অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নোমান প্রধান -
ভব সাগরের নাইয়্যা: ভাটির পুরুষ ওস্তাদ শাহ আব্দুল করিম

যেই গানে মেলে প্রাণের সন্ধান
সেই গান গাওয়া হলো না
আমি গান গাইতে পারি না।।

যিনি গান নিয়েই বেঁচে ছিলেন আর গানেই যিনি বেঁচে আছেন অখণ্ড বাংলার গণমানুষের হৃদয়ে, সেই গানের মানুষ, ভাটির পুরুষ ওস্তাদ শাহ আব্দুল করিমের লেখা উপরের তিন বাক্যের কলিটি। গানের প্রতি তার বিনয়, আকাঙ্ক্ষা আর প্রেমের সহজ প্রকাশ হয় তারই গানে। তিনি মূলত ভালোবাসতেন এই দেশের মানুষকে, সেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন গান আর সুরের মত সহজ বোধ্য এক অনন্য ভাষাকে। তিনিই অবশ্য প্রথম নন, যুগে-যুগে, কালে-কালে, বাংলার মরমী বাউল, কবি ও দার্শনিকগণ গানের কথায় গেঁথে গেছেন গণমানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নাসহ নানান অনুভূতির গল্প আর সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে।

স্বাভাবিকভাবেই কোনো ব্যাক্তির জীবন ও জীবনদর্শন সম্পর্কে জানতে গেলে তার জীবদ্দশার সময়, তার সমাজ ব্যবস্থা, জীবনযাপন ও কর্ম সম্পর্কে জানা বাঞ্ছনীয়।

প্রয়াত শাহ আব্দুল করিম জন্মেছিলেন সিলেট অঞ্চলের সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলায়, গ্রামের নাম উজানধল। কালনী নদী বয়ে গেছে এই গ্রাম ঘেঁষে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মধ্যে যেই বছর লাখনৌ চুক্তি সম্পাদিত হয়, সেই বছরই বসন্তের শুরুতে শাহ আব্দুল করিমের জন্ম। উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশ সরকারের উপনিবেশ। দিনটা ছিল ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ, ১৬ই ফেব্রুয়ারি (মতান্তরে ১৫ই ফেব্রুয়ারি)। তার পিতা ইব্রাহিম আলী ও মাতা নাইওরজানের ঘর আলো করে এসেছিলেন বাংলা লোকগানের প্রবাদপুরুষ। সেদিন কেই-বা ভেবেছিল এই ছেলে একদিন সঙ্গীত সাধনা আর জীবন দর্শনের জোড়ে জয় করে নেবেন সকলের হৃদয়! পরিবারের ছয় সন্তানের মধ্যে শাহ আব্দুল করিম ছিলেন একমাত্র ছেলে সন্তান, বাকিরা সবাই কন্যা সন্তান।

দারিদ্র্র্যতা ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বেড়ে উঠা শাহ আবদুল করিমের সঙ্গীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। পরম করুণাময়ের দানে শাহ আব্দুল করিম ছিলেন অনেকাংশেই স্বশিক্ষিত এবং প্রকৃত সুশিক্ষিত। খুব ছোটোবেলাতেই তিনি বাউল শাহ ইব্রাহিম মাস্তান বক্শ এর কাছে সঙ্গীতের প্রাথমিক শিক্ষা নেন। আজও শাহ আব্দুল করিমের ওস্তাদ, আধ্যাত্মিক সাধক ও পীর শাহ ইব্রাহিম মাস্তান স্মরণে সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে ওরস আয়োজিত হয়। সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার শ্রীপুর নিবাসী ছিলেন প্রয়াত সাধক শাহ ইব্রাহিম মাস্তান। তাছাড়া শাহ আব্দুল করিমের দাদা নসিবুল্লাহও ছিলেন একজন সাধক পর্যায়ের বাউল। দাদার কাছেই একতারা আর সুরের হাতখড়ি হওয়ার সম্ভাবনা বেশ প্রবল।

জাতীয় পত্রিকা যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে কবি ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান লিখেছেন, ‘’দাদার মুখে আধ্যাত্মিক গান- ‘ভাবিয়া দেখ তোর মনে/মাটির সারিন্দারে বাজায় কোনজনে’ শুনেই গানের প্রতি দরদ অনুভব করেন তিনি। একতারায় সুর তোলার শিক্ষা পেতে দূরে যেতে হয়নি, দাদার কাছেই শৈশবে এ শিক্ষা নিয়েছিলেন’’।

নসিবুল্লাহ ছিলেন শাহ আব্দুল করিমের দাদার ছোটো ভাই। নিজের দাদার আদর পাওয়ার সৌভাগ্য না হলেও নসিবুল্লাহর অকৃত্তিম আদর পেয়েছিলেন তিনি। নসিবুল্লাহ সাহেব ফকিরি করতেন, তার কাছে হিন্দু-মুসলমান, সাধু-ফকিরসহ সকল শ্রেণির মানুষের অবাধ আসা-যাওয়া ছিল। আব্দুল করিমের মা নাইওরজান যখন রান্না বা গৃহস্থলির কাজে ব্যস্ত থাকতেন তখন নসিবুল্লাই শিশু করিমকে কোলে পিঠে রাখতেন।

তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও ওস্তাদ করিম নিরক্ষর নন। পবিত্র কোরআন পড়া শিখেছেন ওস্তাদ ছমরু মিয়া মুন্সির কাছে, বাংলা বর্ণমালায় হাতেখড়ি করিয়েছেন তৈমুর চৌধুরী। দিনের বেলা কাজে আটকে পড়ে থাকায় তৈমুর চৌধুরীর নৈশ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন বালক করিম। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণেই হয়তো গ্রামের এক গুজবের কারণে মাত্র অষ্টম দিনেই বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যায়। বালক করিম সেই বিদ্যালয়ে পাওয়া বর্ণমালার একটি বইকে পুঁজি করেই কাজের ফাঁকে স্ব-শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেন। আর দারিদ্রতার সংকীর্ণতায় ভরা জীবন যখন নিজেই শিক্ষক হয়ে উঠে কঠিনভাবে শিক্ষা দেয় তখন আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ কোথায়! পরিবারের অর্থনৈতিক জীর্ণতার দরুন খুব অল্প বয়সেই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সংসারের জোয়াল।

তবে শাহ আব্দুল করিম ছোটোবেলা থেকেই ছিলেন ডানপিটে স্বভাবের, অল্প বয়সেই চষে বেড়িয়েছেন ভাটি অঞ্চল। খুব কাছ থেকে দেখেছেন মানুষের সুখ-দুঃখ। বাল্যকালে তিনি একাকী ঘুরে বেড়াতেন, নিজের আপন মনে বসে থাকতেন কালনী নদীর পাড়ে। দেখতেন সারি গান সেঁধে মাঝি-মাল্লাদের চলাচল। ভাটির জনপদ, কালনী নদী তথা সমস্ত প্রকৃতি তাকে উপহার দিয়েছে মুক্ত জীবনের বোধ। নিজের বাল্যকাল নিয়েও গান বাধা আছে ওস্তাদ শাহ আব্দুল করিমের। গানের কথার ভাঁজে ভাঁজে নিজের শৈশবের বিবরণ দিয়েছেন তিনি। স্বশৈশব নিয়ে ওস্তাদ করিম লিখেছিলেন-

গরিব কূলে জন্ম আমার আজো তা মনে পড়ে
ছোটো বেলা বাস করিতাম ছোট্ট এক কুঁড়ে ঘরে
দিন কাটিতো অর্ধাহারে, রোগে কোনো ঔষধ নাই
আরেক গঞ্জে জন্ম যাদের তেরশ বাইশ বাংলায়
আনন্দে খেলে তারা, ইস্কুলে পড়িতে যায়
আমার মনের দুর্বলতায় একা থাকা ভালো পায়
মনের দুঃখ কার কাছে জানাই?

জমিদার বাড়িতে ‘বন্ধান’ কাজে বাঁধা থাকতেন, রাখাল হয়ে গরু চড়িয়ে বেড়াতেন মাঠে-ঘাটে সারাদিন ধরেই। দুমুঠো অন্ন জোগাড়ের জন্য শৈশবে যতটুকু পরিশ্রম করা সম্ভব, তা করতে গিয়ে নিজের সবটুকুই নিংড়ে দিয়েছিলেন তিনি। তবুও ছোট্ট আব্দুল করিমের মনে জাগতিক লোভ জাগেনি বরং তিনি মজেছেন গান নিয়েই। জীবনের সুখ-দুঃখ, বিরহ-বেদনা আর প্রার্থনার কথা তিনি গেয়েছেন সেই গানে।

উপমহাদেশ তখন পরাধীনতার শৃঙ্খলে থাকলেও গ্রাম-বাংলার জনজীবনে অনেকাংশেই ছিল স্বাধীনতা। গ্রামীণ সমাজ প্রবাহিত হতো নিজের ধারায়, সর্বাঙ্গে ছিল তার স্বকীয়তা। সে সময়টায় যাতায়াত ছিল নদী নির্ভর আর অর্থনীতি ছিল কৃষি ও হাট-বাজার কেন্দ্রিক। হাওড়ে ব্যস্ততার সময়ে সমস্ত জনপদ ব্যস্ত হতো কর্মযজ্ঞে আবার অবসরের সময়টাতে সবাই পেতো বিস্তর ফুসরত। সমাজে উৎসবে আমেজে সবাই এক সাথে মেতে উঠতো। সাধারণ জীবন ধারণে বাঙালির মাঝে কঠিন কোনো দেয়াল ছিল না। ধর্ম বা রাজনীতি ব্যবস্থা পুঁজি করে সুযোগ সন্ধানী কেউ কেউ মতভেদ করতে চাইলেও এদেশীয় সংস্কৃতিতে তা সফল হয়নি কখনও। নিজের চোখে দেখা সময়টার বিবরণ দিতে গিয়েই হয়তো শাহ আব্দুল করিম গেয়েছিলেন-

গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।

অহিংস বাংলার পেছনে নিরবে বড়ো অবদান রেখে গেছেন বাংলার বাউল সাধকগণ, বাংলার শাহ আব্দুল করিমেরা। বাউলদের দর্শনের গভীর ভাবতত্ত্বের সাথে নির্লোভ জীবন যাপন, বাহ্যিকতার প্রতি উদাসীনতা আর সুর-সাগরে যাত্রার স্বাতন্ত্র্য কালে কালে প্রভাব ফেলেছে বাংলার প্রান্তরে। দেহতত্ত্বের ভাব পুঁজি করা সুচিন্তক সাধক আব্দুল করিম এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। ‘গান গাই আমার মনরে বোঝাই’, ‘যা হইবার তা হয়ে গেছে’, ‘দমে দমে পর জিকির লা ইলাহা ইল্লাললাহ’, ‘যার যা ইচ্ছা তাই বলে বুঝিনা আসল নকল’, ‘যা দিয়েছো তুমি আমায় কি দিবো তার প্রতিদান’, ‘আমি এই মিনতি করি রে’, ‘ভব সাগরের নাইয়্যা’ সহ রচনা করেছেন পাঁচশতাধিক (মতান্তরে সহস্রাধিক) গান যার অধিকাংশই বেশ জনপ্রিয় ও লোকমুখে প্রচলিত। দেহতত্ত্ব নিয়েও তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য গান। তার মধ্যে-

চন্দ্র-সূর্য বান্ধা আছে নায়েরই আগায়
দূরবিনে দেখিয়া পথ মাঝি-মাল্লায় বায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়
কোন মিস্তরি নাও বানাইলো রে।।
রঙ-বেরঙের কতো নৌকা ভবের তলায় আয়
রঙ-বেরঙের সারি গাইয়া ভাটি বাইয়া যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়
কোন মিস্তরি নাও বানাইলো রে – গানটি বেশ সমাদৃত ও জনপ্রিয়।

উপরোক্ত গানের ব্যাখ্যায় স্ববয়ানে, ‘ভাটির পুরুষ’ প্রামাণ্য চিত্রে শাহ আব্দুল করিম বলেছেন, “ময়ূরপঙ্খী নাওডা আমার এইডারে(শরীরকে)কইছি। আমার দেহডারে কইছি(বুঝিয়েছি)।

প্রকৃত মানুষের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন মানুষ সৃষ্টির সেরা প্রাণ। বাহ্যিক বেশভূষা, অর্জিত সম্পদ কিংবা পেশা দিয়ে মানুষকে বিচারের পক্ষপাতি ছিলেন না তিনি। স্বজাতিতে ভেদাভেদ দেখে প্রাণ কাঁদতো শাহ আব্দুল করিমের। মানুষে মানুষে যুদ্ধ সহ্য করার মতো কঠিন অন্তর ছিল না আব্দুল করিমের। দুর্বল মানুষের উপর সবলের অত্যাচারে ব্যথিত হতো এই মহৎ প্রাণের অন্তর। শাহ আবদুল করিম জীবনভর বাংলার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির প্রতি অত্যন্ত আস্থাশীল ছিলেন। বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সহ যেকোনো মতবাদের মানুষের জন্য তার মরমে ছিল মায়া। তার একাধিক গানের কথায় এর প্রমাণ মিলে। যদিও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে তাকে ‘নাস্তিক’ বলে মনে করতেন অনেকে। তবে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন-

‘আমি নাস্তিক বা কমিউনিস্ট নই। আমি আল্লাহর ওপর বিশ্বাসী। শেষ নিঃশ্বাস যেন ত্যাগ হয় আল্লাহ আল্লাহ বলে। এটাই আমার শেষ কথা। তারা আমাকে নাস্তিক কিংবা অন্য যা কিছু বলুক।’ (সূত্রঃ sarabangla.net)

বাউল শাহ আব্দুল করিমের যৌবনের উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি তার বিয়ে। কালশিরা হত্যাকাণ্ডের পরের বছর, নাচোলের হত্যাকাণ্ড ও দাঙ্গায় যখন পূর্ববাংলার অনেকাংশ রক্তাক্ত সে বছর শাহ আব্দুল করিম বিয়ে করে ঘরে তোলেন বৈশাখীকে। বাউল করিম তার স্ত্রী সরলা ওরফে বৈশাখীকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসতেন। সরলা নামটি শিল্পী নিজেই দিয়েছিলেন তার স্ত্রীকে। গানও বেধেছেন প্রিয় সরলাকে নিয়ে। পৃথিবীতে আশা যাওয়ার নিয়মে একসময় চলে গেছেন সরলা। নিজের ভিটার ঠিক উল্টোদিকে স্ত্রীকে সমাহিত করেছেন, বাঁধিয়ে রেখেছেন কবর। নিজের স্ত্রী সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভাটির পুরুষ গান বাঁধেন-

“সরলতুমি, শান্ত তুমি
তুমি নূরের পুতুলা
সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা” ।

বাউলের সরল পারিবারিক জীবন নিয়ে সামান্য রহস্য আছে। স্থপতি, নাট্যকার, তথ্যচিত্র নির্মাতা শাকুর মজিদের লেখা ‘সরলা উপাখ্যান’ প্রবন্ধের চুম্বকাংশ তুলে ধরলাম পাঠকদের জন্য। প্রবন্ধটি ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল:

“শাহ আবদুল করিমের স্ত্রী ‘সরলা’কে নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। ৪০ বছরের দাম্পত্য জীবন ছিল করিমের সঙ্গে তাঁর। শাহ করিম সরলাকে নিয়ে লিখেছেন অনেকগুলো গানও। নিজের বসতভিটায় তাঁর জন্য বানিয়েছেন ‘শাহ করিম জাহানের সরলামহল’ কবরখানি। ২০০৩ থেকে ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুদিন পর্যন্ত নানাভাবে তাঁর কাছাকাছি থেকেও এই ‘সরলা’ আমার কাছে এক রহস্যময়ী নারী হিসেবেই থেকে যান। বারান্দায় বেশ কজন এসে ভিড়েছেন। ভাবলাম, এ অবসরে ‘সরলা রহস্য’ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করি। শাহ আবদুল করিমের ছেলে শাহ নুর জালাল বাবুলকে বসালাম ক্যামেরার সামনে। শুরু হয় কথাবার্তা-

‘আপনার মা সরলার সঙ্গে আপনার বাবার বিয়ে হয়েছে কত বছর বয়সে?’
‘বাবার পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে, ১৯৫০ সালে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর বিয়ের ষোলো বছর পর আমার জন্ম হয়েছে। মা মারা যান ১৯৯০ সালে।’
‘এর আগে আপনার বাবা একটা বিয়ে করেছিলেন। এটা সম্পর্কে কিছু বলুন।’
‘সেটা বলতে পারব না।’

বারান্দায় বসে আছেন সরলার ভাই আফতাব আলী। তিনি বললেন, ‘আমার বোনের সঙ্গে বিয়ের সময় আমরা জানতাম না, পরে শুনেছি তাঁর আরেকটা বিয়ে হয়েছিল। ওই মহিলার ডাকনাম ছিল বৈশাখী এবং আসল নাম আফতাবুন নেসা।’

নুর জালাল প্রথমে তাঁর বাবার প্রথম বিয়ের বিষয়টি একেবারেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিষয়টা তিনি জানেন না। কিন্তু মামার কথা শুনে এখন আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। বললেন, দিরাইর কাছে ভাটি এলাকায় রন্নারচর নামে গ্রামের মমজান নামের এক নারীকে তাঁর বাবা বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু ওই বিয়ে টেকেনি” । পাঠকগণ, শাহ করিম সাহেবের সান্নিধ্য পাওয়া শাকুর মজিদের লেখা প্রবন্ধ থেকে রহস্য উন্মোচিত হবে না, বরং আপনারা ধারণা পাবেন রহস্য সম্পর্কে। শাহ আব্দুল করিম যেই আখ্যানকে রহস্যে রেখে যেতে চেয়েছেন তা নাহয় রহস্যেই থাকুক।

শাহ আব্দুল করিম ধর্ম পালনে কখনও বাড়াবাড়ি পছন্দ করেননি। আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক এই বাউল গানের মধ্যেও করেছেন সাম্য ও মানবাধিকারের চর্চা। ততকালীন সমাজে তার চড়া মূল্যও তাকে দিতে হয়েছে। অনেক সময় কাঠ মোল্লাদের ফতোয়া এসেছে তার ওপর, উগ্র ধর্মান্ধরা তার বিরুদ্ধে লেগেছিলেন। অনেক সময় ওয়াজ মাহফিল থেকে তাকে গালাগালি করা হতো বলে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

তাছাড়াও ঈদের জামায়াতে বা জুমার নামাজেও তাকে কম ভর্ৎসনা শুনতে হয়নি। তার স্ত্রী সরলা ও নিকট শিষ্য আকবরের মৃত্যুর পর জানাজা পড়াতে চাননি তৎকালীন মসজিদের ইমাম। তবুও সামাজিক অজ্ঞতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সাতরে যাওয়ার সংগ্রামটা চালিয়ে যাওয়া থেকে কেউ তাকে নড়াতে পারেনি। এমনকি শুধু গান গাওয়ার অপরাধে তাকে একবার গ্রাম থেকে বের করেও দেওয়া হয়েছিল! এসব ঘটনায় তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন বলে অনেক জায়গায় বলে গেছেন। সেই লোকের কথা থেকে পাওয়া দুঃখবোধ থেকে একটি গানও রচনা করেছেন তিনি-

ধর্ম কর্মের ধার ধারে না
গান বাজনাতে রয় বিভোর
হিংসাখোরগণ বলে এখন
আব্দুল করিম নেশাখোর
মানুষের সঙ্গ করিলে
মানুষ তখন মানুষ হয়
জন্ম-জড়া-যম-যাতনা
থাকে না তার কোনো ভয়
বাউল আব্দুল করিমে কয়
নয়ন রাখো মাশুকপুর
হিংসাখোরগণ বলে এখন
আব্দুল করিম নেশাখোর।

কিন্তু কারো উপর তার কোন অভিযোগ ছিল না, ক্ষোভ ছিল না। তিনি নিজ জ্ঞান সাধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন ভালোবাসার বার্তা। কারণ একটা বিশেষ স্বপ্ন তিনি লালন করতেন। আর ঘাত প্রতিঘাতের নামই যে জীবন তাও খুব ভালোই জানতেন শেষ বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। তার স্বপ্ন ছিল এমন যে, পৃথিবীটা একদিন বাউলের হবে। যে পৃথিবীতে সকল মানুষ সাম্যতায় বাঁচে, যে ধরায় মানুষের খড়গ নামে না কোনো মজদুরের উপর, বাহ্যিক চাকচিক্য বর্জিত যে পৃথিবীতে নিজের স্বকীয়তা আঁকড়ে বাঁচতে কেউ লজ্জা বোধ করে না, এমন পৃথিবীটাই হয়ত বাউলের হবে।

আব্দুল করিমের জীবদ্দশায় তার গান ব্যবহার করে অনেকেই পেয়েছিলেন সুখ্যাতি, পয়সা ও পসার। কিন্তু তিনি নিজে কোনোদিন সেই পথে হাঁটেননি। ভারতের প্রখ্যাত লোকশিল্পী প্রয়াত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য একবার বাউল শাহ আবদুল করিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়। আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলে না। এসব দেখতে আপনার খারাপ লাগে না?”

শাহ আবদুল করিম বললেন, “কথা বোঝা গেলেই হইল। আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই।”
কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য আশ্চর্য হয়ে বললেন, “আপনার সৃষ্টি, আপনার গান। মানুষ আপনার সামনে বিকৃত করে গাইবে। আপনি কিছুই মনে করবেন না। এটা কোনো কথা, এটার কোনো অর্থ আছে!”

জবাবে শাহ আবদুল করিম কালিকা প্রসাদকে বললেন, “তুমি তো গান গাও, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। ধরো, তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো। হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে, কিন্তু গান শুনতে কোনো মানুষ আসেনি। শুধু সামনের সারিতে একটা মানুষ বসে আছে। গাইতে পারবে?”

কালিকাপ্রসাদ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলেন, “না, পারব না।”

শাহ আবদুল করিম হেসে বললেন, “আমি পারব। কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়ে আমি একটা আদর্শকে প্রচার করতে চাই, সেটা একজন মানুষের কাছে হলেও। সুর না থাকুক, নাম না থাকুক, সেই আদর্শটা থাকলেই হলো। আর কিছু দরকার নাই৷ সেজন্যই বললাম, শুধু গানের কথা বোঝা গেলেই আমি খুশি।”

অবাক হয়ে কালিকা প্রসাদ তখন জানতে চাইলেন, “সেই আদর্শটা কী?”
বাউল করিম ফের হেসে জানালেন, “একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে।”
কি ভেবে যেনো আব্দুল করিম গেয়েছিলেন-
“যার যা ইচ্ছা তাই বলে বুঝি না আসল-নকল
কেউ বলে শাহ আবদুল করিম কেউ বলে পাগল
জন্ম আমার সিলেট জেলায়, সুনামগঞ্জ মহকুমায়
বসত করি দিরাই থানায়, গাঁয়ের নাম হয় উজানধল
কেউ বলে শাহ আবদুল করিম কেউ বলে পাগল
কালনী নদীর উত্তরপাড়ে, আছি এক কুঁড়েঘরে
পোস্ট-অফিস হয় ধল-বাজারে, ইউনিয়ন তাড়ল
কেউ বলে শাহ আবদুল করিম কেউ বলে পাগল
পিতার নাম ইব্রাহিম আলী, সোজা-সরল আল্লার অলি
পীর-মুর্শিদের চরণ-ধুলি করিমের সম্বল
কেউ বলে শাহ আবদুল করিম কেউ বলে পাগল” ।

নিজের স্বকীয়তায় ও কর্মগুণে খুব অল্প সময়ে বাউল আব্দুল করিম পেয়েছিলেন মানুষের ভালোবাসা। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে অনেক গুণি শিল্পী আব্দুল করিমের গানের কথার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। তার মধ্যে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন অন্যতম। লাল মাওলানা ভাসানি ভালোবেসে একবার বলেছিলেন, “করিম হবে গণমানুষের শিল্পী”। পরবর্তীতে তার একথার সত্যতা আমরা দেখতে পাই। আর শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি করিম ভাইয়ের খুব ভক্ত, শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে করিমও বেঁচে থাকবে’। সত্যি, আজও লাখো প্রাণে বেঁচে আছেন তারা।

লোক সাহিত্যের সবচেয়ে সুন্দর দিক, গণমানুষের অনুভূতির সাথে মিশে যাওয়ায়। বিগত কয়েক শতাব্দীতে বাংলার লোক সংস্কৃতির উন্মুক্ত গগনে ফকির লালন, পাঞ্জু শাহ, গগন হরকরা, হাসন রাজা, শীতালং ফকির, সৈয়দ শাহ নূর, উকিল মুন্সী সহ উল্লেখ্যযোগ্য নক্ষত্রমন্ডলীর আগমন ঘটেছে; যারা আজও বেঁচে আছেন অখণ্ড বাংলার গণমানুষের মাঝে। তবে কর্ম ও দর্শনে পরিপূর্ণতা নিয়ে শাহ আব্দুল করিমের পরবর্তীতে উল্লেখ্যযোগ্য তেমন কারো আত্মপ্রকাশ ঘটেনি। তাই ভক্তকুল ও লোকসাহিত্য প্রেমীরা তাঁকে ভালোবেসেই শেষ বাউল সম্রাট হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে।

সমৃদ্ধ কর্ম জীবনে তিনি পাঁচ শতাধিকের অধিক গান রচনা করেছেন, মতান্তরে সহস্রাধিক। অসংখ্য শিষ্য ছিল উনার, যাদের তিনি শিখিয়েছেন গানের গায়কি ও লিখনী। বাউল আব্দুল করিম তার গান নিয়ে প্রকাশিত করেছেন সাতটি গ্রন্থ। পর্যায়ক্রমে আফতাব সঙ্গীত, গণ সঙ্গীত, কালনীর ঢেউ, ধলমেলা, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে ও সর্বশেষে শুভেন্দু ইমামের সংকলনে শাহ আব্দুল করিম রচনাসমগ্র- নামক বইগুলো তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়।

কর্মের বিনিময়ে সারাজীবন যেমন কামিয়েছেন মানুষের প্রেম ও ভালোবাসা, কুড়িয়েছেন সম্মান তেমনি পেয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘একুশে পদক’ পেয়েছেন ২০০১ সালে। তাছাড়াও লেবাক অ্যাওয়ার্ড, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা, খান বাহাদুর পদক সহ পেয়েছেন আরও বেশ কিছু সম্মাননা ও পদক। তবে শাহ আব্দুল করিম স্ববয়ানে বলে গেছেন, তার সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তির কথা। কাগমারি সম্মেলনে, জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাকে বলেছিলেন, ‘তুই মানুষের শিল্পী’। একজন নির্লোভ, জনদরদী ও মজদুর মানুষের নেতার কাছ থেকে পাওয়া স্বীকৃতিকে তিনি সবচেয়ে বড়ো পাওয়া বলে লালন করেছেন আমৃত্যু।

কালের অমোঘ নিয়তিতে একদিন কর্মযজ্ঞ শেষ হয় প্রতিটা নশ্বর মানুষের, চলে যেতে হয় ভবের মায়া ছেড়ে। ২০০৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর, পরিবার ও অগণিত ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান বাউল শাহ আব্দুল করিম। ক্ষণিকের জীবনে দেহ ত্যাগ করলেও কর্ম, ত্যাগ ও গানের সুরে তিনি চিরকালের মতন জায়গা করে নিয়েছেন বাঙালির হৃদয়ে। কর্ম উদ্যমে পরিপূর্ণ শাহ আব্দুল করিমের নির্লোভ ও নিরলস জীবন কেবল অনন্য উদাহরণই নয়, বিকশিত হতে চাওয়া প্রতিটি মানুষের জন্য উৎসাহ স্বরূপ। জীবনের কষাঘাত পেরিয়ে, শত প্রতিকূলতায় নিজের স্বপ্নের সাথে বেঁচে থাকার এক সত্য চরিত্র বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম।

বাউল শাহ আব্দুল করিমের জীবন, দর্শন আর গান বাঙালির মনে আনবে প্রাণের সঞ্চার, অনুভব করাবে শিকড়ের প্রতি টান যা প্রতিটি প্রাণেই আছে সুপ্ত। আর কেই বা না বুঝে, শিল্পীর তুলিতে আঁকা মহান এবং কল্যাণকর যত সৃষ্টি তা বরাররই সার্বজনীন।

(আমার কাঁচা হাতে বাউল শাহ আব্দুল করিমকে নিয়ে নিবন্ধটি লিখতে গিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ, ওয়েবসাইট, পত্রিকা ও প্রামাণ্য চিত্রের সাহায্য নিতে হয়েছে। পেয়েছি চমৎকার ও দুর্লভ কিছু তথ্য। তার কতটা সদ্ব্যবহার করতে পেরেছি জানি না। যারা আজও লোকসংস্কৃতিকে ভালোবেসে তথ্য ও উপাত্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন তাদের শ্রী চরণে হাজারো সালাম ও অসংখ্য ধন্যবাদ) ।

+ posts

নোমান প্রধান। মাতা, শিক্ষিকা নাছরিন বেগম এবং পিতা, কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মোছলেহ উদ্দিনের কনিষ্ঠ সন্তান নোমান প্রধানের জন্ম নরসিংদী সদর উপজেলার বানিয়াছলে। শিক্ষা জীবনে, নরসিংদী জেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্রাক্ষ্মন্দী কে.কে.এম সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শেষ করে কলেজের পাঠ নরসিংদী সরকারী কলেজে। পরবর্তীতে ঢাকাস্থ একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করা হয়।

সাহিত্যচর্চা শুরু হয়, শিক্ষা জীবনের শেষ দিকে ব্লগে লেখার মাধ্যমে। পরবর্তীতে সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখির ও লোক স্বংকৃতির প্রচারণামূলক কাজের মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা চলতে থাকে। বর্তমানে কবিতা, গান, চিত্রনাট্য, ছোট গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস লেখার মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা অব্যাহত আছে।

প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহঃ কাব্যগ্রন্থ- শ্রেষ্ঠাংশে (২০১৯), গদ্যগ্রন্থ- বহুরূপী মৃত্যু (২০২১)

Read Previous

বই : সৃজনশীল মননের চিরকালীন সঙ্গী

Read Next

জগদীশ গুপ্ত : এক বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্য প্রতিভা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *