অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

উদয় শংকর দুর্জয় -
বই : সৃজনশীল মননের চিরকালীন সঙ্গী

বিখ্যাত মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থবিদ এবং বিজ্ঞান লেখক কার্ল সেগান বলেছেন- ‘হাজার বছর ধরে লেখকরা মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর নিরবে পরিষ্কারভাবে কথা বলে যাচ্ছেন। লেখকরা আসলে জাদুকর, যারা কেউ কোনোদিন একজন আরেকজনকে চিনতো না বা জানতো না, বই তাঁদের সময়ের শৃঙ্খল ভেঙে দূরত্বকে ছেঁটে দিয়েছে। মানব সভ্যতার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো উদ্ভাবন হলো বই, কারণ বই-ই পেরেছে আলোর পথ দেখাতে।’

বই মানব জীবনের, মনুষ্য পরিচয়ের এবং সভ্যতা বিকাশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। লেখক সেরি বার্নেল বলেছেন- ‘Books & story telling have long been part of our identity’. আপনার আমার পরিচয় যাই হোক না কেনো, গল্প সবার জন্য। গল্প চলে আসছে সেই আদিম কাল থেকে এবং সেই গল্পকে আজীবন ধরে রাখার জন্য মানুষ আশ্রয় নিয়েছে পাহাড়, গুহা, গাছের ছালের কাছে; পাথরে খোদাই করে ছবি এঁকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে দিতে মানব সমাজ একেকটি অধ্যায় পার করে আজ ভার্চুয়্যাল যুগে এসে পড়েছে। এখন একটি ক্লিকের মাধ্যমে অসংখ্য তথ্য এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছানো যাচ্ছে নিমেষে।

মানব সভ্যতার এত দ্রুত অগ্রগতির পেছনে রয়েছে ‘গল্প’। সব ঘটনার পেছনে যেমন গল্প থাকে তেমনি সেই গল্পকে ধরে রাখার জন্যই ‘গল্প’ তৈরি হয় মনুষ্য জীবনের ইতিহাস; সভ্যতা, আধুনিকতা সবকিছু গল্পের মতো করেই মানুষ মনে রাখে। বই সৃষ্টি হওয়ার আগে মানুষের কাছে শুধুমাত্র ‘গল্প’ই ছিল। ৬০০ সালের দিকে হাতে আঁকা ছবি দিয়ে এক প্রকার বইয়ের সূত্রপাত ঘটে। আরও পরিষ্কার করে যদি বলতে হয় তাহলে কাগজে লিখিত প্রথম বই প্রকাশিত হয় চায়না থেকে; ব্যবহার করা হয়েছিল তুঁত, শণ, ছাল এবং এমনকি মাছও। প্রথম মুদ্রিত বই হিসেবে ‘দ্য এপিক অফ গিলগামেশ’র নাম উঠে আসে। ‘দ্য এপিক অফ গিলগামেশ’ হলো ইতিহাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পৌরাণিক পুনরুত্থান। উরুকের রাজাকে নিয়ে আবর্তিত আক্কাদীয় ভাষায় লেখা মেসোপটেমীয় মহাকাব্য।

সৃজনশীল ইতিহাসের পেছনেও রয়েছে অনেক বড়ো কালো অধ্যায়। বিশ্বসাহিত্যের অনেক ক্লাসিক বইয়ের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা, দাশ প্রথা, ধর্মীয়-স্পর্শকাতরতা বা যৌনাচারের ধুয়ো তুলে সেগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিখ্যাত লেখকদের মধ্যে রয়েছে মার্ক টোয়েনের মতো লেখক; রয়েছে জেম্স জয়েসের ‘ইউলিসিস’ থেকে শুরু করে গ্যালিলিওর ‘বিশ্ববিধান সম্পর্কে কথোপকথন’, জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’, ব্রেট অ্যাস্টন এলিসের ‘অ্যামেরিকান সাইকো’ সহ বহু বই। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজও বাদ যাননি নিষিদ্ধ দীর্ঘ তালিকা থেকে। মুক্তচিন্তাবিদদের ওপর নিষেধাজ্ঞার খড়গ নামাতে শিল্প-সংস্কৃতির স্বর্ণভূমি ফ্রান্সও বাদ পড়েনি; যেখানে মুক্তচিন্তার ওপর আঘাত এসেছে বারবার।

