অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৯, ২০২৫
২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মে ৯, ২০২৫
২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শফিক হাসান -
অনুপ্রাণন লেখক সম্মেলন-২০২৩ অনুষ্ঠিত

অনুপ্রাণন লেখক সম্মেলন-২০২৩ অনুষ্ঠিত

শফিক হাসান

দিনটা ১৪ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার; স্থানটা জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তন। সময়টা বিকেল ৪.৩০, ঘড়ির কাঁটায় এই সময়েই শুরু হওয়ার কথা অনুপ্রাণন লেখক সম্মেলন-২০২৩ অনুষ্ঠান। বরাবরের মতো এই অনুষ্ঠানও তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে সদ্য প্রকাশিত শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন’র গল্প ও গল্পকার সংখ্যা প্রথম পর্বের মোড়ক উন্মোচন; দ্বিতীয় পর্বে পাঁচজন তরুণ কবি ও পাঁচজন তরুণ কথাসাহিত্যিকের বইয়ের পাঠ উন্মোচন ও শেষ পর্বে অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইয়ের আটজন লেখককে সম্মাননা প্রদান। এমনটাই ছিল আমন্ত্রণপত্রে লেখা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বলা। অথচ সাড়ে চারটা বাজার কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি নামল আকাশ ঝেঁপে! দিনটা যদি হয় ১৪৩০ বঙ্গাব্দের ৩০ আষাঢ়, বৃষ্টি নামতেই পারে; কোনো আপত্তিও ধোপে টেকার কথা নয়! আয়োজকদের কপালের চিন্তার ভাঁজ সমান্তরাল হয়ে যেতেও সময় লাগল না, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই শব্দানুরাগীরা আসা শুরু করেছেন অনুষ্ঠানে। বিকেল ৫টার আগেই মিলনায়তন লেখকে লেখকারণ্য হয়ে উঠল!

সম্মেলনের শুরুতে ১০ জন শিশুশিল্পী উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করে।

অনুষ্ঠান শুরু হয় দশজন শিশুশিল্পীর গান দিয়ে। এর পরের পর্বগুলোতে একক ও দ্বৈত কণ্ঠে সঙ্গীত পরিবেশন করেন ড. অনুপম কুমার পাল ও ইসরাত জাহান সেতু। স্বাগত বক্তব্যে সম্পাদক ও প্রকাশক আবু এম ইউসুফ অনুপ্রাণনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। অনুপ্রাণন কেন তরুণ লেখকদের প্রাধান্য দেয়, সৃজনচর্চায় পৃষ্ঠপোষকের প্রয়োজন কতটুকু, কেমন হওয়া উচিত সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থার চরিত্র এসব বিষয় ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘তরুণদের সাহিত্য কেমন হচ্ছে, বাংলা সাহিত্যে এসবের যোগ কতটুকু কাজে দিচ্ছে, বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা দরকার। সেজন্য আমরা মনে করেছি, তরুণদের যেসব বই প্রকাশ করেছি— বইগুলোর অনুপুঙ্খ আলোচনা করা জরুরি। অগ্রজরাই তরুণদের পথ দেখাবেন, সেজন্য মনে করেছি অগ্রজ লেখকদের দ্বারা তরুণদের বইগুলো আলোচনা হওয়া দরকার। তাহলে ভালো-মন্দ, দুর্বলতা ও শক্তির জায়গা সনাক্ত করা যাবে।’

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক বুলবুল মহলানবীশ প্রয়াত হন শুক্রবার ভোরে। তার স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন অভ্যাগতরা।

ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ ১ম সংখ্যা হিসেবে বাংলাদেশের নির্বাচিত ১০০ গল্পকার প্রথম পর্বে স্থান পেয়েছেন ২৫ জন গল্পকার। প্রবন্ধ-আলোচনার সঙ্গে ছাপা হয়েছে লেখকদের একটি করে নির্বাচিত গল্প। এ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করেন কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই ও সুব্রত বড়ুয়া। হাসনাত আবদুল হাই তার বক্তব্যে অনুপ্রাণনের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘আমাদের দেশে ও বিদেশে যারা সাহিত্যচর্চা করেন তারা বেশ দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়েই কাজটা করেন। তাদের খুব কমই এই কাজে পারিপার্শ্বিক সমর্থন পান। পুরস্কার তো আরও দূরের পথ। সেখানে অনুপ্রাণন তরুণ লেখকদের লেখা ছাপাচ্ছে, বই প্রকাশ করছে, সম্মাননা দিচ্ছে— এসব দেখে খুব উৎসাহ বোধ করি। সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা আশান্বিত হই।’

ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন গল্পকার ও গল্প সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করেন বিশিষত কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়া ও অনুপ্রাণন সম্পাদক আবু মোহাম্মদ ইউসুফ।

সুব্রত বড়ুয়া বর্তমানের সাহিত্যের দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘কেন বইয়ের বিক্রি কমে যাচ্ছে, কেন পাঠকের সংখ্যা কমছে। বই যাদের জন্য আমরা লিখি, তারা চায় না বলেই বই বিক্রি হয় না। তাহলে তারা কী চায়! আমি নিজে সেটা জানি না। তারা কী চায়, নিজেরাও হয়তো জানে না।’

অনুপ্রাণন প্রথম সংখ্যায় আলোচনা করা হয় ২৫ জন গল্পকারের গল্পকর্মের সামষ্টিক মূল্যায়ন। এই ২৫ জন গল্পকারের জন্ম ১৯৫০ সালের মধ্যে। নির্বাচিত লেখক ও আলোচকরা হচ্ছেন— শামসুদ্দীন আবুল কালাম (আলোচক : সাইয়িদ রফিকুল হক), শওকত ওসমান (আলোচক : রকিবুল হাসান), সিকান্‌দার আবু জাফর (আলোচক : মো. জাহিদুর রহমান), আবু রুশ্দ্ (আলোচক : অমল সাহা), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (আলোচক : মোহাম্মদ নূরুল হক), শাহেদ আলী (আলোচক : জসীম উদ্দীন মুহম্মদ), আবু ইসহাক (আলোচক : আবুল খায়ের নূর), আলাউদ্দিন আল আজাদ (আলোচক : বঙ্গ রাখাল), মুর্তজা বশীর (আলোচক : নীলিমা নূর), জহির রায়হান (আলোচক : নোমান প্রধান), সৈয়দ শামসুল হক (আলোচক : সোলায়মান সুমন), হাসনাত আবদুল হাই (আলোচক : আফরোজা পারভীন), আবুবকর সিদ্দিক (আলোচক : মামুন রশীদ), রিজিয়া রহমান (আলোচক : নাহার আলম), হাসান আজিজুল হক (আলোচক : সাবরিনা আফরিন সিলভী), রাহাত খান (আলোচক : আবু আফজাল সালেহ), আবদুশ শাকুর (আলোচক : রবিউল ইসলাম), সালেহা চৌধুরী (আলোচক : উদয় শংকর দুর্জয়), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (আলোচক : ড. আবু নোমান), আহমদ ছফা (আলোচক : ড. ইমদাদুল হক মামুন), সেলিনা হোসেন (আলোচক : জান্নাতুল যূথী), হরিপদ দত্ত (আলোচক : পিন্টু রহমান), হুমায়ূন আজাদ (আলোচক : মৌলি আজাদ), কায়েস আহমেদ ((আলোচক : হারুন পাশা), হুমায়ূন আহমেদ (আলোচক : অলোক আচার্য)।

অনুপ্রাণন থেকে প্রকাশিত ৫টি কবিতার বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি সরদার ফারুক।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তরুণদের ৫টি কবিতার বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি সরদার ফারুক। কবিতার বই ও কবির নাম যথাক্রমে— গোলাপ ও আফিমের প্রজ্ঞা— অনিমেষ প্রাচ্য, আধখোলা জানালার আলাপ— নুরুন্নাহার মুন্নি, বৃষ্টিরা একা আসে না— জিয়াউল হক সরকার, মিথ্যুক আবশ্যক— মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, মুখোশ বদলে গেলে— জারিফ আলম।

নানা দৃষ্টিকোণ থেকে তরুণদের কবিতার বই নিয়ে আলোচনা করেন সরদার ফারুক। তার একটি মন্তব্য প্রায় সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। তরুণদের উদ্দেশ্যে বলা তার বক্তব্যটির সারমর্ম এমন— ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাদ দিয়ে কাব্যচর্চা অসম্ভব; আমাদের রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছাতে হবে, রবীন্দ্রনাথ একটি জংশন। এর পরের জংশন জীবনানন্দ দাশ। এই জংশন থেকে আমাদের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।’

অনুপ্রাণন থেকে প্রকাশিত ৫ জন তরুণ কথাসাহিত্যিকের বই নিয়ে আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেল হক নিয়োগী।

এরপর কথাসাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন মোজাম্মেল হক নিয়োগী। গল্প-উপন্যাসগুলোর নাম ও কথাসাহিত্যিকরা হচ্ছেন— উলঙ্গ সময়— জাহাঙ্গীর হোসাইন, নিমপাতার পাকোড়ার নিষিদ্ধ আলিঙ্গন— ইসরাত জাহান, পাগলের জবানবন্দি— মিজান আকন্দ, অথবা উষ্ণতায়— রোকন রেজা, আলোর খোলস— ঝুমকি বসু। তরুণ লেখকদের প্রবণতা ও সাযুজ্যের দিকে আলোকপাত করেন তিনি। রচনার বৈচিত্র্য, গতানুগতিকতা ও দুর্বলতা উল্লেখ করে মোজাম্মেল হক নিয়োগী লেখালেখিতে ভালো করার কিছু পরামর্শ দেন।

আলোচ্য দশটি বই থেকে পাঠ ও আবৃত্তি করে শোনান দেওয়ান সাইদুল হাসান, সুলতানা শাহ্‌রিয়া পিউ, তাহমিনা শাম্মী ও আরও কয়েকজন আবৃত্তিকার।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে সম্মাননা দেওয়া হয় আটজন কবি ও লেখককে। তারা হচ্ছেন— কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার, কবি রায়হান শরীফ, কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন কবির, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক মনিরা আক্তার, কবি ও কথাসাহিত্যিক লতিফ জোয়ার্দার, কবি ও কথাসাহিত্যিক সুমন শাম্স, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক বাসার তাসাউফ, কবি মোহাম্মদ হোসাইন। সম্মাননাপ্রাপ্তদের ক্রেস্ট, উত্তরীয় ও অনুপ্রাণন নামাঙ্কিত মগ উপহার  দেওয়া হয়। সম্মাননাপ্রাপ্ত কবি-লেখকদের পক্ষে বক্তব্য দেন কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার। তিনি দুজন আলোচকের নির্মোহভাবে গল্প ও কবিতার আলোচনা-সমালোচনার প্রশংসা বলেন, ‘এটাই সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে। তথাকথিত পণ্ডিত অধ্যাপকদের আলোচনা করতে দিলে তারা না পড়েই আলোচনার পাঁয়তারা কষতেন! অনুপ্রাণন গল্পসংখ্যা প্রকাশ করে সম্পাদক একটি বড় দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য গল্পকারদের, আমাদের অগ্রজ সাহিত্যিকদের চিনতে জানতে বুঝতে সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

পুরো অনুষ্ঠানটিতে প্রাণবন্ত উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন সুলতানা শাহ্‌রিয়া পিউ ও তাহমিনা শাম্মী। তাদের সহায়তা করেন সাদিয়া ইয়াসমিন অনন্যা, মিতা আক্তার শিখা ও মানসুরা আক্তার। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন বাঁকে উপস্থাপকদ্বয় আমন্ত্রিত অতিথি, কবি ও লেখকদের সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়ে শোনান।

শেষ ভালো যার, সব ভালো তার! অনুষ্ঠান শেষে কলম ও কণ্ঠশিল্পীরা একরাশ মুগ্ধতা বুকে নিয়ে যার যার বাড়ির পথ ধরেন। ততক্ষণে আকাশ থেকে রাত নামলেও চারদিকে ভর করেছিল যেন উজ্জ্বল আলোর বন্যা। বৃষ্টি তারও আগে বিদায় নিলেও মন থেকে ঝরেছিল ভালোলাগা ও ভালোবাসার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি!

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

বহুমাত্রিক স্বাদের মায়াবী অন্তর্জাল – নুরুন্নাহার মুন্নির কবিতা

Read Next

কলঙ্কিনী রাধা – চতুর্থ পর্ব

২ Comments

  • ‘অনুপ্রাণন লেখক সম্মেলন-২০২৩’ অনুষ্ঠিত সম্মেলন সম্পর্কে জেনে প্রাণটা ভরে উঠলো। প্রতিশ্রুতি দিয়েই বলা যায়, এটি পুরোপুরি সফল হয়েছে। অনুষ্ঠানে থাকতে পারলে আরো ভালো লাগতো। দেশের বাইরে থাকায় তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তাই মিস করার আক্ষেপ রয়েই গেলো।

  • আলোচনা পড়ে মুগ্ধ হলাম। সকলের জন্য শুভকামনা

Leave a Reply to তোফায়েল তফাজ্জল Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *