অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাহিদ সিরাজ -
কলঙ্কিনী রাধা – চতুর্থ পর্ব

সূচিপত্র

প্রথম পর্ব (প্রকাশিত- https://magazine.anupranon.com/ধারাবাহিক-প্রবন্ধ/কলঙ্কিনী-রাধা-প্রথম-পর্ব/)

অধ্যায়-১

পটভূমি

যেখানে জীবনের যাত্রা

গল্প সংকলন থেকে গবেষণা

অধ্যায়গুলোর আগের কথা

একটি অর্থহীন উত্থান হবে না তো (!)

অধ্যায়-২

‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’

ভূমিকা

পেছনের কথা

নীরবতা

প্রসারিত হলো না কারও দু’হাত

পছন্দের সীমাবদ্ধতা

নির্যাতন

সংস্কৃতিক সামাজিক বিষয়াদি

পেশাজীবীদের অভিজ্ঞতা

অপর্যাপ্ত পরামর্শ বা কাউন্সিলিং

বিশেষ প্রক্রিয়াটি

গর্ভপাত পরবর্তী সময়

ফিরে দেখা সমাজ আবার

দ্বিতীয় পর্ব (প্রকাশিত- https://magazine.anupranon.com/ধারাবাহিক-প্রবন্ধ/কলঙ্কিনী-রাধা-দ্বিতীয়-পর্ব/)

অধ্যায়-৩

গল্পের মরালিটি ও গবেষণায় নৈতিকতা

পেছনের কথা

গর্ভপাত সংক্রান্ত নৈতিক প্রশ্নগুলো

নৈতিকতার সীমানা নারীবাদী মতামত ও বাংলাদেশ

প্রাচীন দর্শন এবং গর্ভপাত প্রাচীন দর্শন এবং গর্ভপাত নৈতিকতা কি ধর্মীয় রীতিভিত্তিক খ্রিস্টান, ইসলাম, হিন্দু

সুতরাং এথিকস কি সাবজেক্টিভ, বৈশ্বিক নাকি আপেক্ষিক?

গবেষণায় নৈতিকতা ফোকাস ও উদ্দেশ্য

ফলাফল ও প্রয়োজনীয়তা

গল্পগুলো সংগ্রহের কথা এবং সেগুলোর ব্যবস্থাপনা : এথিককসের আলোকে

গল্প সংগ্রহে ঝুঁকি এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা

নৃবৈজ্ঞানিক নৈতিক নির্দেশনা তথ্য উন্মোচনে, বলায়

গল্প সংগ্রাহকদের ঝুঁকি ও ব্যবস্থাপনা

তথ্য মালিকানা ও প্রকাশ এবং CDA’র নির্দেশনা

উপসংহার : CDA’র বিড়ালটা বেড়ায় বসে থাকে

অধ্যায়-৪

কলঙ্কিনী রাধা

চিরস্থির দৃশ্যপট (?)

কলঙ্কের সূত্রগুলো কে বানাল

গর্ভপাত ও চারপাশের দেশ

গর্ভপাত ও নারীদের ধারণা

গর্ভপাত কলক আর সামাজিক ভাষা

তিসকোর্য চিন্তাভাবনা সমাজ তেমুখের মডেল

কাজ ও টেক্সটভিত্তিক মডেল; সামাজিক ইন্টারএকশনের মাঝে টেক্সট বা মায়েদের গল্পগুলো

দেখার পদ্ধতি

একটি তুলনামূলক আলোকপাত

প্রতিবাদ হিসাবে লিখা

ক্যাথারসিস, অভিজ্ঞাতার সম্মিলন

কলঙ্কিনী রাধা : মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার

তৃতীয় পর্ব ( প্রকাশিত- https://magazine.anupranon.com/ধারাবাহিক-প্রবন্ধ/কলঙ্কিনী-রাধা-তৃতীয়-পর্ব/)

অধ্যায় ৫

মুসলিম অধ্যুষিত দেশসমূহের গর্ভপাত আইন : একটি ইসলামিক ডিসকোর্স বিশ্লেষণ ও নীতিপ্রণয়ন সম্ভাবনা

আলোচনার সূত্রপাত

মৌলিক উৎস কোরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা

বিবেচ্য অন্যান্য বিষয়

সুফিবাদ ও বৃহত্তর ইসলামি নীতি

সুবিধাভোগী মহল এবং আবারও নারীবাদ

বহুজাতিক ইসলামি সংস্থা/ ডোনার

মুসলিমপ্রধান দেশসমূহে গর্ভপাত আইনের বহুমাত্রিকতা

নীতি প্রণয়নের জন্য সুপারিশ

উপসংহার নয় মোটেই

চতুর্থ পর্ব

অধ্যায় ৬

আমি কুলহারা কলঙ্কিনী

যাদের কথা এই বইয়ের রসদ

মাহজাবিন : তুই তো বিপদজনক এক উত্তরাধিকারী শুধু

জেনিফার : আমার আত্মার আত্মীয়টা কই

চামেলী : কোথায় লুকালো নাছোড় যন্ত্রণা

দাসিরা : আমি আর কত বড় হলে

রায়না : আমার পালিত যন্ত্রণার খাঁচা

পঞ্চম পর্ব (প্রকাশিতব্য)

অধ্যায়-৭

অদৃশ্য পালকের সম্ভার

ব্যাখ্যার বদলে রাজপথের স্লোগান

গবেষণার আয়নার আমার মুখচ্ছবি

উন্মোচিত হোক শোকের মোড়ক

CDA’র বিড়ালটা আর আমাদের দেখার জমিন

আনওয়ান্টেড ‘গর্ভ’ বনাম আনওয়ান্টেড ‘গর্ভপাত’

সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চাপের স্বীকৃতি

বিস্রস্ত বর্ণে অজ্ঞাত বিষয়

প্রদোষের আলোয় কিছু দ্রষ্টব্য

পরিশিষ্ট

নোট

১. ৭টি অধ্যায়ে লিখিত প্রবন্ধ গ্রন্থটির, অধ্যায়-১ ও অধ্যায়-২ ধারাবাহিকের প্রথম পর্বে সঙ্কলিত করা হয়েছে।
https://magazine.anupranon.com/ধারাবাহিক-প্রবন্ধ/কলঙ্কিনী-রাধা-প্রথম-পর্ব/

২. ৭টি অধ্যায়ে লিখিত প্রবন্ধ গ্রন্থটির, অধ্যায়-৩ ও অধ্যায়-৪, ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্বে সঙ্কলিত করা হয়েছে।
https://magazine.anupranon.com/ধারাবাহিক-প্রবন্ধ/কলঙ্কিনী-রাধা-দ্বিতীয়-পর্ব/

৩. ৭টি অধ্যায়ে লিখিত প্রবন্ধ গ্রন্থটির, অধ্যায়-৫, ধারাবাহিকের তৃতীয় পর্বে সঙ্কলিত করা হয়েছে।
https://magazine.anupranon.com/ধারাবাহিক-প্রবন্ধ/কলঙ্কিনী-রাধা-তৃতীয়-পর্ব/

৪. ৭টি অধ্যায়ে লিখিত প্রবন্ধ গ্রন্থটির, অধ্যায়-৬ চলতি চতুর্থ পর্বে সঙ্কলিত করা হয়েছে।

চতুর্থ পর্ব

আমি কুলহারা কলঙ্কিনী

অধ্যায় ৬

‘আমার বিনিদ্র রাত কাটে নক্ষত্র নামতায়’

তখন ছিলাম রপসী কিশোরী আমি

স্বেচ্ছায় আমি হয়েছি কলঙ্কিনী

বন্ধু আমার, তোমার প্রেমে ম’জে

গরবিনী আমি হারায়ে কুল

—খাজা ফরিদ

পড়ার আগে

সবার গল্পগুলো টাইপ করে দুইবার প্রত্যেককে পুরোটা পড়তে দিয়েছিলাম। সাথে অনুরোধ ছিল; তারা যেন তাদের

নামের পাশে কিছু একটা লিখে দেন। প্রত্যেকেই গঠনের বা কবিতার লাইন তোলে দিলেন। এবং প্রত্যেক মা-ই পুরো পনেরো জনের গল্প পড়েছেন। অনলাইনে যারা অংশগ্রহণ করেন, তাদেরকেও পড়তে দিই। এবং সবশেষে পুরো বই। আরও, যে সব ছদ্মনাম ব্যবহার করা হচ্ছে; প্রত্যেকেই জানেন তাদের গল্পের ছদ্মনাম।

যাদের কথা এই বইয়ের রসদ

মাহজাবিন : তুই তো বিপদজনক এক উত্তরাধিকারী শুধু

জেনিফার : আমার আত্মার আত্মীয়টা কই

চামেলী : কোথায় লুকানো নাছোড় যন্ত্রণা

দাসিরা : আমি আর কত বড় হলে

রায়না : আমার পালিত যন্ত্রণার খাঁচা

যে কথাগুলো হলো না শোনা

যাঁদের কথা এই বইয়ের রসদ

এই অধ্যায়ে বলা মায়েদের জীবন, অভিজ্ঞতা, গল্প এবং গর্ভপাত সম্পর্কে; যা সাধারণ ধারণা ও অনুমানকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল যে এইসব ধারণা কতটুকু মিথ্যে। মায়েরা যেমন গল্প কথক, তেমনি গর্ভপাত সম্পর্কে সাধারণ ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণীত করায় প্রদর্শক, প্রমাণকারী মায়েদের আবেগ ছুঁয়ে যায় সবাইকে; মায়েরা গল্প বলেছেন মুখে; অথচ তাদের চোখের নোনা পানি গাল বেয়ে ঝরেছে অঝোরে। বহু পুরাতন ছবিকে তারা আবার দেখেছেন নতুন করে; কখনোবা ধুলোবালি ঝেড়ে। নৈরাশ্য আর অবিশ্বাসের বাধায় তারা আজও বেঁচে আছেন; কেউবা ‘অপরাধী’ হয়ে; কেউবা ‘স্বার্থপর’ হয়ে এবং সমাজের দেওয়া কলঙ্ক নিয়ে। জীবন থেকে পালাতে গিয়ে পালাতে পারেননি; কিন্তু হারিয়েছেন সেই দুরন্ত যৌবনের সংসারের স্বপ্ন। কোথাও যেন লুকিয়ে গেছে সেই-ই চেতনা, বাঁচার সম্ভাবনা হারিয়ে কেবলই বেঁচে থাকার তাগিদে বেঁচে আছেন; আহ্নিক গতির নিয়মে।

হিপোক্রেসির সাথে হরদম সংগ্রাম করে বেঁচে আছেন; যা তারা আগে ছিলেন না। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা ও তারা নিজে আজন্ম লালিত স্বপ্নের মৃত্যুতে তারা আদৌ দায়ী নন। কিন্তু মাতৃত্বের মাতাল মন এতসব প্রীতির কথা, এথিকস্, অতীত জটিল সামাজিক, রাজনৈতিক, পুঁজিবাদী, সামন্তবাদী সংমিশ্রণ আর সংবেদন বোঝে না।

বোঝে না বলেই তারা আজও ব্যাকুল হয়ে কাঁদেন। কিন্তু, মায়েরাই শেষ বিচারে সত্যদ্রষ্টা। বায়োলোজি, এমব্রুলোজি, জেনেটিক বিজ্ঞান, গ্রীক দর্শন যা বলে, সন্তান মাতাল মায়ের মনও তাই বলে, ‘আমার সন্তান’ কিংবা প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ। আমি ব্যক্তিগতভাবে, দর্শনের দিকে হাত বাড়িয়েছিলাম এই জন্য যে; প্রাচীন গ্রীসেও নিশ্চয়ই গর্ভপাত হয়েছিল। সমাজের মাঝে এটা ছিল বলেই এরিস্টটল গর্ভপাত নিয়ে ভেবেছেন, এবং খ্রিস্টান থিওলোজিতেও গ্রীক দর্শনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে।

একই সাথে ইসলামিকে ধর্মতত্ত্বেও। একই সাথে ইসলামিক ধর্মতত্ত্বেও। একই সাথে বিজ্ঞান প্রমাণ করছে, প্রাণ এসে যাচ্ছে, কনসেপশন হওয়ার ৭ দিনের মাঝে। বা ১৫ দিন। সুতরাং আমরা কীভাবে বলতে পাঠিয়ে, মা ব্যাকুল হবেন না, যা এটা তো কেবলই মাংসপিণ্ড বা কোষ কতেক?

নীতিশাস্ত্রের গভীরতম তাৎপর্য আর আইনি সংলাপময়তা মায়েরা জানেন না চলে সন্তানের প্রতি অনারারি এপিটাফ আমাদের সংকলন। সন্তানের অস্তিত্বের সাথে আমরাও ঐক্যমত্য প্রকাশ করি। সমাজ আর রাজনীতির নির্দয়তার কথা যেমন শব্দের মারতে আমরা শুনে যাই মায়েদের কাছে; ঠিক তেমনি দেখি মায়েদের দয়ার্দ্র দুই চোখ, স্নেহকাতর মন। যেমন সাহারার রক্ষতার মাঝে সবুজ শ্যামল কদমতলা। প্রতিটি গল্প আলাদা। পৃথক পৃথক সাক্ষাৎকারের আলোকে এগুলো আনা হয়েছি। সব গল্প নামাকিত ছদ্মনামে।

মৌখিক শব্দগুলো ছাড়াও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যতটুকু পেরেছি আমরা বিস্তৃত লিখেছি। এবং এসব সিমান্টিক বা শব্দহীন ভাষা আমাদের দেখাশোনা খুব দরকার ছিল। কারণ, আমরা মনে করি যে, MDA-এর আলোকে কাজ করলে ডিসকোর্সগুলো কেবল ভাষাতেই নয়, চোখে-মুখে, ব্যবহারেও প্রকাশিত হয়; চর্চা হয়। এজন্য, সেই সব না বলা ভাষাকেও আমাদের দ্রষ্টব্যের আওতায় নিয়ে আসি।

কথা আর কথার বাইরের আশপাশের জগতেও রাখতে হয় আমাদের চোখ। দুঃখঘন গল্প, যাতনা-ঝরা অভিজ্ঞতার কথাই না হয় শুনি।

মাহজাবিন

‘তুই তো বিপদজনক এক উত্তরাধিকারী শুধু’

মাহজাবিনের বয়স ২৭। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। বাইরে থেকে এমএস করে এসেছেন। অবিবাহিতা। ছোট এক ভাইকে নিজের কাছে রেখে পড়াশোনা করান। মাঝে মাঝে বাবা-মা আসেন; সে নিছক বেড়ানো বা ডাক্তার দেখানোর তাগিদে।

একদিন হঠাৎ করেই মনে হলো আমার সকল দুঃখ-কষ্ট নিয়েই বোধহয় আমার সন্তানটা আমার সাথেই আছে! এটা যেন এক অবাক করা অনুভূতি। আমার এই হঠাৎ তৈরি হয়ে আসা অনুভূতি কী দিয়ে গেল? আমার সম্পর্কের অবসান? পরিবার আত্মীয়স্বজনের প্রতি অনাগ্রহ? যদিও আমি মনে করি এসব সম্পর্ক বা আত্মীয়তার অনাগ্রহ আমার জীবনে কোনো মূল্যবান বিজয়। যা গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো আমার দোষ আমি স্বীকার করে নিলাম। দুঃখ আর কষ্টের একটা ভূত আমাকে এখন তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি এটা হতে বের হতে পারছি না। চেষ্টা করেও পারছি না।

আমি আমার বাচ্চা চাইছিলাম। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমার সন্তান আমার কোলে কোলে বড় হতে চাইছিলাম। আমার বয়স ছিল ২৪। প্রাইভেট মেডিক্যালের ছাত্রী। সিনিয়র একজন আমার বন্ধু। পাশাপাশি ফ্লাটেই থাকতাম। শেষে একই ফ্লাটে থাকা শুরু করি আমরা। একত্রে থাকার পর থেকে দেখি সে ভায়োলেন্ট ও বেপরোয়া টাইপের মানুষ। যেদিন তার ডিউটি থাকত না, আমাকে রীতিমতো জোর-জবরদস্তি করত আমি যেন কলেজ না যাই। একদিন আমাকে প্রায় হাত তোলেই ফেলেছিল। এভাবেই দিন যাচ্ছিল।

একদিন আমি বুঝলাম, আমি প্রেগনেন্ট। ভ্যাগ্যিস, আমার বাবা-মা মাত্র কদিন আগে আমার ওখান থেকে বেরিয়ে গেছেন। আমার বাবা-মা আসলে সে যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করত। এবং সে তখন সাধারণত বন্ধু-বান্ধবের বাসাতেই থাকত। প্রথম আমি তাকে বলব, কী বলব না, বেশ সংকোচের মাঝে ছিলাম। তাকে আমার রগে রগে চেনা হয়ে গেছে। আমি সোজা বাসা থেকে অন্য কোথাও উঠতাম; প্রয়োজনে তাকে জানতামও না। আমার মাকে যে কোনোভাবে ম্যানেজ করতাম সে বিশ্বাসও ছিল। তবু মনে হলো, যদি বিয়ে করে ফেলি, তাহলে এতসব ঝামেলা পোহাতে হবে না এবং বাবা-মাকেও অহেতুক দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

মোটামুটি দুরুদুরু বুকেই তাকে বললাম ‘আমি প্রেগনেন্ট’ মনে পড়ে, বাইরে অঝোর বৃষ্টি হচ্ছিল। রাতের আঁধার সেরে সেতায় বসে কী জানি মুভি দেখছিল। সে আমার হাত আলতো চেপে ধরল। বিশাল ভরসায় বুকের ছাতি যেন ফুলে উঠল। বিশাল লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাহজাবিন। একটু বিরতি নিলেন; কী যেন মনে হলো ভাবলেন। একটু পানি মুখে দিলেন। কিংবা ঠোঁট ভেজালেন। সে বলল, ‘আমি তো তোমার সাথেই আছি। আমি থাকব। তাছাড়া বাচ্চাটা আমাদেরই হবে। কিন্তু, আমার চাকরি মাত্র শুরু। তোমার পাস করা হয়নি এখনো। এরই মাঝে এসব ‘ঝামেলা আসলে তো তোমার পড়া হবে না।’

এক সেমিস্টার ড্রপ করলে কিছু হবে না। আহা! অহেতুক সেমিস্টার লস করার তো কোনো মানে নেই। তাছাড়া আমরা তো কাগজে-কলমে বিয়ে করিনি। কেন তুমি না বলতে ওসব দুটো সিগনেচার আসল। এখনো বলছি, কিন্তু, বাচ্চার পরিচয় বলে একটা ব্যাপার আছে না? তার মানে তুমি আর বাচ্চাটাকে…

আমি চাইছি; তবে এটা নয় নিশ্চয়ই আমাদের আরেকটা বাবু আসবে, তাছাড়া এটা তো কেবলই সেল, তুমি মেডিকেলের ছাত্রী; তোমার তো সাধারণ মেয়ের মতো কথা বলা মানায় না।

বদমেজাজি বদমাশটার সাথে আমার আর কথা বলার কোনো রুচিই নেই। মনে মনে ভাবলাম এক সপ্তাহ ভাবি। কারও সাথে আলাপ করি। সবচে ঘনিষ্ঠ আমার এক বৌদ্ধ বান্ধবী নবনীতা বড়ুয়ার সাথেই আলাপ করব ঠিক করলাম।

নবনীতা শুনে মাথায় হাত; আমায় বলে বিয়ে হোক না হোক, বাচ্চা তো আর তোদের ধর্মের এসব নিয়মকানুন জানে না। তুই বাচ্চা রাখ। প্রয়োজনে আমার বাড়ি এসে থাক। তোদের ধর্মেও নিশ্চয়ই এটা পাপ। নবনীতা তার মায়ের কাছে আমায় নিয়ে যায়; শান্ত নিপাট সৌম্য এই মহিলা বলেন, ‘মা রে, পরে পস্তাবি, পরে পস্তাতে হবে, তখন আর কূল পাবি না। জন্মের পর না হয় বাচ্চাটা আমায় দিয়ে দিস। আমিই পালব। প্রয়োজন হয় তোদের মুসলিম নাম দিয়েই আমি বাচ্চাটাকে রাখব।’

সেদিন নবনীতাদের গাজীপুরের বাড়িতে আমি থেমে গেলাম। আমার ডাক্তার সাহেবকে বললাম, শরীর ভালো না, নবনীতাদের আমি থাকছি। উত্তর হলো— তোমাকে আগেই বললাম বাড়াত এই ঝামেলা ঝেড়ে ফেলো, যওসব সেন্টিমেন্ট…।

ফোনে তার উচ্চস্বর এতই যে, আমি লাইন কেটে দিলাম। মনে গভীর থেকেই যেন বলে উঠলেন, আমার কিছুই হলো না— নবনীতা, নবনীতার মা কারও কোনো কথায় আমার মন বলল না। একসপ্তাহ পর, পরিচয় গোপন রেখে, ভিন্ন নামে আমি হাসপাতালে গর্ভপাত করালাম।

আমার গর্ভপাতের আগের সপ্তাহাটা ভালোই কাঠছিল ইন্টার্নিতে যাওয়া বাদ দিলাম। সারাদিন শুয়ে শুয়েই থাকতাম। দু’দিন নবনীতা আসে। যথাসাধ্য আমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে। কিছুতেই কিছু হলো না; আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। বাস্তবে আমি নিশ্চিত না; আমার ডাক্তার সাহেবের প্রাত ভালোবাসা নাকি আনুগত্যের জন্য আমাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। সারাক্ষণ বিছানায় থাকতে থাকতে মনে হলো সেই দিনটা আসার আগেই যদি আমার বাবুটার জন্ম হয়ে যায়! শরীর মনে হচ্ছিল অদ্ভুত নরম। মাথার বেয়ে ঢুকে পড়েছিল আজব এক গন্ধ। সারাক্ষণ স্যালাইনের পারফিউম স্প্রে করতাম; মাথা থেকে গন্ধটা যায়! এরই মাসে একদিন আমার ডাক্তার সাহেব জানালেন, যদি আমি বাবুটা রাখি, তিনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন। আমিও মনে মনে তাই চাইছিলাম। কিন্তু তাকে ভালোবাসতাম অন্ধের মতন। আবার চিন্তা করলাম, যদি সে আমার কোনো ক্ষতি করে!

‘কী ক্ষতি হতে পারত?’

ভাই রে, বাংলাদেশের পুরুষ মানুষই নিরাপদ নয়; আমি তো সাধারণ মেয়ে। কী ক্ষতি হতে পারে?

আনমনে চোখ তুলে উপরে তাকালেন। কী জানি ভাবলেন। কয়েক সেকেন্ড। এটা কি তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা? সমাজ যা তাকে দিতে পারত, রাষ্ট্র যা তাকে দিতে পারত? কীসের অজানা আকাঙ্ক্ষা তাকে পেয়ে বসেছিল? আমরা তাকে আবার বললাম, তিনি বললেন যদি সে কোনো ইন্টারনেটে আপত্তিকর ছবি দিয়ে দেয়! যদি আমার মুখে…

রাষ্ট্রের ব্যর্থতায় তার ব্যক্তিগত দুঃখবোধ, তার সন্তান হারানোর কারণ। সেদিন শনিবার ছিল, সকালে খালি পেটেই আমি আর আসার ডাক্তার হাজির। ওখানে আমরা ডাক্তার ছিলাম না। তিনি গার্মেন্টস ম্যানেজার; আর আমি কলেজছাত্রী! এবং স্ত্রী। আমার ধারণা এবং বিশ্বাস, তারাও জানে এটা আমাদের মিথ্যা পরিচয়; তারা তাদের লাভের হিসাব দেখছে; আমরা আমাদেরটা আমি কোনোই কথা বলতে পারছিলাম না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল তারা আমাকে আরেকটাবার জিজ্ঞেস করবে বা জানতে চাইবে আমি কি গর্ভপাত করব? কেউ জানতে চাইল না। আমি ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। আমার ডাক্তার পার্টনার মহোদয় অভয় দিচ্ছেন, এটা মামুলি ব্যাপার। মাত্র দশ মিনিটের মামলা। তিনিই নাকি করাতে পারতেন, যদি এনেসথেসিয়া ভালো করে জানা থাকত!

ভয়ে আঁতকে নাকি ঠিক অন্য কোনো কারণে ওয়েটিং রুমে থাকাবস্থাতেই আমি পেটের ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম। শুধু মনে আছে, পাশের চেয়ারে বসা একটা মেয়ে আমার নাম ধরে বলল, আপা তো ডাক্তার, আপাডারে ত্বরা কইর‌্যা লইয়্যা যান…

জ্ঞান ফিরলে আমি দেখলাম আমাকে অপারেশন থিয়োটারের সার্জারি টেবিল। কিছুই দৃশ্য নয়। তবু মনে হল আমি কত অচেনা এই জায়াগায়, এই টেবিলে; এই পরিস্থিতিতে! মেডিসিনে পাস করা প্রায় ডাক্তার একটা মেয়ের কী নিষ্ঠুর পরিণতি! আমি নিজেই আমার কপাল দেখে হাসলাম!

[আমরা আজকের মতো শেষ করলাম। মাহজাবিনকে যথেষ্ট ক্লান্ত, মনে হচ্ছে। তিনি নিজেও বলেছেন, ভাই এসব অন্তত শুনতে চাচ্ছেন, সেটা এর আগে কেউ করেনি। কেউ একজন হলেও তো পড়বে। জানবে। মাহজাবিনই আমাদের কফি, কেক, জলের দাম দিলেন। বললেন, পরের দিন আপনারা! মাহজাবিন তার গর্ভপাতের কাগজও নিয়ে আসেন সাথে করে; আমাদের উদ্দেশ্যে নয়; এটা তার সাথেই থাকে। ল্যামিনেটেড করা, ছোট সাইজের কপি! তার হারানো সনকে ওর মাঝেই খোঁজেন?

তিনি চলে যাওয়ার পর, আমরা তিনজন চুপচাপ বসে থাকি। দোতলা থেকে দেখলাম, সুন্দর লাল ছোট্ট গাড়ি চালিয়ে রাজপথে হারিয়ে গেলেন।

শিক্ষিত, স্মার্ট, বুদ্ধিদীপ্ত কথার মাঝে মাঝেই যেন কোথাও হারিয়ে যান। আবার দিনেও আসেন। তখনই মনে হলো তাকে একটা বিষয় জিজ্ঞেস করতে হবে, মেডিক্যাল পড়ুয়া ডাক্তার কেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আছেন।]

হাসপাতালের বেড মাহজাবিনের বয়ান

অপারেশন টেবিলে আমি শায়িত। একটু হলেও নিজের মৃত্যুচিন্তা ঘিরে ধরল। যদিও জানতাম, এটাতে কেউ কেউ লোকাল এনেসথেসিয়া দিয়ে থাকেন। এনেসথেটিক ডাক্তার বললেন— লোকালই দিচ্ছি; তবে আপনি কয়েক ঘণ্টা ঘুমাবেন। আমি বললাম ‘না’। আমি জানি না, আমার ‘না’ শব্দটা তাদের কানে পৌঁছেছিল কিনা।

ডাক্তার সকলেই হাসলেন; আমাকে কে যেন বললেন— এক থেকে কুড়ি পর্যন্ত নামতা পড়ুন। আমি নামতা পড়তে পড়তেই চলে গেলাম অদ্ভুত এক আঁধারে; এটা ঘুম নয়; প্রশান্তি; এটা একেবারেই অন্য কিছু।

আমার ঘুম ভেঙে শেষ বিকেলে। নার্সকে বললাম, আমার স্বামীকে ডেকে আনুন। তারা জানায়, তিনি ওয়েটিং রুমে সোফায় ঘুমাচ্ছেন। আমার বাচ্চা কোথায়? নার্সটি হেসে রুম থেকে চলে গেল। কাচের কৌটায় একখণ্ড মাংস, লাল টলমল; আমার মৃত সন্তান ছিল ওটা। নার্সকে বললাম, আমি নিয়ে যাব। তারা জানায়, স্বামীর অনুমতি লাগবে। কিন্তু, সাধারণত এটা কেউ নেয় না। তাছাড়া ডাক্তাররাও নাকি ডিসকারেজ করেন।

স্বামী সাহেব অনুমতি দেননি। ডাক্তারও অনুমতি দেননি। ডাক্তারের ভাষ্য হলো, এটা দেখে দেখে আপনি অহেতুক কষ্ট পাবেন।

আমার চার সপ্তাহের বুকের ধনকে আমি রেখেই চলে এলাম।

মাহজাবিন থামলেন। চোখের কোনা বেয়ে দুটো জল গাল বেয়ে পড়ছে। আলতো একটা বাঁকা হাসি ঠোট ছুঁয়ে গেল। তিনি কি নিজেকেই নিয়ে হাসছেন। আর ওটা হাসি তো নয়; স্পষ্ট উপহাস বা তাচ্ছিল্য। তার নিজেকে? ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা ডাইরি বের করলেন। ২০১১ সাল লেখা।

দেখুন, হাসপাতাল ছেড়ে আসি একই দিন, সন্ধ্যার ঠিক আগে। বর্ষাকাল। লম্বা দিন। সূর্যের আলো চোখে লাগছিল বড় বেশি। আমার স্বামী ভীষণ খুশি। রাতেই আমাকে নিয়ে বাইরে যাবেন। তার হঠাৎ খুশির কারণ আমি যখন ‘ঝামেলা’মুক্ত। যে দায়ভারমুক্ত।

পোস্ট অপারেটিভে থাকা দুই নার্সের কথোকথন। মাহজাবিন ডাইরি থেকে পড়ে শোনালেন—

—আজকের এসআর কয়টা হলো?

—বারোটা।

—আরও একটা মাত্র দরকার।

—জানি। অবশ্যই হয়ে যাবে।

—সিওর।

মাহজাবিন বললেন আমিও মেডিক্যালের ছাত্রী। আর এখানে গিয়েছিলাম; সেটাও হাসপাতাল! সেখানেও ডাক্তার, নার্স সকল পেশাজীবী!

একটু থেমেই মাহজাবিন বলেন, প্রথম কয়েকটা সপ্তাহ কিছুটা ব্যথা ছিল। এমনকি কোনো অন্যরকম অনুভূতিও হয়নি। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর, যখন শুনলাম আমার বড় বোন কনসিভড। বাড়ি থেকে বাবা-মা ফোন করছেন। আমিও ফোন করছি। বোনকে কনগ্রেট করছি। ঠিক তখনই আমার মাথা ঘুরে এল। অবাক এক শূন্যতায় আমি যেন অনুভূতিহীন পালকের মতো হয়ে উঠলাম। আমারও এখন সুসংবাদ হতে পারত।

চোখ মুখ কঠিন করে মাহজাবিন বলেন, ঈর্ষা বা জেলাসনেস নয়। এটা আমার আইস ব্রেকিং সংবাদ। আমার বাচ্চার দোষ কী ছিল।

হাতের মুঠি, চোয়াল শক্ত হয়ে মাহজাবিনের। ক্রমেই যেন আমাদের কাছে তার রুদ্রমূর্তি হয়ে ওঠা দেখি। একটু হলেও মনে হচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে।

বুঝে উঠতে পারছি না, কী করা উচিত। কফিশপের দু একজন উৎসুক হয়ে যাচ্ছে। ওয়েটার অকারণেই আসছে। একজন যাচ্ছে; অন্যজন আসছে। তিনি হঠাৎ চুপ করে যান। আমরাও। তার চোখে চোখ যে কিছু বলব সেই সাহসটুকুও পাচ্ছি না।

তিনিই বলেন— ভাই, স্যরি, এই যে হাসপাতাল, ক্লিনিক সবাই ভদ্রবেশী কসাই। এরা চাকু আর কাঁচি দিয়েই আপনার সন্তানটাকে…। এরা কোনোদিন ও বলবে না, বুঝবে না একটা গর্ভপাত একজন মায়ের জীবন কীভাবে এলোমেলো করে দিতে পারে।

আমি নিজে সাইকোলজিস্ট দেখিয়েছি। বাংলাদেশ। জাপানে। বাংলাদেশের মহিলা সাইকোলজিস্ট আমাকে জীবনানন্দ দাশের আঠারো বছর আগের একদিন কবিতাটি পড়তে দেন। সত্যি বলতে, একটু হলেও সাহায্য করেছে। সেই মহিলাই বলেন, খুব নিছক কালে-ভদ্রে কেউ আসে গর্ভপাত পরবর্তী কাউন্সিলিংয়ের জন্য। আমার বন্ধু নবনীতা আরেকজন পুরষ সাইকোলজিস্ট দেখাতে বলে। সে নিয়েও যায়। আমার মনে হয়েছিল বেচারা বিয়ের ঘটকালি করলেই ভালো করত। আমায় বলে, আপনার গর্ভপাত নিয়ে কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আমাদের সমাজ এখনো এটাকে একসেপ্ট করতে শেখেনি। আর এটা জানাজানি হলে আপনার পরিবার, আত্মীয়স্বজনের মুখ থাকবে না। এবং আপনার বিয়েতেও সমস্যা হবে। হায় রে কাউন্সিলিং! হায়রে ক্ষুদ্র মানুষ।

গর্ভপাত পরবর্তী সময় এবং মাহজাবিনের ‘দায়’

এর পরই আমার পড়াশোনা শেষ। একটা হাসাপাতালে চাকরি করি। গ্রামের বাড়িতে মাসে একবার যাই; দু’দিন বিনামূল্যে রোগী দেখি। যেটা একদিন সুস্পষ্ট— বললাম, তোমার সাথে আমি আর থাকছি না।

আমি শুধুই ভাবতে লাগলাম, আমি প্রতারিত এবং আমি প্রতারক, হন্তারক। আমি বিষয়টাকে একটু ইতিবাচক দেখতেই চাইলাম— যা হয় ভালোর জন্যই; যা হয়েছে তা ভেবে লাভ নেই। এবং যা আদৌ পূর্ণতা পায়নি; যে সব ভেবে ব্যাকুল হওয়ার চাইতে আবার নতুন করে শুরু করবেন। কিন্তু; মনে হতে থাকে গর্ভপাতের ঠিক আগের সপ্তাহটা, সেই দিনটা, মাথায় ঢুকে যাওয়া এক আজব গন্ধ।

আমি ভয়ে সেই বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় উঠলাম; সেই বিছানা, বালিশ সব পাল্টে দেখলাম। সারাক্ষণ মনে হয়, সারা ঘরটার সব কিছুতেই গন্ধটা থেকে গেছে।

নতুন বাসায় আসার পরও একই সমস্যা হতে শুরু করে। মাঝরাতে মনে হয়, বাবুটা যেন কেঁদে উঠে। আমি কান্নার শব্দে ঘুম থেকে উঠি; তাকে খুঁজি। মাঝে মাঝে মনে হয়, এটা আমার অনুতাপ, আমার অনুশোচনা। নিজেকে জোর করে বিছানায় রাখি, চোখ বুজে শুনতে চেষ্টা করি, বাবুটা ঘুমিয়ে গেছে। আমি আধো ঘুম, আধো জাগরণে থাকতেই শুনি কিছু একটার শব্দ। কান্না বা হাসির নয়। বাবুটা মনে হয় ঘুমাচ্ছে! সে এক বিচিত্র অনুভূতি। এরকম কয়েকদিন যায়; হঠাৎ একদিন মনে হলো, আমি কিছুই শুনছি না। কিছু ঘুমের বড়ি খেতে শুরু করলাম। মনে হয় কাজ হচ্ছে।

নবনীতা একদিন বলে যে, আমার মায়ের সাতে যেন শেয়ার করি। মাকে ডেকে এনে বললাম। মা সোজা বলে দিলেন— বিয়ে কর অথবা বাইরে কোথাও চলে যাও। বিয়ে করা সম্ভব ছিল না; অগত্যা বাইরে যাওয়ার অপশনটাই বেছে নিলাম। সিনিয়র একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখলাম। ঘুমের বড়ি পাল্টে দিলেন।

মনে হচ্ছিল আমি ওভারকাম করছি। কিন্তু, ওভারকাম করিনি। রাতে কোনো শব্দ শুনছিলাম, প্রায় মরার মতো ঘুমাই; সকালে উঠলেই মনে হয় বুকটা শূন্য। মানুষ আর মনে হয় না আমাকে। শব্দ আর শুনি না; কিন্তু ঘুম থেকে উঠলেই মনে হয় বাচ্চাটা আমার দিকে হেঁটে আসছে। বাতাসে হাত বাড়াই, মনে হয় তাকে আমি ধরতে পারছি। বেশির ভাগ সময় আমি তাকে দেখাই। মনে হয় সারাক্ষণ আমার ছায়ার সাথে মিশে থাকে।

মাঝে মাঝে আমি তার নরম মুখে হাত বুলাই। জানি, ওসব আমার কল্পনা কিন্তু আমার অজান্তেই যেন এসব কাজ করি।

একদিন গুলশানে এক জাতকের কাছে হাত দেখালাম। অবাক হলেও সত্য যে, তিনি বলে দেন আমার হারানো এক ছেলে; আপনি কোনোদিন খুঁজে পাবেন না। বন্ধু নবনীতা হাসে। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে কি সবই না আমি করে বেড়াচ্ছি!

একদিন আমার ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা। আড়ংয়ে বসে কফি খাচ্ছি। হঠাৎ দেখলাম সেও আমাকে বলে সেও নাকি খুব দুঃখিত; তারও মন খারাপ হয়। মনে মনে হাসলাম। বললাম— তোমার মন তো এতটাই খারাপ ছিল যে, তুমি ঐ দিন রাতেই আমাকে নিয়ে বাইরে খেতে চাইছিলে। আমায় বলে, আমরা কি নতুন করে আবার সব শুরু করতে পারছি কি না!

অবজ্ঞার হাসি দিয়ে মাহজাবিন বলে, সে কোন কোন পুরুষের সাথে আমার আর বিছানায় একসাথে আমরা বললাম যে আপনি কি নিজেকে কোনোভাবে দায়ী করেন কিনা মাহজাবিন তার ডাইরি খুললেন। হাতের লেখা কোথাও খুবই স্বচ্ছ, কোথাওবা পড়া যাচ্ছে না। একটু দম নিলেন, চারপাশে তাকালেন।

আমরা আরেকদিন বসি। আজকে আর বলতে পারছি না। তাছাড়া আমার এক জায়াগায় যেতে হবে।

মাহজাবিন আবার কদিন পরে বিল মেটালেন। দ্রুত হেঁটে বের হলেন। দরজা থেকে আজ আর হাত নেড়ে বিদায় দিলেন না। বরং মনে হলো টিস্যু দিয়ে চোখ মুছলেন।

বিল্ডিংয়ের ভেতরেও দেখলাম পরে নিলেন সানগ্লাস। জল ছলছল চোখ কাউকে দেখাতে চান না না নিশ্চয়ই। আমরা বসেই আছি। দ্রুত তিনি দিয়ে এলেন; গাড়িটি চাবি রেখে গেছেন সোফার উপর। আমরাও আসলে খেয়াল করিনি।

‘স্যরি টু ডিস্টার্ব।’

কোনো কথা নয়। সানগ্লাস চোখেই। থমথমে মুখ। অথচ আজকেই তার নয়। সানগ্লাস চোখেই থমথমে মুখ। অথচ আজকেই তার সাথে আমাদের শেষ বসার কথা ছিল। সামনের সপ্তাহে তিনি দেশের বাইরে যাবেন। আমাদের করণীয় বুঝতে পারছি না। একজন বলল— সময় দিন, কালকে একবার কল দিয়ে দেখব। যদি সময় দেন তো ভালো; সময় না দিলে তো আর কিছুই করার নেই।

মাহজাবিনই পরদিন দোষ দেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন। আসলে তার কোথাও যাওয়ার কথা ছিল না; শুধু ছেলেটার কথা মনে হচ্ছিল; আবেগ হয়তো সংবরণ করতে পারবেন না, তাই আমাদের সাথে কথা বলতে চাননি। তিনদিন পর আবার দেখা। তার বাসাতেই ডাকলেন এবার।

মাহজাবিন বলেন ‘আমার ডাইরিটা দেখুন। পাতার পর পাতা লেখা। ‘আমি গ্রীক দেবতা থিসিয়াস। আমার জন্ম হয়েছে জেগে থাকার জন্য। আমি জেগেই থাকি। আমি ভাবি, কেতলা ভাবি, আমায় হারানো সাম্রাজ্যের পতনের জন্য রিগ্রেন্ট করি…।

‘আমায় জীবনের কেন্দ্র তো ছিল আমার বাবু আজ বয়স তিন হলো। হাঁটে। দৌড়ায়। সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়।

‘বড় দুষ্টু আর চঞ্চল হয়েছে। কিচ্ছু খেতে চায় না কত কিছু তার জন্য তৈরি…।’

‘বাচ্চাটার রাতে বড় ঠাণ্ডা লাগে। লেপ গায়ে রাখতেই চায় না।’

………………

মাহজাবিন পড়েন আর কাঁদেন। অঝোরে গাল বেয়ে অশ্রু পড়ে। আমরা হতবিহ্বল তাকিয়ে থাকি। আমাদেরই একজন পানি এনে দেয়। পানি খান। চুপচাপ বসে থাকেন। আমরা দেখি ফ্লোরে নানান জাতের খেলনা পড়ে আছে। ‘লজ্জা’, ‘দায়’ যাই বলুন না কেন; আমি তো আর কচি খুকি নই। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে আমি সুশিক্ষিত; হয়তোবা স্বশিক্ষিত নই। লজ্জা তো আমার নিজের কাছে। আয়নায় মুখ দেখলেই মনে পড়ে এত আমি সেই; যার সিদ্ধান্তের জন্য আমার বাচ্চাটা আজ আমার কাছে নেই। সেই তো আমার ডাক্তার সাহেব আমার কাছে নেই; আমি থাকিনি তার সাথে; তাহলে এটা কেন আগে করতে পারলাম না।

এ লজ্জা সর্বগ্রাহী। আমি খুব ধার্মিক নই; মায়েদের গর্ভপাতের অধিকার থাকা উচিত। কিন্তু, এই ধারণা আমাকে তো আমার সন্তানের চিন্তা, তাকে হারানোর গিল্ট ফিলিংস থেকে মুক্তি দিচ্ছে না। আবার, আমি চাই না সমাজ আমাকে লজ্জা দিক। ফলে কাউকে জানাচ্ছি না। আমি প্রায় পরিজনহীন একজন মানুষ। আমার গর্ভপাত নিয়ে কার সাথে কথা বলব। এটা তো আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। জানি, সমাজ মানে আত্মীয়স্বজন হাসবে; টিটকারি করবে আড়ালে কথা বলবে। হয়তোবা হাঁসের গল্প জনে জনে হবে বাঁশের গল্প। কিন্তু আমি মাহজাবিনকে কে সান্ত্বনা দেবে আমার সান্ত্বনার প্রয়োজন নেই। সেখানে সান্ত্বনা আমার কাছে নির্দয় উপহাসের মতোই মনে হয়।

আমি ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নেই আর ডাক্তারি করব না। প্রতিদিন শিশুদের প্রেগনেট মহিলাদের দেখতে দেখতে আমি আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সিদ্ধান্ত নিই পাবলিক হেলথ পড়ব এবং সাধারণ একজন শিক্ষক হয়েই জীবন কাটাব। নো বিয়ে; নো সংসার।

জাপানে দেখেছি, কোনো কোনো মা গর্ভপাত নিয়ে আর পেছন ফিরে তাকাননি। জাট উল্টে বলছেন ‘দারে মো ফিনিশিনাই’ ও কেয়ারস। কিংবা এত জানি আমাকে কেউ যদি বলে বলব ‘হু কেয়ারস’। কারণ, আমার দুঃখ-কষ্ট শুনে অহেতুক সান্ত্বনা দেবে; পুরুষ হলে আমার আরও কাছে আসতে চাইবে। কিন্তু আমি কাউকে তো বলছি না।

আমার কষ্ট আমারই থাক।

আমি দুঃখ পাই; দুঃখ পেতেই থাকব। জানি এর শেষ নেই; শেষ হয়েও না। এটা আমার চিরস্থায়ী সম্মতি। পৃথিবীর সকল সম্পদের বিনিময়েও কি আমার হারানো সন্তান পাব? সম্ভব নয়।

আমরা ভাবলাম, যেহেতু জাপান থাকার সময়েও তিনি জাপানি মায়েদের সাথে কথা বলেছেন। তাই, সেখানকার সময়টার কথা কিছু জানতে চাই। জাপানে সময়টা আসলে আমাকে অন্য এক শিক্ষা দিল। আমি থাকলাম কামাকুরা

বিচের পাশে। আমারই এক জাপানি বন্ধুকে নিয়ে একদিন দুপুরে বিচে বসে আছি। বড় বড় ঢেউ আসছে, যাচ্ছে। আমি কী মনে করে একটি শিশুর ছবি আঁকলাম। ও জানত আমার গর্ভপাতের বিষয়টি। তাই প্রায় উজ্জ্বল এতে সে তার গাড়িতে করে আমাকে বাইরে নিয়ে যেত। আমরা মধ্যরাত পর্যন্ত বাইরে থাকতাম। কামাদুরা বিচের সেই বাচ্চাটির মুখ আঁকতেই সে বলল, এই স্বর্ণালি বালকটি কে?

সেও জানত, আমিও জানাতাম। জানতাম যে, এই চিক করছিল আমার ছেলের সারা শরীর। আনাড়ি ঢেউ এসে নিয়ে গেল আমার বাবুটাকে। আমি ও জাপানি বন্ধুটা তাকিয়ে তাকলাম কিছুক্ষণ একে অন্যের দিকে। জাপানি মহিলাটা বিয়ে করেছিল বহু বছর; তাদের কোনো সন্তানাদি নেই। তার স্বামী আফ্রিকায় কোনো দেশে গেছেন জিওগ্রাফির সার্ভে করতে। সেদিন, যে বলে চলো আজ আমার বাড়িতে থাকবে।

সারা বিকেলে আমরা পাবে কাটালাম। রাতে তার বাসায় ডিনার করলাম। বাড়ির পেছনের বাগানে বসে বাটিতে চুমুক দিচ্ছিলাম। সে বলে, মনে করো, ঈশ্বর তৈরি করেছেন এবং ঈশ্বরই নিয়ে গেছেন। যেমন তুমি আজকে তোমার ছেলেকে আঁকছিলে। ক্ষণিকের সান্ত্বনাও পেলাম মনে হয়।

নানান কিসিমের টেস্ট এর পর প্রমাণিত হয়, আমি কনসিভ করব। করতে পারব। সে আমাকে বিয়ের জন্য এতই পীড়াপিড়ি করে, আমি তাকে প্রায় প্রতিশ্রুতিই দিতে বসেছিলাম। দিইনি। দিতে পারিনি। আমার দ্বারা সম্ভবপর নয়।

এবং ইদানীং ও ম্যাসেজ

আমি আরেকটা সন্তান চাই। আমি হারানো সন্তানটার মুখ আবার দেখতে পাব। কিন্তু, বিয়ে করতে পারছি না। আমি ডিসএ্যাবল নই। কিন্তু, মানসিকভাবে, পর্যুদস্ত। ঘুমের বড়ি সমাধান করতে পারছে না।

আমার হারানো ছেলের স্মৃতিই আমার সম্বল। আর আমাকে যদি প্রশ্ন করেন, শোক আর দুঃখ কী? এই তিনদিনে যা বললাম, তাই কি যথেষ্ট নয়! আকাঙ্ক্ষা আর হারানো, গিল্ট আর লজ্জার সংমিশ্রণ।

এখনো বাচ্চার মুখে হাত বোলাই। আমার পাশে শুয়ে থাকে। মাহজাবিনের কণ্ঠ আস্তে আস্তে নরম হতে থাকে; কিংবা আটকে যায়। বুকের ভেতর থেকে যেন শব্দগুলো ধীরে ধীরে ঠোঁটে আসি আসি করে। কী যেন বলেন। ঠোঁটের অস্পষ্ট উচ্চারণের মানে আমরা বুঝতে পারি না। আবার সাহসও হয় না— কী বলছেন, ভালো করে বলুন। প্রসঙ্গান্তরে যেতে আমরাই বললাম, যারা পড়বেন, মায়েদের জন্য কিছু বলবেন কিনা?

কিছুই বলার নেই। কেউ পড়ে যদি না বুঝতে পারেন তবে বলব গর্ভপাতের কষ্টে অনুভব, মাথায়, সমগ্র চেতনায়। এই চেতনাই ঠিক করে দেবে মায়ের ঘুম, জীবনের কাজকর্ম এমনকি বাকি জীবনের চলার পথ। সুতরাং গর্ভপাতের পরে এসব আমার মতো আর ভেবে লাভ হবে না। আগেই চিন্তা করতে হবে। আমার ছেলে আমার সাথে বড় হচ্ছে। আমার আশপাশেই আছে। থাকবে। যদিও আমার সেই ক্ষমতা নেই তাকে বাস্তবের দুনিয়াতে ফেরত আনার; কিন্তু অনুভব তো আছে।

একটি নাম আছে; তার মুখচ্ছবি আছে। হয়তো পুনর্জীবন পাবে না। পার্থক্য তো যা এইটুকুই।

মাহজাবিন সোজা উঠে দিকে গেলেন। দরজা আটকানোর শব্দ শুনলাম। স্পষ্ট কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। কর্তব্যহীনতার মতো আমরা তিনজন বসে রইলাম প্রায় ঘণ্টাখানেক। চলে আসা তো উচিত নয় এই ভাবে। আবার কতক্ষণ বসে থাকব। নাকি কোনো সমস্যা হলো। তিনি ফিরলেন প্রায় দেড় ঘণ্টা পর। চোখে-মুখে পানি দিয়ে একটু ফ্রেশ হয়েছেন এইটুকুও। পর্যুদস্ত। ক্লান্ত। ভীষণ বিষণ্নতায় ঢাকা মুখ। বললেন অন্তত আপনারা শুনতে চাচ্ছিলেন বলেই আপনাদের সম্মান দেখানোর জন্য বাড়িতে নিয়ে এসেছি। ঘরোয়া থেকে খাবার আসবে; তাও আপনাদের সম্মানে। খাবার এল পাঁচ প্যাকেট। তার ছোট ভাইয়ের জন্য একটা। অন্যটা নাকি তার ছেলের জন্য। সকালে প্রথম যে ভিক্ষুকটা আসে, তাকে গরম করে নিজ নিজ হাতে খাওয়াবেন।

জেনিফার

আমার আত্মার আত্মীয়টা কই

জেনিফার। বয়স ৩১। উত্তরবঙ্গের শহরে জন্ম। পড়াশোনার শেষ ভাগ ঢাকাতে। একটি NGO-তে চাকরি করেন। বিবাহিতা। সন্তানাদি নেই। চাকরির পাশাপাশি আইন পড়ছেন। থাকেন দিনাজপুরে। এটা ছিল দুই বছর আগে। আমার বয়স তখন ২৯।

আমরা বিয়ে করি আরও সাত বছর আগে। আমার শারীরিক হরমোনজনিত কারণে কনসিভ করতে পারছিলাম না। মাসিকের প্রায়ই আমার অনিয়ম হতো স্থায়ী প্রত্যেকবার ইউরিন টেস্ট করাতেন। খুব খুশি মনে বলতেন এইবার পজিটিভ হতে দেখে নিও। রিপোর্ট হাতে এলে বেচারার মুখের দিকে তাকানো যেত না। কালো মুখটা বাংলা পঞ্চান্ন। একবার রিপোর্ট পেয়ে বাড়ি আসতে আসতে কেদেঁই ফেললেন। আমার মায়া লাগে। বলি আরেকটা বিয়ে করো। আমি আবার বাড়ি চলে যাব। তিনিই আসার কথা শোনাতেন। চিনি না বা জানি না, সব আত্মীয়স্বজনের কথা বলতেন। মোজা খালার সন্তান হয় বারো বছর পর। বড় ফুপুর তো ষোল বছর পরে। আসুক বন্ধু, তমুক বন্ধুর বোনের। এভাবেই দিন যাচ্ছিল আমাদের। ইউরিন টেস্ট, রিপোর্ট, হতাশমুখে বাড়ি ফেরা। সে আমাকে নিয়ে যায়নি এমন ডায়াগনস্টিক সেন্টার মনে হয় বাকি থাকেনি। মোট সাইত্রিশটা টেস্ট করানো হয়েছিল।

না পারলে দেখো শতবার, আমরা আটত্রিশবার দেখলাম এবং পজিটিভ! বাড়ি আসতে আসতে মনে হচ্ছিল আমার চেয়ে সুখী মেয়ে মনে হয় আর কেউ নেই। গাড়িতেই খেয়াল করলাম আমার স্বামী আশ্চর্যরকম শান্ত। একদম চুপচাপ। আমি কথা বলেই যাচ্ছি। তিনি চোখ বুজে সিটে হেলান দিয়ে থাকলেন। বিয়ের আগেও প্রায় দশ বছর তাকে আমি চিনতাম। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। আমরা একই উপজেলার ও মানুষ। যদিও বিয়ের আগে একসাথে থাকিনি, বা কোনো শারীরিক সম্পর্কও হয়নি। তবু খোলামেলা প্রাণোচ্ছল একজন মানুষ হিসেবেই জানতাম তাকে। সেদিনের নীরবতা আমার কাছে ভীষণ বৈপরীত্য মনে হলো।

বাসায় গিয়ে তিনি আবার বেরিয়ে গেলেন। আমি সবাইকে কল করে খবর জানাচ্ছি। আমার দু’ ননদ কাছেই থাকে। তারা মিষ্টি দিষ্টি নিয়ে আসে হৈ হৈ করে উঠল।

ইতোমধ্যে আমার স্বামীও আসেন। মিষ্টিমুখ হচ্ছে। বাচ্চারা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। আমার এক বান্ধবী তো হাজির নতুন শিশুর বাড়তি মশারি ইত্যাদি নিয়ে। আমি লজ্জায় শেষ। রাতে সবাই খাওয়াদাওয়া করে বিদায় নিল। আমার স্বামী শুধু বললেন, এখন তোমার সতর্ক হয়ে চলাফেরা করা উচিত। আমার মনে হলো এটা উপদেশ, অমিয়

বাণীর মতো। অন্তত তিনি খুশি। এবং মনে হলো বেচারা বোধহয় এত খুশি যে কথা বলতেই ভুলে গিয়েছিলেন। কিংবা সবার আবেগের প্রকাশ তো আর এরকম হয় না। রাতে ভালোই ঘুম হলো। মাঝরাতে একবার ঘুম ভাঙলে দেখি তিনি পাশে নেই। বারান্দায় দেখছি বসা। সিগারেট ফুঁকছেন বসে বসে। আমি পানি খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল দশটায়। তিনি কখন যে চলে গেছেন খেয়াল করিনি।

মোবাইল ফোনে মেসেজ— ‘তুমি ঘুমাও। তোমার বসকে জানিয়ে দিয়েছি, তুমি আজ যাচ্ছ না।’ দায়িত্বজ্ঞানের কোনোদিনই কমতি দেখিনি।

অযাচিত ছুটি পেয়ে ভালোই লাগল। পরদিন শুক্রবার। সুতরাং একটানা তিনদিন ছুটি। এরই মধ্যে অনেকগুলো কল ও মেসেজ এসে বসে আছে। চা বানিয়ে সবগুলো পড়লাম। আমার বস লিখেছেন, প্রয়োজনে নেক্সট উইকেও যেন ছুটি নিই। আমার বসটাকে কেমন যেন ‘মা’ ‘মা’ লাগে; একজন মহিলা বস ছিলেন বলেই হয়তো আমার সিচুয়েশন বুঝতে পারছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, চা খেতেও পারছি না, কেমন যেন বমি বমি লাগছে। অথচ এতকাল পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সমস্যা হয়নি। ব্যাপারটা সাইকোলজিক্যাল ছিল সন্দেহ নেই।

জীবন সম্পর্কে আমি সব সময়ই প্রো-এপ্রোচ পোষণ করি। সেই কলেজ জীবন থেকেই স্বপ্ন দেখি একটা বাচ্চা। একটা মেয়ের স্বপ্ন দেখি। বিশেষ করে আমার মেয়টো হবে ‘আলো’ ছবির মেয়েটার মতো। সবার কোলে কোলে মানুষ হয়ে; বড় হবে।

আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়, ফোন করলেন, অনেক কথা হয়। সেদিনও হলো। শুধু বললেন, তোমার স্বামীর মতামত কী? আমি বলি, মতামত কীসের?

—না, মানে তোমরা ভবিষ্যৎ কী চিন্তা করছ, এসব…।

আমার মাথা ছমছম করে ওঠে। তিনি কী বোঝাতে চাইছিলেন। গর্ভপাত না তো! তাকে আবার কল দিই। ব্যস্ত আছেন অজুহাতে ফোন রেখে দেন। তিনি মোটামুটি ফ্রিই থাকেন। কোনোদিনই এভাবে কল রাখেন না।

দুপুরের পর আমার স্বামীকে ফোন দিলাম; তিনি ভালো-মন্দ বলে রেখে দিলেন। অজানা আশঙ্কা আমাকে পেয়ে বসছে। আমার শাশুড়ির সাথে কথা বললাম; তিনি খুশি। আমার ঐ আত্মীয়দের কথা আমার আশঙ্কার কথা জানাতেই তিনি ধমকে দিলেন। সাথে এও বললেন, তার ছেলের সঙ্গে তিনি এক্ষুনি কথা বলছেন। এবং সম্ভব হলে আমরা যেন তার ওখানে যাই। তিনি প্যারালাইজড; আসতে পারবেন না কিছুক্ষণ পর আমার স্বামীর ফোন— ‘আম্মার সাথে আমাদের ব্যক্তিগত বিষয় কথা বলার দরকার কী ছিল? আমাদের বাচ্চা, আমাদের ভবিষ্যৎ আমরা ভাবব। এসব নিয়ে তা বাজার বসানোর দরকার নেই। তাছাড়া আমার চাকরিতেও ঝামেলা হচ্ছে। এনিওয়ে, আমি এলে কথা হবে।

টেনশন যেন বাড়তেই থাকে। বিকেলে ঘুমিয়ে যাই। সন্ধ্যায় উঠে দেখি আমার স্বামী ড্রয়িংরুমে বসে ফোনে কার সাথে যেন চিৎকার করছেন। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। কোনো কথা হয় না। আমি ঘুমোতে পারছিলাম না। আজেবাজে সকল চিন্তা আমায় পেয়ে বসছে। যদি সত্যি এরকম হয়ে থাকে আমি কী করতে পারি!

আমি যথেষ্ট বয়স্ক, আমি ম্যাচিউরড এনাফ, আর্থিক হিসাবে আমি স্বাবলম্বী। তাছাড়া আমার আজন্ম লালিত স্বপ্ন। আমার শাশুড়ি যথেষ্ট দায়িত্বশীল ও হেল্পফুল। এমনকি আমার মাও। মা-বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে একটু বাড়তি আদর পেয়েই গেছি সারাজীবন। আমার ননদগুলোও সাপোর্টিভ। সুতরাং, মনকে বোঝালাম এমন কোনো অবস্থার মুখোমুখি হলে আমিই সিদ্ধান্ত নেব। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন বেলা করেই আমরা ঘুম থেকে উঠি। বারন্দায় বসে চা খাচ্ছিলাম আর পত্রিকায় চোখ বোলাচ্ছি। আমার স্বামী বললেন, আমার চাকরি আর নেই।

খারাপই লাগল। খারাপ লাগার মতো সংবাদ বটে। বললেন, পুরান ঢাকায় তার এক বন্ধু যাকে বেশ কিছু পুঁজি দিয়ে ব্যবসা দিয়েছিলেন সে বলছে বঙ্গোপসাগরে নাকি জাহাজ ডুবে গেছে। সে আবার টাকা চাচ্ছে। মনের খেদেই বললেন— ‘যত্তসব ব্যাড নিউজ একসাথে চলে এল।’

বুঝলাম না বাচ্চাটাও কি এখন ব্যাড নিউজ! আরেক কাপ চা আনো তো। বুঝলাম লম্বা আলাপের প্রস্তুতি। আমি চা বানাতে বানাতে ঠিক করলাম যা ভেবেছি তাই করব। আই হ্যাড টু স্টার্স্ট। আমার স্বামী মহোদয় বললেন— ‘তুমি কী করতে চাচ্ছ?’

—মানে?

—তোমার পরিকল্পনা কী, তুমি কনসিভড।

—আরও পাঁচ মাস বা ছয় মাস অফিস করব ভাবছি। আর বস বলছেন ম্যাটারনিটি লিভের সাথে আরও দু’ মাস লিভ দেবেন। সুতরায় কোনো সমস্যা তো দেখি না।

—না, মানে বলছিলাম, যেহেতু চাকরিটা আমার নেই, তাছাড়া ব্যবসাটাও লস। এমনটি সহসা কোনো চাকরি পাব তাও তো দেখছি না।

—সমস্যা কী, আমার ডিপোজিট তো আছেই; এগুলো নিয়ে নাও। আর নেবেইবা কী; এগুলো তোমার আমার যৌথ একাউন্টেই আছে। পাস, আমার কর্তন। এবং চাকরি তো একটা হবেই। এত ঘাবড়াবার কোনো কারণ দেখি না। বস্তুত, আমি বুঝে গেছি তিনি কী বলতে চাইছেন, এবং তিনি খোলাখুলি বলতেও সাহস পাচ্ছেন না। হয়তো এতটা আর্থিক লোকসান, চাকরি হারানো, সব মিলিয়ে আসলেই লেজে-গোবরে অবস্থা।

—আমি ভাবছি আমরা যদি এই বাচ্চাটা না নিই তাইলে কেমন হয়? মানে আমি বলছি না যে, তুমি এসআর করে ফেলো এক্ষুনি। এটা আমার প্রস্তাব মাত্র। আমরা আলোচনা করি; দেখি; বুঝি; তারপর সিদ্ধান্ত নিই। তুমি কী বলো?

—আমিও তাই ভাবছি; মানে তোমার এত সব নিয়ে একটা বাবু তো আর সোজা কথা নয়। তাছাড়া, একবার যখন পজিটিভ হয়েছে; নিশ্চয়ই আবার হবে।

—সত্যিই? তার চোখে তারাবাতি জ্বলে উঠল।

এতটা সহজে আমি মেনে নিচ্ছি, এটা আমার স্বামী সাহেব বুঝতেই পারেননি। আমি দিনাজপুরের মেয়ে। প্রচণ্ড খরাতে কেমনে পানি পেতে হয় যেমন জানি; তেমনি জানি প্রচণ্ড শীতেও কেমনে শরীর গরম রাখতে হয়!

—তাহলে এক কাজ করো, আমি কাল পোর্টে যাচ্ছি; দেখি আদৌ জাহাজ ডুবল কিনা; তাছাড়া বীমার ব্যাপারও আছে। তিন চারদিন পর আসব; তখন না হয় ভেট কিছুও করব। আবার ডাক্তারের সাথেও একবার কথা বলা দরকার। তুমি বরং এ সপ্তাহ ছুটি নিয়ে নাও।

—আমি ছুটিতেই আছি। মোবাইল ফোনে বস ছুটি দিয়েই দিয়েছেন। আমি সত্যিই তাকে এনে মোবাইল দেখালাম। আমার স্বামী আমার বুদ্ধির প্রশংসা করলেন।

জুম্মা পড়তে মসজিদে যাবেন। বললেন, ভুনা খিচুড়ি করো আর বেগুন ভাজা। তার অতীত খুশির উদযাপন পদ্ধতি আমি জানি। শুকনো মরিচও ভেজে রাখলাম। বলতে মনে হয় ভুলে গেছেন।

রান্না করতে করতে ভাবলাম আমার শাশুড়িকে জানাই। আবার মনে হলো, তিন চারদিন সময় তো হাতে আছেই। এত তাড়ার দরকার নেই। তাছাড়া এত বড় সুসংবাদের পর তাকে গিয়ে সালাম করা উচিত। ভদ্রমহিলার প্যারালাইজড না হলে এতক্ষণে চলে আসতেন। এরই মাঝে তিনি ফোন করলেন। জানতে চাইলেন তার ছেলে কিছু বলেছে কিনা। সম্পূর্ণ অস্বীকার করলাম। তিনি খুশি হলেন— বললাম না গো বউ মা, আমি শাসিয়ে দেব।

আমার স্বামী চট্টগ্রামে চলে যান। আর আমি বসে ভাবছি কী করা যায়। তিনি সময় সময় ফোন দিয়ে খবর নিচ্ছেন। এরই মধ্যে একদিন আমার বসের সাথে দেখা করলাম। বিস্তারিত বলার পর তিনি বললেন, ইউ আর সাফিসিয়েন্ট এনাফ টু হ্যাড দিস বেবি।

আমার রাতগুলো লম্বা হতেই থাকে। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় আমি দিশেহারা প্রায়। কাল সকালে আমার স্বামী ফিরবেন। বুঝতে পারছি না আমার আত্মবিশ্বাস নড়বড়ে হতে আরম্ভ করছে কেন। আমার চোখের নিচের কালিমা গাঢ়তর হচ্ছে। আমার স্বামী কাল সকালে আসছেন; আমি অজানা আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠছিলাম। অথচ তিনি এত দুদিন পর এলে আমি কী উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। বারবার জিজ্ঞেস করতাম, কী খাবে, কী রাঁধব! এবার ঠিক উল্টো হচ্ছে। আতংকে আমি সারাটা রাত ঘুমাইনি।

ভোরের দিকে ঘুম লাগল। এবং তার আসার মাঝে আমি জেগে উঠি। তার মাঝে কোনো ক্লান্তি নেই। ফ্রেশ হয়েই বললেন— চল, ডাক্তারে কাছে যাই; আমি এপয়েন্ট করে রেখেছি।

আমার গর্ভপাত করানোতে দেখি আমার স্বামী সাহেবের উৎসাহের কোনো কমতি নেই। আমি বললাম, এত তাড়াহুড়ার কী আছে? যাক না আরও ক’টা দিন। তাছাড়া তোমার একটা জবও বোধহয় হচ্ছে।

[মিথ্যাই বললাম]

ক্ষোভে রীতিমতো অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠলেন; সামান্য ত্রিশ হাজার টাকার চাকরি করে বাচ্চা রাখতে চাও; আবার আমাকেও জব দিচ্ছ! তুমি বুঝতে চেষ্টা কর, আমি ওর বাবা, এবং আমার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত! তুমি যদি একার সিদ্ধান্তে বেবি রাখতে চাও, ওয়েলকাম বাট গুডবাই ফ্রম মি।

—মানে কী?

—আমি তোমাদের দু’জনকে ডিভোর্স দেব।

—দু’জন?

—ইউ এন্ড ইউর বেবি পিগ।

আমার হাতে পানির গ্লাস ছিল। খপাস করে পড়ে গেল। আমার কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, কী শুনলাম!

এই লোকটাই কী প্রতিবার ইউরিন টেস্ট করিয়ে দাঁড়কাকের মতো বসে থাকত পজিটিভ হবে! এই কি সেই লোক যে নেগেটিভ হলো বলে নীরবে চোখের জল ফেলে? আমার সমস্ত বিশ্বাস যেন এক নিমিষে উঠে গেল। হা খোদা! কী শোনালে!

আমি বুঝে উঠতে পারছি না কার সাহায্য চাইব? মা, শাশুড়ি, ননদ কে সাহায্য করবে। আবার এও জানি এই লোক কারও কথাই শুনবে না। পরামর্শ শব্দটা তার অভিধানে নেই।

তিনি বেরিয়ে যান। সন্ধ্যার পর ফেরেন— ‘ভাত দাও।’ সারাদিন কোনো খবর নেই। ভাত খেতে খেতে বলেন, কিছু ভেবেছ?

—না।

—তোমার আমাকে কোঅপারেট করা উচিত।

—কীভাবে?

—দেখো এমন যদি হয় আমি বাচ্চাটার প্রতি যত্ন নিচ্ছি না বা আদর যত্ন করতে পারছি না কিংবা তাকে মানসিকভাবে আমি মেনে নিতে পারছি না; সে ক্ষেত্রে সারাটা জীবন সে আমাকে ঘৃণা করবে; যা তার মানসিকতায় প্রভাব ফেলবে। এবং আমারও, পৃথিবীতে তাকে নিয়ে এসে কেবলই তার যন্ত্রণা বাড়াব। আমি গভীর মনোযোগে তার কথাগুলো শুনছি; মানবহত্যার কী সুন্দর যুক্তি; মনে মনে বলি ধন্যবাদ যুক্তিবিদ্যা! তিনি আরও বলেন—বাচ্চাটার যদি ভালো একটা জীবন না হয়; সে ক্ষেত্রে তো আমার দোষ নয়; আমি তো এখন বলছি যে এমআর করে ফেলো। এবং এটা কেবলই তোমার স্বার্থান্ধ চিন্তা হবে যে, বাচ্চাটার জীবন নষ্ট করছ তোমার স্বার্থে। তোমার আবেগেই এখানে দায়।

—আমার আবেগ মানে তোমার কিছু নয়? তুমিই তো প্রত্যেকবার ইউরিন টেস্ট করাতে বলতে; ঠিক কিনা?

—ঠিক, কিন্তু, তোমার জানা উচিত সস্তা আবেগ দিয়ে পৃথিবী চলে না। পৃথিবীর চালিকাশক্তি অর্থ।

—আমি তো জমানো বিশ লক্ষ টাকা তোমাকে দিচ্ছি। এছাড়া জব তো তোমার হবেই।

—বুঝতে চেষ্টা করো, তর্ক কোরো না। তোমাকে ভবিষ্যৎ বলছি, মানে ছেলে বা মেয়েটার ভবিষ্যৎ। আমি বাবা হয়ে মানসিকভাবে এখনো প্রস্তুত নই; যা তার উপর পড়বেই। এবং তার জন্ম পরিবারের সকলের জন্য একটা জিজাস্টার হয়ে থাকে। আমি, খুব মনে পড়ে খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি। আমার কান, চোখ যেন অন্য এক মানুষের কথা শুনছে; অন্য এক মানুষকে দেখছে। এ লোকটা আমার স্বামী নয়। ছিল না কোনোদিন। আমি চিৎকার করে কেঁদে ফেলি। দুর্বিসহ সে রাতের প্রত্যেকটি কথা আমার কানে আগে পরিষ্কার শুনতে পাই। একটি সুন্দর স্বপ্নময় আনন্দময় আলোচনা হবে পারত সেই রাতে। আমার কান্না আসে। তিনি বলে যান— এটা তোমার সিদ্ধান্ত। যেহেতু কনসিভ করেছ আবারও করবে। এবারেরটা ‘এবর্ট’ করে দাও। কিছুই হবে না। প্লাস তোমার আমার রিলেশনটাও থাকবে। তাছাড়া এই মুহূর্তে আমাকে খুব টাফ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে; আমি বহুত যন্ত্রণার মাঝে আছি। আমার যন্ত্রণা আর বাড়িও না।

সে রাতে বিছানায় সে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, আমি খুব কষ্টে আছি। জাহাজের বীমা ছিল না; সুতরাং ওটা কমপ্লিট লস। প্লিজ, তুমি দায়িত্বশীল হও; একবার আমার দিকে তাকাও।

পরবর্তী কয়েকদিন তিনি বাসাতেই ছিলেন। দিন রাত কেবলই আমার কানের কাছে একই বাক্য আওড়াতে থাকেন। আবার যেন মনে, আমাকে পাহারা দিচ্ছেন, আমি কারও সাথে কথা বলি বা কোনো পরামর্শ করি। ইতোমধ্যে আমাকে দু’জন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। একজন ডাক্তার আমারও পরিচিত। বললেন, এটা আপনাদের দুজনের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আর পরবর্তীকালে আবার কনসিভ করবেন; তার নিশ্চয়তা কেউ দেবে না। অন্যজন বলেন কেউ কেউ এসআর পরে একটু ডিপ্রেসভ ফিল করে বাট ইটস ভেরি টেম্পরারি।

মাথায় ঢোকে না, একট বাচ্চার জীবন শেষ করার পর মায়েরা নাকি ‘একটু ডিপ্রেস’ হয়। আমরা বাসায় এসে আবার ভাবি; সে একই গান শোনাচ্ছে। আমি অফিস থেকে পুরো মাসটাই ছুটি নিই। মানে একদিন গিয়ে বসবে ডাইরি, চাবি, অন্যান্য কিছু কাগজপত্রে সই করে আসি।

একদিন সকালে তিনি বলেন, তোমায় এক্ষুনি এপয়ন্টমেন্ট নিতে হবে। আমি আর পারব না। আমার আরও হেডএইক আছে; একটা একটা করে সব শেষ করতে হবে। সুতরাং ডু ইট নাউ, রাইট নাউ। ইনাফ ইট ইনাফ।

আমি হতবাক। ক্ষীণ ধারণা ছিল তার শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং আমরা বাবুটাকে রাখতে পারব।

সেইদিন এবং তারপর

পরদিন হাসপাতালে যাই। হাসপাতাল ঠিক নয় একটা ক্লিনিকে মতোই। যারা এমআর করিয়েই বেঁচে আছে। আমার স্বামীই গাড়ি চালিয়ে যান। ড্রাইভারকে কী জানি কাজে ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কাজের মেয়েকেও ছুটিতে। বহুদিন সে নাকি ছুটিতে যায় না। বুঝতে পাচ্ছিলাম তিনি কাউকেই দেখতে চান না। ভালো মানুষটির চেহারা যেন কেউ না বোঝে। এই তো হাসপাতালে গিয়ে এসআর করিয়ে এলাম।

জেনিফার থামেন। মনে হচ্ছে আর কিছু বলতে চাচ্ছেন না। নীরব চোখ দুটো শান্ত। নিচের দিকে চোখ রাখা। কিছুটা লজ্জিত; একটু যেন চুপ হয়ে গেলেন। আমরা বলি, আজ না হয় থাকুক, আরেকদিন কথা বলব। কোনো উত্তর নেই। সুনিশ্চিত, তিনি দ্বিধাগ্রস্ত। বলা কি কনটিনিউ করবেন, চিন্তা করছেন। আমরা আবার বললাম— আপু, আজ না হয় থাকুক, সময় করে আরেকদিন বসব। এবারও সংবিত ফিরে এলেন যেন।

না না কোনো সমস্যা নেই। আসুন, আরেক কাপ চা খাই। হাসপাতালে গিয়ে সোজা অপারেশন থিয়েটারে। কেউ কিছু জানতে চায়নি। যেন দোকানঘর। খদ্দের আসছে-যাচ্ছে। ওয়েটিং রুমে দেখলাম আট দশজন মেয়ে বসা। দু’তিন-জন পুরুষও। সারাটা পথ আমি মূর্তির মতো বসে ছিলাম। নীল গাউন পরিয়ে টেবিলে তুলতেই যেন আমার জমানো কষ্ট চিৎকার দিয়ে উঠতে চাইছে। আমি কিছুই বলতে পারছি না। আমার কণ্ঠ কে যেন রোধ করে দিয়েছিল। একবার মনে হলো লাথি মেরে সব ফেলে দিই। দু’জন নার্স আমাকে ধরে ইনজেকশন পুশ করল। গভীর অচেতনে চলে গেলাম।

জেনিফার আবারও দম নেন। ভাবেন। আমরাও তাড়া দিইনি। পানি খান জেনিফার এবং কেঁদে ফেলেন। রুমালে মুখ ঢাকেন দুই হাতে। আমাদের মেয়ে সহকর্মী উঠ গিয়ে কাকে হাত রাখে। তিনি তাকে জড়িয়ে ধরেন। আমার বাচ্চাটা ওরা নিয়ে নিল। আমার বাচ্চাটা… এক ভারী পরিবেশ তৈরি হয়ে যায় কফিশপের ভেতরে।

চেতনা ফিরে এল। আমি সাদা চাদরে ঢাকা, সেনাইলের দম বন্ধ গন্ধের মাঝে শুয়ে আছি। অবাক এক শূন্যতায় আমি আমাকে দেখছি। আমার স্বামী পাশেই একটা চেয়ারে বসা। রুমে আমি একা। তিনি আমার হাত ধরতে চাইতেই এক ঝটকায় হাত সরালাম। মনে হলো এক সাক্ষাতে জলদি। এখনই সিদ্ধান্ত নিই তার সাথে আর থাকব না। হাসপাতাল থেকে সোজা গেলাম আমার শাশুড়ির বাসায়, সন্ধ্যায়।

তাকে বলেছিলাম, তুমি বলে দাও একদিন যেন থাকি; আমার শরীর ভালো লাগছে না। উদ্দেশ্য ছিল যাতে তিনি চলে যান। আমি আমার মতো হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে চলে যাব। তিনি নিশ্চিত আমার কোনো সমস্যা হয়নি; এবং আমি মেনে নিয়েছি তার এই হত্যাযজ্ঞ।

আমার শাশুড়ি কাঁদলেন। শ্বশুর সাহেব বলেন— মা, তুমি দেখো, আজ রাতেই তাকে আমি ত্যাজ্যপুত্র বলে ঘোষণা দিচ্ছি। আমার সামনেই ল’ইয়ারকে বললেন আসতে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে। আমাকে নিশ্চয়তা দিলেন যেন তাদের বাসাতেই আপাতত থাকি। আমি বললাম, যা হয়ে গেছে তার জন্য আমার দায়। আমি আপনাদের ছেলের সাথে থাকব না। আমি মায়ের কাছে চলে যাচ্ছি। আমি তাদের পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। তারা ভাবলেন হয়তো সাময়িক এ অভিমান ঠিক হয়ে যাবে।

আমাকে রাতেই গাড়ি করে দিনাজপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। এবং তাদের সাথে এটাই আমার শেষ মোলাকাত। আমি দিনাজপুরে পোস্টিং নিয়েছি। এটা আমার শহর। আমার স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়নি; এটা আসলে আমার বাচ্চার টেকনিক মাত্র। ডিভোর্স শুনলে অনেকই গা ঘেঁষে সম্পর্ক করবেন! তাই সবাইকে বলি আমি বিবাহিতা। তার সাথে কালেভদ্রে একবার কথা হয়। ঐ পর্যন্তই। আমার বস সব শুনে বলছেন যতদিন ইচ্ছে ছুটি নাও। এবং আমার সিদ্ধান্ত যে, সঠিক ছিল না আবারও মনে করিয়ে দেন।

আপনার এখানকার অবস্থা

প্রথমদিকে মনে হতো চাকু দিয়ে নিজেকে ফালি ফালি করে কেটে দিই। অপমান, লজ্জায় আমি ঢাকাতে থাকতে চাইনি। কখনো মনে হতো আত্মহত্যা করি। রাতে ঘুম হতো না। আমার মা সারাক্ষণ কাঁদেন।

কীভাবে আমি এমআর করাতে রাজি হলাম? সেই প্রশ্নের উত্তর আজও পাইনি। সারাক্ষণ খালি মনে হয় এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। একটা বাচ্চার স্বপ্ন নিয়ে আমি বড় হয়েছিলাম। আমার মা আমাকে একদিন বলেন, তুই যদি উল্টাপাল্টা কিছু করিস, আমাকেও বলিস, এই দেখ, এক শিশি পটাশিয়াম সায়ানাইড। তুই কিছু করলে আমি এটার সদ্ব্যবহার করবই। তোর প্রিয় বাবাকে আমি একা রেখে যাব; নিশ্চয়ই তুই এটা চাইবি না।

আমার বেঁচে থাকা উচিত, এই অনুভূতি এখন আর নাই। মনে হয়, আমি আত্মহত্যা করব, আর লিখে দিয়ে যাব একটি হাসপাতালের ত্রিশ মিনিটের অপারেশন আমার জীবন আর আমার বাচ্চার জীবন কীভাবে নিয়ে গেছে। ঘুরে-ফিরে মনে হয়, আমি যদি আমার বাবুকে মারতে পারি; আমাকেও মারতে পারি। সহজ সরল সমীকরণ।

এমআর করানোর আগে আমি ইন্টারনেট দেখছিলাম, বাংলাদেশ এমআর করানো মায়েদের কোনো অভিজ্ঞতা বা কোনো শেয়ারিং, কিছুই পায়নি। শুধু মনে পড়ে আমার বাবুর হত্যার জন্য আমি একক দায়ী। এ দায় আমার, এ কষ্টও আমার প্রাপ্য।

গতমাসে আমার স্বামী কল দিয়ে বলল, এসব দুর্ঘটনা তো জীবনে হয়ই। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। আমি বললাম, একটা পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞকে তুমি নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিচ্ছ?

এসব মনে করে লাভ কী?

আমি বলি, আমি মনে করতে চাই না বলে তো আর তোমার সাথে থাকছি না।

তিনি নতুন চাকরি নিয়েছেন। বহাল তবিয়তে ব্যবসাও করছেন। আমিও আছি আমার মতো। আগামীকাল তার সাথে দেখা হবে আমার অফিসে, এবং আমার ধারণা তিনি ডিভোর্স নিয়েই কথা বলবেন। আমি কোনোই সমস্যা দেখি না। আমি বুঝতেই পারিনি আমার বাচ্চাটার সাথে একা গভীর এটাচমেন্ট ছিল। আমি আক্ষেপ আর আফসোস করেই যাব সারাজীবন। এটাই আমার নিয়তি।

আমার নিজের সত্তা, সাইফ, আত্মা, বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস সব তছনছ হয়ে গেছে। আমার সেই আমি আর নেই। আমার বৃদ্ধ বাবার জন্য আমি বেঁছে আছি।

জেনিফার থামেন। পানি খান। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন আমাদের দিকে। কী বলব, কী বোঝাব, কীইবা সান্ত্বনা দেব আমরা মাথা নিচু করে বসে থাকি। মুর্হূতগুলো কাটে সুনসান নীরবতায়। নীরবতা ভেঙে তিনিই বলেন– প্রথমে মনে হয়েছিল আপনাদের বলে কী হবে, আবার মনে হলো আমি যখন খুঁজছিলাম কোনো বইপত্র, আর্টিক্যাল কিছুই পাইনি। অন্তত কেউ একজন হলেও তো পড়বে। আরেকবার মনে কালকে বসি আজ খুব ক্লান্ত লাগছিল; কিন্তু কাল অফিসে যেতে হবে এবং উনার মাঝেও মিটিং আছে।

আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ দিলেন এবং দ্রুতই যেন আমরা প্রকাশ করি, উইশ করলেন। চিন্তা করলাম, তিনি স্বামীর সাথে মিটিং করবেন, দেখা নয়; তার মানে মন দিয়েই এ সম্পর্ক আর তিনি রাখছেন না। হায় এমআর, হায় সর্বনাশা গর্ভপাত!

চামেলী

কোথায় লুকাল নাছোড় যন্ত্রণা

চামেলী। বয়স ২৪। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষ। চট্টগ্রাম শহরেই থাকেন। বাবা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। সকল ভাই-বোনের ছোট তিনি। বাবার সাথে ব্যবসা দেখেন। ব্যবসা শিখছেন। উচ্চমাধ্যমিক অব্ধি পড়েছেন। আবারও পড়াশোনা শুরু করবেন। আমরা তার সাথে চট্টগ্রামেই সাক্ষাৎ করি। তার বাসাতেই। সম্প্রতি বিয়ে করেছেন। সন্তানাদি নেই।

চট্টগ্রামের মূল শহরেই চামেলীদের বাসা। স্বামী ঢাকাতে যেতে হয় প্রতি সপ্তাহে। তাই তিনি বাবার বাড়িতে থাকেন। তার স্বামী তার বাবার একটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। তিনি খ্রিস্টান পরিবেশে জন্ম নেন। এখন ধর্মান্তরিত মুসলমান। মাথায় হিজাব পরে থাকেন। পরিপূর্ণ ধার্মিক বলেই স্বীকার করেন নিজেকে।

বাসাতে তার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আদিবাসী চেহারার ভদ্রলোক শুদ্ধ বাংলাতেই কথা বলেন। সৌজন্য কথাবার্তার পর তিনি চলে যান। চামেলী বলেন তার মা নেই বলেই তিনি বেশির ভাগ বাসার বাসাতেই থাকেন। দোতলার ফ্লোরটা তার এবং তার স্বামীর জন্য।

হাসিখুশি চামেলীকে এক পলক দেখলে বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। আমরা সকাল দশটার দিকে পৌঁছাই। প্রথমেই দুপুরের খাবার খেয়ে যেতে হবে। ফ্রেশ কালো রূপচাঁন্দা আর গলদার মেন্যু।

বলেন চামেলী—।

এসএসসির পর বাবা আমাকে মালয়েশিয়ার একটি বের্ডিং কলেজে পাঠিয়ে দেন। যেহেতু বাড়িতে মা নেই; আর তিনি মাসের দীর্ঘদিনই মালয়শিয়া থাইল্যান্ড থাকেন। তাছাড়া আর্থিক কোনো সমস্যা ছিল না। তাই সব বিবেচনাতে বাবার সিদ্ধান্ত আমার খুব আমার ভীষণ পছন্দ হয়। তাছাড়া মালয়েশিয়ার পড়াশোনার মানও খারাপ নয়।

বাবা চাইছিলেন আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে পাস করি। যেহেতু বাকি ভাই-বোনগুলো পড়াশোনাতে ভীষণ ভালো; আমিও যেন ভালো হই। ভাই দুজন প্রবাসী। দুবোন বিয়ে করে তারাও প্রবাসী। সুতরাং বাড়িতে আমি একা এবং বাবা প্রায়শ আমাকে দেখতে যেতে পারবেন।

জন্মসূত্রে আমি খ্রিস্টান। পরিবারে ধর্মকর্ম না চললেও আমরা ছোটবেলা থেকেই আমরা সকলেই গীর্জামুখী। পারিবারিক আবহে স্নেহ বা রিলেশন ইত্যাদি নিয়ে কোনোদিনই আলোচনা হয়নি। একজন লগনের কাছে বড় হওয়া। আমার জন্মের তিনদিন পর মা মারা যান। জন্ম আমার দুর্গম পাহাড়ে। মায়ের মুত্যুর পর বাবা প্রতিজ্ঞা করেন, অন্তত বিনা চিকিৎসাতে যেন কোনো মা মারা না যান। তিনি শহরে চলে আসেন।

কুয়ালালামপুরের কলেজটি বোর্ডিং। এবং অবশ্যই মেয়েদের। শনিবারে কেবল আমরা বাইরে যেতে পারতাম। গার্ডবুকে লিখে দিতে হতো কোথায় যাচ্ছি কখন ফিরব। সন্ধ্যা সাতটার আগে ফিরতে হলো। ভালোই দিন যাচ্ছিল; একদিন ‘সাইভিন’ নামে এক শপিং মলের ওখানে একজনের সাথে পরিচয়। সেও বাংলাদেশের। প্রথম দেখাতেই

আমার ভালো লেগে যায়। আমরা প্রতি শনিবার চুটিয়ে আড্ডা মারি। সে কার থেকে গাড়ি ভাড়া করে। আমরা সারাদিন ঘুরি। মজাই লাগছিল। আমার হাত ধরে বসে থাকে সারাক্ষণ। একদিন কিস করে। আমার সারা শরীর হিম হয়ে আসে। আবার অদ্ভুত ভালো লাগে। কাতর হয়ে থাকি আরেক শনিবার আসবে। সে কিস করবে।

পড়াশোনাতে মন বসে না। ফোনে সারারাত কথা বলি। দিনে ল্যাবে ঘুম ঘুম চোখে কোনো সলিউশন করতে পারি না।

এর মাঝে সামার ভ্যাকেশন। বাবা আমাকে নিয়ে দেশে আসেন। সেও আসে। আমাদের বাসাতে একদিন হঠাৎ করে চলে আসে। বাবা বাসায় ছিলেন। বললাম, কুয়ালালামপুরে পরিচয়। বাবা হাসিমুখে তাকে কথা বললেন। চা আসার পর সে চলে যেতে চাইলে বাবাই বলেন থেকে যেতে। হোটেল থেকে সে তার ব্যাগ নিয়ে আসে। রাতে দোতলার গেস্টরুমে সে থাকে। সকালে বাবা তার সাথে কথা বলেন। তার বাবাকে আমার বাবা চেনেন, তিনি একজন ট্রলার ব্যবসায়ী। পরিদিন সন্ধ্যায় সে চলে যায়। আমার মনে হচ্ছিল যদি আমিও চলে আসতাম তার সাথে। মনে পড়ে, সকালে সে যখন ঘুমে, আমি আলতো করে তার রুমে ঢুকে পায়ে চুমু খেয়ে চলে আসি। দোতলায় ওঠার আগে দেখি নিই বাবা মনিং ওয়ার্কে বের হয়ে গেছেন।

এরই মাঝে আমার ইয়ার টুয়েলড শেষ। বাবা বলছেন মালয়েশিয়াতে পড়তে। আমি বললাম বাংলাদেশে। আমার বন্ধুর এমবিএ শেষ আর আমার মালয়শিয়া থাকতে ইচ্ছে করছে না। বাবা বলেন, ইউরোপের কোথাও। আমি গেলাম না। নর্থসাউথে ভর্তি হলাম। বাবা দু’বেডের একটা ট্রাই কিনেই দেন। মাঝে মাঝে তিনিও এসে থাকেন। আমাদের দুজনের সাক্ষাৎ এখন প্রতিদিন হয়। রোজ সন্ধ্যায় সে বাসায় আসে এবং আমার সাথে রাতে খায়। চলে যায়। বিছানায় যেতে সে আব্দার করে। আমার তেমন কোনো বাধা পায় না। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর এসব হবে। কিন্তু হলে না। আমার সাথে প্রায়ই রাতে থাকে সে। প্রতিরাতের পর সকালে মনে হয় নো মোর সেভ। বিয়ের আগের এই শারীরিক সম্পর্ক আর একটা অপরাধবোধ আমাকে কেমন যেন কণ্টকিত করে তোলে।

প্রাথমিক দিকে আমরা কনডম ব্যবহার করতাম। আমি যে শুনেছিলাম যে পিল খেলে নাকি মেয়েরা মোটা হয়ে যায় আরও কী সব ঝামেলা হয়। কয়েক মাসের মধে আমার মধ্যে কনসিভ হওয়ার আশঙ্কা হতে থাকে। বাসাতেই টেস্ট করাই নেগেটিভ আসে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি আর প্রতিজ্ঞা করি— নো মোর।

কিন্তু আমার শিক্ষা হতে থাকে যে, সে আমাকে বিয়ে করবে না। কনসিভ করি বা না করি। কারণ সে এখন আসে কেবল আসে আমার শরীরের জন্য। তাছাড়া তার বাবা এই বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত মানুষ। আমার মতো আদিবাসী (উপজাতি) মেয়ে তারা মেনে নেবে না।

দুর্ভাগ্যক্রমে, যে কমপ্লেইন করতে থাকে, কনডম দিয়ে সে এনজয় করতে পারছে না। সত্যি বলতে কী, আমি নিজেও খুব উপভোগ করতে পারি না। তাছাড়া আমার শারীরিক গঠনও খুব ভালো নয়। আমি বেশ ড্রাই থাকি এবং লুব্রিশন সম্পর্কে আমার কোনো ভালো ধারণা নেই। যেভাবেই হোক আমরা কনডম ছাড়াই ম্যানেজ করে চলতে থাকি। সে নেট ঘেটে কি সব উইথড্রয়াল পদ্ধতি বের করে আমরা তাই করি।

আমার মেজ বোন দেশে আসে এর মাঝে। সোজা আমাকে বলে ‘তুই সেক্স করিস’। সে আমার স্তন খুলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সে বলে বাবার সাথে কথা বলবে; বলা হয়নি আর। তাদের ব্যবসার কী সব ঝামেলার জন্য সাত দিন দেশে থেকে সে চলে যায়। মনে মনে বলি বাঁচা গেল। একমাসে আমার মাসিক হয়নি। টিউব দিয়ে পরীক্ষা করলাম— পজিটিভ! আতঙ্কে মাথা ঝিম করে উঠল। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে আমরা এক মহিলা ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি বললেন পজিটিভ। যেহেতু প্রথম বাচ্চা রেখে দেন।

রাতে সে থেকে গেল। আমাকে বলল— চল, বিয়ে করে ফেলি। সত্যিই। ‘একদম’। আগামী সপ্তাহেই। আমাদের বাবা-মাকে আমরা পরে জানালেও চলবে। সে বলে। আমি আতঙ্কিত। প্রচণ্ড লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন। বাবাকে মুখ দেখানো। ভাই-বোনের সামনে পড়ার লজ্জা। আত্মীয়স্বজন। ক্লাসমেটদের কীইবা বলব। এখানেই শেষ নয়, সে মুসলমান, আমি উপজাতি খ্রিস্টান! বাবার মুখ থাকবে না। তার উপর, আমরা চার্চে জেনেছি এটা পাপ ও হত্যার শামিল। পরদিন আমি ক্লাসে যাইনি, সেও তার অফিসে যায়নি। আমাকে বলল তুমি শুধু মুসলিম হয়ে যাও, বাদবাকি আমিও দেখছি। সেদিন বিকেলেই কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলাম। সে বড় এক ইসলামি দলের নেতা ও ব্যবসায়ীর ছেলে। এবং সত্যিই আমার ধারণা ভুল করে দিয়ে সে আমাকে বিয়ে করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিল।

ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন কোথায় হারাল! বাবাকে বা আত্মীয়দের কী বলব কিছুই মনে থাকল না। মা হওয়ার স্বপ্নে আমি বিভোর হয়ে গেলাম। রাতে মুসলমানি রীতিতে আমরা প্রার্থনা করলাম।

সপ্তাহ নয়, পরদিন কাজী বাসায় এনে আমরা বিয়ে করলাম। স্বামী কাজী সাহেব নিয়ে আসেন। সে দুদিন আমার সাথেই থাকল।

চামেলী থামলেন। বললেন, দুপুরের খাবার দিতে বলি, আর যদি মনে কিছু না করেন, সন্ধ্যায় বা কালকে বসি। তিনি আর এলেন না। খাবার দিল কাজের লোকজন। খাবার শেষে তিনি এলেন। বললেন সন্ধ্যায় যেন আসি। শুরুর দিকে যে হাসিখুশি চামেলীকে দেখেছিলাম এখন সম্পূর্ণ বিপরীত।

সন্ধ্যায় চামেলীদের বাসায় আবার। সেই প্রাণ চাঞ্চল্য যেন হারিয়ে গেছে। হাতে তসবিদানা। বলেন— ভাই, ভুল ভ্রান্ত ছিলাম বলে দুপুরের পর আর কথা বলতে পারছিলাম না। তাই খাবার টেবিলেও আপনাদের সাথে বসতে পারিনি। আমার বিবাহিত জীবন ছিল মাত্র তিনদিনের। তৃতীয় দিন থেকে আমার স্বামীর ফোন বন্ধ। আমি ট্যাক্সি করে তাদের বাসায় গেলাম। দারোয়ান আটকে দিল। বললাম, আমি দেখা না করে যাব না। একজন ভদ্রলোক এলেন, যার কাছে এসেছেন তিনি গত রাতেই আমেরিকা গেছেন।

বললাম, উনার বাবা?

তিনি তো দেশে নাই অনেকদিন।

নিজেকে বেকুবের মতো লাগছিল। আমার কোনো বান্ধবী জানে না। কোনো আত্মীয়স্বজন জানে না। আমার দিক থেকে আমি একা। তার দিকের শুধু তাকেই জানি।

সাক্ষী যারা ছিল তাদের নম্বর নেই। কাজী সাহেবের অফিস চিনি কেবল। তাও যদি সত্যি হয়ে থাকে। ট্যাক্সি ড্রাইভার বললেন— আপা, আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি কি?

ধন্যবাদ, বাসায় যান।

চামেলী থামেন, ঘামতে শুরু করেছেন। কণ্ঠ জড়িয়ে আসছে পানি হাতে নিলেন, মুছে দিলেন না।

বাসায় এসে চিন্তা করতে থাকলাম; আমি বিবাহিত আমি ধর্মান্তরিত মুসলিম আমি প্রেগনেন্ট বাবাকে ছাড়া কারও কথা মাথায় আসছে না। সোজা বোনকে বলা যায়। সে তো বাবাকে জানাবে সোজা। আমার ম্যামকে ফোন করা যায়।

বাবাকে ফোন করে বললাম, আমার পড়াশোনার ভীষণ চাপ মাকে পাঠিয়ে দাও। বাবা পরদিনই নিয়ে হাজির।

মাকে দেখে একটু যেন ভরসা হলো। বাবা কিছুই বুঝলেন না। দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিলেন বাবা। মা আমার রুমে এসে দরজা বন্ধ করলেন— মা, তোমার এই অবস্থার জন্য কে দায়ী?

এই মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছি। আমি তাকে মা ডাকি। বাবার আড়ালে। তিনিও আমাকে ছোট মা বলে ডাকেন। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলাম। আমার মাথায় হাত বোলান। চোখের পানি মুছিয়ে দিলেন। কোনো চিন্তা নেই, ছোট মা আমি তো আছি। তোমার বাবা আজ গেলেই হয়।

বাবা বিকেলের ফ্লাইটেই চলে গেলেন। রাতে মাকে সব বললাম। তিনি ছেলের বাবাকে চেনেন। বললেন, এটা জানাজানি হয়ে গেলে দুই পরিবারের সমস্যা হবে। তাছাড়া তোমার বোঝা উচিত এটা বাংলাদেশ। কালকেই এটা শেষ করে দিতে হবে। তোমার আর কোনো পথ খোলা নেই। কাউকে কিছু বলবে না। বাবা, বোনগুলো, ভাই, ভাইদের বউ, আত্মীয়স্বজন কেউ যেন না জানে।

আমার বাচ্চার কী হবে?

কীসের বাচ্চা তোমার বিয়ে হয়নি; স্বামীগুলো তুমি চেনো না, সুতরাং এই বিয়ে বৈধই হয়নি। তাছাড়া যে কাজী বিয়ে পড়িয়েছে, আমার ধারণা সেটাও ফলস।

পরদিন কাজী অফিসে গেলাম, যে কাজীকে আমি চিনতাম তিনি নাকি চাকরি ছেড়ে দিছেন। নাম, ঠিকানা আমরা কোনো ডকুমেন্ড পাইনি। খাতার ভল্যুমে নিজের চোখে দেখলাম। কোথাও আমাদের নাম নেই।

বিকেলে মা আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। বললাম, আগের ডাক্তারের কাছে যাই, তিনি বললেন ‘অসম্ভব’। আরও বলেন, আমার ধারণা ডাক্তার বা কাজী অথবা এই সাক্ষ্য দুইটার কেউ ছেলের বাবাকে চেনে, সেটা খুব স্বাভাবিক এবং ছেলের বাবা ছেলেকে সোজা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। নতুবা এই কাজী চাকরি ছাড়বে কেন, কোনো নথিতে তোমার নাম থাকবে না বা কেন।

মায়ের কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। কিন্তু আমার বা সন্তানটার কী দোষ? শোনো মেয়ে, তোমার একটা ভুলের জন্য এখন শতটা ভুল করতে হবে মনে কর তোমার বাচ্চাটা রাখলে তাহলে—

১. তার বাবা কে?

২. সে কোন ধর্মের?

৩. যে কীভাবে মানুষ হবে?

৪. তোমার বাবাকে কী বলবে?

৫. তোমাদের গোত্র এখন তোমাদের কীভাবে নেবে?

৬. রাজাকে তোমার বাবা কী বলবে?

৭. যদি তোমার বাবা তোমাকে অস্বীকার করেন, সেক্ষেত্রে তোমার কি ভূমিকা থাকবে?

আবার থেমে যান চামেলী। শ্বাসপ্রশ্বাসে দ্রুত হচ্ছে ক্রমে। আমাদের বলেছিলেন যে স্বাচ্ছন্দ্যে। ২০ মিনিট সময় দেবেন। তিনি চান না এ বিষয়ে আদৌ কোনো কথা বলতে। আমরা বই লিখব বলে তিনি রাজি হয়েছেন এবং ২০ মিনিট সময় আমাদের সাথে কথা বলবেন। তিনি কথা বলছেনই। ২০ মিনিট তো নয় মে হচ্ছে তার অনেক কম। প্রশ্ন বলতে হচ্ছে না তিনিই বলে যাচ্ছেন। এখন থামলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন যদি আপনারা দয়া করে কালকে আসেন। আসলে আমি একদম প্রস্তুত নই। তাছাড়া কেউ কোনোদিন জানতেও চায়নি এভাবে; তিনিও বলেননি। রাতে আরেকটু মানসিক প্রস্তুতি নেবেন। রাতের খাবারের জন্য সাধছিলেন; সাধছিলেন রাজি হলাম না। বলেন সকালে যেন নাস্তাটা তার ওখানেই করি। পরদিন সাতটায় দেখা হবে বলে গুড নাইট জানিয়ে চলে আসি।

শনির সকালে এবং চামেলীর চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা সেদিন বার ছিল শনি। আমার দশাও শনির মতো। প্রথমে এক বুড়ো ডাক্তারকে দেখাতে হলো। আমার ইহজীবনে এত কাঠখোট্টা ডাক্তার দেখিনি। শিক্ষার্থীর বদলে ধমকানি। আমাকে বললেন, টোটাল সময় তিন থেকে তিন শত মিনিট। কোনো সমস্যা যাতে না হয়। এন্টিবায়োটিক দেওয়া হবে। তারপর কোনো সমস্যা হলে আমি যেন কোনো মহিলা ডাক্তার দেখাই। মাত্র পাঁচ মিনিটের কম সময়ে কনসালটেশন শেষ। বেল টিপে ডাকতেই আয়া এলেন। আমি ওয়েটিং রুমে বসলাম। মা সাথেই আছেন। এর মধ্যে বাবার ফোন, আমরা কই। মা বললেন, তার শরীর ভালো না আমরা একজন অশুভ অর্থে জানি। চামেলী নিজেই বলেন। ডাক্তারের কাছে আসছি। মা কথা বলতে উঠে চলে গেলেন। হঠাৎ মনে হলো, বাবাকে কিছু কি বলেছেন? আবার মনে হলো মা সেই ক্যাটাগরির মানুষ নন। হয়তো অন্য কিছু বলবেন, সবার সামনে কথা বলা যাবে না।

ডাক্তার তো নয়ই নার্স আয়া কেউই পরবর্তী সময়ে কী হবে বা হতে পারে আমাকে বলেনি।

বাবা সন্ধ্যায় ফোন দিলেন। বললাম, ঘুমোচ্ছি। পরে কথা বলব। মায়ের সাথে কথা বললেন।

হাসপাতাল থেকে আসার পর আমার অবস্থা আরও খারাপ হলো। পুরো ইনফেকশন হয়ে গেল, ভ্যাজিনার ভেতর থেকে।

মা এক গাইনোকোলজিস্ট দেখালেন, তিনি বললেন যদি এমআর করাতে হয়। অবশ্যই মহিলা ডাক্তার ও গাইনোলজিস্ট। শুধু গ্র্যাজুয়েট ডাক্তাররা জটিল সমস্যাগুলো বুঝতে পারে না। তাছাড়া তারা কেবল গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে। যাই হোক পুরো তিনমাস আমি ক্লাসে যেতে পারলাম না। সেমিস্টার অফ। মা আমার সাথেই আছেন। বাবা ঘনঘন আসছেন মা তাকে যা পারছেন বোঝাচ্ছেন।

আমার পড়াশোনা আর হয় না। সারাক্ষণই শপিং করতে থাকি। প্রায় একবছর আমার ছেলেকে দেখি, লাল পাজামা পাঞ্জাবি পরা, টুকটুক ছেলে আমার। আমি দুটো রিয়ালাইজেশন দেখি। প্রথমত আমি মুসলমান থাকবই। আমি আর সন্তানাদি পাব না।

বছর দুই পরে বাবাকে জানানো হয়। মা-ই জানান বাবাকে। বাবা প্রথমে গেলেন ফাদারের কাছে। ফাদার বাড়ি আসেন বাবাসহ। ফাদার তো জানতে চান আমি তো মুসলমান না হয়েও তাকে বিয়ে করতে পারতাম। সেটা জানি কিনা? আসলেই আমি জানতাম না। যাই হোক আমি বলি, আমি আবার প্রথম ধর্মে আসব না। ধর্মপরায়ণ বাবা আমার ফাদারের দিকে তাকান। ফাদার বলেন খ্রিস্টধর্মে গর্ভপাতের কোনো নিয়ম নেই। তেমনি জোর করে ধর্মান্তরিত করাও। সে যদি তার সন্তানের জন্য ইসলাম ধর্মে যেতে চায়, আমাদের বাধা দেওয়ার কিছু নেই।

বাবা তার অফিসে আমাকে ‘ট্রেইনি’ একটা চেয়ার দেন। সেখানে আমার বর্তমান স্বামীর সাথে পরিচয়। বাবা আমার সাথে প্রথম কথা বলেন। তারপর তার সাথে।

শেষে, দুজনে বাড়িতে এনে। বাবা সব খুলেই বলেন। এমন না যে, তিনি কোনো অর্থ-লোভ দেখান, বা আমার স্বামী কোনো লোভে আমাকে বিয়ে করেন। বরং আমরা দুজনকেই ভালোবাসি এবং প্রথম পরিচয়ে তিনি জানতেন না যে কোম্পানির মালিক আমার বাবা।

সমস্যা হলো আমি আমাকে ক্ষমা করতে পারছি না। আমার ভুলের জন্য আমার পরিবারের সকলে কালিমা নিলেন। ‘রাজা’ আমাদের ত্যাগ করেন। ভাগ্যিস যে, আমার ভাই-বোন সকলেই দেশের বাইরে। বাবা এখন বাৎসরিক উৎসবে যান না। বাবার নামে দেওয়া হাসপাতালের নাম পাল্টে দেওয়া হয়। বাবার নাম একটি কলঙ্ক। প্রতিদিন বাবাকে দেখি। স্বল্পভাষী বাবা কোনো কথাই বলেন না এ বিষয়ে। কে জানি মনে হয় বাবার মনে ভীষণ কষ্ট। গোত্রের এক স্বনামী মানুষ বাবার নাম নিচ্ছে না কেউ। ফুপুরা বাড়িতে আসেন না। রাস্তায় বের হলে দু’তিন বছরের বাচ্চাদের দেখলে মনে হয় এই বাবুটা তো আমার হতে পারত। আমাদের বিয়ে হলো পাঁচ মাস এবং আমি জানি আমাদের কোনো ছেলে মেয়ে হবে না।

মৃত্যুর পর আমার ছেলের সাথে দেখা হবে। সেদিনের অপেক্ষায় আছি। বুকে জড়িয়ে ধরব আমার বাবুকে। আমার বাবু সোনা আমার…

চামেলী হারিয়ে গেছেন স্বপ্নলোকে। তার চোখে পানি। দুই হাত দিয়ে সন্তান জড়িয়ে ধরে রাখার মত বসে আছেন। কষ্টের কথা শুনতে এসে আমাদেরও কষ্ট লাগে। ভাবি এ কষ্ট কী চামেলীর একার? এ দায় কি তার একার? দুটি বছর বয়সে পাওয়া কষ্ট তার অমৃত্যু।…

চামেলী কান্না থামিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। চামেলীর মুখে কোনো কথা নেই। আমরা ভাবছি, একটি গর্ভপাত, গোটা পরিবার লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। লজ্জা, অপমান, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন, সর্বোপরি চামেলীর জীবন… এ দায় কার?

নিউ লিবারেল ইকনোমির প্রভাব দেখলাম। হিপোক্রেট সমাজের এক টুকরো চিত্রে প্রতিফল ঘটছে পুরো সমাজ, সংস্কৃতি আর রাষ্ট্রব্যবস্থার। শুধু স্টিগমার জন্ম আর উৎস দেখলেই পুরোটা দেখা হচ্ছে? বরং একটু ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে কত গভীরে এই চর্চার উৎস। এখানে পুঁজি কথা বলে। টাকা কথা রাখে।

দাসিরা

আমি আর কত বড় হলে…

[দাসিরা। ঢাকার মেয়ে। বয়স ২২। ঢাকাতেই জন্ম। পড়াশোনা এইচএসসি। গার্মেন্টসকর্মী। সন্তানাদি নেই। মাঝে মাঝে কলগার্লের কাজও করেন। একমাত্র ভাই দেশের বাইরে। তিন বোনের দুজন দেশের বাইরে।

দাসিরা ঢাকার একটি কর্মী পরিবারের আবহে জন্ম নেন। পড়াশোনা ইংলিশ মিডিয়ামে। পরে একটি অভিজাত গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি করেন। তার আগেই ‘ও’ লেভেল শেষ করেন। কিন্তু একটি অনাহুত কনসেপশন তাকে বদলে ফেলে আমূল। তিনি গার্মেন্টসকর্মী হয়ে উঠেন।

অর্থবিত্তের পরিবেশে বড় হওয়া দাসিরা এরকম আঁটসাঁট পয়সায় চলতে মানিয়ে নিতে পারেননি। দাসিরার অর্থের প্রয়োজন পড়ে। গার্মেন্টস সহকর্মীদের সাথে কথা বলেন। তারাই পথ দেখিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে কল পান। সপ্তাহে দু বা তিনটি। অন্তত স্বচ্ছলভাবে চলতে তো পারছেন, তার এই সান্ত্বনা। ভার্জিনিটি হলো তার কথায়; বইয়ের শব্দ

আর ফ্যান্টাসি। দাসিরা বলে দেন, এক ঘণ্টার চেয়ে বেশি সময় দিতে পারবেন না। বিকেলে লম্বা ঘুম দিতে হবে; রাতে কল আছে। আবার আগামী কালও কল— ঢাকার বাইরে।]

ইন্টার পড়ার সময় বেইলি রোডে এক জনের সাথে পরিচয় হলো। তিনি ঢাবির ছাত্র। পার্টটাইম একটা শাড়ির দোকানে কাজ করেন। আমি বাসা থেকেই কলেজে আসি। তার সাথে আমার প্রেম চলে বছরখানেক। কেবল দেখা-সাক্ষাৎ। হাত ধরে বসে থাকা। এরই মাঝে আমার বাবা-মা চলে যান দেশের বাইরে দু মাসের জন্য। বোনের সন্তান হবে। প্রথম দিকে একটু খটকা লাগানো, বাসায় যদি আমার বয়ফ্রেন্ডকে ডাকলে যেমন হবে, আবার চিন্তা করলাম যদি বিছানায় চলে যাওয়া হয়; চার-পাঁচদিন পর তাকে ডাকি। প্রথমে ড্রইংরুমে বসে চা নাস্তা খাই। সে আমার হাত ধরে। আমরা এভাবে সারাদিন বসে থাকি। বিকেলে ঘুরতে বের হই। সন্ধ্যায় সে আমাকে নামিয়ে দেয়। আমি বলি, থেকে যাও।

সে রাতেই আমার সর্বনাশ আমি ডেকে আনি। আমরা পাঁচ-সাতবার মিলিত হই। আমর মনেই হয়নি কনডম বা কিছু ব্যববহার করা উচিত।

এভাবে টানা দু মাস চলে। কখনো কনডম, কখনো খোলা। আমরা দিনগুলো ছিল স্বর্ণখচিত।

দিন যেতে থাকে। হঠাৎ একদিন সকালে মনে হয় মাথা ঘুরিয়ে আসে। পেট গুলিয়ে আসে। হড়হড় করে বাথরুমে গিয়ে বমি। বাবা-মা আরও একমাস থাকবেন। কাজের মেয়ে বলে ‘আসার খরব হইছে।’ আমি ঝিম ধরে বিছানায় বসে থাকি। বয়ফ্রেন্ডকে আসতে বলি। বিকেলে আমরা ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার প্রমাণ করে পজিটিভ। আমার বন্ধু বলল, আসলে আমাদের নতুন বিয়ে তো আমরা ঐভাবে প্রস্তুত নই। ইয়াং মহিলা ডাক্তার বলেন আমার সাথে একলা কথা বলবেন; আমার ফ্রেন্ড বেরিয়ে যায়। আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকি। তিনি বিল টিপে সহকারীকে দিয়ে আবার, আমার ফ্রেন্ডকে আনান। বলেন, আপনি ঘুরে আসুন। উনার আরও কিছু টেস্ট করাতে হবে। সময় লাগবে। আপনি বরং তিন ঘণ্টা পর আসুন। সে বলে ওয়েটিং রুমেই থাকব; এটা আপনার মর্জি; আপনি চাইলে ঘণ্টা তিনেক ঘুরে আসুন। সে আমাকে বলে তাইলে কিছু ফটোকপির কাজ আছে; শেষ করে সমস্যা মনে করলে কল দিও।

—আচ্ছা।

আমি ভীত হয়ে পড়লাম। কী করতে হবে যে তিনঘণ্টা লাগবে; তাছাড়া সেও নয় কেন। সেইবা থাকবে না কেন? ডাক্তার মহিলাটার সাথে বেশ আলাপ হয়।

—তোমাকে তুমি বলছি; তোমার বয়স অনেক কম। তাছাড়া তোমাকে মনে হয় আমি চিনি। কিছুদিন আগে এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তোমাকে দেখেছি। তোমাদের বিয়ে তো হয়নি; বরং তুমি বোধহয় এখনো ইন্টার শেষ করোনি। তোমার বয়স মনে হয় আঠারো হয়নি। বলো আমি কি সত্যি বলছি?

—জি। মাথা নিচু করে আমি উত্তর দিই।

—তোমাকে কি ঐ বন্ধুই কলুষিত করেছে?

—জি, কেন?

—না মানে অনেক ক্ষেত্রে যে কবে, সে পালিয়ে যায়, এই জন্য বললাম, মনে কিছু কোরো না।

—সে কি বিয়ে করবে?

—জিজ্ঞেস করিনি।

—তাও ঠিক, আগে তোমরা আলোচনা করনি যে, পজিটিভ হলে কী চিন্তাভাবনা?

—জি না।

—তোমার বাবা-মা জানেন?

—জি না।

—তার বাবা-মা?

—মনে হয় না।

—তার বাড়িতে গিয়েছিলে?

—জি না।

—দেশের বাড়ি কোথায় জানো?

—বগুড়া বলেছে।

—তোমার বাবা-মায়ের সাথে আমি কি কথা বলতে পারি?

—তারা দু মাসে দেশের বাইরে, আরও…

—তোমরা এই সুযোগ নিয়েছ তাই তো?

আমি কোনো কথা বলি না। লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। তার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এত লজ্জার! এত লজ্জার! এই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

আমার বাবা জানত কী ভয়ানক পরিণতি হবে তা আমি জানি।

—শোনো, তোমাকে তিন দিন সময় দিলাম; তোমার বন্ধুর সাথে কথা বলো; ঠিক তিনদিন পর আমার কাছে আসবে। যদি তোমার বন্ধু পালিয়ে বেড়ায়, যেটা হামেশাই ঘটে; তোমার কোনো গার্ডিয়ান নিয়ে আসতে হবে। অথবা, এখন এই মুহূর্তে কাজ সেরে ফেলা যায়। যে জন্য বলছিলাম, তিনঘণ্টা সময় লাগবে। সত্যি বলছি বাচ্চার জন্য তোমার প্রস্ততি নেই; তুমি যথেষ্টই ইমম্যাচিউজড। তবু তোমার সাথে কথা বলবে না। ঘাবড়িও না। এরকম হয়েই থাকে।

ওখান থেকে বের হয়ে দেখি, আমার বয়ফ্রেন্ড বসাই আছে। সব বললাম। তার জবে যাওয়ার কথা, ছুটি নিল। বলল, চল বাসায় যাই।

বাসায় এসে আমি বললাম, আমরা বিয়ে করব।

—তোমার মাথা খারাপ! আমার পড়াশোনা শেষ হয়নি; আবার তোমার বয়সও কম। তাছাড়া, এখনি ছেলে-মেয়ে… বেড়িকুলাস, আমি এখন এসব ভাবতেই পারছি না। বরং ঐ ডাক্তার আপুকে বলো ক্লিয়ার করে দিতে।

—কী, ক্লিয়ার?

—তোমার মাসিক কোলরে করে দিতে। তাহলেই হয়। এত টেনশনের কী আছে, একটা সাধারণ বিষয় নিয়ে।

—আসলেই এত সোজা?

—আরে এসব মানুষই করছে না।

—যদি আমার বাবা জানতে পারেন!

—কে বলতে যাচ্ছে? আমি বললাম না, তুমিও না।

—ঐ ডাক্তার আপু আমাকে চিনে ফেলছেন।

—ও মাই লর্ড!

সে চমকে ওঠে— বলে কী? আমরা অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে যাব।

—লাভ কী, তিনি তো চিনে ফেলেছেন, জেনে গেছেন। তিনি যদি বাবাকে বলেন…।

সে রাতে আমার বন্ধু আর থাকল না। কালকে তার পরীক্ষা। যাওয়ার পর মনে হলো আহা! আর বাড়ির ঠিকানাটা রাখতে পারলাম না। জাস্ট ইন কেইস। হলো না।

রাতে আদৌ আমার ঘুম হলো না। চিন্তা আর ছটছট করেই সময় গেল। সকালে ফোনের রিং শুনে ঘুম ভাঙল বাবার ফোন। এতে আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। ডাক্তার আপুটা কিছু বলেনি তো! বাবা ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করেই রাখলেন। একটু পরেই ডাক্তার আপুটার ফোন।

—কেমন আছ?

—ভালো আপু। আসসালামু আলাইকুম।

—আমি হিন্দু রে ভাই। তোমরা বলো ‘মালু’। যাগগে। তোমার খবর কী? কী সিদ্ধান্ত নিলে। বিয়ে করছ?

—সে বলে এমআর করিয়ে নিতে; তাছাড়া চাকরি নেই। আমার বয়স এরই মাঝে বাচ্চা ডাক্তার…।

—সবগুলো এক ক্ষুরের মাথা কামানো। ঠিক আছে, তুমি আসো কালকে; একাই আসো।

আমি সত্যিই চিন্তিত বাবাকে নিয়ে। আমি আমার বাবাকে চিনি। ভদ্রলোকের পোশাক পরা আমার বাবা কী পরিমাণ বদমেজাজি আমি জানি। আমার ভাইয়ের… দাসিরা থেকে যান। ভাবে। বলবেন কিনা, বলা ঠিক উচিত কিনা এইসব ভাবেন।

আপনাদের হাতে একটু সময় হবে কী? আমি এবটা ফোনকল করছি। যাব আর আসব। দাসিরা ঘড়ি দেখে দ্রুত গেলেন। আমরা দাসিরার কথা ভাবছি। একজন খুব নামকরা মানুষের সাথে দাসিরার চেহারার বড় মিল। ‘অমুক’ সাহেবের মেয়ে না তো?

আমাদের একজন প্রশ্ন করে। আমরা বলি যাক না; এটা জানা কি খুব প্রয়োজন। তিনি মনে করলে বলবেন। দাসিরা মিনিট দশকের মধ্যে চলে আসেন। দাসিরা বলেন, আমার ভাইয়ের ঘটনাটা শুনলে আমরা বুঝতে পারব, আমার আতঙ্ক আর ভয়ের কারণ কী আসলে। আমার ভাই ছিল ডাক্তার। এক আপুর সাথে তার সম্পর্ক; আপুও প্রভাবে কনসিভ করে ফেলে। ভাইয়া মাকে বলায় তার বন্ধুদের দিয়ে এবং মা বাবাকে বলেন। বাবা খুব শান্ত প্রকৃতির। সেদিন বাবার মেজাজ আমরা দেখলাম।

ড্রয়িংরুমে মিটিংয়ের মতো; বাবা সভাপতির মতো প্রসঙ্গ পেললেন। সবার মতামত চাইলেন। এই মাত্র ও লেভেল শেষ করছি।

বোনদের বাবা টিকিট কেটে নিয়ে আসেন। মিটিং করবেন বলে মা বললেন, মেয়ে হিন্দু তো কী হয়েছে; মুসলমান হয়ে যাবে। বড় বোন বলে, তাদের বিয়ে হওয়াটা দরকার। হিন্দু-মুসলমান যাই হোক তোমরা পরে দেখো এসব। বাবা কোনো কথাই বলছেন না। মেজ বোন বলে, আমরা বিয়ে পড়িয়ে মেয়ে তুলে আনি; পরে অনুষ্ঠান করা যাবে। বোন জামাইগুলো মুখে তালা দিয়ে বসেছিল; এতক্ষণে বাবা তাদের দিকে তাকলেন, আমার মনে হয় বাবা আমরা মানবিক দৃষ্টিতে দেখি বিষয়টা। ‘এটা কোনো অরফান সেন্টার নয়; আসার করি তুমি তো জানো। এবং এটা তোমাদের সিয়াটল নম্বর যে, পাশের বাড়ির লোক কী করছে কেউ জানবে না। এটা বাংলাদেশ। এবং আমি কে তোমরা আগেও জানতে, এখনো জানো। অন্যজন বলল— না মানে বলছিলাম কী, বিয়েটা না হলে দুজনেরই একটা সাইকোলজিক্যাল ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া এখন তো আর সেই সব ভাবার সুযোগও নেই; যতদূর জানি, তাদের দু’ জনের সম্পর্ক অনেক এডভান্সড।

বাবা এবার বললেন, তার মানে মেয়ে এখন কনসিভড। আমি কোনো অবৈধ সন্তানকে এই পরিবারে উত্তরাধিকারী করে রেখে যাব না। দুই, মেয়ে হিন্দু, ডাক্তার বা বার এট ল’ সেটা পরের পরিচয়। আমি আমার স্ট্যাটাস দেখবই। প্রতিদিন কোর্টে অন্তত এক হাজার সিনিয়র ল’ ইয়ারের সাথে আমার দেখা। যারা বাংলাদেশের আইন বানায়। তারা পেছনে কথা বলুক, নিশ্চয়ই আমার পুত্রধন চাইবে না। আমি তোমাদের দুইটা পথ দিচ্ছি। প্রথমত সে দেশের বাইরে চলে যাবে; ইচ্ছা করলে ঐ মালুসহ। আমার পরিবারের কারও সাথে ফোন যোগাযোগ রাখবে না। সে কোনোদিন দেশে আসবে না। আমার এই বাড়ি আমার পরে তোমরা যা করতে চাও করো; আমার মৃত্যুর পর। দ্বিতীয়ত সে যদি দেশে থাকতে চায়; থাকতে পারে। সারাজীবনের জন্য তাকে আমি লালঘরে রাখার বন্দোবস্ত করে রাখব। অথবা সে গুম হয়ে যাবে।

এই বলে বাবা বলেন, আমি চেম্বারে যাব, কালকে আবার বসব। সন্ধ্যা সাতটায়। তোমরা আলোচনা করে জানিয়ো। দাদা বলেন, আলোচনার দরকার নেই; আমি বাইরে চলে যাব। আপনি ব্যবস্থা করুন। আর ওকে বিয়ে করব কিনা; আপনাদের আর মাথা ঘামাতে হবে না। এক সপ্তাহের মাঝেই বাবা তাকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেন। সাথে যথেষ্ট পয়সাকড়ি দেন। আজ পর্যন্ত আমার ভাইয়ের সাথে কারও যোগাযোগ নেই। বোনগুলোর সাথে ওখানে গোপনে হয়তো কথাবার্তা হয়; কিংবা হয় না কেউ জানে না। লোকমুখে শুনেছি ভাইয়ের নাকি দেশে আছেন। আমরা তাকে চিনি না; দেখিওনি কোনোদিন। এই হলো আমার বাবা! আবারও বলছি সন্তান নিয়ে কোনো চিন্তাই করছি না; কিন্তু বাবার ভয়েই আমি আতঙ্কিত। বাবাকে সামলানোর কেউ নেই।

ডাক্তার আপুর সাথে দেখা করলাম; পরদিন। এবং তিনি এম আর করিয়ে দিলেন। সে রাতে বাসায় আসতে পারলাম না। বাসায় কাজের বুয়াকে জানালাম দরজা জানালা লাগিয়ে যেন ঘুমিয়ে পড়ে। বললাম, দারোয়ানকে যেন কিছু না বলে।

পরদিন আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি; কিন্তু মোবাইল বন্ধ আর কোনো কথা হয়নি। আর দোকানে লোক পাঠালাম। সে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে নাকি এখানে। তারাও কোনো নম্বর জানে না। আমি এমনটা অনুমান করেছিলাম; ফলে আলাপটি হইন একটুও।

দাসিরা থেকে যান। আমরা বুঝতে পারছি না; এই পরিবারের মেয়েটার এই অবস্থার কারণ কী। দাসিরাকে সরাসরি প্রশ্ন করে একটু বিব্রত বোধ করছি। দাসিরা নিজ থেকেও মনে হয় কিছু বলবেন না। টাইম দেখলেন, যদিও আগে চলে গেছে। তাছাড়া পরবর্তী দুদিন তিনি ব্যস্ত। আমাদের ও জানার ছিল আরও কোনো কিছু পয়েন্ট আমরাই বলি, আপনি সময় করে পরে একদিন যদি জানতে চান, যদি না বসতে চান তাহলে? আমাদের দিক থেকে কোনোই সমস্যা নেই।’ আমরা বলি। এটা আমাদের চাকরি তো নয়ই; আবার এটা জেনে আমদের যে আর্থিক লাভ হবে তাও না। আর আমরা তো বলেছি যে, আমরা কেবলই শুনতে আসছি; জানতে এবং জানাতে।’ ওয়েল। আমি কাল রাতে একবার কল থেকে সম্ভবত তিন চারদিন পর আবার দেখা হবে।

পরদিন ঠিক না, দুদিন পর তার ফোন পেলাম, তার বাসায় ডেকেছেন। বিকেলে। এবং রাতে যেন তার ওখানেই খাওয়াদাওয়া করি। এমনকি কার পছন্দ কোন খাবার তাও জানতে চান। শুধু বলেন যে; নিচতলায় এসে যেন আমরা কেউ কথা বলি তার সাথে। তিনি এসে নিয়ে যাবেন।

দাসিরার বাসায় তিনি অবশ্যই একা। বলেন, এমআর করানোর তিনদিনের মাথায় বাবা-মা হাজির। সাথে বোন দুজন, সদ্য নবজাতকসহ। তাদের জামাইগুলো আসেনি। তারা ব্যস্ত। তাছাড়া, তারা নাকি সাতদিনের জন্য এসেছেন জরুরি কাজে। মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে উঠেন। আমি বলে গেলাম ভুলে গেলাম আমার জন্যই তাদের আসা। বাবা আমাকে সাথে দেখাও করলেন না। বোনের বাচ্চাকে দেখে যা একটু মন খারাপ

হয়েছিল, এই যা! রাতে আবরো সেই মিটিং। বাবার হাতে সমস্ত কাগজপত্র। আমার হাসপাতালের সকল ডকুমেন্ট। আমার মাথায় ঢুকছে না কীভাবে সে সব তার হাতে এল।

এমনকি দু’মাস তেরোদিনের প্রত্যেকটা ঘণ্টায় হিসাব বাবার হাতে। রীতিমতো ফাইল করে রাখা। এই দেখুন দিবস, ১

তারিখ… বুধবার।

দাসিরা বাড়ি থেকে বের হন সকাল সাতটা বিশ। পরনে হালকা বেগুনি টপ। চোখে সানগ্লাস। গাড়ির ডান দরজা দিয়ে গাড়িতে উঠেন। গাড়িতে উঠেই ফোনে কথা বলেন। মতিঝিল একা দোকানে থেমে আইসক্রিম কেনেন। আজিজ সুপার মার্কেট থেকে একজন লোক ওঠেন।

দিবস ১২

তারিখ… বার…

সারাদিন দাসিরা এবং ঐ লোক। তারা কেরানীগঞ্জের দিকে যান।

যদিও গাড়ি তাকে কলেজ রোতে নামিয়ে দেয়। দুপুরে দস্তগীর হোটেলে যান। কেরানীগঞ্জ বাজারে। বাবা সোজা আমাকে বলেন কী চাই। আমার কোত্থেকে জানি সাথে চলে আসে। বলি আমি দাদার মতো দেশ ছাড়ব না। ঐ ছেলে, তুমি নিশ্চয়ই তাকে অফ করে দিয়েছ। তাকেও বিয়ে করছি না। আমি দেশেই থাকব। প্রয়োজনে আয়ার কাজ করব, তবু দেশ ছাড়ব না। এ দেশ আমার। আমি ভূল করেছি। ক্ষমা করেও পাবে না। তবু বলছি দেশ ছাড়ব না।’

আমার বোনগুলো কেঁদে ওঠে। মা কাঁদেন। বাবা নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট টানতে থাকেন। আমার জন্য বরাদ্দ করা হয় কিছু টাকা।

আমি একটা পুরাতন গাড়িও কিনি। বাবা-মায়ের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। কারও সাথে না।

বাবা শুধু বেরিয়েছিলেন ‘তোকে মেরে ফেলতাম, শুধু পাপ হবে বলে পারছি না। কিন্তু, তুই আমার নাম কোথাও বলবি না। যেদিন আমার কাছে এই খবর আসবে যে, তুই আমার নাম ভাঙিয়ে খাচ্ছিস, মনে রাখিস, তোর দিন শেষ। তোর মতো কুলাঙ্গার আমার মেয়ে; এটা ভাবতেই শরীর ঘিনঘিন করে।’

বাবাকে পত্রিকায় দেখি। টেলিভিশনে দেখতাম। যদিও এখন বাবাকে দেখব বলে বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল দেখি না। আমি কুলহারা কলঙ্কিনী। শুধু মনে হয়, বয়সটা আরও একটু বেশি হলে হতো আমার মেয়ে বা ছেলে যাই হোক রাখতে পারতাম! আমি বড় হইনি।

গার্মেন্টসে নাম লিখিয়েছিলাম যাতে একটা জব থাকে। আমি বিদেশি বায়ারদের সাথে যোগাযোগের কাজ করি। আর ফলে যাই আসলে টাকার জন্য। আমার আবার সতীত্ব আর ধর্ম। বাবা মেয়েকে রাস্তায় ফেলে দিল, তখন কি ধর্ম ছিল না? আমি গায়ে-গতরে লেটে যাই।

বিয়ে-শাদি করব কিনা, জানি না। টু আরলি টু টেল। তবে ব্যবসা করব। মেয়েদের ব্যবসাই করব। আসুন বাসাটা ঘুরে দেখাই। দাসিরা বাসা দেখান। পরিপাটি। দামি ফার্নিচারে সজ্জিত রুমগুলো। দামি পেইন্ট দেয়ালের সৌন্দর্য বাড়াচ্ছে। আর বাতির রুচির প্রশংসাই করতে হয়। একেক রুমে একেক ডিজাইনের পর্দা। এটা মাস্টার বেড। এটা স্টাডি রুম। এটা গেস্ট রুম। ওটা আরেকটা গেস্ট রুম। নিজেই রান্নাবান্না করি। কাজের একটা লোক আসে সপ্তাহে দুদিন। ফিজিক্যাল ট্রেইনার আসে তিন দিন এটা ফিজিও রুম দরকার না হলে বাসাতেই থাকি। সেফফে বইয়ের বাহার দেখে আমরা হতবাক! বলেন, আপনারা বই লিখলে একটা কপি চাই কিন্তু!

অবশ্যই।

আপনার সাক্ষাতে যা বলা হয়েছে আমরা সবই পড়তে দেব। আপনার মন্তব্য দরকার। পাঁচ বেড রুমের বিশাল ফ্লাট।

‘আসেন, আমার অবসর সময়ের রুমটায় যাই।’ রুমের দরজা নেই। ভেতরে মেহগনি কাঠের একটা তৈরী কট’। যেটা সচরাচর বাংলাদেশে দেখা যায় না। একটা ডিজাইন, প্লাসিকের ও ডেলভেট হেলান। দামি সব খেলনার সমারোহ।

এলোমেলো। মনে হচ্ছে বাচ্চাটা খেলা শেষ করে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে দিয়েছে। একটা লাল বালিশে পুতুল ঘুমাচ্ছে। দাসিরা হাত ইশারায় চুপ থাকতে বলেন। আলতো করে একটা চাদর গায়ে দিলেন পুতুলের। দেয়ালে মাটির বোর্ড বসানো।

এলোমেলো সব আঁকিবুঁকি। ছুরি নয়, লেখা নয়। একদম দু-আড়াই বছরের বাচ্চারা যেমন এলামেলো পেন্সিল চালায়।

মুহূর্তেই দাসিরা বদলে গেলেন যেন। এই দাসিরাকে আমরা দেখিনি দুই দিনের সাক্ষাতে। এ যেন দাসিরা নয়, অন্য কেউ। বাচ্চা একটা মেয়ে। হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে খেলনা দিয়ে নাড়াচাড়া করলেন। বোর্ডের লেখাগুলো মুছলেন। আবার কীসব আঁকলেন। পেন্সিল এমনভাবে রেখে এলেন, যা তার সাথে একদম যায় না।

তিনি সম্পূর্ণ পরিপার্টি; গোছানো। ব্যবহারে চলায়, কথার, আসবাবপত্রে। আলতো করে রুম থেকে বেরিয়ে আসি। তিনি থেকে যান আমরা ড্রইংরুমে বসে চিন্তা করছি এই মেয়ের সারাটা জীবন কেমনে যাবে? বাইরে থেকে যাকে কিচ্ছু বোঝা যায় না।

মানছি, তার জীবন পাল্টে দেওয়ার জন্য তার গর্ভপাতই দায়ী। কিন্তু এই দুদিনের দীর্ঘ আলাপচারিতায় একবার আমরা বুঝতে পারিনি, বারো সন্তানের প্রতি রাখা আছে এতটাই মমতা! ‘মায়ের জাত! মা তো মা-ই’ আমাদেরই একজন বলেন।

দাসিরা আসেন। চোখ-মুখ বিষণ্ন। তবু হাসি টেনে বের করার চেষ্টা করেন। বলেন, আর কিছু বলবেন? আমরা বলি, না।

তাহলে খেতে যাই চলুন। খাবার মেন্যু সবজি আর ডাল। দুপুদের সবজি। তিন পদের ডাল। সাধারণের মাঝে অসাধারণ। দাসিরা বলেন, তিনি পুরো ‘ভেজ’। পরকালে যদি তার মেয়ের সাথে দেখা হয়; তখন মাছ-মাংস খাবেন।

ড্রইংরুমে বসে চা খাচ্ছি। লেবু চা। তিনি দুধ চা রুটি কিছুই খান না। বাসাতেও রাখেন না। বলেন— ‘আপনাদের একটা সংবাদ দেওয়া হয়নি। গতসপ্তাহে আমার পুরাতন সিমটা একটা জরুরি কাজে ওপেন করলাম। দেখি, ডাক্তার আপুটার মেসেজ। ‘মেইল সি’ আর জেন্টলি’। মেইল করে নম্বর নিয়ে দেখা করলাম। তিনি ডাক্তার নন। ডাক্তার কেবল হাসপাতালের। তিনি আমার দাদার বউ। শুধু বললেন, চিন্তা করিস না সব ঠিক হবে। তোর দাদা আসছেন আগামী ডিসেম্বরে, এবং তিনি তোর বাসাতেই উঠবেন। আমিও অবশ্যই। আমরা হতবিহ্বল। দাসিরার মুখ উজ্জ্বল। দাসিরার কথাবার্তা বুঝতেই পারছি না। তিনি আমাদের হতভম্ব ভাব দেখে শুধরে দেন। বৌদি বলেন, আমাকে তোকে যে প্রথমদিন বলেছিলাম তোরা তো আমাকে ‘মালু’ ডাকিস, সেটা বাবার গালি। অর গালি তো নয়; ওটা আশীর্বাদ। নইলে হাজার ডাক্তার থাকতে আমার কাছে আসতি কেন? আর তোর বাচ্চা আমাকে নষ্ট করতে হয়েছিল কারণ তোর শারীরিক কিছু সমস্যা আছে; তোর দাদাসহ আমরা বসে সব আলোচনা করব।

আমরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকি। দাসিরা হাসেন। এ হাসি আত্মতৃপ্তির। এ হাসি আত্মতুষ্টির। এ হাসি নিজেকে আবার খুঁজে পাওয়ার, নিজের মাঝে। দুঃখ তো দুঃখই। আর এ দুঃখের স্বায়রী হয়ে দাসিরার একটা তৃপ্তি হবেই পরে। তার হাসিই বলে দিচ্ছে।

‘দাসিরা বড় হবেন। মা হবেন। দাসিরার বাড়ি পুতুল নয় মানব শিশুর কিচিরমিচিরে মুখরিত হবে। করুণাময়ের করুণা নিঃশেষ হওয়ার নয়।’

দাসিরার জন্য আমরা একটা শুভেচ্ছা কার্ডে লিখে দিলাম বাক্যগুলো।

রায়না

আমার পালিত যন্ত্রণার খাঁচা

[রায়নার বয়স ৩৮। এক ছেলে এক মেয়ে স্বামী নিয়ে সংসার। রায়না গাজীহরের মেয়ে। ঢাকাতে বড় হয়ে ওঠা। ভার্সিটি অন্য শহরে। কোনো জব করেননি। এমনকি একদিনের জন্যও কোথাও জব করেননি। ভীষণ অন্তর্মুখী রায়নার সাথে আমাদের দেখা হয় তার গাজীহরের বাড়িতে।

রায়নাদের বাড়িতে তাদের পরিবারের সবাই থাকেন। স্বামী ছাড়াও অন্যান্য সদস্য। এটা যৌথ পরিবার। ব্যবসায়ী স্বামীর সাথে রায়নার বিয়ে হয় দশ বছর। রায়নাদের বাড়িতে গেলে তার স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসান্তে স্বামী চলে যান। আমরা রায়নার সাথে কথা বলি। রায়নার শাশুড়িই মূলত বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন।]

আমার বড় বোন একটি ভার্সিটিতে পড়াতেন। আমাকে স্নেহও করতেন অনেক। বড়ভাই ইসলাম কায়েমের জন্য গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ান। পারিবারিক সিদ্ধান্ত বাবা-মা আর বোন মিলেই নিয়ে থাকেন। এমনকি আমার ভাইয়ের ছেলে কোন স্কুলে যাবে ভাই তার খোঁজ রাখেন না। সামান্য পরিবারের চাইতে দাওয়াতি কাজে তিনি বেশি মনোযোগী। ইন্টারের পর আমাকে ভর্তি হতে হলো সেই ভার্সিটিতেই যেখানে আপু পড়ায়। এমনই শনির দশা, পেয়ে গেলাম আপু যে সাবজেক্টের, সেই বিভাগে।

একদম মালির ঘাড়েই পড়লাম।

এ বছরের মাথায় আপু চলে যায় জার্মানিতে; এমএস করবে বলে। আমি হলে উঠলাম। মাঝে মাঝে দুলাভাই আসতেন। কোনো সমস্যা হলে জানাতে বলতেন যা সাধারণ ভদ্রতার মাঝেই পড়ে। কখনোবা বাইরে কোনো হোটেলে নিয়ে খাওয়াতেন। এও নিছক ভদ্রতা, তাই না! কখনো তার বাসায় ভালো কিছু রান্না হলে খেতে বলতেন। এও নিছক সামাজিকতা বা ভদ্রতা। আপুও প্রায়ই ফোনে কথা বলতেন।

ভদ্রতার মাঝেই সীমিত ছিল সম্পর্কের দেয়াল। আমার সর্বনাশ একদনি দুলাভাই বলেন যেন একটু সাহায্য করি; তিনি তার কিছু কলিগকে দাওয়াত দিতেন। বুয়া দুজন আসবে। আমি যেন বুয়াদেরকে ভালো করে দেখিয়ে দিই রান্নাবান্না কী হবে, কীভাবে হবে। এবং সেটাও ভদ্রতার মাঝেই পড়ে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে মেহমান সকল চলে যান। বুয়ারা ও বাসনকোসন ধুয়ে চলে যান। রাত প্রায় এগারোটা। ক্যাম্পাসের শেষ বাসটাও চলে গেছে শহর ছেড়ে রাত দশটায়। শহর থেকে ভারোই দূরে ক্যাম্পাসও একা রিকশায় করে যাব; ভয় হচ্ছিল। আবার এত রাতে হলে ফিরলে বান্ধবী জানতে চাইবে কোথায় ছিলাম; কেন, কার সাথে ইত্যাদি।

দুলাভাই বলেন থেকে যাও। তোমার জন্য তো আর এত রাতে এই ঠাণ্ডায় বাইরে যাওয়া ব্যাপার নয়। আর এখানে তো তোমার আপুরই বাসা। আমিও ভাবলাম কী দরকার, তাছাড়া আলাদা একটা শোবার ঘর তো আছেই। ভেতর থেকে দরজা আটকালে বাইরে নিয়ে কেউ খোলতে পারবে না। তাছাড়া দুলাভাই তো সেরকম মানুষও নন। মনে মনে চিন্তা করলাম আমি কী খারাপ, কী সব খারাপ চিন্তা করছি!

রাতে সব গুছিয়ে আমি শোবার ঘরে বসে টিভি দেখছিলাম; একটু হলেও টেনশন হচ্ছিল যেন। দরজা আটকাইনি, ভেড়ানো লাইট জ্বালানোই ছিল— কী রে, কী করছিস?

তিনি বিছানায় পা তুলেই বসলেন। বুঝতেই পারছি, দীর্ঘ গন্ধের প্রস্তুত।

বসার আগে নিছক ভদ্রতাবশেই তিনি দরজা লাগিয়ে দিলেন— ‘ভাবলাম তোমার সাথে অনেকদিন ভালো-মন্দ কথা হয় না।’

এই গল্প, সেই গল্প, তার আর গল্প শেষ হচ্ছে না। রাত দুটো বাজে। আমার ঘুম চোখের পাতা খুলতে পারছি না। ‘এত তাড়াতাড়ি ঘুমোবি নাকি?’ আমার কাঁধে হাত রাখলেন। এবং সে হাত দ্রুতই নিচের দিকে নামতে থাকে।

আবার জীবনে কোনো সেক্সুয়াল অভিজ্ঞতা হয়নি। কোনো ছেলেকে কিস করিনি। আমি শিহরিত হয়ে উঠে। আচমকা সারা শরীর যেন কেমন করে উঠে। এবং পরপর দুর্বার হলো।

সকালে ঘুম ভাঙল অনেক বেলা করে। শুক্রবার। ছুটির দিন। দুপুরে আমরা রাতের বাড়তি খাবারগুলোই খেলাম। সন্ধ্যায় একটু বেরোলাম। দুলাভাই বলেন, আজও থেকে যা। কালকেও ক্যাম্পাস বন্ধ। তাছাড়া ব্রেক চলছে। সত্যিই, বলছি, আমার মনও সায় দিল। থেকে গেলাম।

পর্দা তো খুলেই গিয়েছে গত রাতে। এবার শুধু নান্দনিক নৃত্য। পরদিন সকালে ভয় পেয়ে গেলাম। কেউ জানার ভয়। করসেপশন-এর ভয়। তাছাড়া ওটা ছিল একদমই খোলা। কোনো ডাক্তার দেখিয়ে ছিল নিয়ে নিত চিন্তা করে রাখলাম। আবার তার সাথে যে করসেপশন নিয়ে আলোচনা করব; তাও পারছিলাম না বিকেলে তিনি আমাকে হল পর্যন্ত পৌঁছে দেন। রিকশায় বসে তাকে বললাম যদি কনসিভ করে ফেলি সে বলে, সত্যি যদি শুনতে চাও, তোমার আপুকে ডিভোর্স দিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে কোনোই আপত্তি নেই। আমার দিলে চমক ওঠে— ‘এসব কী বলছেন, আপনি?’

‘আমি তো আগেই বললাম যদি সত্যি কথাটা শুনতে চাও।’

‘এটাই আপনার সত্যি?’

‘গত দু’দিন পর্যন্ত।’

নির্বিকার উত্তর। আমি বলি, ‘ওটা কোনোদিনই ভদ্রতার নয়। আপু আমাকে অনেক স্নেহ করে। তাছাড়া এটা মানবিক দিক থেকেও অসম্ভব। এবং আপনি রাজি থাকেন বা আছেন সেটা পরের বিষয়। আমি একদম রাজি নই।’

‘তাই একটি কর। এটা তো অনেক ক্লিনিকের অন্যতম কাজ।’

‘আমার বাচ্চার কী হবে।’

‘ওটা তো বাচ্চা নয়; কেবল ডাক্তার মেয়েদের মেনসকে রেগুলার করে দেয়। তাছাড়া এটা কোনো অপারেশনও নয়।’

মনে মনে ভাবি, আমার সর্বনাশ যা হওয়ার হয়েই গেছে। এবার তা সামাল দেওয়ার পালা। বাকি পথ আর কোনো কথা বলতেই ইচ্ছা করেনি। মানুষটা সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষিত পুরুষ, আর এসব কি অমানুষের মতো কথা বলছে!

হলে আসামাত্র তো বান্ধবীরা জড়িয়ে ধরে— কোথায় ছিলি, কার কাছে, কার সাথে?

বলি, এক আত্মীয়ের গায়ে হলুদ ছিল। থেকে গেলাম। আমি বুঝতে পারি, আমার জবাব তাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আমাদের রুমে চারজন। এর মাঝে একটি মেয়ে আমার খুব ঘনিষ্ঠ। রাতে তাকে গল্প করতে করতে সে বলে, সবাই তোর দুলাভাইকে অর তোকে নিয়ে কথা বলে। একটু সামলে চলা উচিত কিনা?

আমি তো সামলেই আছি।

তা আছিস। কিন্তু ধর উনার সাথে রেস্টুরেন্টে না গেলে ক! হয়; কিংবা ধর এই আজকে যেমন তোকে দিয়ে গেলা এই সব আর কি। মনে কর, মেয়েরা তো আর তোর সামনে কথা বলবে না; পেছনে যারা বলে তা আমরা শুনি।

মিতা, আমার কথা শেষ হয়নি। লোকেদের কথাও শেষ হয়নি। আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে…।

আমি সহজে কাঁদতে পারি না; বরং স্টিক হয়ে যাই। লতা আমার হাত জোরে চেপে ধরে। এ হাত ভরসার আর স্বস্তির। আমাকে বলে, তোর পায়ে পড়ি; তুই আর যাসনে। এই লোকটাকে মানা যাবে না। তুই পারবিও না। টোটালি এড়িয়ে চল। যদি হলে ডাকতে আসে, খবর দিস রুমে নাই। দেখা হলে বলিস, ব্যস্ত আছি। অথবা যদি ডিপার্টমেন্টে আসে, নরমালি কথা বলবি। কিংবা তার অফিসে যেতে চাইলে যাবি। অফিসে গেলে খেয়াল রাখিস অফটাইমে না।

—আমাকে সাহায্য কর। তুই আমার ধর্মের বোন।

—তুই আর মুখ খুলবি না, আমার হাতে ছেড়ে দে। যদি মেনস না হয়; সাথে সাথে আমায় জানাস। ডেট কবে?

—সতেরো তারিখ।

—পাঁচদিন বাকি আছে। অবশ্য সাইকেলটা আমিও ভালো জানি না। তবে আবারও বললাম; বেড়ে উঠে।

লতা আমার মাথা তার কাছে রাখে। আমার বড় ভরসা হয়।

অনেক রাতে আমরা ছাদ থেকে নেমে আসি। এমনিতেই আমি খুব কথা বলি না বা কারও সাথে মিশি না। লতাসহ আরেকটা বন্ধু আছে; যারা আমার অবসর সাথী আমার অবসর মানে হলো কবিতার বই। জানলার বাইরে দিগন্তজোড়া ধানখেত। আমি তাকিয়ে থাকি, ধানগাছগুলো গর্ভবতী। আমিও যদি হয়ে যাই! অন্তত ভরসা লতা সামলাবে। পরদিন আপুর ফোন। জার্মানি থেকে।

—তুই নাকি আমাদের বাসায় ছিলি?

—হ্যাঁ, কেন?

—না। এমনিতে বললাম।

—কেন আপু, কোনো সমস্যা হয়েছে?

—না। তোর দুলাভাই অস্বীকার করল; আবার তুই স্বীকার করলি। এ জন্য ভাবছি। তার অস্বীকারের কারণ কি। সে কি তোকে বলেছে আমাকে না করার জন্য?

—না কোনো কথাই হয়নি। তোমাকে বলেনি, হয়তো মজা করতে চাইছে। অথবা বললে তুমি কী না কী মনে কর এই জন্য।

—রায়না, তোকে আমার মেয়ের মতো দেখি, এটা কি তুই জানিস?

—জানি, আপু।

—এমন কিছু যেন না শুনি, যা আমাদের দুই পরিবারকে পোড়াবে।

—আপু, তুমি অহেতুক টেনশন নিচ্ছ।

—টেনশনটা যেন অহেতুকই হয়।

লতার সাথে আপুর কথাও বলি। লতা বলে ওটা নিয়ে তোর চিন্তার দরকার নেই। তারা স্বামী-স্ত্রী, তাদের বিষয়ে তোর মাথা না ঘামালেও চলবে।

ক্লাস নেই। লতারও ক্লাস নেই। সে আর আমি হলের পশের টিলার কিনারে বসি। গল্প বলি। দিনের বেলায় লতা তার লাভারের সাথেই বাইরে থাকে। দিনে আমি একাই থাকি। মেনসের জন্য অপেক্ষা। একটা বাবু হলে খারাপ হতো না। কিন্তু দাঁড়াব কীভাবে সমাজে এই বাবুকে নিয়ে। এবং আমার আপন বোনের স্বামী। মনে হয় কোথাও চলে যাই। সেখানে আমি মেয়ে নই। সটোল বক্ষের আর স্তনের।

পুরুষেরা মূক নয়; বুকের দিকেই প্রথমে তাকায়; আমি চলে যেতে চাই; সেখানে মানুষের মানুষের মতো দেখা যায়। যেখানে মেয়েরা হাবলু, কললু দলাইমলাই দ্বারা রেপড হবে না বাইরে। সেখানে ধর্ষিত হবে না দুলাভাই দ্বারা। সুনীলের ‘না পাঠানো চিঠি’টা আমার মুখস্থ। কয়েকটা লাইন ঘুরে-ফিরে মাথায় আসছে— ‘মাঠ পেরিয়ে, কলা পেরিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে আরও দূরে, আরও দূরে, সেদিকে দু চোখ যার এমন জায়গা নিশ্চয়ই কোথাও আছে কোথাও না কোথাও আছে যেখানে মানুষরা সবাই মানুষের মতন আঁচড়ে দেয় না, কামড়ে দেয় না, গায়ে ছাঙ্গা দেয় না, লাথি মারে না, যেখানে একটা মেয়ে, শুধু মেয়ে নয়, মানুষের মত বাঁচতে পারে।’

জীবনবোধই আমার বদলে যাচ্ছে। নিজের চেহারা দেখে নিজেই বিস্মিত হই। শান্ত সুবোধ বলে বরাবরই ছিলাম পরিচিত। সেই শান্ত বালিকাটি কী রকম যেন বন্য হয়ে গেলাম। কী হয়েছিল আমার সেই রাতে। আমি তো মাতাল ছিলাম না। উন্মাদ ছিলাম না। সততার সাথেই স্বীকার করছি, আমি তো প্রবল কোনো প্রতিরোধ করিনি। শীতের রাতে ক্ষণিকের অনিয়মের মহাউল্লাসে আমি এ কোন ধ্বংসলীলায় মেতেছিলাম। আমি কি মানুষ দিন যাচ্ছিল না; রাত কাটছিল না।

লতার সাথে কথা বললে আরাম পাই; আত্মবিশ্বাসও পাই। কিন্তু সেই আবার চলে যাই দুশ্চিন্তার দূর তোপান্তরে। যেখানে আমি একা। আমার চারদিকে জনমানব নেই সেখানে কোনো নিয়ম নেই। নিয়ম হবে আমি যা করে যাব তাই। আবার বাচ্চাটাকে দিয়েই শুরু হবে সামাজিক নিয়মের শুভ চর্চা। নর্মস আর ভেল্যুস-এর গোড়াপত্তন।

এর মাঝে আপুর সাথে ভালোমন্দ কথা হয়। দুলাভাই বলে, বাসায় এসো।

আমি বলি, ব্যস্ত আছি। একটা বান্ধবীর এসাইনমেন্ট করে দিচ্ছি।

‘কোনটা?’

‘আমাদের ডিপার্টমেন্টের নয়; বাইরের।’

‘কবে শেষ হবে? বৃহস্পতিবারে চলে এসো। শুক্রবার থেকে শনিবার আসবে।’

তার প্রস্তাবে বলি, ‘দেখা যাক।’

বৃহস্পতিবারে সন্ধ্যায় সে হলে আসে। আমাকে কল পাঠায়। শিক্ষক হিসেবে সে নিচতলার সিটি রুমে আসতে পারে; কিন্তু, সেটা আসলে ছাত্রীদের আড্ডাখানা। সে বিব্রত হতে পারে ভেবে কল পাঠায় গেট থেকে। লতা রান্নাঘরে ছিল। ডেকে নিয়ে আসি। লতা বলে, খবরদার নিচে নামবি না। আমি যাচ্ছি।

—স্যার, স্লামালিকুম। রায়নার তো শরীর খুব খারাপ। সকালে মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার বলছেন ওর ইনসমনিয়া হচ্ছে এবং ওর ঘুম দরকার। এখন ঘুমাচ্ছে। ডাকতে পারব না।

—ও আচ্ছা।

—কোনো মেসেজ থাকলে বলতে পারেন।

—না, এমনিতেই এদিক যাচ্ছিলাম; ভাবলাম দেখা করে যাই।

লতা উপরে গিয়ে আমার বলে, যদি তার মুখটা দেখতি। প্রচণ্ড মন খারাপ করে যাচ্ছে। তুই কোনোদিন তার বাসায় যাবি না। যদি একটা কেলেঙ্কারি হয়; তোর লাইফ, তোর আপুর সংসার, ক্যারিয়ার সবই যাবে। তুই শক্ত থাক। ভাবিস না সব আজেবাজে।

বৃহস্পতিবার ষোলো তারিখ। মেনসের একদিন বাকি। রাতে লতা এলে জিফল ট্যাবলেট দেয়। গত কয়েকদিন ঘরেই সে দিচ্ছে। আমরা রাতের খেয়ে লতা আর আমি ছাদে যাই। শীতের রাত। জবুথবু হয়ে বসে আছি।

—যদি তোর মেনস না হয়; তাহলে, আমি একটা গাছের শিকড় এনে রেখেছি; সেটা কাল থেকে কোমরে বাঁধবি। অপশন নম্বর ওয়ান। অপশন নম্বর টু হলো কালকের দিন রেখে পরশু আমরা ডাক্তারের কাছে যাব। আমি দেখতে যেহেতু বড়সড়, আমি হয়ে যাব বড় বোন। আর তোর স্বামী থাকে বাইরে। দেশে এসেছিল, চলে গেছে গত দু’দিন আগে। অপশন তিন হলো, তাতেও যদি না হয় সোজা মেরিস্টপে। এছাড়া কোনো গন্তব্য নেই। মোল্লার দৌড় মসজিদ, আর আমাদের দৌড় মেরিস্টপস। আপাতত এই প্লান থাকুক।

—বাচ্চাটা রাখলে কী হবে?

—কিছুই হবে না। তোর বেবি তুই রাখবি; এখানে সমস্যা কীসের। কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কিছু ফলাফল হতে পারে; যা তোকে চিন্তা করা জরুরি। এবং এই পরিস্থিতিতে।

—কোন পরিস্থিতি?

—যখন এক পাশে তুই; অন্যপাশে তোর দুলাভাই, আর মাঝখানে তোর আপুর। তার ক্যারিয়ার। তার সংসার। এখানেই শেষ না। তোর সারাজীবন যাবে কীভাবে! একদিকে তুই এখন মাত্র সেকেন্ড ইয়ারে। মানে ইন্টার পাস। অন্যদিকে, তোর আপু পরিবারের অন্যতম মানুষ, যিনি সিদ্ধান্ত দেন সকল বিষয়ে। তোর বাচ্চা তোর অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলবে; একই সাথে, তোরা কি আর এই ক্যাম্পাসে থাকতে পারবি? ছোট্ট একটা ক্যাম্পাস; সবাই সবাইকে চেনে তুই, তোর আপু, তোর দুলাভাই একই ডিপার্টমেন্টে। সুতরাং, বাচ্চা রাখা কোনো সমস্যা নয়। বরং তোর অন্তত বাড়তি একটা চাপ থাকবে না যে আরও দুটো পরিবারকে শেষ করে দিবি, সেটা কোন হিসাবে থাকবে।

—আমি তো এতটা চিন্তা করিনি।

—তোর পক্ষে এখন স্বাধীনভাবে চিন্তা করা সম্ভব নয়। তুই এখন টেনসড। তুই ট্রমাটাইজড। এবং একটু হলেও স্থ্যিমাটাইজড। এবং শেষ কথা হলো, তোর পড়াশোনার কী হবে। তুই কি মনে করিস, দুলাভাইয়ের বাচ্চা তোর শরীরে এলে তুই স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারবি এই ক্যাম্পাসে? সেটা কি আদৌ সম্ভব? নাকি তোর বোন পারবেন? মানলাম তিনি এখন দেশ নেই; কিন্তু আসবেন তো, নাকি? চল ঘুমাই। কালকে তোকে শিকড়টা দিচ্ছি। পরশু ডাক্তার। যেভাবে বলছি সেভাবেই আগাব। প্রসিড বাই প্লানও মেথড।

রাতে আছি ছটফট করি। সকালে লতার ডাকে ঘুম ভাঙে। একটা কাগজের পুটলি আমার হাতে দিয়ে সে বেরিয়ে যায়। বলে, ‘বিকেলে দেখা হবে। আর প্রচুর পানি খা। মনে মনে আল্লাহকে ডাকি।

নফল নামাজ পড়তে শুরু করি। যদি মেনস না হয়, কী যে কেলেঙ্কারিতে পড়ে যাব! ভাবতেই আমার মনে হয় হার্টবিট থেকে যাচ্ছে। আমার সতীত্ব নিয়ে আমার না বলা এক অহংকার ছিল!

+ posts

Read Previous

অনুপ্রাণন লেখক সম্মেলন-২০২৩ অনুষ্ঠিত

Read Next

নুশান : দ্যা স্পেশাল চাইল্ড— তৃতীয় পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *