অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মো. জাহিদুর রহমান -
সৈয়দ জাহাঙ্গীর : চিত্রকলায় ‘আত্মার উজ্জীবন’

‘ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করত। বাড়ি থেকে কিছুদূরে একটা মজা পুকুরপাড়ে বাঁকানো একটা নারকেলগাছের ওপর বসে পাশের বিস্তীর্ণ মাঠে সবুজ ধানখেতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে হিন্দোলিত ধানখেত দেখে মনে হতো একটা স্রোতস্বিনী সবুজ নদীর মতো। গভীর বিস্ময়ে দেখতাম প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। জ্যৈষ্ঠের খুব ভোরে দোয়েলের ডাক শুনে ঘুম ভেঙে যেত। একলাফে চলে যেতাম আমবাগানে। ভয় হতো কেউ আগেই সেখানে গিয়ে আম কুড়িয়ে নিল কিনা। খুব ভোরে আম কুড়াতে যেত ছেলে-বুড়ো সবাই। তবে একটু ঝামেলাও ছিল একটা বাগানে— ওখানে ছিল আনারস বাগান। আনারসের পাতার কিনার দিয়ে থাকে ধারাল সব কাঁটা। ওই কাঁটা বাঁচিয়ে এগিয়ে যেতে আঁচড় খেতেই হতো। আর আম যদি ওই পাতার ফাঁকে গিয়ে পড়ত, সেটা উদ্ধার করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। আমগাছের বিচিত্র সব নামও ছিল: সিন্দুরে, সড়েঙ্গা, চুষে, ভুইর মধ্যি, রসগোল্লা, দলদলে, নাইতোলা, গোপালভোগ, বোম্বাই, জালিবান্দা আরও কত কী! আজও দোয়েলের ডাক শুনলে সেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। এখনো যখন দেখি নানা বর্ণের সবুজ গাছের গা ঘেঁষে বিস্তীর্ণ ধানখেত যার মাঝে মাঝে পাকা ধানের সোনালি বিস্তার, নিমেষেই স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠে পৌষের বিকেলে কৃষকের ধান কাটা শেষে গরুর গাড়িতে তুলে নেওয়ার সেই দৃশ্য। সেই সোনালি ধানখেত, আলট্রামেরিন আকাশ, মাটি আর মানুষ এখন আমার ক্যানভাসে।’

—সৈয়দ জাহাঙ্গীর, আত্মপ্রতিকৃতি : স্মৃতির মানচিত্র

বাংলাদেশের চিত্রকলা আন্দোলনের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের একজন ছিলেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর (১৯৩৫-২০১৮)। বাংলাদেশের চিত্রকলায় আধুনিকতার পথ নির্মাণ ও সৃজনযাত্রায় তিনি অগ্রণী চিত্রকর হয়ে উঠেছিলেন। ক্যানভাসের ব্যাপ্তি ও বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে বাংলার নিসর্গ ও মানুষের নানা অনুষঙ্গ তাকে করে তুলেছিল পঞ্চাশ দশকের খ্যাতিমান শিল্পীদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন।

সৈয়দ জাহাঙ্গীর ১৯৩৫ সালের ২ জানুয়ারি নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি সাতক্ষীরা জেলার তালা থানার অন্তর্গত তেঁতুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে চাচা সৈয়দ জালালউদ্দীন হাশেমীর কলকাতার বাসায় বেড়াতে গিয়ে তাঁর শিশুমনে রঙ ও ছবির প্রতি ভালোলাগা তৈরী হয়। চাচা সৈয়দ জালালউদ্দীন হাশেমী ছিলেন বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য (এমএলএ)। অফিসিয়াল কাজে তিনি লাল ও নীল রঙের পেনসিল ব্যবহার করতেন। লাল-নীলের আঁকিবুঁকি সৈয়দ জাহাঙ্গীরের বালকমনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। জনাব হাশেমীর অফিসে আরদালি হিসেবে একজন উড়িষ্যার মানুষ কাজ করতেন। তার পরনে ছিল লাল রঙের জমিনের ওপর সোনালি সব বেল্ট ও রশি দিয়ে তৈরি ঝকমকে সুন্দর পোশাক। তিনিও ওই লাল-নীল পেনসিল দিয়ে সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকতেন। বালক জাহাঙ্গীর বিস্ময়ে দেখতেন ‘ডানাওয়ালা দুলদুল ঘোড়া তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত’ ছবি। তেঁতুলিয়ায় গ্রামের বাড়িতে কলকাতা থেকে যেসব বই ও পত্র-পত্রিকা আসত, বালক জাহাঙ্গীর তা উল্টেপাল্টে দেখতেন, সেসবের ভেতর যত ছবি ও ইলাস্ট্রেশন তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন আর কপি করতেন।

তালার বিডি ইনস্টিটিউশন থেকে ১৯৫০ সালে এসএসসি পাস করেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর। এরপর অগ্রজ সিকান্‌দার আবু জাফরের পরামর্শে ঢাকায় নব্য স্থাপিত গভর্নমেন্ট ইন্সটিটিউট অব আর্টস (চারুকলা কলেজ)-এ ভর্তি হন তিনি। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, সফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, শফিকুল আমিন, খাজা শফীক আহমেদ প্রমুখকে। সতীর্থ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন আমিনুল ইসলাম, কাইয়ূম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, মবিনুল আজম প্রমুখ।

আর্ট কলেজের ছাত্র সৈয়দ জাহাঙ্গীর তার সতীর্থ ও বন্ধুদের নিয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় এবং শহরের বাইরে ঘুরতে বেরোতেন ছবি আঁকার জন্য। কখনো বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ভাড়া করে ঘুরতেন সারাদিন। ছবি আঁকতেন প্রাকৃতিক দৃশ্যের বিশেষত নদীর পার আর ধানখেতের। আঁকতেন পুরাকীর্তির ছবি— সদরঘাট, বড় কাটরা, ছোট কাটরার ছবি।

১৯৫৫ সালে সৈয়দ জাহাঙ্গীর বিএফএ পাস করেন। এর আগে ছাত্রাবস্থায় ১৯৫৩ সালে সহপাঠীদের নিয়ে তিনি ‘ইস্ট আর্টস গ্রুপ’ নামে সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৫৬ সালে বন্ধুবর মুর্তজা বশীর ও কাইয়ূম চৌধুরী সহযোগে ‘পেইন্টার্স ইউনিট’ নামে সংগঠন গড়ে তোলেন। এ বছর প্রেসক্লাবে তাদের চিত্র প্রদর্শনী হয়। প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এ চিত্রপ্রদর্শনী তার শিল্পদক্ষতার পরিচিতি ঘটানোর মাধ্যমে তাঁকে একজন প্রতিনিধিত্বশীল চিত্রকর হিসেবে স্পষ্ট করে তুলেছিল।

পঞ্চাশের দশকের শেষপর্যায়ে ১৯৫৮ সালে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে আমেরিকায় যান সৈয়দ জাহাঙ্গীর। আমেরিকা গিয়ে তিনি শেখেন ছবি প্রদর্শন ও সংরক্ষণের রীতিনীতি, আলো ও আর্দ্রতার নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে। এর পরপরই জাহাঙ্গীরের জলরঙের কাজে এক ধরনের নতুনত্ব প্রকাশ পেতে থাকে। আমেরিকার প্রধানতম জলরং শিল্পী জন মারিনের কাজ নতুন করে উদ্দীপিত করে জাহাঙ্গীরকে। বর্ণের উল্লাস ও উদ্দামতার বেগকে তিনি প্রকৃতির একটা আলাদা ভাব হিসেবে ধরে রাখতে চাইলেন। শৈলী বিদেশি হলেও শিল্পী মনে-প্রাণে ও উপাদান-অনুষঙ্গে স্বদেশি হওয়ার কারণে ছবিগুলো স্বাতন্ত্র্য পেতে থাকে। সত্তরের দশকের শুরু থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত তিনি নিসর্গ ও গ্রামীণ জীবনোপাদান আঁকেন ‘অজানার অন্বেষায়’ শীর্ষক সিরিজে।

সৈয়দ জাহাঙ্গীরের সৃষ্টিকর্মের বেশির ভাগই গ্রামবাংলার জীবন ও নিসর্গ নিয়ে। প্রকৃতি ও ঋতু পরিবর্তন তার চিত্রকর্মের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তার ক্যানভাসে যেমন সযত্নে উঠে এসেছে বাংলার সরল প্রকৃতি ও মানুষের নানা অনুষঙ্গ, তেমনি তার নির্মাণশৈলীতেও ছিল সহজ ছন্দ। ক্যানভাসে বিস্তীর্ণতা ও শূন্যস্থানের ব্যবহার আর রঙের সহজ প্রকাশভঙ্গি তার কাজের স্বাতন্ত্র্য নির্মাণ করেছে। নিসর্গ প্রাধান্যের সঙ্গে তার ছবিতে বারবারই উঠে এসেছে মানুষের শ্রম, ভালোবাসা ও বন্ধনের দৃশ্যকাব্য। মূর্ত ও বিমূর্ত উভয় ক্ষেত্রেই সমকালীন চিত্রকলা অঙ্গনে সৈয়দ জাহাঙ্গীর সাফল্যের সাক্ষর রাখলেন। তার চিত্রকর্মকে বিমূর্ত-আধাবিমূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন অনেকেই। বাংলাদেশের গ্রামের মুক্ত আকাশ, প্রান্তরময় বিশালতার উপস্থাপনে তার বেশির ভাগ ছবিতে ক্যানভাসের জমিনজুড়ে রাজত্ব করেছে নীল ও হলুদ দুই রং। তবে ঋতুবৈচিত্র্যের নানা রংও তার ক্যানভাসে স্বতন্ত্র প্রয়োগভঙ্গিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে এসেছে। তার ক্যানভাসে একই সঙ্গে শক্তি ও ঋজুতার প্রকাশ ঘটেছে। বলা যায়, জীবনের বিপরীত অনেক ভাব ও বোধের সম্মিলন ঘটিয়েছেন তিনি তাঁর ছবিতে।

সুদীর্ঘ ছয় দশক ধরে বিস্তৃত শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরের শিল্পজীবন। তারুণ্যের নিরীক্ষা, সাহস ও উদ্দীপনা তার ক্যানভাসে সর্বদা ভাস্বর হতে দেখা যেত। প্রথমে শুরু করেছিলেন জলরঙের মাধ্যমে। এর আগে ছিল ড্রইং। সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ড্রইংনৈপুণ্য তৎকালীন শিল্পানুরাগীদের মধ্যে প্রায় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বিশেষ করে পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমৃত্যু গ্রামবাংলার নিসর্গকেই নানাভাবে তার করণকৌশলের স্বাতন্ত্র্যে নির্মাণ করে গেছেন শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর। মৃত্যুর কয়েক বছর আগেও জাহাঙ্গীরের ‘মাটি ও মানুষ’ নামক ৩৬তম একক প্রদর্শনীর কাজগুলোতেও পাওয়া গেছে প্রকৃতি ও মানুষের নানা অনুষঙ্গ। রঙ ও ক্যানভাসের বুনটের সমন্বিত এক সহজ ছন্দ তার সৃষ্টিকে করে তুলেছে তাৎপর্যময়। ক্যানভাস ছাড়াও শিল্পী কাগজের ওপর অ্যাক্রিলিকের জমিন ও রেখায় কৃষি ও জেলেজীবন, ফসলের খেত, ঘাটে বাঁধা নৌকার সারি— এসব বিষয়কে উপজীব্য করেছেন। শিল্পচর্চার প্রায় পুরোটাই সৈয়দ জাহাঙ্গীর নীল, হলুদ, সবুজ, সোনালি রঙে কম্পোজিশন ও স্পেসের ব্যবহারের মাধ্যমে পাশ্চাত্য ধারায় প্রাচ্যের গ্রামীণ আত্মাকে আমাদের শিল্পভুবনে প্রতিষ্ঠা করার কাজটি করে গেছেন, যা বাংলাদেশের চিত্রকলায় বিশেষ বৈশিষ্ট্যের আলোয় প্রোথিত হয়ে থাকবে।

একবার পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে বেড়াতে গিয়ে কাপ্তাই লেকে নৌকা নিয়ে চড়ার সময় তার নজরে পড়ে পানির নিচের লতাগুল্ম। লতাগুল্ম থেকে ডালপালাগুলো পানি ভেদ করে উপরে উঠে আসতে চাইছে। এটা দেখে শিল্পীর মনের ভেতর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ যেন এরকম করেই উজ্জীবিত হচ্ছে। সেসময় বাস্তবিক অর্থেই মানুষ ধ্বংস আর ক্ষয়ক্ষতি মাড়িয়ে, অপমান আর মৃত্যুর স্মৃতিকে অতিক্রম করে নতুন করে জীবনের সূচনা করতে চাইছে। মানুষ ৮ ঘণ্টার বদলে ১০ ঘণ্টা কাজ করতে সম্মত। বেতন অর্ধেক হলেও চালিয়ে নিতে রাজি। স্বাধীন দেশের জন্য প্রয়োজনে তারা আরও আত্মত্যাগ স্বীকার করতে রাজি। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ‘আত্মার উজ্জীবন’ নামে নতুন পেইন্টেড সিরিজের কাজ শুরু করেন। ১ বছরে তিনি এই সিরিজের প্রায় ৪০টি শিল্পকর্ম সৃজন করেন। এটা বিমূর্ত রীতির কাজ ছিল, তবু সাধারণ চোখে সে ছবি দেখে প্রাণের স্ফূরণের বিষয়টি মূর্ত হয়ে উঠত। তেলরঙে আঁকা এ ছবিগুলোতে তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন— সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের ভেতর উদ্দীপনা, নতুন করে দেশ গড়ার প্রত্যয় ও কর্মমুখর চেতনার উন্মেষকে।

১৯৫৬ সালে চিটাগং ক্লাবে, ১৯৫৭ ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইবেরিতে, ১৯৫৯ সালে ঢাকার ক্যাসবা রেস্তোরাঁয়, ১৯৬৩ সালে মোংলার আমেরিকান ক্লাবে, ১৯৬৮ সালে ঢাকার আর্ট কাউন্সিল গ্যালারিতে, ১৯৭৮ ও ১৯৯৭ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে, ১৯৯২ সালে সাতক্ষীরার তালা বিডি হলে ও খুলনার মিউনিসিপাল কর্পোরেশন হলে, ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে ঢাকার লা গ্যালারিতে, ১৯৯৯ সালে ঢাকার ডিডি গ্যালারিতে, ২০০২, ২০০৭, ২০১২, ২০১৪ সালে ঢাকার বেঙ্গল গ্যালারিতে এবং ২০০৩ ও ২০০৫ সালে ঢাকার সাজু আর্ট গ্যালারিতে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

দেশের বাইরে ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে আঁলিয়স ফ্রঁসেস ও ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে, ১৯৬০ সালে রাওয়ালপিন্ডির গর্ডন কলেজে, ১৯৬২ সালে রাওয়ালপিন্ডির আর্টস কাউন্সিলে, ১৯৬৩ সালে করাচির আর্টস কাউন্সিলে, ১৯৬৪ ও ১৯৬৮ সালে রাওয়ালপিন্ডির গ্যালারি কো অপে এবং মুলতানের ফ্রেঞ্চ ক্লাবে, ১৯৬৪ ও ১৯৭০ সালে করাচীর মেট্রোপোল হোটেলে, ১৯৬৭ সালে ইসলামাবাদ আর্ট গ্যালারিতে এবং ১৯৬৮ সালে করাচির জিমখানা ক্লাবে, ১৯৫৮ সালে আমেরিকার আর্টস ক্লাব অব ওয়াশিংটন ও বোনউইট টেলের গ্যালারিতে, ২০১০ সালে নিউইয়র্কের এবিসি কনভেনশন সেন্টারে ও ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ এমবাসিতে এবং ১৯৯৫ সালে কুয়েতের সোসাইটি ফর ফরমেটিভ আর্টস সেন্টারে তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯৫২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তান, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, হংকং, মিশর, জাপান, ভারত, নেপাল, চীন, তুর্কি, জার্মানি, জিম্বাবুয়ে, জাম্বিয়া, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কানাডা, রাশিয়া ও বাংলাদেশে ১০০ অধিক চিত্রপ্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৭ সালে ঢাকাস্থ জনতা ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ে ৩৮*৮ ‘আবহমান বাংলা’ ও ১৬*৬ ‘বাংলাদেশ প্রকৃতি ও মানুষ’ শিরোনামের পেইন্টেড ম্যুরাল এবং ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক খুলনা শাখায় ২২*১২ ‘ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা’ শিরোনামের মোজাইক ম্যুরাল স্থাপন করেন তিনি।