নিষিদ্ধ হওয়ার বইয়ের তালিকা শুধু দীর্ঘতরই হয়নি, বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে বহু প্রগতিশীল লেখক এবং প্রভাবশালী মুক্তচিন্তকদের। ইতালীয় বিখ্যাত লেখক দান্তে অ্যালিগিয়েরির ‘ডে মনার্কি’ এবং ‘ডিভাইন কমেডি’র মতো ক্লাসিক সাহিত্যও উগ্রবাদের রোষানল থেকে বাদ পড়েনি। জ্যাঁ পল সাত্রেঁর মতো আধুনিক প্রভাবশালী চিন্তবিদদের অন্যতম অস্তিত্ববাদী ফরাসী দার্শনিক যাকে কমিউনিস্টপ্রীতির কারণে অভিযুক্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ডাস ক্যাপিটালের লেখক কার্ল মার্ক্সের কথাই ধরা যাক, সমাজতন্ত্রের কথা বলে যিনি আলোচিত এবং সমালোচিত হয়েছেন একাধিকবার বা আজও হচ্ছেন। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার এই কার্ল মার্ক্স, যার মৃত্যু হয়েছিল শান্ত এবং শান্তিপূর্ণভাবে কিন্তু তাঁর জীবনের অনেকটা সময় কেটেছিল পুলিশের অস্বাভাবিক অত্যাচারে। বেলজিয়াম থেকে ফ্রান্স, তারপর জার্মানিতে, সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে আবার ফ্রান্সে ফিরে আসেন। ফ্রান্সেও বেশিদিন থাকতে পারেননি, সর্বশেষ লন্ডনে এসে থিতু হন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানে থেকে যান।

চিকিৎসক, মনস্তত্ত্ববিদ এবং লেখক সিগমন্ড ফ্রয়েড বলেছেন- ‘মানুষ ততক্ষণ আত্মবিশ্বাসী থাকে যতক্ষণ তাঁর নিজের বক্তব্য প্রতিনিধিত্ব করে। এর বিরোধিতা করলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে’। ফ্রয়েড ‘দ্য ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিম্স’ বইটি লিখে প্রথম দিকে পাঠকের কাছ থেকে তেমন কোনো সাড়া পান না। নিউরোলজিস্ট হিসেবে স্নায়ুরোগে ভোগা রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে তাদের অবচেতন মন আর সহজাত প্রবৃত্তি সম্পর্কে যে অনাকাঙ্ক্ষিত তথ্য তিনি জানতে পারেন, তা ফ্রয়েডকে এক নতুন পথ দেখাতে সাহায্য করে। অর্থাৎ ফ্রয়েড সাইকো-অ্যানালাইসিস বা মনোসমীক্ষণের এক নতুন অধ্যায় অবিষ্কার করেন।

মানুষ যখন অবচেতন মনকে জানতে শুরু করলো তখন ফ্রয়েডের এই বইটি পাঠক দারুণভাবে সংগ্রহ করতে শুরু করলো। তার আগে বহুবার সমালোচিত হয়েছেন ফ্রয়েড। শুনলে অবাক হতে হয় প্রথম নয় বছরে বইটি বিক্রি হয়েছিল মাত্র ছয়শ’ কপি। জেনে অবাক হতে হয়, ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে হিটলারের শ্যেন দৃষ্টি যখন শিল্প সংস্কৃতির ওপর এসে পড়ে তখন লেখক বুদ্ধিজীবীদের চেতনা আর বিশ্বাসকে নস্যাৎ করার জন্য লেখক সাহিত্যিকদের ঘরবাড়ি দখল করা হয়, পাঠাগার পুড়িয়ে দেয় এমনকি, ভিটেমাটি থেকে উৎখাত পর্যন্ত করে দেওয়া হয়। ‘Against soul shredding overvaluation of sexual activity’-আখ্যা দিয়ে সিগমন্ড ফ্রয়েডের ১৯৩৩ সালের পূর্বে প্রকাশিত সমস্ত বই যখন পুড়িয়ে দেওয়া হয় তখন তিনি ইংল্যান্ডে এসে শেষ আশ্রয় নেন।

‘তবে ইতিহাস তোমাদেরকে কিছুই শেখায়নি, যদি মনে করো যে, তোমরা তাঁদের চিন্তা-চেতনাকে হত্যা করতে পারো’। ১৯৩৩ সালে জার্মানি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা, হিটলারের আদর্শে উৎসাহিত হয়ে বিশ্বের সব নামি লেখক যেমন সিগমন্ড ফ্রয়েড, হেইস. জি ওয়েলস, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জ্যাক লন্ডন, থমাস ম্যানের বইয়ের সাথে নিজের বইও যখন পুড়িয়ে দেয় তখন আমেরিকান লেখক হেলেন কেলার, জার্মান শিক্ষার্থীদের কাছে একটি খোলা চিঠিতে এসব লেখেন। আরও লেখেন ‘তোমরা আমার বই এবং ইউরোপের উৎকৃষ্ট মননের বইগুলো পুড়িয়ে ফেলতে পারো, তবে সেসব লেখকদের চেতনা লক্ষাধিক চ্যানেলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তা অন্যদের মনকে প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত করবে।’

জনপ্রিয় উপন্যাস ‘ললিতা’র কথা কারও অজানা নয়। ভ্লাদিমির নবোকভের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ললিতা’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কী এমন ঘটনা ছিল যে, রাতারাতি বইটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বারো বছরের এক কিশোরীর সাথে মধ্যবয়স্ক পুরুষের যৌন সংসর্গের ঘটনা মূলত সভ্য সমাজের উচুতলার লোকেদের রক্তচক্ষুর কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫৫ সালে প্যারিস, ১৯৫৮ সালে নিউইয়র্ক এবং ১৯৫৯ সালে লন্ডন থেকে উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর অশ্লীতার দায়ে প্রকাশকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। উপন্যাসের মূল চরিত্রে রয়েছে বারো বছরের কিশোরী ললিতা এবং ললিতার মধ্যবয়সি স্টেপ ফাদার অর্থাৎ বিপিতা ড.হাম্বার্ট। ললিতার সৌন্দার্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, ললিতাকে পাওয়ার অভিলিপ্সায় ড.হাম্বার্ট, ললিতার বিধবা মাকে বিয়ে করেন।

এই উপন্যাসের লেখক ভ্লাদিমির নবোকভ দেখিয়েছেন যে,ড.হাম্বার্ট কিছুটা মানসিক রোগে ভুগছেন এবং চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছেন। আরও দেখিয়েছেন ড.হাম্বার্ট তাঁর নিত্যদিনের জীবনযাপনের সব কথাবার্তা ডায়রিতে লিখে রাখছেন। ঔপন্যাসিক তাঁর উপন্যাসটি প্রথমে ইংরেজি ভাষায় লেখেন এবং পরে রুশ ভাষায় নিজেই অনুবাদ করেন। ১৯৯৮ সালে নবোকভের এই ললিতা উপন্যাস টাইম ম্যাগাজিনের লিটারেরি লিস্টে চতুর্থ স্থান দখল করে নেয়। ভ্লাদিমির নবোকভ জন্মগ্রহণ করেন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে ১৮৯৯ সালের ১০ই এপ্রিল। পড়াশোনা করেন ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে; প্রথমে প্রানিবিজ্ঞান নিয়ে পড়লেও পরে ফরাসি এবং রুশ সাহিত্য নিয়ে পড়েন। ট্রিনিটি কলেজে পড়াকালীন তিনি ইংরেজি এবং রুশ ভাষায় বেশ কিছু কবিতাও লেখেন। ১৯২৩ সালের দিকে তাঁর কবিতার বই ‘দ্য ক্লাস্টার অ্যান্ড দ্য এম্পিরিয়ান পাথ’ প্রকাশিত হয়।

সাতাশ বছরের অশ্লীলতার দায় থেকে মুক্তি পাওয়া উপন্যাস ‘ট্রপিক অফ ক্যান্সার’ লেখা হয়েছিল ১৯৩০ সালের দিকে, ঘটে যাওয়া কিছু বেদনার্থক ঘটনা নিয়ে। ঔপন্যাসিক হেনরি মিলার মূলত আত্মজীবনীমূলক খুঁটিনাটি বিষয়কে কেন্দ্র করে উপন্যাসের কাহিনি গড়ে তুলেছেন। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে ক্লাসিক উপন্যাস হিসেবে আলোচিত হলেও তা এক সময় নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকাতেই ছিল। ১৯৩৪ সালে ফ্রান্সে বইটি প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হলেও সেন্সরশিপের কারণে আমেরিকাতে বইটি প্রকাশ হতে অপেক্ষা করতে হয় ১৯৬১ সাল পর্যন্ত।

‘ট্রপিক অফ ক্যান্সার’ উপন্যাসটিতে রয়েছে জীবন দর্শনের টুকরো টুকরো অনুভূতি যেখানে দারিদ্রতা থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের খুঁটিনাটি বিষয়। ঔপন্যাসিক তাঁর যৌনতার বিভিন্ন ঘটনার রসালো অনুচ্ছেদ সামনে আনতে গিয়ে নিজের জীবনের খোলামেলা বিষয়কে আরও বেশি উন্মুক্ত করেছেন। নিজের স্ত্রী মোনার পাশাপাশি অন্য নারী সঙ্গীদের সান্নিধ্য লাভ করার অসংখ্য উচ্ছাসিত, রসালো এবং জমজমাট কাহিনি উঠে এসেছে তাঁর এই আখ্যানে।

নিষিদ্ধ এবং উল্লেখযোগ্য আরও অনেক বইয়ের মধ্যে রয়েছে উইলিয়াম টেইন্ডাল অনূদিত ‘বাইবেল’, অব্রে মেনেনের ‘দ্য রামায়ণ অ্যাজ টোল্ড’ এবং সালমান রুশদির ‘দ্যা স্যাটানিক ভার্সেস’, ব্রেট এস্টন এলিসের ‘অ্যামেরিকান সাইকো’, মার্ক টোয়েনের ‘ইভ্স ডায়েরি’ ও ‘হাকলববেরি ফিন’, বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর ‘বিশ্ববিধান সম্পর্কে কথোপকথন’ অন্যতম। নিষিদ্ধ করা হয় বিখ্যাত লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য সান অলসো রাইজেজ’ বইটিও।

আরও অবাক হওয়ার বিষয় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং সম্মানিত ইংরেজ কবি পার্সি বিসি শেলিকেও নিরীশ্বরবাদের ছুঁতমার্গ দেখিয়ে ‘দ্য নেসেসিটি অফ এথিসম’ বইটির জন্য অপমান করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেক বহিষ্কার করা হয়। অথচ ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ওয়েল্স জুড়ে প্রায় ৬০০ বাসের বিলবোর্ডে লেখা ‘There’s probably no god… now stop worrying and enjoy your life’- দেখতে পাওয়া। শেলি বইটির মধ্যে লিখেছিলেন– ‘The mind cannot believe in the existence of a god.’ এই উক্তির জন্য পাশপাশি তাঁর বন্ধু এবং সহযোগী লেখক হিসেবে থমাস জেফারসন হগও অভিযুক্ত হন।

সাহিত্য জগতের বাইরে আদতে শেলী একজন এথিস্ট এবং মুক্ত-আধুনিক রাজনৈতিক চেতনার মানুষ ছিলেন। সাহিত্যের বাইরে তিনি কিছু প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধ্যানধারণা থেকে বেশকিছু রচনাও লিখেছেন, তার মধ্যে দীর্ঘ একটি রচনা- ‘এ ফিলোসফিক্যাল ভিউ অফ রিফর্ম’ যা লেখার একশ বছর পর অর্থাৎ ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশ কয়েক বছর আগে, সোভিয়েত ইউনিয়নে, ফরাসি দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী জঁ-জাক রুশোর দার্শনিক চেতনার সব বই পাঠ নিষিদ্ধ করা হয়। অন্যদিকে ফ্রানৎস কাফকার বই চেকোস্লোভাকিয়াতে নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ তিনি চেক ভাষায় লিখতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ছিলেন। শুধু তাই নয় হিটলারের নাৎসি বাহিনী এবং সোভিয়েত ইউনিয়নও কাফকাকে চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করে।

‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’, বিশ্বসাহিত্যাঙ্গনে অশ্লীলতার দায়ে যতো বই নিষিদ্ধ হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং বৃহৎভাবে পঠিত এই উপন্যাস। এই উপন্যাসে মূলত জৈবিক চাহিদা এবং কামকলা নৈপুণ্যের এক সুনিপুণ চিত্রায়ন রয়েছে। যৌনতৃপ্তি লাভের অন্বেষণ যখন অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন উচ্চ বিলাসিতাময় সংসার আর সামাজিক মর্যাদার পরব্যাপ্তি তখন সংকীর্ণ হয়ে আসে। ঔপন্যাসিক ডি.এইস লরেন্স এমনই এক সঙ্গা এই জগত সংসারকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, যৌন আকাঙ্ক্ষা বা সম্পর্কিত যৌনজীবন মানুষের মনন এবং দর্শনের ইন্দ্রিয়কে আরও প্রখর এবং অনুভূতিশীল করে তোলে।

তার উপন্যাস থেকে প্রেম সম্পর্কের বহু আবেগময় কথোপকথন পাওয়া যায় যেমন-We’ve got to live, no matter how many skies have fallen’. উনিশ শতকের রক্ষণশীল অভিজাত পরিবার বিবাহ বহির্ভূত সে-যৌন-সম্পর্ক মেনে নেবেইবা কেন, যতই পুরুষ স্ত্রী-সঙ্গমে অক্ষম হোক! পুরুষ শাষিত সমাজ তো চায় নারীর কোনো আকাঙ্ক্ষা না থাকুক; নারী শুধু উপভোগের বস্তু হোক, উপভোগের অংশীদার না হোক। লরেন্স উঁচুতলার ঐ সমাজকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছেন; তিনি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন- ‘শরীরবিহীন মনোমিলনের যে অহেতুক এবং অর্থহীন সম্পর্ক তেমনি মনের সম্পর্ক ব্যাতিরেকে দৈহিক মিলনও জৈবিকতা ছাড়া অন্যকিছু নয়’। রক্ষণশীল সমাজ আর যাই হোক পুরুষের অক্ষমতা সমাজে প্রমাণিত হোক বিংশ শতাব্দীর ইংরেজ সমাজ তা কোনোভাবেই চায়নি। অগত্যা যূপকাষ্ঠে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’।

‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে, ইতালিতে এবং ১৯২৯ সালে ফ্রান্সে। ইংল্যান্ডে প্রথম ছাপার অভিযোগে প্রকাশনা সংস্থা ‘পেঙ্গুইন বুকস’কে আদালতে দাঁড়াতে হয়। মামলা চলতে থাকে বহু বছর ধরে; ১৯৬০ সালে বইটি নতুন করে প্রকাশের অনুমতি মেলে। শুধু তাই নয়, লরেন্সের আরেকটি উপন্যাস ‘দ্য রেইনবো’র জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগে তদন্ত শুরু হয় এবং উপন্যাসটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। প্রতিটি জীবনের প্রাকৃতিক এবং আধ্যাত্মিক সম্পর্কের মধ্যে যৌন আকাঙ্ক্ষার যে অকপট এবং স্পষ্ট আচরণ রয়েছে তারই প্রতিফলন এসে পড়েছে ‘দ্য রেইনবো’ উপন্যাসে।

১৯১৫ সালের ১৩ই নভেম্বর বো স্ট্রীটের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের রায় অনুযায়ী ‘দ্য রেইনবো’ নিষিদ্ধ হয়ে যায়; ১০১১ কপি বই সেই দিনই বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং পুড়িয়ে ফেলা হয়। প্রায় ১১ বছর ধরে ব্রিটেনে বইটি নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকা থেকে নাম কাটাতে পারেনি। ১৯২০ সালে তারই সিকুয়্যাল অর্থাৎ ‘দ্য রেইনবো’র দ্বিতীয় খণ্ড হিসেবে লরেন্স লেখেন ‘উইমেন ইন লাভ’ উপন্যাস। ‘দ্য রেইনবো’র নেগেটিভিটির জন্য প্রকাশক প্রথমত ‘উইমেন ইন লাভ’ প্রকাশে অপারগতা দেখালেও পরে অবশ্য তা প্রকাশ পায়। ডি.এইচ লরেন্স যেমন সমালোচিত হয়েছেন তেমনি উচ্চ প্রশংসিতও হয়েছেন। রবার্ট ম্যাকক্রাম লরেন্সের ‘দ্য রেইনবো’র ওপর পাঠ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় লিখেছেন ‘…Similarly, in The Rainbow and Women in Love, the sexuality of his character’s throbs through the narrative like a feverish pulse. No one write better then Lowrance about the complexity of desire, specially home sexual desire.

‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ আর ‘লজ্জা’ উপন্যাসের কথা কমবেশি সবারই জানা। বিংশ শতাব্দির শেষের দিকে, সৃজনশীল ইতিহাসের সবচেয়ে সমালোচিত এবং আলোচিত এই দুটি বইয়ের লেখক তাঁরা তাদের জন্মভূমি থেকে সম্ভবত চিরদিনের জন্য উৎখাত হয়েছেন। ১৯৮৮ সালে সালমান রুশদির ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশিত হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার দায়ে একবছর পরই বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী বছরে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি সালামান রুশদির বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি ক’রে মৃত্যুদণ্ড দাবি করে। ১৯৯৫ সালে, নিষিদ্ধ হয়েছিল প্রথা বিরোধী লেখক হুমায়ূন আজাদের ‘নারী’ গ্রন্থ।

সিরিয়ান লেখক হায়দার হায়দারের কথা হয়তো অনেকের অজানা নয়। তাঁর উপন্যাস ‘ওয়ালিমাহ লি আআশাব আল-বাহর’ মধ্যপ্র্যাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০০ সালে মিশরে বইটি পুণঃমূদ্রণের পর প্রতিক্রিয়াশীল সমাজে ক্ষোভ এবং বিদ্বেষ দেখা দেয় এবং আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে উপন্যাসটির সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করে নেয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ২০১৭ বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট বদলের কিছু সূচনা লক্ষ্য করা যায়। একদল উগ্রবাদীদের আন্দোলনের মুখে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ্যবই থেকে প্রায় ষোলোজন লেখকের লেখা সরিয়ে নেওয়া হয় এবং পাঠ্যবইগুলো আবার নতুন করে ছাপানো হয়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে হুমায়ুন আজাদ, সত্যেন সেন, জসীম উদ্দীন, লালন শাহ, এহং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ আরও বেশ কয়েকজন। এঁদের লেখাপত্র পাঠ্যবই থেকে বিদায় করে দিলেই কি তাঁদের মস্তিষ্কের সুচিন্তনের কথা নিঃশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়? আলো-কে কখনই রোধ করা যায় না, একদিন না একদিন অন্ধকার ভেদ করে নিজেকে জানান দেবেই।

এখন আসা যাক বইয়ের বর্তমান পাঠকের পাঠ অভ্যাস এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে। লেখক ই.বি হোয়াইটের মতে, সুখ বা কষ্টের যেকোনো সময়েই বই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বন্ধু। তিনি বলেছেন- ‘Books are good company, in sad times and happy times. For books are people-people who have managed to stay alive by hiding between the covers of a book.’. তবে বইয়ের আকার, আঙ্গিক বা পাঠের মাধ্যম এবং অভ্যাস অনেকটা বদলে গেছে। শুধু যে মাধ্যম বদলে গেছে তা নয়, এতো এতো ভিজ্যুয়াল ইন্টারটেনমেন্টসে্র কবলে অক্ষরে মোড়ানো বই পড়ে নিজেকে আনন্দ দেওয়ার সময় কোথায়! সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে ইউটিউব আর নেটফ্লিক্সের জগতে মানুষ যেন বইয়ের গল্প ভুলতে বসেছে।

বর্তমানে প্রিন্টেড অর্থাৎ ছাপা বইয়ের কিছুটা ভাটা পড়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই, সেটা যান্ত্রিক জীবনে সবকিছু এখন ডিজিটালাইজড হয়ে যাচ্ছে। ছাপা বইয়ের বদলে প্রকাশ হচ্ছে অডিও বুক, ই-বুক, পিডিএফ ভার্সন, ওয়েভসাইট বা ডেক্সটপ ভার্সন, ওয়ার্ড ফাইল সহ বিভিন্ন মাধ্যমে। অন্যদিকে মানুষের ঘরে বসে টেবিল-চেয়ারে বসে বই পড়ার সময় বের করা বা অবসর খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই চলার পথে, পার্কে, অফিসে, কাজের অবসরে অথবা অন্য কোনো লেজার টাইমে পড়ার জন্য ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করছে। ব্যস্ত জীবনে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে মানুষ এখন পড়ার জন্য বেছে নিয়েছে মোবাইল ফোন, কিন্ডল, আইপ্যাড, অনিক্স বুক্স নোট, কোবো, জোয়ান, ওয়াকম সহ বিভিন্ন ট্যাবলেট, যাকে এক কথায় বলে রিডিং ডিভাইস। তবু ছাপা অক্ষরের বইয়ের বিকল্প নেই। অক্ষরে ছাপা বইয়ের শরীরে এক অসাধারণ ঘ্রাণ থাকে যা পাঠককে মোহিত করে। ছাপা বইয়ের মাধ্যমে পাঠ আনন্দ যতটা উপভোগ করা যায়, ভার্চ্যুয়াল পাঠে ঠিক তেমনটা হয় না।
বই মানব জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। বাড়িতে একখানা পড়ার বই নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হবে। প্রকৃত জ্ঞান লাভের জন্য ভালো বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। একেক লেখকের একেক রকম মতাদর্শ থাকতে পারে, ভিন্ন মতামত থাকতে পারে, সচরাচর চিন্তার বাইরে আলাদা কোনো ভাবনা থাকতে পারে। সে মতাদর্শ যখনই কোনো সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা করে তখন তা নিষেধাজ্ঞার সারিতে চলে যায়।

তবুও পাঠক এক সময় সে মতবাদ খুঁজে খুঁজে পড়ে এবং ভেতরকার খুঁটিনাটি পাঠারোহণ করে নেয়। একটি ভালো বই একজন মানুষের চিন্তা চেতনাকে বদলে দিতে পারে, দিতে পারে নতুন এক আলোর সন্ধান। লেখক ডেল কার্নেগীর মতে -If I knew your thoughts make you who you r. By changing our thoughts, we can change our lives’. সাম্প্রতিকালের সবচেয়ে আলোচিত লেখক হ্যারি পটারের স্রষ্টা জে.কে রোলিং বলেছেন- ‘If you don’t like to read, you haven’t found the right book’. সত্যি তাই, আনন্দবোধের জন্য ভালো বই খুব দরকার তা না হলে মূল্যবান সময় পণ্ড হয়ে যেতে পারে। যেমন সালমান রুশদি বলেছেন- ‘A book is a version of the world. If you do not like it, ignore it; or offer your own version in return’. অবশ্যই একটি ভালো বই হোক চিরদিনের সঙ্গী।

রেফারেন্স:
১. ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিম্স’: স্বপ্নে যেভাবে কথা বলে অবচেতন মন, বিবিসি নিউজ, বাংলা, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭।
২. ভ্লাদিমির নবোকভ বায়োগ্রাফি, মেলিসা আলবার্ট, লিটারেচার, ব্রিটানিকা ওয়েবসাইট।
৩. ট্রপিক অফ ক্যন্সার, দ্যা এডিটর অফ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, ব্রিটানিকা ওয়েবসাইট।
৪. পার্সি বিসি শেলী- পয়েম্স, বুকস অ্যান্ড লাইফ – বায়োগ্রাফি, বায়োগ্রাফি ওয়েবসাইট
৫. Lady Chatterley’s Lover, Study Guide
Available at https://www.coursehero.com/lit/Lady-Chatterleys-Lover/quotes/
৬. বিখ্যাত যেসব গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়েছে, মাহফুজ রাহমান, available at https://follow-upnews.com
৭. . The 100 best novel: No 43- The Rainbow by DH Lawrence (1915) by Robert
McCrum, The Guardian, 14 July 2014
৮. A little history of reading: How the first books came to be by Carrie Burnell
published on 03 December 2019 on booktrust.or.uk. Available at
https://www.booktrust.org.uk/news-and-features/features/2019/december/a-little-
history-of-reading-how-the-first-books-came-to-be/
৯. যা আমাদের পড়তে দেয়নি, সমুদ্র সৈকত, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ- ২০১৭।
১০. https://quotestats.com/topic/books-can-change-your-life-quotes/
১১. There’s probably no God… now stop worrying and enjoy your life’: Atheist group launches billboard campaign by DAILY MAIL REPORTER UPDATED: 10:05, 7 January 2009
১২. Carl Sagan on books, Cosmos by Carl Sagan, reddit,
Available at https://www.reddit.com/r/books/comments/p4niq/carl_sagan_on_books/
১৩. . Sigmund Freud, Author(s): United States Holocaust Memorial Museum, Washington, DC
Available at https://encyclopedia.ushmm.org/content/en/article/sigmund-freud
১৪. Nazi Book Burning, How H.G. Wells Threatened Hitler by Caroline Byrne, published on The Hub Broadcasting, updated on Nov 25, 2021
Available at https://www.thehubcast.co.uk/post/nazi-book-burning
23/03/2022-28/03/2022

Uday Shankar Durjay
Crosse Courts, Essex, UK
Email: poetryoutlouduk@gmail.com
Facebook: Uday Shankar Durjay
Instagram: uday_shankar_durjay_poetry

+ posts

Read Previous

ব্রোকা অ্যাফেজিয়া, ক্রিয়াপদ ও মনোগত লেক্সিকন
রোয়েলিয়েন বাসতিয়ানস এবং রন ভ্যান জনেভেল্ড

Read Next

ভব সাগরের নাইয়্যা: ভাটির পুরুষ ওস্তাদ শাহ আব্দুল করিম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *