অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রবিউল ইসলাম -
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম : নজরুল গবেষক ও শিক্ষাসাধক

কোনো একক পরিচয়ের বন্ধনে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে বাঁধা যায় না। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নজরুল গবেষক। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক ও অধ্যাপক। বাংলাদেশে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে গবেষণার একক কৃতিত্বের দাবিদার তিনিই। রফিকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক। তিনি ছিলেন নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। এই গুণী শিক্ষাবিদ তাঁর অসাধারণ কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেছেন স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার। রফিকুল ইসলাম ১৯৫৮ সাল থেকে আমৃত্যু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন ও নজরুল গবেষণাকর্মে নিয়োজিত থেকেছেন। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে। তিনি ছিলেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে এর আগেও বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কিন্তু অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের নামটি যখন উচ্চারিত হয়, তখন সে দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত হয় একাগ্রতা, আন্তরিকতা, বিনয় ও মেধার অপূর্ব স্পর্শ। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন, সফলকাম হয়েছেন সেখানেই। তাঁকে কোনো কাজ দিলে তিনি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তা সম্পাদন করে থাকেন। তাঁর লেখনীর মৌলিক ভিত্তিভূমি হলো স্বকীয়তা ও মননশীলতা। বিশেষ করে নজরুল ইসলামকে তিনি বাঙালি পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন ভিন্নমাত্রার একজন কবি ও মানুষ হিসেবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্মভিত্তিক নানা মূল্যায়ন রফিকুল ইসলামকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। ভাষা বিষয়েও তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল উল্লেখ করার মতো। তাঁর ভাষাতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থগুলো বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।

ছাত্রজীবন থেকেই রফিকুল ইসলাম জড়িত ছিলেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। লেখালেখি ছাড়াও তিনি যুক্ত ছিলেন নাট্যাভিনয়, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা এবং আবৃত্তি চর্চার সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। রফিকুল ইসলামের পৈতৃক নিবাস চাঁদপুর জেলার মতলব থানার কলাকান্দা গ্রামে হলেও তিনি কখনো গ্রামে বাস করেননি। রফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায়। পিতার চাকরি ও নিজের লেখাপড়ার সূত্রে রফিকুল ইসলামের শৈশব ও কৈশোর কাটে ঢাকায়। ১৯৫০ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাসের পর তিনি ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স ডিগ্রি লাভের পর তিনি ১৯৫৭ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি মনোযোগ দেন গবেষণার কাজে। এ সময়ে বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাই। তাঁর অনুপ্রেরণায় রফিকুল ইসলাম ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণায় অনুরাগী হয়ে ওঠেন। তিনি আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে ভাষাতত্ত্বে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের তত্ত্বাবধানে তিনি পিএইচ.ডি ডিগ্রির জন্য নজরুল গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, ১৯৬৯ সালে তাঁর গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের অকাল মৃত্যুতে গবেষণাকর্মে ছন্দপতন ঘটে। কিন্তু রফিকুল ইসলাম দমে যাবার পাত্র নন। একাডেমিক গবেষণা বন্ধ হলেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে রফিকুল ইসলাম তাঁর গবেষণাকাজ চালিয়ে যান। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় একের পর এক গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৬৯ সালে বাংলা একাডেমি থেকে ‘নজরুল-নির্দেশিকা’ নামে একটি আকর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। নজরুল জীবন ও কর্মবিষয়ে রফিকুল ইসলাম রচিত অনেক মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে নজরুল বিষয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ রচয়িতার তালিকায় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের নাম সবার উপরে রয়েছে। নজরুল রচনাবলির কালানুক্রমিক তালিকা প্রস্তুত ও নজরুল জীবনীর কালানুক্রমিক ঘটনাপ্রবাহের বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনা প্রথম তাঁরই হাতে ঘটে। স্বাধীনতার পর তিনি মনোযোগী হন একাডেমিক গবেষণায়। ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নজরুলের ওপর তিনিই প্রথম পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জনের গৌরব লাভ করেন।

কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তার কবরস্থানের স্থান নির্ধারণ বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম কাজী নজরুল ইসলাম রচিত, ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই।’ গানের উদ্ধৃতি টেনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর কবর দেবার প্রস্তাব করেন। তাঁর এ প্রস্তাব সকলেই সমর্থন করেন এবং নজরুলের ইচ্ছা অনুযায়ী মসজিদ প্রাঙ্গণে তাকে সমাহিত করা হয়। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ছিলেন একজন পরিশ্রমী লেখক এবং নিবিড় মনোযোগী পাঠক। মেকলে সম্বন্ধে বর্ণনা দিতে গিয়ে থেকারে তাঁর এক লেখনীতে উল্লেখ করেছেন: Maclay read twenty books to write a sentence and travelled twenty kilometres to make a line of description.

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সম্বন্ধেও এ কথাটি অনেকাংশে প্রযোজ্য। জ্ঞানের সাধনায় তিনি ছিলেন দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। সুদীর্ঘ গ্রন্থতালিকা লক্ষ করলেই রফিকুল ইসলামের পরিশ্রমী মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ:

নজরুল নির্দেশিকা, ভাষাতত্ত্ব, নজরুল জীবনী, An Introduction to Colloquial Bengali, বীরের এ রক্তস্নাত রাতে মাতার এ অশ্রুধারা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ঢাকার কথা, ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার, কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও কবিতা, কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সাহিত্য, কাজী নজরুল ইসলামের গীতি সাহিত্য, শহীদ মিনার, আবদুল কাদির, ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ, ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধাবলী, আবুল মনসুর আহমেদ রচনাবলী, বাংলা ব্যাকরণ সমীক্ষা, নজরুল প্রসঙ্গে, কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সৃষ্টি, অমর একুশে ও শহীদ মিনার, কিশোর কবি নজরুল, হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর (২০০৩) ইত্যাদি।

তিনি এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে অধ্যাপনা করেন। অলঙ্কৃত করেছেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে তিনি গভীর নিষ্ঠা একাগ্রতার পরিচয় দিয়েছেন। গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তিনি ছিলেন সময়নিষ্ঠ ও দায়িত্ব সচেতন। ইচ্ছে করলে তিনি অনেক লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন কিন্তু তিনি কখনোই পদ-পদবির লালায়িত ছিলেন না। প্রক্টর, ডিন, প্রাধ্যক্ষ কিংবা শিক্ষক নেতা হবার জন্য তিনি কখনোই কোনো প্রার্থী হননি। একজন শিক্ষকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ গবেষণাকর্ম ও পাঠদান। তিনি শিক্ষকতার এ মহান আদর্শ থেকে কখনোই বিচ্যুত হননি।

রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের একজন সনামধন্য লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ। জীবনের সূচনালগ্ন থেকে তিনি সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি প্রভৃতি নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করে এসেছেন। দেশ, কাল, সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিচিত্র প্রসঙ্গ জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর লেখনীতে। সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অসংখ্য বক্তৃতা দিয়েছেন। নিয়মিত কলাম লিখেছেন পত্র-পত্রিকায়। কিন্তু যা কিছুই করেন না কেন, নজরুল ছিল তাঁর হৃদয়নিগূঢ় অনুষঙ্গ। নজরুল চর্চা বা নজরুল সাধনা থেকে তিনি কখনোই বিচ্যুত হননি। রেডিও টেলিভিশনে তিনি নজরুল বিষয়ে নানামাত্রিক আলোচনা করেছেন। গবেষণা ও সম্পাদনার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। বক্তৃতা ও আবৃত্তিশিল্পে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় রফিকুল ইসলাম নিজস্ব প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন। রফিকুল ইসলাম তাঁর অমূল্য কীর্তি দিয়ে বাংলা ভাষা ও বাঙালিকে করে গেছেন চিরঋণী। বহুগুণের অনন্য অধিকারী এ মানুষটি আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তিনি অমর থাকবেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে।

রবিউল ইসলাম
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা
সরকারি শাহ এয়তেবারিয়া কলেজ, দুপচাঁচিয়া, বগুড়া

Read Previous

হাসান আজিজুল হকের কলম : জীবন খননের হাতিয়ার

Read Next

ভাষাসৈনিক রিজিয়া খাতুন আমাদের অহংকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *