হয় যদিও এখানে মতামতের এত বেশি আধিক্য যে, কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠিত মতামত বের করে আনা প্রায় অসম্ভব। বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হওয়ায় আমরা আলাদা [৫ম] অধ্যায়ে এ বিষয় আলোচনা করছি।
হিন্দু ধর্ম মতে গর্ভপাত
গুগল স্কলার থেকে বেশ কিছু ভালো বই প্রবন্ধ গবেষণা কাজ পাওয়া যায়। হিন্দু ধর্মমতে গর্ভপাত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হিন্দু ধর্মে মনে করা হয় কেউ যদি গর্ভপাতের মাধ্যমে কোনো প্রাণ নষ্ট করে; তাহলে সেই প্রাণটি অন্য কোনো মায়ের গর্ভে যাবে। যদিও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ভারতে মেয়ে শিশু গর্ভপাত করার মাত্রা অনেক বেশি। ১৯৭৬ সালে ভারতে আইন করা হয়, গর্ভে থাকা শিশুর ‘জেন্ডার’ জানার কোনো পরীক্ষা করা যাবে না। ১৯৯৪ সালে সেই আইন আরও বিস্তৃত করা হয়, প্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক এমনকি কোনো ব্যক্তিও যদি মেয়ে শিশু গর্ভপাতে সহযোগিতা বা পরামর্শ দেন তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, এ পর্যন্ত যে তিনটি মতবাদ দেখা হল, সবখানেই গর্ভপাতকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এবং বলা যায়, নৈতিকতার ভিত্তি এখানে ধর্ম ও ধর্মই এসব তাত্ত্বিকদের পরামর্শ।
সুতরাং এথিকস কি সাবজেক্টিভ, বৈশ্বিক নাকি আপেক্ষিক?
নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, গনিত, চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি বড় প্রশ্ন, তাহলে এথিকস বা নৈতিকতা কী
—সাবজেক্টিভ বা ব্যক্তির বিবেকের সাথে যুক্ত?
—নাকি বৈশ্বিক, সকলের জন্যে একই নৈতিক মানদণ্ড?
—নাকি সমাজ ও সংস্কৃতি সাপেক্ষে এটা রিলেটিভ?
যদিও সাম্প্রতিক গবেষণাতে দেখা যায়, গর্ভপাত বিষয়ে অনেকেই ব্যক্তিক নৈতিকতার কথা বলেন। ব্যক্তি মানুষের আপন শৈশব, শিক্ষা, মেধা বুদ্ধির উপর ব্যক্তিক সাবজেকটিভিজম নির্ভর করে। আমরা বলতে পারব না গর্ভপাত খারাপ বা ভালো; বরং ব্যক্তির উপরই এটা নির্ভর করছে। দ্বিতীয়টা, এটার বিপরীত। যেমন ধর্মীয় বিচারে গর্ভপাত অনৈতিক। এটা বৈশ্বিক। এবং এই মতামত অনেকেই ব্যক্ত করেন। পিটার সিংগার মনে করেন, এথিকস ব্যক্তিক সাবজেকটিভ বা সাংস্কৃতিক নয় বরং বৈশ্বিক। মনে করা যাক, আমি যে সমাজে বাস করছি সেটার সাপেক্ষেই আমার নৈতিকতা গড়ে উঠবে। সিংগার মনে করেন, এটা এক দৃষ্টিতে ঠিক আছে; আবার অন্য বিচারে ঠিক নয়। যদি কোনো কাজের ফলাফল ভালো হয় তবে তা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। আবার, সেটি ব্যক্তিক জাজমেন্টকে ভেল্যু করে; সুতরাং এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু, নৈতিকতার বৈশ্বিক মতবাদ আবার গ্রহণযোগ্য যদি সেটা শ্রেণি বৈষম্যমূলক না হয়।
নাকি নৈতিকতা সামাজিক ও সাস্কৃতিকভাবে আপেক্ষিক; এ প্রশ্ন বড় হয়ে আসে নৃবিজ্ঞানীদের কাছে। সমাজ ও সংস্কৃতির মাঝেই মোরাল জাজমেন্ট নিহিত থাকে। একজন রিলেটিভিস্ট মনে করেন না যে, গর্ভপাত খারাপ বা ভালো বরং সমাজের মাঝেই এর উত্তর খুঁজে নেন। কিন্তু, এখানেও প্রশ্ন, সমাজের সকল কি কোনো একটি বিশেষ ইস্যুতে একটি নৈতিক অবস্থান নিতে পারবে? যেমন— গর্ভপাত। বাংলাদেশের সকল মানুষ কি একই অবস্থানে আসতে পারবে? নৈতিকতার মানদণ্ড আপেক্ষিক, একটি বৃত্তে অংশ অন্তত তাই মনে করেন। এক্ষেত্রে ফ্রেডরিক নীৎসে-কে মনে পড়ে। নীৎসে বলেন ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’ ভিন্ন মানুষ ভিন্নভাবে দেখে থাকে।
‘ভালো’-‘খারাপ’-এর সংজ্ঞাও তাঁদের কাছে ভিন্ন। সমাজ থেকে এই ধারণা তৈরি হয়ে থাকে। ম্যাককিনন ও ফিয়ালা মনে করেন এটা হল সবল আপেক্ষিকতা। যা একজন ব্যক্তির ভালো মন্দের জাজমেন্ট, তার সমাজের চোখে একই।
নীৎসের ধারণার ভিত্তি হল পারসপেক্টিভিজম, অর্থাৎ দুনিয়াতে বা সমাজে একটাই পারসপেক্টিভ আছে, এবং এই পারসপেক্টিভ এর আলোকেই বিচার করতে হবে। তাঁর মতে, মোরাল জাজমেন্ট বা নৈতিক বিচার বা বিবেক প্রতিফলিত হয় ক্ষমতার সম্পর্কের ভিত্তিতে ও মৌলিক চাহিদার উপর। যেমন, যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের মাঝে একটা সহজাত প্রবৃত্তি কাজ করে যে, তারা ‘ভালো’ কাজই করে যাচ্ছেন। ও এই ধারণায় ভিত্তি হচ্ছে—তারা মনে করেন, তারা “সুপিরিয়র”। নীৎসে ব্যখ্যা করেন এভাবে, সাধারণ মানুষের চাহিদা ও তাদের কাজের ‘দোষ’ ‘গুণ’ বিচার সাপেক্ষেই এই কাজকে সামাজিক নর্মস হিসাবে গ্রহণ করা যায়। প্রত্যেকটা চাহিদাই ক্ষমতার আওতায় আসে, ক্ষমতার বা ক্ষমতাসীনদের কাজের ভালোমন্দ বিচার না করে সমাজে চালু করা কোনো প্রাকটিস ‘নর্মস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে না। আপেক্ষিকতার বা রিলেটিভ নৈতিকতার এই সংস্করণ আসলেই কঠিন; মূল্যায়ন করতে বা সমালোচনা করতে। কারণ, নীৎসের এই ধারণায় সাংস্কৃতিক বিভাজনকে দেখাচ্ছেন আলাদা করে। অন্য কথায়, ক্ষমতাবানদের কাজ সমাজে নর্মস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে; যদি সেটা সমাজের চাহিদার সাথে সংগতিশীল হয়। তাই আমরা বলতে পারি, গর্ভপাত সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা সমাজের কাছে নর্মস হিসাবে গৃহীত হবে, যদি কোনো পলিসি মেকার জনসাধারণের মতামতের ভিত্তিতে তা গ্রহণ করেন। যদিও নীৎসে গণতন্ত্রকে মানতেন না।
আপেক্ষিক নীতিমালা বা মরালিটির আরেকটা সংস্করণ হল দুর্বল রিলেটিভিটি। পৃথিবীতে বিমূর্ত ও মৌলিক কিছু নর্মস, ভেল্যুস আছে যদি পুরো পৃথিবীতেই চর্চিত হয়, তবে সমাজ ও সংস্কৃতিতে একটু ভিন্নতা আসে যেমন ‘জীবনকে ভেল্যু বা মূল্যায়ন করা উচিত’ এটা ইউনিভার্সেল। ‘জীবন’ বা ‘জীবনের মূল্য’ সমাজভেদে ভিন্ন হয়। হতে পারে এটা মানুষের জীবন কিংবা পশুপাখির জীবন। বা কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক আচার, যেখানে প্রাণী হত্যা করা হয়। এটাকে আবার ক্যাপাবিলিটি এপ্রোচও বলা হয়। যা দিয়ে আমরা ‘নৈতিকতা’ ও ‘সামাজিক কল্যাণ’ বিবেচনা করতে পারি। মার্থার মতে, মানবজীবনে কতিপয় মৌলিক বা কেন্দ্রীয় ক্যাপাবিলিটিস আছে যা বাস্তবিক বিচারে সমাজে চর্চিত হতে পারে। তবে তিনি একই সাথে আইনগত বৈধতা আর আইনি বিষয়ের কথা বলছেন যা কিনা ক্যাপাবিলিটিকে বাস্তবায়িত করে। ব্যক্তির রুচি, স্থানিক অবস্থান প্রথা বা রীতিনীতি এক্ষেত্রে বিবেচ্য। আর তাঁর শেষ কথা হল বৈশ্বিক একটি স্বীকৃত নর্ম দরকার, যদি আমরা ডাইভারসিটি, বহুত্ববাদিতা আর ব্যক্তি স্বাধীনতাকে মূল্যায়ন করতে চাই। তাঁর কথা হল “…each human being as an agent and an end.” কিন্তু সমালোচনার চোখে বলা হয়, গর্ভপাত বিষয়ে কোনো ইউনিভার্সেল বা সর্বজনীন নৈতিক দিকনির্দেশনা যেহেতু নেই; সেহেতু নৈতিকতার এই তত্ত্ব গ্রহণ করা অবাস্তব।
সুতরাং, নৈতিকতার তত্ত্বে আমরা দেখি, আমাদের আপেক্ষিক, বিশেষ করে ‘জোরাল আপেক্ষিকতা’ যেটা নীৎসে বলেন সেটিই অনুসরণ করা প্রয়োজন। কারণ, জন স্টুয়ার্ড মিলের Greater Happiness নীতিমালা, আর ইমানুয়াল কান্টের Categorical impartive যা সমাজের কাস্টম রীতিনীতিকেই মনে করিয়ে দেয়, যার সাপেক্ষে আপেক্ষিকতার এথিকসকে গ্রহণ করা যায়। একই কথা প্রযোজ্য জন ডাউই ও নীৎসের বেলায়। রাজনৈতিক বিবেচনায় নীৎসে যেখানে গণতন্ত্রবিরোধী; ডাউই প্রচণ্ড গণতান্ত্রিক। কিন্তু, নৈতিকতার প্রশ্নে দুজনই আপেক্ষিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে। সাম্প্রতিককালেও মাইকেল ওয়ালজার যিনি Spaheres of Justice বই দিয়ে প্রচুর খ্যাতি পান, তাঁর আরেকটি গ্রন্থ, যেখানে নৈতিকতায় বহুত্বে মানে রিলেটিভিটিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাঁর Thick or Thin বইতে দেখান যে, কোনো সমাজের নৈতিক বিষয় বা কোনো প্রতিষ্ঠানের রীতিনীতি কেবলই ট্রান্সকালচারাল মরাল বা বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের ভিত্তিতে দেখলে চলবে না, বরং সমাজে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত একটি মানদণ্ড আছে, থাকে Thick set of Customs বলছেন। এবং একটি শরীরের বড় বড় অঙ্গ প্রতঙ্গের জোড়ার মাঝে যে রকম ছোট ছোট প্রতঙ্গগুলো থাকে, তেমনি Thick set-এর মাঝেও Thin set থাকে। সুতরাং, প্রত্যেকটি সমাজে আপেক্ষিক; আপেক্ষিক সমাজের নৈতিকতার মাঝেই গর্ভপাত সংক্রান্ত নৈতিক মানদণ্ড পরিচালিত হয়। হবে। আবারও নীৎসে, যেখানে ওয়ালজার বলছেন সমাজের ভেল্যুস শেয়ার করা হবে, সেখানে কীভাবে নৈতিকতার বহুত্বে একটি ঐকমত্য তৈরি হবে। নীৎসে-তে গিয়ে বলব যে, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ চাহিদা পূরণ হযে সেটিই হবে নর্মস বা ভেল্যুস।
গবেষণায় নৈতিকতা : ফোকাস ও উদ্দেশ্য
আমরা আগেই বলেছি, সংকলনটি গবেষণার। এই সংকলন সাহিত্যের উপাদান। আমরা অদ্ভুত আঁধারের গল্প নিয়ে যে গবেষণাটি করেছি এটা কেবলই শোনা বা পাওয়া গল্প নয়। এটি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গর্ভপাতকে দেখা; বৈশ্বিক আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে গর্ভপাতকে বিশ্লেষণ করা; এবং সাম্প্রতিক নৈতিকতার তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে গল্পগুলো জানানো, বোঝানো। গল্পগুলোর ভেতরে থাকা যেমন রাজনীতি দেখেছি তেমনি দেখেছি নির্যাতনের রাহাজানি। দেখেছি একজন মা একদিকে হয়ে উঠেন এজেন্ট ক্ষমতার আবার হয়ে আসেন এন্ড বা সমাপ্তি; ক্ষমতা প্রদর্শনের, চর্চার, ধারণের কিন্তু শেষ হয় না মায়ের দুঃখের। তাই মায়েদের অদ্ভুত আধাঁরের গল্পে Glocal (Global-Local) গ্রামের শহরের ও কসমোপলিটান বিনিদ্র নগরীর।
—আমাদের কাজে যেসব দেখার চেষ্টা করছি তা হল—
ফোকাস
—গর্ভপাদের সিদ্ধান্দ কে নিচ্ছেন? কেন?
—গর্ভপাতের পর নিজের অনুভূতি কেমন?
—গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত না নিলে কি হত?
—গর্ভপাত এর পরবর্তী সময় কেমন?
—এটা গোপন রাখেন কেন?
—কারা কীভাবে সহযোগিতা করছেন?
কাজের উদ্দেশ্যবলি
মোটাদাগে আমরা দেখছি কীভাবে গর্ভপাত করানো মায়েরা সময়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে চলেন ও কেনইবা এটার প্রয়োজন ছিল। একই সাতে গর্ভপাতের সাথে পলিটিক্স ও এর প্র্যাকটিস যার মাধ্যমে সমাজে একজন মা কলঙ্কিনী হয়ে উঠেছেন।
বিশাল এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে ছোট ছোট কিছু উদ্দেশ্যও ছিল।, যেমন—
- গর্ভপাত সংক্রান্ত এথিকস ও মরালিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।
- প্রাপ্ত গল্পগুলোর বিশ্লেষণ যাতে দেখা যায় বাংলাদেশের গল্পগুলোর অবস্থান ও বৈশ্বিক পুঁজিবাদের সাথে এগুলোর সংযোজন।
- গর্ভপাত সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন বিয়ে, ধর্ম, পরিবার, হাসপাতাল-ক্লিনিক এসবের ভূমিকায় ব্যাখ্যা।
- মায়েদের বিভিন্ন মাত্রার সম্পর্কের ব্যাখ্যা, রাষ্ট্র, সমাজ, রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, ধর্মীয় নীতিমালার।
ফলাফল ও প্রয়োজনীয়তা
আমরা আশা করেছি এই কাজের ফলাফল এথিকস অধ্যয়নের তত্ত্বে; এবং একই সাথে সামাজিক বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে একটু হলেও অবদান রাখছে। বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের সমাজে নৃবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কাজটি ডিসকোর্স এনালাইসিসের প্যারাডাইমে নতুন মাত্রা যোগ করছে। গর্ভপাত প্রশ্নে বিতর্ক দেশে-বিদেশে চলমান, এই চলমান বিতর্কে মায়েদের দুঃখগাথার বিবরণ ও এর ব্যাখ্যা আমাদের নতুন করে ভাববার জায়গা দিচ্ছে। মহিলাদের ক্ষমতায়ন মহিলাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গাকে আমরা একেবারেই ভিন্ন জায়গা থেকে দেখছি; যখন বাংলাদেশে গর্ভপাত নিয়ে ডিসকোর্স এনালাইসিসের কোনো কাজ নেই আমাদের জ্ঞান মতে। আমরা কিছু পলিসি সুপারিশ করছি; যদিও আমরা খুব ভালো করেই জানি, পথপ্রদর্শক হিসেবে আছেন অন্ধ সর্বাধিনায়ক। পুরুষতন্ত্রে, ধনতন্ত্রে, জনতন্ত্রে। আমাদের কাছে আসা এসব গীতল বক্তব্য আমরা জানি পরবর্তী গবেষকদের পথ দেখাবে; দিন বদলাবে। আমি জানি, এই দিন দিন নয়…।
এবং সর্বশেষ আমরা বাংলায় লিখছি সাধারণ পাঠক দেখতে পাবেন। বোঝেন। এটার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও এর গভীরতা।
গল্পগুলোর সংগ্রহের পথ ও সেগুলো ব্যবস্থাপনা
গল্পসংগ্রহে আমরা তিনটি গাইড লাইন থিম গ্রহণ করেছি—
১. গর্ভপাত সংক্রান্ত অদ্যাবধি যে সব নৈতিক ও ঐহ্যিকাল দৃষ্টিভঙ্গি আছে সেগুলোর ব্যাখ্যার জন্য অবশ্যই সেকেন্ডারি ডেটার আশ্রয়।
২. মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় গবেষণার জন্য আমাদের মাথায় রাখতে হয়েছে, এখানে যেহেতু ধর্ম একটি ক্রিয়াশীল অনুষঙ্গ সেহেতু এ সংক্রান্ত বইপত্র। ঠিক তেমনি হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের মতামত জানতে আমরা সেকেন্ডারি তথ্যের সাহায্য নিয়েছি।
৩. মায়ের অভিজ্ঞতার কথা আমরা সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে নিয়েছি এটা একই সাথে ছিলো পর্যবেক্ষণমূলক ও ইনডেপ্থ। এছাড়াও অনলাইন মারফত মায়েরা তথ্য দিয়েছেন; তাদের অভিজ্ঞতা লিখেছেন। এমনকি টেলিফোনেও তাঁদের আমরা প্রশ্ন করে তথ্য নিয়েছি সমান্তরালভাবে, ডাক্তার, নার্স, পরিবার সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের সাথে কথা বলে তথ্য পেয়েছি।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ ছিল সম্পূর্ণ অনানুষ্ঠানিক; খোলা চেকলিস্টভিত্তিক, ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইন্টারভ্যুগুলো কয়েক দফায় নিতে হয়েছে। মায়েদের আবেগী উচ্চারণ, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, সময়স্বল্পতা মূল কারণ ছিল। যেহেতু তথ্য সংগ্রহের কৌশল হিসেবে আমরা ক্রিটিক্যাল ডিসকোর্স এনালাইসিস ব্যবহার করেছি; সেহেতু ক্রিটিক্যাল ন্যারিটিভের আশ্রয় নিতে হয়েছে। বর্ণনায়, ব্যাখ্যায়, দেখতে ও দেখাতে। ন্যারিটিভ বর্ণনায় আমরা মূল নাম ব্যবহার করিনি। বরং ছদ্মনাম ব্যবহার করেছি আদ্যোন্ত।
ন্যারিটিভ বর্ণনায়, ও ব্যাক্যায় একটি প্রশ্ন এসে যায়, তা হল গল্পগুলো কতটুকু ‘সত্য’। কারণ, গল্পগুলোতে আছে মায়েদের অভিজ্ঞতা, যাতনা, অনুভূতি, সংগ্রাম। এক্ষেত্রে আমি ধার করছি, মাওরী গবেষক Linda Smith-এর একটি উক্তিকে। স্মিথ বলেন “একজন গবেষক তাঁর এলাকার বা গবেষিত মানুষদের সংগ্রাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে, হতে পারে সে সংগ্রাম তার সংস্কৃতিক বা তার ভালো থাকার।” এভাবেই, সবার বক্তব্য আমরা রেকর্ড করেছি; অনুলিখন করেছি ও কোডফাই করে ব্যাখ্যার জন্যে ব্যবহার করেছি।
এথনোগ্রাফিক কাজে, নিঃসন্দেহের ডেটা ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; যেটাকে কখনোবা Data Cycle Plan বলা হয়ে থাকে। সাইকেলটা হল সিলেকশন, প্রিজারভেশন, মেইনটেইনেন্স, কালেকশন ও আর্কাইভিং।
আইনি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমরা প্রত্যেকের কাছ থেকে স্বেচ্ছায় দেওয়া অনুমতিপত্র নিয়েছি; প্রত্যেকেই স্বেচ্ছায় এখানে সাক্ষাৎকার দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যেহেতু কাজটি অস্ট্রেলিয়ার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আর্থিক সহযোগিতা করেছে আংশিক সেহেতু, গবেষণার তথ্য বিষয়ে তাদের কোনো গাইডলাইন নেই। আর এজন্যে Authorship-এর বেলাতেও অন্য কারও কর্তৃক নেই।
অন্যদিকে কেবল সংরক্ষণের জন্যে Australian Development Dialouge (ADD)-এর আর্কাইভে ডিজিটাল কপি ও বাঁধাই কপি রাখা আছে। গবেষণাতে ADD-এর সাথে চুক্তিবদ্ধ অর্থ মাঠকর্মের জন্যে ব্যয় হয়েছে; যার হিসাব তাদের দেওয়া হয়েছে। প্রকাশনার মালিকানা আমার ব্যক্তিগত ও কপিরাইটও। Open Anthropoogy Coooperetive (OAC), Academia.com-এ কপি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সকল পাবলিক ও কিছু সংখ্যক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও দেওয়া।
তথ্য ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা
সাক্ষাৎকার গ্রহণে বিশাল ডেটা আসে। এমনকি অনলাইনে প্রায় দুইশত’র অধিক মায়ের গল্প আমরা পাই। তথ্য আসে হাজারো সেকেন্ডারি উৎস থেকে। সুতরাং, আমাকে সম্ভাব্য রিস্ক/ ঝুঁকির কথা ভাবতে হয়েছে। আবার একই সাথে স্পর্শকাতরতায় বিষয়টিও। ব্যক্তিগত কম্পিউটার, মোভেবল ডিস্ক, পেন ড্রাইভ ল্যাপটপ সবগুলো পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখা দরকার ছিল। হার্ডকপিসমূহ নিরাপদ লকারে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। ADD-এর প্রধান নির্বাহী ও আমার কাছে চাবি রেখেছিলাম নিরাপত্তার স্বার্থে। মায়েদের প্রাইভেসি ও কাজের গুরুত্বের জন্য আমার এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনো পথও ছিল না।
নৃবৈজ্ঞানিক নৈতিক নির্দেশনা : তথ্য উন্মোচনে ও বলাতে
কাজটা বাংলাদেশের মায়েদের নিয়ে; সুতরাং আমরা চেষ্টা করেছিলাম; বাংলাদেশে নৃবৈজ্ঞানিক কাজের কোনো প্রাকটিক্যাল গাইডলাইন পাই কি না। পাইনি; এবং পাওয়ার কোনো সঙ্গত কারণও দেখি না। আবার, যেহেতু এই কাজটার আংশিক ডোনার অস্ট্রেলিয়ার, সেহেতু আমাকে Australian Anthropological Association-কে অনুসরণ করতে হচ্ছে। একই সাথে Association Social Anthropoligists in UK and Commonwealth (ASA) ও AAA কর্তৃক দেওয়া গাইডলাইন দেখেছি। কিছু পয়েন্ট যা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল; আমরা এখানে তুলে দিলাম— (৪৬)
- গবেষণার ফলাফল সহকর্মী ও গবেষণার অন্যান্য সহযোগীর সাথে শেয়ার করা।
- প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশনা, মতামত-যা কিছু সম্ভব, যে দেশে কাজ করা হয়; সেখানে সহজলভ্য করে দেওয়া; সম্ভব হলে সেই ভাষায়।
- অংশগ্রহণকারীদের ক্ষয়ক্ষতি বা হুমকি বা কোনো ধরনের ঝুঁকির বিষয়টি একজন গবেষকের সতর্ক থাকা। এমনকি, যারা কাজে সহযোগিতা করেন, তাদের থেকেও যেন অংশবিশেষ বা পূর্ণাঙ্গ তথ্য কোনো কারণে কারও হুমকির কারণ না হয়।
—আমরা সহকর্মীদের সাথে শেয়ার করেছি; মতামত আর মূল্যায়ন সাদরে গ্রহণ করেছি। বাংলায় মূল কাজটি করেছি মূলত যারা সময় দিয়েছেন তাঁদের মাথায় রেখে ও সহজলভ্যতার কথা, যেটা ডিসকোর্স এনালাইসের অন্যতম পদ্ধতি; আমরা ইন্টারনেট দিয়েছি। এমনকি; এথিকসের ভাবনা চিন্তা করে; মূল ড্রাফটের কপি আমাদের কাছে বলা মায়েদের পড়তে দিয়েছি; যাতে তাঁরা জানেন ও বুঝতে পারেন, তারা কেবল অংশগ্রহণকারী নয়; তারা পাঠকও। যাদের কাছে আমরা গিয়েছিলাম কথা বলার জন্য; সেটা মোটই সহজ ছিল না। প্রথমে সিলেটের একটি সংস্থার প্রধানের সাথে কথা বলেছিলাম; তিনি চেক লিস্টকে কেটে ছোট করতে করতে বাঘকে বিড়ালে রূপ দান করলেন। শুধু তাই নয়, তার ব্যবসার সুনাম যাবে বিধায় এই কাজের অন্যতম সহযোগী অধ্যাপক সঞ্জয় বিশ্বাসকে হাইকোর্ট দেখিয়ে দিলেন— বড় কর্তার অনুমতি; হেড অফিসের জবাবদিহি ইত্যাদি আর প্রভৃতি। সুতরাং সশরীরে তথ্য পাওয়ার পথ আমাদের মোটেই সুখকর ছিল না। তবু আমরা যোগ্যতার একটা মাপকাঠি তৈরি করেছিলাম।
—অফিসের ম্যানেজার বা বড়কর্তা
—যারা বাংলাদেশের নাগরিক
—যারা আগে কোনো সাক্ষাৎকারের মুখোমুখি হননি
—যারা বাংলাদেশে বসবাস করেন
—যাদের বয়স ১৮+
—যারা স্বেচ্ছায় অনুমতি ফর্মে স্বাক্ষর করবেন।
আমরা মনে প্রাণে চাইছিলাম যেন একটা পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করি। যারা আগে কাজ করেছেন; বা কোনো গবেষকের মুখোমুখি হয়েছেন; তারা হয়ত সাক্ষাৎকারে মনোযোগ হারাবেন বা ভীতশ্রদ্ধ হয় পড়বেন বলে এসব আমাদের ‘ইনক্লুশন’ বৈশিষ্ট্যের সাথে রাখি। ও সমান্তরালভাবে কিছু ‘এক্সক্লুশন’ বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন—
- যারা অনুমতিপত্র পড়তে বা স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন।
- অসুস্থতাজনিত কারণে যারা অংশগ্রহণ করতে পারেননি কিংবা আমাদের মনে হয়েছে ‘স্বাধীনভাবে’ চিন্তা বা কথা বলার মতন সুস্থতা নেই;
প্রথাগতভাবে আমরা কোনো স্যামপ্লিং করিনি; কারণ এথনোগ্রাফিক কাজে আদতেই স্যামপ্লিং এর কোনো স্থান নেই বরং একটি নন স্যামপ্লিং দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করেছি, নেটওয়ার্ক ও স্লো বোলিং-এর মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী মায়েদের বাছাই করেছি। এবং এই নন-স্যামপ্লিং দৃষ্টিভঙ্গিতেই অনেক ভালো কাজ হয়েছে।
গল্প সংগ্রাহকদের ঝুঁকি ও ব্যবস্থাপনা
ক্রিটিক্যাল ন্যারিটিভ পদ্ধতিতে কাজ করতে গিয়ে, একটি সমস্যার কথা বলা হয়, যখন অংশগ্রহণকারীরা ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ-কষ্ট মাঠকর্মীদের সাথে শেয়ার করেন। এবং এক্ষেত্রে আমরা আগেই বলেছি, আমাদের পক্ষে তথাকথিত Objective থাকা আদৌ সম্ভবপর ছিল না বরং আমরা রিফলেক্সিভ ছিলাম। শুধু তাই নয়, আরও একটি এথিক্যাল প্রশ্ন জড়িত ছিল যে, মায়েদের গল্পগুলো স্পর্শকাতর, গোপনীয়, যা পরিবারের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ জানলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এবং ছদ্মনাম ছাড়া এগুলো প্রকাশিত হলে অংশগ্রহণকারীদের সমস্যা হতে পারে।
গবেষিত এলাকা বা সম্প্রদায়ের প্রতি সম্মান দেখানো, তাদের ভেল্যুসকে মূল্যায়ন করা, আরও একটি এথিক্যাল ইস্যু- Respect for Communities, সোজাসাপ্টা এমনটা বলেই দেন উইজার। মাওরী গবেষক এবং লেজেন্ডরী অধ্যাপক, লিন্ডা স্মিথ যোগ করেন এটি একটি বিশেষ অনুভূতি, মানুষের কষ্ট শেয়ার করা, দুঃখ বর্ণনার কথা শোনা, বসে বসে। এমন একটি অবস্থানে স্মিথ বলেন, একদিকে আবেগী আলাপ, অন্যদিকে বাক স্বাধীনতার বিষয়; সুতরাং বিশেষ একটি আন্তরিক অনুভূতি না থাকলে ওমন পরিস্থিতিতে কাজ করা সম্ভব হয় না। এ কথা মাথায় রেখে আমরা কতিপয় উদ্যোগ নিয়েছিলাম—
- মাঠে যারা কাজ করেছিলেন তাদের বারবার এসব বিষয় আমরা মনে করিয়ে দিয়েছি।
- সাক্ষাৎকার এমনভাবে নেওয়া হয় যাতে কোনো ক্রমেই তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি ছিল না। [একটি ব্যতীত]
- অংশগ্রহণকারী মায়েদের তথ্যের সম্পূর্ণ গোপনীয়তা এমনকি তাদের পরিচিতিও আমরা প্রকাশ করিনি।
এছাড়াও উত্তরদাতা মায়েদের বাইরে যারা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাঁদের বেলাতেও আমরা একই নীতিমালা অনুসরণ করেছি।
- বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আমরা আরও দু’টো মডেল ব্যবহার করেছি— ‘ব্রিকলজ’ এবং বন্ধুত্ব’। উদ্দেশ্য ছিল এখানে ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা করা এবং পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
- Bricoleage এটা মূলত একটি ফরাসি শব্দ; নৃবিজ্ঞানের কাজে মূলত একটা মডেল হিসেবেই এখন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মাঠকর্মীদের অন্যতম হাতিয়ার। মাঠে অহেতকু সমস্যা সমাধানে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আপন কৌশল ব্যবহার করাকেই ব্রিকলজ বলা হয়।
- “বন্ধুত্ব” এটি নিছক শব্দের মানে নয়। কেন বন্ধুত্ব প্রয়োজন ছিল; এটা একজন মাঠকর্মীকে, একজন এথনোগ্রাফারকে তার এথিক্যাল অবস্থান তৈরি করতে সাহায্য করে। কেয়ার, সলিডরিটি, কম্যুনিটি, মিউচুয়ালিটি, বিষয়ের সিভিক ট্রান্সফরমেশন, গবেষণার আগে ও পরে “বন্ধুত্ব”র সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করে কারণ, …Strict ‘objectivity’ can not be achieved by means of discourse analysis…
এক্ষেত্রে করিণ গেলস্-এর একটা কথা মনে পড়ছে; তিনি বলেন একটি বিশ্বস্ত ও এথিক্যাল গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য থাকা উচিত সলিডারিটি বা সহমর্মিতা। একজন মা বলেছিলেন, “ভাই আপনি যদি সত্যিই আমার কথা শুনতে চান; তাহলে বসুন, কথা বলি।” অনেক মা-ই প্রায় একই কথা শুনিয়েছেন। যেমনটি শুনে ছিলেন কানাডিয়ান আদিবাসী গবেষক; একজন আদিবাসীর মুখে—
If you want research us, you can go home. If you have come to accompany us; if you think our struggle is your struggle, we have plenty of things to talk.
যে সব মা গল্প বলেছেন; সময় দিয়েছেন; তারা ভালো করেই অবগত ছিলেন, এখানে তাঁদের কোনো ধরনের কোনো প্রকার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। এবং আমরাও নিশ্চিত করেছি, আমরা আপনার দুঃখ-যাত্রার সহযাত্রী।
আরও একটি নৈতিক ইস্যু, কাজ শেষ করার পর অর্থাৎ মাঠকর্ম শেষ করার পর যারা কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের ক্ষমতা, তাদের সত্যাসত্য জ্ঞান, এবং নৈতিকতা কি এসব মায়ের গল্পের সংকলনে, ব্যাখ্যায় কীভাবে প্রভাব রেখেছে?
আদৌ কি সেটা রিফ্লেক্সিভ ছিল? গবেষণায় এই পর্যায় আমাদের কাছে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। এমনকি, আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগেই চিন্তা করেছি, Row-Data বা সাক্ষাৎকারগুলো হুবহু তুলে দিই সেক্ষেত্রে হয়তবা খরচ বাড়বে; কিন্তু ম্যালিপুলেশন হওয়ার শঙ্কা থাকবে না। ‘মাঠকর্ম’ এখানে (সাক্ষাৎকার) পরবর্তী সময়ের ক্ষমতা, সত্য, এবং নৈতিকতা নিয়ে দার্শনিক ও নৃবিজ্ঞানীরা কথা বলেন এমনকি নীতিতাত্ত্বিকেরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। নৃবিজ্ঞানীরা মূলত “ইনফরমড কনসেন্ট”-কে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। কিন্তু সমসাময়িক ধারাতে বিশেষ করে ডেনজিন লিংকন, স্মিথেরা বলেন, যাদের নিয়ে কাজ হল; তাদের একটি এডভান্ড ড্রাফট কপি দেখালে ভালো হয়। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও বিশ্বস্ততার স্বার্থে আমরা মূল কপি লেখার আগে প্রত্যেককে পড়তে দিয়েছি।
গল্প সংগ্রাহকদের ঝুঁকি ও ব্যবস্থাপনা
আমাদের কাজটাকে আরও বেশি বিশ্বস্ত, আরও একটু মানসম্মত ও আরও একটু এথিক্যালি সাউন্ডফুল করতে গিয়ে যারা মাঠে কাজ করেছেন তাদের ঝুঁকির কথা ও চিন্তা করেছি এবং সে অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনিরাপদ যানবাহন, স্যানিটেশন, বাসস্থান, তাপমাত্রা এগুলো মোকাবেলা করতে হয়েছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভায়োলেন্ট বা থ্রেটিং ব্যবহার হতে পারে কিনা সেটিও আমরা চিন্তা করেছিলাম। আবার চিন্তা করেছিলাম যারা মাঠে আছেন, তারা যদি নিজেকে ‘নিরাপদ’ না ভাবেন; কিংবা ক্লান্ত বোধ করেন; সে ক্ষেত্রে তারা কাজ করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে আমরা “Community Gatekeeeper” মডেল ব্যবহার করেছি যাতে অন্তত আইনি জটিলতায় পড়তে হয় না।
সাক্ষাৎকারের সময় ও স্থান নির্বাচন করতে হয়েছে উভয়ের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। যেহেতু সাক্ষাৎকার ছিল লম্বা সময়ের, সেহেতু আমরা প্রত্যেক মায়ের ক্ষেত্রে দুই বা তিনটি সেশনে ভাগ করে নিয়েছিলাম, যাতে কারও উপর ক্লান্তি ভর না করে। সাক্ষাৎকারকালীন পর্যাপ্ত ও নিরাপদ খাবারের বন্দোবস্ত করতে হয়েছিল।
তথ্য মালিকানা ও প্রকাশ ও CDA’র নির্দেশনা
তথ্য মালিকানা, গবেষণা কাজের অন্যতম একটি ইস্যু। এটা যেমন নৈতিকতার, তেমনি বাস্তবতার। ইন্টেলেকটুয়াল প্রপার্টি অধিকার, তথ্য মালিকানা, পেউন্ট অধিকার, তথ্য শেয়ারিং নানাভাবে এথনোগ্রাফিক কাজে আলোচিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা Vencuber Protocol অনুসরণ করেছি। যদি ভবিষ্যতে কোনো অপব্যাখ্যা মিসকনডাক্ট ও বিভ্রান্তির উদ্রেক হয়; আমরা আলোচনা সাপেক্ষে তা দূর করব। এবং আমরা বিশ্বাস করি ‘খোলাখুলি কথাবার্তা’র যেটাকে এথিকসে বরা হয় Openness’ আমরা CDA-র আলোকে ইন্টারনেটে ছেড়েছি; যাতে কোনো ধরনের বিভ্রান্তির উদ্রেক না হয়।
উপসংহার : CDA-র বিড়ালটা বেড়ায় বসে থাকে
CDA-তে একটা সমালোচনা করা হয় যে, CDA সামাজিক গবেষণা আর রাজনৈতিক বিতর্কের মাঝখানটার বেড়ার উপর সারাদিন বলে থাকে। আমরা এখানে একদিকে দেখেছি নীতি বিজ্ঞানের কথা, বিশ্লেষণ, গর্ভপাত সংক্রান্ত নীতি বা মরাল প্রশ্নগুলো। নীতি, এথিকস বা মরালিটির তত্ত্বের অদৃশ্য বিতর্কে বাংলাদেশের মায়েদের কথা বা গল্প আর অভিজ্ঞতার সাথে মূর্ত সেতু বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ক্ষুধিত পাষাণের মতো কোনো কোনো তত্ত্ব বলছে, গর্ভপাত আইনগতভাবে জায়েজ। এটা তো আর মানবশিশু নয়। কেউবা লিখছেন আইন আর নৈতিক ভিত্তি এক নয়। কিন্তু, প্রার্থনার মতো ঠায় বসে থাকা মায়েদের কষ্ট আর বেদনা এতসব নীতিমালা জানে না। আর তাই, আমাদের ইন্দ্রিয় সহযোগিতায় দেখার, শোনার একই সাথে দেখানোর ও শোনানোর চেষ্টা করছি এখানে কী সব নৈতিক প্রশ্ন জড়িত আছে। একজনার নৈতিকতার সাপেক্ষে অন্যান্যাদের নৈতিক মানদণ্ডের পার্থক্য কেন হয়; কীভাবে হয়।
আজনবি বিষণ্নতা আমাদের পায়নি, হলফ করে বলছি না; কিন্তু, জানি একটি এথিক্যাল, রিফ্লেক্সিভ ও প্রো-একটিভ কাজের জন্যে আমাদের দাঁড়াতে হবেই। সম্ভাব্য সকল ঝুঁকি মাথায় রেখেই আমাদের নৈতিকতা ঠিক রাখার চেষ্টা করেছি। আমরা আরও মনে করি, এই কাজটা আমাদের পয়েন্ট অব ডিপারচার; আমরা ছেড়ে দিচ্ছি; কিন্তু, কেউ নতুন পয়েন্ট অব এরাই ভালো ধরবেন। নৈতিক পয়েন্ট অব ভিউ থেকে গর্ভপাত ভালো কি মন্দ কিংবা আইনিভাবে বৈধ না অবৈধ, সে প্রশ্নের আগেও যেটা ঠিক করতে হবে যে, কনসিভ করার সাথে সাথে কি মায়ের গর্ভে নতুন জীবন চলে আসে? নতুন আত্মা? নতুন একটি সত্তা? নাকি কেবলই মাংসপিণ্ড আর কতিপয় কোষ? আমি ব্যক্তিগত মূল্যায়ন বা মতামত প্রকাশ করব শেষ অধ্যায়ের শেষ অংশে। যেহেতু আমরা রিফ্লেক্সিভ ভিউ থেকে কাজটি করে আসছি; সেহেতু আমি মনে করি; একজন শ্রোতা হিসেবে; পাঠক হিসেবে, নৃবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার মতামত দেওয়ার জায়গা আছে। এবং এথিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকেও, আমার মরাল জায়গা থেকে সবিনয়েই একটা মতামত দিতে পারি।
স্মিথ নামের মাওরী দার্শনিক নৃবিজ্ঞানী লিখতে পারেন, আবার হাত উঠিয়ে আন্দোলনও করতে পারেন। CDA’র বিড়ালটাও সারাক্ষণ দেখতে পারে— এই চলমান, বহমান প্রক্রিয়ায় আমি তো কেবল জানালার খিড়কি খুলে সবাইকে দেখাতে পারি; আমার শরীর, চোখটা কোন জানালায় তাও তো সবাইকে জানানো প্রয়োজন। মানবিকতা বোধের জায়গায় নয়; সংযমী সাহিত্যের জায়গায় নয়; বরং কাইফ আজমীর মতো বা জানানা গুসমাও বা পাবলো নেরুদার মতো আমি চাইছিলাম, কলমের সুপারিশ না হয়ে উঠুক ব্যক্তিগত সুপারিশ। আর সেই সুপারিশকে বিশ্বস্ত করতে, অথেনটিক করতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি; নৈতিকতায়; পদ্ধতিতে ও সংকলনে, ব্যাখ্যায়, প্রকাশে ও সকল পদক্ষেপে। বিজ্ঞদের পরামর্শ, কাজের নমুনা ও ধরন সাহস জুগিয়েছে, পথ দেখিয়েছে। আমরা যখন কাজ শুরু করি, দুটো সংস্থা তথ্য দিতে টালবাহানা করে; সহকর্মীরা বলছেন অত্যন্ত স্পর্শকতার। তখন মনে হয়েছিল; গন্তব্য আমাদের বহুদূর। কিন্তু কোথাও যেন বিশ্বাস ছিল এত দূর তো নয় যে, পথ হারিয়ে ফেলব!
আমরা পথ হারাইনি। রাতের আন্ধার শেষে পুবালী আকাশে ধলপহর উঠেছে। আমরা আলোয় আলোয় হেঁটেছিনু সাড়ে চার বছরের দীর্ঘ দূরের মেঠোপথ।
কলঙ্কিনী রাধা
অধ্যায় ৪
“এখন তো কথা বলার সময়”
রবার্ট ফ্রস্ট
কলঙ্কিনী রাধা
—চিরস্থির দৃশ্যপট (?)
—কলঙ্কের সূত্রগুলোকে বানাল
—গর্ভপাত ও চারপাশের দেশ
—গর্ভপাত ও নারীদের ধারণা
—গর্ভপাত কলক আর সামাজিক ভাষা
—ডিসকোর্স চিন্তাভাবনা সমাজ তেমুখের মডেল
—কাজ ও টেক্সটভিত্তিক মডেল; সামাজিক ইন্টারএকশনের মাঝে টেক্সট বা মায়েদের গল্পগুলো
—দেখার পদ্ধতি
—একটি তুলনামূলক আলোকপাত
প্রতিবাদ হিসাবে লেখা
ক্যাথারসিস, অভিজ্ঞতার সম্মিলন
কলঙ্কিনী রাধা : মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার
চিরস্থির দৃশ্যপট
একজন মায়ের স্টিগামাটাইজ্ড বা কলঙ্কিনী হওয়ার দায় তাঁর কাছে নয়; সমাজকাঠামো থেকেই আরোপিত। বাংলাদেশের মতো সমাজে গর্ভপাত করানো হচ্ছে। এবং সমাজকাঠামোই গর্ভপাতের কলঙ্ককে মারজিনালাইজড করে দিচ্ছে। কারও কারও মতে মায়েরা কলঙ্কিনী হচ্ছেন। একই সমান্তরালে। এই প্রক্রিয়ায় যে সব ডাক্তার, নার্স, পেশাজীবী আছেন, তারাও কলঙ্ক বোধ করেন! হ’তে পারেন। আমাদের ফোকাস সেটি নয় এখানে।
গর্ভপাত করানোর ফলে, বা কনসিভ করার কারণ/ ফলে যেহেতু মায়েদের ক্ষেত্রে একটা প্রেক্ষাপট চলে আসে এবং গর্ভপাত স্টিগমা চিহ্নিত হয় কীভাবে, সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক বিজ্ঞানে, সাহিত্যে নেই, যেহেতু আমরা আরভিং গফম্যান স্মরণ করছি। সামাজিক বা ব্যক্তিগতভাবে যখন কোনো পরিচয় কারও সাথে নেতিবাচকভাবে যুক্ত হয়, আমরা বলি কলঙ্ক। মানসিক ভারসাম্যহীনতা বা ‘পাগল’ চিহ্নিত করতেও কিন্তু গফম্যানের এই সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়। ক্যানসার, যক্ষ্মাসহ অনেক রোগীদের সমাজে ‘কলঙ্কিত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যাই হোক, গফম্যানের চোখে কলঙ্ক হয়ে উঠে চরম অবমাননাকর, সমাজের চোখ এবং সেটা যে দৃশ্যমান হতেই হবে তা কিন্তু নয়। আমাদের কাছে বলা গল্পগুলোতে যদি গফম্যানের সাথে বিচার করি, দেখব চারটি নীতি বা সূত্র আছে কলঙ্কিত হওয়ার।
কলঙ্কের সূত্রগুলো কে বানাল
গর্ভপাত করানো মায়েদের কলঙ্কিত হওয়ার সূত্রগুলো—
ক. কলঙ্কগুলো মায়েদের সমাজ থেকে আলাদা একটা ‘লেভেল’ বা ‘মার্কা’ দিয়ে রাখে
খ. মার্কাগুলো মায়েদের নেতিবাচক গুণাবলির মধ্যে ফেলে দেয়।
গ. মার্কাগুলো সমাজে মায়েদের এবং সমাজের মাঝে ‘আমরা’ ও ‘তাহারা’ হিসাবে সীমারেখা তৈরি করে।
ঘ. ‘নেতিবাচক’ বা ‘খারাপ’ গুণাবলির মায়েরা মনে করেন সমাজে তাঁদের প্রাপ্য সম্মান নষ্ট হচ্ছে যার ফলে তৈরি হচ্ছে অসমতার বীজ। কলঙ্কিত হওয়ার ফলে মায়েদের মনে তৈরি হচ্ছে একধরনের হীনম্মন্যতা, লজ্জাবোধ।
আর একজন অসহায় মা পুরো সমাজের কাছে হচ্ছেন কলঙ্কিনী। কারণ, বাংলাদেশের সমাজে ‘গর্ভপাত’ করোনোকে দেখাই হচ্ছে নেতিবাচক, অবমাননাকর ও তাচ্ছিল্যের সাথে। স্বভাবত সেই সব মা হয়ে পড়ছেন একাকী। লজ্জিত, কলঙ্কিত। আর এখানেই দেখা যায়, একজন মা তার ভূমিকাকে [বাচ্চা জন্মদান, লালন পালন] পালন করতে পারলেন না, যা আমাদের সমাজে তার কাছে কিংবা সমাজ কর্তৃক আরোপিত ‘মায়ের দায়িত্ব’।
উল্লেখ্য, গফম্যানের সূত্র ধরে আমরা আরও একটু পেছনে তাকালে দেখি ’৫০-এর দশকে ‘ডার্টি ওয়ার্ক’ মতবাদ নামে একটি ধারণা, যেখানে শারীরিক, সামাজিক বা নৈতিক অবমূল্যায়ন জড়িত। এবং ইদানীং ‘ডার্টি ওয়ার্ক’-এর গতিপ্রকৃতি নিয়ে অনেকেই গর্ভপাতের সাথে মিল খুঁজে পান। যেমন, গর্ভপাতের শারিরীক অবমূল্যায়ন হল মায়েরা ভাবছেন আর সংসার করতে পারবে না একই সাথে শারীরিক সমস্যা গর্ভপাতের। সামাজিকভাবে মায়েরা চিহ্নিত হচ্ছেন এক বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত হিসেবে; যা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব রাখে।
নৈতিকভাবে তাঁরা হয়ে যান দুর্বল। আমরা সাক্ষাৎকারে দেখেছি তারা কতটুকু হীনম্মন্যতার মাঝে জীবনযাপন করছেন। এমনকি অনেকেই স্বাভাবিক পারিবারিক সম্পর্ক রাখতে পারছেন না।
যুগপৎ, আরও একটা বিষয় হল গর্ভপাতের পর, কিংবা অযাচিত গর্ভে পর অনেকেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এমনকি সেটা ডাক্তার, নার্স, বা অন্যান্য স্টাফদের বেলাতে প্রযোজ্য। বিজ্ঞানীদের মতে, গর্ভপাতজনিত স্টিগমা আর ভায়োলেন্স বা নির্যাতন সম্পূরক। যেমন, অনেক মা আমাদের জানাচ্ছেন যে, স্বামীর মানসিক নির্যাতন, কিংবা শারীরিক, সহ্য করতে না পেরে ডিভোর্সের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
সামাজিক হেনস্তার আরও একটি জায়গা হচ্ছে ক্লিনিক বা হাসপাতাল। যেখানে মায়েরা গর্ভপাত করাতে যাচ্ছেন। হাসপাতাল, ক্লিনিক। ভাবছে যে, এরা পাপী, সুতরাং তাদের প্রত্যাশিত কোনো ভালো ব্যবহার করা যাবে না। যে সত্য আমরা প্রত্যেক মায়েদের কথায়, বর্ণনায় পেয়েছি।
আবারো, মায়েদের এই কলঙ্কতিলক কেবল স্বামী বা সঙ্গীদের দ্বারা নয়, এর সাথে পুরো সমাজকাঠামো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যার ফলে একজন গর্ভপাত করানো মায়ের ধারে-কাছে কেউ আসতে চায় না। একথা মায়েরা জানেন বলেই তারা সর্ব্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায় রাখেন। আর তাই, বলা হয় কলঙ্ককে দেখা হয় ছোঁয়াচে বা সংক্রামক হিসেবে।
অন্যদিকে, হাসপাতাল বা ক্লিনিক, যেহেতু, সমাজের ভেতরে থাকা মেডিক্যাল রেগুলেটরি শক্তি বা নিয়ামক; মায়েদের ‘অন্যচোখে’ দেখবেই ও দেখছে। অনেক ডাক্তার-নার্স জানালেন, তারা নিজেদের কলঙ্কিত হিসেবে দেখেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা চাকরি ছেড়েই দিচ্ছেন। যদিও কোনো কোনো গবেষণাতে দেখা যায়, ডাক্তার বা নার্সরা গর্ববোধই করছেন কাজটি করতে। বিপরীতে, এইসব ডাক্তার, নার্সরা যখন তাদের সমমনাদের সাথে থাকেন, তারা নিজেদের হেয় করে দেখেন।
সামাজিক বিজ্ঞানসহ নৃবিজ্ঞানের গর্ভপাত নিয়ে কিছু কাজ আছে; যাতে দেখা যায় গর্ভপাতের মানে সময় ও স্থানভেদে বদলে যায়। পাবলিক হেলথ-এ গর্ভপাত নিয়ে ভালো কিছু গবেষণা দেখা যায়, আবার সামাজিক বিজ্ঞানে বিশেষত; সমাজকর্ম, দর্শন এসব এন্টি-গর্ভপাত বিষয়ে সোচ্চার। গর্ভপাত মানেই একজন মানুষের মৃত্যু, একটি প্রাণের মৃত্যু। আমরা এথিকস অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি।
গর্ভ মানেই তো একটি জীবনের সূচনা। প্রাণের শুরু। ভ্রূণটি মানবশিশুর আকার নেবে। সেটি আবার প্রসবান্তে নাম পাবে। সুতরাং, এটি কি একটি প্রাণ হত্যা? বাংলাদেশের আইন কী বলেছে। নীতিবিষয়ক অধ্যায়ের বিষয়বস্তু বলে এখানে আর আলোচিত হল না। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে স্টিগমার প্রক্রিয়া শুরু হয় সমাজ থেকে, সমাজের মূল্যবোধ থেকে। যদিও নৃবিজ্ঞানের অনেক কাজেই গর্ভপাতে নারীর একান্ত অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখা হয়। আফ্রিকার ক্যামেরুন-এ একটি ব্যতিক্রমধর্মী পর্যবেক্ষণ দেখা যায় সেখানে গর্ভপাত নিয়ে কোনো ধরনের হীনম্মন্যতা নেই, ‘অন্য চোখ’ দিয়ে কেউ দেখে না। এমনকি মায়েরা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে গর্ভপাত করাচ্ছেন— যেখানে কোনো স্টিগামা বা কলঙ্কের বালাই নেই। আফ্রিকার জাম্বিয়াতে দেখা যায়; আইনে গর্ভপাত অনুমোদিত; কিন্তু অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবার ফলে মায়েরা নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগেন; ফলে সমাজে তাদের স্টিগামার চোখেই দেখা যায়। মনে করা হয় মায়েরা সংক্রামক রোগী। থাইল্যান্ডে, সীমিত পরিসরে গর্ভপাত অনুমোদিত বটে, তবে আইনের বাইরে কেউ গর্ভপাত করালে সংশ্লিষ্ট মা ও ডাক্তারকে আইনের ভিতর নিয়ে আসা হয়। থাইল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলে গর্ভপাতকে রিজনেবল মনে করা হয়; আবার বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বিশেষ বিবেচনায় অনুমোদন করে। ও গর্ভপাতকে স্টিগমা করা হয় কিনা সে বিষয়ে পরিষ্কার কোনো মতামত নেই। বৌদ্ধ ধর্মীয় দেশ ভিয়েতনামের চেহারা ভিন্ন। সমাজতন্ত্রের পতাকায় এসে পুরো জাতিকে বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলার জন্য গর্ভপাতকে জাতীয় আইনের আওতায় আনা হয়। একদিকে ধর্মীয় মূল্যবোধের পারিবারিক নর্মস ভেল্যুস আর অন্যদিকে গর্ভপাত করোনোর সকল সহজ বন্দোবস্ত। এই দোটানার মাঝে মায়েরা নিজেকে কলঙ্কিত মনে করেন। মনে করেন, এটা পাপাচার আর অনৈতিক; ফলে কোনো মা গর্ভপাত করানোর পরও গোপনীয়তা রাখেন।
সাহিত্যভিত্তিক একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ অস্ট্রেলিয়াতে দেখা যায়; সেখানে স্টিগমা আর তাচ্ছিল্যের বালাই। আমি নিজে কয়েকজন সমাজকর্মীর সাথে কাজ করছি ও আলাপকালে জানালেন এটা ঠিক নয়। ও পরিবারে বা সমাজে ‘ভালো চোখে’ দেখা যায় না। স্কেনডিনিভিয়ান সমাজে যেখানে গর্ভপাতের আইন অনেক শিথিল, সেখানেও গর্ভপাত করানো মায়ের ‘ইমেজ’ পরিবার, স্বজনের চোখে কলঙ্কিত।
গর্ভপাত ও আমাদের দেশ
আমাদের একেবারেই গায়ে লাগা দেশগুলোর অবস্থা একটু দেখি। গত দুই দশকে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশে গর্ভপাত নিয়ে কিছু কাজ দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোতে আমাদের কাছে এসেছে। স্বামী বা একজন মায়ের গর্ভপাত করানোর প্রক্রিয়ায়।
নেপালের ২৪ বছর বয়েসী মায়েদের দুই তৃতীয়াংশের তিনটি বাচ্চা আছে ও সেখানে ধর্মীয় বিধি নিষেধ থাকার জন্যে গর্ভপাতও কম হয়। কিন্তু, বাল্যবিবাহের হার বেশি। এবং সাম্প্রতিক কাল অবধি নেপালে গর্ভপাত নিষেধ ছিল। (হাল তথ্য আমাদের হাতে নেই বলেই একটু পেছনের তথ্য/ কাজ আমরা গ্রহণ করছি। এবং যেহেতু আমরা সরাসরি কোনো পলিসিতে কাজ করছি না সেহেতু গ্রহণ করতে বাধা দেখি না)। ভারতের অবস্থান একটু ভিন্ন। সেখানে গর্ভপাত করানো হয় মূলত মেয়ে শিশু হলে। এবং এটা ভারতে ইদানীং কালের আইন যে, গর্ভকালীন সন্তানদের লিঙ্গীয় বিষয় জানা যাবে না এবং সেখানে ধর্মীয় বিধি নিষেধ থাকার জন্যে গর্ভপাতও কম হয়। কিন্তু বাল্যবিবাহের হার বেশি। ভারতে আরও দেখা যায়, যুবতী মায়েরা স্বামী ও শাশুড়ির চাপেই গর্ভপাত করান। অবিবাহিতদের বেলায়, নিজের আত্মসম্মান বাঁচানোই মূল কারণ।
বাংলাদেশে গর্ভপাত নিয়ে যে সীমিত সংখ্যক কাজ আছে, সেখানে স্বামীই মূল সিদ্ধান্তদাতা। পাশাপাশি ইরফরমালভাবে বন্ধু, প্রতিবেশী, মা স্বাস্থ্যসেবায় কর্মকর্তাগণ সাহায্য করে থাকেন।
উপরোক্ত কাজগুলোতে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত, প্রক্রিয়া ইত্যাদি ওঠে আসছে। প্রাইমারি ডাটার ভিত্তিতে কাজগুলো করা। কিন্তু আবার দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে মায়েরা যে স্টিগমাটাইজ কলঙ্কিত/ কলঙ্কিনী), সেটাও প্রায় পরিষ্কার।
দেশ, মহাদেশের উদাহরণগুলো প্রাসঙ্গিক। এখানে একটা বিষয় প্রমাণিত করার জন্যে আর তা হল গর্ভপাত স্টিগমা একক সমাজের নয়, বৈশ্বিতার মাঝেই এটা বিদ্যমান। সমাজেই এটার উৎপাদন। পূনরুৎপাদন ও চর্চিত। কর্ষিত। সুতরাং আমরা গর্ভপাত কলঙ্ককে এভাবে সজ্ঞায়িত করতে পারি যে,
গর্ভপাত কলঙ্ক মায়েদের উপর আরোপিত একটা নেতিবাচক ও অচ্ছিলপূর্ণ মূল্যবোধ, যে মূল্যবোধের মাঝে প্রোত্থিত আছে ঘৃণা, উপহাস আর অবদমন।
গর্ভপাত ও নারীত্বের ধারণা
যেহেতু কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সংজ্ঞা নেই, সেহেতু সংজ্ঞাটিকে আপাতত আমরা সামনে রাখছি না। সংগৃহীত গল্পগুলোকে ভালোভাবে বুঝতে, ব্যাখ্যা করতে। এবং ভালোভাবে জানাতে। আমাদের জানা অভিজ্ঞতার গল্পগুলো যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব তথকথিত ‘নারীত্বের’ সাথে এই সংজ্ঞা ভালোই বিরোধপূর্ণ। আরেকটু খোলাসা করেই বলছি—
১. নারীদের যৌনতা কেবলই ‘স্বীকৃত’ সন্তান জন্মদানের জন্য।
২. মাতৃত্বের অধিকার মায়ের একার নয়।
৩. কনসিভ বা গর্ভধারণ করলেই ‘মা’ হওয়া যাবে না।
৪. সামাজিক ভেল্যুস-এর কাছে মায়ের ব্যক্তিগত কোনো মতামত থাকে না। মায়ের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি সমাজে মূল্যহীন।
‘স্বীকৃত’ সন্তান ছাড়া সমাজে নারীর সন্তান জন্মদানের কোনো জায়গা নেই। ‘বিবাহ’ নামক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার এখানে গুরুত্ববাহী। অপরিহার্য। ‘বিবাহ’ ছাড়া গর্ভধারণ, সন্তান, মায়ের জন্য স্টিগমা। বাংলাদেশের সমাজে আমরা এমনটাই দেখি। এবং একজন অবিবাহিত ‘মেয়ে’ ঘনিষ্ঠ কাউকে ‘মিথ্যা’ স্বামী বানিয়ে ক্লিনিকে গিয়ে গর্ভপাত করাচ্ছেন। আমাদের সমাজের প্রভাব এতটাই বেশি যে, একজন ‘মা’ একা একা গিয়ে গর্ভপাত করাবেন— সে জায়গাটুকুও নেই। কোনো কোনো ডাক্তার বলছেন, কেউ আসলে এবং আমাদের বললে আমরা ফিরিয়ে দিই না। কিন্তু বেড়ে উঠার সময়ে একজন মা যেমন করে দেখেছেন বাংলাদেশের সমাজ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ব্যবস্থা তাঁর ‘কনসিভড’ এবং গর্ভপাত করাতে এসেছেন।
মাতৃত্বের অধিকার মায়ের একার হয় না। অভিজ্ঞতাগুলোর মূল্যায়নে আমরা এমন সিদ্ধান্ত নিতেই পারি। বিবাহিত মায়েদের কথাগুলোতে আমরা দেখছি; মা তাঁর উদরস্ত সন্তানের/ মাতৃত্বের সিদ্ধান্ত একা নিতে পারচ্ছেন না, বরং স্বামীর অনুমতির/ সম্মতির অপেক্ষায় ছিলেন। যদি কোনো কারণে স্বামীকে ‘রাজি’ করানো যায় সন্তানটা রাখবেন। মাতৃত্বের উপর তাঁর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন। একজন মাও আমরা পাইনি, যিনি আপন সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করে গর্ভপাত করাননি। সমাজের চোখে ‘কলঙ্কিত’ হয়ে থাকেন, ‘ডিভোর্সি’ হবেন ইত্যাদি আশঙ্কায় গর্ভপাত রাজি হয়েছেন। আবার, গর্ভপাত করানোর পর নিজের কাছে নিজেই হয়ে উঠছেন একজন ‘অপরাধী’, ‘খুনী’, ‘সন্তান হত্যাকারী’। যেমন একজন মা বলেছেন ‘দু’ধারী তলোয়ার’। উপমাটি বেশ তাৎপর্যবহুল। সন্তান রাখলে হবেন ‘ডিভোর্সি’, ‘আশ্রয়হীন’; আবার সন্তান হারিয়ে নিজেই এখন নিজের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামি। গর্ভধারণ মানেই ‘মা’ হওয়া নয়। বিয়ে করেছেন। স্বামী সঙ্গমেই সন্তান ধারণ করেছেন। তথাপি, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মায়ের ভূমিকায় আসতে চাইলে নানা রকম হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন। এবং এখানেই আমাদের সমাজব্যবস্থা দেখিয়ে দিচ্ছে, একজন ‘মা’ কতটুকু অসহায় এবং ভালনারেবল। আরোপিত সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার ফলে হতে হচ্ছে ‘কলঙ্কিত’ বিভিন্ন গবেষণাতে দেখা যায়, নিজেকে এতটাই অপরাধী ভাবেন, তারা নিজেকে আত্মহননের পথে নিয়ে যেতেও দ্বিধা করেন না। গর্ভপাতের পর মায়েদের কাছে জীবনের মানেটাই বদলে যায়। হারিয়ে ফেলেন নৈতিক মনোবল।
একজন ব্যক্তি ‘মা’য়ের মতামত হারিয়ে যায় সমাজের প্রতিষ্ঠিত নর্মস, ভেল্যুস-এর কাছে। মেডিক্যাল, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক যে সব চালিকাশক্তি আছে, মায়ের মতামত সেখানে হয় যায় একেবারেই গৌণ। যেমনটি বলেন মিশেল ফুকো— সমাজ পরিচালনায় যে সব বিষয় এখানে প্রয়োজন তার সবটাতেই সামাজিক মূল্যবোধ প্রভাবক। আবার এই প্রতিষ্ঠানসমূহ একই সাথে মূল্যবোধগুলোকে চর্চা করে ও জিইয়ে রাখে। জিইয়ে রাখে প্রজনন সংক্রান্ত সকল নীতিমালা। বড় বড় দালান বাড়ি হয়, কয়েক হালি লেনের রাজপথ হয়; মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বদলায় না একজন মায়ের মতামত প্রতিষ্ঠিত করার পথ। যেন মায়েরা সমাজের মূল্যবোধের মাঝেই রেজিমেন্টেট হয় আছেন।
একই সাথে একজন মায়ের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি-আবেগ এই সমাজে মূল্যহীন। গর্ভপাত করানো মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে নিজের ‘মা’ও আসেন না অথচ সদ্যপ্রসূত সন্তানের মৃত্যুতে ‘মা’ ছুটে যান সেই মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে। এমনকি মেয়ে জামাইকেও। আমাদের চোখে এসব দৃষ্ট হয়ে আসে, গর্ভপাত করানো ‘মেয়ে’ একজন কলঙ্কিনী তাঁকে আর সান্ত্বনার কীইবা আছে। কিংবা এটা তো আর কোনো সন্তান বা বাচ্চা নয়। অথচ একজন মা সেই সন্তাটাকেই নিয়ে কত রাত জেগে স্বপ্ন দেখেছেন। আর তাই, একজন সন্তান হারানো সান্ত্বনা খুঁজে পান তাঁর মৃত সন্তানের মিলনে, মৃত্যুর পর। যেটি সিগমান্ড ফ্রয়েড শত বছর আগে দেখিয়েছেন। এবং নিজেকে রিকভার করার এ প্রক্রিয়াকে ইদানীংকালে ইতিবাচক বলেই মনে করা হয়। কিন্তু গর্ভপাত কলঙ্কের দায় যদি কেবল সামাজিক মূল্যবোধের উপর চাপিয়ে দিই তাহলেই কি আমাদের পর্যবেক্ষণ শেষ হয়ে যাচ্ছে? এই প্রশ্ন আমাকে অন্য এক দিগন্তে নিয়ে যায়।
বরং সাক্ষাৎকার আরোহিত অভিজ্ঞতাগুলোকে একটু ভিন্ন চোখে দেখি, তবে এসবের অন্য একটা দিক উঠে আসবে। আর তা হল একজন মায়ের সীমিত ক্ষমতা। সীমিত সম্পদ। সীমাবদ্ধতা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সীমাবদ্ধতা, সমাজের রেসোর্স ও রিসিপ্রসিটিতে।
আবার, অনেকে হয়ত বলতেন, অনেকেরই একসেস আছে। কিন্তু, প্রশ্ন হলে সেটা কি স্বামী ও স্ত্রীর সমান। পুরুষ ও নারীর কি সমান একসেস। পাবলিক ও প্রাইভেট বিভাজন কি আমরা দূর করতে পেরেছি আদৌ? যেটা হয়ে আছে শাশ্বত বাংলার সংস্কৃতি হয়। এখনো হাজার বছরের বাঙালির সংস্কৃতির সাথে ‘পরিবার’ মাতৃত্ব ‘যৌনতা’ বা ‘যৌন আচরণ’ বলতে যা মনে করা হত সেটার কি আদতে কোনো পরিবর্তন হয়েছে? এখানেই কাজ করছে ‘পাওয়ার ডাইনামিকস’। এখানেই একজন নারী সরকারপ্রধান হয়ে উঠেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এজেন্ট। এখানে দুটোই পড়া জরুরি। এবং এই আমাদের সমাজে অহরহ হয়, চোখে যায় অমন ‘উন্নতি’ তো হচ্ছেই। খালি চোখে গণনা যায় না গগন-ছোঁয়া দালান-বাড়ির মাঝেই আমরা পাচ্ছি উন্নতির স্বাদ। কেউ কিন্তু ভাবছি না, আমাদের মানসিকতাটা কি একটু উন্নতি হচ্ছে? আমি জানি, সুশিক্ষিত অধ্যাপক সাহেবের স্ত্রী যেমন ‘স্বাধীনতা’ ভোগ করছেন; তেমন ‘স্বাধীনতা’ পাচ্ছেন একজন ঘাম ঝরানো মজুরের স্ত্রী। অমিলটা কই? দালানে বাস করা ‘মা’ যেমন চিন্তিত সমাজের ‘অন্য চোখ’ নিয়ে; তেমন চিন্তাগ্রস্ত কমলাপুর বস্তির কিশোরী মায়ের। এটাই কি সাংস্কৃতিক ব্যবধান? একই সমান্তরালে, আমরা দেখব, কীভাবে ডিসকোর্স এনালাইসিসের মাধ্যমে গর্ভপাত কলঙ্ক বা স্টিগমাকে ব্যাখ্যা করা যায়।
গর্ভপাত, কলঙ্ক আর সামাজিক ভাষা
আমাদের বাংলাদেশের সমাজে কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন মাকে এই অবস্থায় যেতে হয়, দেখব ডিসকোর্স এনালাইসিসের মাধ্যমে। ‘ক্রিটিকাল ডিসকোর্স এনালাইসিস’— CDA আসলে কোনো স্কুল বা মতবাদ নয়; বরং একটি মনোভাব; যে মনোভাবের আলোকে কোনো সামাজিক সমস্যাকে চিহ্নিত করা যাবে, বিশেষ করে, ক্ষমতার উৎপাদন, পুনরুৎপাদন, নির্যাতন, ডমিনেশন ইত্যাদি ডিসকোর্সগুলোর ভূমিকা কি হবে। সেটাই হল CDA. সিডিএ, যেখানে CDA’র বেশ কয়েকটি ফরম্যাট আছে। কয়েকটি ফর্ম নিয়ে আলোচনা করে দেখার প্রয়াসী হব, গর্ভপাত কলঙ্ককে আমরা বাংলাদেশের সমাজে কীভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি।
ডিসকোর্স, চিন্তাভাবনা ও সমাজ : তেমুখের মডেল
এই তেমুখ মডেলে গর্ভপাত কলঙ্ককে আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি। যেটা আবার ভিন্নতরভাবে এসেছে আরভিং গফম্যানের ‘স্টিগমা’ হতে। ওখানে সামাজিকভাবে নির্মিত, চর্চিত ও পুনরুৎপাদিত হতেই দেখা যায়। এবং সেখানে সামাজিক অসমতা বা প্রভাব বিস্তারক কোনো বিষয় নেই।
এবং সিডিএ আমাদের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয় উঠে, কারণ; এখানে আমরা দেখছি মায়েদের অনুভুতি, মায়েদের শারীরিক ভাষা, মৌখিক ভাষা, চোখের চাহনি। যা মনে হচ্ছে সিডিএ-র আলোকে আরও একটু অন্যভাবে দেখা যেতে পারে।
আমাদের কাছে আসা গল্পগুলোতে দেখি, একজন মা, একজন ডাক্তার, একটি ক্লিনিক, একজন স্বামী, এবং বাংলাদেশের সমাজে একটিভ। পুঁজিবাদী সমাজের কাঠামোতে গড়ে উঠা বাংলাদেশের সমাজে একটি ক্লিনিক তার লাভ-লোকসানের হিসাব দেখাবেই। এবং সে ক্ষেত্রে যদি জবাবদিহির প্রশ্ন না থাকে বা কম থাকে, তাহলে সেটার সুযোগ আরও বেশি। একজন ‘মা’ কিংবা ‘অনুগত স্ত্রী’র সংজ্ঞা দেখার প্রয়োজন নেই। যখন মায়েরা বলেন স্বামীর সংসারে থাকতে হবে বলেই গর্ভপাত করানো। কিংবা বাবা আমাকে মেরে ফেললে কোথায় আশ্রয় নেব। এতসব বিষয়; এতসব চিন্তা চলে আসছে একজন মায়ের, মেয়ের মনে। এবং এই চিন্তার গড়ন গাড়ন শুরু হয়, তৈরি হয় শৈশব থেকে। যেখানে ‘শিশু’ মেয়েটি দেখে মোড়লপিনা তার মায়ের উপর, তার নিজের উপর। সে নিজেকে, নিজের মনকে ঐভাবে তৈরি করে নেয়। একটি ডিসকোর্সের উৎপাদন এবং তার পরিণত বয়েসে, বিয়ের পর স্বামীর আনুগত্যের জন্যে গর্ভপাত করানোর মধ্যে দিয়ে এই ডিসকোর্সেরই পুনরুৎপাদন ঘটে। চলে প্রজন্মান্তরে। এবং একই মডেলে আমরা দেখি, ‘লোকাল মিনিং’ বা স্থানিক অর্থ, ভাবার্থ, যা মায়েদের কথায়, লেখায় উঠে আসছে।
স্পষ্ট আবার মাঝে মাঝে অস্পষ্ট আকারে উঠে আসছে সমাজের সাংগঠনিক কাঠামো, তথা রাষ্ট্রের ভূমিকা। যা আমাদের, সবাইকে আবার মনে করিয়ে দেয় মিশেল ফুকোকে। প্রত্যেকেই হয়ে উঠেন, রাষ্ট্রের এজেন্ট। আর এভাবেই একজন ব্যক্তি মায়ের বক্তব্য, ভাবনা, কম্যুনাল। হয় উঠে গর্ভপাত কলঙ্ক সকল মায়ের। এছাড়াও আরও একটি দ্রষ্টব্য বিষয় হল, প্রত্যেক মায়ের আলাদা কনটেক্সট বা প্রেক্ষাপট। প্রত্যেকেই পৃথক পৃথকভাবে তাঁদের গল্প জানিয়েছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতাসমূহ হয়ে উঠে একই স্মৃতিগাথা। যেখানে মুনাফার বিষয়টি উজ্জ্বল। যেখানে মায়ের অসহায়ত্ব আর একাকিত্বই কোনো তলানিতে এসে পড়ে থাকে। মায়ের একাকিত্বেও কষ্ট, সন্তান হারানোর যন্ত্রনাগুলো বিড়ালের মতো নিঃশব্দে হাঁটে। সদা সতর্ক। সদা তটস্থ। সমাজের ভয় আর স্বামীয় ভয়। আর ‘আমরা’ অসুখী মানুষের মতো শুনি কেবল তাঁদের কাতর বর্ণনা। “চেতনাচেতনে যেন হেঁটে যায় অন্ধকারে”।
এখানে দেখা যায়, ডিসকোর্সের যে কাঠামো আছে একজন ‘মা’ একজন স্বামী বা একজন পিতা বা মাতার; সেই ডিসকোর্স কাঠামোর মাঝেই জন্ম হয় মায়ের ভাবনার। আর মতাদর্শ আর কাজের বা চর্চার মধ্যেই তা আসে পুনঃ জন্ম হয় সমাজের কাঠামোতে। সমাজের কাঠামোই হয়ে চায় মূল চালিকাশক্তি। পুরুষ ডমিনেশনের যে চিন্তা ভাবনা, কগনিশন, এবং মতাদর্শ সেটি আসে প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে। গফম্যানে যে কনটেক্সট বা প্রেক্ষাপট কেবলই দেশজ, সিডিএ-তে সেটি অনেক বড়, বৈশ্বিক। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা রাষ্ট্রীয় মতাদর্শেও আলোকে গড়ে ওঠা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ক্লিনিক, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, ধর্মীয় রীতিনীতি কীভাবে একজন মাকে চিনিয়ে দিচ্ছে তার পরিচিতি। এবং সেই পরিচিতিত পূর্ণতা ‘বৈধ সন্তানের’ মাধ্যমে। ক্ষেত্র বিশেষে অনুগত স্ত্রীর মাধ্যমে।
সুতরাং সিডিএ একই সমান্তরালে চিন্তাভাবনা বা মতাদর্শের ব্যাখ্যা আবার সামাজিক বিশ্লেষণ ও রাজনৈতিক আখ্যান। কিন্তু; আমাদের ফোকাস ছিল কীভাবে একটি ডিসকোর্সের কাঠামো মতাদর্শিকভাবে চর্চিত হয়; সামাজিক কাঠামোর মাঝে টিকে রয়। কীভাবে গর্ভপাত করানোর ফলে ‘মা’ আর আদর্শ মা থাকে না। কিংবা অনুগত স্ত্রী। মায়ের সংজ্ঞা আর পরিচিতি পান না বলেই; কিংবা স্বীকৃতি পান না বলেই তাকে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। নিতে হয় বিবেকের চাবুকের আঘাত। সয়ে যেতে হয় সারাটা জীবন। আস্ত, জ্যান্ত মাছের কানকোতে যেমন থাকে লাল রক্তের ছোপ ছোপ দাগ।
কাজ ও টেক্সটভিত্তিক মডেল : সামাজিক ইন্টারেকশনের মাঝে টেক্সট বা মায়েদের গল্পগুলো আর MDA
এই মডেল একটু আলাদা, CDA-সিডিএ থেকে। এটাকে বলা হয় Mediated Discourse Analysis-MDA আমাদের মনে হয় গর্ভপাত কলঙ্ক আর কষ্টকে বোঝার জন্যে এটাও আরেকটা দৃষ্টিভঙ্গি হতেই পারে। বিস্তারিত যাওয়ার আগে, ক্রিটিক্যাল শব্দটি একটু বলে নেওয়া উচিত বোধ হয়। এ প্রসঙ্গে ইমাসুয়েল কান্টই প্রথম বৈজ্ঞানিক ভাবনা চিন্তায় শব্দটি ব্যবহার করেন।
ক্রিটিক্যাল শব্দটি, নিঃসন্দেহে নেতিবাচক অর্থ ধারণ করে। এমনকি আমার সহযোগী অধ্যাপক সঞ্জয়কে যখন বললাম ‘ক্রিটিক্যাল’ মানে কী বোঝায়? খুঁতখুঁতে, নেতিবাচক ইত্যাদি।
সুতরাং, ক্রিটিক্যাল, আমাদের সমাজে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আমরা যখন বলছি ক্রিটিক্যাল ডিসকোর্স এনালাইসিসি, তবে অর্থ, আমরা ক্রিটিক্যালি ভাবছি ও কান্ট বলেছেন, যদি না আমরা ক্রিটিক্যালি না ভাবি, তাহলে সত্যের কাছাকাছি যেতে পারছি না।
সিডিএ’র আলোকে আমরা দেখি, একজন যে সব কুশীলব আছেন, বাংলাদেশের সমাজে তাদের কাজগুলোর ধরন কী রকম। MDA-তে ছয়টি কেন্দ্রীয় ধারণা আছে।
০১. Mediated Action : গর্ভপাত করানোর চিন্তা
০২. Site of Engagement : হাসপাতাল। ক্লিনিক
০৩. Mediational Means : স্বামী/ সঙ্গীর উপদেশ বা আদেশ
০৪. Practice : ডাক্তার-নার্স-আয়া-বুয়া-ম্যানেজার
০৫. Nexus of Practice : হাসপাতালের বুকিং, ডাক্তারের পরামর্শ
০৬. Communily of Practice : অপারেশন থিয়েটার, পোস্ট A. wU; ওষুধ
এবং অতঃপর
চিত্রটি একটু জটিল। কিন্তু বোধগম্য। আবার আমাদের বিষয়টিও একটু জটিল বৈকি। মুসলিম অধ্যুষিত বঙ্গদেশে গর্ভপাত নিয়ে লেখা একটু জটিল তো হবেই। আমরা দেখছি, একজন মাকে গর্ভ ধারণ থেকে শুরু করে নানা পথ দিয়ে, নানা জনের মতামত নিয়ে তার পর তাঁকে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে যেতে হচ্ছে। মধ্যখানে তাঁকে অনেকটা ঘুমহীন রাত পার করতে হয়। শারিরীক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
এখানে উল্লেখ্য, মেডিএইডেট একশনটা আসলে সাইট অব এনগেজমেন্টকে ফোকাস করে। হাসপাতাল, ডাক্তার, ক্লিনিকের বাণিজ্যিকীকরণ মূলত নয়া পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাকেই প্রতিনিধিত্ব করে। এবং ঐতিহাসিকভাবে, বাংলাদেশ। গ্লোবাল দুনিয়াতে কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক এখন আর একলা নয়। প্রযুক্তির কল্যাণে, মানুষ মানুষে যোগাযোগ এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।
একজন মেয়ে বা মা গর্ভবতী হলেন। ছেলে সান্নিধ্যও আজকাল যুগের নিমিত্ত। বাংলাদেশের জন্মকালেও কো-এডুকেশন ছিল। কিন্তু, অবাধ মেলা-মেশার কোনো সুযোগ ছিল না। কিংবা শিক্ষাব্যবস্থার অপ্রতুলতাও আরেকটা কারণ। হাতেগোনা পাবলিক আর মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া উচ্চ শিক্ষার জয়গা ছিল না। নয়া পুঁজিবাদী সমাজে, ’৯০-এর দশকের শেষভাগ হতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শুরু। প্রাইভেট ব্যাংকিং বা অন্যান্য কর্মসংস্থানের জায়গা বাড়ে। ছেলে-মেয়ে পরস্পরকে জানতে পারে আরও নিবিড়ভাবে। মানুষের মনে পুঁজিবাদী সমাজের ভোগবাদী চিন্তাও বাড়ে। তাই, একজন স্বামী বা স্বামীর মনে স্পৃহা জেগে উঠে অর্থ জমানোর, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। এতে চাপ আসে একজন মায়ের উপর গর্ভপাত করানোর। যেটা লেমকি বলছেন, একবারেই ব্যক্তির আচরণ বা কাজ হয়ে উঠে উপরের সামাজিক কাঠামোর সাথে যুক্ত। তাই, একজন মায়ের গর্ভপাত করানোর ভাবনা বৈশ্বিক নয়া পুঁজিবাদী সমাজের মতাদর্শকে সমর্থন দিচ্ছে। একইসাথে বৈধতাও। এভাবেই একজন মা হয়ে উঠেন বৈশ্বিক পুঁজিবাদী সমাজের; গ্লোবাল এজেন্ট। একই সমান্তরালে, একজন ডাক্তার, নার্স, আয়া, বুয়া প্রত্যেকের পরামর্শ, লাভালাভের চিন্তা; মুনাফা বৃদ্ধির অভিলাষ পুঁজিবাদী সমাজের নিয়ামক। কিংবা অবিবাহিতদের বেলায় পরিবারের প্রসার, আত্মসম্মান, ‘এই মেয়ের ভবিষ্যৎ’, ‘পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মুখ দেখানো’, ‘আত্মীয়-স্বজনের নানা টিটকারিমূলক মন্তব্য’— যা বাংলাদেশের সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ধ্বংসাবশেষ হিসাবেই দেখা যায়। এই সকল সদস্য সরাসরি গর্ভপাতের সাথে যুক্ত নয়; কিন্তু অংশগ্রহণকারী বলা হয়। যখন একজন মা নিজের মাতৃত্বের স্বীকৃতি পাচ্ছেন না, তখন থেকেই তিনি সিদ্বান্ত নেন যে তাকে গর্ভপাত করতে হবে CDA-তে আমরা দেখি এই জায়গাতেই এসে একজন মায়ের স্টিগমার সূচনা হয়। আত্মশ্লাঘার শুরু। নিজের সন্তান হরণের চিন্তা তাঁকে নিজের কাছে আসামি করে তোলে। আর তখনই ভাবতে থাকেন যদি সমাজ বা রাষ্ট্র তাকে আশ্রয় দিত, হয়ত বা তিনি বাচ্চাটাকে রাখতে পারতেন।
দেখার পদ্ধতি
পদ্ধতিগতভাবে এখানে আমরা টেক্সট দেখছি; ইন্টারভ্যু নিচ্ছি এবং মায়েদের সিমান্টিক ব্যবহার; হাসি, কান্না, ক্ষোভ, মাথাব্যথা, চোখের চাহনি, শব্দ, ব্যবহার, ইত্যাদি আমরা দেখেছি, যেটা আমাদের এমডিএ (MDA) আলাদা সিডিএ হতে এবং আমরা এই সংকলনে কেবলই টেক্সট দেখছি না বলেই এমডিএ’রও সাহায্য নিলাম। সে জন্যে মনে হল যে মায়ের সামাজিক একশনের মাধ্যমে আমরা চর্চিত ডিসকোর্সগুলোর ব্যবহার দেখব। যা একই সাথে লোকাল বাংলার; আবার গ্লোবাল ভিলেজের সমন্বয় সাধন করে, আমরা বরং নতুন একটা টার্মই বানাই গ্লোকাল লোকাল আর গ্লোবাল একসাথে। এই চর্চিত ডিসকোর্সসমূহ, মায়ের ধারণা, অনুগত স্ত্রীর ধারণা, বৈধ সন্তানের মানে, হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বামী বা আত্মসম্মান, প্রতিবেশী পরিজনের কাছে মুখ দেখানো, কিংবা এটা কোনো রোগ নয়, রোগের মানে, রোগীর মানে এইসব ডিসকোর্সগুলো মায়েদের গল্পে উঠে এসেছে। তাঁদের চর্চায়; কথায়, লেখায়। চোখের ভাষায়, ক্রোধের মাত্রায়।
অবশ্যই এখানে আরভিং গফম্যানের সাথে একটু জায়গা সমান্তরালে হাটা যায়। যেমন এখানে চেইন অব একশন বা ইন্টারএকশন, মানে অন্যদের সাথে একজন মায়ের যে সব সামাজিক ক্রিয়া বা কাজ বা চলা-বসা, এই গর্ভপাত বিষয়ে— সেটি গফম্যানও দেখিয়েছেন। কিন্তু এই পর্যন্তই। কারণ, গফম্যান দেখাননি, এই লোকাল বা স্থানীয় একজন সিলেটের মায়ের এ গর্ভপাত করানো কীভাবে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের মতাদর্শকে চর্চা করেন, সমর্থন করেন এবং টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেন।
তিন নাম্বারে আমরা দেখি, মেডিএইটেট মিনস্! এটি যত না ভাষায় প্রকাশ করা যায়, বা লেখা যায়, তার চেয়ে বেশি দেখা যায়, বা অনুধাবন করা যায়। মায়ের বর্ণনার ভাষা, কান্না, দুঃখবিদারী বাক্য, স্বামীর হুমকি, নিজের মায়ের হুমকি, বাবার হুমকি, অনিশ্চয়তার হাতছানি, নির্ঢেউ জীবনের সম্ভাবনা, আজনবি আচানক ভবিষ্যতের ভুতুড়ে তাড়া খাওয়া চোখের চাহনি— সবই দেখা যায়, বা অনুধাবণ করা যায়, টেক্সটে পাওয়া যাবে না। সিডিএ-তে পাওয়া যাবে না।
গ্রামের মক্তবের মেয়ের মতো এলোমেলো খোলা চুলে দিন যাপন ইত্যাদির বর্ণনা, দৃশ্য আমরা এখানে পাই। যেগুলো কনটেক্সট এনালাইসিসে দেখি না। কিংবা প্রথাগত সিডিএ-তে পাওয়া যাবেনা। আমরা পাচ্ছি না। আর, সাইট অব এনগেজমেন্টে একেকজনার ভূমিকা হয়ে যায় একেক রকম। ডাক্তার, নার্স, আর মায়ের ভূমিকা যেমন ভিন্ন, তেমনি ভিন্ন একজন স্বামী বা সঙ্গীর। একই সাইট বা হাসপাতালের ভেতর এই ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা কিন্তু একটি পারপাস সার্ভ করছে; আর তা হল একজন মায়ের গর্ভপাত করানো। কিন্তু মা ছাড়া আর কেউ অনুধাবন করতে পারছে না, মায়ের স্বপ্নগুলো মুছে যাচ্ছে জলপ্রিয় গাঙচিলের মুখের ফেনার মতো চিরদিনের জন্যে। অপারেশন থিয়েটার, আহ! বয়েসী অজগরের মতো গিলে খায় মায়ের বাচ্চাটাকে।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, মায়ের কাছে তখন একদম ছোট হয়ে আসে তাঁর পৃথিবী। কোন হাসপাতাল, কোন ক্লিনিক, কোন ডাক্তার; এবং এসবের সাথে যুক্ত একজন মায়ের আগের ক্লিনিক বা হাসপাতাল সম্পর্কিত আগের ধারণা— নেক্সাস অব প্র্যাকটিস। অর্থাৎ যেখানে একজন মানুষের কর্ম বা কাজ বা চর্চা সংঘটিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে হাসপাতাল বা ক্লিনিক, কম্যুউনিটি অব প্র্যাকটিস, পদ্ধতিগতভাবে এটি মডেলের একটি গুরুত্ববাহী বিষয়। দু’টো প্রশ্ন সামনে চলে আসে—
১. কীভাবে নেক্সাস অব প্র্যাকটিসকে প্রযুক্তিকরণ করা হয় আর
২. যারা এখানে সক্রিয়, তাদের পরিচিতি কীভাবে তৈরি হয়।
একটু ব্যাখ্যা করেই বলছি। যেমন একজন মা’কে ওয়েটিং রুমে যেয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে; তাঁর দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। কারণ, হাসপাতালের চোখে মা এখানে এসেছেন তাঁর পাপ মোচন করতে। আর নতুবা স্বেচ্ছায় এসেছেন, স্বামীর ভাষায় ‘বাড়তি ঝামেলা’ সারাতে এবং এই কাজ সারাতে অপারেশন টেবিলে সামান্য সময় ব্যয় হবে, প্রযুক্তির কল্যাণে, সেই প্রযুক্তিও গ্লোবাল বাজারের কোনো দেশ থেকে আসা। পুরো বিষয়টাকে ‘প্রযুক্তিকরণ’ বলা হচ্ছে প্রতীকী অর্থে, কারণ সব কিছু মেকানাইজড্। সবাই জানে তার কী ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে এবং একজন মায়ের ক্ষেত্রে, গর্ভপাত করাতে কী করতে হবে, তা অথ্যাধুনিক প্রযুক্তির মতোই ছক বাঁধা, গতবাধা, নির্ধারিত।
আবার যারা এখানে সক্রিয়, ডাক্তার, নার্স, আয়া, বুয়া, ম্যানেজার তারা যে সব ভূমিকা পালন করেন মায়ের প্রতি। সেই ভূমিকা মায়ের কাছে (গর্ভপাত করানোর আগে এবং পরে) এক নতুন পরিচিতি নিয়ে আসে। এতদিন শুনে আসা ডাক্তার, নার্স বা হাসপাতালের সম্পর্কে তাঁর ধারণা পুরোটাই বদলে যায়। নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়; ‘আমরা তো তাদের চোখে রোগী-ই নই’, ‘আমরা ঘৃণার বা পাপী’, ইত্যাদি ধারণা নিয়ে চলে আসেন মায়েরা। যারা অবধারিতভাবে প্রতিনিধিত্ব করছেন একইসাথে পুঁজিবাদী সমাজের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার।
একটি তুলনামূলক আলোকপাত
আমরা দেখেছি, এ অধ্যায়ের প্রথম দিকে, আরভিং গফফ্যানের আলোকে গবেষক কুমার, যেন কোথাও পুঁজিবাদ, কিংবা পাওয়ার রিলেশন, কিংবা বৃহৎ সমাজ ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে, গা বাঁচিয়ে কেবল স্টিগমাটাকেই দেখছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নৃবিজ্ঞানে কাজও হয়েছে। স্বীকৃত ও নন্দিত। বহুল পাঠ্যও বটে। আমরাও আলোকবর্তিকা পেয়েছি কুমারসহ অন্যান্য গর্ভপাত স্টিগমা বা কলঙ্ক কীভাবে মায়েদের ললাটে আঁকা হয়, কিন্তু বাংলাদেশের সমাজে কোনো কাজ নেই। হয়তবা গফম্যান দিয়ে, তাঁর ধারণা দিয়ে গর্ভপাত কলঙ্ককে বোঝা যায়; কিন্তু, এটার পেছনে যে বড় সামাজিক ও রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে তা একদম বোঝা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে সিডিএ-তে মূলত টেক্সট বা কথা বা মৌখিক ডিসকোর্সগুলোকে ফোকাস করা হচ্ছে কিনা ইগনোরড থাকছে সামাজিক এ্যাকশন আবার MDA-তে সামাজিক এ্যাকশন তথা মায়েদের কাজের পরিক্রমা দেখছি যেখানে গর্ভপাত করানোর আগে ও পরে ডিসকোর্সগুলো প্রাকটিস্ড হয়। তাই, প্রকৃতিগতভাবে MDA আমাদের কাছে মনে হচ্ছে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, অনুসঙ্গী। MDA’র কতেক পদ্ধতিগত ধারণা আমরা পেতে পারি। যেমন—
১. সামাজিক এ্যাকশন বাস্তবের দুনিয়াতেই হচ্ছিল— Real-time Action.
২. কাজগুলোর মানে ছিল বাস্তবিক, মূর্ত ও অংশগ্রহণকারীদের অভ্যাস, আচরণ, বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে কাজগুলোকে দেখা যাচ্ছে।
৩. পর্যবেক্ষণ, নিবিড় আলোচনা, সত্যাসত্য যাছাই হল MDA’র মূল হাতিয়ার।
৪. পর্যবেক্ষণ যেহেতু একটি অন্যতম টুল, সেহেতু পর্যবেক্ষণ কেবলই বর্ণনায় সীমিত না থেকে ব্যাখ্যায় রূপান্তরিত হচ্ছে।
আমাদের উদ্দেশ্য, তাই, গর্ভপাত করানো মায়েদের বলা গল্প, ডাক্তারদের সাক্ষাৎকার, অনলাইনে সাড়া দেওয়া মায়েদের লেখা অর্থাৎ সমুদয় টেক্সট আর সিমান্টিক ব্যবহার হয়ত আপনি বলবেন, তাহলে গর্ভপাত নিয়ে উপরোক্ত ব্যাখ্যা কি আসলেই ডিসকোর্স এনালাইসিস? ইতিবাচক উত্তর দিচ্ছি আমরা দুটো কারণে—
১. Tex বা ভাষাকে বাদ দিচ্ছি না, বরং অন্যান্য দিক যেমন মায়েদের গর্ভপাত করানোর জটিল প্রক্রিয়ায় যে সব মেডিএশনাল মিনস্ ও সাইট অব এনগেজমেন্ট, যে সব সামাজিক কাজ চর্চিত হচ্ছে, সেগুলোকেও আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভাবছি।
০২. MDA-তে ডিসকোর্সকে আমরা অনেক বড় পরিসরে দেখার ও বোঝার চেষ্টা করি; যা টেক্সট বা ভাষাতে থাকতেও পারে আবার নাও পারে। যেমন, একজন আয়ার খারাপ ব্যবহার, ডাক্তারের ধমক, গর্ভবতী মেয়ের মায়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা, বাবার আত্মসম্মান বা পরিবারের মুখ দেখানো।
এবার দেখব, কেন ও কোন যুক্তিতে আমরা গল্পগুলো হুবহু তুলে দিচ্ছি; ভূমিকায় বলছি যে, আমরা সাহিত্যের দুটো ধারা নিয়ে এখানে কাজ করছি; প্রথাগতভাবে এথনোগ্রাফিক কাজে সাহিত্যের ধারা নেওয়া হয় না; কিন্তু, আমাদের কাছে এর প্রয়োজনীয়তা ছিল খুব বেশি।
প্রতিবাদ হিসাবে লেখা
এটা আসলে লেখার একটা ধারা। সাহিত্যে অনুসরণ করা হয়। R. F. Brenner থেকে আমি মূলত এই প্রবচনটা হাওলাত করছি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টের নির্মম দিনগুলোর কথা বিধৃত হয় চারজন মহিলার অভিজ্ঞতায়। এর একজন হলেন আনা ফ্রাঙ্ক। যাঁর ডায়েরি পড়েনি বা নাম শুনেনি মানুষ পাওয়া মুশকিল। লেখার মাধ্যমে প্রতিরোধ ও তার আলোকে নৈতিক উৎকর্ষের ভালো পথ আর হয় না। গর্ভপাত করানো মায়েদের খুব দুঃখ-হাসি-কান্নার বর্ণনা একবারেই ব্যক্তিগত। কিন্তু, ব্যক্তি মায়ের গল্পগুলোর সখ্য ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে। টুকরো টুকরো গল্পগুলো, মনে হচ্ছে স্বদেশবাসীর জানা উচিত। দুঃখ আর নির্মম গল্পগুলি কীভাবে প্রতিবাদ হয়ে ওঠে তা Brenner দেখিয়েছেন। হলোকাস্টে নির্যাতিতদের বর্ণনা নয় কেবল, ব্রেনার দেখান কেমন করে প্রতিরোধ, প্রতিবাদ হয়ে ওঠে।
আমরা দেখছি, কী গভীর ঔদার্যময়ী বর্ণনা মায়েদের মুখে। কী গভীর মমতা আর আন্তরিকতা তাঁদের লেখায়। আর গল্পগুলোতে ফুটে আসছে মায়েদের উপর মাতব্বরি করার। সমাজ, পরিবার, স্বামী, রাষ্ট্র সবাই ছড়ি ঘুরিয়েছে মায়েদের উপর। এ লেখাই তাঁদের প্রতিবাদ। প্রতিরোধ। ব্রেনার চারজন নির্যাতিতের বক্তব্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। ইউরোপের এনলাইটননেন্ট’র সময়েও কীভাবে তারা নির্যাতিত হন, এমনকি, প্রশ্ন এনেছেন এথিকস্ বা নৈতিকতার দিক থেকেও। একটা জায়গায় লিখছেন, এখন এগল্পগুলো শোনা ভীষণ “ডিস্টার্বিং”, যেমন গর্ভপাত করানো মায়েদের গল্প। আমরা সাহিত্যের এ ধারা গ্রহণ করেছি, তার কারণ, এখানেও Self-Givness Ges Self-Offering মায়েরা আপাত অর্থে মনে হয় নিজের বাচ্চার প্রতি Self-Offering করেই গর্ভপাত করিয়েছেন শুধু তাই নয়, হাসপাতালের অনুমতিপত্র বা Consent Form-এ তাঁরা স্বাক্ষর দিয়েছেন। বা প্রমাণ করার জন্যে যথেষ্ট, তারা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই তারা হাসপাতালে গিয়েছেন। বাস্তবে, এটি একটি মানবিক প্রশ্ন ও বইটি, পুরোটাই তার সহৃদয় উত্তর, পুরোটাই।
গল্পে চেনা যায় কুশীলবদের নির্দয়তা, শ্লেষমাখা কথা, অপারেশন থিয়েটারের আমুদে পরিবেশ সব মিলিয়ে তৈরি করে গ্রানাইটের মতো নিরাবরণ কষ্টের আখ্যান। মায়েদের কর্মতৎপরতা, স্বামী, সঙ্গীর তাড়া, তাগিদ উঠে এসেছে মায়েদের বিবৃত কথায়। চিরচেনা স্বামীকে চিনছেন নতুন করে। আদ্যোন্ত গল্পগুলো পাঠে নির্মোহ থাকা মুশকিল। মায়েরা হয়ে উঠেন গা ছমছম করা এক অশুভ পূর্বলক্ষণ আমাদের চিরচেনা পরিবেশে।
ক্যাথারসিস অভিজ্ঞতার সম্মিলন
আবেগের পূর্ণাঙ্গতা, যেখানে সকল দুঃখের আখ্যানে বর্ণিত হয়। মূলত এরিস্টটল থেকেই এ ধারা চলমান। যেখানে, ট্রাজেডির মাধ্যমেই সমাপন হয় আবেগের শেষটা। গল্পগুলোর বর্ণনায়, মনে হয়, এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুকরণীয় ধারা। মায়েরা গল্পগুলো বলছেন তাদের নিজেদের জন্যে, অন্যদের জন্যে। যারাই গর্ভপাত সংক্রান্ত কষ্টে ভুগছেন। শারীরিক কিংবা মানসিক।
কোনো ভাবালুতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে মায়েরা বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছেন। আশ্চর্য বাণীমাধুরীতে উঠে আসে স্বপ্ন, ভয়, আলোবাসা, নিঃসৃততা আর নির্মমতার আরাধনা।
গল্পগুলোর আত্মপ্রতিচ্ছবিতে আমরা দেখছি মায়েদের অপন সত্তার বিসর্জন। একই সমান্তরালে সরল ও গভীর।
স্বামী, সঙ্গী, ডাক্তার অর্থাৎ পুরো রাষ্ট্রে ও সমাজের চোখে ‘তুচ্ছ’ বিষয়টি মায়েদের আজন্ম লালিত স্বপ্ন ও সেই স্বপ্নকে হত্যার ঘটনাটা মায়েরা ভোলেন না। ভোলেন না বলেই তারা নিজেদের ‘Self-Giving’-এর মতো দিয়ে আসেন, আত্মসমর্পণ করেন। বিনিময়ে পান কলঙ্কিনী উপাধি। তাই, গল্পগুলোর শেষটা শীতল মৃত্যুর হতাশাজনক অনুসারক না হয়ে বরং হয়ে যায় এক একটি প্রতিবাদলিপি। অক্ষয় সান্ত্বনার মতো সকল মায়েদের জন্যে এই গল্প। ভেঙে না পড়ে বেঁচে থাকার অমোঘ বাণী।
একবারেই ঘরোয়া গল্পগুলো আর ঘরোয়া থাকে না; বরং ব্রিজ তৈরি করে দেয় বাইরের জগতে। বেপরোয়া বিশ্বায়নের সাথে গল্পগুলোর সংযোজনও আমরা দেখেছি নানা বিজ্ঞজনের দেখানো পথ ধরে।
কলঙ্কিনী রাধা : “মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার”
আমাদের গল্পগুলোর কথকেরা অবাধ্য হতে পারতেন আল মাহমুদের বেপরোয়া আয়েশা আক্তারের মতন। বেয়াড়া আর খাতরা। হননি। সমাজ আর সামাজিক রীতি তাঁদের হতে দেয়নি। লানত, লজ্জা আর কলঙ্কে ঢাকা পড়ে আছে তাঁদের হারানো সম্মানের স্মৃতি। বিদায়ের বিষণ্ন রুমালে চোখ মুছতে মুছতে বলেছেন তাদের কথা। জানাচ্ছেন, আর কখনো গর্ভপাত করাবেন না। এবং কেউ যেন না করান। গল্পগুলো পড়তে পড়তে মনে হয়, বর্ণমালার গায়ে গতরে কত না রক্ত দাগ। “প্রত্যেক ফোঁটায় ঝরছে আমার অস্ফুট কথাকলি।” মায়ের যাঁরা বেঁচে আছেন, আমরা তাঁদেরই জানছি। জানছি তাঁদের টলায়মান অসুখী পথ চলার কথা। আর আমাদের শ্রুতিক্ষমতা, দৃষ্টিক্ষমতা বেড়ে অনেকগুণ হল চিন্তার কপাটে। কোনো কোনো মায়ের অভিজ্ঞতা উঠে আসে গভীর দার্শনিকতায়, অপার্থিব অন্বেষায়। সার্বভৌম বাংলায় পরাধীনতার কী গভীর আবেদন!
(চলবে)
কলঙ্কিনী রাধা – প্রথম পর্বের লিংক- https://magazine.anupranon.com/ধারাবাহিক-প্রবন্ধ/কলঙ্কিনী-রাধা-প্রথম-পর্ব/