১৯৬৬-১৯৭১ পর্যন্ত তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলে শিক্ষকতা করেন এবং ১৯৭৭-১৯৯১ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে চারুকলা বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন। ১৯৫৮-তে আমেরিকার এডুকেশন ফাউন্ডেশন কর্তৃক ‘লিডার্স এন্ড স্পেশালিস্ট এক্সচেঞ্জ গ্রান্ট’ ও ১৯৬৮-তে লাহোরে আর্টজেন্স এ্যাট ওয়ার্ক প্রদর্শনীতে ১ম স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে একুশে পদক, ১৯৮৮ সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব সম্মাননা, ১৯৯২ বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা, ২০০০ মাইকেল মধুসূদন একাডেমি সম্মাননা, ২০০৫ সুলতান স্মৃতি স্বর্ণপদক, ২০১০ বার্জার বাংলাদেশ আজীবন সম্মাননা ও ২০১১ হামিদুর রহমান অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে নিজের বাসায় তিনি ইন্তেকাল করেন।

মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন দেশের বিশিষ্ট শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর। দেশের সঙ্গে তাঁর যে আত্মিক বন্ধন রয়েছে, তার প্রভাব বারবার উঠে এসেছে শিল্পকর্মে। চিত্রকলার ভুবনে তিনি খুবই সক্রিয় জীবন যাপন করেছেন। তিনি ছিলেন এ দেশের চিত্রশিল্পের পুরোধাস্বরূপ। তাঁর সৃষ্টিকর্মের বেশির ভাগই গ্রাম এবং গ্রামের প্রকৃতি নিয়ে। প্রকৃতি এবং ঋতু পরিবর্তন ছিল তাঁর ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর বিখ্যাত প্রদর্শনী ও সিরিজের নাম হচ্ছে ‘আত্মার উজ্জীবন’, ‘উল্লাস’, ‘ধ্বনি’, ‘অশনি সংকেত’, ‘অজানা অন্বেষা’। তাঁর নানা চিত্রকর্মের মধ্যে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে করা কাজ ‘আত্মার উজ্জীবন’ উল্লেখযোগ্য।

তাঁর ছবিতে প্রকৃতি ও মানুষের নানা অনুষঙ্গ খুবই সযত্নে উঠে এসেছে। নির্মাণশৈলীতে এসেছে সহজ ছন্দ, যা তাঁর সৃষ্টিকে করে তুলেছে তাৎপর্যময়। সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ছবিতে মানুষের শ্রম-ঘাম, ভালোবাসা ও বন্ধনের দৃশ্যকাব্য উঠে এসেছিল। মূর্ত ও বিমূর্ত উভয় ক্ষেত্রেই সমকালীন চিত্রকলা অঙ্গনে রেখেছেন সাফল্যের সাক্ষর। দেশের মাটি ও মানুষের মর্মযাতনার অনুভব তাঁর সৃজনধারাকে করেছে বৈশিষ্ট্যময়। নিজ সৃষ্টিকর্মেই বেঁচে থাকবেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর।

 

+ posts

Read Previous

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৫ম সংখ্যা

Read Next

মেঘ পাহাড়ের ডাকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *